Categories
কবিতা

ঋতু : রাণু সরকার।

আধোঘুমন্ত অবস্থায় ভেসে এলো গানের সুর কানে,
কে গাইছিলো এতো রাতে?
আমার দৃষ্টির শেষ সীমায় ফুটেছে কমলকলিকা।

বাংলার তৃতীয় ঋতু-
ভরেছে সূর্যের চুম্বকীয় রশ্মিতে,
বেলা শেষ, নামলো ছায়া ধরণীতে,

শিশিরবিন্দুতে ভাসে চোখ-
হয়নি দেখা কোনদিন নয়ন মেলে।
অন্তর লতাবেষ্টিত, কানন মুকুলিত-
অত্যন্ত মিষ্টি মনোহর,
ওগো শেফালিকা, তুমি মনের কামনাপীড়িত!

Share This
Categories
কবিতা

একান্তে :: রাণু সরকার।।।

খেলেছি কত তোমার সাথে যখন আমার শুরু হলো বেলা,
তখন চিনতো কি আমাদের মন
কে তুমি আর কে আমি?
তবু অচেনাকে চেনা করে খেলেছি কত, তোমার কি মনে পড়ে?
হয়তো পড়ে মনে, আমার জানা নেই অনেক দিনের কথা তো!

ছিলোনা ভয় লজ্জা অপমানের জ্বালা, তাই না বলো!
মনটা ছিলো বিশ্রামহীন অস্থির উড়ুউড়ু,
এটাই তো হবার, ছোট বয়স বলে কথা!

সকালসন্ধ্যা রোজ আসতে তুমি ডাকতে,
ভীষণ ভালো লাগতো,
যেন তুমি আমার কোন এককালে ছিলে আপনজনা!
ছুটোছুটি করেছি কত তোমার হাত ধরে আবার কখনো হাত ছেড়ে!
অকারণে হেসে কতনা করেছি লুটোপুটি,
খেলেছি কত বনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।

সেসব দিনের কথা মনে পড়ে
আমার মতো তোমার কি?
তোমার পাঁচমিশালী গানের সুরে দিতাম আমি তাল-
করতো না তো একটুও আমার লজ্জা!
তখন নাচতো আমার মন, হতো চঞ্চল,
আমি তখন ছোট্ট খুকী, বুঝতাম না গানের মর্মার্থ।

আচমকা দিনের সূচনা হল স্তব্ধ,
প্রকৃতির এটাই বুঝি নিয়ম,
পশ্চিমেতে সূর্য রেগে ঠায় দাঁড়িয়ে,
যাচ্ছে না কেনো সে চলে!

বুঝেছি, এবার আমার থাকতে হবে একান্তে নিরালায়।
এখন আমি যে সেই ছোট্ট মেয়ে নই,
বড় হওয়ার গন্ধ সবার নাকে লাগে ওড়ে।।

Share This
Categories
গল্প

পরিবর্তন : দিলীপ রায়।

তপা পরীক্ষার মার্কশীট নিয়ে বাড়ি ফিরল । অভিভাবকের স্বাক্ষর করিয়ে পরের দিন অবশ্যই জমা দিতে হবে । পরেরদিন মার্কশীট জমা দেওয়ার শেষ দিন । তপা মায়ের কাছে গিয়ে মার্কশীট দেখিয়ে বলল, কীভাবে বাবার স্বাক্ষর নেওয়া যায় ? বাবা মার্কশীট দেখলে আমাকে ভীষণ বকাবকি করবে ।
নম্বরের যা বহর, তাতে তুই কোন্‌ মুখে বাবার কাছে গিয়ে স্বাক্ষর চাইবি !
তপার বাবা পশুপতি খাঁ । পূর্বস্থলি স্টেশনের কাছে সোনাঝরা গ্রামে তাঁর মুদিখানার দোকান । দোকানে অনেক ধার-বাকী । খরিদ্দারের কাছ থেকে ধারের টাকা আদায় হচ্ছে না । চাইতে গেলে সকলের মুখে এককথা, “মাঠের ধান উঠুক, ধারের সমস্ত টাকা শোধ করে দেবো ।“ পশুপতির আবার ধার দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ । অথচ ধার না দিলে খরিদ্দার ধরে রাখা কষ্ট । সদলবলে গাজি মিয়ার মুদির দোকানে হত্যে দেবে । তাতে আখেরে তাঁর লোকসান ।
তখন সন্ধ্যা আঁটটা ! খরিদ্দারের আনাগোনা নেই বললেই চলে । তাই ভাবল পশুপতি, এবার দোকান বন্ধ করা যাক । মন-মেজাজ তাঁর ভাল নেই । কিছুক্ষণ আগে খাতা খুলে পশুপতির মাথায় হাত ! প্রায় আঠারো হাজার টাকা ধার । এইটুকু দোকানে এতগুলি টাকা ধার ! লোকে ধার খেয়ে শোধ করার নাম করছে না । অথচ অনেকগুলি টাকা । সংসারে অনেক খরচ । অভাব অনটনের বহর বেড়েই চলেছে । তাঁর বৌটা তেমনি ! একটু রেখে ঢেকে খরচা বাঁচিয়ে সংসার চালাবে সেদিকে তাঁর নজর নেই । শুধু বায়নাক্কা । এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে । দেখা যাবে আজ গৃহের আসবাবপত্র কেনা, কাল দেখা যাবে ঘরের থালা বাসন কেনা ! আজকাল আবার অনলাইনে কেনাকাটা শিখেছে । কেনার শেষ নেই । তাঁর বৌয়ের খরচার হাত ষোলোআনা । এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে পৌঁছালো পশুপতি খাঁ ।
গামছা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁর বৌ বলল, “হাত মুখ ধুয়ে এসো চা বানিয়ে দিচ্ছি । ঐদিকে খাবার রেডি । যখন বলবে তখনই রাতের খাবার দিয়ে দেবো ।“
পশুপতি বৌয়ের দিকে কট্মট করে তাকিয়ে বৌকে ঝাঁঝালো সুরে বলল, “কষ্ট করে আর চা বানাতে হবে না । ক্ষিদে পেয়েছে, সুতরাং একটু পরে রাতের খাবার খেতে দিলেই চলবে । যতোসব আদিখ্যেতা !”
পশুপতি হাত মুখ ধুতে যাবে এমন সময় তপা কাচুমাচু হয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো । মেয়েকে দেখে মুখ ভেঙ্‌চি দিয়ে পশুপতি জিজ্ঞাসা করল, “সাঝ-সন্ধ্যাবেলায় তোমার আবার কী দরকার ?”
“বাবা, আমার স্কুলের মার্কশীটে তোমার স্বাক্ষর চাই”, তপা আমতা আমতা করে বাবাকে বলল ।
মার্কশিট নিয়ে ঐরকম হতচ্ছাড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? নিশ্চয়ই পরীক্ষায় ডাহা ফেল ! দেখি তো মার্কশীট, বলেই পশুপতি মেয়ের হাত থেকে টান দিয়ে মার্কশীট নিজের হাতে নিলো ।
এক ঝলক মার্কশীটের নম্বর দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো পশুপতি । তারপর রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে কষে মেয়ের গালে এক চড় । চড়ের আঘাত সামলাতে না পেরে তপা ঘরের মেঝেতে সটান্‌ পড়ে গেল । যন্ত্রণায় তপা কাঁদছে । তপার মা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলতে গেলে পশুপতি এক ধ্মকে বৌকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো । আর কট্মট করে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “তোমার লায় পেয়ে মেয়েটা উচ্ছন্নে গেছে” ।
তপা কাঁদছে ।
পশুপতি মার্কশীট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকলো ।
“বাবা, মার্কশীট আগামীকাল স্কুলে জমা দিতে হবে”, ভীত ও ত্রস্ত অবস্থায় তপা বাবাকে বলল ।
আগে নাচ বন্ধ করো তারপর স্বাক্ষর । নাচ বন্ধ না করলে আমি আর স্বাক্ষর করবো না । ধাই ধাই করে এখানে সেখানে নেচে বেড়ানো । যার জন্য ১০০ নম্বরের মধ্যে অঙ্কে ২৫ নম্বর । ইংরেজিতে ২২ নম্বর । আহারে ! নম্বরের কী ছিরি !
তারপর আবার মেয়ের উপরে রেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে নাচের সরঞ্জাম দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসে মেয়েকে ধমকিয়ে বলল, “আবার কখনও নাচে তোকে দেখেছি, তাহলে তোকে আস্ত পুড়িয়ে মারবো । তোর মা এসেও বাচাঁতে পারবে না । বলেই ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গজরাতে গজরাতে খাওয়ার ঘরে ঢুকলো ।“
( ২ )
পরের দিন রাজ্যস্তরে নাচের প্রতিযোগিতা । কলকাতার নজরুল মঞ্চে । স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতা ছুটলো নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে । এই ঘটনা একমাত্র তপার মা জানে । কেননা একমাত্র মা তপাকে নাচে ভীষণ উৎসাহ দেয় । সত্যি কথা বলতে, তপার পড়াশুনা ভাল লাগে না । পড়তে বসলেই পড়া থেকে উঠে নাচের অনুশীলন । নাচের অনুশীলনে তার পরিশ্রম নেই, বরং ভীষণ স্বচ্ছন্দ । কিন্তু তার বাবা উল্টো, পড়াশুনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না । অথচ তপার নাচই জীবন । নাচটা তার রক্তে । মনপ্রাণ দিয়ে নাচ শেখে । লুকিয়ে লুকিয়ে নাচের ক্লাস করে । নাচে ভীষণ দক্ষ । মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলকাতার নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিলো তপা । তার সঙ্গে রয়েছে সহপাঠী অনুপম । তপাকে নাচের ব্যাপারে সবরকম সহযোগিতা করে অনুপম ।
বিশাল বড় হল । রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম । প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে একজন অথবা দুইজন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে । টান টান উত্তেজনা । বিচারকের আসনে স্বনামধন্য পাঁচজন । সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হল বেলা ১১টায় । বিচারকেরা নাচের নিয়মাবলী আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন । বিচারকদের নির্দেশমতো প্রতিযোগীদের একটা মাত্র নৃত্য পরিবেশন । শুরু হল নৃত্যানুষ্ঠান ।
তপার পালা ঠিক বেলা দুটোর সময় । তাকে কত্থকের উপর নৃত্য পরিবেশনের জন্য বিচারকমণ্ডলী নির্দেশ দিলেন । তপার নৃত্যের তাল,ছন্দ ও লয় অতীব সুন্দর । তালে তালে এত সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করলো তপা, যার জন্য হলের সমস্ত শ্রোতামণ্ডলী অভিভূতো । প্রচণ্ড হাততালি । বিচারকগণ পুনরায় তপাকে নির্দেশ দিলেন আধুনিক লোকগীতির সঙ্গে আরও একটি নৃত্য পরিবেশন করতে । তপাও তেমনি ! নৃত্যের তাল সম্পর্কে তপার প্রচণ্ড দখল । এটা তার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা । মন খুলে মনের আনন্দে নৃত্য পরিবেশন করলো তপা । নৃত্যে তার অফুরন্ত আনন্দ । অনুপম অবাক ! অনুপম লক্ষ করল, তপার নাচের পরিবেশনের সময় তার সাথে সাথে অর্ধেকের বেশি শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগলেন । অনুপম আরও লক্ষ করল, মাননীয় বিচারকেরা একে অপরের প্রতি হাসিমুখে তাকালেন ।
তারপর দুজনে ছুটলো হাওড়া স্টেশন । ট্রেন ধরতে । পূর্বস্থলি স্টেশনে যখন পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ৭টা । অনুপমের সঙ্গে তপা বাড়ি ফিরছে । তপা ভাবছে এই সময়ে বাড়িতে বাবা নেই, সুতরাং বাবার বকা বা তাঁর হাতে মার খাওয়া থেকে মুক্তি । কিন্তু গাঁয়ের ভাওয়াল মাস্টার মশাই অনুপমের সঙ্গে তপার বাড়ি ফেরা দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন । সরাসরি পশুপতির দোকানে গিয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ ! শেষে কিনা আপনার মেয়ে একটা আদিবাসী ছেলের সাথে মিশছে ? ভর সন্ধেবেলায় আপনার মেয়ে কিনা নীচু জাতের আদিবাসী ছেলেটার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ! স্কুলের ড্রেস পরা । পিঠে স্কুলের বইয়ের ব্যাগ । নির্ঘাত স্কুল থেকে আলো-আধারি রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে ।“ কথাগুলি বলে ভাওয়াল মাস্টার অন্যত্র ছুটলেন ।
পশুপতি রাগে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য । দোকান খোলা রেখেই ছুটলো বাড়ির দিকে । বাড়ি পৌঁছেই চিৎকার, “তপা কোথায় ?”
স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ ধুতে বাথরুমে ঢুকেছে ।
তপা বাথরুম থেকে বের হতেই হাতের বেতের লাঠি দিয়ে তপার পিঠে বেদম মার ! তপার মা থামাতে গেলে তাকেও ঐ বেতের লাঠি দিয়ে চপেটাঘাত । মেয়েকে শাসিয়ে পশুপতি বলল, “নাচ বন্ধ । এখন থেকে শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা । এর বাইরে কোথাও দেখতে পেলে তোর ঠ্যাং খোড়া করে দেবো । স্ত্রীর দিকে ক্রূদ্ধভাবে শাসিয়ে বলল, “মেয়েকে না সামলাতে পারলে আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দেবো ।“
তারপর হন্‌হন্‌ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো পশুপতি ।
মা ও মেয়ে দুইজনেই কাঁদছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে তপা কেদেই যাচ্ছে । কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না ! কলকাতায় ছোটাছুটিতে সারাদিনের ধকলের পর বাবার হাতের বেদম প্রহারে তপা যতো না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছে বাবার হাতে মা নিগৃহীত হওয়ার জন্য !
( ৩ )
তারপর, নাচের প্রতিযোগিতার ফলাফল । সেটা ঘোষণা হবে কলকাতায় শনিবারদিন । বাড়ি থেকে কীভাবে বের হবে সেই চিন্তায় তপা অস্থির ।
মা মেয়েকে বলল, কাল অর্থাৎ শনিবার তুই ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেন ধরে কলকাতা যাবি । সঙ্গে অনুপম যাবে ।
“তুমি যাবে না মা ? তুমি আমার সঙ্গে চলো মা”, বায়না ধরলো তপা ।
যাওয়ার ইচ্ছা আমার ষোলোআনা, কিন্তু তোর বদরাগী বাবাকে নিয়ে ভয় ?
তপা মনকে শক্ত করে মাকে বলল, “আমার নাচে কোনো পুরস্কার পেলে আমি বাবাকে আর ছেড়ে কথা বলবো না । বাবার জন্য তোমার যেমনি অশান্তি তেমনি আমার ভীতি । দরকার হলে থানায় নালিশ জানাবো । বাবার অভব্যতার একটা বিহীত হওয়া দরকার, নতুবা বাবা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে” ।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা শান্তভাবে তপাকে বলল, “বাবাকে নিয়ে ওসব আজেবাজে কথা বলতে নেই মা । তোর নাচের স্বীকৃতি স্বরূপ কোনো পুরস্কার পেলে তোর বাবার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়ে যাবে । তাঁর মনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য । আমার কথাটা মিলিয়ে নিস ।“
পরের দিন মা ও মেয়ে দুইজনেই পশুপতি ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরলো । কলকাতায় রাজ ভবনের প্রেস কর্ণার হলে ফলাফল ঘোষণা । মাননীয় রাজ্যপাল বিজেতাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন । পুরো অনুষ্ঠান টিভিতে লাইফ দেখানো হবে । তপা ও মা এবং অনুপম রাজভবনে গিয়ে আসন নিয়ে বসে পড়লো । অনুপমকে রাজভবনে ঢোকার গেটে সিকিউরিটি ধরেছিল । কিন্তু তপা অনুপমকে তার জেঠতুতো দাদা বানিয়ে কোনোরকমে ম্যানেজ করল । যার ফলে অনুপম ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলো ।
এবার নাম ঘোষণার পালা ।
তপা ভীষণ টেনশনে আনচান । কোনো পুরস্কার না পেলে আজ তার বাবার কাছে রক্ষে নেই । বাড়ি থেকে মা ও মেয়েকে তাড়িয়ে দেবে । পুরস্কারের ব্যাপারে তপা যেটা বুঝেছে সেটা হচ্ছে, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছাড়া আরও জেলা ভিত্তিক একটি করে পুরস্কার । জেলা ভিত্তিক দশ জনের পুরস্কার । পুরস্কারে নগদ ৫০,০০০/- টাকা এবং মানপত্র । প্রথম পুরস্কার ৫ লাখ, দ্বিতীয় পুরস্কার ৩ লাখ এবং তৃতীয় পুরস্কার ২ লাখ টাকা এবং সঙ্গে মানপত্র ।
নাম ঘোষণার জন্য মঞ্চে উঠে এলেন মাননীয় ঘোষকঃ-
হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ । রাজ্যের মন্ত্রী ও উচ্চ পদাধীকারি আধিকারিকগণ । নাম ঘোষণা করলেন —- প্রথম, পূর্বস্থলির তপতি বেরা ।
তারপর হাততালি । প্রচুর হাততালি । ঘোষক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “তপতিকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি ।“
মঞ্চে তপতির ওঠবার পর ঘোষক তাঁর হাতের মাইকটি তপতির হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলো ।“
এদিকে ভাওয়াল মাস্টার পশুপতিকে আবার খবর দিয়ে বলল, “টিভিতে তোমার মেয়েকে দেখাচ্ছে । এখন টিভি খুললেই তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে ।“
সঙ্গে সঙ্গে পাশের দোকানে টিভির সম্মুখে এসে পশুপতি অবাক ! তাঁর মেয়ে প্রেস, মিডিয়া্‌ ও অনেক শ্রোতামণ্ডলির সামনে নির্দ্বিধায় বলছে, “নৃত্য শিক্ষায় আমার অনুপ্রেরণা আমার মা । মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতে আমার নৃত্য শিক্ষার বাস্তবায়ন ।“
পশুপতির চোখ ছলছল । সে আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলো, ফিরে এলে মেয়েকে আর বকবে না । মেয়ে যেটা চায় সেটাই করবে । মেয়ের ক্যারিয়ারে কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না । সে এখন পরিষ্কার বুঝেছে, “যার যেদিকে ঝোঁক তাকে সেদিকেই এগিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় ।“ রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো পশুপতি ।
( ৪ )
তারপর স্কুল, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সকলে তপার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । নাচের প্রতিযোগিতায় তপা রাজ্যে প্রথম হওয়ায় সকলেই গর্বিত ।
পশুপতি কাচুমাচু হয়ে মেয়ের কাছে নত হয়ে ছলছল চোখে বলল, “মা আমাকে ক্ষমা করিস্‌ ।“
তপা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর দুজনের চোখে আনন্দাশ্রু ।
———০———

Share This
Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, ত্রয়োদশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

কঙ্কাবতী প্রমোদের বাড়ি গিয়ে হতাশ ! প্রমোদের বাড়িতে আদর-আপ্যায়ন দূরে থাক তার বাবা-মায়ের ব্যবহারে মর্মাহত । প্রমোদের বাবার অমানবিক ব্যবহারে উদ্বিগ্ন ! হতাশ হয়ে অনিন্দ কঙ্কাবতীকে বলল, “এখানে অনীশার বিয়ে দেওয়া চাপ হয়ে দাঁড়াবে ।“
অনিন্দকে আশ্বস্ত করে কঙ্কাবতী বলল,”ধীরে, আগেভাগে নেতিবাচক মন্তব্য করো না । আজকের ঘটনাটা নিয়ে প্রমোদের সঙ্গে আলাদা বসে আলোচনা করলে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যাবে ।“
কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে মাকে ঘোতন বলল, “আমাদের জাতি ও আমাদের পরিবার সম্বন্ধে তাঁরা অনেক আগেই অবগত । তা সত্ত্বেও কেন বিশ্রিভাবে প্রমোদের বাবা বললেন, আপনাদের সম্প্রদায়ে আমরা আত্মীয়তা করতে পারব না । তা ছাড়া তিনি আরও বললেন, আমাদের পরিবার নাকি তাঁদের অপছন্দ ? এইসব কথা বলার পেছনে তাঁদের কী অভিপ্রায়, বোঝা গেলো না ।“
“প্রমোদ বাড়িতে অনীশার সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসার বিষয়টি ভালভাবে বোঝাতে পারেনি । অথবা অনীশাকে ভালবাসে, একথাটাও বাড়িতে জানায়নি । ফলে বাড়ির লোকজন ভাবছেন, পাঁচটা পরিবার যেমন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ছেলের বাড়ি হাজির হন তেমনি আমরাও আমাদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব নিয়ে তাঁদের বাড়ি হাজির হয়েছি । যার জন্য প্রমোদের বাবা ঘুণাক্ষরেও মেয়ের সম্বন্ধে ইতি বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন না । জাত-পাতের ইস্যু তুলে আমাদের বিদায় দিলেন ।“ এই কথাগুলি ছেলের প্রশ্নের উত্তরে বলেই কঙ্কাবতী আবার বলল, “প্রমোদকে এবার দায়িত্ব নিতে হবে তার বাবা-মাকে বোঝানোর । তাহলে তাঁরা আর তাঁদের ছেলের বিয়ে আমাদের অনীশার সাথে বিয়ে দিতে গররাজি হবেন না । আমরা এখানে এসেছি অনীশার কথার উপর নির্ভর করে । আমরা কিন্তু প্রমোদের সাথে কোনোরকম আলাপ আলোচনা করিনি । সুতরাং এবার ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে পরবর্তী সিদ্ধান্তে আসতে হবে ।“
কঙ্কাবতী সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো ।
উন্মুখ হয়ে বসেছিলো অনীশা । বাবা-মায়ের ফ্যাকাশে মুখ দেখে অনীশা কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলো না । তাই সে আগ বাড়িয়ে কিছু জানতেও চাইলো না । বরং কঙ্কাবতী অনীশার কাছে এসে বলল, “তুই একটু প্রমোদকে খবর দে, সে যেনো সত্বর আমাদের সাথে দেখা করে ।“ আর একটা কথা, “প্রমোদের বাড়ি গিয়ে আমরা ভাল খবর আনতে পারিনি ।“
“কী হয়েছে, আমাকে একটু খুলে বলবে ?” মাকে জোর দিলো অনীশা ।
প্রমোদের বাবা আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর ছেলের বিয়ে দিতে অনিচ্ছুক !
অনীশা জানতে চাইলো, “কেন অনিচ্ছুক, সেই ব্যাপারে কিছু কী বলেছে ?”
সেসব কিছু বলেননি । শুধুমাত্র তিনি এই মুহূর্তে তাঁর ছেলের বিয়ে আমাদের পরিবারের সাথে দিতে রাজি নন । তাঁর এইটুকু ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন ।
অনীশা আর কথা বাড়ালো না । সে বুঝতে পারলো, কোথাও একটা ভুল বোঝবুঝির শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে । সেটা শোধরানোর জন্য সম্ভবত মা প্রমোদকে ডেকে পাঠালো ।
*****************************
প্রমোদকে ডেকে তার বাবা-মা জানিয়ে দিয়েছেন, চড়ুইডাঙ্গার অনিন্দবাবুর মেয়েকে তাঁরা পুত্রবধূ করে ঘরে তুলতে নারাজ । প্রমোদ অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু তার বাবা-মা কোনো যুক্তি মানতে রাজি নন । ফলে অনীশার সাথে বিয়ের জন্য বাড়ির অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে প্রমোদ প্রচণ্ড হতাশ !
অনীশার পাঠানো খবর পেয়ে প্রমোদ সশরীরে দোকানে হাজির ।
“তোমার বাবা নাকি আমাদের বিয়ে মানতে নারাজ ? কথাটা কী সত্যি ?” অনীশা প্রমোদের কাছে জানতে চাইলো ।
প্রমোদ চুপ করে থাকলো ।
ঠিক সেই সময় অনীশার চায়ের দোকানে কঙ্কাবতী উপস্থিত । প্রমোদকে দেখতে পেয়ে কঙ্কাবতী বলল, “ আমি তোমাকে খোঁজ করছিলাম ?”
কাঁচুমাচু হয়ে প্রমোদ কঙ্কাবতীকে বলল, “ঐদিন আপনাদের প্রতি বাবা-মায়ের ব্যবহারে আমি লজ্জিত । আমি বাবা-মায়ের হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।
“ব্যাপারটা ক্ষমার প্রশ্ন নয় । প্রশ্ন হচ্ছে “তুমি অনীশাকে ভালবাসো” এই কথাটা বাড়িতে বুঝিয়ে বলতে পারোনি । এটা তোমার একধরনের গাফিলতি । বাবা-মাকে আগেভাগে বোঝানো থাকলে তোমার বাবা-মা নিশ্চয় ভাল ব্যবহার করতেন । আমি তোমার বাবা-মায়ের ব্যবহারে এতটুকু বিভ্রান্ত হইনি । আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি তোমার মা-বাবাকে তোমাদের দুইজনের ঘর বাঁধার স্বপ্নের কথা খুলে বোঝাতে পারোনি । তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ । স্কুলের মাস্টার মশাই ছিলেন । তাঁর একটা নিজস্ব মতামত রয়েছে । তিনি গাঁয়ের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি । তাই তাঁর ছেলের বিয়ের ব্যাপারে অনেক স্বপ্ন থাকতে পারে । সুতরাং আমার অনুরোধ, তুমি আগে মা-বাবাকে বোঝাও । তারপর তোমাদের চার হাত এক-করার দায়িত্ব আমাদের !” কঙ্কাবতী প্রমোদের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “আমি কী তোমাকে বোঝাতে পারলাম ?”
মাথা নেড়ে তার সম্মতির কথা জানালো প্রমোদ ।
বাবার কাছে নিজের বিয়ের কথা বলতে গিয়ে এবার রীতিমতো ধমক খেলো প্রমোদ । তার বাবার সাফ জবাব, তিনি বেঁচে থাকতে বে-জাতের মেয়েকে কিছুতেই ঘরে তুলতে পারবেন না ।
প্রমোদের বাবা আগেকার ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী । ছেলে-মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনোরকম আপসে যেতে রাজী নন । তাই প্রমোদের বাবা জাত-পাত দেখে পাত্রী নির্বাচন করার পক্ষপাতী । প্রমোদের কোনো যুক্তি তিনি মানলেন না ।
বাবার কড়া ভাষার কচকচানিতে প্রমোদের মনটা ভেঙ্গে চুড়মার । কয়েকদিন চুপচাপ ঘরে বসে কাটিয়ে দিলো । ভাবনার জগতে সে নিমজ্জিত, অতঃপর কী করণীয় ?
বন্ধুবান্ধবদের সাথে শলাপরামর্শ মোতাবেক প্রমোদ সিদ্ধান্ত নিলো, “সে বাবা-মায়ের অমতে অনীশাকে বিয়ে করবে !”
তারপর…………?
তারপর হঠাৎ দোকান বন্ধ রেখে অনীশা প্রমোদের সঙ্গে উধাও । কেউ তাদের খোঁজখবর পাচ্ছে না । এমনকি প্রমোদের বাবা কঙ্কাবতীর বাড়ি গিয়ে ছেলের খোঁজ নিয়ে এসেছে । সেখানে তাকে দেখতে না পেয়ে কী করবেন, সেটাই ভাবছেন ! কঙ্কাবতীকেও তার মেয়ে অনীশা কিছুই বলে যায়নি । সবটাই তারা গোপন রেখেছে । যার জন্য কঙ্কাবতী নিজেও তার মেয়ের উধাও হওয়ার ব্যাপারে পুরোটাই অন্ধকারে । তবে কঙ্কাবতী এবার পরিষ্কার বুঝতে পারছে, প্রমোদ তার ভালবাসাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত । এটা একটা ভাল লক্ষণ । এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রমোদ সত্যিই অনীশাকে ভালবাসে ।
চারিদিকে খোঁজাখুঁজি । ঘোতন কয়েকটি জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে বোনের কোনো হদিস পেলো না । সম্ভাব্য সব জায়গায় হানা দিয়ে ঘোতন হতাশ ! তার ধারণা, অনীশা ও প্রমোদ পালিয়ে লোকালয় থেকে অনেক দূরে চলে গেছে এবং সেই খবরটা উদ্ধার করাও খুব কঠিন !
প্রমোদের বাবা স্থানীয় পঞ্চায়েতে নালিশ জানালেন, তাঁর ছেলেকে নাকি কঙ্কাবতীর গুণ্ডা ছেলে ঘোতন গায়েব করে দিয়েছে । কোথায় আটকে রেখেছে সেই হদিস এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । অথচ তার ছেলে প্রচণ্ড গোবেচারা । সে কোনো ঝুটঝামেলার মধ্যে থাকে না । শোনা যাচ্ছে, কঙ্কাবতীর মেয়ে অনীশাকেও পাওয়া যাচ্ছে না । সুতরাং ছক কষে কঙ্কাবতী ও তার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে প্রমোদকে গায়েব করে দিয়েছে । তিনদিন ধরে ছেলেটা নিখোঁজ । অথচ আজ পর্যন্ত জানা গেলো না, “ছেলেটি কোথায় লুকিয়ে রয়েছে ?”
পঞ্চায়েত প্রধান কড়জোড়ে প্রমোদের বাবাকে জানিয়ে দিলেন, দুজনেই অনেক বড় । নিজেরা নিশ্চয় যুক্তি করে পালিয়েছে । সুতরাং সেখানে পঞ্চায়েতের বা পুলিশের ভূমিকা নেই বললেই চলে । দেশের সুনাগরিক হিসাবে এবং অ্যাডাল্ট হিসাবে তাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আইনগত বাঁধা নেই । সেই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে হস্তক্ষেপ করা আইন-বিরোধী ।
তাহলে কী আমার ছেলেকে আর ফিরে পাবো না ?
“অবশ্যই ফিরে পাবেন । প্রয়োজনে দৈনিক খবরের কাগজে ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিন ।“ এই কথাগুলি বলে পঞ্চায়েত প্রধান অতিরিক্ত আর একটি বাক্য ব্যয় করলেন না । বরং স্থান ত্যাগ করলেন ।
প্রমোদের বাবা থানা পর্যন্ত গেলেন । সেখানে একটা মিসিং ডায়েরী করলেন । কিন্তু সেখানেও ছেলে ফিরে পাওয়ার কোনো হদিস পেলেন না । কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তিনি নন । অনেক ভেবেচিন্তে প্রমোদের বাবা জেলা প্রশাসনের স্মরণাপন্ন হলেন ।
এইদিকে প্রমোদ ও অনীশা সোজা রামপুরহাট । তারামায়ের মন্দিরে পুজো দিয়ে পুরোহিতকে প্রমোদ বলল, “ঠাকুর মশাই, আমি ও অনীশা একে অপরকে ভালবাসি এবং দুইজনে বিয়ে করতে চাই । আপনি আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করুন ।“
পুরোহিত মশাই বিয়ের সরঞ্জাম গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । ঠিক সন্ধ্যা সাতটার সময় পুরোহিত মশাই বিয়ের পিঁড়িতে বর ও কনেকে ডাকলেন । অন্যদিকে তারামায়ের মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি চলছে । ঐদিকে সান্ধ্যকালীন মায়ের পূজো এবং এইদিকে প্রমোদ ও অনীশার বিয়ে, দুটিই সমানতালে চলছে । প্রমোদের ও অনীশার বিয়ের সময় পুরোহিত ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি উপস্থিত নেই । হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে বিয়ের সময় উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি ।
হঠাৎ পুলিশ নিয়ে বিয়ের আসরে সরাসরি হাজির প্রমোদের বাবা । সঙ্গে প্রমোদের মা ও গাঁয়ের কয়েকজন গণ্যমান্য গ্রামবাসী ।
পুলিশকে উদ্দেশ্য করে প্রমোদের বাবা বললেন, “দেখুন স্যার । নিজের চোখে দেখুন । আমার ছেলেটাকে তুলে এনে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে । আপনি এর একটা বিহিত করুন । মেয়েটার ছোট ভাই এলাকার নামকরা মস্তান । তার অঙ্গুলি হেলনে আমার ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে ।“
পুরোহিতকে পুলিশ বললেন, “এই বিয়ে বন্ধ করুন ।“
বেঁকে বসলো প্রমোদ । তাই প্রমোদ পুরোহিতকে বলল, “আপনি বিয়ের পর্ব চালিয়ে যান । আপনি বিয়ের কাজে থামবেন না ।“
আবার পুলিশ পুরোহিতকে বললেন, “আপনি বিয়ে বন্ধ করুন ।“
পুরোহিত ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশ বললেন, “স্যার, আমি বরের নির্দেশ মতো কাজ করছি । যা বলার বিয়ে যিনি করছেন সেই বরকে বলুন ।“
পুলিশ প্রমোদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রমোদবাবু, আপনার বাবা আমাদের কাছে লিখিত নালিশ জানিয়েছেন আপনার নাকি আপনার অমতে বিয়ে হচ্ছে । এটা কী সঠিক ?”
“একদম বেঠিক । আমরা অ্যাডাল্ট । দুজনের পূর্ণ সম্মতিক্রমে এই বিয়ে হচ্ছে । সুতরাং বাবার লিখিত নালিশ এইক্ষেত্রে খাটবে না ।“ বলেই পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে বিয়ের মন্ত্র বলতে শুরু করলো প্রমোদ ।
পুলিশ প্রমোদের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেল, “সরি, দুইজনের মতে যেহেতু বিয়েটা সংঘটিত হচ্ছে সেখানে আমাদের কিচ্ছু করার নেই ।“ তারপর পুলিশ যেকজন এসেছিলেন, জিপে উঠে ফিরে গেলেন ।
প্রমোদের বাবা রেগে ছেলেকে শুধুমাত্র মারতে বাকী । যাচ্ছেতাইভাবে গালিগালাজ করলেন । গ্রামের মানুষের সামনে রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, “আজ থেকে প্রমোদ আমার ত্যাজ্যপুত্র । আমি তার মুখ দর্শন করতে চাই না ।“ বলেই সবাইকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।

দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)
— ( চলবে )

Share This
Categories
কবিতা

স্বপ্নের রং : রাণু সরকার।

প্রাণের পাখি ভালোই তো-
শূন্যে বিচণ করছিলি
কেনো তোর-মন চাইলো যেতে-
অজানায়?

বন্ধনমুক্ত করে- দিলি উড়াল!
ভয়ে তোর হৃদযন্ত্রের কম্পন
হয়নি বুঝি?
প্রণয়াসক্ত ছিলি–
বিকৃতমস্তিষ্ক হলো-
কে করলো তোকে বিবর্ণ?
সেকি বাদ্যকর?

ডানার ভাঁজে আড়াল
রেখেছিলি অতীত!
মনে পড়ে স্বপ্নের রং
মেখেছিলি তুই গায়ে?

ঝড় তো ওঠেনি তবে কেনো
পথ হারালি?
দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
বর্তমানে আষাঢ়ের প্রত্যাশায়
কাটে দিবারাত্রি!

তালগাছে যে- তোর অতীত
কি করে ফিরবি?
স্বয়ং ডানা নিয়েছিস ছেঁটে||

Share This
Categories
কবিতা

বন্দি জীবনের আখ্যান : রাণু সরকার।

অসুখে ঘরে বন্দি,
কালের কাছে নিজেকে
সযত্নে মুড়ে রাখা,
কার প্রত্যাশা করা কি ঠিক?

জানালা দিয়ে ধরণীকে দেখি,
বাতাসে ভেসে আসে বাণী শুনি,
সাথে থাকে মাটির গন্ধ।
খানিক বাদে স্বল্পবাক হয়ে যাই,
মাথা করি নিচু,
নিশ্বাস পড়ে বুকে।

পঙ্কিল সম্পর্কশূন্য
এভাবেই হয়তো অবস্থান নির্ণয়-
শব্দহীন সুচ দিয়ে সেলাই করে যাওয়া
অনাবৃত নির্বুদ্ধি,
কল্পনায় ভয়ে ভয়ে করে ঘুমের ঘোরে চুম্বন!

Share This
Categories
রিভিউ

নদীয়া জেলায় সাহিত্য সমাবেশ।

নদীয়া জেলার মুড়াগাছার গাছা বাজারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল “সাহিত্য সমাবেশ ও গ্রন্থ প্রকাশ” অনুষ্ঠান । ভূমিপুত্র বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক বীরেন্দ্রনাথ সরকারের উদ্যোগে গান, আবৃতি, কবিতা পাঠ, ইত্যাদি নিয়ে একটি সুন্দর মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান । বিভিন্ন জেলার কবি সাহিত্যিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন । অনুষ্ঠানটিতে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন সিস্টার নিবেদিতা আই-টি-আই’এর অধ্যক্ষ মাননীয় প্রবোধ কুমার দাস । বাঙালি বিশ্বে স্বনামধন্য এবং এপার বাংলা-ওপার বাংলার জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক দিলীপ রায় প্রধান অতিথি হিসাবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন । বিশেষ অতিথি হিসাবে মঞ্চে গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া । ছিলেন বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক বিমলচন্দ্র গড়াই, বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ তপন কুমার গাঙ্গুলি, প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস, ড. অমিত কুমার রায়, শিশু সাহিত্যিক স্বপন পাল, বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক ভুবন পাল, বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল ও রবি সরকার । উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয় । উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন সহেলী চ্যাটার্জী । তারপর উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন বীরেন্দ্রনাথ সরকার । স্বাগত ভাষণের পর মঞ্চে উপবিষ্ট গুণীজনদের হাত ধরে বীরেন্দ্রনাথ সরকার ও দিলীপ পালের লেখা গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন হয় । মোড়ক উন্মোচনের সময় বীরেন্দ্রনাথ সরকারের স্ত্রী, প্রীতিকণা সরকার ও একমাত্র ছেলে উপস্থিত ছিলেন । তারপর প্রধান অতিথির ভাষণ । প্রধান অতিথি তাঁর ভাষণে বাংলা ভাষার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং গাছা বাজারের মতো জায়গায় সাহিত্যের অনুষ্ঠানের তাৎপর্য তুলে ধরেন । তিনি উপস্থিত কবি সাহিত্যিকদের বাংলা সাহিত্য শ্রীবৃদ্ধিতে নজর দিতে অনুরোধ করেন । সমাজ উন্নয়নে তথা দেশ উন্নয়নে কবি সাহিত্যিকদের ভূমিকার কথাও মনে করাতে ভুলে যাননি । মাননীয় তপন কুমার গাঙ্গুলি, স্বপন পাল ও বিমলচন্দ্র গড়াই তাঁদের ভাষণে সাহিত্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন । উপস্থিত ছিলেন অর্ক দীপের সাহিত্য সোপানের কর্ণধার ডাঃ দীপ্তি রায় । তিনি কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের নিরিখে সুন্দর বার্তা দিয়েছেন । কবিতা পাঠ করেছেন অনেকেই । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুমিতা পয়ড়া (নদীয়া), রণজয় মালাকার (উঃ ২৪ পরগণা) , ফটিক বিশ্বাস (হুগলী), মানিক সরকার (নদীয়া), প্রমুখ । অন্যান্য কবিদের কন্ঠে কবিতা পাঠ অনন্য সুন্দর হয়ে উঠেছিল । কবি সুসময় বিশ্বাস নিজের লেখা ও সুর দেওয়া গান পরিবেশন করলেন । সমস্ত অনুষ্ঠানটি সর্বাঙ্গসুন্দর হওয়ায় সভাপতি তাঁর ভাষণে কর্মকর্তাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন । সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভূমিপুত্র ও শিশু সাহিত্যিক দিলীপ পাল ।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

নারী : অর্ধেক আকাশ ছাড়িয়ে।

“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্দ্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্দ্ধেক তার নর।”
কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই বিখ্যাত লাইন দুটি উচ্চারণ করতে করতে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, আমাদের সমাজে নারীরা কি তাদের সমান অধিকার পেয়েছে? সাম্প্রতিক সময় থেকে অতীত, ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই সমান অধিকার দূরে থাক নারীরা তাদের যোগ্য সম্মান পায়নি, এখনও হয়তো সেভাবে পায় না। একথা ঠিক বর্তমানে তাদের সামাজিক অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়েছে কিন্তু অবমাননা, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা প্রভৃতি ব্যাপারগুলো আজও থেকে গেছে। আমাদের সমাজে একটা সময় ছিল যখন মেয়েদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। তারা শিক্ষিত হলে তাদের জীবনে অকাল বৈধব্য নেমে আসবে, সমাজ-সংসার রসাতলে যাবে এরকম ভাবনা মানুষের মনে ছিল। নানাবিধ কুসংস্কার, আচার, প্রথার জালে জড়িয়ে তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই দমিয়ে রাখার প্রয়াস আজও চলছে। হয়তো পূর্বের থেকে পদ্ধতিগুলো কিছুটা বদলে গেছে। নারীরাও এসব মেনে নেয় কিংবা মেনে নিতে বাধ্য হয় কেননা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে সর্বদাই দুর্বল বলে ভাবা হয়েছে, শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই। নারীদের একটা বিরাট অংশও মনে মনে নিজেদের সেরকমই মনে করে। এতে তাদের কোনো দোষ নেই। কেননা যুগের পর যুগ ধরে এমন ধরনা যদি তাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাহলে এই ভাবনা ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবনাটি কি আদৌ ঠিক? শারীরিক দিক দিয়ে নারীরা হয়তো পুরুষদের থেকে কিছুটা দুর্বল কিন্তু অন্যান্য বিষয়েও কি তাই? তাছাড়া শারীরিক দিক দিয়েও বা তাদের দুর্বল বলি কী করে? সৃষ্টির ধারক কি দুর্বল হতে পারে? যে নারী গর্ভে সন্তান ধারণ করে, দশ মাস দশ দিন সেখানে লালন পালন করে, তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে তাকে পৃথিবীর আলো দেখায় তাকে শারীরিকভাবে দুর্বল ভাবা বোকামি। আর বর্তমান সময়ে নারীরা সমস্ত কাজে পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে। বৃহৎ ক্ষেত্র বাদ দিয়ে একেবারে সাধারণ কথাই ধরা যাক। একজন সাধারণ গৃহবধূকে নিত্যদিন সংসারে যে কাজ করতে হয় তা তাদের শারীরিক দুর্বলতা নয়, সক্ষমতাই প্রমাণ করে। এসব সাংসারিক কাজগুলো আমাদের বিচার বিবেচনায় স্থান পায় না বলে নারীদের শক্তি, সামর্থ কিংবা দক্ষতা আমাদের চোখে পড়ে না। সে যাই হোক, তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নিলাম নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল কিন্তু মানসিক এবং বৌদ্ধিক দিক দিয়ে? আমার মনে হয় এক্ষেত্রে নারীরা দুর্বল তো নয়ই বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের থেকে অনেক এগিয়ে। বর্তমান ছেড়ে একেবারে অতীত থেকে কিছু দৃষ্টান্ত দিলে আমার মনে হয় ব্যাপারটা পরিস্কার হবে।

যে কৃষিকাজ আদিম মানুষকে যাযাবর জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে স্থিতিশীল ও তুলনামূলক উন্নত জীবন দিয়েছিল সেই কৃষিকাজের পরিকল্পনা প্রথম মাথায় এসেছিল নারীদের। সাহিত্যের দিকে চোখ বোলালে দেখা যাবে সেখানেও তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিশ্বের প্রথম লেখক হলেন মেসোপোটিয়ান রাজা প্রথম সারগনের কন্যা এনহেদুয়ান্না। তাঁর লেখার নিদর্শন পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দে। বিশ্বের প্রথম পেশাদার পুস্তক সমালোচক হলেন আমেরিকার মার্গারেট ফুলার। তাঁর রচিত বই ‘ওম্যান ইন দা নাইনটিন সেঞ্চুরি’। বিশ্বের প্রথম ঔপন্যাসিক হলেন লেডি মুরাসাকি নামে এক জাপানী মহিলা। যিনি ১০০০ থেকে ১০০৮ অব্দের মধ্যে লিখেছিলেন ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’। আমাদের বাংলা ভাষায় প্রথম আত্মজীবনী লেখেন একজন মহিলা, রাসসুন্দরী দেবী। পঞ্চম শতাব্দীর বিখ্যাত গনিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন হাইপেশিয়া যাকে নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল ধর্মীয় উন্মাদদের হাতে। যাঁর মৃত্যুতে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছিল এক কৃষ্ণ অধ্যায়। যে অন্ধকার সময় চলেছিল প্রায় এক হাজার বছর।

আমাদের দেশের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা অসংখ্য মহীয়সী নারীর কথা জানতে পারি। বৈদিক যুগের আদি পর্বে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমান অধিকার ভোগ করার সুযোগ পেত। ঘোষ, অপালা, বিশ্ববারা, গার্গী, মৈত্রেয়ীর মতো বহু মহিয়সী নারীর উল্লেখ আছে বেদ, উপনিষদের আদি গ্রন্থে। এমনকি মধ্যযুগে যখন সমাজে নারীদের অবস্থানের অনেক অবনতি ঘটেছিল তখনও আমরা খনা কিংবা লীলাবতীর মতো বিদূষী নারীকে পেয়েছি। তাহলে কী করে বলি মেধা ও মননের দিক থেকে নারীরা পিছিয়ে? তাছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের হয়তো একটা গন্ডীর মধ্যে আটকে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে কিন্তু তাদের মেধা কিংবা বুদ্ধিকে পুরুষরা কাজে লাগায়নি একথা কী করে বলা যায়? কাজী নজরুল বলেছেন—“কোন কালে একা হয়নি কো জয়ী/পুরুষের তরবারি/শক্তি দিয়েছে প্রেরণা দিয়েছে/ বিজয়লক্ষ্মী নারী।”

একটি সংসারকে সুন্দর করে চালনা করা, তাকে নান্দনিকতায় সাজিয়ে তোলা প্রভৃতিতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা অনেক বেশি দক্ষ। আর বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাই সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে নারীদের গর্বিত পদচারনা। যুগ যুগ ধরে তাদের নানাভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে হয়তো তাদের মধ্যেকার শক্তিশালী সত্তাটি যাতে না প্রকট হয়ে পড়ে সে জন্য। দুর্বলকে তো দমিয়ে রাখার প্রয়োজন হয় না। এই দমিয়ে রাখার প্রয়াস প্রমাণ করে তারা সবদিক দিয়ে পিছিয়ে নয় বরং এগিয়ে। এই দমিয়ে রাখার প্রয়াসটাই আসল দুর্বলতা, ভাবনা ও মানসিকতার। যদি তা না করা হত তাহলে যুগের পর যুগ ধরে সমাজে নারীদের যে দুর্দশার জীবনধারা আমরা দেখে এসেছি বা বর্তমানেও দেখছি, সেটা হত না। তাতে লাভ হত আমাদের সমাজ-সংসার সবকিছুর। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, হাতে হাত রেখে চলার মধ্যে কোনো দুর্বলতা বা হীনতা নেই, থাকে বন্ধুত্ব আর বিশ্বাস যা যে কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার পথকে অনেক মসৃণ করে।

আমার মনে হয় নারীদের মধ্যে যে অফুরন্ত শক্তি আছে তাকে দমিয়ে না রেখে, স্ফূরণের সুযোগ দিতে হবে। তাতে আমাদের সকলেরই লাভ। সেই সঙ্গে সঙ্গে নারীদেরও বুঝতে হবে নিজেকে, নিজের মধ্যেকার শক্তিকে। আমরা যদি পুরাণে চোখ রাখি তাহলে দেখতে পাই দেবী মহামায়া একদিকে যেমন জননী অন্যদিকে তেমনি রনসংহারকারী, অসুর নিধনকারী। আজকের সময়েও নারীদের তাদের মধ্যেকার এই দ্বৈত সত্তাকে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলে সমাজে তাদের স্থান মজবুত হবে।

সবশেষে বলি, নারীদের অবমাননা নয়, বঞ্চনা কিংবা লাঞ্ছনা নয়, তাদের দমিয়ে রাখার প্রয়াসও নয়—ভালোবাসা আর যথাযথ মর্যাদায় যদি তাকে সমাজে স্থান দেওয়া হয় তাহলে সভ্যতার সঠিক বিকাশ সম্ভব, যা আজকের সময় কিছুটা হলেও বুঝেছে। আগামী সময়েও সেই ধারার অগ্রগমন শুধু নারী সমাজ নয়, আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে একটা সুদৃঢ় অবস্থানে স্থাপিত করবে।

কলমে : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

Share This
Categories
অনুগল্প প্রবন্ধ

স্বামীজি ও বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন : তন্ময় সিংহ রায়।

জাহাজ ও দু-দুটো ট্রেন পাল্টে অবশেষে ৩০ শে জুলাই রাত ১১ টায় তিনি উপস্থিত হলেন শিকাগোয়।
ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরটা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে তাকে ফেলেছে এক চরম অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতে, এমনটাই মনে হচ্ছিল। পরিস্থিতি ধারণ করলো আরো জটিল আকার যখন তিনি জানতে পারলেন যে, ধর্মমহাসভায় পরিচয় পত্র আবশ্যক ও যোগদানের তারিখ-ও পেরিয়ে গেছে।
মুহুর্তের মধ্যেই মনে হতে লাগলো অতি যত্নে সাজানো সমস্ত রঙীন স্বপ্নগুলো তাঁর চোখের সামনেই হয়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো!
এদিকে শিকাগোর মতন বড়লোকি শহরে থাকার খরচ।
সামান্য পুঁজি ফুরিয়ে আসার মুহুর্তে তিনি আবিষ্কার করলেন বস্টন নামক একটি শহর যেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ অনেকাংশে কম। অবশেষে বস্টন অভিমুখে রওনাকালীন ট্রেনে পরিচয় হয় ক্যাথেরিন স্যানবর্ন নামক এক ধনী ও প্রভাবশালী মহিলার সাথে।
প্রতিভাদীপ্ত সুদর্শন এক পুরুষের সাথে তিনি নিজেই এসে পরিচয় করে দু-এক কথায় মুগ্ধ হয়ে স্বামীজি-কে তার বাড়িতে থাকার জন্যে জানালেন হার্দিক আমন্ত্রণ!
এ অবস্থায় স্বামীজি সাদরে গ্রহণ করলেন সে আমন্ত্রণ। ক্যাথেরিন স্যানবর্নের বাড়িতে থাকাকালীন স্বামীজি তাঁর এক শিষ্যকে চিঠিতে জানালেন, ‘এখানে থাকায় আমার প্রতিদিনের এক পাউন্ড করে বেঁচে যাচ্ছে আর তাঁর(ক্যাথেরিন স্যানবর্ন) প্রাপ্তি হল, তিনি তাঁর বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে দেখাচ্ছেন ভারতের এক বিচিত্র জীবকে!’
বস্টনে থাকাকালীন ক্যাথেরিন স্যানবর্নের সূত্রে সেখানকার শিক্ষিত সমাজে স্বামীজি হয়ে উঠেছিলেন ভীষণভাবে পরিচিত। অকস্মাৎ ক্যাথেরিনের মাধ্যমে স্বামীজির পরিচয় হয় হাভার্ড ইউনিভার্সিটির এমন একজন সুবিখ্যাত প্রফেসার জন হেনরি রাইটের সাথে যাকে বলা হত বিশ্বকোষতুল্য জ্ঞানভান্ডারের অধিকারী। কিন্তু স্বামীজির তেজোদীপ্ত প্রতিভার আলোক ছটায় বিষ্ময়ে হতবাক হলেন তিনিও। পরিচয়পত্র না থাকায় তিনি (স্বামীজি) মহাধর্মসম্মেলনে যোগ না দিতে পারার সংক্ষিপ্ত কারণ বিশ্লেষণে প্রফেসার প্রত্যুত্তর করলেন, ‘মহাশয়, আপনার কাছে পরিচয়-পত্র চাওয়ার অর্থ এমন যে সূর্যকে প্রশ্ন করা যে তার কিরণ দেওয়ার অধিকার আছে কিনা।’ অতঃপর মহাধর্মসম্মেলনের এক কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে প্রফেসার রাইট লিখলেন :
‘ইনি (স্বামীজি) এমন একজন ব্যক্তি যে, আমেরিকার সমস্ত প্রফেসারের পান্ডিত্য এক করলেও এঁর পান্ডিত্যের সমান হবে না।’ অবশেষে স্বামীজী’র মনে হতে লাগলো তাঁর রঙীন স্বপ্নগুলো জোড়া লাগতে শুরু হল আবার ধীরে ধীরে।
বস্টনে সপ্তা তিনেক থাকার পর শেষে তিনি রওনা হলেন শিকাগো অভিমুখে।

১১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩, শিকাগোর কলম্বাস হলে সকাল দশটায় বিশ্ব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল যে আধিদৈবিক সিংহপুরুষের দ্বিতীয় অধিবেশনের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে তিনি-ই হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
“সিস্টার্স এন্ড ব্রাদার্স অফ অ্যামেরিকা”…… হাজার হাজার দর্শকমণ্ডলীর হর্ষধ্বনি ও করতালিতে ফেটে পড়েছিলো মঞ্চ।
মনে হচ্ছিল এক সংক্ষিপ্ত শক্তিশালী আঁধি সেই মুহুর্তে, সেই স্থানের উপস্থিতজনেদের উপর দিয়ে বয়ে গেলো। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের জয়ঢাক তিনি বাজাননি। মহা ধর্মসম্মেলনে যেখানে সবাই নিজ নিজ ধর্ম সম্বন্ধেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেখানে স্বামীজি দেখিয়েছিলেন, সব ধর্মই সত্য কারণ প্রতিটি ধর্মই মানুষকে পৌঁছে দেয় একই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে।

১৯৯২ সালে স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার একশত বছর পূর্তির আগে এলেনর স্টার্ক নামক এক আমেরিকান মহিলা স্বামীজিকে নিয়ে ‘দ্য গিফট আন-ওপেন্ড.. এ নিউ আমেরিকান রেভলিউশন’ নামক একটি বই লিখেছিলেন যাতে লেখিকা স্বামীজির বাণীকে বর্ণনা করেছেন ‘উপহার’ বলে অর্থাৎ, ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকাকে দেওয়া উপহার।
তিনি বলেছেন, সেই উপহারের প্যাকেট আমেরিকা খুলে দেখেনি, স্বামীজির বাণীকে তারা জীবনে ব্যবহার করেনি। যদি তারা তা করত, একটা নতুন ধরণের বিপ্লব ঘটে যেত আমেরিকাবাসীদের জীবনে।’ ঐ বইতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকা মহাদেশের ভূখন্ডটা কিন্তু বিবেকানন্দ আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকার আত্মাকে!’

‘আমি মুসলমানের মসজিদে যাব, খৃষ্টানদের গির্জায় প্রবেশ করে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর সামনে নতজানু হব, বৌদ্ধদের বিহারে প্রবেশ করে আমি বুদ্ধের শরণাপন্ন হব আবার অরণ্যে প্রবেশ করে হিন্দুদের পাশে বসে ধ্যানমগ্ন হব…. শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যে সব ধর্ম আসতে পারে, তাদের জন্যেও আমার হৃদয় আমি উন্মুক্ত রাখবো।’ (স্বামীজির বাণী) ।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমরা স্বল্প শিক্ষিত ও সীমিত জ্ঞানীরা চুড়ান্ত সাম্প্রদায়িক, আত্মকেন্দ্রিক ও চরম ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বইছে আমাদের রক্তে। তাঁর আদর্শের পরমানুটুকুও ক্রমশঃ আমাদের শরীর থেকে হতে চলেছে নিশ্চিহ্ন!
শরীরের লজ্জা আমরা সহজেই ঢাকতে পারি পোষাক দিয়ে কিন্তু মনুষ্যত্বের এ লজ্জা আমরা ঢাকবো কোন পোষাকে??

 

( তথ্য সংগৃহীত)

Share This
Categories
লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

লেখা পাঠানোর নিয়ম–

লেখা পাঠান মেইল বা whatsap no 9064667340 এই নম্বর এ। কোন মাধ্যম দিয়ে লেখা গ্রহন করা হবে না। মেইল বা whatsap এ পাঠাতে হবে।

Share This