Categories
প্রবন্ধ

আমার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ :: অরূপ কুমার ভট্টাচার্য্য।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালির শৈল্পিক অহঙ্কারের সৌধে অনিবার্যভাবে বিরাজমান। বাংলার সামাজিক উত্থান-পতনের এক যুগ সন্ধিক্ষণে তাঁর জন্ম। ঐতিহ্যবাহী কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সন্তান হিসেবে রবীন্দ্রনাথের শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে জ্ঞানচর্চার এক নির্মল পরিবেশের মধ্যে। মহর্ষি পিতার উপনিষদ চর্চা বালক বয়সেই রবীন্দ্রমানস-গঠনে প্রতিফলন ঘটে এবং সেই শিক্ষাকে তাঁর সমস্ত সত্তায় আত্মস্থ করে নেন। বাল্যকালের সেই উপনিষদিক শিক্ষার আলো সারাজীবন তাঁকে পথ দেখিয়েছে। উপনিষদে যে সত্যের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন সেই সত্যেরই উজ্জ্বল প্রভা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্য সাধনা, মেধা ও শ্রমে নিজেই ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন যা তাঁকে বহুমাত্রিক শিল্পস্রষ্টার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। নিজের বিরাট সৃষ্টিশীল ক্ষমতা তাঁকে এক যুগোত্তীর্ণ মহাপুরুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। বাংলা সাহিত্যে হাতে গোনা যে ক’জন বড় মাপের খ্যাতিসম্পন্ন লেখক আছেন তার মধ্যে একজন অন্যতম পুরোধা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবিভক্ত বাংলায় নবজাগরণের মধ্যাহ্নে রবি কিরণের উন্মেষ ঘটেছিল। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সত্য ও সুন্দরের ফলগুধারার মতো বহমান এবং সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে এবং বাংলা সাহিত্যজগতে হিমাদ্রির মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন এক অলৌকিক ঐশ্বর্য নিয়ে। বাঙালির সমৃদ্ধ ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতির বহুলাংশ জুড়েই আছেন ধীমান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাঙালি তাই তার প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি সংশয়ে আশ্রয় নেয় সেই রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ নিজের সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার পরিধি দিয়ে বিস্তৃত করেছেন গোটা বাংলা সাহিত্যের পরিসর। আমরা তাঁকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় অভিষিক্ত করেছি। রবীন্দ্রনাথের সাফল্যের এই ক্রম-উত্তরণ কিন্তু একদিনে ঘটেনি। এক লহমায় তিনি ‘বিশ্বকবি’ বা ‘কবিগুরু’ অভিধায় ভূষিত হননি। সমগ্র রবীন্দ্র জীবন ও সৃষ্টির পিছনে রয়েছে তাঁর সৃষ্টির দীর্ঘ অবিশ্রান্ত পথ চলা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। তাঁর রচনা চির নতুন ও চিরকালের, কারণ তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন বর্তমানের দৃষ্টির সীমানায়। যে দৃষ্টি তৈরি হয়েছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শনের সমন্বিত অন্তর্দৃষ্টি থেকে। তাই তিনি সব সময়ই আজকের রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। জীবনের প্রভাত থেকে অন্তিমলগ্ন তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা; সব্যসাচী লেখক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীত রচয়িতা, সুর স্রষ্টা, গায়ক, সমালোচক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ হিসেবে অনন্য। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে, বিপুল সৃষ্টিসম্ভারে বদলে দিয়েছেন বাঙালির মানসজগত এবং বাংলাকে দিয়েছেন বিশ্ব পরিচিতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান। একে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, জীবন- চেতনায় রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই অপরিহার্য। আমাদের জীবনের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে, মননের সঙ্গে, আন্দোলনে, ভাষার মাধুর্যে, দেশপ্রেমে সৃষ্টিশীল কর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আমাদের প্রাণের টানে, জীবনের টানে, চেতনার টানে, শিল্প ও সাহিত্যের টানে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে শিল্পের আরাধনায়। তাঁর কবিতার ছন্দ, বাণী ও সুর আমাদের হৃদয়ে বুলিয়ে দেয় শান্তির শুভ্র পরশ। অনন্ত অসীমের সেই অসামান্য রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা প্রার্থনায় নতজানু হই, সমর্পিত হই, পরম বিশ্বাসে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণের কবি, প্রেমের কবি, জীবনের কবি, প্রকৃতির কবি, গানের কবি সর্বোপরি মানুষের ভালোবাসার কবি হয়ে চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে অপার্থিব আনন্দলোকে আনন্দের বিস্তৃৃতি ঘটিয়েছেন। তিনি বাঙালি হয়েও চিন্তা-চেতনায় আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তাঁর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা ছড়া, কবিতা কিংবা বড়দের জন্য লেখা কবিতা, গান, গল্প-উপন্যাসে আমরা বাঙালির সহজ সরল জীবনকে তুলে ধরতে দেখি। তাঁর নানা কাব্যগীতিতে আমরা প্রেম সৌন্দর্য, রোমান্টিক ভাবনা, আধ্যাত্মিক কল্পনার চিন্তাধারা পরিলক্ষিত হতে দেখি। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ গল্প উপন্যাস এখনো আমাদের সৃজনশীল মনকে আন্দোলিত করে। আমরা রাবীন্দ্রিক চরিত্রগুলোকে চলচ্চিত্র ও মঞ্চে রাজা ও রানী, বিসর্জন, রক্তকরবী, চিত্রাঙ্গদা, চিরকুমার সভা, বাল্মিকী প্রতিভা, তাসের দেশ, ডাকঘর, রাজা, মুক্তধারা, অচলায়তন, শাপমোচন, শেষের কবিতা, সফল সঞ্চায়ন দেখি; তখন আমরা নিজেরা কিছুটা রাবীন্দ্রিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ আছেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে তাঁর সৃষ্টির উৎসারণে কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, মঞ্চনাটক, টিভি নাটক, নৃত্যনাট্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত এবং বাংলার সমগ্র সংস্কৃতিতে। তিনি তাঁর মানবীয় উচ্চ ভাবনা-চেতনা আর মানুষের চিরায়ত অনুভূতি ভাষার সৌকর্য সাধন আর নিপুণ শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে কাব্য-সঙ্গীত-প্রবন্ধ-গল্পে আর চিত্রকলায় রূপায়িত করে মানুষের চেতনাকে শানিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ব্যাপকতা বিশ্বজুড়ে শিখরস্পর্শী প্রতিভায় উদ্ভাসিত যা বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তায় ছড়িয়েছে রবির আলো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনকে শিল্পবোধ থেকেই অনুভব করেছেন। আর সেজন্য তাঁর শিল্প-সৃষ্টি প্রায়শই জীবনসংলগ্ন। তিনি কাব্য, গল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটককে জীবনের প্রতিভাষে সিঞ্চিত করেছেন। যা রূপালঙ্কার, প্রতীক ও বিমূর্ততার দ্যোতনায় হয়েছে উজ্জ্বল। সব মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। দেড়শ বছর পেরিয়েও কবি আমাদের মাঝে তাই চিরজাগরুক হয়ে আছেন।

সমগ্র বাঙালির মানস জগতে রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন আবেগ, প্রেরণায় জাগ্রত থাকবেন এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির আলোর দিশারি হয়ে আলো ছড়াবেন যুগ থেকে যুগান্তরে। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর স্বপ্ন আর জীবন দর্শন আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে সত্য ও সুন্দরের।

——————————————————————————-

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

বৃন্দাবনের পথে শ্রীজাহ্নবার অদ্ভুত লীলা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীনিত‍্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবাদেবী প্রথম বার যখন বৃন্দাবন গমন করেন সেটা ছিল সম্ভবতঃ ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দের (১৪৮২ শকাব্দ) মাঘ মাস। সহযাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থরচনাকার নিত্যানন্দ দাস, উদ্ধারণ দত্ত প্রমুখ। আর দ্বিতীয়বার ব্রজে পদার্পণ করেন ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে (১৫০৪ শকাব্দ) খেতু্রীর উৎসবের পরে। সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পদকর্তা গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস, ভাস্কর নয়ন মিশ্র, পরমেশ্বর দাস প্রমুখ। দ্বিতীয়বার যাত্রাপথে জাহ্নবা মাতা অনেক অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেন। পথের মধ্যে রাত্রিযাপন কালে এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন যখন, সেসময় স্থানীয় কিছু নিন্দুক গ্রামবাসী লক্ষ্য করেন যে, সঙ্গীরা সকলে এক রমণীর (জাহ্নবাদেবীর) চরণে প্রণত হচ্ছেন। এ ঘটনায় তাঁরা অত্যন্ত আশ্চর্য ও ক্ষুব্ধ হলেন। কারণ চন্ডীদেবীর পরিবর্তে কোন মানুষীর চরণে শরণাগত হয়েছিল সঙ্গীরা সকলে। তাই তাঁরা গ্রাম মধ‍্যস্থ চন্ডীমন্ডপে চন্ডীমাতার কাছে নালিশ করলেন যে, যারা দেবীর পরিবর্তে মানুষের চরণে পতিত হয় তাদের যেন তিনি সংহার করেন অবিলম্বে। শাস্তি বিধান অত্যন্ত প্রয়োজন। এমন বলে যখন তাঁরা নিদ্রায় গেলেন তখন ক্রোধিত দেবী চণ্ডী তাঁদেরকে স্বপ্নাদেশ দিলেন –“জাহ্নবাকে নারীজ্ঞানে অবহেলা করছো তো, তোমাদের মুণ্ডছেদন করবো আমি ! মহিমা না জেনে ধিক্কার করছো তাঁর! মানুষী জ্ঞান করছো! কিন্তু তিনি আমারও প্রণম‍্য। কাল প্রভাতেই অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইবে তাঁর কাছে। না হলে, আমি তোমাদের সংহার করবো।” নিন্দুকেরা সকলে পরদিবস প্রভাতেই মাতার চরণে পড়লেন। দোষ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন। ঈশ্বরী জাহ্নবা সন্তান জ্ঞানে সকলকে কাছে টেনে নিয়ে কৃপা করলেন। প্রত‍্যক্ষদর্শী নিত্যানন্দ দাসের বিবরণ অনুযায়ী এমন আরও এক অলৌকিক লীলা করেন জাহ্নবা ঠাকুরাণী পথে।

কুতুবুদ্দিন নামক এক দস‍্যুদলপতি নিজের সঙ্গীদের নিয়ে রাতে ডাকাতি করতে আসেন যে গৃহে জাহ্নবা মাতা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই গৃহেই। কিন্তু, ডাকাতদল সারারাত ধরে ঘুরেও পথ খুঁজে পেলেন না গৃহে প্রবেশের। গৃহের চারিদিকে বিশালাকার ভয়ংকর সব সর্প ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গৃহের দিকে এগোতেই ছুটে আসছিল সর্পরা দংশন করতে। রাত্রি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু প্রতীক্ষা ব্যর্থ হল। কিছুই করতে পারলেন না তাঁরা। শেষরাত্রে দৈববাণী হল—-“ঠাকুরাণীই তোমাদের জব্দ করলেন।” কুতুবুদ্দীন তাঁর সঙ্গীসাথীসমেত মাতার চরণে শরণ নিয়ে ক্ষমা চাইলেন। জাহ্নবাদেবী নামপ্রেম দিয়ে তাঁদের অযাচিত কৃপা করলেন।
এভাবে, পথে নানা পতিত উদ্ধার লীলা করতে করতে জাহ্নবা মাতা গণসমেত শুভাগমন করলেন মথুরায়। সেখান থেকে ব্রজে। শ্রীজীব গোস্বামী জাহ্নবাদেবী ও তাঁর সঙ্গীদের বাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। ঈশ্বরীর আগমনে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দ যারপরনাই আনন্দিত হলেন। গোপাল ভট্ট, ভূগর্ভ গোস্বামী, লোকনাথ গোস্বামী, মধু পন্ডিত, কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী প্রমুখ মহাজনরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করলেন। জাহ্নবা মাতা যে কতখানি সম্ভ্রম-সম্মান নিজ গুণে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দের থেকে অর্জন করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ দুটি উদাহরণ দেওয়া যায় –(১) ঈশ্বরীর দ্বিতীয়বার বৃন্দাবন আগমনের পূর্বে যখন শ্রীনিবাস আচার্য বৃন্দাবন থেকে গৌড়ে গমন করবেন, তখন শ্রীগোপাল ভট্ট তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তিনি যেন গৌড়ে ফিরে জাহ্নবা মাতাকে বৃদ্ধ গোপাল ভট্টের খেদোক্তির কথা জানান –“ঈশ্বরীর পদযুগ না দেখিনু আর।” (প্রেমবিলাস , ৬ বিলাস)। আসলে অসুস্থ গোপাল ভট্টের বয়স হয়েছিল। তাই তাঁর শঙ্কা ছিল যে জাহ্নবা মাতার চরণ দর্শনের সৌভাগ্য বোধহয় আর এ জীবনে হবে না তাঁর। তাই তিনি অমন বিলাপ করেছিলেন।
(২) যখন প্রথমবার জাহ্নবা মাতা ব্রজে যান তখন রাধাকুণ্ড নিবাসী রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পর্ব ঘটেনি। তাই তিনি দ্বিতীয়বার ব্রজে আসছেন শুনে চলচ্ছক্তিরহিত বৃদ্ধ দাস গোস্বামীজী নিজে প্রেরণ করেন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ ও অন্যান্য বৈষ্ণববৃন্দকে , যাতে তাঁরা ব্রজ থেকে সসম্মানে জাহ্নবা মাতাকে রাধাকুণ্ডে নিয়ে আসেন। জাহ্নবাদেবী কৃপাদর্শন দান করে ধন্য করবেন দাস গোস্বামীজীকে তাহলে।
রন্ধন পটিয়সী দেবী জাহ্নবা বৃন্দাবনে আপন হস্তে ভোগ রন্ধন করে শ্রীগোবিন্দ, গোপীনাথ, মদনমোহন,রাধাদামোদর ও রাধারমণ –এই ছয় বিগ্রহকেই ভোগ নিবেদন করতেন। তারপর সেই প্রসাদামৃত ব্রজবাসীদের বিতরণ করে দিতেন। সকলেই সে সুস্বাদু প্রসাদ আস্বাদন করে ধন্য হতেন, তৃপ্ত হতেন।

ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবার রাতুল চরণে অধমা রাধাবিনোদিনীর ভক্তিপূর্ণ প্রাণের প্রণতি নিবেদিত হল ।

সমাপ্ত

Share This
Categories
প্রবন্ধ

অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য : ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী, মৃত্যু দিবস স্মরণে।

ভূমিকা—

 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘাট্লে দেখা যাবে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন আমাদের দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য। কিন্তু এখনো অনেকেই জানে না অনেকের নাম। কত শহীদ এর আত্মত্যাগের ঘটনা রয়ে গেছে অন্তরালে।  এখন আমরা জানব  ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য  সম্পর্কে কিছু কথা।

 

বিপ্লবী জীবন—-

 

এবার আমরা জানব অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য’র বিপ্লব জীবনের কর্মকান্ড নিয়ে কিথা। আমরা সকলেই জানি  আলিপুর বোমা মামলার সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা।

কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে একটি বোমা তৈরির স্থান ছিলো। সেই মুরারিপুকুরের ঘটনায় আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯০৯ সনের মে মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে দণ্ডাদেশ হ্রাস পাওয়ায় ১৯১৫ সনের মে মাসে মুক্তি পান। ১৯২০ সনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন ও নারায়ণ পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। এছাড়াও বিজলী, আত্মশক্তি ও ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার সংগেও যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ হচ্ছে রণসজ্জায় জার্মানি, স্বরাজসাধনা, মুক্তিসাধনা, জার্মানি প্রবাসীপত্র, ইউরোপে ভারতীয় বিপ্লবের সাধনা প্রভৃতি।

 

আলিপুর বোমা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিগণ—

৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ মুজাফফরপুর, বিহারে রাত সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যা করেন ক্ষুদিরাম বসু। সেই ঘটনার পর আলিপুর বোমা মামলা শুরু হয়। ১৯০৯ সালের ৬ মে আলিপুর বোমা মামলার রায় দেয়া হয়। রায়ে বিচারক বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তকে মৃত্যুদণ্ড দেন। উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, বিভূতিভূষণ সরকার, বীরেন্দ্র সেন, সুধীর ঘোষ, ইন্দ্রনাথ নন্দী, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায়ের, দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। পরেশ মৌলিক, শিশির ঘোষ, নিরাপদ রায় ১০ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড, অশোক নন্দী, বালকৃষ্ণ হরিকোণে, শিশির কুমার সেন ৭ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড এবংকৃষ্ণ জীবন সান্যাল ১ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত হন। আপিলে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয় এবং তার বদলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান এবং অনেকের সাজা হ্রাস করা হয়।

 

স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ—–

 

কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে একটি বোমা তৈরির স্থান ছিলো। সেই মুরারিপুকুরের ঘটনায় আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯০৯ সনের মে মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে দণ্ডাদেশ হ্রাস পাওয়ায় ১৯১৫ সনের মে মাসে মুক্তি পান। ১৯২০ সনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন ও নারায়ণ পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।

 

রচিত গ্রন্থ—-

 

এছাড়াও বিজলী, আত্মশক্তি ও ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার সংগেও যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ হচ্ছে রণসজ্জায় জার্মানি, স্বরাজসাধনা, মুক্তিসাধনা, জার্মানি প্রবাসীপত্র, ইউরোপে ভারতীয় বিপ্লবের সাধনা প্রভৃতি।

 

মৃত্যু—-

 

১০ মে, ১৯৬২ সালে মহান এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রয়াণ ঘটে।

 

।।তথ্য ঋণ: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

ব্রতচারী নিয়ে দুটি কথা : দিলীপ রায়।

আজ ১০ই মে, ব্রতচারী দিবস ৷ ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্তের জন্মদিনকে স্মরণে-সম্মানে আজকের দিনটি ব্রতচারী দিবস হিসাবে পালিত হয় বা হচ্ছে । ব্রত শব্দের অর্থ তপস্যা ও সংযমের সংকল্প । বিশেষ ব্রত নিয়ে যারা চলে , তারাই ব্রতচারী । তাই ব্রতচারীদের ব্রত পালন করার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে — সত্যনিষ্ঠা, সংযম, অধ্যবসায় ও আত্মনির্ভরতা । মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্রতচারীদেরকে – জ্ঞান , শ্রম , সত্য , ঐক্য ও আনন্দের সাথে জীবনযাপন । বাঙালির দৈহিক-মানসিক গঠন এবং নৈতিক বোধ উন্নয়নের ভাবনা থেকে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত প্রাসঙ্গিক নৃত্য-গীত অবলম্বন করে গুরুসদয় দত্ত ১৯৩২ সালে ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন । ব্রতচারী আন্দোলন হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উন্নয়নের আন্দোলন । আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয়চেতনা ও নাগরিকত্ববোধ । গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারণের শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হবার শিক্ষা ।
এবার আমরা গুরুসদয় দত্ত সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করি । ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত ১৮৮২ সালের ১০ মে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । গুরুসদয় দত্ত সাত বছরে পিতৃহারা, চোদ্দ বছরে মাতৃহারা হয়ে জেঠুর কাছে মানুষ হন । বালক বয়স থেকে গুরুসদয় দত্ত ছিলেন দুরন্ত , নির্ভীক আর একই সঙ্গে হৃদয়বান । ছোট বেলা থেকেই তিনি সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । প্রয়োজনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বন্যাত্রাণে, অগ্নি নির্বাপনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন । গ্রামের মাইনর স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু । তারপর সিলেট শহরের ইংরাজি মাধ্যম স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন এবং মেধানুসারে তিনি অসম প্রদেশে প্রথম স্থান অধিকার করেন । কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করে তিনি বিলেত যান । ১৯০৪ সালে তিনি আই.সি.এস. পাশ করেন এবং মেধা তালিকার সপ্তম স্থান অধিকার করেন । তিনি ছিলেন সরকারি কর্মচারি । জেলাশাসক, কালেক্টর, কৃষি ও শিল্প বিভাগের সচিব হিসাবে কাজ করেছেন । সরোজ নলিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় । ১৯৪০ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন ।
১৯৩২ সালে তিনি ব্রতচারী প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৩৪ সালে ব্রতচারী সমিতি এবং ১৯৪১ সালে কলকাতার জোকায় ব্রতচারী গ্রাম স্থাপন করেন । ব্রতচারী আন্দোলনে কেউ সামিল হতে চাইলে তিনটি উক্তি স্বীকার করে নিতে হতঃ-
১। আমি বাংলাকে ভালবাসি
২। আমি বাংলার সেবা করব
৩। আমি বাংলার ব্রতচারী
গুরুসদয় দত্ত সারাজীবন লোকশিল্প আর সংস্কৃতির সন্ধানে প্রবৃত্ত ছিলেন । তিনি রায়বেঁশে (রায়বেঁশে হচ্ছে পুরুষদের দ্বারা লোকযুদ্ধ নৃত্যের একটি ঘরানা), কাঠি, ধামাল, ঝুমুর, ব্রত, ঢালিনৃত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন । ব্রতচারীদের মধ্যে তিনি “প্রবর্তক জী” নামে খ্যাত ছিলেন । ব্রতচারীদের অভিবাদন-ভঙ্গি, মাতৃভাষা প্রীতি, স্বাস্থ্যজ্ঞান, সত্যনিষ্ঠা, সংযম, প্রফুল্লভাব, অধ্যবসায়, আত্মনির্ভরতা খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে । রবীন্দ্রনাথ সহ তৎকালীন সময়ের বহু বিখ্যাত ব্যক্তি গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন । তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যেগুলো বর্তমানে দুর্লভ । গ্রাম পুনর্গঠন , সমবায় প্রথায় চাষ, লোকশিল্প সংগ্রহ, ম্যাগাজিন প্রকাশ সহ তিনি নানান কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন । লোকসাহিত্য গবেষক, লেখক, স্বদেশপ্রেমী গুরুসদয় দত্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪১ সালের ২৫ জুন পরলোক গমন করেন । এখনও তাঁর লোক ঐতিহ্যের সন্ধান বাঙালি জাতিকে আত্ম-আবিষ্কারের পথে চালিত করে । তাঁর জন্মদিনে শতকোটি প্রণাম । (তথ্যসূত্র: সংগৃহীত)
——০——–

Share This
Categories
প্রবন্ধ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩-তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

বাংলা সাহিত্য জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি আমাদের সকলের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য, “ভাবগভীরতা, চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক, সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা ।“ তাঁর লেখা অসাধারণ সব কবিতা ও গান, আজও প্রত্যেকটা বাঙালীর মন কাঁড়ে । তিনি শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ কবি বা গল্পকারই ছিলেন না, সেইসাথে ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিকও । রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক । ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল । কথা সাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন । সমাজ কল্যাণের উপায় হিসাবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন এবং পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরূদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় মনুষ্য সেবার কথাই বলা হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে মানুষ ঈশ্বরের পুজার কথা বলেছিলেন । সঙ্গীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন । রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি । তিনি দুই হাজারের উপর গান রচনা করেছেন । তাঁর রচিত “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে” — ভারতে এবং “আমার সোনার বাংলা” — বাংলাদেশে জাতীয় সঙ্গীত ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৭ই মে ১৮৬১ সালে ( ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ ) পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে অবস্থিত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে | তাঁর বাবার নাম ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি কিনা ছিলেন তদানীন্তনকালের ব্রাহ্মসমাজের একজন ধর্মগুরু এবং তাঁর মায়ের নাম সারদাসুন্দরী দেবী । অনেকেই জেনে অবাক হবেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাবা মায়ের ১৪তম সন্তান । বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা গ্রহণ করেননি । গৃহ শিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । মাত্র আট বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু । ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তাঁর “অভিলাষ” কবিতাটি প্রকাশ পায় । এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ।

১৮৭৮ সালে মাত্র সতের বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান । ১৮৮৩ সালে ৯ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় বেণীমাধব রায়চৌধুরী নামে ঠাকুরবাড়ির এক অধস্তন কর্মচারীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে । বিয়ের সময় ভবতারিণীর পুণরায় নামকরণ করা হয় এবং তাঁর নাম পাল্টে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী । ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন । ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মাচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন । সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন । ১৯০২ সালে তাঁর পত্নী বিয়োগ হয় । ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন । ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে “নাইট” উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৯১৫ সালে জালিনওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন । ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় । দীর্ঘজীবন তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন ।

অবশেষে দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট , জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০ বছর ।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী ও কেলে কুকুরের আশ্চর্য কাহিনী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শান্তিপুরের গোঁসাইজী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর গৃহমন্দিরে এক পোষ্য  সারমেয় (কুকুর) থাকত। নাম তার কেলে। কেলে ছিল অন্যান্য কুকুরদের থেকে একদম আলাদা। কোনদিনও সে আমিষ আহার গ্রহণ করেনি। বা , কারোর উচ্ছিষ্টেও (এঁটো খাবার) মুখ দেয়নি। সে সবসময় প্রসাদ গ্রহণ করতো। আর প্রতিদিন শান্তিপুরের শ্যামসুন্দর মন্দিরকে প্রদক্ষিণ করতো। মন্দিরে কীর্তন চলাকালীন এক মনে দূর থেকে বসে তা শুনতো । সেসময় মাঝেমধ্যেই তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। কাউকে কামড়ানো-হাঁচড়ানো, বলাবাহুল্য তা তো জীবনে করেনি সে। বিজয়কৃষ্ণ তাই বলতেন প্রায়ই ,”ওরে কেলেকে তোরা আর পাঁচটা কুকুরের মত ভাবিস না। ও কোন সাধারণ কুকুর নয় । ও বিশেষ কার্যসাধন করতে পৃথিবীতে এসেছে।” তাঁর কথা শুনে অনেকে ভাবতো—-কি এমন কাজ করবে কেলে ?  কবে আসবে সেদিন, যেদিন চোখের সামনে এমন কিছু দেখতে পাবো ?

১২৯৫ বঙ্গাব্দের অর্থাৎ ১৮৮৮ সালের ২৬শে ফাল্গুন শুক্রবার, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী তাঁর পুত্র এবং কন্যা উভয়ের বিবাহ দিলেন একসাথে। ঢাকার গেন্ডারিয়ার আশ্রমে বেশ সমারোহের সাথেই পুত্র যোগজীবনের নামে সাথে পাত্রী বসন্তকুমারীর আর জগদ্বন্ধু মৈত্রের সাথে কন্যা শান্তিসুধার শুভ পরিণয়   সুসম্পন্ন হল । এই বিবাহপ্রদানের কিছুদিন পরই গোস্বামীজি শান্তিপুরে  চলে আসেন আর বেশ কিছুকাল বাস করেন এখানে ।সেসময় একদিন স্থির করলেন নগর সংকীর্তন করতে করতে সকলে মিলে বাবলায় যাবেন।

বাবলা অর্থাৎ সেই স্থান যেখানে গৌর-আনা ঠাকুর সীতাপতি শ্রীঅদ্বৈত সাধনা করতেন।  এই বাবলাতেই তিনি গঙ্গাজল তুলসীপত্র হাতে নিয়ে অশ্রুসজল নয়নে সুরধনীর আবক্ষ বারিতে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের আরাধনা করে তাঁকে মর্ত্যে অবতীর্ণ হতে প্রার্থনা জানাতেন। দীর্ঘ ১২ বছর এমন আকুতি ভরা অনুনয় করার পর অবশেষে নবদ্বীপে শ্রীজগন্নাথ মিশ্রের পত্নী শ্রীশচীদেবীর  গর্ভসিন্ধুতে শ্রীহরিরূপ চন্দ্র  উদিত হয়েছিলেন শ্রীগৌরাঙ্গ রূপে। এখন অবশ্য আর গঙ্গা দেখা যায় না। শুধু খাতটাই রয়ে গেছে। কিন্তু সেসময় পতিতপাবনী  গঙ্গা শান্তিপুরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিতা ছিল। তখন গঙ্গার স্রোত সুরধনী নাম নিয়ে  এই বাবলা পুণ্যভূমির  ধার ঘেষে বহমানা ছিল। বর্তমানে সেই সুরধনী প্রায় মৃতপ্রায় দশায় । উল্লেখ্য, বৈষ্ণব ইতিহাস তথা শান্তিপুরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িত এই ১৪কি.মি. দীর্ঘ সুরধনী নদীকে বাঁচাতে , তাকে স্বাভাবিক স্রোতস্বিনী ছন্দে ফিরিয়ে আনতে উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সংস্কারের দাবিতে শান্তিপুরের পরিবেশ ভাবনা মঞ্চ দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে সম্প্রতি।

শান্তিপুর শহরের ৩.২ কিলোমিটার উত্তরে বাবলার অবস্থান । এখন এই স্থান আদি শান্তিপুর নামে পরিচিত হলেও অদ্বৈত প্রভুর আমলে শান্তিপুরেরই অন্তর্গত ছিল । এই স্থান অতীতে বাবলা বৃক্ষে পরিপূর্ণ থাকায় নাম হয়েছে বাবলা। বাবলার উত্তরে পঞ্চবটী । পঞ্চবটীর কাছে ছিল দোলমঞ্চ । যেখানে অদ্বৈত প্রভুর দোল হতো। এখন দোল উৎসব শ্রীমন্দিরেই হয় , যা সপ্তম দোল নামে পরিচিত।  সপ্তম দোলকে উপলক্ষ্য  করে বহু ভক্ত সমাগম হয় প্রতি বৎসর । মহোৎসবও হয় সেদিন।

এই বাবলাতেই অদ্বৈতের দীক্ষালাভ হয়েছিল শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদের কাছে। আবার এখানেই অদ্বৈত দীক্ষা প্রদান করেছিলেন নামাচার্য শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে।   এখানেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাসের পূর্বে শ্রীনিত্যানন্দের সাথে আসতেন অদ্বৈত গৃহে। মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর বৃন্দাবন যাবেন বলে তিনদিন ধরে রাঢ়দেশে ঘোরার পর যখন তাঁকে  নিত্যানন্দ ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন শান্তিপুরে  , তখন এই বাবলাতেই এনেছিলেন।  এখানেই শচীমাতা সহ নবদ্বীপবাসীরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় গোরাচাঁদকে দেখতে হাজির হয়েছিলেন। তখন তো গৌরাঙ্গ নবীন সন্ন্যাসী,  নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী। এখানে অদ্বৈত প্রভুর গৃহে সেসময় দশদিন মহাপ্রভু ছিলেন। পরবর্তীতে ১৫১৪-১৫ সালে অবশ্য আবারও বেশ কিছুদিন ছিলেন তিনি । এখানেই  লীলা সাঙ্গ করেন আচার্য অদ্বৈত । বাবলা তাই শ্রীঅদ্বৈতের শ্রীপাট। একে অদ্বৈতপাটও বলা হয়।

শ্রীপাটের মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজিত রয়েছেন  আচার্যের দারুময় বিগ্রহ । স্বয়ং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী বলেছিলেন—–এই বিগ্রহের শ্রীবদনপানে চেয়ে নয়নে নয়ন স্থির রেখে একমনে নিজের দীক্ষামন্ত্র জপ করলে বিগ্রহে অদ্বৈতের উপস্থিতির অনুভূতি লাভ করবে , দর্শনও পাবে। অনেক ভক্তসুজন সেই সৌভাগ্য লাভ করেছেনও।

ফিরে আসি সেদিনের সংকীর্তনের কথায় । সালটা ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ । চৌদ্দ মাদল নিয়ে মহানন্দে মনপাগল, প্রাণহরণ করা কীর্তন করতে করতে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী ভক্তগণ সমেত এসে উপস্থিত হলেন বাবলায় । গৃহপালিত সারমেয় কেলেও  সংকীর্তন দলের অনুগামী হল । সেও যে ভক্ত । ভক্ত না হলে এমন ভক্তের ন্যায় আচরণ করবেই বা কেন ! যাহোক,  যখন গঙ্গার খাত পেরোনোর সময় হল তখন সহযাত্রীদের অনেকের নজরে পড়ল একটা কুকুরও তাদের সাথে খাত পার হবার চেষ্টা করছে। তারা তাকে তাড়াবার চেষ্টা করতে থাকলো।কেলে ‘কুঁই কুঁই’ করতে করতে গোস্বামী প্রভুর চরণে পরলো। ভাবখানা এমন যে, আমাকেও তুমি ভবনদী পার করাও । যেতে অনুমতি দাও তোমাদের সাথে । আমিও যে উদ্ধার হতে চাই ।

গোস্বামীজী সকলকে উদ্দেশ করে বললেন, “তোমরা ওকে তাড়িও না গো। ওকে যেতে দাও । চলুক আমাদের সঙ্গেই ।”

প্রভুর আজ্ঞা পেয়ে সকলে  বললেন, “চল ,চল তোকে গোঁসাইজী কৃপা করেছেন । তুইও আমাদের সাথে তবে চল।আর কেউ কিছু বলবে না তোকে।” ভক্তেরা হাসলেন আনন্দে কুকুরের এমন কান্ড দেখে।  হরিনাম যে মানব ,জীবজন্তু ,বৃক্ষ-লতা, গুল্ম সকলকে মত্ত করে দেয়—-এ ঘটনা যেন তারই প্রমাণ।

সংকীর্তন দল অচিরেই শ্রীঅদ্বৈত শ্রীপাটে প্রবেশ করলো।  কেলে দাঁড়িয়ে রইলো অদূরে এক কোণে । মন্দিরে কীর্তনের তালে তালে ভক্তেরা আনন্দে ভাবাবেশে নৃত্য করছেন । এমন সময় একটা দিব্য ঘটনা ঘটলো। অপর কোন কীর্তনের দল বুঝিবা মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসছে। সে কীর্তনের সুরের অদ্ভুত সুরেলা প্রাণছোঁয়া আবেশ।  তাই অনেক ভক্তই মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে পথে অপেক্ষা করতে লাগলেন সেই কীর্তন দলের জন্য। কেউ কেউ আবার আরও একটু এগিয়ে গেলেন কীর্তন দলের আগমনের আশায়। তাঁরাও তাতে যোগ দিতে চান। তাই প্রবল উৎসাহী। অথচ সকলেই অবাক হলেন এই ঘটনায় যে, সুরের ঝংকার , মৃদঙ্গ-করতালের ঝনঝনি শ্রবণ করা গেলেও কেউ কোথাও নেই।  এক সময় তাঁরা মন্দিরে আবার ফেরত এলেন হতাশ হয়ে ।বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি। তিনি মন্দিরেই বসেছিলেন। ভক্তদের ফিরে আসা দেখে হাসলেন আর বললেন, “ওগো , এ কীর্তন যে মহাপ্রভু , নিত্যানন্দ, আচার্যপ্রভু আর তাঁদের পার্ষদদের    করা কীর্তন। মহাপ্রভুর নিত্যলীলার অংশ এ ।” বাবলা শ্রীপাটে পাঁচ শতাধিক পূর্বে ঘটা মহাপ্রভুর লীলা যে নিত্য ! কোন কোন ভাগ্যবান তা দর্শন করতে পারেন । সেই নিত্যলীলার কীর্তনের সুরই সেদিন অনুরণিত হয়েছিল বাবলা শ্রীপাটের নির্জন , ছায়াঘেরা, সুশীতল , মনোরম পরিবেশে।

ওদিকে কেলে সারমেয় সবটাই নিরীক্ষণ করছে মনোযোগ  দিয়ে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এক একটা দৃশ্যের সে প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বিজয়কৃষ্ণ তাকে আদর করে নাম দিয়েছিলেন ‘ভক্তরাজ’। ভক্তরাজ এসব মন দিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎই উঠে চলে গেল মন্দিরের কিছু দূরের পঞ্চবটীর কাছে একটি স্থানে।
আর সেখানে তার পা দিয়ে জোরে জোরে মাটি হাঁচরাতে লাগলো। তারপরই ছুটে গিয়ে গোস্বামী প্রভুর বহির্বাস দাঁতে ধরে টানতে থাকলো। সকলে , “হাই হাই” করে উঠলো।  গোস্বামী প্রভু ভ্রূ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলেন হঠাৎ ভক্তরাজ কেলে এমন আচরণ করছে কেন !  তিনি বললেন, “কি হয়েছে , কি হয়েছে ?” কাপড় আর ছাড়ে না ভক্তরাজ ।  টানছে সমানে।  যেন বোঝাতে চাইছে তার সাথে যেতে। ‌   গোস্বামী প্রভু বলে উঠলেন, “আচ্ছা চল , চল ! কি হয়েছে ?কোথায় নিয়ে যাবি ? নিয়ে চল।  কেলে তখন কাপড় ছেড়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চলতে থাকল , চোখের ভাষায় ডাকতে থাকলো মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোস্বামী প্রভুকে । তার পশ্চাতে পশ্চাতে গোস্বামীজী গেলেন।  ভক্তরাও অনুসরণ করলেন তাঁদের প্রিয় গোঁসাইজীকে।

পঞ্চবটীর কাছে পূর্বের স্থানে এলো ভক্তরাজ। এসেই মাটি হাঁচড়ে-হাঁচড়ে কিছু বোঝাতে চাইলো । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ভাবলেন তাহলে কী মাটির তলায় কিছু আছে , যা ভক্তরাজ দেখাতে চাইছে।  তিনি আদেশের সুরে বললেন, “এই এখানে মাটি খুঁড়ে দেখতো, কিছু আছে কিনা ! এমনটা কেন করছে ভক্তরাজ!  বোঝা যাচ্ছে না , নাহলে ।” এক-দু’জন মাটি খুঁড়লেন । কিন্তু কই, কিছুই তো নেই সেখানে। বৃথাই কুকুরটা কাওতালি করল কতক্ষণ ধরে ! — সকলে ভাবলেন। প্রভুজী কেলেকে উদ্দেশ করে বললেন, “কী রে?  কই রে? কী দেখলি তুই ?  কিছুই তো নেই এখানে।” গোস্বামীজী কেলের দিকে চাইতেই কেলে সতৃষ্ণ ব্যাকুল নয়নে কিছু যেন বোঝাতে চাইল। ছটফট করতে করতে আবার সেই স্থানে গিয়ে মাটি হাঁচড়াতে থাকল। বিজয়কৃষ্ণ চিন্তা করলেন, “এমন তো করে না কখনো শান্তশিষ্ট কুকুরখানা ! আজ এমন চঞ্চল হয়ে উঠল কেন?”

তিনি বলে উঠলেন , “এই আবার আর একবার মাটি তোলো তো তোমরা । আরো গভীর করে মাটি ওঠাও।” অগত্যা আবার মাটি খোঁড়া হতে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোদাল যেন কোন ধাতব পদার্থের গায়ে লাগলো। “হ্যাঁ প্রভু। কিছু একটা আছে মাটির তলায়।” মাটি খোঁড়া হতে থাকলো । অচিরেই একটা পিতলের হাড়ি প্রকাশ হলো।  পিতলের হাড়িটি বার করা হলো মৃত্তিকার তলদেশ থেকে ।
কী আছে তাতে? যা ছিল তা বড় দুর্লভ সম্পদ  । শুধু দুর্লভ নয় , সুদুর্লভ —– শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর নামাঙ্কিত একজোড়া কাষ্ঠ পাদুকা , একটা কমন্ডুল আর হস্তলিখিত পুঁথি শ্রীঅদ্বৈতের , যা একটা বাক্সের মধ্যে ভরা ছিল।  সকলের চোখ কপালে উঠলো এহেন ঘটনায়। ভাষাহীন প্রত্যেকে।  তখন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী পাদুকাটি নিজের মাথায় বসিয়ে নৃত্য শুরু করলেন। ভক্তেরা আনন্দে মাতোয়ারা আজকের এই শুভ দিবসে এমন দিব্যবস্তু লাভ করার জন্য।

ভাবের ঘোরে প্রভু বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী সংজ্ঞা হারালেন । ভক্তদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জ্ঞান ফিরে আসলো তাঁর । দেখা গেল কেলেও অচৈতন্য দশায় মাটিতে পড়ে আছে। গোস্বামীজী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নাম শোনাতে থাকলেন। এ সময় জ্ঞান ফেরত আসলো কেলের । গোস্বামীজী তাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেন ।খানিক আদর করার পর বললেন, “ভক্তরাজ ! এবার তোমার কার্য শেষ হয়েছে।  যে জন্য তুমি এসেছিলে তা সাঙ্গ হল । এবার তুমি গঙ্গালাভ  করতে পারো।”

অনেক রাত পর্যন্ত সংকীর্তন চললো। বাবলা ছেড়ে ভক্তেরা ফেরৎ গেলেন তারপর একসময়।

পরদিন অতি অদ্ভুত ভাবে দেখা গেল গঙ্গায় হাঁটুজলের মধ্যে কেলের মৃতদেহ পড়ে আছে। যেখানে কিনা সাঁতার জানতে পারে বলে কুকুরদের সুনাম, সেখানে গঙ্গার এই সামান্য জলে কেলে যে কী ভাবে মারা পড়লো, তা এক প্রশ্ন ! কী অদ্ভুত! গোস্বামীজী নিজের হাতে গঙ্গাতীরে পলি খনন করে সমাধিস্ত করলেন ভক্তরাজ কেলেকে। সে তার দায়িত্ব পূরণ করে চলে গেল স্বেচ্ছায়।

নিশ্চয় মনে প্রশ্ন জাগছে , যে বস্তুগুলো পাওয়া গেল সেগুলোর কি হলো?  সেসবের অধিকার নিয়ে গোস্বামী পরিবারের লোকেদের মধ্যে কলহ শুরু হলো। আর তাই  শেষমেশ গোস্বামীপ্রভু  বাবলায় অদ্বৈত বিগ্রহের তলায় সমাধিস্ত করে দিলেন সেসব। তবে থেকে সেই ঐতিহ্যপূর্ণ দ্রব্যগুলি লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেল।

সমাপ্ত

Share This
Categories
প্রবন্ধ

আজ ৮ এপ্রিল, ইতিহাসের আজকের এই দিনে যা ঘটেছিল।

আজ ৮ এপ্রিল। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বছরের প্রতিটি দিনে ঘটেছে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আসুন আজকের দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় একনজরে দেখে নিই।  ইতিহাসের আজকের এই দিনে কী কী ঘটেছিল, কে কে জন্ম নিয়েছিলেন ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন——-

 

দিবস—-

 

(ক) বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস (বাংলাদেশ)

 

আজ যাদের জন্মদিন—-

১৯০৪ – নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইংরেজ অর্থনীতিবিদ জন হিক্স।

১৯১১ – নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আমেরিকান রসায়নবিদ মেলভিন কেলভিন।

১৯২৯ – বেলজিয়ান গায়ক, গীতিকার ও অভিনেতা জ্যাকুয়েস বরেল।

১৯৩৪ – জাপানি স্থপতি কিশোর কুরোকাওয়া।

১৯৩৮ – কফি আনান, ঘানার কূটনীতিবিদ এবং জাতিসংঘের সপ্তম মহাসচিব।

১৯৪২- কাজী আরেফ আহমেদ, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ।

১৯৫১ – আইসল্যান্ড অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ ২৩ তম প্রধানমন্ত্রী গেইর হারডে হার্ডে।

১৯৬৩ – সাবেক ইংল্যান্ড ক্রিকেটার অ্যালেক জেমস স্টুয়ার্ট।

১৯৬৩ – ইংরেজ গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা ও ফটোগ্রাফার জুলিয়ান লেনন।

১৯৬৬ – আমেরিকান অভিনেত্রী, পরিচালক ও প্রযোজক রবিন রাইট।

১৯৬৮ – আমেরিকান অভিনেত্রী ও পরিচালক প্যাট্রিসিয়া আরকুয়েটে।

১৯৭১ – শোয়াইব জিবরান, বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক ও শিক্ষাতত্ত্ববিদ।

১৯৮৩ – ভারতীয় তামিল অভিনেতা ও গায়ক আল্লু অর্জুন।

১৯৮৬ – রাশিয়ান ফুটবলার ইগর আকিনফেভ।

১৯৮৭ – ডাচ ফুটবলার রয়স্টন ড্রেন্টে।

১৮৫৯ – অস্ট্রীয় গণিতবিদ ও দার্শনিক এডমন্ড হুসার্ল।

১৮৭৮ – সি এম মার্থন, দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান।

১৮৯২ – (ক) হেম চন্দ্র রায়চৌধুরী, ভারতীয় বাঙালি ইতিহাসবিদ।

(খ) ম্যারি পিকফোর্ড, কানাডীয়-মার্কিন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও প্রযোজক।

১৬০৫ – স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপ।

 

ইতিহাসের পাতায় আজকের দিনের ঘটনাবলী—-

২০০২ – ১৯৭২ সালের পর আবার ঢাকায় ‘বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য বৈঠক’ অনুষ্ঠিত হয়।

১৯০২ – কলকাতায় মূক ও বধির বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯০৮ – হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ‘হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯১৩ – চীনে প্রথম পার্লামেন্ট চালু হয়।

১৯৪৬ – লীগ অব নেশন্সের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৫০ – ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘লিয়াকত-নেহরু’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৫৯ – পৃথিবী থেকে পাঠানো রাডার সিগনাল সূর্যের সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।

১৯৬২ – পারস্য উপসাগরে ব্রিটিশ জাহাজে বোমা বিস্ফোরণ হলে প্রায় ২৩৬ জন নিহত হয়।

১৯৬২ – ভারতীয় ব্যাটসম্যান উমরিগড় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৭২ রান করেন।

১৯৭০ – ইসরাইলের যুদ্ধ বিমান কায়রো থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে বাহরুল বাকের স্কুলে হামলা চালালে পাঠরত ৪৬টি শিশু নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করে। উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের প্রথম তিনমাসে ইহুদীবাদী ইসরাইল উত্তর পূর্ব সিরিয়ার বেসামরিক জনবসতির উপর বিমান হামলা চালায়। সে বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইসরাইলীরা একটি কারখানায় বোমা বর্ষণ করলে কর্মরত ১৬৮ জন শ্রমিক হতাহত হয়। তাছাড়া তারা ঐ একই সালের ৩১ মার্চ মিশরের উত্তর পূর্বাঞ্চলে হামলা চালালে ১২ জন বেসামরিক মানুষ নিহত ও আরো ৩৫ জন আহত হয়।

১৯৭১ – ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য ৯টি শরণার্থী শিবির খোলা হয়।

১৯৭২ – বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রথম স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী গঠন করা হয়।

১৯৮০ – প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ বাকের সাদর এবং তার বোন বিনতুল হুদা ইরাকের বাথ সরকারের হাতে শহীদ হন।

১৯৯৪ – অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হোসেকাওয়া পদত্যাগ করেন।

১৮৫৭ – সিপাহী বিদ্রোহের সৈনিক মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসি দেয়া হয়।

১৮৬৬ – ইতালি ও প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একাত্মতা ঘোষণা করে।

১৮৯৮ – সুদানের আতবারা নদীর কাছে যুদ্ধে বৃটিশ সেনাপতি হোরেশিও কিচেনার বিজয়ী হন।

১৭৫৯ – ব্রিটিশ বাহিনী ভারতের মাদ্রাজ দখল করে।

১৫১৩ – জুয়ান দ্য লেওন ফ্লোরিডা (যুক্তরাষ্ট্রের দ্বীপ) আবিষ্কার করেন।

৭১১ – আবুল আব্বাস আবদুল্লাহ বিন মোহাম্মাদ যিনি সাফহ নামে বিশেষভাবে পরিচিত তিনি আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে প্রথম খেলাফাতের মসনদে বসেন। উল্লেখ্য আব্বাসীয়রা আবু মোসলেম খোরাসানি এবং তার সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় সর্বশেষ উমাইয়া শাসক দ্বিতীয় মারোয়ানকে হত্যা করে উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তবে বনি আব্বাসীয়রাও উমাইয়াদের মতো বছরের পর বছর ধরে সেখানকার জনগণের উপর জানমালের উপর অত্যাতার চালায় এবং ৬৫৬ হিজরী পর্যন্ত তারা শাসন ক্ষমতায় ছিলেন।

০৭১৪ – আবুল আব্বাস আবদুল্লাহ বিন মোহাম্মাদ যিনি সাফহ নামে বিশেষভাবে পরিচিত তিনি আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে প্রথম খেলাফাতের মসনদে বসেন।

 

এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন যারা—-

২০০০ – আমেরিকান অভিনেত্রী ক্লেয়ার ট্রেভর।

২০১৩ – ইংরেজ আইনজীবী রাজনীতিবিদ ও যুক্তরাজ্য প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার।

১৯৩১ – নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সুইডিশ কবি এরিক আক্সেল কারলফেল্ডট।

১৯৩৬ – নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অস্ট্রিয়ান চিকিৎসক রবার্ট বারানি।

১৯৫০ – হেমচন্দ্র কানুনগো, বাঙালি, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী।

১৯৭১ – বাংলাদেশের রাঙ্গামাটিতে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ শহীদ হন।

১৯৭৩ – পাবলো পিকাসো, স্পেনীয় চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর।

১৯৭৬ – খ্যাতনামা বাঙালি ফুটবলার গোষ্ঠ পাল (দৈনিক ইংলিশম্যান তাকে চীনের প্রাচীর উপাধি দিয়েছিল)।

১৯৮০ – প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ বাকের সাদর এবং তার বোন বিনতুল হুদা ইরাকের বাথ সরকারের হাতে শহীদ হন।

১৯৮১ – বাঙালি পতঙ্গবিশারদ ও উদ্ভিদবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।

১৯৮৪ – নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রাশিয়ান পদার্থবিদ পিয়োতর লিওনিদোভিচ কাপিৎসা।

১৯৯২ – নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সুইস ফার্মাকোলজিস্ট ড্যানিয়েল বভেট।

১৯৯৩ – ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যান গ্রিফিথ।

১৯৯৪ – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, জাতীয় ব্যক্তিত্ব এম এম মোহাইমিন।

১৯৯৬ – মরিস অলম, বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার।

১৮৩৫ – ভিলহেল্ম ফন হুম্বোল্ট, জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী।

১৮৫৭ – সিপাহি বিদ্রোহের অগ্রণী সৈনিক মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসি হয়।

১৮৬১ – নিরাপদ লিফ্‌টের মার্কিন উদ্ভাবক এলিশা গ্রেভ্‌স্ ওটিস।

১৮৯৪ – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাঙালি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

১৭৫৭ – বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁ।

১১৪৩ – বাইজান্টাইন সম্রাট জন দ্বিতীয় কম্নেনস।

১০৩০ – দিগ্বিজয়ী সুলতান মাহমুদ গজনবী।

০২১৭ – রোমান সম্রাট কারাকালা।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য : ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী।

ভূমিকা—

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘাট্লে দেখা যাবে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন আমাদের দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য। কিন্তু এখনো অনেকেই জানে না অনেকের নাম। কত শহীদ এর আত্মত্যাগের ঘটনা রয়ে গেছে অন্তরালে।  এখন আমরা জানব  ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য  সম্পর্কে কিছু কথা।

বিপ্লবী জীবন—-

এবার আমরা জানব অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য’র বিপ্লব জীবনের কর্মকান্ড নিয়ে কিথা। আমরা সকলেই জানি  আলিপুর বোমা মামলার সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা।

কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে একটি বোমা তৈরির স্থান ছিলো। সেই মুরারিপুকুরের ঘটনায় আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯০৯ সনের মে মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে দণ্ডাদেশ হ্রাস পাওয়ায় ১৯১৫ সনের মে মাসে মুক্তি পান। ১৯২০ সনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন ও নারায়ণ পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। এছাড়াও বিজলী, আত্মশক্তি ও ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার সংগেও যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ হচ্ছে রণসজ্জায় জার্মানি, স্বরাজসাধনা, মুক্তিসাধনা, জার্মানি প্রবাসীপত্র, ইউরোপে ভারতীয় বিপ্লবের সাধনা প্রভৃতি।

আলিপুর বোমা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিগণ—

৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ মুজাফফরপুর, বিহারে রাত সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যা করেন ক্ষুদিরাম বসু। সেই ঘটনার পর আলিপুর বোমা মামলা শুরু হয়। ১৯০৯ সালের ৬ মে আলিপুর বোমা মামলার রায় দেয়া হয়। রায়ে বিচারক বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তকে মৃত্যুদণ্ড দেন। উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, বিভূতিভূষণ সরকার, বীরেন্দ্র সেন, সুধীর ঘোষ, ইন্দ্রনাথ নন্দী, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায়ের, দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। পরেশ মৌলিক, শিশির ঘোষ, নিরাপদ রায় ১০ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড, অশোক নন্দী, বালকৃষ্ণ হরিকোণে, শিশির কুমার সেন ৭ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড এবংকৃষ্ণ জীবন সান্যাল ১ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত হন। আপিলে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয় এবং তার বদলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান এবং অনেকের সাজা হ্রাস করা হয়।

স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ—–

কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে একটি বোমা তৈরির স্থান ছিলো। সেই মুরারিপুকুরের ঘটনায় আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯০৯ সনের মে মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে দণ্ডাদেশ হ্রাস পাওয়ায় ১৯১৫ সনের মে মাসে মুক্তি পান। ১৯২০ সনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন ও নারায়ণ পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।

রচিত গ্রন্থ—-

এছাড়াও বিজলী, আত্মশক্তি ও ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার সংগেও যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ হচ্ছে রণসজ্জায় জার্মানি, স্বরাজসাধনা, মুক্তিসাধনা, জার্মানি প্রবাসীপত্র, ইউরোপে ভারতীয় বিপ্লবের সাধনা প্রভৃতি।

মৃত্যু—-

১০ মে, ১৯৬২ সালে মহান এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রয়াণ ঘটে।

।।তথ্য ঋণ: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

“মিলেট” হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্য-শস্য — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায়।

প্রথমেই আমাদের জানা দরকার “মিলেট” কী ? জোয়ার, বাজরা, রাগি, ইত্যাদি কয়েকটি ক্ষুদ্র দানাশস্যকে একত্রে মিলেট বলে । পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে বেশী মিলেট উৎপন্ন হয় । সাধারণত দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের গরীব অধিবাসীরা খাদ্যশস্য হিসেবে এই ফসলগুলি বেশী ব্যবহার করে । মিলেট শস্য বেশী পরিমানে লক্ষ্য করা যায় মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে ।
এটা ঘটনা — কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রগুলি যেমন দুগ্ধ, পশুপালন, মৎস্য, হাঁস-মুরগি, রেশম চাষ, ইত্যাদি ভারতীয় অর্থনীতির স্তম্ভ ! কৃষি যেমন অর্থনীতির স্তম্ভ তেমনি স্বাস্থ্য হলো সমৃদ্ধ সমাজের এক অপরিহার্য অঙ্গ । স্বাস্থ্য সম্বন্ধে মানুষ কম-বেশী ওয়াকিবহাল । তাই স্বাস্থ্য দেখ-ভালের নিরিখে মিলেট খাদ্য-শস্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রেক্ষাপটে মিলেট দানাশস্যকে বলা চলে অধিক পুষ্টিকর ।
সেই কথা মাথায় রেখে ও মিলেট শস্যের উপকারিতার কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা ২০২৩ সালকে “আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ” হিসেবে ঘোষণা করেছে । সকলের ধারণা, কৃষি ও খাদ্য বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে মিলেট বড় ভূমিকা নিতে পারে । মিলেটের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার অতীতে খুব শোনা যায় । মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর পছন্দ করতেন “লাজিজা” –এক ধরনের মটর মিশ্রিত মিলেটের খিচুড়ি । শোনা যায় এর প্রচলন ছিল গুজরাটে । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে নানান ধরনের মিলেট ভেজানো কিংবা সেদ্ধ করে নেওয়ার পর তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ পাওয়া যায় ।
জীবিকা ও কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এমনকি বিশ্বের খাদ্য ও পুষ্টিগত চাহিদা মেটাতে মিলেট একটি গুরুত্বপূর্ণ দানাশস্য । তাই শস্যটির চাহিদা ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ঘোষিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ, ২০২৩ । যার জন্য ভারত সরকার জোয়ার, বাজরা, রাগি ইত্যাদি শস্যের ফলন বাড়াতে ও স্বাস্থ্যে এদের উপকারিতা বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে । ইতিমধ্যে এই দানাশস্যে পুষ্টির অনুপাত বেশী থাকার জন্য “পুষ্টিকর দানাশস্য” হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । অন্যদিকে সরকারের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক অঙ্গনওয়াড়ি পরিষেবার পরিপুরক পুষ্টি কর্মসূচিতে খাবারের পুষ্টিগত মান বাড়াতে জোয়ার, বাজরার কথা উল্লেখ করেছে । শোনা যায় ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, চন্ডিগড়, ইত্যাদি রাজ্য ও কেন্দ্রিয় শাসিত অঞ্চলে পরিপুরক পুষ্টিতে জোয়ার-বাজরা ঠাঁই পাচ্ছে ।
মিলেট হলো এক ধরনের দানাশস্য যেগুলির বীজ ছোট এবং যেগুলিকে সহজে চাষ করা যায় । এগুলি চাষের জন্য বাইরে থেকে দামী রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি ক্রয় করতে হয় না । মিলেট পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং এগুলি খাদ্য ও জীবিকার নিরাপত্তা বজায় রাখে । মিলেট চাষের দু-রকমের উপযোগিতা রয়েছে । মিলেট চাষ করলে মানুষের জন্য খাদ্যশস্য এবং সেইসঙ্গে গবাদি পশুর জন্য খড়ও পাওয়া যায় । আবার কিছু অঞ্চলে মিলেটই মানুষের প্রধান খাদ্য । মিলেটের ফসল – বৈচিত্র ও চাষব্যবস্থা সেই ফসলগুলির বাস্তুতন্ত্রের কৃষিবৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করে । কেদো মিলেটও অত্যন্ত পুষ্টিকর । এর মধ্যে গ্লুটেন নেই, এটা সহজপাচ্য, সেইসঙ্গে এটি ফাইটোকেমিক্যাল উপাদান, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট এবং ডায়েটারি ফাইবার সমৃদ্ধ । পোলাও, খিচুড়ি, উপমা, পরোটা, দোসা ও চাপাটি তৈরীতে শস্য হিসাবে মিলেট ব্যবহার করা যায় । মিলেট থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য তৈরী করা যায় যেমন মাল্টিগ্রেন পাস্তা, মাল্টিগ্রেন সুইট মিক্স, মাফিন, পুষ্টিকর মিলেট আটা, রাগি ফ্লেক্স, রাগি পাপড়, পাউরুটি, কুকিজ, রাগি স্নাক্স, ফ্লেকড জোয়ার, মিলেটের আটা, ইত্যাদি ।
( ২ )
এবার আসছি মিলেট শস্য মানুষের কী উপকারে আসতে পারে । প্রথমত এটি একটি বিকল্প প্রধান খাদ্য হয়ে উঠতে পারে । মিলেটে কার্বোহাইড্রেট-ফাইবার অনুপাত কম থাকার কারণে, জীবনযাত্রাগত বিভিন্ন রোগের মোকাবিলায় এটা কাজে আসে । মিলেট হলো “পুষ্টির পরিপূরক” যাতে রয়েছে ফাইটোকেমিক্যাল এবং অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্ট, যা সুস্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার চিকিৎসায় বিশেষ কার্যকর । গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্য তথা পুষ্টির উপর মিলেটভিত্তিক খাদ্যের একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে । গর্ভবতী মহিলাদের খাদ্যতালিকায় পরিপূরক খাদ্য হিসাবে মিলেট-ভিত্তিক খাদ্যকে যাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেই দিকে ধ্যান দেওয়া সময়োপযোগী । কারণ গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মায়েদের জন্য মিলেটভিত্তিক পরিপূরক খাদ্যদ্রব্যগুলি খুবই পুষ্টিকর । আমরা জানি, খাদ্য-তালিকায় ফাইবার থাকা বিশেষ প্রয়োজন । এই ফাইবার গ্লোকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । মিলেট, লিউসিনের একটি চমৎকার উৎস, এটা ধীরে ধীরে কার্বোহাড্রেট (এবং খনিজ পদার্থ) হজম করায়, যা পোস্ট-প্রান্ডিয়াল গ্লুকোজের মাত্রার আকস্মিক বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে । ফলে এটি ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য একটি পুষ্টিকর খাবার । চাল ও গমের মতো অধিক পরিচিত খাদ্যশস্যের তুলনায় মিলেটে অধিক পুষ্টিকর খাদ্যগুণ রয়েছে । মিলেট ক্যালশিয়াম, আয়রন এবং ফাইবারে ভরপুর যা একটি শিশুর বেড়ে উঠতে সাহায্য করে । আশার কথা, ছোটদের খাবারে মিলেটের ব্যবহারও ক্রমশ বাড়ছে ।
জোয়ার-বাজরা পুষ্টির এক ভাঁড়ার বলে সুবিদিত । দেশে অপুষ্টিকর সমস্যা ঘোচানোর জন্য ইদানীং জোয়ার-বাজরা খাওয়ার প্রচলনের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে । এটা ঘটনা, আজকালকার মানুষ বেশি স্বাস্থ্য সচেতন । যার জন্য পুষ্টিকর জোয়ার-বাজরার ব্যবহার ক্রমবর্ধমান । এককালে “গরীব মানুষের খাদ্যশস্য” বলে পরিচিত জোয়ার-বাজরার দাম ছিল খুব কম । তা ছাড়া চাল, ডাল, গম উৎপাদনে অধিক গুরুত্ব আরোপ হওয়ায় দানাশস্যের উৎপাদনও কম ছিল । কিন্তু বর্তমানে দানাশস্যের ব্যবহারও ক্রমশ বাড়ছে । চাহিদাও ঊর্ধ্বমুখি । তামিলনাড়ুতে দানাশস্য ব্যবহার করে তৈরী হচ্ছে দোসা, পোঙ্গল, রাভা দোসা, প্রভূতি । সাধারণত চাল থেকে দোসা তৈরী হয় । তবে দানাশস্য চাল ও গমের চেয়ে অধিক পুষ্টিসম্পন্ন । রুটি পরোটার ক্ষেত্রে আটা বা ময়দার বদলে মিলেটের পরোটা অনেক পুষ্টিকর । মিলেটের খাওয়ায় অনেক উপকার । মিলেটে প্রচুর ফাইবার থাকায় এটা ডায়াবিটিকদের জন্য ভীষণ উপকারী । এতে প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিওক্সিডেন্টস রয়েছে । তাই এটাও কিন্তু ক্যানসারের মতো মারণ রোগ প্রতিরোধ করতে পারে ।
( ৩ )
বাংলাদেশেও মিলেটের চাষ দেখা যায় । বাংলাদেশের জীবনধারায় খাদ্য হিসেবে মিলেটের ব্যবহার নাকি খুব প্রাচীন কাল থেকে । সেই দেশের মানুষের খাদ্যাভাস বা নানান প্রথার সঙ্গে এই দানাশস্যের অনুষঙ্গ জড়িয়ে রয়েছে । তবে সেই দেশে ধান, গম ও ভুট্টার পরে চার নম্বরে স্থান দেওয়া হয়েছে মিলেট চাষকে । বাংলাদেশে মিলেটকে জোয়ার, বাজরা ছাড়াও চিনা বা কাউন বলে । মিলেটকে বাংলাদেশে জোয়ার বা সরগাম (Jower or Sorghum) , যব (Oat), চিনা (Proso millet), কাউন (Foxtail millet), ইত্যাদি নামে মানুষে জানে । বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সরগামের অপর নাম জোয়ার জানে । শুষ্ক এলাকার জন্য মানুষ ও পশুপাখির খাদ্য হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ । চিনা সাধারণত গরুর ঘাসের জন্য ব্যবহৃত হয় । যদিও বাংলাদেশের চিনার চাষ প্রাচীন কাল থেকে । বিশেষ করে পাবনা, টাঙাইল, জামালপুর, ফরিদপুর, জেলায় বেশী চাষ হয় । কাউন চাষ তুলনামূলক কম । কাউনের জাউ বা খিচুড়ি খুব জনপ্রিয় । তা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে চাউনের ভাতও খেতে দেখা যায় ।
সবশেষে যেটা আমাদের জীবনধারা ও খাদ্যাভাস নিয়ে ভাববার বিষয়, সেটা হচ্ছে প্রয়োজনে জীবনধারা ও খাদ্যাভাস পর্যালোচনা করে তার পরিমার্জন করাটাও স্বাস্থ্যের নিরিখে অত্যন্ত জরুরি, বলা চলে সময়োপযোগী । সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে সক্ষম, পুষ্টিগুণসম্পন্ন, জল সাশ্রয়ী এই ফসলকে আরও উৎপাদনমুখি করে তুলতে উদ্যোগী হওয়া বাঞ্ছনীয় । যাতে মানুষ এই দানাশস্যের পুষ্টির সুফল অধিকমাত্রায় পেতে পারে । আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষকে মাথায় রেখে দেশের সুশীল নাগরিক সমাজ জোয়ার-বাজরা-রাগি ইত্যাদি শস্যের প্রতি নজর দিলে দানাশস্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে আবার ঘরে ঘরে মানুষের পাতে ফিরে আসবে । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত ও যোজনা-০১/২০২৩)
———০———–
লেখকঃ কথা সাহিত্যিক (ভারত)

Share This
Categories
প্রবন্ধ

মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী উৎপল দত্ত চিরকাল শােষিত বঞ্চিত মানুষের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেছেন তার নাটক ও নাট্য প্রযােজনার মধ্য দিয়ে!

ভূমিকা—-

উৎপল দত্ত একজন ভারতীয় অভিনেতা, পরিচালক এবং লেখক-নাট্যকার ছিলেন।  তিনি মূলত বাংলা থিয়েটারের একজন অভিনেতা ছিলেন, যেখানে তিনি আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারে একজন অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন, যখন তিনি ১৯৪৯ সালে “লিটল থিয়েটার গ্রুপ” প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলটি অনেক ইংরেজি, শেক্সপিয়র এবং ব্রেখ্টের নাটক রচনা করেছিল, যা বর্তমানে থিয়েটার নামে পরিচিত।  “এপিক থিয়েটার” সময়কাল, এটি অত্যন্ত রাজনৈতিক এবং উগ্র থিয়েটারে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করার আগে।  তাঁর নাটকগুলি তাঁর মার্কসবাদী মতাদর্শের প্রকাশের জন্য একটি উপযুক্ত বাহন হয়ে ওঠে, যা কল্লোল (১৯৬৫), মানুষের অধিকার, লৌহা মনোব (১৯৬৪), টিনার টোলোয়ার এবং মহা-বিদ্রোহার মতো সামাজিক-রাজনৈতিক নাটকগুলিতে দৃশ্যমান।  এছাড়াও তিনি ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে ১০০ টিরও বেশি বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং মৃণাল সেনের ভুবন শোম (১৯৬৯), সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক (১৯৯১),  চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সর্বাধিক পরিচিত।   এবং হৃষিকেশ মুখার্জির হিন্দি কমেডি যেমন গোল মাল (১৯৭৯) এবং রং বিরাঙ্গি (১৯৮৩)।  তিনি তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে ১৯৯৩ সালে দূরদর্শনে ব্যোমকেশ বক্সীর (টিভি সিরিজ) সীমান্ত হীরার পর্বে একজন ভাস্কর স্যার দিগিন্দ্র নারায়ণের ভূমিকাও করেছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং তিনটি ফিল্মফেয়ার সেরা কমেডিয়ান পুরস্কার পান।  ১৯৯০ সালে, ভারতের ন্যাশনাল একাডেমি অফ মিউজিক, ড্যান্স অ্যান্ড থিয়েটার সঙ্গীত নাটক আকাদেমি তাকে তার সর্বোচ্চ পুরস্কার, থিয়েটারে আজীবন অবদানের জন্য সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ প্রদান করে।

 

প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা—-

 

উৎপল দত্ত বাংলা গণনাট্য আন্দোলনের সময়ে বিশিষ্ট অভিনেতা এবং নাট্যকার। উৎপল দত্ত ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পিতা গিরিজারঞ্জন দত্ত।  তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন।

 

ব্যক্তিগত জীবন–

 

১৯৬০ সালে, দত্ত থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শোভা সেনকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র মেয়ে, বিষ্ণুপ্রিয়া দত্ত, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড অ্যাসথেটিক্স, নয়া দিল্লিতে থিয়েটার এবং পারফরম্যান্স স্টাডিজের একজন অধ্যাপক।

 

কর্মজীবন—

 

গণনাট্য আন্দোলন ছিল মূলত রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলন, মার্ক্সবাদ থেকে প্রণীত এক ধারা যেখানে মঞ্চ হয়ে ওঠে প্রতিবাদের মাধ্যম তিনি মঞ্চের কারিগর ,বাংলা মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তিনি শেক্সপিয়ার আন্তর্জাতিক থিয়েটার কোম্পানির সাথে ভ্রমণ করেছেন বেশ কয়েকবার। তাকে গ্রূপ থিয়েটার অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হিসাবে গন্য করা হয়। কৌতুক অভিনেতা হিসাবেও তার খ্যাতি রয়েছে।

তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র গুড্ডি, গোলমাল, শওকিন ও রং বিরঙ্গিতে (১৯৮৩) -তে অভিনয় করেছেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ এবং আগন্তুক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। মননশীল ছবি ছাড়াও অজস্র বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী ও মার্ক্সবাদী। উৎপল দত্তের বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে টিনের তলোয়ার, মানুষের অধিকার ইত্যাদি। তার নাটক গুলি কে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। পূর্ণাঙ্গ নাটক, পথ নাটিকা, যাত্রাপালা।

 

উৎপল দত্ত রচিত নাটকের তালিকা—

 

বাংলা রাজনৈতিক নাটকের ইতিহাস সুপ্রাচীন। নীলদর্পণ থেকেই এই রাজনৈতিক নাটকের সূচনা। কিন্তু উৎপল দত্তকে বলতে হয় অবিমিশ্র রাজনৈতিক নাট্যকার। তাঁর সমস্ত নাটকের মধ্যেই থাকে সচেতন উদ্দেশ্য। পূর্ণাঙ্গ, একাঙ্ক, পথনাটক ইত্যাদি মিলে উৎপল দত্তের নাটকের সংখ্যা প্রায় সন্তরটি। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও নাটকগুলি বিচিত্র, কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সর্বত্রই সেখানে অতন্দ্র থেকেছে। মৌলিক এই নাটকগুলি ছাড়াও আছে অসংখ্য অনুবাদ নাটক। আরাে উল্লেখ্য, রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে উৎপল দত্ত কখনও শিল্পসৃষ্টির অজুহাতে বা শাসক শক্তির কোপদৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনাে অস্পষ্টতা বা অবরণের আশ্রয় নেন নি। তার বক্তব্য স্পষ্ট, সুবােধ্য এবং অকুতােভয়।

 

লাল দূর্গ, বণিকের মাণদন্ড,  এংকোর (অনুবাদ গল্প), দিল্লী চলো, ছায়ানট(১৯৫৮), অঙ্গার(১৯৫৯), ফেরারী ফৌজ(১৯৬১), ঘুম নেই (১৯৬১), মে দিবস (১৯৬১), দ্বীপ (১৯৬১), স্পেশাল ট্রেন (১৯৬১), নীলকন্ঠ(১৯৬১), ভি.আই.পি (১৯৬২), মেঘ (১৯৬৩), রাতের অতিথি (১৯৬৩), সমাজতান্ত্রিক চাল (১৯৬৫), কল্লোল(১৯৬৫), হিম্মৎবাই (১৯৬৬), রাইফেল (১৯৬৮), মানুষের অধিকার (১৯৬৮), জালিয়ানওয়ালাবাগ (১৯৬৯), মাও-সে-তুং (১৯৭১), পালা-সন্ন্যাসীর তরবারি (১৯৭২), বৈশাখী মেঘ (১৯৭৩), দুঃস্বপ্নের নগরী(১৯৭৪), এবার রাজার পালা, স্তালিন-১৯৩৪, তিতুমির, বাংলা ছাড়ো, দাঁড়াও পথিকবর, কৃপান, শৃঙ্খলছাড়া, মীরকাসিম, মহাচীনের পথে, আজকের শাজাহান, অগ্নিশয্যা, দৈনিক বাজার পত্রিকা, নীল সাদা লাল, একলা চলো রে, ক্রুশবিদ্ধ কুবা, নীলরক্ত, লৌহমানব, যুদ্ধং দেহি, লেনিনের ডাক, চাঁদির কৌটো, রক্তাক্ত ইন্দোনেশিয়া, মৃত্যুর অতীত, ঠিকানা, টিনের তলোয়ার, ব্যারিকেড, মহাবিদ্রোহ, মুক্তিদীক্ষা, সূর্যশিকার, কাকদ্বীপের এক মা, ইতিহাসের কাঠগড়ায়, কঙ্গোর কারাগারে, সভ্যনামিক, নয়াজমানা, লেনিন কোথায়, সীমান্ত, পুরুষোত্তম, শৃঙ্খল ঝঙ্কার, জনতার আফিম, পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস, মধুচক্র, প্রফেসর মামালক, শোনরে মালিক, সমাধান, অজেয় ভিয়েতনাম, তীর।

 

পুরষ্কার এবং স্বীকৃতি—-

 

থিয়েটারে আজীবন অবদানের জন্য ১৯৯০ সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ

শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – জিতেছেন
১৯৭০ ভুবন শোম – ভুবন শোম

ফিল্মফেয়ার সেরা কমেডিয়ান পুরস্কার – জিতেছে
১৯৮০ গোল মাল – ভবানী শঙ্কর
১৯৮২ নরম গরম – ভবানী শঙ্কর
১৯৮৪ রং বিরঙ্গি – পুলিশ ইন্সপেক্টর ধুরন্ধর ভাতাওদেকর

বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড: সেরা অভিনেতার পুরস্কার- জিতেছেন
১৯৯৩ আগন্তুক – মনোমোহন মিত্র

ফিল্মফেয়ার সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার – মনোনীত৷
১৯৭৫ অমানুষ – মহিম ঘোষাল
১৯৮০ গোল মাল – ভবানী শঙ্কর
১৯৮৬ সাহেব – বদ্রী প্রসাদ শর্মা

 

 

মৃত্যু—–

 

১৯৯৩ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া।।

 

Share This