Categories
অনুগল্প প্রবন্ধ

স্বামীজি ও বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন : তন্ময় সিংহ রায়।

জাহাজ ও দু-দুটো ট্রেন পাল্টে অবশেষে ৩০ শে জুলাই রাত ১১ টায় তিনি উপস্থিত হলেন শিকাগোয়।
ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরটা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে তাকে ফেলেছে এক চরম অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতে, এমনটাই মনে হচ্ছিল। পরিস্থিতি ধারণ করলো আরো জটিল আকার যখন তিনি জানতে পারলেন যে, ধর্মমহাসভায় পরিচয় পত্র আবশ্যক ও যোগদানের তারিখ-ও পেরিয়ে গেছে।
মুহুর্তের মধ্যেই মনে হতে লাগলো অতি যত্নে সাজানো সমস্ত রঙীন স্বপ্নগুলো তাঁর চোখের সামনেই হয়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো!
এদিকে শিকাগোর মতন বড়লোকি শহরে থাকার খরচ।
সামান্য পুঁজি ফুরিয়ে আসার মুহুর্তে তিনি আবিষ্কার করলেন বস্টন নামক একটি শহর যেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ অনেকাংশে কম। অবশেষে বস্টন অভিমুখে রওনাকালীন ট্রেনে পরিচয় হয় ক্যাথেরিন স্যানবর্ন নামক এক ধনী ও প্রভাবশালী মহিলার সাথে।
প্রতিভাদীপ্ত সুদর্শন এক পুরুষের সাথে তিনি নিজেই এসে পরিচয় করে দু-এক কথায় মুগ্ধ হয়ে স্বামীজি-কে তার বাড়িতে থাকার জন্যে জানালেন হার্দিক আমন্ত্রণ!
এ অবস্থায় স্বামীজি সাদরে গ্রহণ করলেন সে আমন্ত্রণ। ক্যাথেরিন স্যানবর্নের বাড়িতে থাকাকালীন স্বামীজি তাঁর এক শিষ্যকে চিঠিতে জানালেন, ‘এখানে থাকায় আমার প্রতিদিনের এক পাউন্ড করে বেঁচে যাচ্ছে আর তাঁর(ক্যাথেরিন স্যানবর্ন) প্রাপ্তি হল, তিনি তাঁর বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে দেখাচ্ছেন ভারতের এক বিচিত্র জীবকে!’
বস্টনে থাকাকালীন ক্যাথেরিন স্যানবর্নের সূত্রে সেখানকার শিক্ষিত সমাজে স্বামীজি হয়ে উঠেছিলেন ভীষণভাবে পরিচিত। অকস্মাৎ ক্যাথেরিনের মাধ্যমে স্বামীজির পরিচয় হয় হাভার্ড ইউনিভার্সিটির এমন একজন সুবিখ্যাত প্রফেসার জন হেনরি রাইটের সাথে যাকে বলা হত বিশ্বকোষতুল্য জ্ঞানভান্ডারের অধিকারী। কিন্তু স্বামীজির তেজোদীপ্ত প্রতিভার আলোক ছটায় বিষ্ময়ে হতবাক হলেন তিনিও। পরিচয়পত্র না থাকায় তিনি (স্বামীজি) মহাধর্মসম্মেলনে যোগ না দিতে পারার সংক্ষিপ্ত কারণ বিশ্লেষণে প্রফেসার প্রত্যুত্তর করলেন, ‘মহাশয়, আপনার কাছে পরিচয়-পত্র চাওয়ার অর্থ এমন যে সূর্যকে প্রশ্ন করা যে তার কিরণ দেওয়ার অধিকার আছে কিনা।’ অতঃপর মহাধর্মসম্মেলনের এক কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে প্রফেসার রাইট লিখলেন :
‘ইনি (স্বামীজি) এমন একজন ব্যক্তি যে, আমেরিকার সমস্ত প্রফেসারের পান্ডিত্য এক করলেও এঁর পান্ডিত্যের সমান হবে না।’ অবশেষে স্বামীজী’র মনে হতে লাগলো তাঁর রঙীন স্বপ্নগুলো জোড়া লাগতে শুরু হল আবার ধীরে ধীরে।
বস্টনে সপ্তা তিনেক থাকার পর শেষে তিনি রওনা হলেন শিকাগো অভিমুখে।

১১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩, শিকাগোর কলম্বাস হলে সকাল দশটায় বিশ্ব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল যে আধিদৈবিক সিংহপুরুষের দ্বিতীয় অধিবেশনের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে তিনি-ই হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
“সিস্টার্স এন্ড ব্রাদার্স অফ অ্যামেরিকা”…… হাজার হাজার দর্শকমণ্ডলীর হর্ষধ্বনি ও করতালিতে ফেটে পড়েছিলো মঞ্চ।
মনে হচ্ছিল এক সংক্ষিপ্ত শক্তিশালী আঁধি সেই মুহুর্তে, সেই স্থানের উপস্থিতজনেদের উপর দিয়ে বয়ে গেলো। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের জয়ঢাক তিনি বাজাননি। মহা ধর্মসম্মেলনে যেখানে সবাই নিজ নিজ ধর্ম সম্বন্ধেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেখানে স্বামীজি দেখিয়েছিলেন, সব ধর্মই সত্য কারণ প্রতিটি ধর্মই মানুষকে পৌঁছে দেয় একই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে।

১৯৯২ সালে স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার একশত বছর পূর্তির আগে এলেনর স্টার্ক নামক এক আমেরিকান মহিলা স্বামীজিকে নিয়ে ‘দ্য গিফট আন-ওপেন্ড.. এ নিউ আমেরিকান রেভলিউশন’ নামক একটি বই লিখেছিলেন যাতে লেখিকা স্বামীজির বাণীকে বর্ণনা করেছেন ‘উপহার’ বলে অর্থাৎ, ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকাকে দেওয়া উপহার।
তিনি বলেছেন, সেই উপহারের প্যাকেট আমেরিকা খুলে দেখেনি, স্বামীজির বাণীকে তারা জীবনে ব্যবহার করেনি। যদি তারা তা করত, একটা নতুন ধরণের বিপ্লব ঘটে যেত আমেরিকাবাসীদের জীবনে।’ ঐ বইতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকা মহাদেশের ভূখন্ডটা কিন্তু বিবেকানন্দ আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকার আত্মাকে!’

‘আমি মুসলমানের মসজিদে যাব, খৃষ্টানদের গির্জায় প্রবেশ করে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর সামনে নতজানু হব, বৌদ্ধদের বিহারে প্রবেশ করে আমি বুদ্ধের শরণাপন্ন হব আবার অরণ্যে প্রবেশ করে হিন্দুদের পাশে বসে ধ্যানমগ্ন হব…. শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যে সব ধর্ম আসতে পারে, তাদের জন্যেও আমার হৃদয় আমি উন্মুক্ত রাখবো।’ (স্বামীজির বাণী) ।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমরা স্বল্প শিক্ষিত ও সীমিত জ্ঞানীরা চুড়ান্ত সাম্প্রদায়িক, আত্মকেন্দ্রিক ও চরম ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বইছে আমাদের রক্তে। তাঁর আদর্শের পরমানুটুকুও ক্রমশঃ আমাদের শরীর থেকে হতে চলেছে নিশ্চিহ্ন!
শরীরের লজ্জা আমরা সহজেই ঢাকতে পারি পোষাক দিয়ে কিন্তু মনুষ্যত্বের এ লজ্জা আমরা ঢাকবো কোন পোষাকে??

 

( তথ্য সংগৃহীত)

Share This
Categories
প্রবন্ধ

সিন্ধু সভ্যতার ভারতের আকাশে-বাতাসে আজ রাজনীতির গন্ধ! : তন্ময় সিংহ রায়।

বর্তমান প্রজন্ম তো দিলাম ছেড়েই ,
আমরা যতটা চিনি গ্যালিলিও , নিউটন , টেসলা কিংবা আইনস্টাইনকে ,
সুশ্রুত , ব্রম্ভগুপ্ত , চরক বা বরাহমিহিরকে ঠিক
ততটাই কি?
যতটা গর্বিত , উৎসাহিত , উত্তেজিত এনাদেরকে নিয়ে , ঠিক ততটাই আমাদের ভারতীয় কোহিনূরদের নিয়ে কি?
উত্তর বোধহয় হবে ‘না।’
আর হবেটাই বা কিভাবে?
অবহেলা , উদাসীনতা , সর্বোপরি
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনীতি , বছরের পর বছর যদি গোড়াতেই ইংরেজদের মতন ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে গলদ হয়ে , তো আমি-আপনি সাধারণ মানুষ আর করবোটাই বা কি?
গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ তো আজ পরিণত এক শক্তিশালী সিস্টেমে?
আর অন্ধ , বোবা , কালা হয়ে এই সিস্টেমের চাকায় পিষে বেঁচে থাকাটা আজ পরিণত হয়েছে বা করানো হয়েছে আমাদের অভ্যেসে , এরপর আদর্শ আর মনুষ্যত্ব বিক্রির সংখ্যাটা পৃথিবী উত্তপ্ত হওয়ার মতন বেড়ে চলেছে দিনের পর দিন ,
পাশাপাশি বহু বছর আর জন্মায়ও না রাজা রামমোহন রায় অথবা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।
অতএব আমার-আপনার বৃহত্তর সমাজটা না হয়
যাক ভবিষ্যতে কোমায় , আমি-আপনি সুখে
থাকলেই হল।
কিন্তু পরিণত হওয়া এ অভ্যেস আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মে একদিন সৃষ্টি করবেনা তো সুনামি?

যদি বলি চীনের উহান ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজি
থেকেই করোনা ভাইরাস মহাসংক্রমিত হয়ে প্রায় সমগ্র বিশ্বকে তছনছ করে ছেড়েছে?
ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছেড়েছে পৃথিবীর বেশ কয়েকটা দেশের আর্থিক মেরুদণ্ড?
রাষ্ট্রের পর রাষ্ট্রকে বানিয়ে ছেড়েছে মৃত্যু উপত্যকা?
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিষয়টা বর্তমানে সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন যে , ও এক প্রকৃতিগত বিপর্যয় ছাড়া তেমন কিছুই ছিলনা , ওটা হতেই পারে।
সাথে আপনিসহ হাজার জন অন্তত আমায় পাল্টা
প্রশ্ন করবেন যে ,
নির্দিষ্ট বা উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া আপনি এ কথা এত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন বা লেখেন কিভাবে?
প্রতিবেশী একটা রাষ্ট্রের সরকারের নামে এভাবে বদনাম দেন কিসের ভিত্তিতে?
সেক্ষেত্রে আপনাদের প্রশ্নদেরকে সম্মান জানিয়েই
আমি প্রত্যুত্তর করবো ,
দুর্ঘটনাবশতঃ কোনো কোনো সময়ে কিছু গোপনীয়
ঘটনার রহস্য ফাঁস হয়ে পড়ে কোনোভাবে ,
যেটা অনুসন্ধিৎসু লেখক-মন চিরুনী তল্লাশি করে খুঁজে নেয় ঠিকই।
আর কবর দেওয়া এরকম বহু কিছু আজ ইন্টারনেটের বাড়বাড়ন্তে বেরিয়ে এসে সাধারণ মানুষের কাছে বাধ্য হয়েছে ধরা দিতে।

ধরা যাক আমি ডাহা মিথ্যে বলছি , বা লেখায়
প্রয়োগ করতে চাইছি রাজনৈতিক কৌশল ,
তো জানাই , জাতিসংঘ স্বীকৃত এ বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে চীন যে সবার মাথার উপরে উঠে আসতে চাইছে যেনতেন প্রকারেণ , এ বিষয়টা নিশ্চই কম-বেশি জানেন অনেকেই , আর বর্তমানে চীন যে ভারতের ঠিক কত বড় শত্রু , তা আর নিশ্চই যুক্তি , প্রমাণ দিয়ে কাউকে বোঝাতে হবেনা?
এরপরেও জানিয়ে রাখি , যদি সময় পান ,
গুগুলে গিয়ে সার্চ করে পড়বেন , ‘চক্রব্যূহে ভারত তথা বিশ্ববাসী।’
এছাড়াও রয়ে গেছে বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ , খোঁজার মতন খুঁজলে পাবেন আপনিও।

আচ্ছা কখনও কখনও আপনাদের মনে আমার
মতন প্রশ্ন নিশ্চই জাগে যে ,
Research and Analysis Wing , Mossad , Central Intelligence Agency , Australian Secret Intelligence Service ইত্যাদি বিশ্বের তাবড়-তাবড় সব গোয়েন্দা সংস্থা , জাতিসংঘ ,
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমানে সব চুপ কেন?
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের উৎসটা
ঠিক কোথায় , তা শুধুমাত্র খুঁজে বের করাটা কি
অবৈধ কিংবা ঘোরতর অন্যায় কিছু ছিল?
এটা কি সত্যিই ছিল না সাধারণ মানুষের জানার একটা অধিকার?
লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের বিশ্বাস , জীবন , আস্থা , আর্থিক পরিস্থিতি প্রভৃতির চেয়ে রাজনীতিটা কি এক্ষেত্রেও বড়?
তবে কি বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টের চাপ?
না কি ভয়-ভীতি , না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার দুশ্চিন্তা?
কিভাবে এত বিপুল সংখ্যক জনগণ আজ বাধ্য হয়ে হলেও মেনে নিল এই অমানুষিক হত্যাযজ্ঞকে?

যদি বলি মানুষ ছাড়াও এ অনন্ত বিশ্বব্রম্ভাণ্ডে মানুষেরই মতই আছে একধরণের প্রাণীর অস্তিত্ব?
আর হতে পারে মুষ্টিমেয় কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের
অতিরিক্ত আগ্রহ থেকে জন্ম নেওয়া দিবারাত্রির নিরলস এক্সপেরিমেন্ট , তা থেকে রেডিও সিগনাল পাঠানো , এর ভয়াবহ পরিণাম হিসেবে অতিরিক্ত মাশুল গুণতে হতে পারে গোটা পৃথিবীবাসীকেই?
হতে পারে ভবিষ্যতে এ গ্রহ থেকে সমগ্র মানব সভ্যতার অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন?
বলাবাহুল্য স্টিফেন হকিং তো আগেই এ বিষয়ে সচেতন করে দিয়ে গেছেন বিজ্ঞানীদের।
সময় করে কিছুটা হলেও ঘুরে আসতে পারেন গুগুল থেকে , টাইপ করবেন , ‘গহীন ও দুর্ভেদ্য রহস্যে আবৃত
Area-51!’
এছাড়াও লুকিয়ে আছে বেশ কিছু উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ , যা অনেকেই আজ গেছেন জেনে , কিন্তু ওই , চুপ?
ভারতের মাটিতেই চাপা দিয়ে রাখা আছে এমন কিছু ইতিহাস , যা সশরীরে ভূমি ফুঁড়ে জনসমক্ষে বেরিয়ে আসলে বোধহয় সৃষ্টি হবে দাবানল।
তো যাইহোক , ফিরে আসি সেই আগের টপিকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের ডেভিড ফ্রলি , বর্তমানের পদ্মভূষণ প্রাপ্ত , বেদাচার্য , আয়ুর্বেদিক শিক্ষক , বৈদিক জ্যোতিষ , গবেষক ও লেখক
বামদেব এক বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন যে ,
“যখন পুরো বিশ্ব লেখাপড়া জানতো না , তখন ভারতের হিন্দুরা বেদ লিখেছিলেন।
যখন পুরো বিশ্বে শিক্ষা চালু ছিল না , তখন ভারতের হিন্দুদের শিক্ষা দেওয়া হত গুরুকুলের মাধ্যমে।”

ভারতের মহান পরমাণু বিজ্ঞানী ও একাদশ রাষ্ট্রপতি ডঃ এ পি জে আব্দুল কালাম এ প্রসঙ্গে উক্তি করেছেন , “বেদ মানবসভ্যতার প্রাচীনতম ক্ল্যাসিক , ভারতবর্ষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।
সমগ্র ভারতের আত্মা এই বেদেই প্রোথিত।”

ভলতেয়ার বলেছেন ,
“বেদ হল মানবসভ্যতার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার , যার জন্য পাশ্চাত্য সবসময় প্রাচ্যের নিকট কৃতজ্ঞ থাকবে।”

বেদে সংখ্যাতত্ত্বের সর্বপ্রথম উল্লেখ প্রসঙ্গে আইনস্টাইন মন্তব্য করেছিলেন ,
“আমরা আর্যদের কাছে কৃতজ্ঞ , কেননা তাঁরাই সর্বপ্রথম সংখ্যা আবিস্কার করেছে যা ছাড়া বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কারই সম্ভবপর হত না।”

দার্শনিক , ধর্ম এবং সমাজতত্ত্ববিদ , অধ্যাপক , ভারতবিশারদ , সংস্কৃত ভাষায় সুপ্রসিদ্ধ জার্মান পণ্ডিত ও অনুবাদক ম্যাক্স মুলার বলেছেন ,
“পৃথিবীতে বেদ-উপনিষদের মত প্রণোদনাপূর্ণ ও
এত অতিমানবীয় বই আর নেই।”

জাতি , ধর্ম , বর্ণ নির্বিশেষে সর্বধর্মসমন্বয়ের দেশ আমাদের ভারতবর্ষ , যা বিশ্ব ইতিহাসে দখল করে আছে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান , কিন্তু আজ ক্রমশ
যেন আত্মপ্রকাশ করছে তা কেমন ম্লান হয়ে।
তো যাইহোক , বিশ্ববন্দিত , মহান মানুষদের এই অমূল্য মন্তব্যসমূহ এখানে তুলে ধরার উদ্দেশ্য কোনো ধর্মের জয়গান গাওয়া বা প্রচার নয় ,
বরং অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানানো এই যে ,
এই সমস্ত কিংবদন্তি , ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের অমূল্য সৃষ্টি ও এর পিছনে লুকিয়ে থাকা অক্লান্ত ও নিরলস পরিশ্রম , সংগ্রামের সেইসব কাহিনী , আত্মত্যাগ আজও ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় পেয়ে ওঠেনি সেভাবে বিশেষ কোনো জায়গাই , এমনকি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র , চন্দ্র শেখর আজাদ বা রাসবিহারী বসুকে নিয়েও নয়।
থেকে গেছে অবহেলা , উদাসীনতা , বঞ্চনা , সর্বোপরি
রাজনীতির স্বীকার হয়ে , আর এভাবেই ধীরে ধীরে হয়তো ডাইনোসরের মতন এনারা হয়ে যাবেন ভারতের ভূখণ্ড থেকে আগামীতে বিলুপ্ত।

এ প্রজন্মকে যদি প্রশ্ন করা হয় , ‘পৃথিবীর প্রথম সার্জন
কে ছিলেন , যিনি আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই
ব্যবহার করতেন প্রায় ১১৬-২০ রকমের ছুরি-কাঁচি?’
কিংবা ‘Father of Surgery কাকে বলা হয়?’
নতুন প্রজন্ম কেন , আমরাই অনেকেই ঠিক জানিনা এর সঠিক উত্তর , এ আমাদের চরম লজ্জা!
আমরা হয়তো এও জানিনা বা স্মৃতিতে নেই আজ আর বেঁচে যে , সম্পূর্ণ পৃথিবীতে যখন প্রথাগত শিক্ষার কোনো অস্তিত্বই ছিল না , তখন ভারতে ছিল ১৬ টা বিশ্ববিদ্যালয় ও ৭২৫ টা কলেজ।
দেশীয় সেই সমস্ত মহামানবকে আমরা যথাযথ মর্যাদা দিতে পারিনি ঠিকই , কিন্তু রতনে ঠিকই চিনে নিয়েছে রতন।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবর্নের Royal Australia College of Surgeons – এর ঠিক সামনেই সগৌরবে আজও বসে আছেন মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র এবং ধন্বন্তরির শিষ্য সুশ্রুত এর শ্বেত পাথর মূর্তি।
রাজনীতি , বিনোদন , অপরাধ , খেলাধুলা , প্রতিদিনের পেপার , নিউজ চ্যানেলে এসব
দেখে-শুনে যেন অস্থির ও তিক্ত হয়ে গেছে মন ,
পরিণত হয়ে গেছে বা পরিণত করানো হয়েছে এ আমাদের এক অভ্যেসে।
তাই প্রকৃত গণতন্ত্র , শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা ভারতীয় অতীত ইতিহাসের সেই গৌরবময় , ভাস্বর এবং সুবৃহৎ অধ্যায় আবার ভারতবাসীর কাছে ফিরে আসুক স্বমহিমায় , এই আশায় বুক বেঁধে আজ নয় আপাতত এখানেই শেষ হোক এই প্রবন্ধ।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

Area-51 কি আদৌ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর এক Operation ঘাঁটি? : তন্ময় সিংহ রায়।

প্রায় সমগ্র বিশ্ববাসীকে দুর্ভেদ্য অন্ধকারে রেখে , Area 51- এ কর্মরত উচ্চপদস্থ অফিসার , সরকার কিংবা বিজ্ঞানীরা কি তবে দীর্ঘ ২৫ থেকে ৩০ বছর যাবৎ এলিয়েন নামক ভীনগ্রহের উন্নত প্রাণীর
সাথে অত্যন্ত গোপনে ও কৌশলে রেখে চলেছে ক্রমাগত যোগাযোগ?

চিনের হুবেই প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী উহান শহরের চিয়াংশিয়া পৌর জেলায় অবস্থিত ‘ Wuhan institute of virology ‘ নামক গবেষণাগারটিতে দীর্ঘদিন যাবৎ অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে গবেষণা করা হয়ে আসছে বৈচিত্রময় প্রজাতির ভাইরাস নিয়ে।
বিগত বছরে সমগ্র বিশ্বব্যাপী করোনা নামক এক অপরিচিত ও মারণ ভাইরাসের মহাসংক্রমণের ফলে , হঠাৎই যেন রহস্যজনকভাবে এই গবেষণাগারটি ব্যাপকভাবে উঠে আসে প্রচারের মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার সাম্রাজ্যে , কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ করোনা অতিমারির সেই উৎস পৃথিবীবাসির কাছে আজও হয়ে আছে এক রহস্য হয়েই।

অনুরূপভাবে , Mariana trench  ও Vatican
secret archive এর মতন High secured ও
Strictly restricted zone হিসেবে ‘Area -51’ এর জন্মলগ্ন থেকেই চরম গোপনীয়তার দুর্ভেদ্য অন্ধকারে আবৃত বলেই কিন্তু এ নিয়ে জনমানসে গহীন রহস্য ক্রমশই ঘনীভূত হয়ে আসছে দিনের পর দিন ধরে , আর জমাট বাঁধা এ সকল রহস্যকে কেন্দ্র করেই কালক্রমে জন্ম নিয়েছে বেশ কিছু Conspiracy theory. 

আসলে সত্যিকে কোনও দিনও রাখা যায়নি কবর দিয়ে , আর বিশ্ব ইতিহাসে এর উদাহরণও আছে ভুরি ভুরি।
আর ঠিক এ কারণেই হয়তো এক্ষেত্রেও ঘটে গেছে
বা চলেছে এর চুড়ান্ত সব বহিঃপ্রকাশ।

Area 51-এ কুখ্যাতি অর্জন করা একজন আমেরিকান ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক Robert Scott Lazar
বা Bob Lazar, ১৯৮৯ সালের মে মাসে Las Vegas Television Station ‘KLAS’ -এ তদন্তকারী সাংবাদিক George Knapp- এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে হঠাৎই দাবী করে বসেন যে ,
ভিনগ্রহের প্রাণীদের নাকি Area 51-এ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় জেলখানার আসামীর মতই। 
আমেরিকার সামরিক বাহিনীর হাতে গুলি খাওয়া এক বহির্জাগতিক Pilot- এর সাথে Telepathy- এর মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছেন Area 51-এর একজন Officer,
এমনও এক অস্পষ্ট Video footage ধারণ করেছিলেন Area 51-এ কর্মরত ভিক্টর নামক এক ব্যক্তি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এবং সরকার বিশ্ববাসীর সামনে রহস্যজনক সেই ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণরূপে ধামা চাপা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও ,
৮ জুলাই ১৯৪৭ সালে দুর্ঘটনাবশতঃ হঠাৎই বিকট শব্দে মরুভূমিতে আছড়ে পড়া UFO -এর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের পর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব নিউ
মেক্সিকোর Roswell শহর তো প্রায় গোটা বিশ্বে
এখন তুমুল জনপ্রিয়।

To watch the video click the link below :
https://youtu.be/o1RS7D_szJo

১৯৭৮ সালে Nuclear Physicist ও লেখক Stanton T. Friedman একটি Interview নেন Major Jesse A. Marcel-এর , যিনি সাহায্য করেছিলেন Flying Saucer- এর ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ এবং নিকটবর্তী Air Force Base-এ সেগুলিকে পৌঁছে দিতে।
Interview- তে Marcel স্বীকার করেন যে , Roswell-এর ধ্বংসাবশেষগুলি ছিল UFO-এর ,
ও সেই স্থান থেকে পাওয়া বিভিন্ন বস্তুসামগ্রীর কোনটাই পৃথিবীর বলে মনে হয়না।
পরবর্তীতে লেখক Stanton T. Friedman দ্বারা প্রকাশিত হয় ‘TOP SECRET/MAJIC’ ,  ‘CAPTURED'(The True Story of The World’s First Documented Alien Abduction.),  ‘FACT, FICTION, AND FLYING SAUCERS’ প্রভৃতির মতন চাঞ্চল্যকর , তথ্যসমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় সব বই।
প্রকৃত এই ঘটনার ৪৮ বছর পর ১৯৯৫ সালে Ray Santilli (British) নামক এক Television, Film & Record Producer-এর মাধ্যমে ‘Alien Autopsy’ নামক ১৭ মিনিটের এক সাদা-কালো Video footage
প্রকাশিত হয় , যেখানে দেখা যায় Roswell Incident-এর UFO থেকে উদ্ধারকৃত Alien-এর মৃতদেহ নিয়ে ডাক্তাররা কাটা-ছেঁড়ার মাধ্যমে চালাচ্ছেন অবাধে ময়নাতদন্ত।
আর Video- টা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই প্রায় সারা বিশ্বব্যাপী শুরু হয় তুমুল উত্তেজনার রেনেসাঁস।
কিন্তু পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এটাকে
Weather Balloon নামে Hoax (ধাপ্পাবাজি) বলে ফুৎকারে দেয় উড়িয়ে।

To watch the video click the link below :
https://youtu.be/m9lTaQMvDvs

এছাড়া , Alien from Area 51: The Alien Autopsy Footage Revealed.
Amazon এ গিয়েও পারেন দেখতে।

সাল ২০১৬-এর May মাসে রাষ্ট্রপতি হওয়ার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক মনোনয়নের জন্য সম্ভাব্য মনোনীত প্রার্থী Hillary Clinton, Jimmy Kimmel Live -এ গিয়ে বলেছিলেন , যে যদি তিনি President নির্বাচিত হন তাহলে Roswell-এর ঘটনার সত্যতা তুলে ধরবেন পৃথিবীর জনসাধারণের কাছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ওনার পরাজিত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই রহস্য থেকে যায় রহস্যেই।

কিছু Conspiracy theorist-এর মতে , area-51-এ আসলে American সরকার এবং ভিনগ্রহের প্রাণীরা যৌথ প্রচেষ্টায় মানুষ ও এলিয়েনের সংকর প্রজাতি সৃষ্টির কাজে বেশ গতিশীল।
বিশ্বখ্যাত ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ Stephen William Hawking তাঁর ‘Stephen Hawking’s Favorite Places’ নামক এক Original documentary series-এ উল্লেখ করেছেন যে ,
‘One day, we might receive a signal from a planet like this….
But we should be wary of answering back. Meeting an advanced civilization could be like Native Americans encountering Columbus. That didn’t turn out so well? ‘

কিন্তু সে কথায় আজ কোনো কর্ণপাত করা বা
গুরুত্ব তো দিচ্ছেই না আমেরিকার সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা , বিজ্ঞানী থেকে সরকার ,
উপরন্তু প্রত্যুত্তরের নিদারুণ আশায় বুক বেঁধে Deep space -এ তাঁরা ক্রমাগত পাঠিয়ে চলেছেন রেডিও সিগনাল।

সম্প্রতি মার্কিন নৌবাহিনীর ফুটেজে ধরা
পড়ার রেকর্ড অনুযায়ী বিগত ২০ বছরে আকাশে UFO – এর সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে শীর্ষ মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্তা এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পাশাপাশি মার্কিন গোয়েন্দারা এ কথাও স্বীকার করেছেন যে , হতেও পারে এগুলো চিন বা রাশিয়ার মতন অন্যান্য শক্তি দ্বারা সম্পাদিত সামরিক সরঞ্জাম বা প্রযুক্তির পরীক্ষা থেকে তা মার্কিন আকাশে উদ্ভূত , যা ষড়যন্ত্রের এক অংশ মাত্র।
বলাবাহুল্য আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এ বিষয়ে বেশ অবগত।

২০ শতাব্দীর এক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী Carl Sagan-এর ধারণানুযায়ী প্রস্তুত করা হয়েছিল ‘Voyager Golden Record’ যেটি আজ থেকে প্রায় ৪০-৪২ বছর আগে সংযোজন করা হয়েছিল Voyager Spacecraft-এর সাথে।
এতে Record-টা চালাবার নির্দেশিকা-সহ ছিল পৃথিবীর ৫৫ টা ভাষা , ১১৫ টা ছবি ও ভারতীয়
রাগ-ভৈরবী সমেত বিভিন্ন দেশের সঙ্গীত।
Golden Record -টা তৈরীর উদ্দ্যেশ্য ছিল এটাই
যে , দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে কখনও , কোনো একদিন অসীম মহাবিশ্বের কোনো এক গ্রহের এলিয়েন অথবা আমাদের মতই উন্নত কোনো প্রাণীর কাছে গিয়ে যদি এটা পৌঁছায় , তবে তাঁরা সেই Disc অনুধাবন করে জানতে পারবে যে আমরা মানুষ ,
এই Universe-এ উপস্থিত আছি বা ছিলাম কোনো একসময়ে।
NASA -এর উল্লেখযোগ্য ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই মন্তব্য অনুযায়ী তাই হয়তো সর্বশেষ বলা যেতেই পারে , ‘We are not alone!’

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

বৃক্ষমাতা থিম্মাক্কা : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

বিষাদের মধ্যে জড়িয়ে থাকে ধূসর অন্ধকার। যন্ত্রণার মধ্যে লুকিয়ে থাকে গভীর কান্না। বিষাদ আর যন্ত্রণার বিষাক্ত ছোবলে ভয়ংকর শূন্যতায় হারিয়ে যায়অনেক জীবন। কিন্তু প্রতিটি জীবন আলোর স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন তখনই সফল হয় যদি যন্ত্রণা আর বিষাদের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া যায় আলোর পথে। তার জন্য চাই আলোক-স্পর্শ, ভালোবাসার ছোঁওয়া।বাস্তবে যদি তা সম্ভব হয় তখন অন্ধকারের গর্ভে জন্ম নেয় আশ্চর্য আলো। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা নিজেদের দুঃখ যন্ত্রণাকে আলোর পথে চালিত করে ইতিহাসের পাতায় রচনা করে গেছেন সোনালী অধ্যায়। তেমনই এক আশ্চর্যময়ী নারী হলেন পরিবেশবিদ‘বৃক্ষমাতা’ থিম্মাক্কা। যিনি বিশেষভাবে পরিচিত ‘সালুমারাদা’ থিম্মাক্কা নামে।
কর্নাটকের টুমাকুরু জেলার গুব্বি তালুকে এক অতি সাধারণ দরিদ্র পরিবারে থিম্মাক্কার জন্ম। বাবা চিক্কারাঙ্গিয়া ও মা বিজয়াম্মা, দুজনেই ছিলেন শ্রমিক। অভাবের সংসারে স্কুলে যাওয়া কিংবা পড়াশোনার করার সুযোগ হয়নি থিম্মাক্কার। অভাবের সংসারে ছোটোবেলা থেকেই বাবা-মায়ের কাজে তাঁকে সাহায্য করতে হত। বাড়ির পাশের একটি খাদানে তিনি শ্রমিকের কাজ করতেন।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে থিম্মাক্কার বিয়ে হয় বিক্কালু চিক্কাইয়ার সঙ্গে। তিনি ছিলেন রামনগর জেলার মাগদি তালুকের হুলিকাল গ্রামের বাসিন্দা। বিক্কালুও শ্রমিকের কাজ করতেন। সংসারে অভাব ছিল কিন্তু বেশ সুখেই কাটছিল তাদের জীবন। সেই সুখের সংসারে একসময় নেমে আসে বিষাদের অন্ধকার।
বিয়ের পঁচিশ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের কোনো সন্তান হয় না। বন্ধ্যা রমনীদের সমাজে নানান অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হত। নানাবিধ অপবাদের শিকার হতে হত। থিম্মাক্কার জীবনেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। লোকে তাঁকে নানান কথা শোনাত। এমনকি একসময় সমাজ তাদের একপ্রকার একঘরে করে দেয়। এসব কারণে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন থিম্মাক্কা। এর থেকে মুক্তি পেতে তিনি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন। এইসময় তাঁর পাশে দাঁড়ান চিক্কাইয়া। সন্তানের দুঃখ ভোলার জন্য তিনি বিকল্প পথের সন্ধান দেন। বলেন তাঁরা দুজনে মিলে গাছ লাগাবেন আর সেই গাছকে নিজেদের সন্তানের মতো করে বড়ো করবেন। এই অভিনব ভাবনা মনে ধরে থিম্মাক্কার।
থিম্মাক্কাদের গ্রামে প্রচুর বট গাছ। তাঁরা স্থির করেন তাঁদের গ্রাম হুলিকাল থেকে পাশের গ্রাম কুদুর পর্যন্ত বিস্তৃত চার কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগাবেন। প্রথম বছর তাঁরা দশটি গাছ লাগান। পরের বছর পনেরো। তারপরের বছর কুড়ি। এইভাবে প্রত্যেক বছর গাছ লাগানোর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি গাছের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। শুধু গাছ লাগিয়ে ক্ষান্ত থাকেন না, তাদের চারিদিকে বেড়া দেন। প্রতিদিন গাছে জল দেন। এলাকায় খুব জলের সমস্যা। দীর্ঘ্য রাস্তা জল বয়ে নিয়ে যেতে হত তাঁদের। কাজটা ছিল বেশ কষ্টকর।সেই কারণে পরবর্তী সময়ে তাঁরা বর্ষাকালে গাছ লাগানো শুরু করেন।এইভাবে তাঁরা প্রায় ৩৮৫ টি বটগাছ লাগান এবং অন্যান্য গাছের সংখ্যাও প্রায় আট হাজার। সন্তানহীনা থিম্মাক্কা একটু একটু করে হয়ে ওঠেন অসংখ্য বৃক্ষের জননী।
থিম্মাক্কার কাজ মানুষের মনে ধরে। যে সমাজ তাঁকে বন্ধ্যা অপবাদ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, তারাই তাঁকে আপন করে নেয়। ভালোবেসে তাঁকে ডাকতে থাকেন ‘সালুমারাদা’থিম্মাক্কা নামে। কন্নড় ভাষায় ‘সালুমারাদা’ কথার অর্থ হল বৃক্ষের সারি। সন্তানহীনা থিম্মাক্কা হয়ে ওঠেন ‘বৃক্ষমাতা’ থিম্মাক্কা।
১৯৯১ সালে স্বামীকে হারান তিনি। এটা তাঁর জীবনের বড়ো আঘাত। স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা ভাতার সমান্য টাকায় কোনোরকমে দিন চলতে থাকে তাঁর। তবে গাছ লাগানো আর তাদের পরিচর্যায় কোনো ছেদ পড়ে না। সেসব চলতে থাকে আগের মতো।একটু একটু করে তাঁর কার্যকলাপ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশ নিয়ে এই কাজের জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি ‘জাতীয় নাগরিক সম্মান’ পান।ক্রমশ তাঁর কার্যকলাপ রাজ্য ছাড়িয়ে দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কর্নাটক সরকার তাঁর লাগানো গাছের দায়িত্ব নেন।
২০১৯ সালে বাগেপল্লি ও হালাগুরু রাস্তা তৈরি করার সময় থিম্মাক্কার লাগানো গাছের কিছু কাটার প্রস্তাব হয়। ব্যাপারটা জানতে পেরে শিউরে ওঠেন থিম্মাক্কা। এরা তো কেবল গাছ নয়, তাঁর সন্তান। চোখের সামনে নিজের সন্তানদের হত্যা দেখবেন কী করে! থিম্মাক্কা কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন গাছগুলো না কাটার জন্য। সরকার তাঁর অনুরোধকে সম্মান জানিয়ে বিকল্প রাস্তার কথা ভাবেন।
পরিবেশের প্রতি তাঁর এই অসামান্য ও নিঃস্বার্থ অবদানের জন্য ভারত সরকার ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দেন। রাষ্ট্রপতি রমানাথ কোবিন্দ তাঁর হাতে এই সম্মান তুলে দেন। সম্মাননা প্রদানের সময় প্রোটোকল ভেঙে তিনি রাষ্ট্রপতির মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। এক স্নেহময়ী মায়ের এমন মধুর স্পর্শ নাড়িয়ে দেয় রাষ্ট্রপতিকেও। যা নিয়ে তিনি বলেছেন, “সালুমারাদা থিম্মাক্কার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার মুহূর্তটি আমার কাছে খুবই হৃদয়স্পর্শী।”
১৯৯৯ সালে তাঁর জীবন নিয়ে ‘থিম্মাক্কা মাথু ২৮৪ মাক্কালু’ নামে একটি ডকুমেন্টারি হয়েছে। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তা প্রদর্শিত হয়। তাঁর নামানুসারে একটি মার্কিন পরিবেশ সংস্থা তাদের নামকরণ করেছে থিম্মাক্কা রিসোর্সেস ফর এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন। এছাড়া তিনি পেয়েছন থাম্পি বিশ্ব বিদ্যালয়ের নাদোজা পুরস্কার, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমাতা পুরস্কার, বীরচক্র প্রশস্তি পুরস্কার, কর্নাটক কল্পবল্লী পুরস্কার, সবুজ চ্যাম্পিয়ান পুরস্কার প্রভৃতি। ২০২০ সালেকর্নাটক সরকার তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দেন।
যে মহিলাকে একদিন সমাজ একপ্রকার স্থান দেয়নি, একঘরে করে রেখেছিল, সেই মহিলাকে দেশের নানা প্রান্তে আমন্ত্রণ জানানো হয়, বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে। শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণ নয়, পাশাপাশি আরও বেশকিছু পরিবেশমূলক সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তিনি জড়িয়ে রয়েছেন।
একথা অনস্বীকার্য, স্বামী পাশে না থাকলে তিনি আজ এই জায়গায় পৌঁছোতে পারতেন না। হয়তো হারিয়ে যেতেন কোনো রাক্ষুসী অন্ধকারে। স্বামী তাঁর জীবনে নতুন আলো দেখিয়েছেন। অন্ধকার থেকে তাঁকে টেনে এনেছেন জীবনের পথে। সেই স্বামীর স্মৃতিতে তিনি তাঁর গ্রামে একটি হাসপাতাল করতে চান। তাঁর জন্য একটি ট্রাস্টও গঠন করেছেন তিনি।
জীবনের চলার পথে একটি দরজা যদি বন্ধ হয়ে যায় তখন আরও একটি দরজা কোথাও না কোথাও খোলা থাকে। আমাদের শুধু সেই পথটা খুঁজে বার করতে হয় ঠিকঠাক ভাবে। যারা পারেন, তাদের জীবনের পথচলা কখনও রুদ্ধ হয় না। সেই কাজটা করে দেখিয়েছেন সালুমারাদা থিম্মাক্কা। জীবনের দুঃখ, কষ্ট, অপ্রাপ্তিগুলোকে চালিত করেছেন আলোর পথে।সংকীর্ণ গণ্ডী থেকে মুক্ত হয়ে, বৃহত্তর ও মহত্তর ভাবধারায় নিজেকে মেলে ধরেছেন উন্মুক্ত বিশ্বে। তথাকতিত পুঁথিগত শিক্ষা এবং অর্থবল না থাকলেও যে জীবনে মহৎ কাজ করতে পারা যায় তা তিনি করে দেখিয়েছেন। তার থেকে বড়ো কথা, যে প্রকৃতিকে আমরা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি, তাকে তিনি ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তার চেনা রূপ। তিনি শুধু একজন পরিবেশবিদ নন, তিনি আসলে এক আলো, যে আলো আমাদের অন্ধকার পেরিয়ে এক আলোকিত জীবনপথে চালিত করে। কেবল বৃক্ষমাতা নয়, তিনি হলেন চিরন্তনী জননী।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ – দুঃখ, বিড়ম্বনা ও সহনশীলতা : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

ভারতবর্ষের গৌরবের ইতিহাসে যে সকল বিরল প্রতিভার ব্যতিক্রমী মানুষের দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ যাঁকে সময় ও কালের গণ্ডীতে বিচার করা যায় না। তিনি শাশ্বত, চির-বর্তমান। তাই জন্মের দেড়শ বছরের বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জীবনে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের যে দিকটি বেশি করে আমাদের নাড়া দেয় তা হল তাঁর সহনশীলতা, যা তাকে দুঃখ, বিড়ম্বনা জয় করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, তাঁকে সাধারণ থেকে আসাধারণত্বের দিকে নিয়ে গেছে এবং মরণশীল জগতে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের জীবনের পথচলা কখনওই মসৃণ ছিল না। কৈশোর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত দুঃখ ছিল তাঁর সঙ্গী। কিন্তু দুঃখে তিনি কাতর হয়ে পড়েননি। তাঁর মধ্য দিয়ে খুঁজেছেন বেঁচে থাকার আনন্দ। আপন সৃষ্টির মধ্যেই তিনি ভুলতে চেয়েছেন জীবনের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাকে। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে তাঁর সৃষ্টি, দুঃখ তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে সর্বত্র।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে যা মনে আসে তা হল তাঁর গান। জীবনের এমন কোনো দিক নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গান লেখেননি। বর্তমানে অজস্র গান, সুর যেখানে সৃষ্টির বর্ষপূর্তির আগে হারিয়ে যায়, সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান তার ব্যতিক্রমী সুর মূর্ছনায় শাশ্বত হয়ে আছে। আজও সুখের মুহূর্তে আবেগমথিত মনে যেমন বেজে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর, তেমনি দুঃখ ভারাক্রান্ত, বিরহক্লিষ্ট মন সান্ত্বনা পেতে ডুব দেয় রবীন্দ্রসঙ্গীতে। সারাজীবনে প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে ব্যাপক প্রসারতা তা রবীন্দ্র জীবদ্দশায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথের জীবনের বহুবিধ দুঃখের মধ্যে এও ছিল এক বিষম দুঃখ। সেই দুঃখের প্রকাশ আমরা দেখি তাঁর কথায়। মৃত্যুর দু-বছর আগে ১৯৩৯ সালের ১৪ মে, রবীন্দ্রনাথ মংপুতে মৈত্রেয়ীদেবীর সামনে বলেছিলেন, “… দেখো রবিঠাকুর গান মন্দ লেখে না, একরকম চলনসই তো বলতেই হবে। …কম গান লিখেছি! হাজার হাজার গান, গানের সমুদ্র—সেদিকটা বিশেষ কেউ লক্ষ করে না গো, বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিয়েছি। আমাকে ভুলতে পার, আমার গান ভুলবে কী করে?”
সত্যিই রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাসিয়ে দিয়েছেন গানের সমুদ্রে। প্রাণ-প্রাচুর্যতাপূর্ণ তাঁর গান চির নতুন ও চিরন্তন। সেই গান তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। কিন্তু উপরোক্ত উক্তি প্রমাণ করে কতটা আক্ষেপ, যন্ত্রণা, দুঃখ মিশে রয়েছে তাঁর কথায়। আসলে জীবিতকালে তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচকের অভাব ছিল না। সেকারণে জীবদ্দশায় তিনি তাঁর গানের ব্যাপক প্রসারতা দেখে যেতে পারেননি। তাই বলে তাঁর কলম থেমে থাকেনি। দুঃখ সহ্য করে, বুকের মধ্যে অভিমান চেপে রেখে একের পর এক গান রচনা করে গেছেন তিনি।
আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের জীবনের পথচলা কখনওই মসৃণ ছিল না। সারাজীবন ধরে নানান বিড়ম্বনা তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। ঘরে-বাইরে রবীন্দ্র অনুরাগী যেমন অনেক ছিল, তেমনি রবীন্দ্র সমালোচকেরও অভাব ছিল না। বিভিন্ন সময় এরা নানাভাবে রবীন্দ্রনাথের নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন, তাঁকে কটাক্ষ করেছেন, তাঁকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কখনও এদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেননি। শান্ত, সমাহত চিত্তে তিনি সমস্ত সমালোচনা সহ্য করেছেন। হিংসা, বিদ্বেষ তাঁর মনের মধ্যে ছিল না। ছোটোবেলায় তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন ব্রাহ্মধর্মে। যে ধর্মের মূলকথা ছিল সমভাতৃত্ববোধ। আজীবন তিনি সেই ধর্ম বা ধারনা থেকে বিচ্যুত হননি। তাই দেশ কিংবা বিদেশ, যে বা যারা কটাক্ষ করুক না কেন, তিনি দুঃখকে নীরবে সহ্য করেছেন। কারুর বিরুদ্ধে অপ্রিয় কথা বলেননি।
খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে একটি কথা আছে। জীবনে যত খ্যাতি তিনি পেয়েছেন ততই বিড়ম্বনাও বেড়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের যে নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে আমাদের গর্ব, সেটাও তাঁর জীবনে ছিল এক ভয়াবহ বিড়ম্বনা ও যন্ত্রণার কারণ। তৎকালীন বহু বাঙালী পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির তীব্র কটাক্ষ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর ‘দ্য সং অফারিংস’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতা বা গানগুলির ইংরাজি অনুবাদ করেছিলেন কবি নিজে। কিন্তু তৎকালীন কিছু বাঙালী পণ্ডিত বলতে থাকলেন এই অনুবাদ কবির নিজের নয়। কেননা কবির ইংরাজি জ্ঞান খুব কাঁচা। কেউ বলতে থাকলেন ওগুলো অনুবাদ করেছেন ইয়েটস। কেউ বা বলতে থাকলেন অ্যান্ড্রুজ এর কথা।
রবীন্দ্রনাথ যে ইংরাজিতে বাংলার মতো সাবলীল ছিলেন না তা তিনি নিজের মুখে স্বীকার করেছেন। ভাইঝি ইন্দিরাকে লেখা একটি চিঠিতে একথার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, “…আমি যে ইংরাজি লিখতে পারিনে এ কথাটা এমনি সাদা যে এ-সম্বন্ধে লজ্জা করার মতো অভিমানটুকুও আমার কোনোদিন ছিল না। যদি আমাকে কেউ চা খাবার নিমন্ত্রণ করে ইংরাজিতে চিঠি লিখত তাহলে তার জবাব দিতে আমার ভরসা হত না। তুই ভাবছিশ আজকে বুঝি আমার সে মায়া কেটে গেছে—একেবারেই তা নয়—ইংরাজিতে লিখছি, এইটেই আমার মায়া বলে মনে হয়।” তবে গীতাঞ্জলির কবিতাগুলির অনুবাদ যে তাঁর নিজস্ব সে বিষয়ে কোনো সংসয় নেই। নিজের লেখা অনুবাদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কবিতা কিংবা গানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। পাছে তাঁর কবিতার অর্থ বদলে যায় সেই ভয়ে অনুবাদের ব্যাপারে তিনি অন্য কারও ওপর ভরসা করতে পারেননি। এদিকে রোটেনস্টাইন তাঁর কবিতার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ইংল্যান্ড সফরে তাঁর হাতে কিছু কবিতা তুলে দেওয়ার জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই অনুবাদের কাজে মন দেন। ইন্দিরাদেবীকে লেখা উপরিউক্ত চিঠিতে সেকথার বিবরণ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, “… গেল বারে যখন জাহাজ চড়বার দিন মাথা ঘুরে পড়লুম, বিদায় নেবার বিষম তাড়ায় যাত্রা বন্ধ হয়ে গেল, তখন শিলাইদহে বিশ্রাম করতে গেলুম। কিন্তু মস্তিস্ক ষোলো আনা সবল না থালে একেবারে বিশ্রাম করার মতো জোর পাওয়া যায় না। তাই অগত্যা মনটাকে শান্ত রাখবার জন্য একটা অনাবশ্যক কাজে হাত দেওয়া গেল। তখন চৈত্রমাসে আমের বোলের গন্ধে আকাশে আর কোথাও ফাঁক ছিল না এবং পাখির ডাকাডাকিতে দিনের বেলাকার সকল কটা প্রহর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল। ছোটোছেলে যখন তাজা থাকে তখন তার মার কথা ভুলেই থাকে। যখন কাহিল হয়ে পড়ে তখনই মায়ের কোলটি জুড়ে বসতে চায়—আমার সেই দশা হল। আমি আমার সমস্ত মন দিয়ে আমার সমস্ত ছুটি দিয়ে চৈত্র মাসটিকে যেন জুড়ে বসলুম—তার আলো আর হাওয়া আর গন্ধ আর গান একটুও আমার কাছে বাদ পড়ল না। কিন্তু এমন অবস্থায় চুপ করে থাকা যায় না—হাড়ে যখন হাওয়া লাগে তখন বেজে উঠতে হয়। ওটা আমার চিরকালের অভ্যেস, জানিসত্। অথচ কোমর বেঁধে কিছু লেখবার মতো বল আমার ছিল না। সেই জন্যে ঐ গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি নিয়ে একটি একটি করে ইংরাজিতে তর্জমা করতে বসে গেলুম। যদি বলিস্ কাহিল শরীরে এমনতর দুঃসাহসের কথা মনে জন্ময় কেন—কিন্তু আমি বাহাদুরি করবার দুরাশায় একাজে লাগিনি। আর একদিন যে ভাবের হাওয়ায় মনের মধ্যে রসের উৎসব জেগে উঠেছিল সেইটিকে আর একবার আর এক ভাষার ভিতর দিয়ে মনের মধ্যে উদ্ভাসিত করে দেবার জন্য কেমন একটা তাগিদ এল। একটা ছোট্ট খাতা ভরে এল। এইটি পকেটে নিয়ে জাহাজে চড়লুম। পকেটে নেবার মানে হচ্ছে এই যে, ভাবলুম সমুদ্রের মধ্যে মনটি যখন উসখুশ করে উঠবে তখন ডেক চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার একটি দুটি করে তর্জমা করতে বসব। ঘটলও তাই। এক খাতা ছাপিয়ে আর এক খাতায় পৌঁছন গেল।” রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি প্রমাণ করে যে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে সমালোচকদের কটাক্ষ কতটা মিথ্যা ছিল।
যাই হোক, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি যে তাঁর জীবনে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করতে চলেছে তা আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৩-এর নভেম্বর মাসে শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর নোবেলপ্রাপ্তির টেলিগ্রাম এসে পৌঁছোয়। ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী উত্তেজিতভাবে রবীন্দ্রনাথকে সেই আনন্দ সংবাদ দেন। কিন্তু কবিগুরুর মুখে আনন্দের চেয়ে বিষণ্ণতার ছবু ফুটে ওঠে। সেই সময় তাঁর পাশে উপস্থিত এডওয়ার্ড টমসনকে কবি বলেছেন, “I shall ever have any peace again.” যে এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের লেখার উচ্চ প্রশংসা করেছেন, যে ইয়েটস্ তাঁর ইংরাজি গীতাঞ্জলির ভূমিকা লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি তাঁদের খুশি করতে পারেনি। উল্টে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন, তাঁর ইংরাজি অনুবাদ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। আবার ইয়েটস জীবনের সায়াহ্নে এসে অনুযোগ করে চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে। সব বিতর্ক ভুলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন দেশে গেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু এখানেও বিড়ম্বনা তাঁকে পিছু ছাড়েনি। জাপান, আমেরিকা, চীন প্রভৃতি দেশে তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমিরকায় দেওয়া বক্তব্যের পর কখনও তাঁকে বলা হয়েছে, তাঁর বক্তব্যের উদ্দেশ্য হিন্দু বিপ্লবী প্রচারে বাধা দেওয়া, কখনওবা বলা হয়েছে তিনি দেশের যথার্থ প্রতিনিধি নন। ১৯২৪ সালে চীনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাঁকে নানান অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। এমনকি ২৫ মে এক বক্তৃতা দেওয়ার সময় চীনা যুবকরা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে—‘পরাধীন দেশের দাস ফিরে যাও।’ বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যখন জার্মানি যান তখন অনেকে তাঁকে দেখেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দূত হিসাবে। রবীন্দ্রনাথের জীতায়তাবোধ কিংবা দেশপ্রেম নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। তাই উপরোক্ত ঘটনাগুলি তাঁর কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু এসব অপমান কিংবা কটাক্ষ তিনি নীরবে সহ্য করেছেন।
তবে রবীন্দ্রনাথের জীবনের সবচেয়ে বড়ো দুঃখ বা শোক হল মৃত্যুশোক। নিজের জীবদ্দশায় পারিবারিক মৃত্যু মিছিলের স্বাক্ষী থেকেছেন তিনি। প্রায় তিরিশজন পরিজনের মৃত্যু দেখতে হয়েছে তাঁকে। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। কিন্তু মায়ের মৃত্যু তাঁর মনে সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি। প্রথমবার মৃত্যুর গভীর শোক অনুভব করেন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে। কাদম্বরী দেবী ছিলেন তাঁর শৈশবের খেলার সাথী, কৈশোর-যৌবনের বন্ধু। স্বামীর অবহেলায় নিঃসঙ্গ কাদম্বরীও রবীন্দ্রনাথকে অনেকটাই আপন করে নিয়েছিলেন। তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। সে বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখে বলি, রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী উভয়ে উভয়কে ভালোবাসতেন। তাই কাদম্বরীর মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে প্রবলভাবে আঘাত করেছিল। তাঁর কথায়, “কিন্তু আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হল তা স্থায়ী পরিচয়।” পরবর্তী সময়ে তাঁর নানা লেখায় আমরা দেখতে পাই এই হারানোর যন্ত্রণার সুশোভন প্রকাশ। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি হারান সহধর্মিনী ও কর্মসাথী মৃণালিনীদেবীকে। স্ত্রীর মৃত্যুও তাঁকে গভীরভাবে আঘাত দেয় যা প্রকাশ রয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়। এর মধ্যে ছোটোপুত্র শমীন্দ্রনাথ যাকে রবীন্দ্রনাথ আদর করে ডাকতেন ‘শমী ঠাকুর’ বলে, তার মৃত্যু কবির মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। এককথায়, পরিজনদের মৃত্যু তাঁক কষ্ট দিয়েছে বারবার। কিন্তু মৃত্যুকে তিনি গ্রহন করেছেন শান্ত চিত্তে আর অন্তরের কষ্টকে তিনি মর্যাদার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন তাঁর লেখালিখির মধ্য দিয়ে। আসলে রবীন্দ্রনাথ জানতেন বৃহৎ কর্মের জন্যই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। তাই মৃত্যুতে কাতর হয়ে পড়া তাঁর চলবে না। শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি জগদীশচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমাদের চারিদিকেই এত দুঃখ এত অভাব এত অপমান পড়িয়া আছে যে নিজের শোক লইয়া অভিভূত হইয়া এবং নিজেকেই বিশেষরূপে দুর্ভাগা কল্পনা করিয়া পড়িয়া থাকিতে আমার লজ্জাবোধ হয়।” আবার ১৩২৫ সনের ১৪ শ্রাবণ শান্তিনেকতন থেকে শ্রীমতী রানু অধিকারীরে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, “… কেননা আমার উপরে যে কাজের ভার আছে; তাই আমাকে দুঃখ ভোগ করে দুঃখের উপরে উঠতে হবে। নিজের শোকের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এই মুহূর্ত কাটাইবার হুকুম নেই আমার।”
এই দুটো বক্তব্যই প্রমাণ করে রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গী। বৃহত্তর শোক আর দুর্দশার আবহে তিনি নিজের দুঃখ ও শোককে গ্রহন করেছেন। মৃত্যু তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, যন্ত্রণা দিয়েছে কিন্তু বিপর্যস্ত করে দিতে পারেনি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন প্রেমিকের মতো। তাই তিনি বলেছেন, ‘মরণরে, তুহু মম শ্যাম সমান।’
রবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যুই জীবনের শেষ কথা নয়। জীবনের বহু পরিবর্তনের মতো মৃত্যুও একটি পরিবর্তন। মৃত্যু মানে জীবনের শেষ নয়, শরীরের সমাপ্তি। ১৩৩৮ সনের ১৫ কার্তিক বাসন্তীদেবীকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন, “জীবন আর মরণ তো একই সত্তার দুই দিক—চৈতন্যে ঘুম আর জাগরণ যেমন।” এই মৃত্যুশোকের মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর সৃষ্টির ধারা। আর মৃত্যুকে তিনি গ্রহন করেছেন শান্ত চিত্তে, প্রকাশ করেছেন মর্যাদার সহিত। যেখানে মৃত্যু নয় তিনি বড়ো করে দেখিয়েছেন জীবনদেবতাকে। নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের এই গভীর সহনশীলতা জীবনের এত বিপর্যয় এড়িয়ে তাঁকে বৃহত্তর জগতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।
পরিশেষে বলি, রবীন্দ্রনাথ শুধু একজন সাহিত্যিক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, কর্মযোগী প্রভৃতি ছিলেন না। তিনি আমাদের সামনে এক প্রতীক। দুঃখকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক। গয়ায় থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ একসময় বলেছিলেন, “জীবনে দুঃখ পাওয়ার দরকার আছে।” সত্যিই তাই। তা নাহলে জীবনের প্রকৃত সুখ, বেঁচে থাকার প্রকৃত আনন্দ অনুভব করা যায় না। দুঃখ নিজেকে চিনতে শেখায়, নিজেকে ভাবতে শেখায়। শুধু তাই নয়, দুঃখই দুঃখকে ভুলতে শেখায়। জাহাজে পাড়ি দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছোনোর যে সুখ, তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যায় যদি সেই জাহাজ সমুদ্রে চরম ঘূর্ণিতে আটকে পড়ার পর তীব্র লড়াই করে শেষমেশ গন্তব্যে পৌঁছোতে সক্ষম হয়। আমাদের জীবনটাও তাই। জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের ভাগ বেশি। তাই দুঃখে কাতর হয়ে পড়লে জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণার, বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে দুঃসহ। সে কারণে দুঃখে কাতর হওয়া নয়, দুঃখে নিজেকে শক্ত রেখে লড়াই করতে হবে। তাহলে জীবনে প্রকৃত সুখ অর্জন করা সম্ভব। অন্য কিছু নয়, কেবল দুঃখই পারে দুঃখের নিরসন ঘটাতে। তবে তার জন্য চাই সহনশীলতা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
“দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে
দহন করে মারতে হবে।
জ্বলতে দে তোর আগুনটারে
ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন
জ্বলবে না আর কভু তবে।
এড়িয়ে তারে পালাস না রে
ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল
দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে যে একেবারে,
তার পরে সেই জীবন এসে
আপন আসন আপনি লবে।”
রবীন্দ্রনাথের জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করে বারে বারে যে দিকটি আমাদের সামনে প্রকট হয় তা হল তাঁর জীবনভরা দুঃখ, বিড়ম্বনা ও তাঁর অসীম সহনশীলতা। উপরোক্ত কবিতায় দুঃখ এবং তাঁর থেকে মুক্তির পথ কী, তা সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন কবি।

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

দুর্গার দুর্গতি : ডঃ অশোকা রায়।

করোনার ক্যারিশমা সত্যি সত্যি দেখার মতো। দেবী দুর্গারও বুক বাপের বাড়িতে এসে দুরুদুরু।অথচ বাপের বাড়ির লোভ জয় করা দুরুহ। মা দুর্গা ও বোধহয় অতটা জিতেন্দ্রিয় নন। বছরান্তে একবারো বাপের বাড়ি পা দেবেন না,তা কি করে হয়? কথায় বলে মেয়েদের কাছে বাপের বাড়ির মাটিটুকু বড়ো মিষ্টি। স্বামী বুঝিয়েছেন,’ এই আশ্বিনে যেওনা বাপের বাড়ি। গতবার গিয়ে তো দেখেছ, খাতির যত্ন পাওনি। আর পাবে কোথা থেকে বলো তো দুর্গা রানী? করোনা নামে
অতি মহামারী পৃথিবী কে ছারখার করে দিয়েছে। তারপর তোমার বাপের বাড়ি,তা সে পূব বা পশ্চিম বাংলা- যাইহোক না কেনো,কেউ তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইংল্যান্ডের বাসিন্দাদের মতো ধনী নয়।ফলে করোনার করুণায় তোমার বাপের বাড়ির বাসিন্দাদের হাঁড়ির হাল। নন্দী তো সেদিন ঘুরে এসে বললো, তাবড় তাবড় ভালো চাকরি করা লোকেরা বাড়িতে বসে মাছি তাড়াচ্ছে আর টিপে টিপে সামান্য সঞ্চয় থেকে খরচা করছে,প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া টিউব থেকে পেস্ট বার করার মতো।না শেভ করা দাড়ি নিয়ে অনেক পুরুষ এখন ঘরের মধ্যে বিষাদের ঘরে নিজেদের বন্দী করেছে। বেল্ড বা ক্ষুর- শেভিং ক্রিমের পয়সা যতটা বাঁচে। যাদের অফিস বা রোজগার নামক বস্তু টি কোনক্রমে টিঁকে আছে, তাদেরও সদাই ভয়, এই বুঝি রিটেনশনের নোটিশ দ্বিধা থরো থরো হাতে কেউ গুঁজে দিল। মালিক পক্ষের মানবিকতা আছে, কিন্তু কি করবে তারা? করোনার কাছে নতজানু হয়েও বিশেষ সুরাহা হয়নি।নিজেদেরই পেট ভরে না, শংকরকে ডাকবে কি করে? সুতরাং অন্ততঃ ফিফটি পারসেন্ট ছাঁটাই তো বটে, ইফ নট মোর,নয়তো পুরোপুরি তালা বন্ধ। বাড়ির গিন্নীদের কাছে বিউটি পার্লার যাওয়া পূর্ব জন্মের স্মৃতির মতো। বরং দু ফোঁটা তেলে জলের ছিটে দিয়ে রাঁধতে নাজেহাল। লোকাল ট্রেন তো বিধিবদ্ধ ভাবে চলল না। স্টাফ স্পেশ্যাল নাম কা ওয়াস্তে। আপামর পাবলিকের ভিড়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা ব্যবস্থা। মুখে মাস্ক কি এহেন ব্যবস্হার মুশকিল আসান হতে পারে? তার ওপর উপনির্বাচনে প্রচারের ঠ্যালা।যেও না গিন্নী, অসুবিধায় পড়বে। গিন্নী নাছোড়, ” বছরে তো একবার বাপের বাড়ি যেতে দাও। বাদবাকি সময় তো তুমি,তোমার ছেলেমেয়ে আর তোমার হাঁড়িহেঁশেল নিয়ে পড়ে থাকি। আমার কি আমোদের সুযোগ টুকুও থাকবে না? এক নম্বর মেল-শভিনিস্ট কোথাকার।”কি যে হবে মা দুর্গার কে জানে! আর জানার ইচ্ছে আছে নাকি ভদ্র মহিলার? সেই আসতেই হবে ঝড়- জল উপেক্ষা করে কোভিড এর যুগে। এতোটাই অবুঝ যে বুঝতে পারে না, দুর্গা এসেছে বলে হাজার হাজার না হোক, অন্ততঃ শখানেক লোক ছুটে আসবে আদিখ্যেতা করতে। কোভিডের সংক্রমণ হার বাড়বে। সামাল দিতে সরকারের প্রাণান্তকর অবস্হা। পুলিশ ব্যতিব্যস্ত। আর কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এলে আবার প্রাণ নিয়ে টানাটানি।ডাক্তার দের নাওয়া- খাওয়া মাথায়। কোভিডের গুঁতো তো মা দুর্গা কে সইতে হয় না। তাঁর মাথাব্যথা হবে কেন? চীন যতদূর মনে হয় তাঁর এক্তিয়ারভুক্ত নয়। শুনেছি তো চীনে ওয়াংশাং বলে এক দেবতা আছে, সে না কি সাহিত্যের দেবতা; আর ফুসি স্বর্গলোকের দেবতা, নুইও মর্ত্য লোকের দেবতা।
আর ওয়েল বিয়িং এর দেবী সকলের মঙ্গলের দিকটা দেখে। আর ইয়াং লং ড্রাগন বৃষ্টির দেবতা। তবে সব সেরা দেবতা হচ্ছে Tian. তা দুর্গার সাথে এদের কোন প্যাক্ট হয়েছে কি না জানা নেই।তবে দুর্গা আসছে কোন সাহসে? বলি মরণের ভয় ডর কি নেই?তার ওপর বায়না, দুর্গা আর তার পরিবার মাস্ক পড়ে কিছুতেই আসবেন না।সৌন্দর্য নষ্ট হবে যে! কোভিড বিধিতে পড়ে গেলে ফাইন হবে , সে চিন্তাও নেই! মর্ত্যে আসবে, অথচ মর্ত্যের আইন মানব না… এ তো বেশ গা জোয়ারী ব্যবস্থা। অথচ দুর্গার মুখে যত বোলচালই হোক না কেনো, করোনার ভয়ে তিনিও কিন্তু কাঁটা।পুজো উদ্যোক্তারা কেউ কেউ দুর্গা আর তার পরিবারের মুখে মাস্ক পরিয়ে দিলে,
” মা দুর্গা রাতের স্বপ্নে উদ্যোক্তাদের ওপরে প্রথম হম্বিতম্বি করেন,” এক্ষুনি হাটা তোদের এই মুখোশ, আমার আর ছেলেমেয়েদের প্রাণ যায় যায়। অক্সিজেন লেভেল নেমে যাচ্ছে। এখানকার ডাক্তার গুলো ভীতুর ডিম এক একটা। পিপিই কিট পড়ে জবরজং সাজা ডাক্তার সব। নিজের সেফটি দেখতে ব্যস্ত। অথচ পকেটে টাকা বোঝাই করা চাই। তাই কত বুদ্ধি। হাসপাতালের ডিউটি শেষ হলো তো, শুরু হলো প্রাইভেট কনসালটেন্সি।ভিডিও কলিং এ দেদার রোজগার।বুদ্ধুরাম ডাক্তার দের পড়াশোনার বহর তো জানা আছে! আর অভিজ্ঞতা? না বলতেই হবে এবার, ধনবান হলে একরকম কসরত। আর ধনবান না হলে ভিডিও কলে বা ফোনে যা হোক নিদান দিয়ে ছেড়ে দাও।অন লাইনে পেমেন্ট এলেই হলো। টিকি পাকড়াও করে কোন পাকড়াশী? তার তো এখনও জন্মই হয়নি। চীনের উহান দোষী নিশ্চয়ই। এর একটা বিহিত করতে হবে বলে তোদের বাবা ঐ কল্কে সেবী শিব সকল দেবতা দের নিয়ে মিটিং ডাকছে। শুধু ডেট ফিক্সিং বাকি। আমি এখান থেকে ডেটা নিয়ে যাই… তখনই ডেটটা জানিয়ে দেব তোদের। কত রূপে কত অসুর আর দৈত্যদের বধ করলাম! আর তোদের বিরক্ত করে মারছে যে করোনাসুর, তাকে মারা তো আমার বাঁ হাতের খেলা রে। তবে একটা ভ্যাকসিন আর সিরিঞ্জ আমার চাই। খোঁজে আছি। পেলেই করোনাসুর কে এমন ফুটিয়ে দেব বুকে সিরিঞ্জ, জিভ বার করে অক্কা পাবে। বিভিন্ন দেশের সাথেও যোগাযোগ রাখছি, যদি কেউ মোটা সিরিঞ্জ আর ওষুধ দেয়। তাহলে মর্ত্যের খেলা মর্ত্যেই মিটিয়ে যাব। আমি এর মধ্যে না পারলে লক্ষী আর সরস্বতী তো পরপর আসবে। ওদের হাতেই না হয় করোনাসুর বধ হবে। মায়ের কাজ মেয়ে করবে, তাতে লজ্জা কি? শুধু ভয় পাচ্ছি এখন এখানে লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকের যদি কিছু হয়, কি হবে? একটা ডাক্তারও ফিজিক্যালি
চেক- আপ করবে না।ভিডিও কলিং এ কি রোগী দেখা যায় রে? নাড়ি টিপব না, জিভ দেখব না নিজের চোখে? সব কি ক্যামেরার এক্সপোজার দিলেই হয়ে যায়?ওদের বাপ আমায় মোবাইলেই তুলোধুনো করবে, ফেরারও তর সইবে না। বলবে, “পরপর দুই বছর শূন্য মন্ডপে বসে ধান ভানার কি দরকার? সরাসরি শিবের গাজন তো কৈলাশে বসেই গাওয়া যায়। আমি নিজের গাজন ভালো করে শুনতে পাই, তা’ও আবার তোমার মুখে। মনে পুলক হয়। মর্ত্যে তুমি যা কর, তা ঠিক মতো দেখতে পাই না, শুনতেও পাই না। একেবারে বেপরোয়া হয়ে বাপের বাড়ির আদর খাও। চোখ আর কান দুটো অর্গানই আজকাল বড়ো জ্বালাচ্ছে।” দুর্গা বলেন, এবার থেকে তোরা আমাকে আনার সময় ঘোড়া- মুখো অশ্বিনী কুমার দুজনকে আনার ব্যবস্থা করবি। অশ্বিনীকুমাররা যমজ দুই ভাই। কপালদোষে ঘোড়া মুখো। সূর্য আর তার বৌ সংজ্ঞার কি যে শখ জাগল, ঘোড়া রূপে মিলিত হল। জন্ম হলো ঘোড়া মুখো অশ্বিনীকুমার দের।মা হয়ে তোদের সাথে এসব আলোচনা করা উচিত নয়,বুঝি। তবুও দুশ্চিন্তায় কি মাথার ঠিক থাকে?ওদের কথা তোদের জেনে রাখা ভালো। পরের বার এ্যাপ্রোচ করতে সুবিধা হবে। তোরা তো দেখছি সকলেই ষোল ঊর্ধ্বে।সুতরাং আমার পাপ হবে না অশ্বিনী কুমার দের জন্ম রহস্য খোলসা করে তোদের বলার জন্য । ষোলো পেরোলেই ছেলে -মেয়ে মায়ের বন্ধু।জানিস,অশ্বিনীরা তো আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস। সরোর শরীরটা চিরকাল তেমন শক্তপোক্ত নয়। লক্ষীর ইদানীং দেখছি এনার্জি লেভেল কম। এনসিওর খাওয়াচ্ছি দুবেলা, কিছুতেই কিছু হবার নয়। কেমন করে কেৎরে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখ না। কেতোর আবার সামনের মাসে আর্চারি কম্পিটিশন আছে। এখানে আবার আসবে তো সেই কার্তিক মাসেই, তাই ডেট এ্যাডজাস্ট করার জন্য আমাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছে। এ্যাপ্রুড হয়ে যাবে মনে হয়। কর্তৃপক্ষ তো জানে পঞ্জিকার ডেটের নট নড়ন- চড়ন।গনশার দেহটাই ওমনি ঢ্যাপসা। বলতে গেলে ও বিকলাঙ্গ মানুষ। মানুষের দেহে হাতির মাথা। তার ওপর পেটটাও অস্বাভাবিক বড়ো ।হাঁসফাঁস করছে।এখানে এতো বৃষ্টি হচ্ছে,অথচ গুমশুনি ভাব গেল না।দু- দুটো মাস্ক স্পেশাল অর্ডার দিয়ে করিয়েছিস , গনশার তো সর্দি হয়ে গেছে। বারবার ন্যাপকিন চাইছে।করোনা হলে সামলাবে কি করে?আসার জন্য এখন আমার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। সোয়ামীর কথা না শুনলে এমনই হয়। তা যাক গে এসব কথা। করোনা হলে দেখা যাবে। তোরা মানুষরা কত কষ্ট পাচ্ছিস, আমার তো এখানে থাকার মেয়াদ কুল্লে পাঁচদিন। তোদের ভোলে বাবা ঠিক পার করিয়ে দেবে। জয় ভোলানাথ।

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

সিঙ্গল মাদার : ডঃ অশোকা রায়।

বহুদিন বাদে তোমাকে দেখলাম. ট্যাংগুলার পার্কের মোড়ে আদি ঢাকেশ্বরীতে. মায়ের জন্যে একটা কালো পাড় গরদের শাড়ি কিনতে এসেছিলাম একবারে শেষ মুহূর্তে. আজ দুর্গা পুজোর ষষ্ঠী.
মায়ের শাড়িটা শেষ মুহূর্তে কেনার কারণ মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবহেলা নয়. মা ছিল বেলভিউতে. বেলুন সার্জারি হয়েছে হার্টের. ভালো আছে এখন. কিন্তু নিজের মা হাসপাতালে, তাই পুজোশপিং অন্যান্য দের জন্য করলেও আমার মা নার্সিংহোম থেকে ছাড়া না পাওয়া অবধি মা আর নিজের জন্যে কোন কিছু কিনবো না বলে রেজ‌োলিউশন নিয়েছিলাম. মা কে কাল বাড়ি নিয়ে এসেছি. মায়ের একমাত্র সন্তান ‌আমি. সুতরাং এসব ঝামেলা আমাকেই পোয়াতে হয়. বাবা আর শ্বশুর মারা গেছেন আমার বিয়ের আগে. ‌আর আমার স্বামী তার উজ্জ্বল
কেরিয়ার গড়তে পাড়ি দিয়েছে সাগর পাড়ে. শ্বাশুড়ির দায়িত্ব আমার ঘাড়ে নিয়েছি স্বেচ্ছায় সানন্দে. অবশ্য মায়ের মতো আমার শ্বাশুড়িকে নিয়ে ছুটতে হয় না যখন তখন ডাক্তারের চেম্বারে.তবে সপ্তাহে একদিন যেতে হয় শ্বাশুড়ির সংগে সিনেমা হলে. স্মার্ট শ্বাশুড়ি আমার. কি হিন্দি, কি বাংলা কি ইংরেজী সব সিনেমা কোথায় চলছে, টাইম কি, সব মুখস্থ. আমার দায়িত্ব অন লাইনে টিকিট বুকিং আর ওঁনাকে সংগ দেয়া, সে আমার ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক. হাজার অন্য কাজ থাকুক. ‌অদ্রিজাকে বলিনি, আমার শ্বাশুড়ির মেজাজের সংগে আমার অল্পবিস্তর পরিচয় আছে. অদ্রিজা আমার শ্বাশুড়ির ছাত্রী. আমার সংগে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে. ‌আমার শ্বাশুড়ি অমনোমত হলে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন না আমাকে. অথচ আমি যে তাঁর মেয়ে হয়ে এসেছি এই বাড়িতে.. এই প্রতিশ্রুতির খেলাপ তাঁর কোনও দিন হয়নি. আমি তাঁর মেয়ের মতো নই.. সত্যিই মেয়ে. মা- মেয়ের মধ্যে রাগারাগি তো স্বাভাবিক জিনিস সম্পর্কের সুস্বাস্হ্যের লক্ষ‌ণ. আমার শ্বাশুড়ি বলেছিলেন, বেয়ান বাড়ি ফিরলে তোমাদের সাথেই আমার শাড়ি কিনো. তবে শ্বাশুড়ির বিনীত আবদার তার ছাত্রী অদ্রিজার বুটিকের পার্টিকুলার ডিজাইনের ঢাকাই শাড়ি. আজ সকালে অদ্রিজাকে ফোন করেছিলাম, শাড়িটা রেডি
আছে কিনা. অদ্রিজা বলেছে, বাপস্ রে বাপ্ ম্যাডামের অর্ডার সবার আগে তৈরি করে রেখেছি. নাহলে কি ‌আর রক্ষে আছে. জানো বৌদি ম্যাডাম সম্পর্কে আমাদের আগের সেই সম্ভ্রম আর ভালোবাসার মিলিজুলি ‌আবেগ আজো বজায় আছে. আমাদের ব্যাচের গেট-টুগেদারে ঘুরে ফিরে ম্যাডামের প্রসঙ্গ উঠবেই উঠবে.
টেলিফোনের মধ্যে হেসে উঠি আমি, “মা তো খুব ভালো মানুষ.মাইডিয়ার বলে যাকে, তবে ভয় পেতে কেন? অদ্রিজাও হাসে,” শুধু ভয় তো বলিনি. ভালোবাসার কথাও বলেছি. ক্লাসে ডায়াসে ভয়াবহ.
পড়া না করে ক্লাসে ঢোকা, পড়াবার সময় অন্যমনস্ক হলে কঠিন কঠোর. অথচ ক্লাসের বাইরে এক সংবেদনশীল বন্ধু. এমন মানুষ কে না ভালোবেসে পারা যায়?” কি আর বলি, শুধু বললাম “মায়ের শাড়িটা রেডি করে রেখো. সন্ধ্যের দিকে একসময় কালেক্ট করে নেবো.
ঢাকেশ্বরীতে ঢোকার আগে শ্বাশুড়ি – মায়ের শাড়িটা অদ্রিজার বুটিকের থেকে কালেক্ট করেছি. তারপর ঢাকেশ্বরীতে ঢুকেছি. মা আর আমার দুটো পছন্দ সই শাড়ি কিনেছি. মায়েরটা অবশ্যই কালো পাড় গরদ. মা বৈধব্যের সব নিয়মকানুন মানেন. আঁশ খান না. একাদশী করেন. কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি – মা সেসবের ধারপাশ দিয়ে যান না. নাঃ আমার রাগ হয় না. আজকের জগতের নিয়মই তো হচ্ছে আপ রুচি খানা. আপ রুচি পড়না. তাই আমি আমার মা বা শ্বাশুড়ি- মায়ের এসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে যাই না. ওদের ওদের মতো থাকতে দিই. তবে দুই বেয়ানের খুব ভাব. প্রতিদিন দেখা না হলেও রোজ টেলিফোনে কথা হয়. আর কি আশ্চর্য দুজনেই ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করতে ভালোবাসে.
যাক গে এখন আমি সেদিনের ঘটনায় আসি. ‌এক্কেবারে প্রথমে এমন একজনের কথা বলেছি, যার সংগে আজ অনেকদিন বাদে আমার দেখা. সে সুজন, আমার প্রাক বিবাহিত জীবনে আমার হার্ট -থ্রব. বিয়ে নিশ্চয়ই করেছে.
শাড়ির বিলের পেমেন্ট করেছে আমি লক্ষ্য করেছি. তখন সংকোচে কথা বলতে পারি নি. কাঁচের দরজা ঠেলে যখনই বেরোচ্ছি, তখনই দুজনের চোখাচুখি. সুজন স্বাভাবিক. জিজ্ঞেস করেছে কেমন আছি আমি. মৃদু হাসি আমার,.. “ভালো.” রাস্তায় দাঁড়িয়ে পূর্ব স্মৃতির রোমন্থন, তারপর সুজনের অনুরোধে তার অডিতে চেপে ডিনারের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য পাঁচতারা হোটেলে পদার্পণ… নিশির ডাকে চলেছি আমি. সুজনের নির্দেশে কি ওয়েটার আমার সফট ডিঙ্কসের গ্লাসে হার্ড ডিঙ্কস সার্ভ করেছে? আগের পীরিতির লোক, তার ওপর নিজের স্বামী স্বপনের দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি সামাজিক অনুশাসনের ব্যাকরণ ভুলেছি. সুজনের পীড়াপীড়িতে বেশ কয়েক পেগ খাওয়া হয়ে গেছে. চেতনা লুপ্ত. জ্ঞান ফিরে পেয়েছি চারশো – বিশ নাম্বার স্যুটের অবিন্যস্ত বিছানায়. গায়ে চাদর টানা রয়েছে. দেহে পোশাকের অনুপস্থিতি বলে দিয়েছে আমাকে আমার বর্তমানের স্ট্যাটাস. পাশে আমার কেনা কালকের সব প্যাকেট. ওয়াশরুমে গিয়ে স্নান করে পোশাক পরে নিয়েছি. ঘড়ি তে ‌আটটা বাজতে পনেরো . রিসেপশন থেকে ফোন করে জানিয়েছে, চেক আউট টাইম ডট আটটা. পেমেন্ট করা আছে. আমি প্যাকেট গুলো নিয়ে বেরিয়ে এসেছি হোটেল থেকে. ট্যাক্সি নিয়ে বলেছি জেনেক্সভ্যালি. ড্রাইভার ট্যাক্সি ছুটিয়েছে. এখনও ঠিকমতো অফিস- টাইম আরম্ভ হয়নি. নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক আগে পৌঁছেছি বাড়িতে. শ্বাশুড়ি রেগে ‌আগুন, তেলে বেগুন. হিসহিসে স্বরে জিজ্ঞেস করেছেন, “রাত কাটালে কোথায়? বেয়ানের বাড়িতে যাওনি শুনলাম. ” আমি ‌আনুপূর্বিক সব ঘটনা বলে গেলাম. নিরাসক্ত মুখে শুনে গেলেন. চেয়ার থেকে উঠে ল্যান্ড ফোনের কাছে. মাকে বললেন সব. ওপ্রান্তের উত্তর শোনা গেল না. মেয়ের কুকীর্তিতে একটা মায়ের বলার কি বা থাকে! শ্বাশুড়ি ফোন কানে নিয়েই বিশাল হুঙ্কার ছাড়েন…” এই বাড়ির বাইরে যাও.” হুঙ্কারের রেশ মেলায়নি. শ্বাশুড়িমা আমার সপাটে আছড়ে পড়েছেন মাটিতে.ডাক্তারকে খবর দিয়েছি. এসে শ্বাশুড়িকে পরীক্ষা করে বলেছেন চার ঘন্টা বাদে এসে ডেথ-সার্টিফিকেট লিখবেন. ম্যাসিভ্ হার্ট এ্যাটাক্. চেম্বারে অনেক পেশেন্ট অপেক্ষা করছে. নিয়মবিধি অনুযায়ী চার ঘণ্টার আগে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া যাবে না.পুরনো কাজের লোক শ্বাশুড়ির ছেলে ও অন্যান্য দের খবর দিয়েছে. স্বামী স্বপন আসছে বলে জানিয়েছে. সময় যাতায়াতের জন্য যেটুকু লাগবে. বডি পিস-হেভেনে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি. বাড়ির মধ্যে ঢুকিনি. এমন কি টয়লেটেও যাই নি. মনে হচ্ছে শরীরের প্রাকৃতিক ক্রিয়া – কর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে. মাসী শ্বাশুড়িকে বলেছি, শ্বাশুড়ির জন্যে কেনা নতুন ঢাকাই পড়িয়ে দিতে. মনে মনে বলেছি “ওটা তো তোমার ছেলের পয়সায় কেনা. পড়তে আপত্তি নেই নিশ্চয়ই. কেমন তরো সংবেদনশীল মানুষ তুমি তোমার মেয়েকে ক্ষমা করতে পারলে না! “তোমার ছাত্রীরা তোমাকে ঠিক মতো চেনে না. একটা ফোন করেছি আমি যে এন. জি. ও র সংগে যুক্ত সেখানকার প্রেসিডেন্ট জলিদি কে. থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে. মেয়েদের সেলাই শেখাই সেখানে. বস্তীর মেয়েদের পড়াশোনার উইং খুললে তার দায়িত্ব নেব. এখনকার ‌থেকে মাইনেও বেড়ে যাবে. যথাসময়ে মেয়ের জন্ম দিয়েছি আমি. নাম রেখেছি অগ্নিহোত্রী. কামনার অগ্নি থেকে ওর জন্ম. স্হির করেছি এমন দৃঢ় ও চৌখশ ভাবে গড়ে তুলবো ওকে, তখন ওকে ডাকবে সবাই আগুনে পাখি বলে, যে সমাজের সব জন্জাল সাফ করে,… হবে মহীয়সী এক নারী. স্বপন বা সুজন আসে নি আর কোন দিন. আমার নিজের মা বেঁচে আছে কোনক্রমে. কিন্তু আমার মুখ দেখে না. আমি সিঙ্গল – মাদার.


Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জাতিস্মর : ডঃ অশোকা রায়।

কি নিয়ে লিখব ভাবছিলাম বেশ কিছু ক্ষণ ধরে। কিছুই মাথায় আসছিল না।
মাথাটা একেবারে ব্ল্যাংক। হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। আমার ঘরের ঠিক জানলার নীচে একটা ঝোপ আছে, অনেক ক্ষণ ধরে সেখান থেকে ব্যাঙের ঘ্যানঘ্যানানি ডাক ভেসে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম বৃষ্টি আসবে। অপেক্ষায় থাকলাম বৃষ্টির। বৃষ্টি আমার আশা পূরণ করলো। ঝমঝমানি শব্দ করে নামলো বৃষ্টি। প্রথমে জানলা বন্ধ করিনি, যদি বৃষ্টি দেখে মাথায় গল্পের প্লট আসে, তবে সুমনের পোর্টালে আজ একটা আবার গল্প দিতে পারবো, এই ধান্দা নিয়ে। জগতটাই তো ধান্ধাবাজিতে চলছে, তবে আমিই বা এব্যাপারে পেছিয়ে থাকি কেন? লোকে তো তখন আমার কপালে “ব্যাক ডেটেড” শব্দটা দেগে দেবে। কি একটা হিন্দি সিনেমায় দেখেছিলাম নায়কের হাতে উল্কি কেটে ” আমার বাবা চোর” লিখে দেয়া হয়েছিল। সে নিয়ে তো সিনেমাটা একেবারে ক্লাইমেক্সে পৌঁছে গিয়েছিল। বক্স অফিসও হিট। সিনেমার নামটা ভালোই মনে আছে। কিন্তু বলে তর্ক সৃষ্টি করতে চাই না। এত চিন্তামগ্ন ছিলাম যে, বৃষ্টির ছাঁট আমার পাঞ্জাবিটা ভিজিয়ে দিয়েছে কখন বুঝতেই পারিনি। সুতরাং জানলা বন্ধ করে দিতে যাই। আর তখনি আকাশের গায়ে জোর বিদ্যুৎ ঝলকানি। তা’ দেখে আমার মাথায় গল্পের প্লট এসে যায়। জানলা বন্ধ করে আমি টেবিলের সামনে চেয়ারে বসি। কলম তুলে নিই, লেখনী এগিয়ে চলে পাতার পর পাতা। কল্পনার গরু ‌আমার একবারে মগডালে।
সমীরণ খুব ভালো বন্ধু আমার সেই স্কুল জীবন থেকে। ওদের বাড়িতে আমি যেতাম প্রায়ই। খুব ছোট যখন লুডো বা ক্যারাম খেলতে। শৈশবে সমীরণ খুব বেশি না হলেও আমাদের বাড়িতে আসত‌। কিন্তু সে ইনডোর গেমেই ইন্টারেস্ট দ‌েখাতো, আউটডোর গেমে নয়। আমি সমীরণ দুজনেই বড়ো হয়েছি। সমীরণ ঘরের কোণে বই মুখে দিয়ে বসে থেকেছে। আমি গেলে বেশ বড়ো অবস্থাতেও আমার সাথে সাপলুডো খেলেছে। আমি ব্যঙ্গ করে বলেছি চল্ আমরা সাপলুডোই খেলি। বড়োদের বিজ্ঞাপন কিন্তু আমি যে এঁচ‌োড়ে পাকা। সরল সমীরণ আক্ষরিক অর্থেই কথাটা নিয়েছে। ইনার মিনিংটা বোঝে নি, বা বোঝার ক্ষমতা তার ছিল না। এই সময় আমাদের বয়েস চোদ্দ বছর। সমীরণকে কতবার মাঠে খেলার কথা বলেছি। মোটা চশমার কাঁচের আড়ালে ঢাকা সমীরণের চোখ দুটো এক লহমার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পরক্ষণেই ম্রিয়মাণ গলায় জবাব দিয়েছে “না রে, মা বাবা বকবে” রহস্যটা উদ্ধারের ইচ্ছে থাকলেও তখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই। আমি ফুটবল, ক্রিকেট সব খেলাতেই বেশ দড় ছিলাম। ফুটবলে সেন্টার ফরোয়ার্ড প্লেয়ার হিসেবে আমার তখন পাড়া, পাশাপাশি বেপাড়ায় বেশ সুনাম। তার থেকেও বড়ো কথা আমি তখন অনুর্দ্ধ ঊন্নিশ-এ সি. এ. বির টুর্নামেন্ট খেলছি। নামযশ কিছু কিছু ছড়িয়েছে। কাগজে আমার ক্যালিবারের প্রশংসা করে রিভিউ বেরোচ্ছে। তবু তার মধ্যেও সমীরণের বাড়ি যাই। দুজনের চরিত্রগত প্রকৃতির বিশাল ডিফারেন্স। তবুও সমীরণের আকর্ষণ আমার কাছে অপ্রতিরোধ্য। কারণটা তখন বুঝতে পারি নি। বুঝেছি অনেক পরে।
ইতি মধ্যে আরো কয়েকটা বছর কেটে গেছে। আমি বেঙ্গল ক্রিকেট দলের অপরিহার্য সদস্য। টেস্ট দলে আমার অন্তর্ভুক্তি আলোচনার স্তরে আছে। আমার এ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন হায়ার সেকেন্ডারির স্তর পেরিয়ে থমকে গেছে। দরকার কি? এ. জি বেঙ্গলে ঢুকে গেছি। সমীরণের সংগে সম্পর্ক ত্যাগ করিনি। আমার চাকরি পাওয়া উপলক্ষ্যে “রেড চিলি” তে তাকে ডিনার খাইয়েছি। সমীরণ তখন এম. এ তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বি. এড পড়ছে আর চাকরি পাওয়ার জন্য জুতোর শুকতলা ক্ষয়িয়ে ফেলছে। আমি ভেবেছি ওর চাকরির জন্যে কোন মুরুব্বিকে ধরব‌ো। এখন আমার পরিচিতির সার্কেল হাইফাই। দরকার হয়নি , আমি তখন টেস্ট খেলছি ব্যাঙ্গালোরে। রাত আটটায় আমার মোবাইলে ফোন “অর্ক আমি একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি। ভাগ্যিস বি. এড টা কমপ্লিট করেছিলাম।” আমি শ্রী অর্ক রায় সমীরণকে অভিনন্দন জানিয়েছি। রাতে ঘুম আসার আগে রবি ঠাকুরের গানটা মনে পড়েছে, “প্রান ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে ম‌োরে আরো আরো আরো দাও প্রান। তব ভুবনে, তব ভবনে মোরে আরো আরো আরো দাও স্হান। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নয় অর্ক সমীরণকে এই গানটা ডেডিকেট করে। এ এক আশ্চর্য টান!
দুবছর বাদে সমীরণের সংগে আমার চাক্ষুষ সাক্ষাৎ। চুপিচুপি এসেছি ওর বাড়ি। তখন ক্রিকেটে আমার নাম দেশ-বিদেশের ক্রীড়ামোদীদের কাছে খুব আদরনীয় এক নাম। সিকিউরিটি নিইনি, ড্রাইভারও নয়। আজ এসেছি আমি সমীরণ‌ের মা-বাবার একসাথে মৃত্যুর খবর পেয়ে। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাঙালির কাছে পুরী রথ দেখা কলা বেচার মতো… জগন্নাথ ও সমুদ্র দর্শন একত্রে। ফিরতি পথে বাস উল্টেছে। জখম অল্প বেশি সকলে। শুধু সমীরণ‌ের মা-বাবার নাম নিহতের তালিকায়। সমীরণ কে ফোন করে বডি আইডেন্টিফিকেশন করতে বলা হয়েছে কটক থানা থেকে। কটকেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। সমীরণ থানায় গেছে। নিজে শিওর হয়েছে ও পুলিশ কে জানিয়েছে বডি তার মা-বাবার। কটকের শ্মশানে পাশাপাশি দুটো চুল্লিতে সমীরণের জীবনের দুই প্রিয় মানুষের নশ্বর দ‌েহ ভস্মীভূত হয়েছে সমীরণকে খুব একলা করে দিয়ে। সমীরণ বিয়ে করেনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। তার থেকে বলা ভালো মা-বাবার সংগে বৌয়ের অবনিবনা হবার ভয়ে। বিয়ে আমিও করিনি। বহু সেলিব্রিটি নায়িকা, ফ্যাশন জগতের মেয়েদের সংগে বা বড়ো বিজনেস ম্যানদের মেয়েদের সাথে ফস্টিনস্টি করেছি একটা সীমারেখা বজায় রেখে। তবু এ নিয়ে ইয়েলো জার্নালিজম হয়েছে। ক্রেডিটে আমার অনেক স্ক্যান্ডাল জমা পড়েছে। কেয়ার করিনি। সেলিব্রিটিদের কাছে এগুলো মুকুটে গোঁজা কৃতিত্বের অনুষঙ্গের এক, একটা পালক বিশেষ। সুতরাং বিয়েতে আমারও অনীহা।
বর্ষার বৃষ্টি অঝোরে পড়ছে সারাদিন ধরে। থামা-কমার নামগন্ধ নেই। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আমি আজ এসেছি সমীরণের বাড়িতে। মব এ্যারেস্টেড্ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সমীরণের অঙ্গে কাছা। খাপছাড়া ভাবে সে আমায় আজ কিছু কথা বলে, যা জুড়ে আমি সমীরণের বক্তব্য সম্পর্কে কিছু আভাস পাই । নিজের মতো সাজিয়ে নিয়ে সমীরণের বলতে চাওয়া কথা গুলো আমি আপনাদের বলছি। মা-বাবা দুজনকেই একসাথে হারানো সমীরণকে আপনারা দোষ দেবেন না। ওর মানসিক স্হিতি এ‌খন খুব নড়বড়ে। আমি সমীরণের বকলমে যা বলবো, তাতে অসংগতি বা অগোছালো ভাব থাকবে না। কারণ আমি সমীরণের বন্ধু মাত্র। তার মা-বাবা যাওয়াতে দুঃখ পেয়েছি খুবই কিন্তু সমীরণের মতো ভেঙ্গে পড়িনি। সমীরণের মা-বাবা আমার পাড়ার কাকু-কাকীমা, মা-বাবা তো নয়।
সমীরণ ফিরে গিয়েছিল আমাদের সেই ছেলেবেলায়। বলেছে, আমার মনে আছে কিনা, যে সে খেলতে যেত না মাঠে আমার হাজার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও। খুব মনে আছে আমার। ভীষণ রাগ লাগতো আমার মানে শ্রীমান অর্ক রায়ের, সে কথাটাও ভুলিনি। তা’ সত্ত্বেও সমীরণের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণের কথা ভুলিনি। যেচে যেচে ওদের বাড়ি যেতাম। মনে পড়ে আমি গেলে সমীরণের মা কেমন ভাবে স্নেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন আমার দিকে। থালা ভর্তি খাবার এনে এক থালা থেকে খাইয়ে দিতেন আমাদের দুজনকে। আমাদের তখন নিজের হাতে খাওয়ার সুযোগ কই? ততক্ষণে হয়তো সমীরণের পুট পড়লে আমার পাকা ঘুঁটি কেঁচে যাবে। নয়তো সমীরণের ছক্কা আর দুই পড়লে শেষ ঘুঁটি ঘরে উঠে যাবে। সমীরণ জিতে যাবে। দারুণ টেনশনের মুহূর্ত। আর তাছাড়া সমীরণের মায়ের হাতে খেতে আমার ভালো লাগতো। সমীরণ আর আমি গল্প করছি, নিজের হাতে খেতে কোন বাধা নেই। তবুও কাকীমার কাছে আবদার করেছি, খাইয়ে দেয়ার জন্যে। কাকীমার চোখে জল। মানে বুঝতে পারি নি কেন? কারণও জিজ্ঞেস করা হয় নি। ভেবেছি আনন্দাশ্রু। কাকীমা খুব নরম-সরম। আমার মায়ের মতো স্ট্রিক্ট ছিলেন না। সমীরণের বাবা সবসময় বাড়ি থাকতেন না। আমি যখন সমীরণদের বাড়ি যেতাম অফিস থেকে ফেরার সময় তখনও কাকুর হতো না। কিন্তু ছুটির দিন আমাদের দুজনকে পাশে বসিয়ে দেশ-বিদেশের নানা গল্প বলতেন। কি আকর্ষণীয় বলার ভঙ্গি! আমরা দুই বন্ধু গালে হাত দিয়ে শুনতাম। আমার বাবা মস্ত অফিসার। অফিসের পর মিটিং, ক্লাব – পার্টি। রবিবারও তিনি ব্যস্ত। নিজের ছেলেকে দেবার মতো সময় তার রবিবারের সিডিউলেও থাকতে নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সমীরণের বাড়ির আকর্ষণ আমার কাছে অপ্রতিরোধ্য। আজ সমীরণের কাছে জানতে পারলাম, সে জাতিস্মর। পূর্ব জন্মের কথা তার জ্ঞান হওয়া অবধি মনে আছে। আর এই কথা লোকজানাজানি যাতে নাহয়, তার জন্যেই কাকু-কাকীমা সমীরণকে বেরোতে দিতেন না। বিস্ময়কর বটে সমীরণের কথাটা। বিশ্বাস – অবিশ্বাসের দোলায় দুলি আমি। সমীরণ বুঝতে পারে আমি ওর গল্পটা ঠিক মতো হজম করতে পারছি না। জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মারে, ” বৃষ্টির তোড়টা একটু কমেছে। রাত অনেক। রাস্তাও শুনশান। তোকে ঘিরে ধরার লোকজন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে। যাবি নাকি আমার সংগে একটা জায়গায়?” সমীরণ ভুল বলেনি রাজি হয়ে যাই। সমীরণ ড্রয়ারে রাখা চাবির গোছা তুলে হাতে নেয়। কাছাধারীর পকেট কোথায়? আমি পকেট হাতড়িয়ে গাড়ির চাবি বার করে নিই।
নিশুতি রাত চিরে গাড়ি এগিয়ে চলে। চালক আমি, পথ নির্দেশক সমীরণ। পথটা মনে হয় আমাদের ডায়মন্ড হারবারের দিকে নিয়ে চলেছে। আবার বৃষ্টি় তোড়ে এসেছে। ওয়াইপার চলছে। তবু দৃশ্যমানতায় অসুবিধা হচ্ছে। আমরা চুপচাপ। তবুও আমি দু-একটা কথা বলতে গিয়েছিলাম। অদ্ভুত গলায় সমীরণ বলেছে চুপচাপ সাবধানে গাড়ি চালা, এ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। আমি সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, মুখের রেখা গুলো কেমন অচেনা। তবুও বলি, “ডেস্টিনেশনটা কিন্তু এখনো জানাস নি।” ছোট্ট উত্তর এসেছে, ” ডায়মন্ড হারবারের দেউলা স্টেশন। গ্রামের নাম দিশাগড়।” দিশেহারা আমি বলি, ” রাস্তা চিনি না।” সমীরণ বলে, “ডিরেকশন দেয়ার দায়িত্ব আমার।” আমি আর কিছু বলি না। চুপচাপ স্টিয়ারিং এর নিয়ন্ত্রণ করি।
সমীরণের নির্দেশক্রমে দেউলা স্টেশনে পৌঁছে গ্রামের পথ ধরেছি। রাস্তা একদম ভালো নয়. বৃষ্টি থেমেছে। তবে সারা রাস্তা কাদায়-কাদা। বৃষ্টি থামা আকাশে কাস্তে চাঁদের উঁকি ঝুঁকি। নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ। অন্ধকারে জোনাকের আলোর মিটিমিটি ফোকাস , ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক.. আমার নেশা ধরায়। অথচ সমীরণের বাড়ি আসবো বলে দামী মদে অভ্যস্ত আমার পেটে আজ একফোঁটা এ্যালকোহল নেই। আমার নেশা চটকে দেয় সমীরণ… ” অর্ক গাড়ি থামা। এসে গেছি আমরা আমাদের বাড়িতে। যন্ত্র – গাড়ি যান্ত্রিক আওয়াজ করে থেমে যায়। গাড়ি থেকে নেমে দেখি জীর্ণ বাড়ি। রঙ-পলেস্তারা অনেকদিন পড়ে নি। তবুও একেবারে বসবাসের অযোগ্য নয়। সমীরণ কখন যে একটা চার ব্যাটারির টর্চ সংগে নিয়েছিল, খেয়াল করিনি। টর্চের জোরালো আলোয় অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা বাড়ির সদর-দরজার সামনে। আগে হয়ত এই পথের ধারে কেয়ারী করা বাগান ছিল, হয়তো ছিল না। নিছক আমার কল্পনা। তবে এখন যে এই জায়গায় আগাছা থরে থরে গজিয়ে রয়েছে, সেটা বাস্তব। সমীরণকে কিছু জিজ্ঞেস করবে, ইচ্ছে করছে না। সে যেন এখন একটা ভূতগ্রস্ত জীব। সমীরণ চাবির গোছা থেকে সঠিক চাবি বেছে নিয়ে ঢোকায় তালার গর্তে। তালা খুলে যায়। ওরা ভেতরে ঢোকে। বাড়ির মেঝে মার্বেলের ঝাঁট-মোছ না পড়ার দরুন ধূলিকণায় মলিন। নীচের সব ঘর বন্ধ. সমীরণ সেদিকে যায় না। বিশাল মার্বেলের সিঁড়ির ধাপ গুলো পেরোতে থাকে সে। পেছনে নিশি পাওয়া মানুষের মতো আমি তাকে অনুসরণ করি.
দোতলার ঘরের তালা খোলা হয়। আমি আর সমীরণ ঘরের মধ্যে। আমি দেখি জমিদার বা ভীষণ অবস্থাপন্ন দের বিশাল শয়ন- কক্ষ। মেহগিনী কাঠের পালঙ্ক। বার্মা টিকের নানা ফার্নিচার, বেলজিয়াম কাঁচের আয়না বসানো আলমারি। ঘরের মাঝে একটা গোল শ্বেত-শুভ্র টেবিল। চারপাশে লালটুকটুকে ভেলভেটের চেয়ার। একপাশের দেওয়াল আলমারিতে কাঁচের পুতুল, আরেকটা দিকের দেয়াল- আলমারিতে দেশ বিদেশের নানা বই। আমি যেন সাপুড়ের বীণ শোনা মন্ত্রমুগ্ধ এক সাপ। নিজের অজান্তেই মন আমার হেলছে দুলছে. দেয়ালে টাঙানো বিদেশী ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার চোখ আটকায় একটা সাদা-কালো ছবিতে. একি, এ তো সমীরণের মা-বাবার ছবি। এতো বড়ো ছবি, তা’ও চোখে পড়েনি। ফোটোগ্রাফ থেকে গোড়ের ঝুঁইের মালা ঝুলছে। এই ঘরে ঢুকে আমি পুরোনো ভ্যাপসা ঘরের গন্ধ পাই নি। উল্টে একটা ভালো গন্ধ পাচ্ছিলাম। মনে মনে তখন আমি ধরে নিয়েছি, এটা সমীরণদের বাড়ি। সংগে সংগে প্রশ্ন জেগেছে মনে,যাদের এতো ভালো অবস্থা,.. কলকাতায় তারা কেন অতো সাধারণ ভাবে থাকতো? এখন আমরা বড়ো হয়ে গেছি। একথা ছোট বেলার জিগরি – দোস্তকেও জিজ্ঞেস করা যায় না। কিছু ভাবতে পারে। ছোটবেলায় অনেক কিছু বলা যায়, অনেক কিছু করা যায়। পরিনত বয়েসে সম্পর্কের সমীকরণ সরলপথে হাঁটে না। তাই শুধু জিজ্ঞেস করি সমীরণকে , ” কাকু-কাকীমার ফোটোগ্রাফে মালাটা কোথা থেকে এলো রে? ” সমীরণের উদাস উত্তর, “জানি না”। অবাক হই, সমীরণ কোন মালা যে আনেনি আমি শিওর। সমীরণ নিয়ে যায় পরবর্তী ঘরে। ঘরের ফার্নিচার গুলো বলে, এটা কোন বাচ্চার ঘর। সুন্দর খাটের বিছানায় দুজনের পাশাপাশি শোওয়ার সরন্জাম বলে, একজন নয়, দুজন বাচ্চার ঘর। বইপত্র, খেলনার সংগে ঘরের এককোণে দাঁড়ানো ক্রিকেট ব্যাট রয়েছে। একটা ফুটবল খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আমার পায়ে ধাক্কা মারে। সমীরণ আমাকে দেখে যাচ্ছে। আমি ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছি পড়ার টেবিলে রাখা আরো একটা ফটোগ্রাফ….. সমীরণ আর আমার। সমবয়সী দুটো ছেলের ছবি। জিজ্ঞাসু আমার চোখে এমন কিছু ছিল, যার উত্তর দিতে সমীরণ বাধ্য হয়েছিল।

সমীরণ জানিয়ে ছিল সমীরণ, কাকু, কাকীমা তিনজনেই পূর্ব স্মৃতি নিয়ে জন্মেছিল। বাদ ছিলাম খালি আমি। অথচ একই পাড়ায় আমার জন্ম। পূর্বজন্মের দুই যমজ ভাই এই জন্মে সমবয়সী দুই বন্ধু। আমি সমীরণের কথা বিশ্বাস করেছি। আমার মনে পড়েছে কাকীমার মাতৃ-স্নেহ, কাকুর পিতৃসুলভ আচরণ। ছেলের বন্ধু কে অনেকেই ছেলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু কাকু-কাকীমার ভালোবাসায় অরিজিনাল কিছু ছিল, ছিল রক্তের টান। আর সমীরণের সংগে তো শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, আত্মার সম্পর্ক একই বৃন্তে ফোটা দুটি কুসুমের মতো। সমীরণকে বলি,” চল, এবার আমরা এগোই.”
আবার আমি চালক। পথ চিনে গেছি, সব কিছু জেনে গেছি। সমীরণের নির্দেশক বা কথকের ভূমিকা শেষ। সমীরণ চুপচাপ। আমার মনে দিশের গড়,… আমার পূর্ব জীবন, পূর্ব জীবনের বাড়ি তোলপাড় তুলেছে। আমি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। গাড়ি উল্টেছে নয়ানজুলিতে। আশেপাশের লোকজন আমায় কষ্ট করে বার করেছে গাড়ি থেকে। আমার কিচ্ছু হয়নি। একটুও কাটেনি-ছড়েনি পর্যন্ত। আশ্চর্যের বিষয়, সমীরণ নেই। জমায়েত জনতা বলেছে আর কেউ ছিল না গাড়িতে। তাদের চোখের সামনেই তো ঘটনাটা ঘটেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করি সমীরণ নয়ানজুলির ধারে দাঁড়িয়ে বলছে, ” অর্ক, আমিও আর বেঁচে নেই রে। দেড় বছর আগে ডেঙ্গি আমায় নিয়ে গেছে। শুধু তোকে প্রকৃত ঘটনা জানাব বলে প্রতীক্ষা করছিলাম তোর দেশে ফেরার। ফিরে যা অর্ক, তোর নিজস্ব জগতে। অতীতের মাঝে বাসের কষ্ট আমরা তিনজন জানি। তবে তোর আমাদের প্রতি আকর্ষনের কারণটা তোর জানা দরকার ছিল। চলি রে। সমীরণ মিলিয়ে যায়। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অন্য কেউ সমীরণকে দেখে নি, আমাদের কথোপকথন শোনে নি। গাড়ি স্টার্ট করি। সেদিন নিরাপদে পৌঁছে যাই আমার এ জন্মের আস্তানায়।
আমি কাছাধারণ করেছি আমার এ জন্মের মা-বাবা জীবিত থাকা সত্ত্বেও। প্রশ্নের বাণ ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এসেছে। আমার এ জন্মের মা কেঁদেছে। বাবা মুখ গম্ভীর করে ঘুরেছে। সমীরণের কাছ থেকে আমার পূর্বজন্মের পরিচয় পাওয়ার ঠিক দশদিনের মাথায় ঘটাপটা করে আমার পূর্বজন্মের তিন আত্মজনের শ্রাদ্ধাদি কার্য করেছি। নিমন্ত্রিতদের কৌতুহল সেদিন নিবারণ করেছি,… “আমার পূর্বজন্মের শেষ ঋণ চোকাচ্ছি।”
সমীরণ তোর শেষ কথা রাখতে পারিনি। ডুপ্লিকেট চাবি করিয়ে যখনই দেশে থাকি দিশেরগড়ের বাড়িতে যাই অতীতের সংগে কথা কই। জানি না তোরা শুনতে পাস কিনা, নাকি তোদের পুনর্জন্ম হয়ে গেছে?

Share This