Categories
গল্প

পুজোর আলোয় বাঁধা স্মৃতি।

কলকাতার সরু গলির এক প্রান্তে, ছোট্ট একটি আবাসিক এলাকা। সেপ্টেম্বরের শেষের দিনগুলো ছিল, আর বাতাসে যেন পুজোর ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছিল। এই বাঙালি মহল্লার প্রতিটি কোণায় হালকা আলো, আর ফুলের সাজ। সকলের মুখে যেন অপেক্ষার আনন্দ; কারোর চোখে উৎসাহ, কারোর চোখে নস্টালজিয়া।

রেখা, এক চাকুরিজীবী মহিলা, দীর্ঘদিন ধরে শহরে একা থাকলেও পুজোর সময় তাঁর মন যেন অন্যরকম হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে মা ও দিদিমার সঙ্গে যে দূর্গা পুজোতে আনন্দ করত, সেই স্মৃতি এখনও জীবন্ত। এবার সে ঠিক করেছিল—নিজেই ছোট্ট হলেও পুজোর মেজাজ ঘরে তৈরি করবে।

সপ্তাহব্যাপী পরিকল্পনা, বাজার ঘুরে সামগ্রী সংগ্রহ, ফুল, আলো, বেলুন—সবকিছু। এক সন্ধ্যায়, প্রতিটি দীপ আর বাতির আলো মিলিয়ে রুমটি যেন সোনালি হয়ে উঠল। রেখা দেখল, সে যতই ব্যস্ত থাকে, এই ছোট্ট পুজোই তার মনকে শান্তি দিচ্ছে।

পরদিন, মহল্লার বাচ্চারা এবং প্রতিবেশীরা তার ঘরে আসতে শুরু করল। সবাই মিলে ঠাকুরমার পূজা—ছোট্ট মণ্ডপ, হাতে মালা, আর ঠাকুরমার সামনে লাল চন্দন আর ফুল। শিশুরা খুশিতে উল্লসিত, কেউ কেউ মুখে মিষ্টি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।

রেখা দেখল, পুজো শুধুই রীতি নয়, এটি মানুষের হৃদয়কে একত্রিত করার একটি সেতু। প্রত্যেকের হাসি, প্রতিটি আলোর ঝলক—সবকিছু যেন বলছে, “এটাই বাঙালির পুজোর আসল রূপ।” সেই সন্ধ্যায়, যখন ঢাকের ঢাকনা বাজছিল এবং বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল ধূপের গন্ধ, রেখার মনে হল, এই ছোট্ট পুজোও বড় আনন্দ দিতে পারে।

পুজো শেষ হলে, সবাই বিদায় নিলো। কিন্তু রেখা জানে, এই স্মৃতিগুলো তার সঙ্গে সারাজীবন থাকবে—প্রতিটি আলোর ঝলক, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি ধূপের গন্ধ। পুজো হয়তো শেষ, কিন্তু তার আনন্দ চিরস্থায়ী।


নিশ্চয়ই! এখানে আমি একটি পূর্ণাঙ্গ, সংক্ষিপ্ত কিন্তু আবেগময় “দূর্গা পুজোর গল্প” তৈরি করলাম:

 

 

 

শিরোনাম: পুজোর আলোয় বাঁধা স্মৃতি

 

কলকাতার সরু গলির এক প্রান্তে, ছোট্ট একটি আবাসিক এলাকা। সেপ্টেম্বরের শেষের দিনগুলো ছিল, আর বাতাসে যেন পুজোর ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছিল। এই বাঙালি মহল্লার প্রতিটি কোণায় হালকা আলো, আর ফুলের সাজ। সকলের মুখে যেন অপেক্ষার আনন্দ; কারোর চোখে উৎসাহ, কারোর চোখে নস্টালজিয়া।

 

রেখা, এক চাকুরিজীবী মহিলা, দীর্ঘদিন ধরে শহরে একা থাকলেও পুজোর সময় তাঁর মন যেন অন্যরকম হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে মা ও দিদিমার সঙ্গে যে দূর্গা পুজোতে আনন্দ করত, সেই স্মৃতি এখনও জীবন্ত। এবার সে ঠিক করেছিল—নিজেই ছোট্ট হলেও পুজোর মেজাজ ঘরে তৈরি করবে।

 

সপ্তাহব্যাপী পরিকল্পনা, বাজার ঘুরে সামগ্রী সংগ্রহ, ফুল, আলো, বেলুন—সবকিছু। এক সন্ধ্যায়, প্রতিটি দীপ আর বাতির আলো মিলিয়ে রুমটি যেন সোনালি হয়ে উঠল। রেখা দেখল, সে যতই ব্যস্ত থাকে, এই ছোট্ট পুজোই তার মনকে শান্তি দিচ্ছে।

 

পরদিন, মহল্লার বাচ্চারা এবং প্রতিবেশীরা তার ঘরে আসতে শুরু করল। সবাই মিলে ঠাকুরমার পূজা—ছোট্ট মণ্ডপ, হাতে মালা, আর ঠাকুরমার সামনে লাল চন্দন আর ফুল। শিশুরা খুশিতে উল্লসিত, কেউ কেউ মুখে মিষ্টি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।

 

রেখা দেখল, পুজো শুধুই রীতি নয়, এটি মানুষের হৃদয়কে একত্রিত করার একটি সেতু। প্রত্যেকের হাসি, প্রতিটি আলোর ঝলক—সবকিছু যেন বলছে, “এটাই বাঙালির পুজোর আসল রূপ।” সেই সন্ধ্যায়, যখন ঢাকের ঢাকনা বাজছিল এবং বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল ধূপের গন্ধ, রেখার মনে হল, এই ছোট্ট পুজোও বড় আনন্দ দিতে পারে।

 

পুজো শেষ হলে, সবাই বিদায় নিলো। কিন্তু রেখা জানে, এই স্মৃতিগুলো তার সঙ্গে সারাজীবন থাকবে—প্রতিটি আলোর ঝলক, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি ধূপের গন্ধ। পুজো হয়তো শেষ, কিন্তু তার আনন্দ চিরস্থায়ী।

Share This
Categories
গল্প

শেষ চিঠির অপেক্ষা।

একটি দীর্ঘ, আবেগঘন ও রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প লিখছি। গল্পে থাকবে সম্পর্কের গভীরতা, আবেগ, দ্বন্দ্ব, ভুল বোঝাবুঝি, বিচ্ছেদ এবং পুনর্মিলনের স্বাদ—যাতে এটি পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে রাখে।


❤️ “শেষ চিঠির অপেক্ষা”

(একটি ৫০০০ শব্দের ভালোবাসার গল্প)


অধ্যায় ১: প্রথম দেখা

শীতের এক বিকেল। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের ভিড় জমজমাট রাস্তা।
অর্পিতা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে ফিরছিল। বইয়ের গন্ধ, গলির চায়ের দোকান, আর পাশের বইয়ের দোকানের ডাকাডাকি—সব মিলে এক অন্যরকম পরিবেশ।

হঠাৎ করেই এক ধাক্কা। তার হাত থেকে বইগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল।
“সরি, আমি দেখিনি!”—একটা কণ্ঠস্বর।

অর্পিতা তাকিয়ে দেখল, লম্বা, হাসিখুশি এক যুবক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে সোয়েটার।
সে তাড়াতাড়ি বইগুলো তুলে দিয়ে বলল—
“আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। আমি সমীর।”

অর্পিতা কিছুটা রেগে ছিল, কিন্তু ছেলেটির আন্তরিক হাসি দেখে রাগ গলে গেল।

সেদিনের দেখা যেন তাদের জীবনের গল্পের প্রথম পৃষ্ঠা।


অধ্যায় ২: বন্ধুত্বের শুরু

সমীর ও অর্পিতার দেখা হতে লাগল বারবার। কখনও কলেজ স্ট্রিটে, কখনও কফি হাউসে।
তাদের আলোচনার বিষয় বই, সিনেমা, সঙ্গীত, স্বপ্ন।

একদিন সমীর হেসে বলল—
“তুমি জানো, তুমি একদম সত্যজিৎ রায়ের ছবির নায়িকা মতো।”
অর্পিতা লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হল। তারা একসাথে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করল—ছোট্ট একটা বাড়ি, অনেক বই, রবিবার সকালে একসাথে চা খাওয়া।


অধ্যায় ৩: প্রেমের প্রথম স্বাদ

ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে গঙ্গার ধারে তারা দুজনে হাঁটছিল।
হাওয়া ঠাণ্ডা, সূর্যাস্তের আলো গঙ্গার জলে লেগে সোনালি রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

সমীর হঠাৎ অর্পিতার হাত ধরল।
“অর্পিতা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

অর্পিতার চোখে জল চলে এলো।
“আমিও সমীর। আমি অনেকদিন ধরে বলতে চেয়েছিলাম।”

সেই মুহূর্তে মনে হল, পৃথিবী থমকে গেছে। শুধু তারা দুজন, আর চারপাশে গঙ্গার ঢেউ।


অধ্যায় ৪: জীবনের বাস্তবতা

কিন্তু ভালোবাসা যত সুন্দর, জীবনের বাস্তবতা তত কঠিন।
সমীর মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অর্পিতার বাবা-মা চায় সে বিদেশে উচ্চশিক্ষা করুক।

অর্পিতা দ্বিধায় পড়ল—
সে কি প্রেম বেছে নেবে, নাকি স্বপ্ন?
সে কি সমীরকে অপেক্ষা করাবে, নাকি একসাথে ভবিষ্যত গড়বে?


অধ্যায় ৫: দূরত্বের সূচনা

অর্পিতা বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
এয়ারপোর্টে বিদায়ের সময় সমীর চিঠি দিয়ে বলল—
“যখন একা লাগবে, পড়বে। আমি অপেক্ষা করব।”

অর্পিতা কান্না আটকাতে পারল না।
বিমানের জানালা দিয়ে সমীরকে ছোট হতে হতে হারিয়ে যেতে দেখল।


অধ্যায় ৬: অপেক্ষার দিনগুলো

সমীর প্রতিদিন অর্পিতাকে চিঠি লিখত।
প্রথম কয়েক মাস অর্পিতা নিয়মিত উত্তর দিত।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উত্তর কমতে লাগল।

অর্পিতা নতুন শহর, নতুন জীবন, নতুন বন্ধুদের মাঝে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সমীর একা শহরে তার চিঠির অপেক্ষা করত।


অধ্যায় ৭: ভুল বোঝাবুঝি

একদিন সমীর শুনল অর্পিতা একজন সহপাঠীর সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছে।
তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধল।

সে একটি রাগী চিঠি লিখে ফেলল—
“তুমি যদি আমাকে ভুলে গিয়ে থাকো, তাহলে বলো। আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।”

অর্পিতা চিঠি পেয়ে কষ্ট পেল।
সে কিছুদিন চুপ করে রইল। এই নীরবতা তাদের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিল।


অধ্যায় ৮: বিচ্ছেদ

অবশেষে অর্পিতা লিখল—
“সমীর, হয়তো আমাদের সময় শেষ। আমি এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত। তুমি তোমার জীবনে এগিয়ে যাও।”

সমীর ভেঙে পড়ল। তার পৃথিবী যেন থেমে গেল।
সে লেখা বন্ধ করে দিল।


অধ্যায় ৯: সময়ের নিরাময়

বছর কেটে গেল।
সমীর চাকরি পেল, শহর বদলাল।
অর্পিতা বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরল।

একদিন কলেজ স্ট্রিটের সেই পুরোনো বইয়ের দোকানে তারা হঠাৎ মুখোমুখি হল।
চোখে চোখ পড়তেই যেন পুরোনো সব স্মৃতি ফিরে এল।


অধ্যায় ১০: শেষ চিঠির অপেক্ষা

অর্পিতা ধীরে ধীরে বলল—
“সমীর, আমি তোমার লেখা চিঠিগুলো সব রেখেছি।”
সমীর তাকাল—”তাহলে তুমি কখনও আমাকে ভুলোনি?”
অর্পিতা চোখের জল মুছল—
“না সমীর। আমি শুধু সময় চেয়েছিলাম। আজ আমি প্রস্তুত। তুমি কি এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছ?”

সমীর মুচকি হাসল—
“আমি আজও সেই শেষ চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম।”

তারা আবার একসাথে হাঁটল।
গঙ্গার ধারে সূর্যাস্তের আলোতে যেন তাদের প্রেম আবার নতুন করে জন্ম নিল।


সমাপ্তি

গল্পটি আমাদের শেখায়—ভালোবাসা সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকতে পারে, যদি দুজনেই একে অপরকে সময় দেয় এবং অপেক্ষা করতে জানে।

 

Share This
Categories
গল্প

অন্ধকারে লুকানো সত্য (রহস্য গল্প)।

(একটি পূর্ণাঙ্গ রহস্য গল্প)

১. প্রথম সতর্কবার্তা

পার্থ মুখার্জি কলকাতার এক পুরোনো বাড়িতে একা থাকে। বাড়িটা তার ঠাকুরদার সময়ের, প্রায় একশো বছরের পুরোনো। সেদিন সকালে ডাকবাক্স খুলতেই সে দেখতে পেল একটি হলুদ খামের চিঠি। খামের উপর কাঁপা হাতের লেখা —
“আজ রাত বারোটার আগে বাড়ির ঘড়ি থামিয়ে দিও। না হলে বিপদ আসবে।”

চিঠি পড়ে পার্থর শরীরে কাঁটা দিল। কে লিখল এই চিঠি? কেন লিখল? সে জানে তার বাড়ির দোতলায় ঝোলানো ঘড়িটা অনেক বছর ধরে বন্ধ।

দিনভর তার মাথায় এই রহস্য ঘুরপাক খেতে লাগল। সন্ধ্যা নামতেই বাড়ির ভিতর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। পার্থ বারবার সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ছে।

২. অদ্ভুত শব্দ

রাত বাড়তে থাকল। ঠিক ১১টা নাগাদ হঠাৎ দোতলার দিক থেকে টিক-টিক শব্দ শোনা গেল।
পার্থ থমকে দাঁড়াল।
— “অসম্ভব! ওই ঘড়ি তো নষ্ট…”

টর্চ হাতে নিয়ে দোতলায় উঠতেই তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করেছে।

ঘড়ির কাচের ভেতরে তার নিজের মুখ দেখল, কিন্তু মনে হল আরেকটি ছায়া দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। টর্চের আলো ফেলতেই ছায়া মিলিয়ে গেল।

৩. দেয়ালের পেছনের ঘর

ঠিক তখনই দেয়ালের পেছন থেকে ফাঁপা শব্দ এল। পার্থ টর্চ দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে দেয়ালের একটা অংশ ঠুকল। হঠাৎ একটা গোপন দরজা খুলে গেল। ভেতরে ছোট্ট একটা ঘর, ধুলো জমে আছে, কিন্তু সেখানে রাখা একটি টেবিলের উপর পুরোনো ডায়েরি আর কিছু দলিল।

ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা —
“আমি এই বাড়ির আগের মালিক অমরেশ মুখার্জি। আমাকে আমার আপন ভাই খুন করেছে এই বাড়ির সম্পত্তির জন্য। আমার দেহ এই ঘরের মেঝের তলায় লুকানো আছে। আমার আত্মা মুক্তি চাই।”

পার্থর গলা শুকিয়ে গেল। সে সাথে সাথে পুলিশের খবর দিল।

৪. তদন্ত শুরু

পরের দিন সকালেই ইন্সপেক্টর সুদীপ সরকার এলেন। অভিজ্ঞ অফিসার, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
— “আপনি বলছেন ঘড়ি নিজে থেকে চলতে শুরু করেছে?”
পার্থ মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ স্যার, আর এই ডায়েরিটা পেয়েছি।”

দলিল আর ডায়েরি দেখে সুদীপ গম্ভীর হলেন।
— “আমরা ঘরের মেঝে খুঁড়ব। যদি হাড়গোড় পাওয়া যায় তবে এটা খুনের মামলা।”

মেঝে খুঁড়তেই সত্যিই একটি কঙ্কাল পাওয়া গেল। বাড়ি হইচই পড়ে গেল। খবর ছড়িয়ে পড়ল পাড়ায়।

৫. অতিপ্রাকৃত ইঙ্গিত

সেই রাতে পার্থ আবার সেই ছায়া দেখল। এবার ছায়াটি তাকে হাতের ইশারায় অন্য ঘরের দিকে ডাকল। পার্থ ভয় পেলেও সাহস করে গেল। সেখানে একটি ছোট কাঠের বাক্স পেল। বাক্সের ভিতরে পুরোনো নথি আর একটি রুপোর চেইন।

পরদিন ইন্সপেক্টরকে বাক্সটি দেখানো হল। নথির মধ্যে ছিল বাড়ির পুরোনো দলিল, যেখানে দেখা গেল অমরেশ মুখার্জির মৃত্যুর পর সম্পত্তি বেআইনি ভাবে তার ভাই অর্জুন মুখার্জির নামে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সুদীপ বললেন,
— “এখন স্পষ্ট, অর্জুন খুন করেছে। কিন্তু সে তো বহু বছর আগে মারা গেছে। খুনের পেছনে আর কেউ ছিল কি?”

৬. নতুন সন্দেহভাজন

তদন্তে জানা গেল অর্জুনের নাতি রাজীব মুখার্জি সম্প্রতি বাড়ির দখল নিতে চেয়েছিল। পার্থর কাছে চিঠি লিখে বাড়ি ছাড়ার হুমকিও দিয়েছিল।

পার্থ মনে পড়ল— সেই চিঠির হাতের লেখা! চিঠি আর রাজীবের পুরোনো স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখতেই বোঝা গেল দুটোই এক।

সুদীপ পুলিশ টিম নিয়ে রাজীবকে গ্রেপ্তার করল। রাজীব স্বীকার করল যে সে জানত তার দাদু অমরেশকে খুন করেছে। সে এই সত্যিটা চিরতরে গোপন রাখতে চেয়েছিল, তাই পার্থকে ভয় দেখাতে চিঠি লিখেছিল।

৭. চূড়ান্ত মুখোমুখি

রাজীবকে নিয়ে বাড়িতে পুনর্নির্মাণ চলছিল। ঠিক তখনই ঘড়ি আবার বাজতে শুরু করল। হঠাৎ জানলা বন্ধ হয়ে গেল, ঘর অন্ধকার। সবাই দেখল এক ফ্যাকাশে ছায়ামূর্তি রাজীবের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজীব চিৎকার করে উঠল,
— “আমার দোষ নেই! আমি খুন করিনি!”

ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটায় থেমে গেল। যেন আত্মা শান্তি পেল।

৮. ন্যায়বিচার

রাজীবকে আদালতে তোলা হল। ডায়েরি, দলিল আর পার্থর সাক্ষ্য মিলে মামলায় প্রমাণ হল অমরেশকে খুন করেছিল অর্জুন। আদালত পার্থর নামে বাড়ির সম্পত্তির অধিকার ফিরিয়ে দিল।

ইন্সপেক্টর সুদীপ পার্থকে বললেন,
— “আপনি কেবল বাড়ির মালিক নন, আপনি ইতিহাসের সাক্ষী। আপনি যদি সাহস না করতেন, অমরেশ মুখার্জির আত্মা আজও শান্তি পেত না।”

৯. সমাপ্তি

রাতের আকাশে পূর্ণিমার আলো ঝলমল করছে। পার্থ দোতলায় দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ি থেমে আছে, কিন্তু বাড়ি আর অদ্ভুত নয়। যেন শান্তি ফিরে এসেছে।

পার্থ ভাবল,
— “এই বাড়ি শুধু আমার নয়। এখানে এক ইতিহাস আছে, এক রক্তাক্ত অতীত আছে। এখন আমি সেই অতীতের রক্ষক।”

সে টেবিলে ডায়েরিটা রাখল, যেন ভবিষ্যতের জন্য প্রমাণ হয়ে থাকে। বাইরে হাওয়ায় যেন একটুখানি ধন্যবাদসূচক ফিসফিসানি শুনল।

 

Share This
Categories
গল্প

শেষ ট্রেনের অপেক্ষা।

১. শুরুটা – এক ট্রেনস্টেশনের গল্প

রাত তখন প্রায় দশটা। শহরের শেষ ট্রেন ধরার জন্য ভিড় কমতে শুরু করেছে। হাওয়া ঠান্ডা, রেললাইনের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ধরনের বিষণ্ণ নীরবতা।
স্টেশনের বেঞ্চে বসে আছেন অনির্বাণ—চোখের সামনে কুয়াশা, হাতে এক কাপ চা। মনটা তার আজ বড় খারাপ। অফিসে আবারও প্রোমোশনটা পায়নি, তার ওপরে আজ ছিল বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। দিনভর ব্যস্ততার ভিড়ে মন খারাপটাকে চাপা দিতে পেরেছিল, কিন্তু এই ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে এসে হঠাৎ যেন সবটাই আবার মনে পড়ল।

ঠিক তখনই, পাশের বেঞ্চে বসে পড়ল এক মেয়ের ছায়া।
গায়ে হালকা নীল শাল, হাতে মোবাইল। চুলগুলো খোলা, যেন বাতাসে খেলা করছে। মেয়েটির চোখেমুখে একটা অদ্ভুত শান্তি, অথচ চাহনিতে ছিল গভীর কষ্ট।

অনির্বাণ খানিক তাকিয়ে আবার নিজের চায়ের দিকে মন দিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটিই কথা শুরু করল—
— “মাফ করবেন, শেষ ট্রেনটা ক’টায় আসে জানেন?”

অনির্বাণ একটু চমকে তাকাল।
— “দশটা পঞ্চাশে। তবে আজ ট্রেন লেট হবে শুনলাম।”

মেয়েটি হেসে মাথা নাড়ল।
— “আচ্ছা, ধন্যবাদ।”

এতটুকুই পরিচয়। কিন্তু অনির্বাণের মনে হল, সে মেয়েটির মুখের হাসিটা আবার দেখতে চায়।


২. পরিচয় – কথার সূত্রপাত

ট্রেন লেট হওয়ার কারণে, তারা ধীরে ধীরে কথায় জড়িয়ে গেল।
মেয়েটির নাম ইশানি। সে পাশের শহরে স্কুলশিক্ষিকা। আজ এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল, ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।

অনির্বাণ জানাল, সে এক আইটি কোম্পানিতে কাজ করে, অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে এখানে ট্রেনের অপেক্ষা করছে।

কথার পর কথায় তারা দু’জনের জীবন খুলে গেল যেন—
ইশানি জানাল, সে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার জন্য একাই থেকে এসেছে। বাবা-মা গ্রামে থাকেন। তার জীবনটা সোজাসাপ্টা, কিন্তু কখনও কখনও একাকিত্ব খুব কষ্ট দেয়।
অনির্বাণ বলল, তার মা অনেক বছর আগে মারা গেছেন, বাবার সঙ্গেই বড় হয়েছে। বাবাই তার জীবনের অনুপ্রেরণা ছিলেন।

দুজনেই অনুভব করল—কোনো এক অদ্ভুত মিল আছে তাদের মধ্যে।
যেন দুজনেই একই রকম শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে।


৩. বন্ধুত্ব – অজানা টান

ট্রেন এল, দুজনেই পাশাপাশি বগিতে উঠল।
স্টেশনে পৌঁছে তারা নম্বর বিনিময় করল না। কিন্তু দুজনেরই মনে হল—এটাই কি শেষ দেখা?

কিন্তু ভাগ্যও যেন চুপিচুপি হেসে ছিল।
কয়েকদিন পর অনির্বাণ আবার স্টেশনে ইশানিকে দেখতে পেল।
সেই থেকে তাদের পরিচয় গভীর হতে থাকল। ফোন নম্বরও বিনিময় হল, কখনও একসঙ্গে চা খেল, কখনও বইয়ের দোকানে গেল।

ধীরে ধীরে তারা একে অপরের জীবনের গল্পে ঢুকে গেল।
অনির্বাণের ক্লান্ত সন্ধ্যাগুলোতে ইশানির ফোন যেন আলো হয়ে এল।
ইশানির একাকী রাতগুলোতে অনির্বাণের মেসেজ তাকে হাসিয়ে তুলল।


৪. ভালোবাসা – অব্যক্ত অনুভূতি

এক সন্ধ্যায়, বৃষ্টি পড়ছে ঝরঝর করে।
স্টেশনের ছাদে দাঁড়িয়ে দুজনে ভিজে ভিজে গল্প করছে।
হঠাৎ ইশানি বলল—
— “তুমি কি কখনও কাউকে খুব মিস করো? এমন মিস, যা বুকের ভেতরটা ভারী করে দেয়?”

অনির্বাণ চুপ করে রইল।
তার মনে পড়ল তার বাবা-মা, তার একাকী ঘর।
কিন্তু আজ যেন মনে হল, এই মেয়েটির জন্যও এমন একটা মিস সে বোধ করছে।

— “হ্যাঁ,” ধীরে ধীরে বলল অনির্বাণ।
— “আর সেই মিসটা আজ তোমাকে দেখেই হচ্ছে।”

ইশানি অবাক হয়ে তাকাল, তারপর হেসে ফেলল।
কিন্তু চোখের কোণে ছোট্ট একটা অশ্রুবিন্দু চিকচিক করল।

সেই রাতে বাড়ি ফিরে ইশানি ডায়েরিতে লিখল—
“হয়তো এটাই প্রেম।”


৫. বাঁক – জীবনের পরীক্ষা

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল।
হঠাৎ একদিন ইশানির বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ইশানিকে গ্রামে ফিরে যেতে হল। সে আর শহরে ফিরল না।

অনির্বাণ ফোন করত, কিন্তু ইশানি খুব কম উত্তর দিত।
দুজনের দূরত্ব যেন বাড়তে থাকল।

মাস কেটে গেল।
একদিন হঠাৎ খবর এল—ইশানির বিয়ে ঠিক হয়েছে।

সেদিন রাতে অনির্বাণ স্টেশনে বসে কেঁদে ফেলল।
যে প্ল্যাটফর্মে তাদের প্রথম দেখা, আজ সেইখানেই তার মনে হল সবকিছু ফাঁকা।


৬. সমাপ্তি – শেষ ট্রেনের অপেক্ষা

দিন যায়। ইশানির বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে।
অনির্বাণ চেষ্টা করেও দেখা করতে যায়নি।

বিয়ের আগের রাতে হঠাৎ অনির্বাণ ট্রেনস্টেশনে গেল।
এবারও রাত দশটা বেজে গেছে।
কিন্তু আজও সে মনে মনে চাইল—যেন একবার ইশানিকে দেখতে পায়।

ঠিক তখনই, প্ল্যাটফর্মের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ইশানিকে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
চোখে জল, কিন্তু মুখে এক আশ্চর্য হাসি।

— “আমার বিয়ে হচ্ছে ঠিকই,” বলল ইশানি।
— “কিন্তু জানো, আমি আজ এখানে এসেছি শুধু তোমাকে একবার দেখতে।
তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি।”

অনির্বাণ কিছু বলল না।
শুধু বলল—
— “তুমি সুখে থেকো।”

ট্রেন এল।
ইশানি উঠে গেল বগিতে।
অনির্বাণ তাকিয়ে রইল।
শেষ ট্রেন চলে গেল।

কিন্তু অনির্বাণ জানল—তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা, যদিও হারিয়ে গেল, তবুও তাকে এক অদ্ভুত শান্তি দিয়ে গেল।


গল্পের সারমর্ম

ভালোবাসা সবসময় পেতে হয় না।
কখনও কখনও ভালোবাসা মানে কেবল সেই মানুষটির সুখের প্রার্থনা করা, দূর থেকে হাসিমুখে বিদায় দেওয়া।
অনির্বাণের কাছে ইশানি রয়ে গেল সেই শেষ ট্রেনের মতো—যে ট্রেন হয়তো আর কখনও ধরা যাবে না, কিন্তু যার হুইসেল চিরকাল তার মনে বাজতে থাকবে।

 

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও গণেশ পূজা : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)।

ওঁ নমঃ শ্রী ভগবতে প্রণবায়….!
ওঁ গণ গণপতয়ে নমঃ,…

আমাদের সুন্দর মূল্যবান মনুষ্য জীবনে উৎসবমুখর ভারতবর্ষে পূণ্যভূমি পবিত্রভূমি এই তপভূমিতে জগৎ জননী মায়ের আসার আগেই শ্রী গণপতি বাপ্পা আসেন। সত্য সনাতন ধর্মে যে কোনো শুভকাজের শুরুতে তিনি পূজিত হন এবং সফলতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হন। গণেশ বা গজানন হলেন শিব ও পার্বতীর পুত্র। আগামী শুক্লাচতুর্থী বা গণেশচতুর্থী তিথিতে গণপতি বাপ্পার আগমন ঘটবে সেই *গণেশ পূজা* চলবে দশদিন অনন্ত চতুর্দশী পর্যন্ত। গণেশ বিঘ্ননাশকারী, বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা, শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক, এবং সৃষ্টি ও সৌভাগ্যের প্রতীক। সত্য সনাতন ধর্মে যে কোনো শুভকাজের শুরুতে তিনি পূজিত হন এবং সফলতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হন।

“গণেশ” নামটি গণ ও ঈশ শব্দ দুটির সমষ্টি। গণ শব্দের অর্থ গোষ্ঠী বা সমষ্টি এবং ঈশ শব্দের অর্থ ঈশ্বর বা প্রভু। ভগবান গণেশ এই মহাবিশ্বে শৃঙ্খলা আনেন এবং কোনও নতুন প্রচেষ্টা, বৌদ্ধিক যাত্রা বা ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করার আগে সকলেই তাঁর উপাসনা করেন। তিনি সমস্ত বাধা বিঘ্ন দূরকারী ভগবান হিসাবে পরিচিত। গণেশ উৎসব বা গণেশ চতুর্থী ভগবান গণেশের জন্মোৎসব। তিনি বিঘ্ননাশক, জ্ঞান ও সমৃদ্ধির দেবতা, তিনি মর্ত্যে অবতীর্ণ করে ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। তিনি গণপতি, বিঘ্নেশ্বর, বিনায়ক, গজপতি, একদন্ত ইত্যাদি নামেও পরিচিত। এই উৎসবের মাধ্যমে গণেশের জন্মকে স্মরণ করা হয়। এটি একটি আনন্দময় ও পারিবারিক সামাজিক, সার্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠান। মন্ডপে গণেশের মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা হয় এবং বিভিন্ন ধরনের মোদক ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।

পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী দেবী পার্বতী যখন স্নান করতে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি নিজের শরীর থেকে ঘর্ষণের মাধ্যমে মাটি ও আবর্জনার মিশ্রণ থেকে গণেশকে সৃষ্টি করেন এবং তাকে নিজের বাড়ির পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। গণেশ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন, যখন তার পিতা শিব ঘরে ফিরতে চাইলেন গণেশ তাকে বাধা দেন। ফলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং শিব গণেশকে এমনভাবে আঘাত করেন যে তার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ঘটনার পর দেবী পার্বতী অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন এবং শিবকে গণেশকে পুনরুজ্জীবিত করতে বলেন। তখন শিব তার প্রথম যে প্রাণীটিকে দেখতে পান, তার মাথা কেটে গণেশের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। আর সেই প্রাণীটি ছিল একটি হাতি। তাই তিনি গজানন।

ভারতবর্ষে ১৮৯৩ সালে ব্যাপকভাবে গণেশ উৎসব বা গণপতি উৎসবের প্রচলন করেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী লোকমান্য তিলক বা বাল গঙ্গাধর তিলক। তিনি এই উৎসবকে জনগণের মধ্যে ঐক্যের প্রচার এবং জাতীয়তাবাদের ধারণা কে উজ্জীবিত করার জন্য শুভারম্ভ করেন। যা পরবর্তীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া (জাভা এবং বালি), সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, ফিজি, গায়ানা, মরিশাস এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগো সহ বৃহৎ জাতিগত ভারতীয় জনসংখ্যার দেশগুলিতে গণেশ পূজার প্রথা বিস্তার লাভ করেছে।

ভাদ্র মাসের শুক্ল চতুর্থীতে শুরু হয় এবং উৎসবের সময়কালে গণেশের মূর্তি স্থাপন, পূজা ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে আনন্দ ও ভক্তির প্রকাশ ঘটে। উৎসবের মূল অনুষ্ঠানগুলো মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মতো রাজ্যগুলিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়, যেখানে এই উৎসবকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়। এটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, জাতীয় ঐক্য এবং ভক্তির একটি জীবন্ত উদাহরণও বটে। গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও এই উৎসব অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। এই বৎসর ২৭শে আগস্ট বুধবার গণেশচতুর্থীর দিন উৎসব শুরু হবে। এবং ৬ ই সেপ্টেম্বর শনিবার অনন্ত চতুর্দশীর দিন উৎসবের সমাপ্তি হবে। গণপতি বাপ্পা সকল বাধা বিঘ্ন নাশ করে সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। সুখ সমৃদ্ধি সৌভাগ্য বৃদ্ধি করুন এই প্রার্থনা করি। জগৎগুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশীর্বাদ সকলের শ্রী বর্ষিত হোক।
*গণপতির প্রতিষ্ঠা মুহুর্ত:-*
২৭শে আগস্ট, ২০২৫, বুধবার গণেশ চতুর্থীর শুভ মুহূর্ত হলো সকাল ১১:০৬ থেকে দুপুর ১:৪০ পর্যন্ত, যা গণপতিকে বাড়িতে আনার এবং স্থাপনার জন্য সবচেয়ে শুভ সময় হিসাবে বিবেচিত হয়। এই সময়ে, বিশেষত দুপুরবেলা, সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্ম হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়, তাই এই সময়টি ‘মধ্যাহ্ন গণেশ পূজা’র জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসলে, বুধবার সকালে সূর্যোদয় থেকে পুরো দিনটি শুভ। সুবিধামতো গণপতির প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সর্বাধিক শুভ মুহুর্ত- অভিজিৎ মুহুর্ত ২৭শে আগস্ট ১১.৪৫ থেকে ১২.৫৫ পর্যন্ত হবে। এই মুহুর্তে গণপতি মূর্তি স্থাপন সবচেয়ে শুভ হবে। এর পাশাপাশি, ২৭শে আগস্ট দুপুর ১.৩৯ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬.০৫ মিনিট পর্যন্ত মুহুর্তটিও শুভ।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ *পরিব্রাজক*

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

ত্রিলোকনাথ; তুমি আছ বিশ্বনাথ অসীম রহস্যমাঝে : শীলা পাল।।।।।।।

অনেক অনেকবছর আগে প্রায় চল্লিশ বছর তো হবেই ।তখন লাহুল স্পিতি উপত্যকা আমাদের কাছে একটা রহস্যময় অচেনা জগতের মতো ছিল।তবু ভবঘুরে মন আর পায়ের তলায় সরষে ।তাই বছরের কোনও না কোনও সময়ে হিমালয়ের ডাক কানে এসে পৌঁছতো আর আমরা ছয়জনের যে দলটি লোটা কম্বল নিয়ে  সব সময় রেডি থাকতাম বেরিয়ে পড়তাম।সেই বছর ত্রিলোকনাথ যেন আমাদের ডাক পাঠালেন।ব্যাস আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।সেপ্টেম্বর মাস এমনিতেই বাতাসে শারদীয়ার সুর
আমরা চললাম মানালির উদ্দেশ্যে ।ওখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে।সেই সময়ের মানালি যেন কুমারী সুন্দরী।কী তার রূপ সবুজে শ্যামলে পাহাড়ে নদীতে যেন রূপসী অপ্সরা।আর তেমন পথঘাট সেইরকম সুন্দর ওখানকার লোকজন ।চোখফেরানো যায় না এমন সব রমণীয় রমণীদের পথে ঘাটে দেখি আর বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি।আমাদের একসঙ্গী সবে কলেজে ঢুকেছে তার চোখে ঘোর ।ওকে নিয়ে কি মজাটাই করেছি আমরা দুই সখী স্বপ্না আর আমি।বিপাশার কলকল ধ্বনি প্রথম দিনেই আমাদের মন জয় করে নিল।কীভীষন ভালো লাগায় মন ভরে গেল যেন।প্রাথমিক কিছু রসদ কেনাকাটা করা হল।চাল ডাল ফল সব্জি ইত্যাদি এটা আমাদের পাহাড়ি পথে সবসময়ই মজুত রাখা হয়।অভ্যাস অনেক রকম অভিজ্ঞ।তা থেকে বুঝেছি এটা সঙ্গে থাকলে রাস্তাতেও দিন কাটানো যায় ।পাহাড়ের রাস্তা বড়ই খতরনক ।মানালী থেকে বাস ছাড়লো সকাল আটটায় ।বিপাশাকে বাঁয়ে রেখে যাত্রা শুরু ।পাহাড়ি পথে পাক খেতে খেতে বাস এগিয়ে চলে।উৎসুক মন কখন রোটাংপাস দেখবো।ভয়ংকর রোটাং  হিমশীতল রোটাং।কিন্তু রোটাংপাস এ পৌঁছে মন ভরলো না।রিক্ত রুক্ষ কঠোর কেমন যেন সর্বস্ব হারা রূপ ।রোটাংপাস থেকে অনেকটা পথ নেমে প্রায় বারোটার সময় এসে পৌঁছলাম চন্দ্র নদীর তীরে খোকসারে।এখানে হিমালয় যেন গৈরিক সন্ন্যাসী ।ভাবগম্ভীর প্রশান্তিময় মৌন গিরিরাজ।
খোকসার থেকে রাস্তা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে ।একটি চন্দ্র নদীর উৎস অভিমুখে অন্য টি আমরা যে পথে যাবো ত্রিলোকনাথ এর দিকে যে পথে আমরা যাবো।
খোকসারের প্রণাম জনপদ শিশু।শিশু নামের বিশেষত্ব ছড়ানো আছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ।কোন্ অদৃশ্য নিপুন হাতে রোপিত অজস্র শিশুগাছের শ্যামল বনানী ।বাস রাস্তার নীচে র দিকে অনেক বর্ধিষ্ণু পাহাড়ি গ্রাম ।ক্ষেতে ক্ষেতে সর্বত্র ই ফসল তোলার সাড়া ।আসন্ন শীতের জন্য এই তোড়জোড় ।শীত এদের কাছে বিভীষিকা ।তাই চাষবাস পশুপালন শীতের আগেই সঞ্চয় করার অভ্যাস বা রীতি নিয়ম সবকিছু ।ছোট ছোট অনেক জনপদ পেরিয়ে বেলা তিনটে নাগাদ এসে পৌঁছলাম তান্ডি তে।এখানে  ভাগা নদী মিলিত হয়েছে চন্দ্র নাম হয়েছে চন্দ্রভাগা।নদীর জল ঘন নীল ।পুরো রাস্তা টাই কাঁচা তান্ডি থেকে।সংকীর্ণ এবড়োখেবড়ো পথ তার মধ্যে ই বড়বড় লরি চলাচল করছে।বেশ ভয়ে ভয়ে এই রাস্তা পার হয়েছি ।থিরোট হুয়ে কীর্তিং প্রায় পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছলাম ।রাস্তার ওপরেই লোকালয় ।জায়গা টি বেশ জনবহুল ।সামনেই চা আর পকৌড়ার দোকান।গোবিন্দ চেঁচিয়ে উঠল ফুলকাকা সামনেই চা আর পাকৌড়া নামুন  নামুন ।আমরা সবাই হুড়মুড়িয়ে বাস থেকে নামলাম। উফ্ একটানা বাসের গোঁ গোঁ আওয়াজ মাথা যেন কাজ করছে না ।মুক্ত হাওয়ায় চা টা খেয়ে বেশ ভালো লাগছে।এমন সময়  মি ঠাকুর নামে এক ভদ্রলোক পাশেই তার বাড়ি আমাদের ডাকলেন নিজের হাতে আপেল পাড়ার জন্য ।কী অপূর্ব তার বাগান।ওইটুকু সময়ের মধ্যে তাঁর বাড়ি বাগান ঘুরে এত্তো আপেল নিয়ে বাসে উঠলাম ।কি খুশী ওনার চোখে মুখে ।এরকম আন্তরিক মধুর ব্যবহার আমাদের চিরদিন মনে থাকবে।চলার পথে এগুলো ই পাথেয় ।সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ধূলিধূসরিত আমরা এসে হাজির হলাম চন্দ্র ভাগা উপত্যকার উদয়পুরে।রাস্তার ওপরেই পি ডব্লিউ ডির সুন্দর সাজানো বাংলো।জায়গাটা যেমন সুন্দর তেমনি নির্জন ।সামনেই চন্দ্র ভাগা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে ।মনোরম এই পরিবেশ আমাদের সব ক্লান্তি কোথায় মিলিয়ে গেল।স্বপ্না কি সুন্দর করে গাইল -পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে ।সব অবসাদ মুহূর্তে মুছে গেল ।
পরের দিন সকালে ত্রিলোকনাথ দর্শন ।উদয়পুর থেকে প্রায়  নয় কিলোমিটার ।ভোরের পাহাড় যে কি স্নিগ্ধ হয় মনে যেন কি শাস্তি আসে।চন্দ্রভাগার উপর সেতু পার হয়ে শুরু পাহাড়ি পাকদণ্ডি পথ।সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে মনে হল যেন তুষার শৃঙ্গের মুকুট পরে চন্দ্রভাগা উপত্যকা যেন তার সমস্ত সৌন্দর্য মেলে ধরেছে।একটা সরু নালার পাশ দিয়ে খুব পিচ্ছিল ভাঙাচোরা পথ।মাঝে মাঝে চড়াই ভেঙে দু তিনটে ছোট ছোট পাহাড় পেরিয়ে হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেলাম আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত ত্রিলোকনাথ মন্দির ।জায়গাটির নাম ত্রিলোকনাথ ।পাহাড়ের মাথায় জনবসতির একপাশে দেবালয় ।এখানে দেবতা রুদ্ধ দ্বারে বসে নেই একান্ত আপনজনের মতো সকলের সাথে মিশে রয়েছেন।মন্দির প্রাঙ্গণে দেখা হল এখানকার অধিবাসীদের সাথে।পরদেশি দেখে সবাই  ভীড় করে এলো।কি হাসিখুশি সহজ সরল মানুষ গুলি মন্দিরের সামনেরঅংশটি ভেঙে গেছে।তিব্বতি ধাঁচের  মন্দির ।ভাঙা অংশ টি পেরিয়ে আমরা জুতো মোজা খুলে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলাম ।অসংখ্য প্রদীপের আলোয় মন্দির আলোকিত ।মৌণ মন্দির অভ্যন্তরে পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত কয়েক জন পাহাড়ি মেয়ে।এখানে সকলেই বৌদ্ধধর্মালম্বী।বুদ্ধকে স্মরণ করেই ত্রিলোকনাথ দেবের পুজো নিবেদিত হয়।ত্রিলোকনাথের মাহাত্ম্য এবং কিংবদন্তী অনেক  আছে।এই মুর্তিটি  অনেকবার চুরি করার চেষ্টা করা হয়েছে ।একবার কুলুর রাজা সেনা পাঠিয়ে বিগ্রহ তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু কিছুতেই পারেন নি।এখনও নাকি মুর্তিটির ডান পায়ের নীচে তরোয়ালের দাগ দেখা যায় ।আমরা পুজো দেওয়ার জন্য পুরোহিতের খোঁজ করতে জানলাম উনি বাইরে আছেন ।পুরোহিতের ছেলে আমাদের পুজো নেবে।অর্ঘ্য  তো সামান্য ।কিছু ধূপের বান্ডিল আর নতুন কাপড়ের টুকরো।ভগবান বুদ্ধের চরণে এই সামান্য ডালি নিবেদন করে ডক্তিভরে সবাই  প্রণাম করলাম ।তারপর পুরোহিতের কানে কানে আমাদের মনোবাঞ্ছা জানালাম ।আমরা এক বিখ্যাত হিমালয়প্রেমীর কাছে যা জেনেছিলাম ।পুরোহিত একবার চকিতে চারিদিক দেখে নিল।মন্দির পুরো ফাঁকা ।ইসারায় আমাদের একদম বিগ্রহের সামনে নিয়ে গেল।অজস্র পাথর মনি মুক্তোর মালা তুলে উন্মোচন করলো পুরো মুর্তিখানি।কোথায় গেল সেই সৌম্য শান্ত বুদ্ধ এ যে ভুবন ভোলানো নৃত্যরত নটরাজ! এমন সৌম্য রূপের সঙ্গে সংহার রূপের মিলন ।আমরা বিমোহিত হতবাক।প্রতিটি আঙুলের মুদ্রা আর ভঙ্গিমা  এতো ছন্দময় এতো প্রাণবন্ত যেন স্বয়ং নটরাজ নৃত্যরত বালকের মতো আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন ।ধন্য আমরা।ধন্য আমাদের ত্রিলোকনাথ দর্শন ।জয় ত্রিলোকনাথ ।তুমি আছ বিশ্বনাথ অসীম রহস্য মাঝে।
একরাশ আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম উদয়পুর ।বেলা একটা নাগাদ ।চাল ডাল সামনের চায়ের  দোকানে দিয়ে সুন্দর খিচুড়ি আর ওখানকার সুস্বাদু আলু ভাজি আমাদের দুর্দান্ত লাঞ্চ হয়ে গেল।কিছুক্ষণ এখানকার লোকজনদের সঙ্গে গল্প গুজব  করে বিশ্রাম  নিতে গেলাম বাংলোর ভিতর ।
পরের  দিন ভোরে মানালি ফেরা।সবাই খুব হৈ হৈ  করে দিনটা কাটালাম।তখনও বুঝি নি এই  অপূর্ব চাঁদের আলো এই উচ্ছল সন্ধ্যা গানে গানে মুখরিত রাত্রি ঢেকে যাবে কালোমেঘে।মাঝ রাতে শুনি বাইরে তান্ডবলীলা ।এমনিতেই এখানে প্রচন্ড ঠান্ডা হঠাৎ যেন দশগুণ বেড়ে গেল।সারারাত কম্বলের তলায় ঠকঠক করে কেঁপেছি আর ফেরার কথা ভেবে আকুল হয়েছি ।ভোরবেলায় উঠে দেখি প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে ।আর উত্তুরে হাওয়া যেন সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবে।একরাতের মধ্যে সামনের পাহাড় গুলো মুহূর্তে বরফে ঢেকে গেছে।বাস আসতেই উঠে বসলাম ।সব যাত্রীদের মুখে এক কথা এভাবে বরফ পড়তে থাকলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে ।রাহুল ও মানালির একমাত্র সংযোগ স্থল রোটাংপাস যদি বন্ধ হয়ে যায় আমরা এখানেই বন্দী হয়ে যাবো।বাস একটু একটু করে যায় আর থেমে যায় ।জিজ্ঞেস করলে ড্রাইভার বলে ডিজেল ফাঁস গিয়া।প্রচন্ড ঠান্ডাতে ডিজেল জমে যাচ্ছে । বাসের মধ্যে সবাই চুপচাপ বসে আছি।এত দুর্ভাবনার মধ্যে ও বাইরের দিকে তাকিয়ে অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সব ভুলে গেলাম ।কি হবে কি হতে পারে সব ভাবনা ভুলে দেখতে থাকি আকাশ থেকে ঝরে পড়া যেন মুঠো মুঠো শ্বেত টগরের পাপড়ির মতো তুষার বৃষ্টি ।আর চারিদিক সাদায় সাদা।ডিজেল ফাঁসতে ফাঁসতে অবশেষে বিকেল বেলা খোকসার এসে পৌঁছলাম ।চারিদিক অন্ধকার ।এরকম দুর্যোগে কোনও গাড়ি আর যেতে চাইছে না।সব লরি বাস বন্ধ ।আজ এখানেই রাত্রি বাস।স্থানীয় লোকজন বলছে এরকম আবহাওয়া চলতে থাকলে রোটাংপাস বন্ধ হয়ে যাবে।ছ দিন কি ছ মাস  কেউ বলতে পারবে না।উৎকন্ঠিত চিত্তে পি ডব্লিউ ডির  রেস্ট হাউসে রাত কাটানোর জন্য হাজির হলাম ।সেদিনের মতো পোড়া আলু আর পোড়া রুটি  ডিনারের জন্য চায়ের দোকানে পাওয়া গেল।এরপরে কি হবে জানা নেই।এর মধ্যে ই মলয় বললো কি আর হবে দিদি তোর মেয়েটা বড় হয়ে যাবে আর কাকীমার তোমার ছেলে এক ক্লাস এগিয়ে যাবে ।আর যত দিন কাফ সিরাপ আছে রুটি দিয়ে গুড়ের মত খেয়ে নেব।কি চিন্তা আমাদের ।উফ্ কি ছেলে রে বাবা ।আমরা একমনে বাবা ত্রিলোকনাথ কে ডেকে যাচ্ছি  আর প্রার্থনা করছি রক্ষা করো বাবা।রাত্রি নটার পর ঝড়ের বেগ একটু কমে গেল।বৃষ্টির আওয়াজ ও যেন কমেছে মনে হল।একটু রাতে হঠাৎ যেন কাঁচের জানালার ফাঁকে এক ঝলক আলো এসে পড়লো ।হৈ হৈ করে বারান্দায় বেরিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় তুষারাবৃত হিমালয় স্নান করছে।অবর্ণনীয় সেই আলো সেই সৌন্দর্য ।আলোর ঝর্ণা ধারায় আনন্দে চোখে জল এসে গেল।মলয় আনন্দের চোটে গান গাওয়া শুরু করল–প্রেমের জোয়ারে ভাসাব দোঁহারে বাঁধন খুলে দাও দাও দাও যতো হাসি আর বলি ওরে এ যে  শ্যামার গান  প্রেমের গান কে কার কথা শোনে হাসতে হাসতে আমরা বাঁধন খোলার আনন্দে ভেসে গেলাম ।পরদিন বেলা দশটা নাগাদ বাস ছাড়লো।বরফ কেটে কেটে মন্থর গতিতে সন্ধ্যা সাতটায় রোটাং পাসের ভয়ানক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যেন মানালি এসে গেলাম ।একশ আশি কিলোমিটার শুধু সাদা দেখে দেখে সবুজের ছোঁয়ায় মন ভরে গেলো।জয় ত্রিলোকনাথ ।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

সমুদ্র মন্থনের বিষ ও নীলকণ্ঠ মহাদেব : শ্রাবণের পুরাণকথা ও তাৎপর্য।

প্রস্তাবনা

ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চায় প্রতিটি ঋতু, মাস, দিন, এমনকি মুহূর্তেরও বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সেই পরম্পরায় শ্রাবণ মাস (জুলাই-আগস্ট) হল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ এক মাস। এটি চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী হিন্দু বর্ষপঞ্জির পঞ্চম মাস, এবং বর্ষার পূর্ণ মৌসুমি রূপে আবির্ভাব ঘটে এই সময়। শ্রাবণ শব্দটি এসেছে ‘শ্রবণ’ নক্ষত্র থেকে, যা এই মাসের পূর্ণিমার দিনটিকে নির্দেশ করে। এই মাস মূলত ভক্তি, তপস্যা ও আত্মশুদ্ধির মাস। এই সময়টা দেবাদিদেব মহাদেবের পূজা-অর্চনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়।

শ্রাবণ মাস ও দেবাদিদেব মহাদেবের সম্পর্ক

শ্রাবণ মাস প্রধানত শিব ভক্তদের জন্য এক বিশেষ পূণ্যকাল। পুরাণ অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় যখন হলাহল বিষ উৎপন্ন হয়, তখন সমস্ত দেবতাদের প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। সেইসময় ভগবান শিব তা নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন যাতে সৃষ্টির কোনো ক্ষতি না হয়। এই ঘটনার পর থেকেই শিবকে নীলকণ্ঠ বলা হয়।
বিশ্বাস করা হয়, সেই সময় ছিল শ্রাবণ মাস। ভগবান শিবের গলায় ধারণ করা বিষের তাপ প্রশমনের জন্য দেবতারা তাঁকে গঙ্গাজল, বেলপাতা ও দুধ নিবেদন করেন। সেই থেকেই শুরু হয় শ্রাবণ মাসে শিবের আরাধনা এবং শিবলিঙ্গে জল ও দুধ নিবেদন করার প্রথা।

শ্রাবণ মাসে উপবাস ও ব্রত

শ্রাবণ মাসে উপবাস রাখার প্রচলন অত্যন্ত প্রাচীন। এই মাসে প্রতি সোমবার ‘শ্রাবণ সোমব্রত’ পালন করা হয়। সাধারণত অবিবাহিতা কন্যারা উপযুক্ত বর প্রাপ্তির আশায় এই ব্রত পালন করেন, আর বিবাহিত নারীরা স্বামীর দীর্ঘ জীবন কামনায় এই ব্রত নেন।
সোমবার ব্রত পালনের নিয়ম:

ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করা।

শিবলিঙ্গে জল, দুধ, ঘৃত, মধু, চন্দন, বেলপাতা, ধুতুরা, আকাশবেল ইত্যাদি নিবেদন।

“ওঁ নমঃ শিবায়” মন্ত্র জপ করে আরতি এবং প্রার্থনা।

সারাদিন উপবাস রাখা বা ফলাহার গ্রহণ করা।

বিশেষ ব্রত ও পূজার ধরন:

মঙ্গলা গৌরী ব্রত: মহিলারা মঙ্গল কামনায় প্রতি মঙ্গলবার পালন করেন।

নাগ পঞ্চমী: নাগদের পূজার দিন; শিবের গলায় বাস করা বাসুকি নাগকে স্মরণ করে।

রক্ষাবন্ধন ও শ্রাবণী পূর্ণিমা: ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্ক উদযাপন।

শ্রাবণ মাসে পবিত্র তীর্থযাত্রা ও কাওয়ার যাত্রা

শ্রাবণ মাসে ভারতজুড়ে লক্ষ লক্ষ শিবভক্ত “কাঁওয়ারিয়া” হন। তাঁরা গঙ্গার পবিত্র জল সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট শিবমন্দিরে তা নিবেদন করেন। বিশেষ করে উত্তর ভারতের হরিদ্বার, গোমুখ, গঙ্গোত্রী, বারাণসী, বৈদ্যনাথধাম, কেদারনাথ প্রভৃতি স্থান থেকে জল সংগ্রহ করে দীর্ঘ পথ হেঁটে ভোলেনাথকে অর্ঘ্য দেন। এটি একটি কঠোর ব্রত; কাঁওয়ারিয়ার দল নিরামিষ আহার করেন, অনেকে নিদিষ্ট দিনে উপবাস পালন করেন এবং কঠোর নিয়ম পালন করেন।

পৌরাণিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব

শ্রাবণ মাসে দেবতা, ঋষি ও অন্যান্য মহাপুরুষের অনেক ঘটনাও এই মাসের সঙ্গে যুক্ত।

সমুদ্র মন্থন ও নীলকণ্ঠ রূপ
বিষ পান করে শিব পৃথিবীকে রক্ষা করেন। শ্রাবণ মাস সেই আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে।

শিব ও পার্বতীর পুনর্মিলন
শ্রাবণ মাসেই দেবী পার্বতী দীর্ঘ ব্রতের পর মহাদেবকে লাভ করেন।

শ্রীবিষ্ণুর যোগনিদ্রা থেকে জাগরণ
দেবশয়ন একাদশীতে শ্রীবিষ্ণু যোগনিদ্রায় যান এবং শ্রাবণ মাসে উত্থান একাদশীতে জেগে ওঠেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম মাস
শ্রাবণ মাসেই কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী পালিত হয়।

আয়ুর্বেদ ও প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রাবণ মাস

আয়ুর্বেদ অনুসারে, শ্রাবণ মাসে শরীর ও মন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, কারণ বর্ষার কারণে পরিপাক শক্তি দুর্বল হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই এই সময় উপবাস ও সাদামাটা খাদ্যাভ্যাস শরীরকে বিশ্রাম দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও জলবাহিত রোগ, সর্দি-কাশি, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি এই সময়ে বেশি দেখা যায়। তাই ফলাহার, নিরামিষ ভোজন, নিয়মিত যোগাভ্যাস এবং প্রার্থনা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক।

মানসিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

শ্রাবণ মাস শুধু বাহ্যিক পূজা-অর্চনার জন্য নয়, এটি introspection বা আত্মসমীক্ষণের জন্যও উপযুক্ত সময়। এই মাসে তপস্যা, জপ, ধ্যান ও উপবাসের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের মধ্যে শুদ্ধতা আনতে পারে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে—

“যঃ শ্রাবণমাসে শিবং ভজেত্, তস্য পাপানি নাশ্যন্তি ইহলোক পারত্র চ।”
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শ্রাবণ মাসে ভগবান শিবের উপাসনা করেন, তার সব পাপ নাশ হয় – এই লোকেও, পরলোকেও।

শ্রাবণ মাসে পালনীয় কিছু নিয়ম

ব্রহ্মচর্য পালন করা।

নিষিদ্ধ দ্রব্য যেমন পেঁয়াজ, রসুন, মাংস-মদ ইত্যাদি পরিহার করা।

প্রত্যেক সোমবার উপবাস ও শিবপূজা।

কাঁওয়ার যাত্রায় অংশগ্রহণ করা অথবা অন্ততপক্ষে গৃহস্থ পর্যায়ে গঙ্গাজল নিবেদন।

দান-ধ্যান ও গরিবদের সাহায্য করা।

আধুনিক সমাজে শ্রাবণ মাসের তাৎপর্য

আজকের ব্যস্ত জীবনে শ্রাবণ মাস আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও পরিবেশ সচেতনতার বার্তা নিয়ে আসে। শিবের আরাধনা মানে কেবল পূজা নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও জীবনের ভারসাম্য খোঁজাও। বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণ, মানসিক চাপ, মূল্যবোধের অবক্ষয় যখন মানুষের জীবনে নৈমিত্তিক সমস্যা হয়ে উঠেছে, তখন শ্রাবণ মাসের ব্রত ও অনুশাসন ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে পারে।

উপসংহার

শ্রাবণ মাস সনাতন ধর্মের এক অমূল্য রত্ন। এটি শুধুমাত্র এক মাস নয় – এটি আত্মবিশ্লেষণ, আত্মত্যাগ, পরোপকার, সংযম, এবং ভক্তির এক দীর্ঘ সাধনার সময়। এই মাসে শিব ভক্তরা যেমন শারীরিক ও মানসিক তপস্যা করেন, তেমনি সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগও পান।
ভক্তি, শুদ্ধতা ও ধার্মিক চেতনার এই অনন্য উৎসবমুখর মাস নতুন করে মনে করিয়ে দেয় – “শিবেই সর্বস্ব”, “শিবই অনন্ত”, আর তাঁর চরণেই লুকিয়ে আছে মোক্ষের দ্বার।
শেষ কথা: শ্রাবণ মাসে অন্তত কিছু সময় ভগবান শিবের নাম জপ, নিঃস্বার্থ সেবা, এবং আত্মিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলা – এটাই এই মাসের প্রকৃত পালন।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ রিভিউ

করম উৎসব – লোকসংস্কৃতির অঙ্গ কলমেঃ দিলীপ রায়

করম উৎসব – লোকসংস্কৃতির অঙ্গ
কলমেঃ দিলীপ রায় ( ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)
করম প্রধানত সৃষ্টির উৎসব, সৃজনের উৎসব । শরতের আগমনে শস্য ও সমৃদ্ধি কামনায় করম পরব বা করম উৎসব । ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী বা পার্শ্ব একাদশীতে করম উৎসব পালিত হয় । এই বছর অনুষ্ঠিত হবে ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ । এই পরবের মূল আকর্ষণ হলো জাওয়া গান (অনেকে ‘জাওয়া’ বানান ‘যাওয়া’ লিখে থাকেন) । বলা চলে, গানগুলো লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গ ।
এবার আসছি জাওয়া কি ? সেটা আমাদের জানা দরকার । “জাওয়া শব্দটা নাকি ‘জাত’ শব্দ থেকে এসেছে । বীজের অঙ্কুরোদ্‌গম বা চারার ‘জাত’ বা জন্ম থেকে এইরকম নামকরণ হয়ে থাকতে পারে । শব্দটি “জাওয়া” হবে, নাকি “যাওয়া” হবে , সেটা নিয়েও মতোভেদ রয়েছে । যাই হোক “জাওয়া” হচ্ছে একটি শস্য উৎসব । আবার শস্য বীজের অঙ্কুরোদ্‌গমেরও অনুষ্ঠান বলা চলে । একমাত্র কুমারী মেয়েরাই এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে । ভাদ্র মাসের পার্শ্ব একাদশীর এক সপ্তাহ আগে এই অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে ।
এবার আসছি করম পরব প্রসঙ্গে ।
করম পরব ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, আসাম, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশ ও নেপালে একটা ফসল কাটার উৎসব । এই উৎসবে করম দেবতার উপাসনা করা হয় । যিনি হচ্ছেন কিনা শক্তি, যুব ও যৌবনের দেবতা । করম পরব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা, ঝাড়্গ্রাম জেলা, বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কুড়মি, ভূমিজ, বৈবা, মুণ্ডা, রাজোয়াড়, সরাক, লোহার বাউরি, বীরহড়, বীরনিয়া, খেরওয়ার, হো, খেড়িয়া, শবর, কোড়া মাহালি, পাহাড়িয়া, হাড়ি, বাগদি, বেদে, ঘাসি, লোধা ও বৃহৎ জনগোষ্ঠী সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, প্রভূতি সম্প্রদায়ের জঙ্গলভিত্তিক ও কৃষিভিত্তিক লোক উৎসব । তবে কুড়মি সমাজে এর স্বীকৃতি, মান্যতা ও ব্যাপকতা উল্লেখযোগ্য ।
প্রকৃতির পুজা ও উর্বতার উৎসব । এই করম পরব প্রায় সাতদিন ধরে উদযাপন হয় । কুমারী কন্যারা নিষ্ঠার সঙ্গে সাতদিন ধরে ব্রত পালন করেন, করম গাছের ডাল পুজা করেন এবং বপন করা হয় ভুট্টার বীজ । অঙ্কুরিত ভুট্টার চারা বা ‘জাওয়া’কে উর্বতার প্রতীক হিসাবে দেখা হয় । মূলত এই করম উৎসবটি আদিবাসী ও সাঁওতাল জনজাতিদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় । করম পুজা ঝুমুর গান, “আজরে করম রাজা ঘরে দুয়ারে, কালরে করম রাজা কাশ নদীর পারে” ।
ভাই বোনের গভীর ভালবাসার কথা জাওয়া গান গুলোতে বারবার ফুটে উঠে । দাদা ও ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো সুখের মিহূর্তগুলো বোনকে খুব পীড়া দেয় । তাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী হলে, মিথ্যাই সাত্ত্বনা দিতে বধূটি বলে ওঠে – “আমারি জনম পরের ঘর ।“ ভাই তখন সান্ত্বনা দেয় । সেই গান মেয়েরা গেয়ে ওঠে —
“আমি কি লিখ্যেছি বহিন বিধাতা লিখ্যেছে রে
বিধাতা লিখেছে পরের ঘর ।
পরেরই ঘরে বহিন খাটি লুটি খাও রে
রাখি দিহ বাপের ভায়ের নাম ।“
মূলত গ্রামের অবিবাহিত কুমারী মেয়েরাই এই ‘করম’ ঠাকুরের উপাসক । শুক্লা একাদশীর সাতদিন আগে কুমারী মেয়েরা একত্রে বাঁশের বোনা ‘টুপা’ (ডালা) এবং বিভিন্ন ধরনের শস্যবীজ নিয়ে জড়ো হয় পার্শ্ববর্তী কোনো নদী, পুকুর বা জলাশয়ে । সেখানে প্রত্যেকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে সদ্যস্নাত ভিজে কাপড়ে নিজের নিজের টুপায় নদী খাতের বালি ভর্তি করে বাড়ি থেকে আনা সেই শস্যবীজগুলো বোনে । তারপর পরস্পরের হাত ধরে টুপা’কে কেন্দ্র করে গোল হয়ে বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী গান গাইতে থাকে ।
এরপর শুরু হয় এই জাওয়া টুপাগুলোর পরিচর্যা । দিন দুয়েক পরেই বীজগুলির অঙ্কুরোদ্‌গম হয় । জাওয়া পাতানো কুমারী মেয়েরা, জাওয়ার শুদ্ধতা বজায় রাখার নিরিখে সারা সপ্তাহ ধরে পালন করে কিছু রীতি নীতি । যেমন – একদিন তারা শাক খায় না, খাটিয়ায় ঘুমোয় না, মাথায় তেল দেয় না, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় না, । এছাড়াও প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা নিজ নিজ ডালাসহ গ্রামের এক জায়গায় জড়ো হয় । জাওয়াকে কেন্দ্র করে সারা সন্ধ্যা চলে করম গান ও নাচ ।
সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের লায়া (পুরোহিত) এক জায়গায় করম ডাল পুঁতে করম ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন । তৈরি হয় পুজোর বেদী । গ্রামের ব্রতকারী কুমারী মেয়েরা “করম ডালায়” পুজোর অর্ঘ্যরূপে মাটির প্রদীপ, শাল পাতার তৈরি থালায় নদীর বালি, ঘি, গুড়, আতপ চাল, মধু, ধূপ, সিঁদুর, একগাছি ধান আর ‘কাঁকুড়’, ইত্যাদি নিয়ে সমবেত হয়ে পুজো করে পরম ঠাকুরের । কামনা করে সোহাগী স্বামী পাওয়ার ও সন্তানবতী হওয়ার ।
এবার আসছি করম পুজার প্রচলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে । এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, করম পুজা প্রচলনের ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে । একটি মত সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
কথিত আছে, কর্ম ও ধর্ম দুই ভাই । দু’জনেই খুব পরিশ্রমী ও দয়ালু । কিছু দিন পর কর্মের বিয়ে হয়ে গেলো । তাঁর স্ত্রী ছিল অধার্মিক এবং অন্যদের বিরক্ত করার মানসিকতা । আর এতে রাগান্বিত হয়ে কর্ম বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
তিনি চলে যেতেই সকলের কর্মফল ও ভাগ্যও চলে গেলো এবং মানুষের দুঃখ দুর্দশা বাড়তে লাগলো । মানুষের সমস্যা সহ্য করতে না পেরে ধর্ম ভাইয়ের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন । কিছু দূর হাঁটার পর তাঁর জল তেষ্টা পেলো এবং দেখলেন, আশেপাশে কোথাও জল নেই । দূরে একটা নদী দেখতে পেলেন এবং সেখানে গিয়ে দেখলেন, জল নেই । নদী ধর্মকে বলল, তোমার ভাই এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমাদের কর্মফল নষ্ট হয়ে গিয়েছে । গাছের সব ফল নষ্ট ! তাঁকে খুঁজে পেলে বলো, তাঁর কাছে আমাদের এই সমস্যার সমাধান চাই । তারপর আরও একজন মহিলার সঙ্গে তাঁর দেখা এবং তিনি বললেন, কর্ম চলে যাওয়ার পর থেকে রান্নার পরে পাত্রগুলি হাতে লেগে যেতে শুরু করে, এর সমাধান কী ? আপনি কর্মকে জিজ্ঞাসা করুন এবং তাঁকে সমাধান বলতে বলুন । ধর্ম আরও এগিয়ে গেলেন । একটি মরুভূমিতে পৌঁছালেন । সেখানে তিনি দেখলেন, কর্ম গরমে অস্থির । তাঁর শরীরে ফোসকা পড়েছে এবং তিনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন । তাঁর অবস্থা অসহনীয় । ধর্ম কর্মকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন । তখন উভয় ভাই বাড়ি ফিরে যেতে লাগলেন । ফেরার সময় সেই মহিলার সঙ্গে দেখা । কর্ম তাঁকে বললেন, ঐ মহিলা কখনও কোনও ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াননি, তাই তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে । সুতরাং এটি তাঁর কর্মফল । একইভাবে সকলকে নিজের কর্মফলের কথা জানানোর পর কর্ম বাড়িতে ফিরে এসে পুজা করেন । তারপর সমগ্র এলাকার লোকেরা আবার সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন এবং সমৃদ্ধি ফিরে আসল । সেই স্মরণে করম পরব পালিত হয় ।
# আর একটি মত হচ্ছেঃ
এক সময় সাত ভাই ছিল যারা কৃষিকাজে কঠোর পরিশ্রমী । এমনকি তাঁদের দুপুরের খাওয়ারও সময় থাকতো না । তাই, স্ত্রীরা প্রতিদিন তাঁদের দুপুরের খাবার মাঠে নিয়ে যেতেন । একবার এমন হয়েছিল, তাঁদের স্ত্রীরা দুপুরের খাবার নিয়ে মাঠে যাননি । সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত ছিলেন তাঁরা । সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখেন তাঁদের স্ত্রীরা বাড়ির উঠোনে করম গাছের ডালের পাশে নাচ-গান করছেন । এটা দেখে তাঁরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা । এক ভাই তাঁর মেজাজ হারিয়ে ফেলে করমের ডাল ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিলেন । করম দেবতাকে অপমান করা হয়েছিল । ফলে তাঁদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে এবং অনাহারে তাঁদের দুর্দশা অবস্থা । একদিন একজন ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) তাদের কাছে এলেন এবং সাত ভাই পুরো ঘটনাটা তাঁকে খুলে বললেন । এরপর সাত ভাই করম ঠাকুরের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। তাঁরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে থাকেন এবং এইভাবে খোঁজার পর একদিন তাঁরা করম গাছের সন্ধান পান । পরবর্তীকালে, করম ঠাকুরের পুজো করেন । তারপর তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতি ঘটতে থাকে । সুখ ও শান্তি ফিরে আসে ।
এলাকার মানুষ সহ কর্ম ও ধর্ম সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন এবং সমৃদ্ধি ফিরে আসল । সেই স্মরণে করম পরব পালিত হয় । বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে করম পার্বণ একটি অন্যতম । এটি গ্রাম বাংলার এক অজানা অথচ বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী, কুড়মিদের চা-বাগানের মানুষদের সু-প্রচলিত করম উৎসব । এই বছরও করম পুজাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজ্য সরকার ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ছুটি ঘোষণা করেছেন ।
পরিশেষে বলা যায়, করম পরব আদিম জনগোষ্ঠীর ধারক ও বাহক । এর মধ্যে অন্যতম কুড়মি, সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা, ওঁরাও, রাজোয়াড়, ডোম, ঘাসি প্রভৃতি জনগোষ্ঠী । যদিও উল্লেখিত, কুড়মি সমাজের মধ্যে এর স্বীকৃতি, মান্যতা ও ব্যাপকতা অবর্ণনীয় । আদিম জনগোষ্ঠী প্রায় সকলেই প্রকৃতির পুজারী । ভাল করে এই উৎসবের পুজানুষ্ঠান ও পালনবিধি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এটা একটা বৃক্ষ পুজার অনুষ্ঠান । বৃক্ষকে জীবন্ত আত্মার অধিকারী হিসাবে স্বীকার করে এবং তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বাস-সংস্কার, আচার-অনুষ্ঠানের এক বিস্ময়কর সমাবেশ এবং শুদ্ধ ভক্তির পরম্পরা ! (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী (পিন-৭৪১২৩৫) / ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

চার ধাম : এক মহাপবিত্র তীর্থযাত্রার ইতিহাস ও তাৎপর্য।

🔶 ভূমিকা

ভারতবর্ষের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরম্পরায় চার ধামের গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দু ধর্মে “চার ধাম” বলতে বোঝায় চারটি পবিত্র স্থান, যেখানে একবার তীর্থ করে আসা মানুষের পাপ মোচন হয় এবং মোক্ষ লাভের পথ প্রসারিত হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। এই চারটি তীর্থক্ষেত্র হল—বদ্রীনাথ (উত্তরে), দ্বারকা (পশ্চিমে), জগন্নাথ পুরী (পূর্বে) এবং রামেশ্বরম (দক্ষিণে)।
এই তীর্থযাত্রা শুধুমাত্র ভ্রমণ নয়, বরং আত্মশুদ্ধির এক অনন্য উপলক্ষও বটে।

🕉️ চার ধামের উৎপত্তি ও ধারণা

চার ধামের ধারণা প্রচলন করেন মহান আচার্য শংকরাচার্য। তিনি অষ্টম শতকে সারা ভারতে ধর্মীয় সংস্কার ও আধ্যাত্মিক জাগরণ আনতে চারটি প্রান্তে চারটি ধামের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ধর্মের মূল মন্ত্রকে দেশজুড়ে বিস্তার করা এবং মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ঐক্য ও আত্মিক উত্তরণ ঘটানো।

📍 চার ধামের পরিচিতি

১. বদ্রীনাথ ধাম (উত্তর ভারত)

অবস্থান: উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় হিমালয়ের নরনারায়ণ পর্বতের কোলঘেঁষে অবস্থিত।

প্রধান দেবতা: ভগবান বিষ্ণু (বদ্রীনারায়ণ রূপে)।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: এখানে শংকরাচার্য আধ্যাত্মিক তপস্যার আশ্রম স্থাপন করেছিলেন। পুরাণ অনুযায়ী, বদ্রীনাথ হল সেই স্থান যেখানে নারায়ণ তপস্যা করেছিলেন এবং লক্ষ্মী দেবী বাদামের গাছ (বদ্রি) হয়ে তাঁকে রোদ থেকে রক্ষা করেছিলেন।

মুখ্য আর্কিটেকচার: পাহাড়ের মাঝে কাঠ ও পাথরের মিলিত রীতিতে তৈরি মন্দির।

তীর্থকাল: এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, কারণ শীতকালে তুষারপাতের কারণে বন্ধ থাকে।

২. দ্বারকা ধাম (পশ্চিম ভারত)

অবস্থান: গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে আরব সাগরের তীরে।

প্রধান দেবতা: শ্রীকৃষ্ণ (দ্বারকাধীশ রূপে)।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: কৃষ্ণ এখানে Mathura থেকে স্থানান্তর করে রাজ্য স্থাপন করেন। এটি তাঁর রাজ্যপাটের স্থান। মহাভারতের বহু কাহিনি এই শহরকে ঘিরে আবর্তিত।

দ্বারকাধীশ মন্দির: এটি চৌহান শাসকের দ্বারা নির্মিত, ৭-তলা বিশিষ্ট বিশাল মন্দির।

তীর্থকাল: সারা বছরই ভক্তদের আনাগোনা দেখা যায়, বিশেষ করে জন্মাষ্টমীতে।

৩. জগন্নাথ পুরী (পূর্ব ভারত)

অবস্থান: ওড়িশার পুরী শহরে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে।

প্রধান দেবতা: ভগবান জগন্নাথ (কৃষ্ণ রূপে), বলভদ্র ও সুভদ্রা।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: এটি কৃষ্ণের এক বিশেষ রূপ। এই মন্দিরে একমাত্র স্থানে কৃষ্ণের কাঠের মূর্তি বিরাজমান। এখানেই অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বখ্যাত ‘রথযাত্রা’ উৎসব।

জগন্নাথ মন্দির: ১২ শতকে নির্মিত এই মন্দিরটি হিন্দু স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন।

বিশেষত্ব: “মহাপ্রসাদ”, রাঁধার নিয়ম ও বিতরণ পদ্ধতি এক অলৌকিক ঘটনা।

৪. রামেশ্বরম ধাম (দক্ষিণ ভারত)

অবস্থান: তামিলনাড়ুর রামনাথপুরম জেলায়, পাক প্রণালীতে অবস্থিত।

প্রধান দেবতা: শিব (রামনাথস্বামী রূপে)।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: রামায়ণ অনুযায়ী, ভগবান রাম এখানে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পুজো করেন লঙ্কা যাত্রার পূর্বে। সেই কারণে এই স্থান অত্যন্ত পবিত্র।

রামনাথস্বামী মন্দির: বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ করিডোর বিশিষ্ট দক্ষিণী শৈলীতে নির্মিত মন্দির।

অন্য নাম: হিন্দু ধর্মে এটি “বেণারসের পরে সর্বোচ্চ পুণ্যক্ষেত্র” হিসেবেও ধরা হয়।

🙏 চার ধামের তীর্থযাত্রার গুরুত্ব

◾ মোক্ষ লাভের আশ্বাস

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, জীবনে একবার চার ধাম দর্শন করলে মোক্ষ লাভ হয়, আর পুনর্জন্মের আবর্ত থেকে মুক্তি মেলে।

◾ পাপ মোচন

শাস্ত্রে বলা হয়েছে, এই ধামে পবিত্র স্নান, দান, পূজা ও জপ-তপ করলে মানুষের জন্মজন্মান্তরের পাপ ধুয়ে যায়।

◾ আত্মিক পরিশুদ্ধি

চার ধামের প্রত্যেকটির নিজস্ব পরিবেশ, অনুভব, ও আত্মিক প্রভাব আছে। পাহাড়, সমুদ্র, নদী ও উপকূলের মিশ্র পরিবেশ আত্মাকে শুদ্ধ করে।

🚩 আধুনিক যুগে চার ধাম যাত্রা

বর্তমানে সরকার চার ধাম যাত্রাকে অনেক সহজতর করে তুলেছে। “চার ধাম মহামার্গ” প্রকল্পের মাধ্যমে একাধিক হাইওয়ে নির্মাণ হয়েছে। পাশাপাশি হেলিকপ্টার পরিষেবা, ট্রেন, বাস, ও অনলাইন বুকিংয়ের সুযোগ বাড়ানো হয়েছে।

🔍 কিছু চমকপ্রদ তথ্য

বদ্রীনাথ ধামে একমাত্র ঠাণ্ডার মরসুম বাদে পূজা হয়।

রামেশ্বরমে রামের স্থাপন করা শিবলিঙ্গের পাশে অন্য এক শিবলিঙ্গ নেপাল থেকে আনা হয়েছিল।

জগন্নাথ মন্দিরে পতাকা প্রতিদিন উল্টো দিক থেকে ওড়ে।

দ্বারকায় এখনও সমুদ্রের নিচে ডুবে যাওয়া প্রাচীন শহরের নিদর্শন পাওয়া যায়।

🌿 উপসংহার

চার ধাম তীর্থ শুধু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক এক সফর নয়, এটি আত্মিক উৎকর্ষের এক গভীর অনুশীলন। শংকরাচার্যের প্রতিষ্ঠিত এই তীর্থগুলি আজও হিন্দু ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী হৃদয়ে এক গভীর ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে এই যাত্রায় অংশগ্রহণ করে চলেছেন।
জীবনে অন্তত একবার চার ধামের দর্শন জীবনের উদ্দেশ্য, কৃতজ্ঞতা, আত্মবোধ ও ঈশ্বর ভাবনার নব দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়।
‐——————–
—‐‐-‐-‐————–‐-

Share This
Categories
গল্প

শেষ ট্রেনের যাত্রী।

পর্ব ১: রাতের ট্রেন

সেদিন রাত সাড়ে দশটা। কুয়াশায় ঢাকা শীতের রাত। তরুণ সাংবাদিক ঋষি সরকার কলকাতা থেকে বর্ধমান ফিরছিলেন।
অফিসের কাজ শেষ করতে করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। কলকাতা স্টেশন থেকে শেষ লোকাল ট্রেন ধরা ছাড়া উপায় ছিল না।
ট্রেনটা যখন আসল, প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লাল বাতির নিচে কাঁপছিল এক ছায়া। ঋষি খেয়াল করল—একজন মহিলা। খুব ধীরে ধীরে ট্রেনের দিকে এগোচ্ছেন। মুখ ঢাকা লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে। বড্ড নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছিল।
ঋষি নিজের কামরায় উঠল। সে ছাড়া পুরো কামরায় আর কেউ নেই। একটা জানলার পাশে বসে সে মোবাইলে হেডফোন গুঁজে সংবাদ সম্পাদনা শুরু করল।

পর্ব ২: ছায়ার সঙ্গী

ট্রেন ছেড়ে দিলো।
কুয়াশা গিলে ফেলছে রেললাইনের দুই দিক। ট্রেনের আলোতে মাঝে মাঝে জ্বলজ্বল করে উঠছে কোনও পুরনো সিগন্যাল পোস্ট বা গাছের ছায়া।
হঠাৎ ট্রেনের ভিতর একটা শব্দ হলো—টিক…টিক…টিক…
ঋষি প্রথমে ভাবল মোবাইলের শব্দ। কিন্তু না—এটা যেন কারও চুড়ির শব্দ। পাশের কামরায় কেউ কি উঠল?
ঋষি উঠে গিয়ে দেখতে পেল—সেই সাদা শাড়ির মহিলা। তিনি কামরার একেবারে কোণার আসনে বসে জানালার দিকে মুখ করে আছেন। আলোতে মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।
ঋষি একটু অস্বস্তি বোধ করল, কিন্তু কিছু বলল না।
তখনই মহিলা মুখ ঘুরিয়ে বললেন—
“এই কামরাটা কি শুধু আপনার?”
ঋষি অবাক হয়ে বলল, “না তো! ট্রেন তো পাবলিক…”
মহিলা ধীরে ধীরে হেসে বললেন,
“তাহলে আপনি জানেন না, রাত সাড়ে দশটার পর এই ট্রেন আমার একার হয়।”
ঋষির বুকের মধ্যে শীতল কিছু জমে উঠল।

পর্ব ৩: মুখহীন গল্প

ঋষি সেই মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারছিল না, মজা করা হচ্ছে না কি…?
মহিলার মুখটা এখনও স্পষ্ট নয়। যেন কুয়াশায় আবৃত।
সে আবার বলল—
“এখানে কেউ বেশিক্ষণ থাকে না। যাঁরা থাকেন, তাঁদের আর কোথাও ফিরতে হয় না।”
ঋষি হাসল, “আপনি লেখিকা নাকি অভিনেত্রী? খুব অভিনয় করছেন মনে হচ্ছে।”
মহিলা হঠাৎ একটানা বললেন—
“১৯৭৮ সালের জানুয়ারির এক রাত ছিল। এই ট্রেনেই আমি ফিরছিলাম। ঠিক এই কামরায়, এই জানালার পাশে। একদল লোক এসে আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কারণ আমি বিধবা হয়েও মঞ্চে গান গাইতাম। সমাজ মেনে নেয়নি।”
ঋষির হাসি মুখে জমে গেল। সে সামনে তাকিয়ে দেখল—মহিলার মুখে মাংস নেই। কেবল পুড়ে যাওয়া চামড়া আর একটা গলিত চোখ।
সে চিৎকার করে উঠতে গেল, কিন্তু শব্দ বের হলো না। গলা শুকিয়ে কাঠ।

পর্ব ৪: ছেঁড়া টিকিট

ঋষি জ্ঞান হারাল না, বরং হঠাৎই নিজেকে খুঁজে পেল সেই পুরনো দিনের ট্রেনে। যেন টাইম মেশিনে ঢুকে গেছে।
এখন কামরায় বেশ কিছু যাত্রী। সবাই পুরনো ধাঁচের পোশাক পরা। কেউ রেডিও শুনছে, কেউ বিড়ি টানছে।
ঋষি তাকিয়ে দেখে—সেই মহিলা মঞ্চে গান গাইছে, “আমারে ছাড়িয়া বন্ধু…”
কিন্তু তখনই হঠাৎ তিনজন লোক এসে ওর উপর চড়াও হলো। কেরোসিন ঢালা, চিৎকার…আর তার পর আগুন!
ঋষি চিৎকার করে উঠল—
“না! কেউ ওকে বাঁচাও! বাঁচাও!!”
চোখ মেলে দেখে সে ট্রেনের সিটে বসে। গলা ভিজে গেছে ঘামে। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই।
শুধু তার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা ছেঁড়া টিকিট—১৯৭৮ সালের বর্ধমান লোকালের।

পর্ব ৫: শেষ স্টেশন

বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন ঢুকতেই ঋষি নেমে পড়ল। রাত তখন প্রায় ১টা।
প্ল্যাটফর্মে একজন বৃদ্ধ হকার চা বিক্রি করছিল। ঋষি ছুটে গেল ওর কাছে।
“এই ট্রেনে একটা মহিলা ছিল, সাদা শাড়ি পরা, পুড়ে গেছিল নাকি… এমন কেউ কি ছিল?”
চাওয়ালা তাকিয়ে বলল,
“আপনি ওনার কামরায় ছিলেন? ভাগ্য ভালো, ফিরে এসেছেন। সবাই তো ফেরে না। উনি গান পছন্দ করতেন, কিন্তু ওর গান সমাজ মেনে নেয়নি।”
“কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
চাওয়ালা বলল,
“কারণ আমি সেই রাতে ট্রেনেই ছিলাম। তখন আমি কেরোসিন নিয়ে এসেছিলাম…”
ঋষি হতভম্ব!
বৃদ্ধ হঠাৎ হেসে বলল,
“এখন আমিও মরেছি, আপনি বেঁচে থাকুন। এটাই অনেক।”
চাওয়ালা হঠাৎ মিলিয়ে গেল কুয়াশায়।
ঋষি মাথা ধরে স্টেশনের বেঞ্চে বসে পড়ল।

শেষ ভাগ: শিরোনাম ও পুনর্জন্ম

ঋষি বাড়ি ফিরে সেই কাহিনি লিখল।
নাম দিল—“শেষ ট্রেনের যাত্রী”
কোনও সম্পাদক সাহস পেল না ছাপাতে।
এক বছর পর, সেই স্টেশনের গায়ে একটা নামহীন কবরে সে একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি রাখল। আর লিখল—
“তোমার গান আমি শুনেছি, এবার তুমি শান্তিতে ঘুমাও।”

Share This