ভূমিকা—
তপেন চ্যাটার্জী ছিলেন ভারতের একজন বাঙালি কিংবদন্তি অভিনেতা যিনি সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে বেশ কয়েকটি ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, বিশেষ করে গুপি গাইনে বাঘা বাইন (১৯৬৮) এবং এর সিক্যুয়েল ১৯৬৮-এ গুপি গাইনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সফল ছবি সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। ১৯৬৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবির নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন সন্তোষ দত্ত, জহর রায় ও হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। সেই সময় বাংলায় সবথেকে ব্যয়বহুল ছবি ছিল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’।
জন্ম ও পরিবার—
তপেন চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, কালীঘাটের মাইশোর রোডের বাড়িতে। নলিনীরঞ্জন ও শোভনাদেবীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তপেন ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁরা তিন ভাই ও দুই বোন। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক তপেন চট্টোপাধ্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা রাজেন্দ্র বিদ্যাভবনে।
অভিনয়ের দিকে ঝোঁক—
ছোট থেকেই অভিনয়ের দিকে ঝোঁক ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তপেন প্রথম মঞ্চে পা দিলেন, নাটকের নাম ‘অচলায়তন’। ছোট্ট চরিত্র হলেও দর্শকের মনে দাগ কেটে গিয়েছিল তাঁর অভিনয়। শীতকালে বা পুজোর সময় সেই নাটকের জন্যই ডাক পড়ত তপেনের। পরে শেখর চট্টোপাধ্যায়ের গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন।
কর্ম জীবন—-
অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার তপেন চট্টোপাধ্যায় খুব কম বয়সে এক সময়ে রাজস্থানের বিকানেরে চাকরি করতেন। সেখানকার জিপসাম মাইনস-এ রোজ দু’ টাকা দু’ আনা পারিশ্রমিক মিলত। বছর দুই চাকরি করার পর অতঃপর কলকাতায় ফিরলেন তিনি। তখনও কি জানতেন, এই রাজস্থানে এসেই তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ চরিত্রের জন্য শুটিং করবেন, তা-ও সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায়! কলকাতায় ফিরে এসে যোগ দিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটকের দলে।
অভিনয় জীবন—-
তবে প্রথমে তিনি একজন যোগ্য প্রকৌশলী হিসেবে, চ্যাটার্জির রাজস্থানে চাকরি ছিল, এরপর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং সত্যজিৎ রায়ের পুনরুজ্জীবিত বাংলা পত্রিকা সন্দেশে যোগ দেন। ছোটদের পত্রিকা সন্দেশের বিজ্ঞাপন বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। সত্যজিৎ তাকে মহানগরে একটি ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করেন এবং তারপরে গুপি গাইন বাঘা বাইন-এ গায়ক গুপি গাইন হিসেবে বিখ্যাত হন। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাশে গানটি তার উপর গুপি এবং রবি ঘোষের বাঘা বাইন চরিত্রে নির্মিত গানটি এখনও বাঙালি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের স্মৃতিতে নাড়া দেয়।
জানা যায় গুপীর চরিত্রে তপেন’ই পরিচালকের প্রথম পছন্দ ছিলেন না। ষাটের দশকের শুরুতে, সত্যজিৎ যখন এই ছবি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, তখন বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর অভিনেতা অরুণ মুখোপাধ্যায়কে গুপীর চরিত্রের জন্য ভেবেছিলেন। শুন্ডি ও হাল্লা রাজার চরিত্রে ছবি বিশ্বাস, এবং মন্ত্রীর ভূমিকায় তুলসী চক্রবর্তীর কথা ভেবেছিলেন। এরপর একমসয় গুপীর চরিত্রে গায়ক-অভিনেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়ের নামও শোনা যায়।ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে বাঘার চরিত্রে অভিনয় করবেন রবি ও গুপীর ভূমিকায় দেখা যাবে নবাগত জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে যিনি সত্যযুগ পত্রিকার সহসম্পাদক ছিলেন।
শেষমেশ তিন-তিনবার অভিনেতা পাল্টে গুপীর জন্য তপেনকে নির্বাচিত করেন সত্যজিৎ। এর আগে তপেন সত্যজিতের ‘মহানগর’-এ একটি ছোট চরিত্রে কাজ করেছিলেন। ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হীরক রাজার দেশে ছবিতেও গুপী ও বাঘার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তপেন ও রবি।
চলচ্চিত্র সমূহ—
১৯৬৩-মহানগর, ১৯৬৯-গুপী গাইন বাঘা বাইন, ১৯৭০- রূপসী, ১৯৭১-ধন্যি মেয়ে, ১৯৭৩- শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ১৯৭৩- ননিগোপালের বিয়ে, ১৯৭৪- সঙ্গিনী, ১৯৭৪- বিকালে ভোরের ফুল, ১৯৭৪- ঠগিনী, ১৯৭৭-ভোলা ময়রা, ১৯৭৭- হাতে রইল তিন, ১৯৭৯গণদেবতা (তারা নাপিত) , ১৯৮০আঁচল (প্রযোজনা), ১৯৮০-হীরক রাজার দেশে(গুপী গাইন), ১৯৯১-গুপী বাঘা ফিরে এলো(গুপী), ১৯৯৬-রবিবার, ১৯৯৭- শ্রীমান ভূতনাথ, ২০০৮- নরক গুলজার(সর্বশেষ চলচ্চিত্র)
প্রয়াণ—-
তপেন চ্যাটার্জি ২৪ মে ২০১০ তারিখে ৭২ বছর বয়সে মারা যান। তিনি ফুসফুসের রোগে ভুগছিলেন।
।।তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ ।।