আজ ৩১ অক্টোবর, লৌহ মানব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জন্মদিন। ভারতের প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পরিচিত ‘আয়রন ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ হিসেবে।তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নেহেরু ‘নতুন ভারতের নির্মাতা ও একীকরণকারী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই থেকেই তিনি লৌহ মানব নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা। প্রজাতন্ত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন নিঃস্বার্থ নেতা। একটি আধুনিক ও অখন্ড ভারত গড়ার প্রকৃত যোদ্ধা। যে দেশের স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে লড়ে গেছেন প্রাণপণে। নতুন রূপ দিয়েছিলেন ভারতের ভাগ্যকে। আজকের এই দিনে আসুন জেনে নেওয়া যাক তাঁর সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল (ভারত-রত্ন, ১৯৯১) ছিলেন একজন ভারতীয় পণ্ডিত ও জাতীয়তাবাদী নেতা। যিনি সরদার প্যাটেল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তাকে ভারতের লৌহমানব বলা হয়। গুজরাতের কুর্মী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্যাটেল। তার পিতা-মাতা ছিলেন জাভেরভাই ও লাডবাই। তার বাবা ঝাঁসির রানির সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিলেন। তার মা ছিলেন একজন খুব আধ্যাত্মিক মহিলা।
গুজরাতি মিডিয়াম স্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পরবর্তীকালে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে স্থানান্তরিত হন।১৮৯৭ সালে তিনি উচ্চ বিদ্যালয় পাস করেন এবং আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন।তিনি তুলনায় বেশি বয়েসে ম্যাট্রিক পাশ করেন (২২ বছর)।তিনি আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করতে ১৯১০ সালে ইংল্যান্ডে যান। তিনি ১৯৩৩ সালে ইনস অফ কোর্ট থেকে আইন বিভাগে ডিগ্রী সম্পন্ন করেন ।ভারতে ফিরে এসে তিনি গুজরাতের গোধরায় তাঁর আইন অনুশীলন শুরু করেন। আইনি দক্ষতার জন্য তাকে ব্রিটিশ সরকার অনেক লাভজনক পদে প্রস্তাব দিয়েছিল তবে তিনি সব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের আইনের কট্টর বিরোধী ছিলেন । তাই ব্রিটিশদের পক্ষে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
১৯১৭ সালে সর্দার বল্লভভাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গুজরাত শাখার সেক্রেটারি হিসাবে নির্বাচিত হন । ১৯১৮ সালে কায়রায় বন্যার পরে ব্রিটিশরা জোর করে কর চাপিয়ে দিলে তিনি কৃষকদের কর প্রদান না করার জন্য একটি বিশাল “কর শুল্ক অভিযান” পরিচালনা করেছিলেন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে কৃষকদের কাছ থেকে নেওয়া জমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেছিল। তাঁর এলাকার কৃষকদের একত্রিত করার প্রচেষ্টা তাঁকে ‘সর্দার’ উপাধি দিয়েছিল।
তিনি গান্ধী দ্বারা চালিত অসহযোগ আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিলেন।
১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর উদ্যোগে বিখ্যাত লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য কারাবন্দী নেতাদের মধ্যে সর্দার বল্লভভাই পটেল ছিলেন। “লবণ আন্দোলন” চলাকালীন তার অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য অসংখ্য লোকের দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুপ্রাণিত করেছিল যারা পরবর্তীকালে এই আন্দোলনকে সফল করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। কংগ্রেস সদস্যদের অনুরোধে গান্ধী কারাগারে বন্দী থাকাকালীন তিনি গুজরাত জুড়ে সত্যগ্রহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৩১ সালে সর্দার প্যাটেলকে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইন এবং মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এই চুক্তিটি গান্ধি-আরউইন চুক্তি হিসাবে পরিচিতি পায়। একই বছর তিনি করাচি অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন ।যেখানে দলটি তার ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করেছিল।
১৯৩৪ সালের আইনসভা নির্বাচনের সময় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে প্রচার করেছিলেন। যদিও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তিনি গান্ধীর প্রতি তার অটল সমর্থন অব্যাহত রেখেছিলেন।
পটেলের রাজনীতি এবং চিন্তাভাবনার উপর গান্ধীর গভীর প্রভাব ছিল । তিনি গান্ধীর প্রতি অটল সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং সারা জীবন তার নীতির পাশে ছিলেন। জওহরলাল নেহেরু, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এবং মাওলানা আজাদ সহ নেতারা আইন অমান্য আন্দোলন ব্রিটিশদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করবে মহাত্মা গান্ধীর এই ধারণার সমালোচনা করেছিলেন।কিন্তু পটেল গান্ধীর এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের সাথে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি আহমেদনগর দুর্গে বন্দী ছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথম উপ- প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। পটেল স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে প্রায় ৫২২ টি রাজ্যকে ভারতের অধীনে এনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার এই শাসকদের দুটি বিকল্প দিয়েছিল – তারা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারে; বা তারা স্বাধীন থাকতে পারে। এই ধারা অসুবিধা বাড়িয়ে তোলে। কংগ্রেস এই ভয়ঙ্কর কাজটি সর্দার প্যাটেলকে অর্পণ করেছিলেন যিনি ১৯৪৭ সালের তিনি রাজ্যগুলোর সংহতকরণের জন্য তদারকি শুরু করেছিলেন। জম্মু ও কাশ্মীর, জুনাগড় ও হায়দরাবাদ বাদে সকল রাজ্যকে সংহত করতে তিনি সফল হয়েছিলেন। অবশেষে তিনি তার তীব্র রাজনৈতিক বুদ্ধির সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন এবং জম্মু ও কাশ্মীর, জুনাগড় ও হায়দরাবাদ কে ভারতের অধীন করেছিলেন। আমরা যে ভারতকে আজ দেখতে পাচ্ছি তা হল সরদার বল্লভভাই পটেল যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তার ফল।ঐক্যের মূর্তি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তাঁর ছায়া আজও ভারতীয় রাজনীতিতে উজ্জ্বল। নিজেকে কখনও উঁচুতে তুলে ধরতে চাননি তিনি, তেমনটা করেননি কখনও। বরাবর নিজের কাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন সবথেকে বেশি। তাঁর কাজই তাঁর পরিচয়। গোটা প্রশাসক জীবনে অসাধ্যসাধন করেছেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। অসামান্য এক স্বাধীনতা সংগ্রামী তিনি। পাশাপাশি এক অসাধারণ প্রশাসকও বটে। নিজে গান্ধীবাদী হলেও অন্ধ অনুসারী নন। আজ মানুষ ভারত বলতে যা বোঝে, সেই ভারত তিনিই গড়ে দিয়েছেন। তাঁকে দেশের ‘লৌহমানব’ বলা হয়। তার সম্মাননায় ভারতের গুজরাতে তার জন্মস্থানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় “ঐক্যের মূর্তি।”সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের স্ট্যাচুই এখন পৃথিবীর উচ্চতম স্ট্যাচু। ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’ নামে এই মূর্তি উন্মোচন করেন। ১৮২ মিটার উঁচু এই মূর্তি নর্মদা নদীর তীরে অবস্থিত। এইছাড়াও তার নামে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে।২০১৪ সালে তার জন্মদিবস ৩১ অক্টোবরকে রাষ্ট্রীয় একতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।মৃত্যুর পরে তাঁকে ভারতরত্ন সম্মান দেওয়া হয়। প্যাটেলকে শ্রদ্ধা জানাতে ২০১৪ সালে সূচনা হয় রাষ্ট্রীয় একতা দিবসের। প্রত্যেক বছর তাঁর জন্ম বার্ষিকীতে পালন হবে এই একতা দিবস । ১৯৫০ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুম্বাইতে সৰ্দার বল্লভভাই পটেলের পরলোকপ্রাপ্তি ঘটে।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া।।