Categories
নারী কথা রিভিউ

প্রাণে প্রাণে যে প্রদীপ জ্বলে : জয়তী ধর পাল।

একই বৃন্তে যেমন দুটি কুসুম ফুটে ওঠে , তেমনি একটি মহীরূহকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে দুটি সাহিত্যকুসুম। মহীরূহটি অবিভক্ত মেদিনীপুরের জনপ্রিয় গান্ধিবাদী নেতা শ্রী কুমারচন্দ্র জানা , আর সাহিত্যকুসুম দুটির একটি উপন্যাস ‘মাটিমাখা মহাপ্রাণ’ , অপরটি নাটক ‘সুতাহাটার গান্ধি’।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন , নাটকে লোকশিক্ষে হয়। এই লোকশিক্ষে যথার্থ না হলে , স্বাধীন দেশেও আমরা পরাধীন থাকব। আর তাই স্বাধীনতার স্বপ্ন আমাদের যারা দেখিয়েছিলেন তাদের অন্যতম পুরোধা দেশমিত্র কুমারচন্দ্র জানাকে আশ্রয় করে কবি শুভ্রাশ্রী মাইতি লিখেছেন নাটক ‘সুতাহাটার গান্ধি’ , যে নাটক আমাদের স্বাধীনতার যথার্থ চালচিত্রের সাথে পরিচিত করায় আলোর কলমে।
কুমারচন্দ্র জানার ব্যক্তিগত জীবন আর স্বাধীনতার সংগ্রামের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটকে নাট্যকার খুব অল্প পরিসরে এই পাঁচ অঙ্কের নাটকে জীবন্ত করে তুলেছেন এক অসাধারণ দক্ষতায়। সময়ের প্রতীক হিসাবে গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো চরিত্রগুলির ভাষ্য কোরিওগ্রাফির মধ্যে দিয়ে প্রবাহমান সময়কে বহতা নদীর মতোই উপস্থাপন করেছেন । কোরিওগ্রাফি কোথাও কোথাও মঞ্চে জন্ম দেয় কবিতার…
(অন্ধকার মঞ্চ জুড়ে জোনাকির ছোট ছোট বৃত্ত আলোর নকশা তৈরি করবে তখন। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে সেই দিকে …। আবহ – ও জোনাকি কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ…)।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের মঞ্চ উপস্থাপনা দর্শক মনে জন্ম দেয় শিহরনের…
(ঝুঁকে থাকার সময়রূপী সামনের জন সামনের প্লেটে রাখা লাল আবির ছিটিয়ে দেবে চারপাশে। গুলির শব্দ । পেছনের পর্দায় আলোর ঝলকানি, লাল আলো। চিৎকার। আর্তনাদ। সময়রূপী পাঁচজন লাল কাপড়ের বাঁধনে নিজেদের জড়াতে জড়াতে প্রকাশ করবে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে ধীরে ধীরে।)
ছোট্ট কুমার বিদ্যাসাগরের মতো মহাপুরুষদের গল্প হলেও সত্যি কথা পড়তে পড়তে বড় হয়ে ওঠে , অন্যকে শ্রদ্ধা তার ভেতরে এক আলোর জন্ম দেয় , আর সেই আলো হাজার কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়ার সময় বের করার অঙ্গীকারবদ্ধ করে তাঁকে। কুমার তার জীবনের মূলমন্ত্রে ‘ ঠকিলেও , ঠকাইব না ‘ ( যা বইটির প্রচ্ছদে ধ্রুবপদের মতো ব্যবহৃত হয়েছে ) দীক্ষিত করেন তার ছাত্রদের , যারা এই দেশের ভবিষ্যৎ। নাটকে পাই ,
কুমার : তা পারে। তবে একটা কথা মনে রেখো সবসময়- ‘ঠকিলেও ঠকাইব না’। এই দরিদ্র মাস্টারের আর কিছু না হোক , এই কথাটিকে জীবনের ধ্রুবতারা করে তোলো তোমরা।
সকলে : ঠকিলেও ঠকাইব না। ঠকিলেও ঠকাইব না।
তিনি প্রকৃতই একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে মানুষ গড়ার কারিগরের ভূমিকা নেন তাই বালিগঞ্জ জগবন্ধু ইনস্টিটিউশন এর সভাপতি আশুতোষ চৌধুরী। বলেন,
আশুতোষ : এ একেবারে খাঁটি কথা মুরলীবাবু । কুমারবাবু শুধু পুঁথিপড়া বিদ্যাদিগ্গজ ছাত্র নয় , দেশের জন্য খাঁটি সোনার মানুষ গড়ার কাজে হাত লাগিয়েছেন জোরকদমে। উনি আমাদের স্কুলের সম্পদ।
কুমার অনুভব করেন ‘দেশ মানে শুধু বাহিরমহল নয় , দেশ মানে অন্দরমহলও , আমাদের অন্তরমহলও’। এই উপলব্ধি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত করে …
কুমার : মানে শুধু আমাদের , মানে পুরুষজাতির উন্নতি হলেই হবে না , আমাদের অন্তর ছুঁয়ে আছেন যাঁরা , অন্তর তৈরি করছেন যাঁরা , তাঁদেরও তুলে আনতে হবে ঘরের অন্ধকার কোন থেকে। সামিল করতে হবে এই দেশ গঠনের মহাযজ্ঞে।
তাই স্ত্রী চারুশিলার সাথে বিবাহবন্ধনকে নাট্যকার চিহ্নিত করেছেন ‘শ্রী যোগ হল শক্তির সাথে’ বলে।
হিন্দু মুসলমানের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালবাসা ফিরে ফিরে এসেছে নাটকটিতে। মুহুরি ভূদেব চক্কোত্তির হুমকির উত্তরে কুমার দৃঢ় স্বরে বলেন,
কুমার : আমাকে ভাঙবেন আপনি কি করে ? আমাকে ভাঙতে গেলে যে এই আশ্রম ভাঙতে হবে। এই দেশ ভাঙতে হবে , ভাঙতে হবে হিন্দু-মুসলমানের ভাই-ভাই সম্পর্ক। তা কি আর আমি হতে দেবো কখনো? তোমরা কি দেবে বলো?
কুমার যখন এ কথা বলেন তখন কুমারের মধ্যে যেন অখন্ড গোটা ভারতকে দেখতে পাই তাই। কুমারনারায়ন তথা কুমারচন্দ্র হয়ে ওঠেন মহম্মদ কুমারচন্দ্র ,
মৌলভী : ( ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেন কুমারকে ) আপনি সাধারণ মানুষ নন কুমারবাবু , আজ আপনি চোখ খুলে দিলেন সবার। আপনাকে প্রণাম। আজ থেকে আপনার আরেক নাম হল মহম্মদ কুমারচন্দ্র ।
সকলে : জয় কুমারচন্দ্রের জয় , মহম্মদ কুমারচন্দ্রের জয়।
নাট্যকার প্রতিটি চরিত্রের মুখে যথাযথ সংলাপ প্রয়োগ করে তাদের করে তুলেছেন জীবন্ত রক্ত মাংসের মানুষ। তারই কয়েকটি নিদর্শন ,
১. মিস্টার স্মিথ : শাট্ আপ , রাস্কেল ! কে চায় টুমাদের সাহায্য ? ব্ল্যাক নিগার কোথাকার । টুমি যে হাসছিলে হামার ড্রেসের কাদা ডেকিয়া… সেটা কি অপমান নয় যথেষ্ট ?
২. গোমস্তা : খালি বিগ্ টক , বিগ বিগ টক্ , তাই না ! বুঝবে একদিন মজা… একটা ছোট জাতকে মাথায় তুলে নাচা…
৩. ফতেমা : (ছুটে এসে কুমারের পায়ে পড়ে কাঁদতে থাকে) দাঠাউর মুই কুন অন্যায় কাম করি নাই গো। প্যাটের জ্বালা নিভাতে , মেয়া লাতির মুখে দুটা অন্ন তুলি দিবার জন্য কাম করিতে চাইছিলি শুধু । এ গেরামে মোর খসমের ভিটাবাড়ি। মুই কখনো এর অমঙ্গল চাইতি পারি?
৪. কুমার : জানি না সূর্য । বুকের মধ্যে কে যেন ডাক দিয়ে যায় বারবার । গাঁয়ের ফকিরবাবার সুর ভেসে আসে কানে । গান্ধিজির গলার স্বর গমগম করে ওঠে, সুরেনবাবুর বক্তৃতায় শিরা-উপশিরায় আগুন ছোটে যেন… আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল হয় খুব। কান্না দলা পাকিয়ে উঠে গলায়। আমার মা আমার দেশ – সব যেন একাকার হয়ে যায় আমার কাছে।
বেশিরভাগ দৃশ্য শেষ হচ্ছে গানের মধ্যে দিয়ে যা ঘটনা রেশকে দর্শকমনে অনুরণিত করে।
পরানচক স্কুলের মাস্টারমশাই মানসবাবু বলেন,
মানসবাবু : কুমার , তোমার মধ্যে আমি খাঁটি সোনা দেখেছি। আমি চাই তোমার মত ছেলেরা নিজেকে প্রস্তুত করে তুলুক । নিজেকে চিনুক। দেবদূত হয়ে ফিরে আসুক এ পোড়া দেশ গাঁয়ে। মানুষের সামনে আয়না ধরুক , নিজেকে চেনার নিজেকে জানার… আঁধার কেটে যাক সব নতুন দিনের আলোয় …ওই শোনো ফকির বাবা গান ধরেছেন কেমন…
নাটকটিও যেন দর্শকদের সামনে তুলে ধরে এক আয়না, যার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয় আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন।
নাটকের শেষে সময়ের হাত ধরে তৈরি হয়, এক অপূর্ব কবিতা …অপূর্ব আলো… অপূর্ব বন্দনা …অনন্ত …অফুরন্ত…
(সকলে একটি সুন্দর কোরিওগ্রাফিতে মাটিতে হাঁটু ঠেকিয়ে বসবে। প্রদীপজ্বলা হাত বাড়িয়ে থাকবে সামনে… নতুন দিনের আলো একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়বে নাটকের মঞ্চেও। )
আবহে বাজবে –
ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়
তোমারি হউক জয়…

‘মাটিমাখা মহাপ্রাণ’ এক আলোমাখা উপন্যাস , এ আলো ভোরের সূর্যোদয়ের মতোই আশাবাদী , দুপুরের তেজদীপ্ত গগনের মতোই অগ্নিময় , সন্ধ্যের গোধূলির মতোই স্নিগ্ধ শান্তি বর্ষণকারী।
একজন মহামানবের জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে লেখক শুভঙ্কর দাস যে চালচিত্র রচনা করেছেন …যে স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এঁকেছেন… তাতে সমকালীন দেশ কালকে নিপুন বুনোটে সাজিয়েছেন। লেখনীর অমোঘ আকর্ষণে সময়দেবীর সুতোতে টান পড়েছে , সেই টানে যেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বিদ্যাসাগর , গান্ধীজি , বীরেন্দ্র শাসমল , আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র , মদনলাল ধিংড়ার মতো অসামান্য চরিত্ররা , তেমনি বিধবা হররমা পতি বা রমানাথের মত আড়ালে থেকে যাওয়া নিঃস্বার্থ মানুষেরা তাদের আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। আর আছেন রবীন্দ্রনাথ , প্রতিটি অধ্যায়ের পথ চলার শুরুতে তাঁর আলোকোজ্জ্বল উদ্ধৃতি নিয়ে পথপ্রদর্শক হয়ে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে লেখকের মনের মাধুরী মিশিয়ে কিছু কাল্পনিক চরিত্র , যারা উপন্যাসটিকে মাটির রূপকথা করে তুলেছে এক আশ্চর্য রূপটানে। যেমন আব্দুল ফকিরের চরিত্রটি বারবার ফিরে ফিরে এসেছে , যে গানে গানে প্রকৃত মানুষ হবার শিক্ষা দেয় , যে বলে ,
‘মনকে বলো , জগতে সবই সুন্দর , কালো এলে আলো করব , আর কান্না এলে পান্না দেখব , এইভাবেতে বাঁচতে চাই…।’
রবীন্দ্রনাথের কথায় , ‘ ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূলরস হবে মানবরস ‘। এই উপন্যাসের প্রতিটি অক্ষরে সেই মানবরসের ধারা নদীর মতই বহমান। দেশের জন্য আত্মোৎসর্গের দৃঢ় পণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সন্তানস্নেহ , ভ্রাতৃপ্রেম ,সহধর্মিণীর আত্মত্যাগ , বন্ধুবাৎসল্য , গুরুজনকে শ্রদ্ধার দৃঢ় ভিত্তি প্রস্তরের উপর। কুমারের বাবা গরিব চাষী ঠাকুরদাস একটা ছেঁড়া বইয়ের পাতা নিয়ে ঘোরেন বইটি সংগ্রহের চেষ্টায় , যার জন্য তিনি নিজের সারা বছরের অন্নসংস্থানে চাল বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত। এই উত্তরাধিকারই বহন করেন কুমার। শিশু কুমার ঝড় জলের সারারাত কেঁদে কেঁদে খোঁজে বর্ণপরিচয় , উঠোনকে স্লেট করে লিখে চলে অ আ। কুমারের মা লক্ষ্মীদেবী পানাভর্তি পুকুর পরিষ্কার করে , পুকুরপাড়ে ডাঁই হয়ে ওঠা কচুরিপানা দেখিয়ে বলেন ,
‘এই হচ্ছে দুঃখ কষ্ট আর আঘাত , পুকুর হলো জীবন , এইভাবে এগুলো সরিয়ে আলো আনতে হবে , এগিয়ে যেতে হবে , বুঝলি…’
এমন শিক্ষা যে মায়ের , তাঁর সন্তানই তো হয়ে ওঠেন অন্ধকারে নিমজ্জিত পরাধীন জাতির আলোর দিশারী। স্ত্রী চারুশীলাদেবী স্বামীর জন্য ভাত সাজিয়ে বসে থাকেন , মৃদু হেসে বলেন ,
‘যে অপেক্ষা করতে জানে, সে যার জন্য অপেক্ষা করছে , তার পদধ্বনি শুনতে পায়।’
এরকম সহধর্মিনীকে যিনি পাশে পান , তিনিই তো পারেন… একদিন ঘর ও বাহির মিলে এই দেশকে সোনার দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে…। মাস্টারমশাই ক্ষীরোদচন্দ্র কুমারের হাতে ‘আনন্দমঠ’ তুলে দিয়ে বলেন,
‘ মানুষের মতো মানুষ হও , তুমি যেন নিজেই একটা পথ হয়ে উঠতে পারো।’
এইরকম মাস্টারমশায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়েই কুমারচন্দ্র বন্ধু গঙ্গাধরকে বলে ,
‘ ভাই , আমি ধুলোর মতো হতে চাই , মাড়িয়ে যাক , থুতু ফেলুক , কিন্তু আমি তো জানি , সেই ধুলোতে জল ঢেলে কখনো মূর্তি , কখনো শস্য ফলানো যায় ! এই বিশ্বাস আমার কোনদিন হারাবে না ! ‘
এই মাটিমাখা মহাপ্রাণের ছোঁয়ায় তাই মাটি জাগে , সেইসঙ্গে জাগে মাটিমাখা মানুষগুলো , যাদের কেউ কোনদিন সম্মান করেনি , মানুষ ভাবেনি !
উপন্যাসিক শুভঙ্করের প্রথম পরিচয় তিনি একজন কবি , তাই কবির কলমে উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনা কোথাও কোথাও কবিতার ব্যঞ্জনায় হয়ে উঠেছে এক এক টুকরো উজ্জ্বল হীরকখন্ড ! উপন্যাসটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতির পর কবিতার ব্যঞ্জনায়…
‘চার্চের সুউচ্চ ঘন্টা-তোরণের পেছনে অস্তমিত সূর্য । দেখলে মনে হয় , সুদীর্ঘ ও সুতীব্র অন্ধকার দূর করতে করতে নিজেই তীরবিদ্ধ যোদ্ধার মতো ক্লান্ত , রক্তাক্ত এবং একাকী । সেই চার্চে এখনই ঈশ্বর-বন্দনা শুরু হবে। তার জন্য ঘন্টাধ্বনি হচ্ছে।’
অথবা , বালক কুমারের অধ্যয়নমগ্নতার বর্ণনা…
‘দূর থেকে দেখলে মনে হতো এ যেন সেই তপোবনের একটি খণ্ড দৃশ্য । সেখানে ছিল অপরূপ সবুজ গাছগাছালির সৌন্দর্য , এখানে মাঠের পর মাঠে রোদ মেঘের লুকোচুরি খেলা।
তার মধ্যে একজন একলব্যের মতো সেই রোদ-মেঘকে গুরু কল্পনা করে পড়াশুনা করে চলেছে।’
এইভাবে হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি চলে কবিতা আর উপন্যাস …তৈরি করে এক খন্ড মানব ইতিহাস !

আজকের এই দিশেহারা সমাজে নিজেকে দীপ করে জ্বালতে হবে , সেই আলোয় পথ দেখে চলতে হবে … নব প্রাণের আলোয় সমাজকে করতে হবে কলুষমুক্ত। আর সেই জীবনদীপে সলতে পাকানোর কাজটি করে দেয় , কুমারচন্দ্র জানার মত সৎ কর্মযোগী দেশপ্রেমিক সাধক মহামানবদের জীবনীপাঠ। দেশকে ভালো না বাসলে দেশের মানুষকে ভালো না বাসলে কখনোই প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা যায় না , তাইতো মানবজমিন পতিত রয়ে যায়। এইরকম নাটক , উপন্যাস , কবিতা, গল্প , প্রবন্ধ গ্রন্থ লেখা ও পাঠের মধ্যে দিয়ে সেই মানবজমিনে সোনা ফলানোর আশায় অপেক্ষায় থাকে সময় …

সুতাহাটার গান্ধি
শুভ্রাশ্রী মাইতি
লিপি প্রকাশন

মাটিমাখা মহাপ্রাণ
শুভঙ্কর দাস
লিপি প্রকাশন

Share This
Categories
রিভিউ

সাহিত্যের নিরিখে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের এক ঝলক : দিলীপ রায়।

প্রথমেই বলি, এবার ভিন্ন-ভিন্ন স্বাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম যেটা সাহিত্যের নিরিখে ভীষণ প্রাসঙ্গিক !
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলা সমিতির আমন্ত্রণে আমার বাংলাদেশ সফর ।
একুশে ফেব্রুয়ারি (২০২৩) ফ্লাইট থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে সোজা গিয়েছিলাম “আসমান-জমিন” পত্রিকা অফিস উদ্বোধনে । সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ৭ বারের সংসদ সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ছাত্র নেতা শ্রদ্ধেয় আ স ম ফিরোজ, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বার্তা সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক আয়ুব ভুঁইয়া এবং কলামিস্ট, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মীর আব্দুল আলীম । স্বল্প পরিসরে সাংবাদিক-সাহিত্যিকদের নিয়ে সুন্দর একটি উচ্চ-মানের অনুষ্ঠান । তারপর সোজা যাই শহীদ মিনার । সেখানে শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি । এটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলা সমিতি একটি সমৃদ্ধশালী সাহিত্য সংগঠন । সংগঠনটি এপার-বাংলা ও ওপার-বাংলার কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরী করার নিরিখে এবং ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় করার অভিপ্রায়ে একুশে বইমেলা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে “ভারত-বাংলাদেশ জাতীয় সাহিত্য উৎসব-২০২৩” গত ২২শে ফেব্রুয়ারী (২০২৩) সংঘটিত করলো । যে অনুষ্ঠানের ভারতের পক্ষ থেকে আমি ছিলাম যুগ্ম আহ্বায়ক । সুন্দর একটি উচ্চ-মানের সাহিত্য অনুষ্ঠান । সারাদিন ব্যাপী কবিতা, আবৃত্তি, ছড়া, গান, আলোচনায় অনুষ্ঠানটি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠেছিল । বাংলাদেশ সরকারের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট মিনিস্টার উপস্থিত ছিলেন । একজন মাননীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ ও অন্যজন মাননীয় পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী । অনুষ্ঠানটি ফিতে কেটে উদ্বোধন করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মোঃ আখতারুজ্জামান । সারাদিন অনুষ্ঠানের মাঝে একান্ত কাছে পেয়েছিলাম বরিষ্ঠ কবি ও একুশের পদক জয়ী অসীম সাহা, শিশু সাহিত্যিক ও একুশের পদক জয়ী আসলাম সানী, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বার্তা সম্পাদক আয়ুব ভুঁইয়া ও বাংলা একাদেমির সভাপতি সেলিনা হোসেনকে । পরে দেখা হয়েছিল ভ্রাতৃসম জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র পরিচালক ড. মাসুদ পথিকের সাথে । সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভ্রাতৃসম আবু হানিফ হৃদয় । উল্লেখ থাকে যে, ভারত থেকে আমরা যথেষ্ট সংখ্যায় কবি, লেখক, বাচিক শিল্পী, সাহিত্যিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম । তাঁদের মধ্যে অন্যতম ড. রামপদ বিশ্বাস, পার্থসারথি ঝা, দিলীপ কুমার প্রামাণিক, বুলু রায়, সুমিতা পয়ড়্যা, নন্দিনী লাহা, প্রমুখ । এই ধরনের বরিষ্ঠ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে এবং যথোপযুক্ত সম্মান পেয়ে আমি “নারায়নগঞ্জ জেলা সমিতি”এর কাছে নতমস্তকে কৃতজ্ঞ । অনুষ্ঠানটি সফলভাবে পরিচালনার জন্য অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ও সদস্য-সচিব মীর আব্দুল আলীমকে (কলামিস্ট, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক) আমার অন্তরের ভালবাসা ও শুভকামনা ।


পরেরদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভুলতায় অবস্থিত আল-রফি হাসপাতাল পরিদর্শন করার পর হাজির ছিলাম “ব্রাইট শিশু কানন হাই স্কুল” এর অনুষ্ঠানে । অনুষ্ঠানটি সংঘটিত হয়েছিল নগরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । শিশুদের নাচ-গান সহ হৃদয়গ্রাহী একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । এক কথায় বাচ্চাদের সুন্দর একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান । এখানে রাসেল আহমেদ (সাংবাদিক) ভাইয়ের আতিথেয়তা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক । ১৩টি রসনা তৃপ্ত দেশি মাছের ডিস দিয়ে দুপুরের আহারের ব্যবস্থা, একটি চরম পাওয়া । পরেরদিন সকালে পৌঁছালাম “রক্তের বন্ধন ফাউন্ডেশন” প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অনুষ্ঠানে । এই প্রতিষ্ঠানটি সমাজের হিতার্থে রাত-দিন সমানে কাজ করে চলেছে । এইজন্য রক্ত-যোদ্ধাদের আমার হার্দিক অভিনন্দন । রক্ত-যোদ্ধাদের অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে ছুটলাম “দৈনিক দিন প্রতিদিন” পত্রিকার বার্ষিক অনুষ্ঠানে । বাংলাদেশের বরিষ্ঠ সাংবাদিকরা সেখানে হাজির ছিলেন । সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে গিয়ে আমি বললাম, “আপনারা অর্থাৎ সাংবাদিকেরাই পারেন দেশ উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা নিতে ।“ সুন্দর একটি অনুষ্ঠানের সাক্ষী রইলাম । শেষদিন হাজির ছিলাম “রূপগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ” আয়োজিত দুই বাংলার সাহিত্য সম্মেলনে । সেখানে অনেক গুণী কবি-সাহিত্যিকেরা উপস্থিত ছিলেন । এছাড়া ছিল বন্ধুবর মীর আব্দুল আলীমের বাড়িতে স্বল্প সময়ের জন্য আতিথেয়তা গ্রহণ !
পরিশেষে ভারতের কথা সাহিত্যিক হিসাবে আমার উপলব্ধি, “বাংলাদেশ সফরের ফলে দুই দেশের মানুষের ভালবাসার বাঁধন আরও মজবুত হলো ।“

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ও আমরা বাঙালী : প্রশান্ত কুমার দাস।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী –দিনটিকে আমরা বাঙালীরা ভুলতে পারিনা। বাঙালির কাছে এ এক স্মরণীয় দিন । ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই দিন বাংলাদেশে ‘শহীদ দিবস’ রূপে পালিত হয় আর ২০০০ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী “আর্ন্তজাতিক মাতৃদিবস” হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
আমাদের মাতৃভাষা- বাংলাভাষা-যে ভাষায় নিতাই- গোরা সারা দেশে ভক্তিস্তোত্র বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন- যে ভাষাতে রবীন্দ্রনাথ,বঙ্কিমচন্দ্র,মধুসূদন,শরৎচন্দ্র বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন – এই ভাষাতেই বিদ্রোহি কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রক্ত-ঝরা কবিতা লিখে ব্রিটিশ শক্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন – এই ভাষাতেই ‘হরিবোল’ গাইতে গাইতে আমরা ভবসাগর পার হয়ে যায়।
এই ভাষাতেই আমরা বাঙালীরা বড় হয়েছি, কথা বলেছি, গান গেয়েছি এবং আজও বেঁচে আছি।
কিন্তু এই মাতৃভাষা দিবসটা সিক্ত হয়ে রয়েছে অনেক সন্তানহারা-মায়ের অশ্রুজলে- তাই ভুলতে পারছিনা ছেলে- হারা-মায়ের অশ্রুতে গড়া একুশে ফেব্রুয়ারীর কথা। কারন এই দিনটিতে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর কয়েকশ বাঙালী ভাইয়ের রক্তে রঙিন হয়ে উঠেছিল- এদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনের নাম প্রকাশ্যে আসে-তারা হলেন আব্দুল সালাম, বরকত জব্বর,আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমেদ ও শফিউর।
সেই রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি আজও মুছে যাইনি এবং শত শত বছর পরেও মুছে যাবেনা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো কিন্তু দ্বিখন্ডিত হয়ে – একটি ভারত যুক্তরাষ্ট্র অপরটি পাকিস্তান রাষ্ট্র ।তবে পাকিস্তান দ্বি-খন্ডিত রূপে- পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান । পাকিস্তানে যেমন উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হলো তেমনি বাংলাদেশেও(পূর্ব পাকিস্তানে) ঊর্দুকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো। তারা ঊর্দূভাষার ডাকটিকিট প্রকাশ করলো, ফর্মে ও খামে এবং সমস্ত ধরনের সাইনবোর্ডে ঊর্দূকে স্থান দিল।
কিন্তু বাংলার জনৈক মুসলিম ভাই মহঃ শহীদুল্লা উচ্চকণ্ঠে জানালেন –“আমরা যেমন মুসলমান সত্য, তেমনি আমারা বাঙালী”। অতএব বাংলাকেই আমাদের দেশে মর্যাদা দিতে হবে।“১৯৪৮ সালে আলিজিন্না জানালেন – পাকিস্তানে উর্দূই হবে রাষ্ট্রভাষা“। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনও জানিয়ে দিলেন- এদেশে উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
কিন্তু বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা এই দাবীকে অগ্রাহ্য করলো এবং ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারে ঘোষিত ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে মিছিল নিয়ে এগিয়ে চললো বীর বিক্রমে।কিন্তু সরকার নৃশংসভাবে জনতার উপর গুলি চালালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে – যেখানে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লো কতশত তরুন তরতাজা যুবক। কয়েক শত হতাহত তরুণ প্রান-রক্তে লাল হয়ে উঠলো ঢাকার রাজপথ । বেশির ভাগ শহীদ হওয়া রক্তাক্ত দেহকে হাপিস করে দেওয়া হলো।
কিন্তু মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন থামলো না, বরং আরও তীব্রতর হলো পৃথিবীর ব্যাপী বিভিন্ন প্রান্তে । শেষকালে ১৯৯৮ সালে ২৯ শে মার্চ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব কফি আন্নানের হাতে একটি আবেদন পত্র এসে পৌঁছালো।এই আবেদন পত্রে লেখা হয়েছিল – “পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে।“ সেই আবেদন পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের কথা এবং পাঁচ জন তরুনের শহীদ হওয়ার কথা। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে সকল রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর তারিখ মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। তারপরে২০০০সালের ২১শে ফ্রেবুয়ারী প্রথম আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালিত হয়।
আজও আমরা প্রতিবছর এই দিনটিকে স্মরণ করে সেই মৃত্যুহীন প্রাণ শহীদের প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই – কবিরা নতুন নতুন গান সৃষ্টি করেন, পত্রিকায়,ম্যাগাজিনে এই দিনের তাৎপর্য নিয়ে লেখা হয়, বিভিন্ন ক্লাব ও প্রতিষ্ঠান এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে।
দুই বাংলার বাঙালিরা ভাষার আকর্ষনে এক অভিনব মিলন সেতু তৈরী করে। কলকাতার বইমেলায় দেখা যায় বাংলাদেশের কবি ও সাহিত্যিকদের ,গড়ে ওঠে বাংলাভাষীদের মৈত্রী – হিন্দু মুসলিম পৃথক সত্ত্বা ভুলে যায় – বাঙালির ভাষার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে ঐক্যতান।
কিন্তু এত কিছুর পরেও একটা বেদনা মনের মধ্যে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে কি আর বাংলা ভাষার কদর থাকবে ? দেখা যাচ্ছে ,বাংলা ভাষা বাঙালিদের কাছে ক্রমশঃ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে। সম্পন্ন ঘরের ছেলে মেয়েরা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে যাচ্ছে, বাবা-মা ছেলে মেয়েদের ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়ে গর্ববোধ করছেন। অনেকে বলেন – আমার ছেলে বেশ ভাল ইংরাজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু বাংলাটা ঠিক আসে না তাই পড়তে চায় না। আবার কেউ কেউ বাংলা ভাষা না জানাটাই গর্বের বস্তু বলে মনে করেন। শহরে এমনকি গ্রামেগঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠছে। সেখানে অনেক অনেক বেশি খরচ করে অভিভাবকগণ ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করছেন শুধুমাত্র ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবার জন্য।
আমি জানি ইংরাজি ভাষা একটা আর্ন্তজাতিক ভাষা এই ভাষাতে দক্ষতা অর্জন করা অতি অবশ্যই প্রয়োজন, এমনকি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিতেও আমদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কিন্তু বাংলাকে অবহেলা করা একদম উচিত নয়।
তাছাড়া আমাদের রাজ্যে এখনও ব্যাঙ্কে,পোষ্ট অফিসে বা সরকারী অফিসের সব ধরনের ফর্মগুলি ইংরাজি ভাষায় লিখিত। ইংরাজি নববর্ষে আমরা Happy New Year বলতে অভ্যস্ত । আমাদের কোনো অফিসে দরখাস্ত পাঠাতে হলে ইংরাজি ভাষায় লিখতে হবে। সুতরাং আমাদের বাংলার দৈন্যতার জন্য আমরাই দায়ী।
আজ আমরা যারা বাংলাকে ভালবাসি তাদের উচিত ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলাদেশের শহীদদের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানানো তেমনি আমাদের মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ বাংলাভাষাকে নতুন করে ভালোবাসা জানানো । আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে বাংলা কবিতার বই ,গল্পের বই, ঠাকুরমার ঝুলি প্রভৃতি উপহার হিসাবে তুলে দেব।কারন বাংলা ভাষাই হচ্ছে বাঙালির আশা ভরসা। বাংলা ভাষা যদি অবলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আর বাঙালির অস্ত্বিত্ব থাকবে না।
এজন্য আজ সমস্ত বাঙালিকেই সজাগ থাকতে হবে, আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
আর একটা কথা আমাদের জানা প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির শহীদ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে- তবুও এই দিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সকল ভাষা ভাষীর মানুষ নিজ নিজ ভাষাকে ভালোবাসবে, নিজের নিজের ভাষার উন্নতির চেষ্টা করবে।সাঁওতালরা তাদের সাঁওতালী ভাষাকে প্রাধান্য দিবে, নেপালীরা তাদের নেপালী ভাষার জন্য গর্ববোধ করবে, উড়িয়ারা তাদের উড়িয়া ভাষাকে উন্নততর করার চেষ্টা করবে – এমনি করে প্রতিটি ভাষার মানুষ নিজের ভাষাকে মাতৃদুগ্ধ মনে করবে। তবেই ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটি উদযাপন করা সার্থকমন্ডিত হয়ে উঠবে।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ভাষা দিবসের তাৎপর্য – একটি সমীক্ষা :: দিলীপ রায়।

মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বোধের উন্মেষ । মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে । শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও তেমন গুরুত্ব । মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে । মাতৃভূমির মতো মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয় । মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব । মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি । কারণ, এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না। মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ সম্ভব ।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, তারা উন্নয়নের ধারায় তত বেশি এগিয়ে । নিজেদের ভাষাকে উন্নত ও কার্যকরী করেই বিশ্বের জাতিসমূহ উন্নত ও অগ্রসর হতে পেরেছে ।
উনিশ শতকের ভারতীয় চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় রাজনারায়ণ বসু (০৭.০৯.১৮২৬ — ১৮.০৯.১৮৯৯) বলেছেন “জননীর স্তনদুগ্ধ যদ্রুপ অন্য সকল দুগ্ধ অপেক্ষা বল বৃদ্ধি করে, তদ্রূপ জন্মভূমির ভাষা অন্য সকল ভাষা অপেক্ষা মনের বীর্য প্রকাশ করে ।”
মাতৃভাষা হল মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রকৃত প্রকাশ মাধ্যম । তার জিয়নকাঠির স্পর্শেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা তাঁর জীবনস্মৃতিতে লেখা ) হয়, বোধের গভীরে চিন্তার বুদবুদ কারার দ্বার ভেঙে বাইরে এসে বাক‌্মূর্তি ধারণ করে । আর অন্যদিকে শিক্ষা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ । মানুষের সকল ধনসম্পত্তি মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেও অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান কখনো মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না । তাই সেই অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তস্থলের আবেগের যোগ থাকা একান্ত আবশ্যক । সেকারণে শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তরের আবেগকে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের । প্রাণের ভাষা ও প্রাণের জ্ঞান একত্রিত হলে তবেই একজন সার্থক মানুষরূপে পৃথিবীর বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে । একটা শিশুর মাতৃভাষা হলো তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ । মাতৃভাষা ‘সফলভাবে কাজ ও কথা বলার সামাজিক ধরনকে’ প্রতিফলন ঘটাতে সাহাযা করে ।
তাই মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য প্রসঙ্গে ইউনেস্কোর মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মুল তাৎপর্য হলো মাতৃভাষা নিয়ে সচেতন হওয়া ও বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখা । বাঙালিদের মতে, মায়ের মুখের ভাষাই হলো জীবন, ভাষাই হলো স্বাধীনতা ।
আবার সংস্কৃতির একটি অংশ ভাষা । তবে এ ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক । ইউনেস্কোর সম্মেলনে, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে বলা হয় – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার । মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে । সুতরাং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হলো প্রতিটি মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিশেষ করে দুর্বল ও জীর্ণ মাতৃভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোনো ভাষার উপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা । এদিবসে প্রত্যেক ভাষাভাষি মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালবাসবে তেমনি অন্যজাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে । সুতরাং বলা যায়, একুশকে ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ ।
তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন । একটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত । বাঙালী জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন ।
এবারে আসছি ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে । ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে । প্রথমে ভাষা বিক্ষোভ শুরু হয় । ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন সমগ্র পাকিস্তানে উর্দু হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা (Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan) । এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেন নি । ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে । এর প্রতিবাদে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২০শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল করে । মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে । মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন । ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সাথে সাথে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় । এতে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম সহ কয়েকজন ছাত্র যুব হতাহত হন । এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্দ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হস্টেলে সমবেত হন । নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে । ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর রাখার জন্য ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গড়ে উঠে একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬শে ফেব্রুয়ারি গুড়িয়ে দেয় । একুশে ফেব্রুয়ারি এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয় । ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি । ১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে “বাংলা ভাষা প্রচলণ বিল” পাশ হয় । যা কার্যকর হয় ৮ই মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে ।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় । এতে তরতাজা ছাত্র-যুবকেরা হতাহত হন । সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আহত ছাত্রদের দেখতে । ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিলো ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ । লাশটি দেখে তার মনে হয় এটা যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ । তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে উঠে ঃ
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লেখেন । যেমন –
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি “একুশের গান” শিরোনামে প্রকাশিত হয় । ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ যিনি সেসময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন । ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরিতে প্রথম গানটি গাওয়া হয়েছিলো । পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে । ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।
এবার আসছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রসঙ্গে । কানাডার ভ্যাঙকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুল সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসাবে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতি সংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আননের কাছে ১৯৯৮ সালে । সে সময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসাবে কর্মরত হাসান ফিরদৌসের নজরে এই চিঠিটি আসে । তিনি ১৯৯৮ সালের ২০শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন । পরে রফিক আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান । এতে একজন ইংরেজভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন । তারা আবার কফি আননকে “এ গ্রুপ অফ মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড”এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন । ১৯৯৯ সালে তারা জোশেফের সাথে ও পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন । আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫টি দেশ — কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে । ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতি সংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে । ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশন মোতাবেক এখন থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে জাতিসংঘ । সুতরাং ১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবস হিসাবে উদযাপন হয়ে আসছে ।
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক । ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের স্মরণে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের গণআন্দোলনের প্রতীক, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সুমহানস্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতীর পিতা (বাংলাদেশ) শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এদেশের মাটি থাকবে, যতদিন বাঙালির সত্ত্বা থাকবে শহীদদের আমরা ভুলতে পারবো না । আমরা কোনোক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না । এ বিজয় সাত কোটি বাঙালির বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়” ।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাদিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন । এ সময় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের করুণ সুর বাজতে থাকে।
পরিশেষে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালানো । মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে নতুন শতকের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা । বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারকে মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে দেশের সেবা করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো । সারা বিশ্বে বাঙালী জাতির কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন । তাই ২১ আমাদের গর্ব, ২১ আমাদের অহংকার । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই চেতনাকে সবার মধ্যে সঞ্জীবিত করার মধ্যেই নিহিত আছে এই মহান দিবসের সার্থকতা ।
প্রসঙ্গত, আমরা স্মরণ করতে পারি কবি অতুল প্রসাদ সেনের লেখা ঃ—-
মোদের গরব, মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা !
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা !
কি যাদু বাংলা গানে ! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
এমন কোথা আর আছে গো !
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা ।
আজ এই পুণ্যদিনে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
————————–0—————————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী (৭৪১২৩৫), ভারত

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

স্বামী বিবেকানন্দ — আজও প্রাসঙ্গিক ::: দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।।।

স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার । তিনি ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের একমাত্র শিষ্য । তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নত করে বিবেকানন্দ সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন । স্বামী বিবেকানন্দ জীবপ্রেমের দীক্ষা পান শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন ‘যত্র জীব, তত্র শিব’। জীবের সেবা করলে স্রষ্টারও সেবা করা হয় । স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ । সবার আগে মানব সেবা । সুতরাং মানুষের সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সেবা করা সম্ভব। জীবপ্রেমের দর্শন প্রকাশ পেয়েছে তাঁর দুটি চমৎকার লাইনেঃ
“বহুরুপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ?
জীবপ্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর ।“
তাই আমরা কেউ বিবেকানন্দকে পরিপূর্ণভাবে বুঝিনি । কারণ তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব । তিনি প্রচুর বই পড়তেন । দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য, ইত্যাদি বিষয়ে । তা ছাড়া তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল বেদ, উপনিষদ, ভাগবতগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, প্রভূতি হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে । যার জন্য সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ব, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ছিলো গভীর ব্যুৎপত্তি । তাই তিনি নিজেই বলেছেন, “বিবেকানন্দকে বুঝতে হলে আরেক বিবেকানন্দকে দরকার” । কর্মী বিবেকানন্দ, সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, গুরু বিবেকানন্দ, শিষ্য বিবেকানন্দ, জ্ঞানী বিবেকানন্দ, যোগী বিবেকানন্দ, কবি বিবেকানন্দ সবই বাহ্য । কারণ এই সমস্ত গুণেই তিনি শীর্ষস্থানের অধিকারী হলেও তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, ‘ভালোবাসায় ভরা হৃদয় বিবেকানন্দ’ ।
বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের “শিব জ্ঞানে জীব সেবা” মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন । তাই তিনি মানুষের কল্যাণ সাধনকেই প্রকৃত ঈশ্বর সাধনা বলে মনে করেছিলেন ।
বিবেকানন্দ ছিলেন মানব প্রেমিক সন্ন্যাসী । মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়কেই সমানভাবে প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন । তাঁর মতে “ধর্ম”” মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বকে ফোটাবে । বিজ্ঞান মানুষকে সুখ ও সমৃদ্ধি উপহার দেবে । শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ প্রথমে আত্মবিশ্বাসী হবে । আর আত্মবিশ্বাস থেকে আসবে আত্মনির্ভরশীলতা । বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষাই সমাজের সকল সমস্যা দূরীকরণের মূল চাবি কাঠি । শিক্ষার আলো মানুষের মনের অন্ধকারকে দূর করে এবং মানুষকে স্বনির্ভর করতে সাহায্য করে । বিবেকানন্দের শিক্ষা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যেই ছিল সমাজে যথার্থ “মানুষ” তৈরি করা –যাতে চরিত্র গঠিত হয়, মনের শক্তি বাড়ে । বুদ্ধি বিকশিত হয়, মানুষ নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে শেখে । উপরন্ত বিবেকানন্দের শিক্ষা ছিল সার্বজনীন । তিনি চেয়েছিলেন বিশেষভাবে যুব সমাজের নবচেতনার অভ্যুদয় । নিষ্ঠা, সততা ও আত্মনির্ভরতা ছিল তাঁর আরাধ্য । এসব গুণ জগতের সব সমাজের সব মানুষেরই সম্পদ ।
( ২ )
এখানে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য – বিবেকানন্দ যেভাবে ভারতবর্ষকে চিনেছিলেন বা অনুভব করেছিলেন, অন্য কোনো ব্যক্তি ঠিক সেভাবে ভারতবর্ষকে অনুভব করতে পারেননি । পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করে বিবেকানন্দ ধন্য মনে করেছিলেন । ভগিনী নিবেদিতার ভাষায়, “তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষ – রক্তমাংসে গড়া ভারত প্রতিমা ।“ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রোমাঁ রোলাঁকে (ফরাসী সাহিত্যিক) বলেছিলেন, “যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও বিবেকানন্দকে জানো । বিবেকানন্দের লেখা আগে পড়ো । “
বিবেকানন্দ সহজে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবকে গুরু মানেননি । প্রথমদিকে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে গুরু বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন । এমনকি তাঁর চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন । অথচ উল্টে তিনি রামকৃষ্ণ দেবের ব্যক্তিত্বের কাছে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন । যার জন্য ঘনঘন তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন । ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য নরেন্দ্রনাথ সেইসময় মূর্তিপূজা, বহুদেববাদ, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কালী পুজা সমর্থন করতেন না । এমনকি অদ্বৈত বেদান্তমতবাদকেও তিনি ঈশ্বরদ্রোহিতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন । নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে পরীক্ষা করতেন । রামকৃষ্ণ দেবও শান্তভাবে তার যুক্তি শুনে বলতেন, “সত্যকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করবি ।“
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে । চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁকে প্রথমে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর ও পরে কাশীপুরের একটি বাগান বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয় । সেখানেই নরেন্দ্র নাথের ধর্ম শিক্ষা চলতে থাকে । কাশীপুরে নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন । তারপর রামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে সন্ন্যাস ও গৈরিক বস্ত্র লাভ করেন । রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নরেন্দ্রনাথকে শিক্ষা দেন “মানব সেবাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সাধনা” । এরপর ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট শেষ রাত্রে কাশীপুরেই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব প্রয়াত হন । ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নরেন্দ্রনাথের গুরুভ্রাতা বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের আঁটপুরে আমন্ত্রণ জানান । সেখানেই তাঁরা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মতো জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নেন । তখন নরেন্দ্রনাথ “স্বামী বিবেকানন্দ” নাম গ্রহণ করেন ।
এরপরে পরিব্রাজকরূপে তাঁকে আমরা কী দেখলাম । ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিব্রাজকরূপে মঠ ত্যাগ করেন বিবেকানন্দ । পরিব্রাজক হিন্দু সন্ন্যাসীর এক ধর্মীয় জীবন — এই জীবনে তিনি স্বাধীনভাবে পর্যটন করে বেড়ান কোনো স্থায়ী বাসস্থান ও বন্ধন ছাড়াই । পরিব্রাজক জীবনে বিবেকানন্দের সঙ্গী ছল একটি কমন্ডলু, লাঠি এবং তাঁর প্রিয় দুটি গ্রন্থ –ভাগবদ্গীতা ও ইশানুসরণ । বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সুপরিচিত হন । এই সময় ভিক্ষোপজীবী হয়ে সারা ভারত পদব্রজেই পর্যটন করেন বিবেকানন্দ । সেইজন্য বিবেকানন্দকে সারা বিশ্বের মানুষ “পরিব্রাজক” হিসেবে জানে । ভারতবর্ষ পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন পণ্ডিত, দেওয়ান, রাজা এবং হিন্দু-মুসলমান, খ্রিষ্টান এমনকি নিম্নবর্গীয় ও সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গেও মেলামেশা ও একসঙ্গে বাস করেন ।
( ৩ )
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বারাণসী থেকে যাত্রা শুরু করেন । তখন সাক্ষাৎ হয় বিশিষ্ট বাঙালী লেখক ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও বিশিষ্ট সন্ত ত্রৈলঙ্গস্বামীর সাথে । বৃন্দাবন, হথরাস ও হৃষীকেশে ভ্রমণের সময় হথরাসে তাঁর সঙ্গে স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্তের সাক্ষাত হয় । তিনি পরে বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সদানন্দ নামে পরিচিত হন । তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের প্রথম যুগের শিষ্য । ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে আবার নৈনিতাল, আলমোড়া, দেরাদুন, ঋষীকেশ, হরিদ্বার এবং হিমালয় ভ্রমণে যান । তারপর রওনা দেন দিল্লি । এইভাবে পশ্চিম ভারত, দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ সারেন ।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩০শে জুন থেকে ১৪ই জুলাই শিকাগো যাওয়ার পথে বিবেকানন্দ জাপান ভ্রমণ করেন । তিনি ঘুরে দেখেছিলেন কোবে, ওসাকা, কিওটো, টোকিও আর য়োকোহামা শহর । ১০ই জুলাই ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে য়োকোহামার ওরিয়েন্টাল হোটেল থেকে তাঁর ভক্ত মাদ্রাজের আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠিতে বিবেকানন্দ জানিয়েছিলেন জাপান নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার কথা । তিনি জাপানীদের “পৃথিবীর সবচেয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জনগণের অন্যতম” বলে অভিহিত করেছিলেন । তারপর চিন, কানাডা হয়ে তিনি শিকাগো শহরে পৌঁছান ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে । কিন্তু শিকাগো শহরে পৌঁছে মূলত দুটি সমস্যায় পড়েন । মহাসভা শুরু হতে দেড় মাস বাকী । অন্যটা কোনো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের প্রশংসাপত্র বা পরিচয়পত্র ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বধর্ম মহাসভায় গ্রহণ করা হবে না । তারপর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সংস্পর্শে এলেন । তাঁকে হার্ভার্ডে আমন্ত্রণ জানানোর পর এবং ধর্মসভায় বক্তব্যদানে বিবেকানন্দের প্রশংসাপত্র না থাকা প্রসঙ্গে রাইটের বক্তব্য, “আপনার কাছে প্রশংসাপত্র চাওয়াটা হচ্ছে স্বর্গে সূর্যের আলো দেওয়ার অধিকার চাওয়ার মতো অবস্থা ।“ রাইট তখন প্রতিনিধিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিকট এক চিঠিতে লিখলেন, “আমাদের সকল অধ্যাপক একত্রে যতটা শিক্ষিত ইনি তাঁদের থেকেও বেশী শিক্ষিত ।“
বিশ্বধর্ম মহাসভা ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন হয় । তিনি ভারত এবং হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন । পাশ্চাত্যে অভিযানের নিরিখে যেসব অভিজ্ঞতা, তাতে শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় সনাতন ও বেদান্তের উপর ভাষণ দেওয়া ভীষন তাৎপর্যপূর্ণ । তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন, “আমেরিকার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ …।“ — সম্ভাষন করে । তাঁর বক্তব্যে সহিষ্ণুতা ও মহাজাগতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গ ওঠে । গীতা থেকে উদাহরণমূলক পংক্তি তুলে ধরেন । তাঁর বক্তব্যে বিশ্বজনীন চেতনা ধ্বনিত হয় ।
প্রেসের কাছে তিনি “ভারতের সাইক্লোন সন্ন্যাসী” হিসেবে অভিহিত হন । “নিউ ইয়র্ক ক্রিটিক” লিখেছিল “ঐশ্বরিক অধিকারবলে তিনি একজন বক্তা এবং তাঁর শক্তিশালী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার চেয়ে বরং আগ্রহোদ্দিপক ছিল ঐ সকল ছন্দময়ভাবে উচ্চারিত শব্দসমূহ ।“ আমেরিকার পত্রিকাসমূহ বিবেকানন্দকে “ধর্মসভার সবচেয়ে মহান ব্যক্তিত্ব” হিসেবে প্রতিবেদন লিখেছিল । পরবর্তীতে শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত ভারতে ফিরে এসে লিখেছিলেন, “গেরুয়াধারী কম বয়স্ক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন মঞ্চে বিবেকানন্দ ছিলেন সূর্যের মতো তেজস্বী এক পুরুষ ।“
তারপর ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর আমেরিকা ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ শেষে ইংল্যান্ড থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । তারপর ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারী কলম্বো তিনি পৌঁছান ।
( ৪ )
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বিবেকানন্দের সদর্থক ভূমিকা । রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু । সেই বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ছিলেন “আধুনিক ভারতের স্রষ্টা ।“ জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনার প্রতি তিনি ছিলেন সতত সংবেদনশীল । সুতরাং বিবেকানন্দের স্বদেশমন্ত্র দেশ স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । বলা চলে বিবেকানন্দ স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন । যার জন্য মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “বিবেকানন্দের রচনা তাঁর “দেশপ্রেম হাজারগুণ” বৃদ্ধি করেছিল ।“ যখন পরাধীন ভারতবাসী আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, তখন বিবেকানন্দ চেয়েছেন মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ । তাই তিনি বলেছেন, “তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের অধিকারি, পবিত্র ও পূর্ণ । তুমি নিজেকে দুর্বল বলো কী করে ? ওঠো, সাহসী হও, বীর্যবান হও ।“
স্বদেশমন্ত্রে তিনি বলেছেন, হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা … এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করবে ? এই লজ্জাকর কাপুরুষতা সহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে ? হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী । ভুলিও না, তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর । ভুলিও না, তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের —নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে । ভুলিও না, তুমি জন্ম হতেই “মায়ের” জন্য বলিপ্রদত্ত । ভুলিও না, নীচজাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই । হে বীর, সাহস অবলম্বন করো, সদর্পে বলো —- আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই । বলো, মুর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই । সদর্পে বলো, ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী । বলো ভাই, ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ । ভারতের কল্যান, আমার কল্যান । “
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ই জুলায় রাত ৯.১০ মিনিটে ধ্যানরত অবস্থায় দেহত্যাগ করেন । তাঁকে বেলুড়ে গঙ্গা নদীর তীরে একটি চন্দন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চিতার উপর দাহ করা হয় । যার বিপরীত পাশে ষোলো বছর আগে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মরদেহ দাহ করা হয়েছিল ।
আজ তাঁর শুভ জন্মদিন (জন্মঃ ১২ই জানুয়ারী, ১৮৬৩) । তাঁর শুভ জন্মদিনে আমার শতকোটি প্রণাম ।
———–০————–

Share This
Categories
রিভিউ

সম্মানিত কবি ও গবেষক লিটন রাকিব।

হরিহর মহাবিদ্যালয় সংলগ্ন মাঠে হালদার পাড়া রেডিয়েন্ট ক্লাবের উদ্যোগে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষে ঘুটিয়ারী শরিফ মিলন মেলার শুভসূচনা হল। এবছর মেলা তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করলো। উলেখ্য প্রজাতন্ত্র দিবসের  পূর্ণলগ্নে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যানিং এর ভূমিপুত্র তরুন কবি,সম্পাদক ও গবেষক লিটন রাকিব সহ এলাকার বিশিষ্টজনেরা। এদিন লিটন রাকিবকে অগণিত মানুষের উপস্থিতিতে সহৃদয় সংবর্ধনা প্রদান করেন মেলা কমিটির সভাপতি মান্নান লস্কর ও সম্পাদক আক্কাস ঘোরামী। উত্তরীয়, পুষ্পস্তবক ও স্মারক  তুলে দেওয়া হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। সম্মাননা গ্রহনের পর লিটন রাকিব তাঁর বক্তৃতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৌহার্দ এবং সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে মননশীলতার চর্চায় উতসাহিত করেন তরুন প্রজন্মকে।তিনি আরো বলেন- যেকোনো সৃজনশীলতায় নিগুড়ভাবে মননশীলতা বিরাজ করে।

সমগ্র অনুষ্টানটির  সঞ্চালনায় ছিলেন সাবির আলি লস্কর। মেলায় ভিড় ছিলো চোখে পড়ার মতো।মিলনমেলা চলবে ২ রা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

নেতাজী বসেছিলেন,  তাই সেই চেয়ারে আর কেউ কখনো বসেননি, নেতাজীর স্পর্শ পাওয়া কাঠের চেয়ারকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন দেশুড়িয়া গ্রামের কর্মকার পরিবার।

নেতাজী বসেছিলেন যে চেয়ারে সে চেয়ারে  আর কেউ বসেনি কোনোদিন। ৭৩  বছর ধরে বাঁকুড়ার দেশুড়িয়া গ্রামের কর্মকার বাড়িতে যত্নে রাখা সেই চেয়ার আজো শূন্য। পরিবারের আশা ফের কোনোদিন নেতাজী ফিরে এসে আবার বসবেন সেই চেয়ারে।

সালটা ১৯৪০। বাংলার আকাশে ক্রমশ তীব্রতা বাড়ছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের। ২৮ এপ্রিলের তপ্ত বাঁকুড়ায় সুভাষ চন্দ্র বসু এসেছিলেন গঙ্গাজলঘাটির বুকে সভা করতে। মঞ্চে তাঁর বসার জন্য রানীগঞ্জ থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল সুন্দর সোফা। স্থানীয় নেতৃত্বের বসার জন্য মঞ্চে বরাদ্দ ছিল স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ করা কাঠের চেয়ার।

 

 

নেতাজী সোফা সরিয়ে বসার জন্য টেনে নিয়েছিলেন সাধারণ একটি কাঠের চেয়ারকে। আগুন ঝরানো বক্তৃতা শেষে নেতাজী মঞ্চ ছাড়তেই আর দেরী করেননি দেশুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা রামরূপ কর্মকার। ছুটেছিলেন মঞ্চের উদ্যেশ্যে। তাঁর বাড়ি থেকে আনা চেয়ারেই যে বসেছিলেন নেতাজী। সটান মঞ্চে উঠে সেই চেয়ার মাথায় তুলে হেঁটে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন রামরূপ কর্মকার। বাড়িতে ফিরে চেয়ার রেখেছিলেন নিজের বাড়ির ঠাকুর ঘরে।

 

বাড়ির সকলকে বলেছিলেন ওই চেয়ারে নেতাজীর ছোঁয়া আছে। তাই সেই চেয়ার যেন যত্নে রাখা হয়।  তারপর দামোদর দিয়ে বয়ে গেছে বহু জল। প্রিয় নেতাজী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। আরও পরে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু নেতাজী অন্তর্ধান রহস্যের মিমাংসা আজো হয়নি। নেতাজীকে হারানোর একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে আজো দিন কাটে কর্মকার পরিবারের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বুক দিয়ে কর্মকার পরিবার আগলে রাখেন নেতাজীর ছোঁয়া পাওয়া সেই সাধারণ কাঠের চেয়ারটিকে। পরিবারের কূলদেবী মনসার নিত্য পুজোর পাশাপাশি শূন্য কাঠের চেয়ার কর্মকার বাড়িতে পূজিত হয় দেবতা জ্ঞানে। শূন্য কাঠের চেয়ারকে ঘিরে যাবতীয় আবেগ ও অহঙ্কার আবর্তিত হয় দেশুড়িয়া গ্রামের কর্মকার পরিবারের।

 

কলমে : আবদুল হাই।

Share This
Categories
রিভিউ

বাংলায় হুগলির বৈঁচিগ্রাম বইমেলায় ফুটে উঠলো বাংলা জনপদে বই প্রেমের রঙ্গিন প্রচ্ছদ।

মন সারস সহিত্য ডেস্ক, সৌগত রাণা কবিয়াল:- ভারতবর্ষে তক্ষশিলা যুগ থেকে আজকের হালফ্যাশন অনলাইন পিফিএফ-এ লেখকদের সৃষ্টি পরিচয় নিবন্ধন… পুরোটা পথ জুড়েই বইয়ের প্রতি, জ্ঞানের প্রতি মানুষের অদম্য উচ্ছ্বাস… যার পরিমার্জনায় শীতের আরাম-আদুরে উৎসবমুখর বাঙালীর চতুর্দশতম পার্বণ হিসেবে বইমেলার অলিখিত স্বীকৃতি…!

শীতকাল মানেই হাজার উৎসবের মাঝে জায়গা করে নেওয়া বই উৎসব বা বই পার্বণ…. কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা কিংবা বাংলাদেশের একুশে বইমেলার মতন বৃহৎ পরিসরের পাশাপাশি জেলায় জেলায় ছোট শহর কিংবা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এরকম অজস্র ক্ষুদ্র স্থানীয় বইমেলা ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা…..তারই ধারাবাহিকতায় শহর কলকাতা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরবর্তী হুগলি জেলার একটি বর্ধিঞ্চু গ্রাম বৈঁচিগ্রামের আঞ্চলিক গ্রন্থমেলা- ‘বৈঁচিগ্রাম বইমেলা’…!
গত ৫ই জানুয়ারি থেকে ১২ই জানুয়ারি পর্যন্ত বৈঁচিগ্রামবাসিরা এবার তাদের ১৫ তম মেলা আয়োজন করে বৈঁচিগ্রাম অগ্রগামী সংস্থার অসাধারণ পরিচালনায়…!

‘গ্রাম থেকে জেগে ওঠে প্রাণ’ থিমকে সামনে রেখে এই বইমেলায় প্রায় ত্রিশটি বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থার অংশগ্রহণে বৈঁচিগ্রাম বইমেলা হয়ে উঠেছিলো বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির এক চমৎকার মেলবন্ধন…! শীত উৎসবের ভীড়ে মেলার মাঠ প্রাঙ্গণে স্থানীয় শিশু থেকে প্রবীণ, সকল আপামর মানুষের উৎসবমুখর পদচারণায় মেলা মঞ্চের আলো ছড়িয়ে পড়ে বইমেলার প্রতিটি কোনে….! গুগল মাষ্টার মশাইয়ের এই যুগেও নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে মেলা প্রাঙ্গণে বই প্রেমীদের ভীড় ভীষণ আশা জাগানিয়া সুখ এনে দেয়…!

সাত দিন ব্যাপি এই পুস্তক মেলার উদ্ভোদন করেন বিশিষ্ট কবি মৃদুল দাশগুপ্ত মহাশয়..উপস্থিত ছিলেন কবি তনুশ্রী রায় মহাশয়া…! মেলা উপলক্ষে ভিন্ন-ভিন্ন দিন নানান সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাঝে বিশেষ সাহিত্যিকগনের উপস্থিতিতে মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ সাহিত্য আলোচনা…! সেখানে উপস্থিত হয়ে গ্রামীণ জনপদে সাহিত্য নিয়ে মুল্যবান আলোকপাত বর্ষীয়ান কবি গীতিকার অরুণ চক্রবর্তী মহাশয়, সাহিত্যিক রজত পুরোকায়স্থ মহাশয় ও কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সাংবাদিক সৌগত রাণা কবিয়াল মহাশয়…! তাদের পাশাপাশি মেলা মঞ্চে সংবর্ধিত হোন স্থানীয় সাহিত্যিক ঘরের মেয়ে মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়…!
মনোজ্ঞ সঙ্গীত সন্ধ্যায় মেলা মঞ্চে নিজেদের অপূর্ব সুর মূর্ছনায় আগত বই প্রেমিদের মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করেন জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী লোপামূদ্রা মিত্র, রূপঙ্কর বাগচি এবং সুরজিৎ ও বন্ধুরা…! মেলায় মঞ্চস্থ হয় নাটক ইচ্ছামৃত্যু… অনুপম বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায়, রাহুল গোস্বামীর নির্দেশনায় চমৎকার এই নাটকটিতে অভিনয় করেন, জগবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়, পাপিয়া মুখোপাধ্যায়, প্রজিৎ চ্যাটার্জি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও
অর্নব ঘোষ প্রমুখ…!


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পৃষ্ঠপোষকতায় বিহারী লাল মুখার্জীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বি-এল মুখার্জি বিদ্যালয়ের মাঠ প্রাঙ্গণে
বৈঁচিগ্রাম বইমেলার উদ্ভোদনী দিনে উপস্থিত ছিলেন মাননীয়া বিধায়িকা ডক্টর রত্না দে নাগ মহাশয়া, পান্ডুয়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি চম্পা হাজরা মহাশয়া, পান্ডুয়া পঞ্চায়েত সমিতির কর্মদক্ষরা ও জেলা পরিষদের সদস্য ও সদস্যরা, বাটিকা বৈচি অঞ্চলের প্রধান ও উপপ্রধান ও সমাজসেবী আব্দুল মান্নান মহাশয়, অঞ্চলের সব সদস্য সদস্যরা ও আরো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এবং বইমেলার সম্পাদক সঞ্জিত ব্যানার্জি মহাশয়…!

৯৬০ সালের পরবর্তী সময়ে প্রাচীণ চিনা-দের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে ‘শানবিন’ এর প্রচলন… পৃথিবীতে বই সংগ্রহের প্রাচীণতম এই উদাহরণের পাশাপাশি সক্রেটিস সময়েও জ্ঞান অর্জনে বই কেনা বেচার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়…! তবে প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী খ্রিষ্টীয় পনেরো শতকে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করার পর থেকে জার্মানিতে লিপজিগ মতান্তরে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে ছাপা বইমেলার প্রারম্ভিক সূচনা থেকে পরবর্তীতে ১৭ শতকের পর ইউরোপসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে বইমেলা বা গ্রন্থমেলা মানুষের শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের অন্যতম উৎসব হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে…!

গাছের বল্কলে, গুহায়, পাথরের গায়ে নানান আঁকাবুকির মাধ্যমে তাদের নিজস্ব ও অবস্থানগত বিবরণ তুলে ধরার যে চর্চা শুরু হয়েছিলো..আজকের বইমেলা যেন তারই অত্যাধুনিক বিবর্তন…!
প্রায় চার হাজার বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় ( বর্তমান ইরাক ও সিরিয়া ) ‘গিলগামেশ’ পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস থেকে আজকের বৈঁচিগ্রাম বইমেলার মতন আঞ্চলিক বইমেলাগুলোতে বাবা মায়ের হাত ধরে আসা ছোট শিশু সাহিত্যিকদের ভাবনার চিত্রপটে লেখা শিশুতোষ গল্পের বইয়ের সচিত্র মলাট…..
এ যেন এক পূর্ণ পৃথিবীর সভ্যতার কথা বলে যায়…!

সভ্যতার যাদুর ঝুলি যতই জীবনকে দুর্দান্ত বেগ এনে দিক না কেন, মানুষের মনের কথাগুলোর কল্প চিত্রের আবেগ হয়ে বইমেলা সবসময় থাকবে সময়ের বর্তমান চাকায়…!
বই কিনুন..বই পড়ুন..বই উপহার দিন প্রিয়জনকে…!
ধন্যবাদ…

 

সৌগত রাণা কবিয়াল—
— কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Share This
Categories
রিভিউ

সে তুমি কবি হও বা নাও হও, আমি জানি কবিতার ঈশ্বর তুমি, কবিতা ::: শুভঙ্কর দাস।।।

“আমি ঈশ্বরের নামমাত্র প্রশংসা করব না,
বরং ঈশ্বরের উচিত আমার স্তুতি করা,আমার হৃদয়ের
সামনে মাথা নত করে ক্রন্দন করা,আমার অশ্রু অথবা
অফুরন্ত আবেগের জন্য আবার একটি জন্ম উপহার দেওয়া,যাতে আমি জ্বলন্ত জীবনের শেষদিন পর্যন্ত

নারীকে,হৃদয়বতীকে এমনভাবে রক্তমাংসমদির ভালোবাসি,মুগ্ধতার পদাবলি রচনা করি এবং একটু স্পর্শের জন্য প্রাণ তুচ্ছ করতে পারি!

যা ঈশ্বরের করা অসম্ভব,অকল্পনীয় এবং অরতিময়!

কে কার সৃষ্টি জানি না!প্রেমের ফুল হাতে নিলেই
ভেতরে যে ধ্বনিত হচ্ছে শ্বাসবায়ুরচিত কবিতা,তা
গালিবের লেখা,লেখা নয়, তাই গালিব

সে তুমি কবি হও বা না হও!”( গালিবের কবিতা।শুভঙ্কর দাস)

প্রায় দু’শতাব্দী আগে এক প্রেমিক-কবির জন্ম হয় ১৭৯৭ সালে আগ্রায়,তিনি সৈনিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও,কখনো অস্ত্র ধরেননি,বরং নিজের হৃদয়কে ফুল করলেন,প্রতিটি শানিত অস্ত্র যাতে ফুল এবং অস্ত্র ভান্ডার ফুলের বাগানে পরিণত হয়।
তিনি উর্দুতে কবিতা লিখতেন। শেষ পর্যন্ত এই ভাষার প্রতি তাঁর পরম নিষ্ঠা ও বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।তাঁর সারাজীবন ছিল সৌন্দর্য সন্ধানের আকর।তিনি লক্ষ্য করলেন,ঈশ্বরের সৃষ্ট এই জগতে সত্যিকারের সুন্দরতম বলে কিছু থেকে থাকে,তা হল নারী।
সেই নারীর হৃদয় জয় করা তাঁর কাছে শত সাম্রাজ্য জয় করার সমান মনে হত।
ডেই নারীর হৃদয়ে স্থান পাওয়াকে তিনি মনে করতেন বেহস্তে যাওয়ার সমান।
তপ্ত হৃদয়ের ভেতর ছায়া আনতে এবং মরুসদৃশ ওষ্ঠতৃষ্ষা মেটাতে পারে একমাত্র নারী।তাই সেই কবির কাছে প্রেম,নারীর প্রেম জীবন ও মরণ,ত্যাগ ও ভোগের একাত্ম সাধনরূপ হয়ে উঠল।
তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে বুলবুল,গোলাপ,বসন্ত,চাঁদ, ফুল,ময়ূর,কেশদাম,সুরা, লায়লা-মজনু এবং যে শব্দটি অযুতবার এসেছে, তা হল চুম্বন।
অর্থাৎ তিনি নারীর প্রেমকে ও তার প্রাপ্তিকে জীবনের সবশ্রেষ্ঠ গজল মনে করতেন।
প্রায় ১৭৯৬ টি কবিতা রচনা করেছেন।
তিনি ইংরেজি জানতেন না!
তিনি বাংলা যে জানতেন না,তা বলা বাহুল্য!
তিনি ফার্সি জানতেন কিন্তু পদ রচনায় তিনি উর্দুকেই বাহন করেছিলেন।
তার সত্ত্বেও তাঁর হৃদয়আর্তিকে আটকে রাখা যায়নি!
অনুবাদের মাধ্যমে আলোকিত কবি-প্রেমিক সম্রাট হয়ে আছেন সারা ভুবনে।

তিনি মির্জা আসাদুল্লাহ্ খান।
গোটা জগৎ তাঁকে মির্জা গালিব নামে চেনে।

কাব্য-বিশেষজ্ঞের মতামত এই “গালিব শুধুমাত্র বড় কবি নন,তিনি অত্যন্ত দুরূহ কবি।তাঁর কবিতা ও গজল দু’শতাব্দী অতিক্রম করেও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক। গালিবকে তাঁর জীবনী ও কবিতায় আমরা পাই সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, মেধা ও মননের সমৃদ্ধ সমকালীন ভারতীয় সংস্কৃতির পটভূমিকায় একজন অমিত শক্তিধর স্রষ্টা হিসেবে। সমগ্র উর্দু ও ফারসি কাব্যে একমাত্র ইকবাল ব্যতীত আর কোনো কবি একরকম কালোত্তীর্ণ প্রতিভা নিয়ে উপস্থিত হননি”

আর মহাকবি গালিব নিজে স্বয়ং কী বলেন, তাও শোনা দরকার–
“শোনো,দুটি পৃথিবী আছে,একটি আত্মার, অন্যটি মাটি ও জলের পৃথিবীর। সাধারণ নিয়ম এই যে মাটিজলের পৃথিবীতে যারা অপরাধী তারা আত্মার পৃথিবীতে শাস্তি পাবে,আবার যারা আত্মার জগতে অপরাধী তারা মাটিজলের পৃথিবীতে শাস্তি পাবে”

তাঁর আত্মা কবিতার জন্য নিবেদিত ছিল।তাই তিনি মাটিজলের পৃথিবীতে নানা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে প্রেমকে প্রজ্বলিত করেছেন তিলে তিলে…
তিনি তাই বলেন—
“আমাদের প্রেমের ব্যাকুলতা তোমার মহত্ত্বকে প্রকাশ করে
তোমার পৃথিবী তোমার মুখের তুলনায় অতি সামান্য
একটি আয়না মাত্র! ”
সেই আয়না যদি উর্দু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকত,তাহলে সসাগরা বসুন্ধরা এই অতুলনীয় প্রেমের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকত,তাই আমরা যারা অসহায় অথচ গালিব পড়তে আগ্রহী এবং বহুভাষাজ্ঞানহীন অথচ বহুমাত্রিক প্রেমসন্ধানী, তাদের জন্য অনুবাদ একান্ত প্রয়োজন।
এগিয়ে এলেন কবি তপনকুমার মাইতি।
কবি তপনকুমার মাইতি অখন্ড মেদিনীপুরের প্রেমের কবিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনাকার।তিনি নিজে অসংখ্য এবং সার্থক প্রেমের কবিতা সৃষ্টি করেছেন।এবং যা আবৃত্তিশিল্পীদের স্বর্ণকলস হতে পারে! যেমন একটি শোনাই—

“ভালোবাসলে সব মানুষের মুখ সুন্দর দেখায়
তখন শত্রুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলা যায়,বুকে এসো
তখন ঝরা ফুল হাতে নিয়ে বলা যায়,বৃন্তে ফিরে যাও
তখন ছোট ছোট লোভ ও ঘৃণাগুলো নক্ষত্র হয়ে যায়
তখন অচেনা মানুষের দুঃখের ভেতর দাঁড়ানো যায়

ভালোবাসলে পাখি নেমে আসে গাছ থেকে
মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমে আসে

ভালোবাসার মত স্বচ্ছ আয়না আর একটিও নেই। ”

সেই মানুষটি প্রেমের হৃদয় দিয়ে গালিব ভাষান্তর করেছেন। মূল উর্দু কবিতার পাশাপাশি বাংলায় অনুবাদ।কয়েকটি প্রেমপ্রদীপ জ্বালানো যেতেই পারে—

“ঘুম তো তারই,গর্বও তারই,রাত্রিও তার
তোমার অবিন্যস্ত কেশদাম যার বাহুর উপর বিছিয়ে আছে”

“দেওয়াল ও দরজাবিহীন একটি ঘরে বানাতে চাই
সেখানে কোনো পাহারাদার থাকবে না,থাকবে না কোনো পড়শি”

“তুমি বলছ কুড়িয়ে পাওয়া হৃদয়টা ফিরিয়ে দেবে না
হৃদয় কোথায় যে লুকিয়ে রাখবে? আমি পেলাম আকাঙ্ক্ষিত করুণা”

এইরকম কবি তপনকুমার মাইতি একশো দুটি অনুবাদ করেছেন গালিবের কবিতার।মূল উর্দুর সঙ্গে পড়তে এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে যায়,তবে হয়তো যে শব্দ বা বাক্য উর্দুতে প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে,তার বাংলা সেই আবেদন নিয়ে কোথাও কোথাও হাজির হয়নি,অনুবাদ সদর্থক এবং সাবলীল, কিন্তু ভাষান্তরে সেই ধ্বনিময় অনুভবজারিত রস পাওয়া অসম্ভব।
তা সত্ত্বেও কবি তপনকুমার মাইতি আমাদের জন্য যে স্বর্ণখনি নির্মাণ করেছেন,তাতে মুগ্ধ হতেই হয় এবং অবশ্যই পাঠ করতে হয়।

গালিব বাংলা ভাষায় কবিতাচর্চা করতেন না,এমন কি তিনি বাংলার কবিতাসম্ভার জানতেন কি না,জানা যায় না,কিন্তু ১৮২৬ সালে কলকাতায় এসেছিলেন।দিল্লির শেষ বাদশা বাহাদুর শাহের সভাকবি ছিলেন তখন।সেইসময় কলকাতায় তাঁকে ঘিরে একটি উর্দু কবিমন্ডল তৈরি হয়। যে সময় কলকাতায় রাজা রামমোহন রায় একের পর এক সমাজসংস্কারমূলক বাংলা বই রচনা করে চলেছেন এবং রামমোহন নিজে খুব ভালো ফার্সি ও উর্দুভাষা জানতেন।সেদিক থেকে গালিবের সঙ্গে রাজা রামমোহনের সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না,জানা যায় না! রামমোহন গালিবের চেয়ে ২৩ বছরের বড় ছিলেন।এবং গালিব যখন কলকাতায় সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বীরসিংহের টোলে পড়াশুনা করছেন এবং তাঁর বয়স মাত্র ছয়।
এবং সেই সময় বাংলার প্রধান কবি ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত।
তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্রে গালিবের কোনো সংবাদ প্রকাশিত অথবা গালিবের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন বা প্রকাশ করেছিলেন কি না,জানা যায় না!
এইসব ইতিহাসের উর্ধ্বে যা থাকে,তা হল গালিবের কবিতা।তাই আমরা হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছি, কবি তপনকুমার মাইতির আয়োজনে,এটাই বড় প্রাপ্তি।এই আলোচনায় অনেকের মনে হতে পারে,শব্দার্থ বা উপমা প্রয়োগ অথবা ভাষান্তরে ভাবের বিস্তার বা সংকোচ হল কি না,তা তো আলোচিত হল না!
না,আমি সেসব করতে বসিনি,সে যোগ্যতাও আমার নেই।আমি শুধু এক কবি হৃদয়ের আর্তি অপর কবিহৃদয় কীভাবে সঞ্জাত করে গালিবপ্রিয় পাঠকের মনে সঞ্চারিত করল,তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরলাম।মহাকবি মধুসূদন তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্যের একটি জায়গায় বলেছেন—

” যে যাহারে ভালোবাসে/সে যাইবে তার পাশে
মদন রাজার বিধি লঙ্ঘিবে কেমনে?
যদি অবহেলা করি/রুষিবে শম্বর-অরি
কে সমস্বরে স্মরশরে এ তিন ভুবনে?”

এই সত্যিটুকু মির্জা গালিবের কবিতায় আছে,কবি তপনকুমার মাইতির কবিতায় আছে এবং পাঠান্তর তাই আমার মতো তুচ্ছ নগন্য পাঠকের মনেও সোনালি রেখায় স্পন্দিত হয়েছে,এরপর আর কি চাই??
শেষ করব গালিবের কবিতা দিয়ে,যা তপনকুমার অনন্য হৃদয়ময়তায় ফুটিয়ে তুলেছেন—

“অনুযোগে আমিও পূর্ণ, বাদ্যযন্ত্র যেমন রাগিনীতে
একটু বিচ্ছেদ দাও,দেখ কেমন বেজে উঠি”

————————//——————–

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

সাক্ষী দগ্ধ পলাশ :::: শুভঙ্কর দাস।।।।

“এইমাত্র নদী নেমে গেল মনের
শেষ ধাপে,শুকনো পাতার মতো রৌদ্র কাঁপে
মানুষের জন্ম! এ কি কোনো দৈব অভিশাপে!
জানে না জীবন অথবা মৃত্যু!
তার মাঝে এই তো অক্ষরের সন্তান-সন্ততি
সঙ্গে আরও একটু শ্বাসের হাতটি বাড়াস…

নৌকাজন্ম যখন,একটু স্রোতের দিকটা ঘুরে যাস…

জেগে উঠে দেখি,মানুষে বুকে-চোখে ভরে আছে

শুধু মুখোশের লাশ,সাক্ষী দগ্ধ পলাশ! “( পলাশ।শুভঙ্কর দাস)

একটি মানুষ আপাদমস্তক সাহিত্যের সঙ্গী,সাহিত্যের সহযোগী এবং সাহিত্যিকের পরমবন্ধু। এবার আপনার মনে হল,তাহলে একটি দেখা করাই যেতে পারে।আপনি পূর্বেই ভেবে রেখেছেন, সাহিত্য-অন্তপ্রাণ মানে গিয়ে দেখব,রাশি রাশি বই খুলে পড়ছেন অথবা কোনো শ্বেতপাথরের টেবিলে উদাস বাউলের মতো কলমটি ধরে মানুষের জীবনকে ফুটিয়ে তুলছেন সাদা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়,বা ভাবলেন,গিয়েই কথা বলা শুরু করলেই তিনি সাহিত্যের অতীত গৌরব, বর্তমান দুরবস্থা এবং ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা নিয়ে সুদীর্ঘ বক্তব্য বা উপদেশ দেবেন!
না,তা কিছুই হবে না।
একটি বর্ণময় আন্তরিক সাহিত্যসভা চলছে..
সেই মানুষটি এই সভার প্রাণপুরুষ এবং সর্বময়কর্তা,তিনি কোথায়?
আপনি গিয়েই বুঝলেন,এখানে সাহিত্যের একটি যাগযজ্ঞ হচ্ছে।
নিশ্চিত মঞ্চের ওপর বসে থাকা কোনো একজন ব্যক্তি তিনি হবেন,কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করি?
অথবা যিনি মাইক্রোফোন ধরে সারা সভাকে শব্দশাসনে রেখেছেন,তিনিও হতে পারেন!
অথবা এই তো এতগুলো বইপ্রকাশ হল,এঁদের মধ্যে তিনি একজন হবেন নিশ্চিত।
এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে আপনি দেখবেন এবং বিস্মিত হয়ে উঠবেন,ও হরি!
সাহিত্যবাগানে ঢোকার মুখে একটি সাধারণ মানের জামা-প্যান্ট ও খালি পায়ে অভ্যর্থণা করছিলেন এবং আপনি পা ধোবেন বলে,যিনি পুকুর থেকে জল তুলে দিলেন,তারপর আপনার পথক্লান্তি দূর করার জন্য নিজের হাতে ডাব কেটে আপনাকে খাওয়ালেন, আবার আপনার প্রাতরাশের জন্য ঠোঙাভর্তি মুড়ি-চানাচুর-নারকেল দিলেন এবং আপনাকে হাসিমুখে সভাস্থলের চেয়ার পর্যন্ত বসিয়ে আন্তরিকভাবে বলে উঠলেন,এখানে সাহিত্য নিয়ে আনন্দ করুন এবং বাড়ি যাওয়ার কোনো চিন্তা করবেন না,এখানেই থাকুন এবং সব রকমের সাহিত্য-সেবা এখান থেকেই গ্রহণ করুন।
এবং তা শুধু কথার কথা নয়, একেবারে সত্য ও সুন্দর।

তিনি ভূতনাথ পাণিগ্রাহী।

সাহিত্য-প্রাণ সকল মানুষের জন্য প্রাণপাত করতে রাজি আছেন।
তাহলে প্রশ্ন,কী পড়েন?
—কেন মানুষ পড়ি।এর থেকে ভালো বই আজ পর্যন্ত ছাপা হয়নি
কখন লেখেন?
—ঐ যে ঘুমোনোর আগে জেগে থাকতে লিখি,এখন তো জেগে থাকাটাই আসল কাজ
এই পথে কোনো পথপ্রদর্শক আছে?
— আছেন,আসুন দেখাচ্ছি,বলেই আপনাকে নিয়ে যাবেন,তাঁর তৈরি সাহিত্যবাগান,যার নাম সংলাপ।
সেই সংলাপের আদি এবং একমাত্র সভাপতি দর্শনে।
যিনি ভূতনাথের নাথ।
গিয়ে দেখবেন, শ্বেতপাথরের মর্মরমূর্তি। সেই সদাহাস্যজ্বল আনন্দময় পাগলা ঠাকুর।যিনি বলতেন,তোমাদের চৈতন্য হোক..
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
এরপর দেখবেন,ভূতনাথ পাণিগ্রাহী কোনো ভূমিকা ছাড়াই সেই মূর্তির পাদতলে বসে, আপনাকে ইঙ্গিত করে বলবেন,ইনিই সব।
এবার আপনি বুঝে যাবেন,কেন এই সাহিত্যপুরুষ অন্যের থেকে আলাদা।
সেই অক্ষর মাটির চাষা শান্ত-সৌম্য মনে একের পর গ্রন্থ রচনা করে চলেছেন।তার সংখ্যা প্রায় কুড়িটি।
এবার যে গ্রন্থটি হাতে এলেনা,তার নাম দগ্ধ পলাশ।

এ হল ভূতনাথের আশ্চর্য স্বগোতক্তির স্বতঃস্ফূর্ত ধারা।

যে সাহিত্যিক বই নয়, মানুষ পড়েন।যিনি মঞ্চ নয়,মাটিতে বসে বক্তব্য দেন,যিনি মনে করেন,গাঁয়ের চটে-ঘেরা চা-দোকানের আলোচনায় যে দর্শন উঠে আসে,তা বড় বড় দার্শনিকের বইয়েও নেই!
সেই মানুষটি যেন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে চলেছেন,এই বইটিতে।
বইটির কোনো শুরু নেই,শেষ নেই,একেবারে আমাদের কথা বলার মতো।কোনো সূচিপাতা নেই!
এই বইতে তিনি একটি আশ্চর্য আয়না নির্মাণ করে একের পর এক ছবি অক্ষরে খোদিত করছেন।সেইসঙ্গে যিনি পড়বেন, তাঁকেও অন্তর্গত আয়না করে দিচ্ছেন।
কয়েকটি দৃষ্টান্ত না দিলে ভূতনাথ-দর্পণ বোঝা যাবে না!

এক

লেখাপড়া

লেখাপড়া করা যদি খাওয়া, সঙ্গম আর শুধু বেঁচে থাকাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ওটা না করাই ভালো! কারণ বাবুর কুকুরেও তো লেখাপড়া না করে,অক্লেশে বরং আরামের বেঁচে থাকে!

কবিতা

আমি জন্ম হলাম।যন্ত্রণা শুধু শুধু দিলাম স্রষ্টাকে।স্পর্শ করলোই না কেউ! দেখলোই না কেউ মুখে তুলে!
কারণ আমি হেমু মুর্মুর মেয়ে যে,নাম? কবিতা।

আত্মমর্যাদা

অর্ধশোয়া জামরুলের পাশে দাঁড়ালাম।কাজ হয়ে যুবতী লাল ফল শয্যায়!হাত বাড়াতেই!
বলল,নির্ভরতা লজ্জার।এভাবেও বাঁচা যায়।মুখ্য বিষয় আত্মমর্যাদা।

ফুল

যে ফুল ফুটুক, ভেতরে ওগুলো ওর শিশির নয়! কান্না! পোকা থেকে দেবতা সবারই চাই! ফুলের,বলি তার আবার চাওয়া কী? রক্ত করলেও সর্বমঙ্গল্যে!
সে যে ফুল ফুটুক। ভেতরে ওগুলো ওর শিরশির নয়! কান্না।

প্রেম
হৃদয় তপ্ত দগ্ধ না হলে,প্রেমের পরশ কি সহজে মেলে?

বৃদ্ধ

বৃদ্ধ কাঁপা হাতটি দিয়ে ঝাকালো হঠাৎ
বলল,বেঁচে আছি
শব্দহীন আমার মুখ!
আকাশে দেখি দলছুট একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে, কেবল আজ একা!

এইরকম জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে মানুষের মনের অসংখ্য সিঁড়ি, সহবাস এবং সাধনাকে ভূতনাথ আপন অভিজ্ঞতা ও আলোক মিশিয়ে তুলে ধরেছেন।
এ যে সেই ঠাকুরের রসে-বশে থাকা।
ঠাকুর বার বার বলতেন,কলিযুগে নারদীয় ভক্তি।
জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা মানুষের হাতে যে সময়ের বড় অভাব।তাই শাস্ত্রে যে সকল কর্মের কথা আছে,তার সময় কই?
তাই ঠাকুরের নিদান,ঈশ্বর ও সংসার দুইহাতে ধরে এগিয়ে যেতে হবে,আর তাতে একটাই জিনিস দরকার,তা হল,মন ও মুখ এক করতে হবে।

মন ও মুখের এক করার সেই অমোঘ আয়না নির্মাণের চেষ্টা করেছেন সাহিত্যসাহসী ভূতনাথ পাণিগ্রাহী।
তাঁকে প্রণাম।
————————–//——————

Share This