Categories
গল্প

শেষ ট্রেনের অপেক্ষা।

১. শুরুটা – এক ট্রেনস্টেশনের গল্প

রাত তখন প্রায় দশটা। শহরের শেষ ট্রেন ধরার জন্য ভিড় কমতে শুরু করেছে। হাওয়া ঠান্ডা, রেললাইনের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ধরনের বিষণ্ণ নীরবতা।
স্টেশনের বেঞ্চে বসে আছেন অনির্বাণ—চোখের সামনে কুয়াশা, হাতে এক কাপ চা। মনটা তার আজ বড় খারাপ। অফিসে আবারও প্রোমোশনটা পায়নি, তার ওপরে আজ ছিল বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। দিনভর ব্যস্ততার ভিড়ে মন খারাপটাকে চাপা দিতে পেরেছিল, কিন্তু এই ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে এসে হঠাৎ যেন সবটাই আবার মনে পড়ল।

ঠিক তখনই, পাশের বেঞ্চে বসে পড়ল এক মেয়ের ছায়া।
গায়ে হালকা নীল শাল, হাতে মোবাইল। চুলগুলো খোলা, যেন বাতাসে খেলা করছে। মেয়েটির চোখেমুখে একটা অদ্ভুত শান্তি, অথচ চাহনিতে ছিল গভীর কষ্ট।

অনির্বাণ খানিক তাকিয়ে আবার নিজের চায়ের দিকে মন দিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটিই কথা শুরু করল—
— “মাফ করবেন, শেষ ট্রেনটা ক’টায় আসে জানেন?”

অনির্বাণ একটু চমকে তাকাল।
— “দশটা পঞ্চাশে। তবে আজ ট্রেন লেট হবে শুনলাম।”

মেয়েটি হেসে মাথা নাড়ল।
— “আচ্ছা, ধন্যবাদ।”

এতটুকুই পরিচয়। কিন্তু অনির্বাণের মনে হল, সে মেয়েটির মুখের হাসিটা আবার দেখতে চায়।


২. পরিচয় – কথার সূত্রপাত

ট্রেন লেট হওয়ার কারণে, তারা ধীরে ধীরে কথায় জড়িয়ে গেল।
মেয়েটির নাম ইশানি। সে পাশের শহরে স্কুলশিক্ষিকা। আজ এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল, ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।

অনির্বাণ জানাল, সে এক আইটি কোম্পানিতে কাজ করে, অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে এখানে ট্রেনের অপেক্ষা করছে।

কথার পর কথায় তারা দু’জনের জীবন খুলে গেল যেন—
ইশানি জানাল, সে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার জন্য একাই থেকে এসেছে। বাবা-মা গ্রামে থাকেন। তার জীবনটা সোজাসাপ্টা, কিন্তু কখনও কখনও একাকিত্ব খুব কষ্ট দেয়।
অনির্বাণ বলল, তার মা অনেক বছর আগে মারা গেছেন, বাবার সঙ্গেই বড় হয়েছে। বাবাই তার জীবনের অনুপ্রেরণা ছিলেন।

দুজনেই অনুভব করল—কোনো এক অদ্ভুত মিল আছে তাদের মধ্যে।
যেন দুজনেই একই রকম শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে।


৩. বন্ধুত্ব – অজানা টান

ট্রেন এল, দুজনেই পাশাপাশি বগিতে উঠল।
স্টেশনে পৌঁছে তারা নম্বর বিনিময় করল না। কিন্তু দুজনেরই মনে হল—এটাই কি শেষ দেখা?

কিন্তু ভাগ্যও যেন চুপিচুপি হেসে ছিল।
কয়েকদিন পর অনির্বাণ আবার স্টেশনে ইশানিকে দেখতে পেল।
সেই থেকে তাদের পরিচয় গভীর হতে থাকল। ফোন নম্বরও বিনিময় হল, কখনও একসঙ্গে চা খেল, কখনও বইয়ের দোকানে গেল।

ধীরে ধীরে তারা একে অপরের জীবনের গল্পে ঢুকে গেল।
অনির্বাণের ক্লান্ত সন্ধ্যাগুলোতে ইশানির ফোন যেন আলো হয়ে এল।
ইশানির একাকী রাতগুলোতে অনির্বাণের মেসেজ তাকে হাসিয়ে তুলল।


৪. ভালোবাসা – অব্যক্ত অনুভূতি

এক সন্ধ্যায়, বৃষ্টি পড়ছে ঝরঝর করে।
স্টেশনের ছাদে দাঁড়িয়ে দুজনে ভিজে ভিজে গল্প করছে।
হঠাৎ ইশানি বলল—
— “তুমি কি কখনও কাউকে খুব মিস করো? এমন মিস, যা বুকের ভেতরটা ভারী করে দেয়?”

অনির্বাণ চুপ করে রইল।
তার মনে পড়ল তার বাবা-মা, তার একাকী ঘর।
কিন্তু আজ যেন মনে হল, এই মেয়েটির জন্যও এমন একটা মিস সে বোধ করছে।

— “হ্যাঁ,” ধীরে ধীরে বলল অনির্বাণ।
— “আর সেই মিসটা আজ তোমাকে দেখেই হচ্ছে।”

ইশানি অবাক হয়ে তাকাল, তারপর হেসে ফেলল।
কিন্তু চোখের কোণে ছোট্ট একটা অশ্রুবিন্দু চিকচিক করল।

সেই রাতে বাড়ি ফিরে ইশানি ডায়েরিতে লিখল—
“হয়তো এটাই প্রেম।”


৫. বাঁক – জীবনের পরীক্ষা

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল।
হঠাৎ একদিন ইশানির বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ইশানিকে গ্রামে ফিরে যেতে হল। সে আর শহরে ফিরল না।

অনির্বাণ ফোন করত, কিন্তু ইশানি খুব কম উত্তর দিত।
দুজনের দূরত্ব যেন বাড়তে থাকল।

মাস কেটে গেল।
একদিন হঠাৎ খবর এল—ইশানির বিয়ে ঠিক হয়েছে।

সেদিন রাতে অনির্বাণ স্টেশনে বসে কেঁদে ফেলল।
যে প্ল্যাটফর্মে তাদের প্রথম দেখা, আজ সেইখানেই তার মনে হল সবকিছু ফাঁকা।


৬. সমাপ্তি – শেষ ট্রেনের অপেক্ষা

দিন যায়। ইশানির বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে।
অনির্বাণ চেষ্টা করেও দেখা করতে যায়নি।

বিয়ের আগের রাতে হঠাৎ অনির্বাণ ট্রেনস্টেশনে গেল।
এবারও রাত দশটা বেজে গেছে।
কিন্তু আজও সে মনে মনে চাইল—যেন একবার ইশানিকে দেখতে পায়।

ঠিক তখনই, প্ল্যাটফর্মের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ইশানিকে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
চোখে জল, কিন্তু মুখে এক আশ্চর্য হাসি।

— “আমার বিয়ে হচ্ছে ঠিকই,” বলল ইশানি।
— “কিন্তু জানো, আমি আজ এখানে এসেছি শুধু তোমাকে একবার দেখতে।
তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি।”

অনির্বাণ কিছু বলল না।
শুধু বলল—
— “তুমি সুখে থেকো।”

ট্রেন এল।
ইশানি উঠে গেল বগিতে।
অনির্বাণ তাকিয়ে রইল।
শেষ ট্রেন চলে গেল।

কিন্তু অনির্বাণ জানল—তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা, যদিও হারিয়ে গেল, তবুও তাকে এক অদ্ভুত শান্তি দিয়ে গেল।


গল্পের সারমর্ম

ভালোবাসা সবসময় পেতে হয় না।
কখনও কখনও ভালোবাসা মানে কেবল সেই মানুষটির সুখের প্রার্থনা করা, দূর থেকে হাসিমুখে বিদায় দেওয়া।
অনির্বাণের কাছে ইশানি রয়ে গেল সেই শেষ ট্রেনের মতো—যে ট্রেন হয়তো আর কখনও ধরা যাবে না, কিন্তু যার হুইসেল চিরকাল তার মনে বাজতে থাকবে।

 

Share This