Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক — এক অসাধারণ পাহাড়ি সফর।।

যাত্রার শুরু: শিলিগুড়ির সকাল

শিলিগুড়ি, উত্তরবঙ্গের প্রধান প্রবেশদ্বার, পাহাড়ি সফরের এক স্বাভাবিক সূচনা বিন্দু। শীতের এক হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে আমরা যাত্রা শুরু করি। শহরের ভিড় পেরিয়ে, যখন গাড়ি সেভক রোড ধরে এগোতে থাকে, তখন তিস্তার রূপ চোখে ধরা দেয়। নদীর দু’পাশে সবুজ পাহাড়ের প্রহর, মাঝে মাঝে চা-বাগানের গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে।

সেভক ব্রিজ ও তিস্তা নদী

সেভক ব্রিজের কাছে পৌঁছে প্রথমবার পাহাড়ি সফরের আসল রূপ দেখা দেয়। গাঢ় নীলচে সবুজ তিস্তা নদী পাহাড় কেটে বয়ে চলেছে, আর দূরে সান্দাকফুর মতো পাহাড়চূড়া মেঘের আড়ালে। সেভক থেকে রংপো পর্যন্ত রাস্তা হলো এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা—এক পাশে পাহাড়, আরেক পাশে খরস্রোতা নদী।
পথে ছোট ছোট দোকান, যেখানে গরম চা ও মোমো পাওয়া যায়। আমরা থেমে এক কাপ লাল চা (লেপচা চা) খাই, যার স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে।

সিকিম প্রবেশদ্বার: রংপো

প্রায় দেড় ঘণ্টার ড্রাইভের পর পৌঁছাই রংপোতে—সিকিমের প্রবেশদ্বার। এখানে গাড়ির পারমিট চেক হয়, কারণ সিকিমে প্রবেশের জন্য অনেক জায়গায় বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। রংপো থেকেই পাহাড়ি রাস্তার বাঁক বেড়ে যায়, আর প্রতিটি বাঁক যেন নতুন দৃশ্যপট খুলে দেয়।

তিস্তার বাঁক আর পাহাড়ি গ্রাম

রংপো পেরিয়ে রাস্তা কখনো পাহাড়ের গা ঘেঁষে উপরে উঠে যায়, কখনো নিচে নেমে যায় নদীর ধারে। তিস্তার পানির রঙ এখানে আরও উজ্জ্বল। মাঝে মাঝে দেখা মেলে পাহাড়ি গ্রামের—ছোট কাঠের বাড়ি, টিনের ছাদ, উঠানে গাঁদা ফুল আর বাঁশের বেড়া। গ্রামের মানুষরা হাসিমুখে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়।

সিংতাম ও রুমটেকের পথে

গ্যাংটকের দিকে যেতে সিংতাম নামের একটি জায়গা পড়ে, যেখান থেকে রুমটেক মঠের রাস্তা বেরিয়েছে। রুমটেক সিকিমের অন্যতম বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ, কার্মাপার আসন। যদিও আমাদের সফরের সময় রুমটেক সরাসরি যাওয়া হয়নি, কিন্তু দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে বসে থাকা সোনালি ছাদের ঝলক দেখা গিয়েছিল।

গ্যাংটকের পথে শেষ কয়েক কিলোমিটার

শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক প্রায় ১২০ কিলোমিটার, কিন্তু পাহাড়ি রাস্তার কারণে সময় লাগে ৪–৫ ঘণ্টা। শেষ কয়েক কিলোমিটারে পাহাড়ি বন ঘন হয়ে আসে, বাতাস আরও শীতল। ছোট ছোট ঝর্ণা রাস্তার ধারে পড়ে, আর পাখিদের ডাক শোনা যায় স্পষ্টভাবে।

গ্যাংটকে প্রবেশ

গ্যাংটক শহরে ঢোকার আগে তিস্তার উপর দিয়ে শেষবারের মতো একটি সেতু পার হতে হয়। তারপরই শহরের প্রথম ঝলক—উচ্চতায় বসে থাকা রঙিন বাড়ি, রেলিং ঘেরা রাস্তা, আর দূরে বরফঢাকা পাহাড়। সন্ধ্যা নেমে আসছিল, আর পাহাড়ি বাতাসে এক ধরনের উৎসবের গন্ধ ছিল।

গ্যাংটকের রাত

গ্যাংটকের এমজি মার্গে রাতের আলোর রঙ অপরূপ। এখানে গাড়ি চলাচল নেই, শুধুই পথচারীদের জন্য। দুই ধারে দোকান, ক্যাফে, পাহাড়ি পোশাক ও হস্তশিল্পের স্টল, আর পর্যটকদের ভিড়। এক বাটি থুকপা আর গরম কফি খেয়ে রাতটা যেন পূর্ণতা পেল।

পরদিনের অভিযাত্রা

গ্যাংটক থেকে পরের দিন আমরা ছুটে গেলাম তাশি ভিউ পয়েন্টে, যেখানে ভোরের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। পাহাড়ের উপরে লেগে থাকা মেঘের ফাঁক দিয়ে সোনালি আলো পড়ছিল—এমন দৃশ্য জীবনে একাধিকবার পাওয়া যায় না।
এরপর হানুমান টক, গণেশ টক, এবং বানঝাকরি ওয়াটারফল—প্রতিটি জায়গার নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে দাঁড়িয়ে বরফঠান্ডা পানির ফোঁটা মুখে লাগার অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম।

সংস্কৃতি ও মানুষ

গ্যাংটকের মানুষ শান্ত, অতিথিপরায়ণ এবং হাসিখুশি। এখানে লেপচা, ভুটিয়া, নেপালি—বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে থাকে। শহরে বৌদ্ধ মঠের প্রার্থনা ঘণ্টা আর তিব্বতি পতাকার রঙিন দোল এক অন্য আবহ তৈরি করে।

ফেরার পথ

ফেরার পথে একই রাস্তা হলেও দৃশ্যপট আলাদা লাগছিল। হয়তো মন তখন পাহাড়ের মায়ায় আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। শিলিগুড়িতে ফেরার সময় একরাশ স্মৃতি আর পাহাড়ি হাওয়ার স্বাদ বুকে বয়ে নিয়ে এসেছিলাম।

উপসংহার

শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক সফর কেবল পাহাড়ি ভ্রমণ নয়—এটি এক আত্মার যাত্রা, যেখানে প্রকৃতি, মানুষ, আর সংস্কৃতি মিলে এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি দৃশ্য যেন বলে—পাহাড়ে ফিরে এসো আবার।
আপনি চাইলে আমি এর জন্য একটি প্রতীকী ছবি বা পোস্টার ডিজাইনের বর্ণনাও দিতে পারি, যাতে পরে ছবিতে রূপান্তর করা যায়।
আপনি কি সেই বর্ণনাটিও চান?

Share This
Categories
প্রবন্ধ

৯ আগস্ট—ভারত ছাড়ো আন্দোলন: স্বাধীনতার পথে এক জাগ্রত আহ্বান।

 

ভূমিকা

১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ও বিস্ময়কর দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসন তখন ভারতের মানুষের ওপর ক্রমশ দমননীতি চালাচ্ছিল। মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃত্ব তখন বুঝতে পেরেছিলেন—আর বিলম্ব নয়, স্বাধীনতার ডাক দিতে হবে। সেই ডাকে জন্ম নিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন (Quit India Movement)—যা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রামে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল, এবং এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল বর্তমান বাংলাদেশেও।


ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ শাসনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

ভারতে তখন প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ শাসন চলছে। প্রশাসন, অর্থনীতি ও কৃষি ব্যবস্থা উপনিবেশিক শোষণের শিকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের জনগণকে কোনো অনুমতি বা আলোচনার বাইরে রেখেই যুদ্ধে জড়িয়ে দেয়। ভারতীয়রা বুঝতে পারে—এ লড়াই মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য নয়।

কংগ্রেসের অবস্থান

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রথমে ব্রিটিশদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা ছাড় আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু ১৯৪২ সালের ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে, মহাত্মা গান্ধী বলেন—
“এখন বা কখনোই নয়” (Do or Die)
এ ছিল এক নিঃশর্ত স্বাধীনতার ডাক।


৯ আগস্ট ১৯৪২: আন্দোলনের সূচনা

বোম্বে কংগ্রেস অধিবেশন

৮ আগস্ট ১৯৪২ সালে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) কংগ্রেসের সর্বভারতীয় কমিটি এক ঐতিহাসিক প্রস্তাব পাস করে—ভারতের অবিলম্বে স্বাধীনতা দাবি এবং ব্রিটিশ শাসন অবসানের আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবটি ইতিহাসে পরিচিত হয় ‘ভারত ছাড়ো প্রস্তাব’ নামে।

নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার

৯ আগস্ট ভোরেই ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরদার বল্লভভাই পটেলসহ প্রায় সব শীর্ষ কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তার করে। এর ফলে নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় আন্দোলন এক নতুন রূপ নেয়—জনতার হাতে আন্দোলনের দায়িত্ব চলে যায়।


আন্দোলনের বিস্তার

জনতার বিদ্রোহ

নেতারা কারাগারে বন্দি থাকলেও সারাদেশে হরতাল, বিক্ষোভ, ট্রেনলাইন উপড়ে ফেলা, ডাকঘর ও থানা আক্রমণ—এসব চলতে থাকে। যুব সমাজ, ছাত্র, কৃষক ও শ্রমিকরা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল।

গ্রামীণ আন্দোলন

শহরের পাশাপাশি গ্রামে-গঞ্জেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামীণ জনগণ ব্রিটিশ প্রশাসন বর্জন করে বিকল্প শাসন কাঠামো গড়ে তোলে।


বর্তমান বাংলাদেশের ভূমিকায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন

তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায়ও আন্দোলনের প্রভাব প্রবল ছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে কংগ্রেস, যুবলীগ ও ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে মিছিল-মিটিং হয়। ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনারা দমননীতি চালালেও আন্দোলন থামানো যায়নি।


ব্রিটিশ দমননীতি ও সহিংসতা

ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমনে গুলি, গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জ ও দমনমূলক আইন প্রয়োগ করে। সরকারি হিসাবে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়, আর লাখেরও বেশি গ্রেপ্তার হয়। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়।


আন্দোলনের তাৎপর্য

  1. নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার দাবি – আলোচনার মাধ্যমে নয়, সরাসরি স্বাধীনতার ডাক
  2. জনতার অংশগ্রহণ – নেতৃত্ব ছাড়াই সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে আন্দোলন চলা
  3. অহিংসা ও সহিংসতার মিশ্রণ – গান্ধীবাদী অহিংস প্রতিবাদের পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্ত সহিংস প্রতিরোধ
  4. ব্রিটিশদের দুর্বলতা প্রকাশ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলায় ব্রিটিশদের পক্ষে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি

স্বাধীনতার পথে প্রভাব

ভারত ছাড়ো আন্দোলন সরাসরি ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার কারণ না হলেও, এটি ব্রিটিশ সরকারকে বুঝিয়ে দেয়—ভারতকে দমন করে চিরকাল শাসন করা সম্ভব নয়। যুদ্ধশেষে ব্রিটিশরা রাজনৈতিক সমাধানের পথে যেতে বাধ্য হয়।


সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা

  • নেতৃত্ব গ্রেপ্তারের কারণে পরিকল্পিত আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়
  • সহিংস কর্মকাণ্ডে কিছু জায়গায় সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়
  • দেশীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উদ্ভব ঘটে

আজকের দিনে প্রাসঙ্গিকতা

৯ আগস্টের ডাক আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াই অপরিহার্য। শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্যও একই ধরনের সাহসী পদক্ষেপ দরকার।


উপসংহার

৯ আগস্ট ১৯৪২ শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি দিন নয়—এটি ছিল এক জাতির অদম্য সাহস, আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতার অমোঘ আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। মহাত্মা গান্ধীর “করো বা মরো” আহ্বান শুধু ব্রিটিশদের চ্যালেঞ্জ করেনি, বরং গোটা উপমহাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছিল। আজকের প্রজন্মের কাছে এই দিনটি কেবল ইতিহাস নয়—এটি অনুপ্রেরণার চিরন্তন উৎস।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

পুষ্পলতা দাশ: অসমের সাহসী কন্যা ও ভারতের নারী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত।

✦ ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অবদান যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ততখানি প্রেরণাদায়কও বটে। অসংখ্য নারী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন পূরণের জন্য। এই মহান নারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন পুষ্পলতা দাশ। অসমের এই সাহসিনী শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামেই অংশ নেননি, বরং সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষা, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বেও ছিলেন অনন্য। তিনি আজও অসমবাসীর কাছে এক প্রেরণার প্রতীক।
এই প্রবন্ধে আমরা পুষ্পলতা দাশের জন্ম, শৈশব, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা, কারাবাস, সামাজিক অবদান এবং তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

✦ জন্ম ও শৈশবকাল

পুষ্পলতা দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৫ সালের ২৭ মার্চ, আসামের উত্তর লখিমপুর জেলায়। তাঁর পিতা ছিলেন আইনজীবী এবং মাতা ছিলেন একজন গৃহিণী, যিনি পরিবারে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা লালন করতেন। শৈশব থেকেই পুষ্পলতা রাজনৈতিক আলোচনা ও জাতীয় আন্দোলনের গল্প শুনে বড় হয়েছিলেন।
তাঁর পরিবারে দেশপ্রেমের যে পরিবেশ ছিল, তা তাঁর চিন্তা ও জীবনদর্শন গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। ছোটবেলা থেকেই তিনি দৃঢ়চেতা, স্পষ্টভাষী এবং অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।

✦ শিক্ষাজীবন

পুষ্পলতা দাশের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় আসামের স্থানীয় স্কুলে। পরে তিনি গৌহাটি এবং শিলংয়ে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় যান এবং ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং ‘স্বদেশী’ ও ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের প্রভাব তাঁর মনে গভীরভাবে পড়ে।
ছাত্রাবস্থায়ই তিনি লালন করতেন নারী জাগরণ ও শিক্ষার স্বপ্ন। পরে এই স্বপ্নই তাঁকে নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ করে তোলে।

✦ স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান

পুষ্পলতা দাশের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে ১৯৩০ সালের দিকে, যখন মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশজুড়ে সিভিল অবিডিয়েন্স মুভমেন্ট শুরু হয়। অল্প বয়সেই তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন।
১৯৩১ সালে, অখিল অসম ছাত্রী সম্মেলন-এর সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি নারী শিক্ষার প্রসার, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এবং স্বাধীনতার বার্তা প্রচার করতে থাকেন।

✦ সল্ট সত্যাগ্রহ ও কারাবাস

গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে পুষ্পলতা দাশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অসমে মহিলাদের লবণ উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা, বিদেশি পণ্যের বয়কট, ব্রিটিশবিরোধী মিছিল—এসব কর্মকাণ্ডে তাঁর নেতৃত্ব ছিল দৃশ্যমান।
১৯৩২ সালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং কয়েক মাসের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগারে থাকাকালীন তিনি অন্য মহিলা বন্দিদের স্বশিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যান।

✦ ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন

১৯৪২ সালে কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিলে পুষ্পলতা দাশ অসমে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি অসমের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানান।
পুলিশ একাধিকবার তাঁকে গ্রেফতার করে। তিনি দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করেন, কিন্তু তাঁর মনোবল ভাঙেনি। বরং কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।

✦ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজ

স্বাধীনতার পরে পুষ্পলতা দাশ নিজেকে কেবল রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের জন্য বহু উদ্যোগ নেন। অসম মহিলা সমিতি-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি নারীদের স্বাস্থ্য, স্বনির্ভরতা এবং অধিকার নিয়ে কাজ করেন।
তাছাড়া, তিনি আসামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং প্রচারে বড় ভূমিকা রাখেন। সাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত এবং লোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল।

✦ রাজনৈতিক জীবন

পুষ্পলতা দাশ স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। তিনি অসম বিধানসভায় নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী অধিকার এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন।

✦ ব্যক্তিগত জীবন

পুষ্পলতা দাশ বিয়ে করেছিলেন ওমিও কুমার দাস-কে, যিনি ছিলেন অসমের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সমাজকর্মী। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল দেশ ও সমাজসেবার কাজে নিবেদিত। দুজন মিলে শিক্ষার প্রসারে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

✦ সম্মান ও স্বীকৃতি

পুষ্পলতা দাশ তাঁর আজীবন সংগ্রাম ও অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে।

✦ শেষ জীবন

পুষ্পলতা দাশ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমাজসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু অসম ও সমগ্র দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল।

✦ উত্তরাধিকার

পুষ্পলতা দাশ শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন; তিনি নারী মুক্তি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের এক প্রতীক। তাঁর জীবন আজও তরুণ প্রজন্মকে শেখায়—সাহস, দৃঢ়তা, ত্যাগ ও নিষ্ঠা থাকলে কোনো লক্ষ্যই অসম্ভব নয়।

✦ উপসংহার

অসমের এক ছোট্ট শহরে জন্ম নেওয়া এই নারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সমাজ সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়ে এবং রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে প্রমাণ করেছিলেন যে নারীর ক্ষমতা অসীম। পুষ্পলতা দাশের জীবন কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং আজও নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয়তাবাদের এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

কল্পনা দত্ত: ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামের এক সাহসিনী কন্যা।

🔰 ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু নারী বীরাঙ্গনার নাম আমরা জানি, কিন্তু কল্পনা দত্ত (পরে কল্পনা যোশী) তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয়—কারণ তিনি ছিলেন যুগান্তর বিপ্লবী দলের এক সক্রিয় সদস্যা, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন।
যে সময় নারীদের মূলত ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল, সে সময় কল্পনা দত্ত নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের মুক্তির জন্য।


👶 শৈশব ও শিক্ষাজীবন

কল্পনা দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ২৭ জুলাই ১৯১৩ সালে, চট্টগ্রামের (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলন তিলক দত্ত, যিনি ব্রিটিশ সরকারের এক কর্মচারী। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলেও কল্পনা ছোট থেকেই স্বাধীনচেতা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন।

তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন চট্টগ্রামেই। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসেন এবং বেথুন কলেজে ভর্তি হন। এখানেই তিনি প্রথম রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র আন্দোলন, স্বদেশী প্রচার এবং দেশীয় পণ্যের ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে যুক্ত হন।


🚩 স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যোগদান

কলকাতায় পড়াশোনার সময় কল্পনা দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শে প্রভাবিত ছাত্রছাত্রীদের একদল সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীর। এই সময় তিনি যুগান্তর বিপ্লবী দল-এর সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলন সংগঠিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই খবর কল্পনা দত্তকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি কলেজ ছেড়ে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং সরাসরি মাস্টারদার নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলে যোগ দেন।


⚔ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুঠ অভিযানে ভূমিকা

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুঠ অভিযান চালানো হয়। যদিও কল্পনা দত্ত সরাসরি মূল আক্রমণে অংশ নেননি, তিনি অভিযান-পরবর্তী পরিকল্পনা, বার্তা আদানপ্রদান, এবং বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে তিনি কৃষক পরিবারগুলির মধ্যে দেশপ্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দেন এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে জনসাধারণের সংযোগ স্থাপন করেন।


🛡 গোপন কার্যকলাপ ও নারীর ভূমিকা

ব্রিটিশ পুলিশ তখন বিপ্লবীদের ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছিল। কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, এবং অন্যান্য নারী কর্মীরা পুরুষ বিপ্লবীদের নিরাপদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন।

তিনি নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরিতে বিশেষভাবে কাজ করেন। গ্রামের মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো, বিপ্লবীদের জন্য খাদ্য ও তথ্য সরবরাহ করা—এসব কাজে তাঁর সাহস ছিল অসাধারণ।


🎯 প্রীতিলতার শহিদ হওয়ার পর

১৯৩২ সালে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে শহিদ হন। এই ঘটনার পর কল্পনা দত্তকে মাস্টারদা সূর্য সেনের সরাসরি সঙ্গিনী হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তাঁরা দু’জনে চট্টগ্রামের গ্রামীণ অঞ্চলে গোপন আস্তানা বদলে বদলে পুলিশের চোখ এড়িয়ে চলছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ গুপ্তচরদের খবরের ভিত্তিতে ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ তাঁদের ঘিরে ফেলে।


⛓ গ্রেপ্তার ও বিচার

১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কল্পনা দত্ত ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। মাস্টারদা সূর্য সেন একই সময়ে ধরা পড়েন এবং পরে তাঁকে নৃশংসভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়।

কল্পনা দত্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যাচেষ্টা এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। তাঁকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

কারাগারে তিনি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন। দীর্ঘদিন একাকী সেলে বন্দি থাকতে হয়। কিন্তু তাঁর মনোবল ভাঙেনি।


🕊 মুক্তি ও পরবর্তী জীবন

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। এর ফলে কল্পনা দত্তও মুক্তি পান।

মুক্তির পর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন এবং শ্রমিক আন্দোলন, নারী অধিকার আন্দোলন ও কৃষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।


💍 ব্যক্তিগত জীবন

মুক্তির কিছু বছর পর কল্পনা দত্ত বিয়ে করেন কমিউনিস্ট নেতা পিসি যোশী-কে। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় কল্পনা যোশী। যদিও রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও ব্যক্তিগত কারণবশত তাঁদের সম্পর্ক পরবর্তীতে বিচ্ছিন্ন হয়, তবুও কল্পনা সারাজীবন সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে নিবেদিত ছিলেন।


📖 সাহিত্যকর্ম ও স্মৃতিকথা

কল্পনা দত্ত তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন—
“Chittagong Armoury Raiders: Reminiscences”
এতে তিনি চট্টগ্রাম বিপ্লব, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, এবং নিজের সংগ্রামের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।

এই বই আজও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অমূল্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।


🏅 সম্মান ও স্বীকৃতি

যদিও কল্পনা দত্তের নাম আজ সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব বেশি প্রচলিত নয়, ইতিহাসবিদরা তাঁকে ভারতের নারী বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম অগ্রণী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠান আয়োজন করে। তাঁর জীবন নিয়ে তথ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে।


✊ কল্পনা দত্তের আদর্শ

কল্পনা দত্ত আমাদের শিখিয়ে গেছেন—

  1. নারী যদি সংকল্পবদ্ধ হয়, তবে দেশমাতৃকার জন্য যেকোনও ত্যাগ স্বীকার করতে পারে।
  2. বিপ্লব কেবল পুরুষের কাজ নয়; নারীরাও এর সমান অংশীদার।
  3. অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে গোপন ও প্রকাশ্য—দুই ধরনের লড়াই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

🔚 উপসংহার

কল্পনা দত্ত ছিলেন এমন এক সংগ্রামী যিনি নিজের পড়াশোনা, আরাম-আয়েশ, এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। চট্টগ্রামের বিপ্লবী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অমূল্য।

যতদিন ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হবে, ততদিন কল্পনা দত্তের নাম স্মরণে থাকবে একজন অগ্নিকন্যা হিসেবে—যিনি নির্ভীকভাবে বলেছিলেন:

“দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি।”


 

Share This
Categories
প্রবন্ধ

প্রবন্ধ : বর্ষাকাল।

 

  1. বর্ষার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশের পরিবর্তন
  2. কৃষিতে বর্ষার ভূমিকা
  3. শহর ও গ্রামে বর্ষার প্রভাব
  4. সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বর্ষা
  5. বর্ষাকালে স্বাস্থ্য সমস্যা ও প্রতিকার
  6. শিশু ও শিক্ষার্থীদের জীবনে বর্ষার প্রভাব
  7. উপসংহার

প্রবন্ধ : বর্ষাকাল

ভূমিকা

বাংলার ষড়ঋতুর মধ্যে বর্ষাকাল এক বিশিষ্ট ও প্রভাবশালী ঋতু। গ্রীষ্মের দাহ ও ক্লান্তির পরে আকাশ যখন কালো মেঘে ছেয়ে যায় এবং প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ে, তখন প্রকৃতির মাঝে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসে। সাধারণত আষাঢ় ও শ্রাবণ—এই দুই মাস মিলে বর্ষাকাল গঠিত হলেও এর প্রভাব অনেক সময় আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই ঋতু শুধু প্রাকৃতিক নয়, কৃষি, জীবনযাপন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও এক বিশাল ভূমিকা পালন করে।


১. প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশের পরিবর্তন

বর্ষার আগমন প্রকৃতিকে করে তোলে সজীব, তরতাজা ও মনোমুগ্ধকর। চারিদিকে সবুজের ছোঁয়া, পাতার গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা, নদীর ঢল, মাঠ-ঘাটে পানির প্রবাহ সব মিলিয়ে প্রকৃতি হয়ে ওঠে অনন্য এক চিত্রকলা। আকাশে কালো মেঘের ভেলা, বিদ্যুৎ চমক ও মেঘের গর্জন বর্ষার সৌন্দর্যকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে। শুকনো গাছপালা নতুন প্রাণ ফিরে পায়, পাখিরা আনন্দে গাইতে থাকে। পরিবেশে তাপমাত্রা কমে গিয়ে এক প্রাকৃতিক শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে।


২. কৃষিতে বর্ষার ভূমিকা

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ এবং কৃষি প্রধানত নির্ভর করে বর্ষাকালের বৃষ্টির উপর। বৃষ্টির জল চাষাবাদের প্রধান ভিত্তি। আমন ধান, পাট, আখ প্রভৃতি ফসল বর্ষাকালে চাষ করা হয়। নদী ও খালে পানির প্রবাহ বাড়ায় সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সহজলভ্য হয়। এছাড়া, বর্ষাকালেই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় যা ফসল উৎপাদনে সহায়ক। তবে অতিবৃষ্টি ও বন্যা হলে ফসলের ক্ষতিও হতে পারে, তাই কৃষির সাথে ঝুঁকিও বর্ষার একটি বাস্তব দিক।


৩. শহর ও গ্রামে বর্ষার প্রভাব

গ্রামে বর্ষাকাল সাধারণত আশীর্বাদস্বরূপ। কৃষিকাজ সচল হয়, নদীতে মাছ পাওয়া যায় এবং প্রকৃতি সজীব থাকে। তবে শহরাঞ্চলে বর্ষাকালের চিত্র একটু ভিন্ন। ড্রেনেজ সমস্যার কারণে জলাবদ্ধতা, রাস্তার ক্ষতি, যানজট ইত্যাদি দেখা যায়। শহরে চলাচল দুরূহ হয়ে পড়ে, জীবনের গতি মন্থর হয়ে যায়। তাই শহরের মানুষের কাছে বর্ষা কখনও আনন্দের, কখনও বিড়ম্বনার।


৪. সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বর্ষা

বর্ষাকাল বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের অন্যতম প্রেরণার উৎস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ সহ বহু কবি বর্ষাকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। “আষাঢ়ে গগনে…” কিংবা “মেঘ বলেছে যাবো যাবো…” এই ধরনের গান বা কবিতা বর্ষার মনোমুগ্ধকর চিত্র তুলে ধরে। বর্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাদ্যযন্ত্রের সুর, নাচ ও লোকসংস্কৃতি। এই ঋতু প্রেম, বিরহ, ভাবুকতা ও প্রকৃতির মেলবন্ধনের এক অপূর্ব রূপ।


৫. বর্ষাকালে স্বাস্থ্য সমস্যা ও প্রতিকার

বর্ষাকালে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা, নোংরা পানি ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে নানা ধরনের রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ে। ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, চর্মরোগ, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তারা বেশি আক্রান্ত হয়। এ সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, বিশুদ্ধ পানি পান, সঠিক পোশাক ব্যবহার ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি।


৬. শিশু ও শিক্ষার্থীদের জীবনে বর্ষার প্রভাব

বর্ষাকাল শিশুদের জন্য আনন্দের সময়, বিশেষ করে গ্রামের শিশুদের কাছে। তারা বৃষ্টিতে ভিজে খেলাধুলা করে, কাদার মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করে। তবে শহরের শিশুদের ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা অনেক সময় সীমিত। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের পক্ষে বর্ষাকাল কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে—বৃষ্টির কারণে বিদ্যালয়ে যাতায়াত ব্যাহত হয়, ক্লাস বাতিল হয়, পাঠদানে সমস্যা হয়। তবে বাড়িতে থেকে পড়াশোনার সময়ও বেশি পাওয়া যায়।


উপসংহার

বর্ষাকাল প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সৌন্দর্য, প্রভাব ও গুরুত্ব বহুস্তরে বিস্তৃত। যদিও বর্ষাকাল কিছু সমস্যার জন্ম দেয়, তবুও এর উপকারিতা অনস্বীকার্য। কৃষি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, প্রকৃতি—সবখানে এর এক অদ্ভুত প্রভাব রয়েছে। তাই বর্ষাকে শুধু “বৃষ্টি” নয়, আমাদের জীবনচক্রের অংশ হিসেবে গ্রহণ করাই শ্রেয়। প্রকৃতির এই অনন্য উপহারকে যত্নসহকারে উপভোগ করা উচিত, যাতে এর সৌন্দর্য ও সুবিধাগুলো আমরা দীর্ঘদিন উপভোগ করতে পারি।


 

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

পিঁয়াজ: গুণাগুণ, উপকারিতা ও ব্যবহার।।

ভূমিকা:-  পিঁয়াজ (Onion), আমাদের প্রতিদিনের রান্নার অপরিহার্য একটি উপাদান। এটি শুধুমাত্র স্বাদের জন্য ব্যবহৃত হয় না, বরং একটি প্রাচীন ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবেও পরিচিত। প্রাচীন মিশরীয়, ভারতীয় এবং গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্রে পিঁয়াজের ব্যবহারের ইতিহাস লক্ষণীয়। আধুনিক বিজ্ঞানও পিঁয়াজের পুষ্টিগুণ ও ঔষধি কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে।
এই প্রবন্ধে আমরা পিঁয়াজের বৈজ্ঞানিক পরিচয়, খাদ্যগুণ, ভেষজ গুণাগুণ, ব্যবহার, চাষাবাদ, ইতিহাস এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করব।

১. পিঁয়াজের বৈজ্ঞানিক পরিচয়

বিষয়তথ্যস্থানীয় নামপিঁয়াজ, পেয়াজইংরেজি নামOnionবৈজ্ঞানিক নামAllium cepaপরিবারAmaryllidaceaeঅংশ ব্যবহৃতকান্ড (bulb), পাতা, রস

২. পিঁয়াজের পুষ্টিগুণ

পিঁয়াজে রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান:

ভিটামিন C: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

ভিটামিন B6, B9 (Folate): রক্ত তৈরিতে সহায়তা করে

অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস: কোষ সুরক্ষা দেয়

ফাইবার: হজম শক্তি বাড়ায়

মিনারেলস: যেমন পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম

প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা পিঁয়াজে যা থাকে:

উপাদানপরিমাণক্যালরি৪০ Kcalকার্বোহাইড্রেট৯.৩৪ গ্রামফাইবার১.৭ গ্রামপ্রোটিন১.১ গ্রামচর্বি০.১ গ্রামভিটামিন C৭.৪ মি.গ্রা.পটাশিয়াম১৪৬ মি.গ্রা.

৩. পিঁয়াজের ভেষজ ও স্বাস্থ্যগুণ

৩.১ হৃদরোগ প্রতিরোধ

পিঁয়াজে রয়েছে quercetin নামক একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা রক্তনালিকে শিথিল করে ও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত পিঁয়াজ খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।

৩.২ রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ

পিঁয়াজ ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস রোগীরা নিয়মিত কাঁচা পিঁয়াজ খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৩.৩ প্রদাহ প্রতিরোধ

পিঁয়াজে থাকা sulfur compounds এবং flavonoids প্রদাহ হ্রাস করে। গাঁটের ব্যথা বা বাতের সমস্যা থাকলে উপকারী।

৩.৪ হজম শক্তি বৃদ্ধি

ফাইবার ও প্রিবায়োটিক উপাদান থাকার কারণে এটি অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া উন্নত করে এবং হজমে সহায়তা করে।

৩.৫ ক্যান্সার প্রতিরোধে সম্ভাব্য ভূমিকা

গবেষণায় দেখা গেছে যে, পিঁয়াজে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও সালফার যৌগসমূহ অন্ত্র, পাকস্থলী ও প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।

৩.৬ ঠান্ডা ও সর্দিতে উপকারী

পিঁয়াজের রস সর্দি, কাশি ও গলা ব্যথায় উপশম আনে। একে মধু বা আদার সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়।

৪. পিঁয়াজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

৪.১ প্রাচীন মিশরে

প্রায় ৫০০০ বছর আগেও মিশরের লোকেরা পিঁয়াজ খেত। এটি ছিল পুনর্জন্ম ও চক্রাকার জীবনধারার প্রতীক।

৪.২ ভারতীয় আয়ুর্বেদে

পিঁয়াজকে “রসালো, উষ্ণ, পিত্তবর্ধক” বলা হয়েছে। এটি যৌনক্ষমতা, বল এবং তেজ বৃদ্ধি করে বলে বিশ্বাস করা হত।

৪.৩ গ্রিক ও রোমান যুগে

যোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পিঁয়াজ খাওয়ানো হতো। অলিম্পিক ক্রীড়াবিদদের খাদ্যতালিকায়ও এটি ছিল।

৫. পিঁয়াজের প্রকারভেদ

পিঁয়াজ বিভিন্ন ধরনের হয়:
ধরনবৈশিষ্ট্যলাল পিঁয়াজস্বাদে ঝাঁজালো, বেশি সময় রাখা যায়সাদা পিঁয়াজনরম ও হালকা স্বাদের, স্যালাডে ব্যবহৃতহলুদ পিঁয়াজরান্নায় ব্যবহারযোগ্যবসন্ত পিঁয়াজ (Spring Onion)পাতা ও কাণ্ডসহ খাওয়া যায়

৬. পিঁয়াজ চাষাবাদ

আবহাওয়া: শীতপ্রধান ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো হয়

মাটি: বেলে দোআঁশ মাটি

সেচ: নিয়মিত জলসেচ দরকার

ফসল সংগ্রহ: বপনের ৯০–১২০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যায়

ভারতের মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক, ও গুজরাটে সবচেয়ে বেশি পিঁয়াজ চাষ হয়।

৭. ঘরোয়া ব্যবহার ও ঘরোয়া টোটকা

৭.১ মাথা যন্ত্রণায়

পিঁয়াজের রস কপালে লাগালে মাথাব্যথা উপশম হয়।

৭.২ চুল পড়া রোধে

পিঁয়াজের রস চুলে লাগালে চুল পড়া কমে এবং নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।

৭.৩ পোকামাকড়ের কামড়ে

পিঁয়াজ ঘষে দিলে বিষক্রিয়া কমে ও জ্বালাভাব দূর হয়।

৭.৪ অজ্ঞান অবস্থায়

কাঁচা পিঁয়াজ কেটে নাকের কাছে ধরলে অজ্ঞান ব্যক্তি সাড়া দিতে পারে।

৮. রান্নায় ব্যবহার

পিঁয়াজ ব্যবহারের মাধ্যমে রান্নায় যে স্বাদ ও ঘ্রাণ তৈরি হয় তা এককথায় অতুলনীয়। এটি:

ঝোল ও তরকারিতে স্বাদ ও ঘনত্ব আনে

সালাদ ও চাটে খাওয়া যায়

ভাজা পিঁয়াজ দিয়ে পোলাও বা বিরিয়ানির স্বাদ বাড়ানো যায়

৯. সতর্কতা

খালি পেটে বেশি পিঁয়াজ খেলে অম্বল বা পেটফাঁপা হতে পারে

গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পিঁয়াজ বর্জন করা ভালো

রক্ত পাতলা করার ওষুধ খেলে অতিরিক্ত পিঁয়াজ খাওয়া নিরাপদ নয়

কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে

১০. আধুনিক গবেষণায় পিঁয়াজ

গবেষণাফলাফলJournal of Nutrition (2012)পিঁয়াজ ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়Food and Chemical Toxicology (2015)পিঁয়াজের অ্যান্টিক্যান্সার প্রভাবPhytotherapy Research (2010)অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ

উপসংহার

পিঁয়াজ কেবল একটি মসলা নয়, এটি একটি প্রাকৃতিক ওষুধ, যা হাজার বছর ধরে মানুষের খাদ্য, চিকিৎসা এবং সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে। এর গুণাগুণ দৈহিক স্বাস্থ্য রক্ষায় যেমন সহায়ক, তেমনি ঘরোয়া চিকিৎসাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার এড়িয়ে চলা বাঞ্ছনীয়।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও রক্ষাবন্ধন : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)।

আমাদের মূল্যবান মনুষ্য জীবনে রক্ষাবন্ধন বা রাখীবন্ধন উৎসব ভারতীয় সংস্কৃতি সভ্যতায় ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সত্য সনাতন ধর্মে এই উৎসবটি ভাই ও বোনের শুভ রাখীবন্ধন উৎসব। ভাই ও বোনের মধ্যে ভালোবাসা ও প্রীতিবন্ধনের উৎসব। হিন্দু জৈন, বৌদ্ধ ও শিখরা এই উৎসব পালন করেন। এই দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতে পবিত্র রাখী বেঁধে দেয়। এই রাখীটি ভাই বা দাদার প্রতি দিদি বা বোনের ভালবাসা ও ভাইয়ের মঙ্গলকামনা এবং দিদি বা বোনকে আজীবন রক্ষা করার ভাই বা দাদার শপথের প্রতীক হিসাবে পরিগণিত হয়।

রক্ষাবন্ধন শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিন পালন করা হয়। রাখীপূর্ণিমা উৎসব কে রাখীবন্ধন ও বলা হয়। আবার ঝুলন পূর্ণিমা ও বলা হয়। ঝুলন পূর্ণিমা কিছু মন্দিরে শুধুমাত্র একদিনের জন্য ঝুলন যাত্রা উৎসব পালন করা হলেও, কিছু মন্দিরে একাদশীর দিন থেকে পূর্ণিমার দিন পর্যন্ত পালন করা হয়, যা শ্রাবণ মাসে পাঁচ দিন ধরে চলে। ঝুলন যাত্রা একটি ধর্মীয় উৎসব যা ভগবান কৃষ্ণ এবং ভগবান জগন্নাথকে উৎসর্গ করা হয়।

পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বলির রাজ্য রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিরাজের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রক্ষাবন্ধন বা রাখীবন্ধন উৎসব হিসেবে পালন করে।

মহাভারতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী একবার যুদ্ধে ভগবান কৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। এতে ভগবান কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে যান। দ্রৌপদী তাঁর অনাত্মীয়া হলেও, তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোন বলে ঘোষণা করেন এবং দ্রৌপদীকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। পরে, পাশাখেলায় কৌরবরা দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে গেলে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। এইভাবেই রাখী বন্ধনের প্রচলন হয়।

ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী ৩২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।

তাছাড়াও ১৫৩৫ সালে গুজরাটের সুলতান বাদশা চিতোর আক্রমণ করলে চিতোরের রানী কর্ণাবতী হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তার কাছে একটি রাখী পাঠান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করতে পারেননি কারণ তিনি চিতোর পৌঁছানোর আগেই বাহাদুর শাহ চিতোর জয় করে নিয়েছিলেন। বিধবা রানী কর্ণাবতী নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে এবং বাহাদুর শাহ এর হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৩০০০ স্ত্রীকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জহর ব্রত পালন করেন। পরে হুমায়ুন চিতোর জয় করে কর্ণাবতীর ছেলে বিক্রম সিংহ কে রাজা ঘোষণা করেন। রাণী কর্ণাবতী ও সম্রাট হুমায়ুনের সম্পর্কের বুনিয়াদ ছিল শুধুই একটি রাখি আর সাথে থাকা একটি চিঠি। ভিন্ন ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্ক কিছুই মুখ্য হয়নি ভাইকে পাঠানো বোনের রক্ষাবার্তায়। বোনকে রক্ষায় ছুটে এসেছেন ভাই। শেষ রক্ষা না হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন অপরাধীকে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রক্ষাবন্ধন বা রাখীবন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন। আজ কাল আমরা সবাই রাখী বন্ধন উৎসবে মেতে উঠি। কিন্তু অনেক সময় তা উৎসব হয়েই থেকে যায়। অনেক সময় দামী ও রংচঙে রাখীর নিচে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পবিত্র রাখি বন্ধন উৎসব এর সেই পুরোনো মহিমাময় ঐতিহ্য ও গৌরব। উত্তর প্রদেশের মথুরা এবং বৃন্দাবন শহরগুলির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ ধাম ও শান্তিপুরে অত্যন্ত আড়ম্বর ও আনন্দের সাথে উদযাপিত হয়। সারা দেশে ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে কৃষ্ণমন্দির, জগন্নাথ মন্দির এবং অন্যন্য মন্দিরেও ঝুলন যাত্রা পালিত হয়। সারা বিশ্ব এবং সারা দেশ থেকে ভক্তরা এই মন্দির গুলিতে উৎসব উদযাপন করতে সমবেত হন। এই বছর রক্ষাবন্ধন বা রাখিপূর্ণিমা বাংলা ২৩ শে শ্রাবণ ১৪৩২ সাল শনিবার (09.08.2025)। পূর্ণিমা তিথি শুরু হচ্ছে ৮ আগস্ট, শুক্রবার বেলা ১ টা বেজে ৫৭ মিনিটে ও শেষ হচ্ছে ৯ আগস্ট শনিবার বেলা ১ টা ৪১ মিনিটে। সবাইকে শুভ ঝুলন পূর্ণিমা ও রক্ষাবন্ধনের শুভেচ্ছা। আজ এই শুভ দিনে জগৎগুরু ভগবান প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ সবার শিরে বর্ষিত হোক এই প্রার্থনা করি।
ওঁ গুরু কৃপাহি কেবলম্ ….!

Share This
Categories
প্রবন্ধ

স্মরণে বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও কালজয়ী গীতিকার – শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।।।।।।

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি এবং কালজয়ী গীতিকার। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে অসাধারণ গানের কথা সাজিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র ও আধুনিক সঙ্গীত জগতে যাঁরা উপহার দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩২ সালে খুলনা, ব্রিটিশ ভারতের, বর্তমানে বাংলাদেশ জন্মগ্রহণ করেন।

বাবা শচীগোপাল ব্যানার্জি ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার এবং মা রাধারানী দেবী ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের যোদ্ধা। তিনি স্থানীয় একটি স্কুলে তাঁর পড়াশোনা করেছেন। দেশভাগের দাঙ্গার সময় তিনি বাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় আসেন দিদি শিবানী চ্যাটার্জির বাড়িতে, যিনি দক্ষিণ কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত প্রাবন্ধিক এবং চিত্রশিল্পী। আশুতোষ কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন এবং স্নাতক হন। কিছুদিনের মধ্যেই স্থানীয় খানপুর স্কুলে মাইনর মাইনেতে টিচারের চাকরি পান। কিন্তু দিদি শিবানী চট্টোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়, দেশ, বসুমতীসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কেউ কেউ চল্লিশ ও ষাটের দশকের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত শিল্পী অপরেশ লাহিড়ীর প্রেরণায় “ক্রান্তি শিল্পী সংঘ” এর জন্য গান লিখে খ্যাতি লাভ করেন। তার কবিতা তথা গানে সাধারণ মানুষের সমস্যা উঠে এসেছে। অপরেশ লাহিড়ী, ভূপেন হাজারিকা,ভি.বালসারা,ইলা বসু মান্না দে’র সঙ্গে তার কাজ প্রশংসনীয়। চলচ্চিত্রের জন্য গান ও আধুনিক বাংলা গান ছাড়াও চিত্রনাট্য ও নাটক রচনা করেছেন তিনি। ইলা বসু, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, রুণা লায়লা, রুমা গুহঠাকুরতা, কিশোরকুমার, অংশুমান রায়, মান্না দে,ভূপেন হাজারিকা লতা মঙ্গেশকর সহ বহুস্বনামধন্য শিল্পীদের সুললিত কণ্ঠ-মাধুর্যে কালজয়ী হয়েছে তার রচিত গানগুলি।
তাঁর রচিত কয়েকটি কালজয়ী গান—
সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল, বিস্তীর্ণ দুপারে, আমি এক যাযাবর, ভালো করে তুমি চেয়ে দেখো, ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম'(ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়ার), তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, এই তো বেশ আছি একেলা, আমার কবিতা ছবি আঁকে সঞ্চিত ব্যথা, বাজে না জীবনের এই বীণা, আমার ব্যাটার বিয়া দিব সময় হয়েছে, ময়লা কাগজ কুড়ানো ছেলে, এই কি পৃথিবী সেই, একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে, সরস্বতী বিদ্যেবতী তোমায় দিলাম খোলা চিঠি,সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা, হাওয়া মেঘ সরায়ে ফুল ঝরায়ে, গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা, কত রাজপথ জনপথ ঘুরেছি, আকাশের সিঁড়ি বেয়ে, ভারত আমার ভারতবর্ষ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো, ওরে আমার ভালবাসার ইছামতী রে, মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা প্রভৃতি।
সম্মাননা—-
কালজয়ী গানের এই গীতিকারের সম্মানে কলকাতা পুরসভার সৌজন্যে ১১২ নম্বর ওয়ার্ডে একটি আবক্ষ তাম্রমৃর্তি স্থাপন করা হয়।
জীবনাবসান—
শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ই আগস্ট কলকাতায় প্রয়াত হন।

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

নেপোলিয়ন বোনাপার্টের শেষ যাত্রা : সেন্ট হেলেনার যাত্রা।।।।।

8 আগস্ট, 1815, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের শেষ যাত্রার সূচনা হিসাবে চিহ্নিত করে, যখন তিনি প্রত্যন্ত দ্বীপ সেন্ট হেলেনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন, যা তার নির্বাসনের শেষ স্থান। একসময়ের পরাক্রমশালী ফরাসি সম্রাট, যিনি ইউরোপের অনেক অংশ জয় করেছিলেন, তিনি এখন ব্রিটিশদের বন্দী ছিলেন, ওয়াটারলু যুদ্ধে পরাজয়ের পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন।

নেপোলিয়নের পতন—-

নেপোলিয়নের পতন 1812 সালে শুরু হয়েছিল, যখন তার রাশিয়ার বিপর্যয়কর আক্রমণ তার সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দিয়েছিল এবং তার সম্পদকে নিষ্কাশন করেছিল। ব্রিটেন, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং প্রুশিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ষষ্ঠ জোট তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল এবং একটি সিরিজ আক্রমণ শুরু করেছিল যা তাকে ইউরোপ জুড়ে পিছনে ঠেলে দেয়।

1814 সালের এপ্রিলে, নেপোলিয়নকে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং তাকে ভূমধ্যসাগরের একটি ছোট অঞ্চল এলবা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়েছিল। যাইহোক, তিনি 1815 সালের ফেব্রুয়ারিতে এলবা থেকে পালিয়ে যান এবং স্বল্প সময়ের জন্য ফ্রান্সে ক্ষমতায় ফিরে আসেন, যা হানড্রেড ডেস নামে পরিচিত।

ওয়াটারলু যুদ্ধ—–

নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয় 18 জুন, 1815 এ, ওয়াটারলু যুদ্ধে, যেখানে তিনি ওয়েলিংটনের ডিউক এবং ফিল্ড মার্শাল গেবার্ড ভন ব্লুচারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ও প্রুশিয়ান বাহিনীর একটি জোটের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হন। প্রচণ্ড লড়াই সত্ত্বেও, নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল এবং তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে বাধ্য হন।

ব্রিটিশরা নিয়ন্ত্রণ নেয়—–

ওয়াটারলুর পর, নেপোলিয়নকে ব্রিটিশ হেফাজতে নেওয়া হয়, এবং ব্রিটিশ সরকার তাকে একটি দূরবর্তী স্থানে নির্বাসিত করার সিদ্ধান্ত নেয় যেখানে তিনি আর হুমকির সম্মুখীন হতে পারেন না। দক্ষিণ আটলান্টিকের একটি ছোট দ্বীপ সেন্ট হেলেনাকে তার চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল।

সেন্ট হেলেনা ভ্রমণ—-

8 আগস্ট, 1815-এ, নেপোলিয়ন ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস বেলেরোফোনে চড়েছিলেন, যেটি সেন্ট হেলেনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। সমুদ্রযাত্রাটি দীর্ঘ এবং কঠিন ছিল, শেষ হতে দুই মাসের বেশি সময় লেগেছিল। বোর্ডে নেপোলিয়নের সাথে তুলনামূলকভাবে ভাল আচরণ করা হয়েছিল, তবে তাকে সর্বদা নিবিড় পাহারায় রাখা হয়েছিল।

সেন্ট হেলেনা জীবন—-

নেপোলিয়ন 17 অক্টোবর, 1815 তারিখে সেন্ট হেলেনায় পৌঁছান এবং তাকে তার নতুন বাসভবন লংউড হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়িটি স্যাঁতসেঁতে এবং বাতাসে ভেসে গিয়েছিল এবং নেপোলিয়নের স্বাস্থ্য দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে। তাকে বাগানে হাঁটতে এবং ব্যায়াম করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাকে কখনই সম্পত্তি ছেড়ে যেতে দেওয়া হয়নি।
নেপোলিয়নের শেষ বছরগুলি অসুস্থতা, একঘেয়েমি এবং হতাশা দ্বারা চিহ্নিত ছিল। তিনি সর্বদা ব্রিটিশ রক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন এবং তাকে দর্শক গ্রহণ বা বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

সেন্ট হেলেনায় মৃত্যু—–

নেপোলিয়ন 5 মে, 1821 সালে 51 বছর বয়সে মারা যান, সম্ভবত পাকস্থলীর ক্যান্সার বা আর্সেনিক বিষক্রিয়ার কারণে। তার মৃত্যু ব্রিটিশদের জন্য স্বস্তি ছিল, যারা তার ক্রমাগত দাবি ও অভিযোগে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
নেপোলিয়নের উত্তরাধিকার
তার চূড়ান্ত পরাজয় এবং নির্বাসন সত্ত্বেও, নেপোলিয়নের উত্তরাধিকার বেঁচে ছিল। তাকে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক মনের একজন হিসাবে স্মরণ করা হয় এবং ইউরোপীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে তার প্রভাবকে অতিরঞ্জিত করা যায় না। তার আইনের কোড, নেপোলিয়নিক কোড নামে পরিচিত, আজও অনেক দেশে ব্যবহৃত হয়।

উপসংহার—-

সেন্ট হেলেনায় নেপোলিয়ন বোনাপার্টের যাত্রা একটি যুগের অবসান ঘটিয়েছিল, কারণ একসময়ের পরাক্রমশালী সম্রাট ব্রিটিশদের বন্দী হয়েছিলেন। তার শেষ বছরগুলি কষ্ট এবং পতনের দ্বারা চিহ্নিত ছিল, কিন্তু তার উত্তরাধিকার আমরা আজ যে বিশ্বে বাস করি তা গঠন করে চলেছে।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

রেড ক্রসের গঠন : মানবিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক।।।।।

8 আগস্ট, 1864, মানবিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক চিহ্নিত করে, কারণ এই দিনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে রেড ক্রস গঠিত হয়েছিল। রেড ক্রস, ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট মুভমেন্ট নামেও পরিচিত, একটি মানবিক সংস্থা যা যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য সংকট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জরুরী সহায়তা, দুর্যোগ ত্রাণ এবং শিক্ষা প্রদান করে।

একটি ধারণার জন্ম—–

যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রেড ক্রসের ধারণার জন্ম হয়েছিল। 1859 সালে, হেনরি ডুনান্ট, একজন সুইস ব্যবসায়ী, সলফেরিনোর যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যেখানে হাজার হাজার সৈন্য আহত হয়েছিল এবং চিকিৎসা ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়েছিল। ডুনান্ট যে দুর্দশা দেখেছিলেন তার দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধের সময়ে মানবিক সহায়তা প্রদান করতে পারে এমন একটি নিরপেক্ষ সংস্থার প্রয়োজন ছিল।
1862 সালে প্রকাশিত ডুনান্টের বই, “এ মেমোরি অফ সোলফেরিনো”, আহত সৈন্যদের যত্নের জন্য জাতীয় ত্রাণ সমিতি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিল। বইটি ইউরোপ জুড়ে আগ্রহের ঢেউ ছড়িয়ে দেয় এবং 1863 সালে জেনেভায় আহতদের জন্য আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করা হয়।

প্রথম জেনেভা কনভেনশন—-

1864 সালের 8 আগস্ট, প্রথম জেনেভা কনভেনশনে 16টি দেশ স্বাক্ষরিত হয়েছিল, রেড ক্রসকে একটি নিরপেক্ষ মানবিক সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। কনভেনশন রেড ক্রস প্রতীককে স্বীকৃতি দিয়েছে, একটি সাদা পটভূমিতে একটি লাল ক্রস, চিকিৎসা কর্মীদের এবং সুবিধার জন্য একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রতীক হিসাবে।

কনভেনশনটি বেসামরিক, আহত এবং যুদ্ধবন্দীদের সুরক্ষা সহ মানবিক আইনের নীতিগুলিও প্রতিষ্ঠা করে। এই নীতিগুলি তখন থেকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ভিত্তি হয়ে উঠেছে।

বৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণ—

প্রথম জেনেভা কনভেনশনের পরের বছরগুলিতে, রেড ক্রস আন্দোলন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ন্যাশনাল রেড ক্রস সোসাইটি ইউরোপ জুড়ে এবং তার বাইরের দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সংস্থাটি মানবিক সাহায্যের জন্য একটি বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, রেড ক্রস সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকদের চিকিৎসা সেবা এবং ত্রাণ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সংস্থাটি ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস (ICRC) প্রতিষ্ঠা করতেও সাহায্য করেছিল, যেটি আজও রেড ক্রস আন্দোলনের গভর্নিং বডি।

তারপরের দশকগুলিতে, রেড ক্রস বিশ্বজুড়ে নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সংকটের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবর্তিত এবং সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে। আজ, রেড ক্রস বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সম্মানিত মানবিক সংস্থাগুলির মধ্যে একটি, যার উপস্থিতি 190 টিরও বেশি দেশে রয়েছে।

প্রভাব এবং উত্তরাধিকার—

রেড ক্রস গঠন মানবিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে। সংস্থাটি অগণিত জীবন বাঁচিয়েছে, সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ মানুষকে সান্ত্বনা ও সহায়তা প্রদান করেছে এবং মানবিক আইনের নীতিগুলি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে।
বিশ্বজুড়ে শান্তি ও বোঝাপড়ার প্রচারে রেড ক্রসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার নিরপেক্ষতা এবং নিরপেক্ষতার মাধ্যমে, সংস্থাটি সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও মানুষকে একত্রিত করতে এবং সংলাপ সহজতর করতে সক্ষম হয়েছে।

উপসংহার—

1864 সালের 8 আগস্ট রেড ক্রসের গঠন মানবিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। জেনেভায় তার নম্র সূচনা থেকে, সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাহায্য ও সমর্থন প্রদান করে, ভালোর জন্য একটি বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আমরা যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, রেড ক্রস আশার আলো এবং অন্যদের জীবনে পরিবর্তন আনতে মানবতার শক্তির অনুস্মারক হিসাবে রয়ে গেছে।

Share This