Categories
গল্প

রোদের নিচে জমে থাকা শীত।

(একটি শীতের দুপুরের প্রেমকাহিনি)

শীতের দুপুরগুলো অদ্ভুত।
সকাল যেমন কুয়াশায় ঢাকা থাকে, সন্ধে যেমন হিম হয়ে আসে—
দুপুর ঠিক তেমন নয়।
দুপুরে রোদ থাকে, অথচ শীত যায় না।
যেমন কিছু মানুষ—ভালোবাসা দেখায়, তবু দূরে থাকে।

সেদিনও এমনই এক শীতের দুপুরে,
কলকাতার উত্তর দিকের ছোট্ট পাড়াটার রাস্তায় হাঁটছিল নীলয়।

রোদ পড়েছে ঠিকই, কিন্তু বাতাসে এখনো কাঁপুনি।
হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে সে ধীরে হাঁটছিল।
আজ অফিস নেই।
ছুটির দিন—তবু কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই।

হঠাৎ চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সে।

এই দোকানটা তার খুব পরিচিত।
দু’তলা পুরনো বাড়ির নিচে, কাঠের বেঞ্চ, লোহার কেটলি,
আর সেই চেনা গন্ধ—চা, বিস্কুট, ধোঁয়া আর পুরনো সময়।

“এক কাপ লাল চা,” বলল নীলয়।

চা হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসতেই চোখ পড়ল জানালার দিকে।
আর ঠিক তখনই—

সে দেখল মিতালীকে

অনেক বছর পর।

মিতালী জানালার ধারে বসে আছে।
হালকা বাদামি সোয়েটার, খোলা চুল, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা।
হাতের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে,
আর মুখে সেই চেনা নির্লিপ্ত ভাব।

যেন কিছুই বদলায়নি।

নীলয়ের বুকের ভেতর হঠাৎ করে কিছু একটা নড়ে উঠল।
অনেকদিন পর কেউ হঠাৎ পুরনো গান বাজিয়ে দিলে যেমন হয়।

সে নিজেও বুঝল না কেন,
পা দুটো নিজে থেকেই মিতালীর দিকে এগোল।

“মিতালী?”
স্বরে সামান্য দ্বিধা।

মিতালী তাকাল।
চোখের পাতা এক মুহূর্ত কাঁপল।
তারপর ধীরে হাসল।

“নীলয়!”

এই এক শব্দে এত স্মৃতি জমে ছিল—
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।

“তুমি এখানে?”
মিতালী বলল।

“হ্যাঁ… মানে… মাঝে মাঝে আসি,”
নীলয় হালকা হেসে বলল।

“বসো,”
মিতালী সামনে রাখা চেয়ারটা টেনে দিল।

নীলয় বসল।
দুজনের মাঝখানে টেবিল, দু’কাপ চা,
আর বহু বছর না বলা কথা।

তাদের শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় সাত বছর আগে।
সেদিনও ছিল শীত।
তবে দুপুর নয়—সন্ধে।

সেই দিনটার কথা দুজনেই মনে রেখেছে।
কারণ সেদিনই সব শেষ হয়েছিল,
কিন্তু কেউ ঠিক করে কিছু শেষ করেনি।

“কেমন আছ?”
মিতালী জিজ্ঞেস করল।

“চলে যাচ্ছে,”
নীলয় বলল।
“তুমি?”

“আমি… ভালোই,”
একটু থেমে যোগ করল,
“মানে, থাকা যায়।”

এই ‘থাকা যায়’ কথাটার ভেতরেই মিতালীর সব কথা লুকিয়ে থাকে।
আগেও থাকত।

নীলয় জানে।

“এখন কোথায় থাকো?”
নীলয় জানতে চাইল।

“সল্টলেকে,”
“অফিস ওখানেই।”

“এখনো লেখালেখি করো?”
নীলয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

মিতালী তাকিয়ে রইল।
তারপর হালকা হেসে বলল,
“কখনো সখনো।”

এই উত্তরটার মানে নীলয় ভালো করেই বোঝে।
কখনো সখনো মানে—
মন খারাপ হলে,
শীতের দুপুরে,
অথবা পুরনো কেউ হঠাৎ সামনে এসে বসলে।

চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
তবু কেউ খেয়াল করছিল না।

বাইরে রোদ পড়েছে।
রাস্তায় মানুষজন, রিকশা, সাইকেল—সব চলছে।
কিন্তু এই টেবিলটার চারপাশে যেন সময় থেমে গেছে।

“তুমি কি বিয়ে করেছ?”
মিতালী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

নীলয় একটু থমকে গেল।
তারপর মাথা নাড়ল।

“না।”

“আমি… করেছিলাম,”
মিতালী বলল খুব আস্তে।

নীলয় জানত না কেন,
এই কথাটা শুনে তার ভেতর কোনো ব্যথা হলো না।
বরং একরকম শান্তি।

“কেমন?”
নীলয় জানতে চাইল।

মিতালী জানালার বাইরে তাকাল।
রোদের দিকে।

“শেষ হয়ে গেছে,”
বলল সে।
“কিছু জিনিস টেকে না।”

নীলয় চুপ করে থাকল।
এই কথার মানে সে বুঝতে পারে।

তাদের গল্পটা শুরু হয়েছিল কলেজে।
শীতের দুপুরে লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে।

মিতালী তখন কবিতা লিখত।
নীলয় পড়ত, শুনত, বোঝার চেষ্টা করত।

তাদের ভালোবাসা ছিল শান্ত।
কোনো নাটক নেই, কোনো চিৎকার নেই।
শুধু দুপুরের রোদ,
চায়ের কাপ,
আর দীর্ঘ নীরবতা।

সমস্যা এসেছিল তখনই—
যখন জীবনের গতি বদলাতে শুরু করেছিল।

নীলয়ের চাকরি,
মিতালীর লেখালেখি,
দুজনের আলাদা আলাদা স্বপ্ন।

তারা ঝগড়া করেনি।
শুধু কথা বলা কমে গিয়েছিল।
আর একদিন—
কথা বলা পুরোপুরি থেমে গিয়েছিল।

“তোমার মনে আছে?”
মিতালী হঠাৎ বলল।
“সেই শীতের দুপুরটা?”

নীলয় হাসল।
“যেটাতে তুমি বলেছিলে—
ভালোবাসা মানে চুপ করে পাশাপাশি বসে থাকা?”

“হ্যাঁ,”
মিতালীও হাসল।
“আমি এখনো তাই ভাবি।”

নীলয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমিও।”

দুজনেই জানত—
এই কথাটার ভেতর অনেক কিছু আছে।
কিন্তু সেগুলো আর বের করার দরকার নেই।

বাইরে রোদ একটু ঢলে পড়েছে।
শীতের দুপুর ধীরে ধীরে বিকেল হচ্ছে।

মিতালী উঠে দাঁড়াল।

“আমাকে যেতে হবে,”
বলল সে।

নীলয় মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ।”

দুজনেই জানত—
এই যাওয়াটা চূড়ান্ত নয়,
আবার নয়।

দরজার কাছে এসে মিতালী থামল।
একটু ভেবে বলল,
“কখনো… আবার দেখা হবে?”

নীলয় জানত,
এই প্রশ্নটার উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’—
কোনোটাই পুরো সত্য নয়।

তবু বলল,
“হতে পারে।”

মিতালী হালকা হাসল।
তারপর চলে গেল।

নীলয় আবার বেঞ্চে বসল।
ঠান্ডা চা হাতে নিল।

শীতের দুপুর তখন শেষের পথে।
রোদ কমছে,
কিন্তু ভেতরের ঠান্ডা একটু কমেছে।

সে বুঝল—
কিছু ভালোবাসা শেষ হয় না।
শুধু জমে থাকে।

শীতের দুপুরের মতো।
রোদের নিচে,
চুপচাপ।


✨ শেষ ✨

 

Share This
Categories
গল্প

গল্প : দোতলা বাস আর প্রথম প্রেম।

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরতে দোতলা বাস ধরত রিয়া।
একদিন উপরের সিটে বসে দেখল—একটা ছেলে তাকে দেখে হাসছে। নাম—সমর।

ধীরে ধীরে প্রতিদিন একই বাসে দেখা হতে হতে তারা কথা বলতে শুরু করল।
একদিন বাস খুব ভিড়। সামান্য ধাক্কায় রিয়ার হাত থেকে বই পড়ে গেল।
সমর ঝুঁকে বই তুলে দিয়ে বলল—“তোমার বই, কিন্তু কাহিনীটা আমার মতো মনে হচ্ছে—তুমিও আমাকে পছন্দ করো, তাই না?”

রিয়া লজ্জায় বলল—
“তুমি সবকিছু এত সহজে কিভাবে বলো?”

সমর মুচকি হেসে বলল—
“সত্যি কথা বলতে সাহস লাগে, কিন্তু চেষ্টা করলে কঠিন না।”

সেদিন থেকে বাসের সিটটাই হয়ে উঠল তাদের ছোট্ট পৃথিবী।
নগরীর শব্দ, মানুষের ভিড়—সবকিছু ম্লান হয়ে দুইজনের হাসি আর কথা।
একদিন সমর বলল—“বাসের ভিড়ের চেয়ে তোমাকে হারানোর ভয়টাই বড়।”

রিয়া হাসল—“তাহলে হারিয়ো না আমাকে।”

Share This
Categories
গল্প

গল্প : আধখানা গল্প।

লেখক অভিজিৎ বছরের পর বছর ধরে নিজের উপন্যাস লিখছে—কিন্তু শেষ অধ্যায়টা লিখতেই পারছে না।
কারণ? গল্পে যে মেয়েটি আছে—মীরা—তার বাস্তব রূপকে সে হারিয়েছে পাঁচ বছর আগে।

এক সন্ধ্যায় বইমেলায় গিয়ে অভিজিৎ চমকে উঠল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মীরা—হুবহু একই।
মীরা বলল—“তোমার লেখা পড়েছি। সেখানে আমি কেন হারিয়ে যাই?”

অভিজিৎ বলল—
“কারণ বাস্তবে তুমিই হারিয়ে গিয়েছিলে… কারণ না জানিয়েই।”

মীরা চোখ নামিয়ে বলল—
“পরিস্থিতি ছিল… তুমি বুঝতে না।”

দু’জনই চুপ। বইমেলার ভিড়, আলো এবং গন্ধ যেন দূর হয়ে গেল।

মীরা বলল—
“এখন যদি বলি—আবার শুরু করতে চাই… তুমি রাখবে?”

অভিজিৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলল—
“আমার গল্প তো আধখানা হয়ে বাকি আছে। শেষটা লিখব কী করে? যা হারিয়েছিলাম তা যদি ফিরেই আসে… তাহলে হয়তো শেষটা লিখতে পারব।”

মীরা ধীরে অনিকের হাত ধরল—
“শেষটা তবে আমাদের দু’জনের লেখা হোক।”

Share This
Categories
গল্প

গল্প : ভুল নামের নোটবুক।

অনিকের অফিসে নতুন ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দিল তির্থা। প্রথম দিনেই সে ভুল করে অনিকের ডেস্কে নিজের নোটবুক রেখে চলে যায়। নোটবুকের ওপরে বড় করে লেখা—“তির্থার ডায়েরি – কেউ খুলবে না।”
অনিক প্রথমে ফেরত দিতে চাইছিল, কিন্তু কৌতূহলে একটু উঁকি মারতেই দেখল প্রথম পাতায় লেখা—

“নিজের মনের কথা কারও কাছে বলতে পারি না…
তাই ডায়েরির কাছে বলি।
যদি কখনো কেউ এই ডায়েরি পড়ে…
জেনে নিও—আমি খুব একাকী।”

এটা পড়ার পর থেকেই তির্থাকে আর সাধারণ ইন্টার্ন মনে হলো না তার কাছে।
পরের দিন নোটবুক ফেরত দিতে গিয়ে সে দেখল তির্থা একটু অগোছালো, একটু চঞ্চল, একটু মিষ্টি।

ধীরে ধীরে দু’জনের মধ্যে কথা বাড়ল।
তির্থা ধীরে ধীরে নিজের মন খুলতে লাগল—তার একজন ছিল, যে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে হঠাৎ হারিয়ে গেছে।
অনিক মন দিয়ে শুনত, শুধু বলত—“সব হারানো মনে রেখে বসে থাকলে নতুন আলো তো আসবে না।”

একদিন লাঞ্চ ব্রেকে তির্থা বলল—
“তুমি জানো, তুমি প্রথম যে মানুষ—যার সাথে কথা বললে আমার ভয় লাগে না।”

অনিক হেসে বলল—“তাহলে ভয়হীন থাকার অনুশীলনটা আমার সঙ্গেই করে যাও।”

তির্থা চুপ করে অনিকের দিকে তাকালো। যেন বুঝে গেল—একাকীত্ব থেকে বের হওয়ার পথ হয়তো এ মানুষটাই।

মাসখানেক পরে, অফিসের ছাদে দাঁড়িয়ে তির্থা বলল—
“অনিক, তুমি যদি সত্যি মনে করো… আমরা একসঙ্গে হাঁটতে পারি… তাহলে আমি রাজি।”

অনিক বলল—
“আমি তো প্রথম দিনই নোটবুক খুলেই বুঝেছিলাম—আমি তোমাকে সামলাবো।”

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

গল্প : হারিয়ে পাওয়া কণিকা।

অরূপ ট্রেনে বসে ছিল। তাকে বিপরীতে বসা মেয়েটির চোখ বারবার কিছু বলতে চাইছিল।
নাম—কণিকা।
দু’জনের কথাবার্তা মিলল, গল্প জমল, হাসি থামছিল না।

স্টেশন এলে কণিকা নেমে গেল। কিন্তু তার ব্যাগে ভুল করে অরূপের দেওয়া বইটা থেকে গেল।
বইয়ের ভিতরে অরূপের নম্বর।

দু’দিন পর অরূপের ফোনে একটি মিষ্টি কণ্ঠস্বর—
“আমি কণিকা… আপনার বইটা আছে আমার কাছে।”

এভাবেই শুরু তাদের নিয়মিত কথা…
একদিন কণিকা বলল—“এবার দেখা হবে?”

সেই দেখা-টাকেই তারা দু’জনই আজীবন মনে রাখল।
মনে হল—যেন একে অপরকে তারা আগেই চিনত… শুধু সময়ই তাদের মিলিয়ে দিল।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

গল্প : ফুলওয়ালার প্রেম।

রাজীব শহরের একটি ফুলের দোকানে কাজ করত। প্রতিদিন সকালে সে ফুল সাজাতে ব্যস্ত থাকত।
একদিন দেখল—একটা মেয়ে প্রতিদিন একই সময় একটা গোলাপ কিনে নিয়ে যায়।
মেয়েটির নাম—মেঘলা।

রাজীবের মনে প্রশ্ন—কার জন্য এত গোলাপ?

একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করল—“আপনি কি কারো জন্য ফুল নেন?”
মেঘলা একটু দুঃখ নিয়ে বলল—“না। আমার মা গোলাপ খুব ভালোবাসতেন… তাই তাঁর স্মৃতিতে রাখি।”

রাজীব বুঝল—মেঘলার চোখের হাসির পিছনে লুকানো বিষাদ।
পরের দিন সে তাকে একটা সাদা গোলাপ উপহার দিল।
মেঘলা অবাক—“এর দাম?”
রাজীব বলল—“কখনো কখনো কিছু জিনিস দামের নয়—অনুভূতির।”

সেই দিন থেকে তাদের আলাপ বাড়ল, আর ধীরে ধীরে মেঘলার চোখের দুঃখটা একটু একটু করে কমতে থাকল।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প নারী কথা

গল্প : নীল শাড়ির মেয়ে।

অভি প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার পথে বাসস্ট্যান্ডে একই মেয়েটিকে দেখত—নীল শাড়ি, কপালে ছোট টিপ, আর শান্ত দু’টো চোখ।
মেয়েটির নাম ছিল—ঋদ্ধিমা।

অভি সাহস করে কোনও দিন কথা বলেনি, শুধু দূর থেকে দেখেই যেত।
একদিন কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অভি গান গাইছিল। গান শেষে কেউ একজন বলল—
“তুমি খুব সুন্দর গাও।”
অভি তাকিয়ে দেখল—ঋদ্ধিমা!

তারপর থেকেই দু’জনের মধ্যে ছোট ছোট কথা, হাসি…
একদিন ঋদ্ধিমা বাসে উঠতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যাচ্ছিল। অভি ধরল তাকে।
ঋদ্ধিমা হেসে বলল—“তুমি না থাকলে আজ হাড্ডি ভেঙে যেত।”

অভি সাহস সঞ্চয় করে বলল—“দূর থেকে দেখতাম… কিন্তু বলতে পারিনি—তোমাকে ভালো লাগে।”

ঋদ্ধিমা প্রথমে অবাক, তারপর মুখটা লজ্জায় লাল।
সে বলল—“আমি ভেবেছিলাম শুধু আমিই দেখি তোমাকে।”

সেইদিন প্রথমবার দু’জন একসঙ্গে হাঁটল—ফুটপাতের পাশে কাঁচের দোকানে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে দু’জনই হেসে ফেলল।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

গল্প : বৃষ্টিভেজা দুপুরে।

মেঘভাঙা বৃষ্টির দুপুরে অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ঝর্ণা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল—ভিজে যাওয়ার ভয় নেই, কিন্তু একা থাকার ভয় ছিল। বৃষ্টি সবসময়ই তাকে অতীতের কোনো অদ্ভুত স্মৃতিতে ফিরিয়ে দিত।

হঠাৎ একটা ছাতা মাথার উপরে থামল।
তপন—ওদের অফিসের নতুন ছেলেটা।
সে হাসলো—“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো পুরোপুরি ভিজে যাবে।”

ঝর্ণা একটু অপ্রস্তুত হলেও ছাতার নিচে দাঁড়াল। বৃষ্টির শব্দে কথাগুলো ভেঙে যাচ্ছিল, কিন্তু একটা অদ্ভুত শান্তি নেমে এলো দুই জনের মাঝে।

বাস এল না। রাস্তায় জল জমে গিয়েছে।
তপন বলল—“চলো, ওখানে চায়ের দোকান আছে। বৃষ্টি থামা পর্যন্ত বসি।”

চায়ের কাপে গরম ধোঁয়া। বাইরে মেঘের গর্জন।
ঝর্ণা আস্তে বলল—“বৃষ্টি আমার ভালো লাগে না।”
তপন জিজ্ঞেস করল—“তবে এতক্ষণ ভিজে দাঁড়িয়ে ছিলে?”
ঝর্ণা উত্তর দিল—“কারো জন্য অপেক্ষা করছিলাম… কিন্তু সে আর আসে না।”

তপন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—
“কখনো কখনো যারা আসে না, তাদের জন্য অপেক্ষা করাটাই ভুল। বরং যারা পাশে দাঁড়ায়—তাদের চিনতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ।”

ঝর্ণা তাকাল তপনের দিকে।
এ প্রথম অনুভব করল—কেউ তাকে বোঝার চেষ্টা করছে।

বৃষ্টি থামার পর দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরল।
সেদিনের বৃষ্টিটা ঝর্ণার আর খারাপ লাগল না।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

গল্প: “শেষ বিকেলের চিঠি”

সন্ধ্যার শেষে রং মাখা আকাশের নিচে রুদ্রর হাতে কাঁপছিল একটি পুরনো খাম। গ্রামের স্কুলের শেষ বেঞ্চে বসে পড়াশোনা করা দুই বন্ধু—রুদ্র আর মহুয়া। তাদের বন্ধুত্বটা ছিল খুব স্বাভাবিক, কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য একটা অনুভূতি ভিড় জমিয়েছিল দু’জনের হৃদয়ে।

মহুয়া কলকাতায় নার্সিং পড়তে যাবে—এই খবরটা শোনার পর থেকেই রুদ্রর ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। বহুদিন ধরে বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সাহস পাইনি। তাই লিখে ফেলেছিল একটা চিঠি—কিন্তু সেই চিঠি কখনোই দেওয়া হয়নি।

যেদিন বিদায় নেবে মহুয়া, সেদিন রুদ্র তাকে নিয়ে গেল তাদের প্রিয় নদীর ধারে। চারদিক নরম বাতাসে ভরে আছে। তার হাত কাঁপছিল, গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল—
“তুই চলে যাওয়ার আগেই এটা তোকে দিতে চাই।”

মহুয়া চিঠি খুলে দেখল—মাত্র তিনটি শব্দ: “আমি তোকে ভালবাসি।”
নীরবতা তৈরি হল। বাতাসের শব্দও যেন থেমে গেল।

মহুয়া রুদ্রর দিকে তাকিয়ে চোখের জল আটকাতে পারল না।
“এতদিন বলতে পারলি না?”
রুদ্র মাথা নিচু করে বলল, “হারানোর ভয় ছিল।”
মহুয়া তার হাত ধরল—“তুই আমাকে হারাবি না, রুদ্র। আমি ফিরব। আমার পড়াশোনা শেষ হলে এ নদীর ধারে আবার দাঁড়াব—তোর পাশে।”

রুদ্র কিছু বলল না। কিন্তু সে জানল—এ অপেক্ষাই হবে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রতীক্ষা।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

“শেষ বিকেলের আলো” — একটি প্রেমের গল্প।

শহরের ব্যস্ত রাস্তাটা প্রতিদিনের মতোই শব্দে ভরা। কিন্তু সেই দিনের শেষ বিকেলটা অদ্ভুত নরম ছিল। রোদটা যেন একটু বেশি কোমল, আর বাতাসে ছিল কেমন যেন অজানা এক টান।

নীলা কলেজ থেকে ফিরছিল। হাতে আঁকা খাতাটা বুকে জড়িয়ে হাঁটছিল ধীর পায়ে। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল অয়ন—তার পুরোনো স্কুল বন্ধু। বহুদিন পর দেখা হওয়ায় তারা দু’জনেই একটু অবাক, একটু অস্বস্তি।

“এতদিন কোথায় ছিলে?” নীলা হেসে জিজ্ঞেস করল।

অয়নও হেসে বলল, “ছিলাম তো… এখানেই। তুমি-ই ব্যস্ত হয়ে পড়লে।”

তাদের কথাবার্তা ধীরে ধীরে নরম হতে লাগল। পুরোনো দিনের স্মৃতি, ছোটখাটো দুষ্টুমি, ক্লাস ফাঁকি—সব ফিরে আসতে লাগল। অয়ন বুঝতে পারছিল, এত বছর পরও নীলার চোখের সেই কোমল হাসিটা তাকে ঠিক একইভাবে নাড়া দেয়।

কথা বলতে বলতে তারা হাঁটতে লাগল। হঠাৎ করে নীলা থেমে গেল।

“ওই রোদের আলোটা দেখো না… কত সুন্দর, তাই না?”
অয়ন তাকাল। রোদের আলো নীলার চুলে পড়ে যেন সোনালি হয়ে উঠেছে।

তার বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা অনুভূতি জমতে লাগল।
কথা না ভেবে বলে ফেলল—
“নীলা, তুমি জানো… তুমি হাসলে মনে হয় পুরো দিনটাই সুন্দর হয়ে গেল।”

নীলা অবাক হয়ে তাকাল। চোখে একফোঁটা লাজুক ঝিলিক।

“এতদিন পর আজ এটা বললে?”
“হ্যাঁ… কারণ আজ বুঝলাম, কথা না বললে বোধহয় ভুল হয়ে যাবে।”

নীলা ধীরে ধীরে মাথা নিচু করল।
তারপর খুব নরম স্বরে বলল—
“তুমি দেরি করেছ, অয়ন… কিন্তু তবুও… আমি অপেক্ষা করছিলাম।”

শেষ বিকেলে দু’জনের ছায়া লম্বা হয়ে একসাথে মিশে গেল।
রাস্তা একই রইল, শহরও একই। কিন্তু তাদের জন্য পৃথিবীটা ঠিক তখনই একটু বদলে গেল।

Share This