Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

একটি পরিবারে নারীর ভূমিকা।।

ভূমিকা

মানবসমাজের ইতিহাসে পরিবার একটি মৌলিক একক। পরিবার গড়ে ওঠে ভালোবাসা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। আর এই পরিবারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে, একে সুসংহত ও সমৃদ্ধ রাখতে নারীর ভূমিকা অপরিসীম।

নারী শুধু মা, বোন, কন্যা বা স্ত্রী হিসেবে পরিচিত নন, বরং তিনি একজন সংরক্ষক, সৃষ্টিশীল চিন্তক, সংস্কৃতির ধারক ও মানসিক শক্তির উৎস। ভারতীয় সমাজসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে নারী পরিবারকে শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিক ও নৈতিক দিক থেকেও ধরে রাখেন।


১. পরিবারে নারীর ঐতিহাসিক ভূমিকা

১.১ প্রাচীন সমাজে নারী

ভারতীয় সভ্যতায় নারীকে গৃহদেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

  • বেদের যুগে নারী ছিলেন শিক্ষিত, দর্শন ও শাস্ত্রচর্চায় পারদর্শী।
  • গার্হস্থ্য জীবনে তিনি ছিলেন পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু – অন্নপূর্ণার প্রতীক।

১.২ মধ্যযুগে অবস্থার পরিবর্তন

মধ্যযুগে নানা সামাজিক কারণে নারী কিছুটা গৃহবন্দি হয়ে পড়েন।

  • পর্দা প্রথা, বাল্যবিবাহ, শিক্ষার অভাব – এসব কারণে নারীর স্বাধীনতা সীমিত ছিল।
  • তবু তিনি পরিবারের মূল ভরসা ছিলেন – রান্না, সন্তান লালনপালন, গৃহস্থালি সামলানো সবই তাঁর হাতে।

১.৩ আধুনিক যুগে পরিবর্তন

শিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের ফলে আধুনিক কালে নারীর ভূমিকা বহুমাত্রিক হয়েছে।

  • আজ তিনি কর্মজীবী, শিক্ষিত, আর্থিকভাবে স্বনির্ভর।
  • পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে।

২. পরিবারে নারীর মানসিক ভূমিকা

২.১ আবেগীয় ভারসাম্য রক্ষা

নারী প্রায়শই পরিবারের মানসিক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেন।

  • সন্তানদের মানসিক বিকাশ, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক, আত্মীয়তার জাল – সব কিছুতে তাঁর কূটনৈতিক ভূমিকা থাকে।
  • পারিবারিক দ্বন্দ্ব মেটাতে তিনি মধ্যস্থতাকারী।

২.২ ভালোবাসা ও সহানুভূতি

নারীর স্নেহ পরিবারকে একত্রে রাখে।

  • মায়ের ভালোবাসা শিশুর চরিত্র গঠনের ভিত্তি।
  • স্ত্রী হিসেবে তিনি স্বামীকে মানসিক সমর্থন দেন।

৩. পরিবারে নারীর সামাজিক ভূমিকা

৩.১ মূল্যবোধের সংরক্ষণ

নারী প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নৈতিকতা ও সংস্কৃতির শিক্ষা দেন।

  • তিনি সন্তানদের মধ্যে শৃঙ্খলা, সহমর্মিতা, মানবিকতা গড়ে তোলেন।
  • পারিবারিক ঐতিহ্য ও উৎসবের ধারক।

৩.২ সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা

পরিবারের সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় নারীর অবদান বড়।

  • আত্মীয়, প্রতিবেশী, পাড়া-প্রতিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন।
  • সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিয়ে পরিবারের সম্মান বাড়ান।

৪. অর্থনৈতিক ভূমিকা

৪.১ গৃহস্থালি পরিচালনা

নারী সংসারের আর্থিক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ।

  • সংসারের খরচ, সঞ্চয়, বাজেট – সব কিছু তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন।
  • অনেক ক্ষেত্রেই সংসারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তিনি।

৪.২ কর্মজীবী নারী

আজ অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে সফল।

  • চাকরি বা ব্যবসার মাধ্যমে পরিবারে আর্থিক অবদান রাখেন।
  • দ্বিগুণ দায়িত্ব সামলে পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যান।

৫. সন্তান লালনপালনে নারীর ভূমিকা

৫.১ প্রথম শিক্ষক

মা শিশুর প্রথম গুরু।

  • ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ সবকিছু তিনি শেখান।
  • সন্তানের মনোবিজ্ঞান বোঝেন ও তার বিকাশে সাহায্য করেন।

৫.২ শিক্ষার পরিবেশ

নারী বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করেন।

  • তিনি সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, পড়াশোনায় সাহায্য করা, স্বপ্ন দেখাতে উৎসাহ দেন।

৬. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভারসাম্য

পরিবারে নারীর ভূমিকা শুধু মায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

  • তিনি স্বামীর সঙ্গী, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক।
  • সংসারের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখা – সংসারের স্থিতিশীলতার মূল।

৭. আধুনিক চ্যালেঞ্জ

৭.১ দ্বৈত ভূমিকা

কর্মজীবী নারীদের জন্য পরিবার ও অফিসের ভারসাম্য রাখা কঠিন।

  • মানসিক চাপ ও সময়ের অভাব দেখা দেয়।

৭.২ সামাজিক বাঁধাধরা ধারণা

আজও অনেক স্থানে নারীকে শুধুমাত্র গৃহিণীর ভূমিকায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাওয়া হয়।

৭.৩ মানসিক স্বাস্থ্য

পারিবারিক দায়িত্ব, সন্তান, কর্মজীবন সামলে নারীর মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে।


৮. সমাধান ও অগ্রযাত্রা

৮.১ শিক্ষা ও সচেতনতা

নারীর শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।

  • শিক্ষিত নারী পরিবারের মান উন্নত করেন।

৮.২ পুরুষের সহায়তা

পরিবারে পুরুষকেও সমান দায়িত্ব নিতে হবে।

  • গৃহকর্ম ও সন্তান পালনে অংশগ্রহণ জরুরি।

৮.৩ মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

নারীর জন্য কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বাড়ানো উচিত।


উপসংহার

নারী পরিবারে মেরুদণ্ডের মতো। তিনি শুধু একজন মা বা স্ত্রী নন, বরং একজন শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, মনোবিদ, সামাজিক কর্মী ও ভবিষ্যত প্রজন্মের গড়নশিল্পী

আজকের দিনে যখন নারী ক্রমশ শিক্ষিত ও স্বনির্ভর হচ্ছেন, তখন সমাজেরও উচিত তাঁকে সমান মর্যাদা ও সহযোগিতা দেওয়া। পরিবারে নারীকে সম্মান দিলে পরিবার হয় শান্তিপূর্ণ, সুখী ও সমৃদ্ধ। আর সেই পরিবারই তৈরি করে একটি সুস্থ সমাজ ও শক্তিশালী দেশ।

 

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

আজ নারী সমতা দিবস, জানুন তার ইতিহাস এবং কেন পালিত হয়ে আসছে এই দিনটি।।।।।।

 

আজকের যুগে নারীরা অনেক এগিয়ে। সমগ্র বিশ্ব দেখেছে নারীরা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম। কোনও কাজেই আজ নারীরা পুরুষদের থেকে পিছিয়ে নেই। এখন বিশ্বব্যাপী এখন অনেক সংস্থা গড়ে উঠেছে, যারা নারীদের প্রতি নিপীড়ন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে, সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে নারীদের সমান সুযোগ প্রদান করে চলেছে। পুরুষের সঙ্গে সমান তালে পা মিলিয়ে এগিয়ে ছলছে নারীরা। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি অনস্বীকার্য। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা তাদের যোগ্যতার ছাপ ফেলে যাচ্ছে। খেলা ধুলা, শিক্ষা দীক্ষা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা সর্বক্ষেত্রে তারা নিজেদের যোগ্যতার সাক্ষর রেখে যাচ্ছে। পুরুষের থেকে তারাও যে কোনো অংশে কম নয় তা বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের সাফল্য দিয়ে। ফলস্ববরূপ তাদের এই জয়। সেদিনের আধিকার লড়াই এর সাফল্য।
আমেরিকান কংগ্রেস এবং আমেরিকার ৩৭তম রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৩ সালের  ২৬ অগস্ট দিনটিকে ‘নারী সমতা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকায় এই দিবস উদযাপন শুরু হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে নারী সমতা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ১৯২০ সালের ঊনবিংশ সংশোধনী (সংশোধন XIX) গৃহীত হওয়ার স্মরণে ২৬শে আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীর সমতা দিবস উদযাপন করা হয়, যা যুক্তরাষ্ট্র এবং ফেডারেল সরকারকে নাগরিকদের ভোটের অধিকার অস্বীকার করা থেকে নিষিদ্ধ করে।  লিঙ্গ ভিত্তিতে রাষ্ট্র.  এটি প্রথম ১৯৭১ সালে পালিত হয়েছিল, ১৯৭৩ সালে কংগ্রেস দ্বারা মনোনীত হয়েছিল, এবং প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি দ্বারা ঘোষণা করা হয়।মহিলাদের অধিকার নিয়ে ৭২ বছরের কঠোর পরিশ্রম ও প্রচারের পর ১৯২০ সালে সফলতা পায় মহিলারা ৷
ইতিহাস—

যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের আগেই শুরু হয়েছিল নারীদের ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ রাজ্যে কেবল ধনী শ্বেতাঙ্গ পুরুষদেরই ভোটের অধিকার ছিল ১৮৩০-এর দশকের দিকে । প্রথমবার নারী সমতা বা নারী সমানাধিকার নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছিল ১৮৪৮ সালে নিউইয়র্কে Women’s Rights Convention-এ ।  পরবর্তী সময়ে এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন এর নেতৃত্বে ১৮৯০-এর দশকে, ন্যাশনাল আমেরিকান ওমেন স্যাফারেজ অ্যাসোসিয়েশন শুরু হয়। এই দশক শেষ হওয়ার আগে, আইডাহো এবং ইউটা মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার মিলেছিল। ১৯১০ সালে অন্যান্য পশ্চিমী রাজ্যগুলি মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার দিতে শুরু করে। তবে তখনো বেশ কয়েকটি পূর্ব এবং দক্ষিণী রাজ্যে মহিলাদের ভোটারাধিকারে স্বীকৃতি মেলেনি। এর পর, ১৯২০ সালের ২৬ অগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ১৯তম সংশোধনী গৃহীত হয়, যেখানে মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার পান।
তারিখটি ১৯২০ সালে সেই দিনটিকে স্মরণ করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল যখন সেক্রেটারি অফ স্টেট বেইনব্রিজ কোলবি আমেরিকান মহিলাদের ভোট দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার দেওয়ার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন।  ১৯৭১ সালে, ১৯৭০ সালের দেশব্যাপী নারীদের সমতার জন্য ধর্মঘট এবং আবার ১৯৭৩ সালে, সমান অধিকার সংশোধনী নিয়ে লড়াই চলতে থাকলে, নিউইয়র্কের কংগ্রেসওম্যান বেলা আবজুগ ২৬শে আগস্টকে নারীর সমতা দিবস হিসেবে মনোনীত করার জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
১৯৭২ সালে, রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ২৬ আগস্ট, ১৯৭২কে “নারী অধিকার দিবস” হিসাবে মনোনীত করেছিল এবং এটি ছিল নারীর সমতা দিবসের প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।  ১৯৭৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেস এবং আমেরিকার ৩৭তম রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ অগস্ট দিনটিকে ‘নারী সমতা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।  আমেরিকার মহিলাদের প্রথম ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল।  একই দিনে, রাষ্ট্রপতি নিক্সন নারী সমতা দিবসের জন্য ঘোষণা ৪২৩৬ জারি করেছিলেন, যা শুরু হয়েছিল, অংশে: “মহিলাদের ভোটাধিকারের সংগ্রাম, যাইহোক, আমাদের জাতির জীবনে মহিলাদের পূর্ণ এবং সমান অংশগ্রহণের দিকে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে,  আমরা আমাদের আইনের মাধ্যমে লিঙ্গ বৈষম্যকে আক্রমণ করে এবং মহিলাদের জন্য সমান অর্থনৈতিক সুযোগের জন্য নতুন পথ প্রশস্ত করার মাধ্যমে অন্যান্য বিশাল অগ্রগতি করেছি৷ আজ, আমাদের সমাজের কার্যত প্রতিটি ক্ষেত্রে, মহিলারা আমেরিকান জীবনের গুণমানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে৷ এবং এখনও,  এখনও অনেক কিছু করা বাকি আছে।”
২০২১ সাল পর্যন্ত, রিচার্ড নিক্সনের পর থেকে প্রতিটি রাষ্ট্রপতি প্রতি বছর ২৬ আগস্টকে নারী সমতা দিবস হিসাবে মনোনীত করে একটি ঘোষণা জারি করেছেন। তাই এই দিনটি মহিলাদের সমান অধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হয়।আমেরিকায় এই দিবস উদযাপন শুরু হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে নারী সমতা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

আরতি গুপ্ত : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সাহসী নারী বিপ্লবী।

ভূমিকা:- ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে নারী বিপ্লবীদের অবদান আজও অনেকাংশে অপ্রকাশিত থেকে গেছে। তাঁদের জীবন ও সংগ্রাম কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের জন্যই ছিল না, বরং তা ছিল আত্মমর্যাদা, জাতীয়তাবোধ এবং সামাজিক পরিবর্তনের এক অদম্য প্রয়াস। আরতি গুপ্ত ছিলেন সেই ধরনেরই এক সাহসী নারী, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন। যদিও তাঁর নাম হয়তো অনেকের কাছে অপরিচিত, তবু তাঁর কর্মজীবন, সংগ্রামী মানসিকতা এবং আত্মত্যাগের ইতিহাস ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অমূল্য সম্পদ।

শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি

আরতি গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (প্রায় ১৯১০–১৯১৫ সালের মধ্যে) তৎকালীন বেঙ্গল প্রদেশের (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের) একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন এক সুপরিচিত শিক্ষাবিদ ও সামাজিক কর্মী, যিনি জাতীয়তাবাদী চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। মা ছিলেন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা নারী, যিনি আরতিকে ছোট থেকেই দেশপ্রেমের গল্প শুনিয়ে বড় করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই আরতি সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যে গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং পড়াশোনার পাশাপাশি নাটক, আবৃত্তি ও দেশাত্মবোধক গান গাওয়ায় দক্ষ ছিলেন।

শিক্ষাজীবন ও রাজনৈতিক প্রেরণা

আরতির স্কুলজীবন কেটেছে কলকাতার একটি গার্লস’ স্কুলে। সেখানেই তিনি প্রথম গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিপ্লবী কার্যকলাপ এবং বাঘা যতীনের মতো বীরদের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হন।
কিশোরী বয়সেই তিনি যুগান্তর দল ও অগ্নিবীণা সমিতি-এর মতো বিপ্লবী সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর এক সহপাঠিনীর মাধ্যমে তিনি গোপনে বিপ্লবী সাহিত্য পড়া শুরু করেন এবং অস্ত্র সংগ্রহ, গোপন বার্তা আদানপ্রদান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।

বিপ্লবী জীবনের সূচনা

আরতি গুপ্ত প্রথম সক্রিয় ভূমিকা নেন ১৯৩০ সালে সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স মুভমেন্ট বা নাগরিক অবাধ্যতা আন্দোলনের সময়। তখন তিনি মাত্র কুড়ি বছরের এক তরুণী। কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ মিছিলে তিনি সরাসরি অংশ নেন এবং পুলিশি লাঠিচার্জের মুখে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশবিরোধী স্লোগান দেন।
এই সময় তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ও মহিলা আত্মরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিপ্লবীদের জন্য গোপন আশ্রয়, অস্ত্র পরিবহন এবং গোপন নথি লুকিয়ে রাখার কাজে ভূমিকা রাখেন।

উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড

১. অস্ত্র পরিবহন অভিযান

১৯৩২ সালে বেঙ্গলে ব্রিটিশ পুলিশ যখন বিপ্লবী সংগঠনগুলোর উপর দমননীতি চালায়, তখন আরতি গুপ্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশনে অংশ নেন। তাঁকে কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত একটি রিভলভার ও কয়েক ডজন কার্তুজ পৌঁছে দিতে হয়। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে তিনি গৃহবধূর ছদ্মবেশ নেন এবং নিজের শাড়ির আঁচলে অস্ত্র লুকিয়ে সফলভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দেন।

২. জেলবন্দী বিপ্লবীদের সহায়তা

ব্রিটিশ সরকার বহু বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠালে, আরতি তাঁদের পরিবারের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও চিঠি-পত্র পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও মহিলা কমিটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেন।

৩. প্রচারণা ও নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

তিনি বিশ্বাস করতেন স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর ভূমিকা অপরিহার্য। তাই তিনি কলকাতা ও হাওড়া অঞ্চলে গোপন বৈঠক আয়োজন করে তরুণীদের বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।

গ্রেপ্তার ও কারাবাস

১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ পুলিশ একটি অস্ত্র চক্রের খোঁজ পেয়ে বেশ কয়েকজন বিপ্লবীর সঙ্গে আরতি গুপ্তকেও গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে “ব্রিটিশবিরোধী ষড়যন্ত্র” ও “অস্ত্র আইন ভঙ্গ” করার অভিযোগ আনা হয়।
জেল জীবনে আরতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু তিনি কখনও সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করেননি। তাঁর দৃঢ়তা দেখে অনেক জেলবন্দী নারী অনুপ্রাণিত হন। প্রায় ১৮ মাস কারাবাসের পর তিনি মুক্তি পান, তবে ব্রিটিশ সরকার তাঁর উপর নজরদারি চালিয়ে যায়।

স্বাধীনতার পর জীবন

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আরতি গুপ্ত সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি সামাজিক ও শিক্ষামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও স্বনির্ভরতা বৃদ্ধিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তিনি কলকাতায় একটি মহিলা শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে নারীদের সাক্ষরতা শিক্ষা, সেলাই, হস্তশিল্প ও প্রাথমিক চিকিৎসা শেখানো হতো।

ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ

আরতি গুপ্ত ছিলেন এক দৃঢ়চেতা, সাহসী ও ত্যাগী নারী। তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র ছিল— “দেশ আগে, নিজের জীবন পরে”। তিনি কখনও খ্যাতি বা পুরস্কারের জন্য সংগ্রাম করেননি, বরং নীরবে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন।

উত্তরাধিকার

যদিও তাঁর নাম ভারতের মূলধারার ইতিহাস বইয়ে তেমনভাবে উল্লেখিত নয়, তবুও স্থানীয় পর্যায়ে ও বিপ্লবীদের স্মৃতিচারণায় তাঁর অবদান আজও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবার তাঁকে “আরতি দি” নামে ডাকতেন।

উপসংহার

আরতি গুপ্তের জীবন আমাদের শেখায় যে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুধু সামনের সারির নেতাদের দ্বারাই সম্ভব হয়নি; অসংখ্য অজানা নারী-পুরুষ গোপনে, নিঃস্বার্থভাবে, জীবন বাজি রেখে সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন।
তাঁদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে। আজকের দিনে যখন জাতীয়তাবোধ প্রায়শই রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, তখন আরতি গুপ্তের মতো মানুষদের জীবনের শিক্ষা আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়— “সত্যিকার দেশপ্রেম মানে ত্যাগ, সততা ও নীরব সংগ্রাম”।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

হংসাবেন মেহতা : ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় নারী।।

ভূমিকা— ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু নারীই তাঁদের সাহস, ত্যাগ, এবং অনন্য নেতৃত্বের মাধ্যমে চিরস্মরণীয় হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হংসাবেন মেহতা — যিনি কেবলমাত্র স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই করেননি, বরং স্বাধীনতার পর ভারতের সংবিধান প্রণয়ন, নারী অধিকার রক্ষা, এবং শিক্ষার প্রসারে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, নারীবাদী, এবং সামাজিক সংস্কারক — এককথায়, এক বহুমুখী ব্যক্তিত্ব।

শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি

হংসাবেন মেহতার জন্ম ৪ জুলাই ১৮৯৭ সালে গুজরাটের সুরাট শহরে। তাঁর পিতার নাম ছিল হারিপ্রসাদ দেসাই, যিনি ছিলেন শিক্ষিত, উদারচিন্তাধারার মানুষ। পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্ত কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ। ছোটবেলা থেকেই হংসাবেনের মধ্যে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার প্রবণতা দেখা যায়।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন সুরাটে এবং পরে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বগুণের বিকাশ ঘটে, এবং নারী শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ জন্ম নেয়।

প্রথম জীবনে নারীবাদী চেতনা–

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় হংসাবেন পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন — বিশেষত জন স্টুয়ার্ট মিল এবং এমেলিন প্যাঙ্কহার্স্টের নারী অধিকারের দর্শন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন এবং সেখানকার নারী ভোটাধিকার আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর রাজনৈতিক এবং সামাজিক চেতনার ভিত্তি দৃঢ় করে।

রাজনীতিতে প্রবেশ–

ভারতে ফিরে এসে হংসাবেন সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং নারীদের সমস্যা, শিশুদের শিক্ষা, ও সামাজিক সংস্কারের বিষয়ে ধারালো প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। তাঁর লেখনী ছিল স্পষ্ট, যুক্তিপূর্ণ, এবং সাহসী।
তিনি গুজরাট মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করত।
হংসাবেন ১৯৩৭ সালে বম্বে প্রাদেশিক বিধানসভা-র সদস্য নির্বাচিত হন। সেখানেও তিনি নারীর অধিকার রক্ষার জন্য একাধিক বিল প্রস্তাব করেন, যেমন — বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা পুনর্বিবাহের প্রচার, এবং নারীদের কর্মক্ষেত্রে সমান মজুরি।

স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা–

হংসাবেন মেহতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী-র আদর্শে অনুপ্রাণিত।
তিনি অসহযোগ আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি প্রায় তিন বছর বন্দি ছিলেন।
কারাবাসের সময়ও তিনি নারী বন্দিদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন এবং তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেন।

সংবিধান সভায় ভূমিকা–

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৬ সালে হংসাবেন মেহতা সংবিধান সভা-র সদস্য নির্বাচিত হন।
সংবিধান রচনার সময় তিনি নারী অধিকার সংক্রান্ত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেন।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তাঁর প্রচেষ্টাতেই ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা-তে “Equality” বা সমতা শব্দটি যুক্ত হয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
তিনি মানবাধিকার সনদ (Universal Declaration of Human Rights)-এর প্রণয়নেও অবদান রাখেন। জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সক্রিয়ভাবে নারী অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

নারী শিক্ষার প্রসারে অবদান–

হংসাবেন বিশ্বাস করতেন যে স্বাধীনতা অর্থবহ হবে কেবল তখনই, যখন নারীরা শিক্ষিত ও আত্মনির্ভর হবে।
তিনি গুজরাটের গ্রামীণ অঞ্চলে একাধিক বিদ্যালয় ও নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন।
তাঁর প্রচেষ্টায় বহু মেয়েরা প্রথমবার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়।
তিনি মেয়েদের জন্য বিজ্ঞান, কলা, এবং পেশাগত শিক্ষার প্রসারে জোর দেন, যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।

লেখনী ও সাহিত্যকর্ম–

হংসাবেন একজন দক্ষ লেখিকাও ছিলেন। তিনি “Indian Woman” এবং “The Awakening of Indian Women” নামে দুটি প্রভাবশালী বই লেখেন, যেখানে ভারতীয় নারীর ইতিহাস, সংগ্রাম, এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়াও তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ, বক্তৃতা, এবং রিপোর্ট লিখেছেন, যা নারী আন্দোলনের ইতিহাসে অমূল্য দলিল।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি–

হংসাবেন মেহতার অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে ভারত সরকার তাঁকে একাধিক সম্মানে ভূষিত করে।
১৯৮৮ সালে তিনি পদ্মভূষণ লাভ করেন।
এছাড়াও নারী আন্দোলন ও সামাজিক সংস্কারে অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা তাঁকে সম্মানিত করে।

ব্যক্তিগত জীবন–

হংসাবেনের বিবাহ হয়েছিল ঝাবেরচন্দ মেহতা-র সঙ্গে, যিনি নিজেও সামাজিক সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল আদর্শ সহযোগিতামূলক — স্বামী-স্ত্রী মিলে সমাজ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার–

হংসাবেন মেহতার মৃত্যু হয় ১৯৯৫ সালে। তবে তাঁর কর্ম, আদর্শ, এবং সংগ্রামের উত্তরাধিকার আজও ভারতীয় নারী আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বল।
তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে একজন নারী কেবল ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় — বরং জাতি, সমাজ, এবং রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

উপসংহার

হংসাবেন মেহতা ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম, সংবিধান রচনা, নারী অধিকার রক্ষা, এবং শিক্ষা প্রসারে সমানতালে অবদান রেখেছেন।
তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে স্বাধীনতার সংগ্রাম কেবল বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে নয় — বরং সামাজিক অন্যায়, লিঙ্গ বৈষম্য, এবং অশিক্ষার বিরুদ্ধেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁর সংগ্রাম ও আদর্শ আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে — স্বাধীনতার মূল্য, সমতার গুরুত্ব, এবং শিক্ষার শক্তি উপলব্ধি করতে।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিকন্যা, মোহিনী দেবী।

সূচনা—
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের অব্যর্থ পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে মোহিনী দেবী  প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু শহীদ ভগৎ সিং-এর মতই নয় বরং শক্তিশালী নারীদের দ্বারা প্রশস্ত হয়েছিল যারা তাদের মাটিতে দাঁড়িয়েছিল এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করেছিল। মোহিনী দেবী  ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যিনি দেশমতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ রূপে।
ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিকন্যা ছিলেন তিনি।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় নাম
মোহিনী দেবী। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিকন্যা। এছাড়া তার পরিবার বাংলাদেশের প্রগতিমুলক শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত ছিল। ইতিহাসে তাঁর নাম আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। জেনে নেবো তাঁর সংগ্রামী জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
জন্ম ও পরিবার—-
মোহিনী দেবী ১৮৬৩ সালে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামশঙ্কর সেন ও মাতার নাম উমাসুন্দরী দেবী। ১২ বছর বয়সে তারকচন্দ্ৰ দাশগুপ্তের সঙ্গে বিবাহ হয়। শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী প্রভাবতী দাশগুপ্ত।
শিক্ষাজীবন—-
মোহিনী দেবী ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রথম হিন্দু ছাত্রী, কলকাতার অভিজাত অ্যাংলিকান প্রতিষ্ঠান, মোহিনী দেবী (১৮৬৩ – ১৯৫৫) তার মূলে একজন জাতীয়তাবাদী ছিলেন।  ঢাকার বেউথার রামশঙ্কর সেনের কন্যা, বারো বছর বয়সে তারকচন্দ্র দাশগুপ্তের সাথে তার বিয়ে হয়।  তা সত্ত্বেও, তিনি পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী এবং রামতনু লাহিড়ীর অধীনে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের কলকাতার অধ্যবসায়ী।  তিনি ইউনাইটেড মিশনের একজন মহিলা শিক্ষকের কাছে ইংরেজি শিখেছিলেন।  এইভাবে তিনি ভারতের সমসাময়িক উন্নয়ন সম্পর্কে সচেতন হন এবং শুরু থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন।
রাজনৈতিক জীবন—-
১৯২১-২২ সালে তিনি গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে কারাবরণ করেন। ১৯৩০-৩১ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে নেতৃত দেন। এজন্য তাকে ছয় মাসের জেল খাটতে হয়েছিল। ‘নিখিল ভারত মহিলা সমিতির’ সভানেত্রী হিসেবে তার ভাষন উচ্চ প্রশংসিত হয়। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় মুসলিম প্রধান অঞ্চল এন্টালি বাগানে নিজের বাড়িতে থেকে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রচার চালিয়েছিলেন। সে সময় তার বন্ধু-বান্ধব আত্নীয় পরিজন তাকে তিরস্কার করে কিন্তু তাতে তিনি সংকল্প হারান নি। মোহিনী দেবী একদিকে স্বাধীনতা আন্দোলন এর পক্ষে কাজ করেছিলেন অন্যদিকে নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, সমাজসংস্কারমূলক কাজ।
স্বাধীনতা আন্দোলনে—
১৯২০-১৯২২ সালে, ব্রিটিশদের সাথে অসহযোগের জন্য গান্ধীর আহ্বানের উচ্চতায়, তিনি নিজেকে আন্দোলনে উত্সর্গ করেছিলেন।  ১৯৩০-১৯৩১ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের সময়, তিনি আইন ও পুলিশি বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে এবং পথে কারাভোগ করে একজন উল্লেখযোগ্য নেতা আন্দোলন হিসাবে আবির্ভূত হন।  গান্ধীবাদী আদর্শে তার সম্পূর্ণ সাবস্ক্রিপশন এবং তার আন্দোলন কৌশলের প্রতি অটল জমা দেওয়ার কারণে, তিনি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সভাপতি হন;  তার বাকপটু বক্তৃতা গান্ধী সহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।  নিজের এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে, তিনি কলকাতার রাস্তায় নেমে আসেন এবং ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ কলকাতা দাঙ্গার অন্ধকার দিনগুলিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
গান্ধীজীর আদর্শে অবিচলিত নিষ্ঠা ছিল। ১৯৪৬ খ্রী. কলিকাতায় দাঙ্গার সময় দাঙ্গা-আধুষিত মুসলমান-প্রধান অঞ্চল এন্টনিবাগানে নিজের বাড়িতে থেকে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের বাণী প্রচার করেন। ‘দি স্কাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অব বেঙ্গল’ এবং ‘জুটি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে’র প্রেসিডেন্ট তাঁর কন্যা প্ৰভাবতী দাশগুপ্ত ১৯২৭-২৮ থেকে ১৯৩০ – ৩১ খ্রী. পর্যন্ত শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
মৃত্যু—-
মহান এই  সংগ্রামী মোহিনী দেবী ২৫ মার্চ ১৯৫৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া।।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

বিজয়া সেন: এক অনন্য নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী

ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসংখ্য নারী তাঁদের জীবন, স্বপ্ন, পরিবার ও নিরাপত্তা বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের অনেকের নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকলেও, অনেকের অবদান অজানা রয়ে গেছে। বিজয়া সেন তেমনই একজন সংগ্রামী, যিনি বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত নাম। তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক কর্মকাণ্ড, নারীর অধিকার রক্ষায় অবদান এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ড তাঁকে স্বাধীনতার ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন

বিজয়া সেন ১৯১০ সালের দিকে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) এক সাংস্কৃতিক ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক এবং মা ছিলেন গৃহবধূ হলেও সাহিত্য ও সংগীতপ্রেমী। ছোটবেলা থেকেই বিজয়ার মনে দেশপ্রেমের বীজ রোপিত হয়েছিল, কারণ তাঁর পরিবার ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবাপন্ন ছিল এবং বাড়িতে প্রায়ই স্বদেশী নেতাদের আলোচনা হত।
শিক্ষাজীবনে বিজয়া ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন, যা তখন নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান ছিল। এখানেই তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ শুরু করেন।

রাজনৈতিক প্রেরণা

১৯২৮ সালের সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলন এবং লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় বিজয়া গভীরভাবে প্রভাবিত হন। বেথুন কলেজে পড়াকালীন তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ছাত্র সংঘের সভায় অংশ নিতে শুরু করেন।
তবে কেবল কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না থেকে, তিনি বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর এবং বঙ্গীয় যুব সংঘ-এর সঙ্গেও গোপনে যুক্ত হন। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল একদিকে গান্ধীবাদের অহিংস প্রতিরোধ, অন্যদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি—পরিস্থিতি অনুযায়ী কোন পথ গ্রহণ করা হবে, তা তিনি বাস্তবতার ভিত্তিতে বিবেচনা করতেন।

বিপ্লবী কর্মকাণ্ড

বিজয়া সেন কলকাতা ও চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর সময় তিনি সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষার জন্য মহিলা কুরিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলেন।
তিনি একাধিকবার বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছেন, পুলিশের চোখ এড়িয়ে অস্ত্র পরিবহন করেছেন, এবং নারীর পরিচয়ের আড়ালে গোপন বার্তা বহন করেছেন। তাঁর সাহসিকতার কারণে তাঁকে সমসাময়িকরা “বেঙ্গল’স ব্রেভহার্ট” বলে ডাকতেন।

কারাবাস ও নির্যাতন

১৯৩২ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, অবৈধ অস্ত্র রাখা এবং বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য হওয়া। কারাগারে বিজয়া সেনকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
কারাগারে থেকেও তিনি অন্য বন্দিনী নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেন। তিনি কারাগারে গান্ধীজীর বই পড়াতেন, নারীদের সংগঠিত করতেন এবং ব্রিটিশ শাসনের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজসেবা

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বিজয়া সেন সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেননি, তবে সামাজিক কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেন। তিনি কলকাতায় বস্তিবাসী শিশুদের জন্য একটি বিনামূল্যের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং নারীদের স্বনির্ভর করতে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন।
তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে একাধিক প্রচারাভিযান চালান এবং একাধিক নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর কাছে স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়—সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা ছিল প্রকৃত স্বাধীনতা।

ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ

বিজয়া সেনের ব্যক্তিত্ব ছিল দৃঢ়, স্নেহশীল এবং ন্যায়পরায়ণ। তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করতেন। তাঁর জীবনদর্শন ছিল—

“স্বাধীনতা কেবল মাটির নয়, মন ও মনের স্বপ্নেরও স্বাধীনতা।”

সমসাময়িকদের প্রশংসা

বিজয়া সেনের জীবদ্দশায় অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী তাঁর অবদান স্বীকার করেছেন। প্রখ্যাত বিপ্লবী অনন্ত সিং একবার বলেছিলেন—

“বিজয়া আমাদের জন্য শুধু অস্ত্র বহন করতেন না, সাহসও বহন করতেন।”

উত্তরাধিকার

আজকের দিনে বিজয়া সেনের নাম ইতিহাসের মূলধারায় খুব বেশি উচ্চারিত হয় না, কিন্তু তাঁর জীবন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। তাঁর কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, স্বাধীনতার আন্দোলনে নারী কেবল সহযাত্রী নয়, বরং নেতা ও পথপ্রদর্শকও হতে পারে।

উপসংহার

বিজয়া সেনের জীবন কাহিনী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। তিনি ছিলেন সাহসী, আদর্শবাদী, এবং মানবিক চেতনার প্রতীক। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কেবল শাসক বদল নয়, সমাজ বদল জরুরি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীর অবদান নিয়ে যখনই কথা হবে, বিজয়া সেনের নাম সেখানে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবে।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

গার্গী দেবী: বাংলার সাহসী কন্যা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত।

ভূমিকা:-  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারীর নাম রয়েছে, যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের মুক্তির জন্য। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছেন, আবার অনেকের নাম কিছুটা হলেও মানুষের মনে রয়ে গেছে। গার্গী দেবী সেইসব সাহসী নারীদের একজন, যিনি জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
তাঁর সংগ্রাম কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যই ছিল না, বরং নারীশিক্ষা, নারীর স্বাবলম্বন ও সামাজিক সমতার জন্যও তিনি কাজ করে গেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা গার্গী দেবীর জীবন ও কর্মযাত্রার বিস্তারিত আলোচনায় যাব।

শৈশব ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট

গার্গী দেবীর জন্ম ১৯১২ সালে অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে, এক শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে সমৃদ্ধ পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং মা ছিলেন গৃহবধূ, যিনি ধর্মীয় হলেও প্রগতিশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাস করতেন। ছোটবেলা থেকেই গার্গী দেবী সাহিত্য, সংগীত ও দেশপ্রেমমূলক আলোচনায় বড় হয়েছেন।
বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার বই ছিল সর্বদা। এগুলোর প্রভাবেই তাঁর মনে দেশপ্রেম ও মানবতার বীজ অঙ্কুরিত হয়।

শিক্ষাজীবন

গার্গী দেবী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন কৃষ্ণনগর গার্লস স্কুলে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। বেথুন কলেজ সে সময় নারীদের উচ্চশিক্ষার একমাত্র বড় কেন্দ্র ছিল এবং এখানেই তিনি রাজনৈতিক সচেতনতার প্রথম পাঠ পান।
কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ব্রিটিশবিরোধী বক্তৃতা, সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় সমসাময়িক নারী সংগ্রামী যেমন প্রীতি লতা ও বিনোদিনী দাসের সঙ্গে।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনা

গার্গী দেবীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলনের মাধ্যমে। বেথুন কলেজের ছাত্রীরা তখন বিক্ষোভ মিছিল ও সভা সংগঠিত করেছিল, এবং গার্গী দেবী তার অন্যতম মুখ্য সংগঠক ছিলেন।
১৯৩০ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি গান্ধীবাদী কর্মসূচিতে অংশ নেন, পাশাপাশি গোপনে বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর ও বঙ্গীয় যুব সংঘ-এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন।

বিপ্লবী কর্মকাণ্ড

গার্গী দেবী চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি নারীর পোশাকের আড়ালে বিপ্লবীদের কাছে গোপন বার্তা পৌঁছে দিতেন, অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন, এমনকি আহত বিপ্লবীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন।
১৯৩২ সালে কলকাতায় এক ব্রিটিশ পুলিশের গোপন নথি চুরি করার অভিযানে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এই নথি বিপ্লবীদের হাতে পৌঁছালে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।

গ্রেফতার ও কারাবাস

১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ না থাকলেও, তাঁকে ১৮ মাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে গার্গী দেবী নারীবন্দীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেন।
তিনি কারাগারে গান্ধীজীর “হিন্দ স্বরাজ” পড়াতেন, বিপ্লবীদের গান গাইতেন এবং কারা কর্তৃপক্ষের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এই সময় তিনি অনশনও করেন, যা ব্যাপক আলোড়ন তোলে।

স্বাধীনতার পর সমাজসেবা

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর গার্গী দেবী রাজনীতিতে সক্রিয় না থেকে সামাজিক কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি নারীদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প চালু করেন। কলকাতার কালীঘাটে তিনি একটি মেয়েদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে অবহেলিত পরিবারের শিশুদের বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হত।
তিনি একাধিক নারী সংগঠনের সভাপতি ছিলেন এবং নারী অধিকার রক্ষায় আইনি লড়াই চালিয়েছেন।

ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ

গার্গী দেবী ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সৎ ও সাহসী। তিনি বিশ্বাস করতেন—

“স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকও হতে হবে।”

তিনি সর্বদা সরল জীবনযাপন করতেন এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতেন।

সমসাময়িকদের স্মৃতিচারণ

বিপ্লবী অনন্ত সিং একবার বলেছিলেন—

“গার্গী শুধু একজন নারী সংগ্রামী ছিলেন না, তিনি ছিলেন পুরুষদের সাহস জোগানো এক অদম্য প্রেরণা।”

উত্তরাধিকার

গার্গী দেবীর নাম আজ মূলধারার ইতিহাসে খুব বেশি উচ্চারিত হয় না, কিন্তু তাঁর অবদান অমূল্য। তিনি প্রমাণ করেছেন যে নারীর সাহস, বুদ্ধি ও দৃঢ়তা জাতির মুক্তি সংগ্রামে অপরিহার্য।
তাঁর জীবনী আজকের তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারে—বিশেষ করে সেইসব মেয়েদের, যারা বড় স্বপ্ন দেখে এবং দেশের জন্য কিছু করতে চায়।

উপসংহার

গার্গী দেবীর জীবন কাহিনী কেবল স্বাধীনতার আন্দোলনের অংশ নয়, বরং নারীর মুক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর সংগ্রাম, ত্যাগ ও কর্মযজ্ঞ আমাদের শেখায় যে—সত্যিকারের দেশপ্রেম কেবল কথায় নয়, কাজে প্রকাশ পায়।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

মাতঙ্গিনী হাজরা: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমর নারী যোদ্ধা

প্রস্তাবনা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অসংখ্য পুরুষ বিপ্লবীর নাম আমরা জানি, কিন্তু নারীদের অবদানও ততটাই অনন্য ও অনুপ্রেরণামূলক। মাতঙ্গিনী হাজরা সেইসব নারীদের একজন, যিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। তিনি শুধুমাত্র বীরাঙ্গনা নন, বরং তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে দেশপ্রেম বয়সের সীমা মানে না। ব্রিটিশ শাসকের গুলি বুকে নিয়েও তিনি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত “বন্দে মাতরম” ধ্বনি তুলেছিলেন।


শৈশব ও পারিবারিক জীবন

মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম ১৯ শতকের শেষভাগে, ১৯ শতকের ৬০-এর দশকে (আনুমানিক ১৮৬৯ সালে) তামলুক মহকুমার এক ছোট গ্রামে। গ্রামের সাধারণ এক কৃষক পরিবারে জন্মানো মাতঙ্গিনী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শান্ত, কিন্তু দৃঢ়চেতা। আর্থিক কষ্টের কারণে তিনি বিদ্যালয়ে যেতে পারেননি, তাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর হয়নি। তবে গ্রামীণ পরিবেশ, লোকসংস্কৃতি এবং চারপাশের মানুষের জীবনযুদ্ধ তাঁকে জীবনের প্রথম পাঠ শিখিয়েছে— অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ও অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা।

মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় তমলুকেরই এক মধ্যবয়সী ব্যক্তির সঙ্গে। কিন্তু বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। স্বামী মারা যাওয়ার পর মাতঙ্গিনী তরুণ বয়সেই বিধবা হয়ে পড়েন। সমাজ তখন বিধবাদের জন্য কঠোর নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল, কিন্তু মাতঙ্গিনী সেই শৃঙ্খলকে নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে ভাঙতে শুরু করেন।


স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের প্রেরণা

তৎকালীন তমলুক মহকুমা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উর্বর ক্ষেত্র। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন, স্বদেশী ভাবধারা ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছিল। মাতঙ্গিনী ক্রমশ এই আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি বুঝতে পারেন, ব্রিটিশ শাসনের শোষণ থেকে মুক্ত না হলে দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচবে না।

১৯৩২ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি প্রথমবার সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি মিছিল, সভা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে যোগ দেন। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল করার জন্য তাঁকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়।


কারাবরণ ও সংগ্রামী জীবন

মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনে কারাবাস ছিল একাধিকবারের ঘটনা। প্রথমবার গ্রেপ্তারের সময় তাঁর বয়স প্রায় ৬৩ বছর। তমলুক শহরে ব্রিটিশ বিরোধী মিছিলে যোগ দেওয়ার অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে আনা হয়। কিন্তু বয়স ও স্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তবে সতর্কবার্তা তাঁর মনোবল ভাঙাতে পারেনি। তিনি গান্ধীজির ‘সত্যাগ্রহ’ নীতিকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। খদ্দরের পোশাক পরা, চুল সাদা, মুখে শান্ত হাসি— এমন চেহারার এক বৃদ্ধা হলেও তাঁর অন্তরে ছিল অদম্য সাহস।


১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৪২ সালের “ভারত ছাড়ো আন্দোলন” (Quit India Movement) ছিল এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। মাতঙ্গিনী হাজরা তখন প্রায় ৭৩ বছরের বৃদ্ধা, কিন্তু তাঁর উদ্যম ও দেশপ্রেম তখনও অটুট।

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ সালে তমলুক মহকুমার কটালীপাড়ায় কংগ্রেসের আহ্বানে একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল— তমলুক থানা দখল করে জাতীয় সরকারের পতাকা ওড়ানো। মাতঙ্গিনী সেই মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে।


শেষ লড়াই ও শহিদি বরণ

ব্রিটিশ পুলিশ মিছিলে বাধা দেয় এবং ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি চালায়। কিন্তু মাতঙ্গিনী পিছু হটেননি। তিনি সামনে এগিয়ে গিয়ে পুলিশদের উদ্দেশে বলেছিলেন—
“আপনারা গুলি চালান, আমি এগোবই।”

গুলি তাঁর শরীর ভেদ করলেও তিনি পতাকা উঁচিয়ে “বন্দে মাতরম” ধ্বনি তুলতে থাকেন। একে একে তিনটি গুলি তাঁর শরীরে লাগে— একটি হাতে, একটি বুকে, একটি কপালে। তবুও পতাকা মাটিতে ফেলেননি। পতাকা হাতে নিয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


মৃত্যুর পর প্রতিক্রিয়া ও সম্মাননা

মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মবলিদান সমগ্র তমলুক তথা বাংলায় গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ মানুষের মনে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তমলুক জাতীয় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর আত্মত্যাগ বিশেষ প্রেরণা হয়ে ওঠে।

স্বাধীনতার পরে মাতঙ্গিনী হাজরাকে নানা ভাবে স্মরণ করা হয়—

  • কলকাতার রেড রোডে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে, যা আজও শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে পরিচিত।
  • তমলুক ও তার আশপাশে বহু রাস্তা, বিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
  • পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতি বছর তাঁর শহিদ দিবস পালন করে।

ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ

মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনদর্শনের মূল ভিত্তি ছিল—

  1. ত্যাগ — ব্যক্তিগত কষ্ট ও সামাজিক অপমানকে উপেক্ষা করে দেশের জন্য আত্মদান।
  2. অহিংসা — গান্ধীজির নীতি অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন করা।
  3. অদম্য সাহস — বারবার পুলিশের গুলি ও গ্রেপ্তারি সত্ত্বেও পিছিয়ে না যাওয়া।

উত্তরাধিকার

আজকের প্রজন্মের কাছে মাতঙ্গিনী হাজরা কেবল ইতিহাসের একটি নাম নন, বরং সাহস ও দেশপ্রেমের জীবন্ত প্রতীক। তাঁর জীবন শেখায়—

  • স্বাধীনতা কখনো বিনা মূল্যে আসে না।
  • বয়স বা শারীরিক সীমাবদ্ধতা দেশসেবার পথে বাধা নয়।
  • সত্য ও ন্যায়ের পথে চললে মৃত্যু পর্যন্তও ভয় পাওয়া উচিত নয়।

উপসংহার

মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অদম্য সৈনিক, যিনি বৃদ্ধ বয়সেও নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন মাতৃভূমির জন্য। তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়— স্বাধীনতা রক্ষার জন্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব আছে।

আজ আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি, কিন্তু এই স্বাধীনতার পিছনে থাকা শহিদদের কথা স্মরণ রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মাতঙ্গিনী হাজরার জীবন আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়— যে কোনো যুগে, যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই প্রকৃত দেশপ্রেম।

 

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

ফুলন দেবী (১৯৬৩–২০০১): দস্যু রানী থেকে সংসদ সদস্য হয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতীক।

ভারতের আধুনিক ইতিহাসে কয়েকজন ব্যক্তি এমনভাবে আলোচিত হয়েছেন যেভাবে ফুলন দেবীর নামে পরিচয় পেয়েছিলেন—‘দস্যু রানী’। তিনি ছিলেন মানুষের নীচু বর্ণ থেকে উঠে আসা এক নারীবাদী প্রতীক। নিঃস্ব, নির্যাতিত এক কন্যা থেকে দস্যু-নেত্রী, কারাগারে বন্দী, সংসদ সদস্য, এবং শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যার শিকার—ফুলন দেবীর জীবন ছিল এক প্রেম, প্রতিশোধ, রাজনীতি ও সামাজিক পরিবর্তনের জটিল ছায়ালিপি।


1. প্রারম্ভিক জীবন ও পটভূমি

  • ফুলন দেবী জন্মেছিলেন ১৯৬৩ সালের ১০ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের জালৌন জেলার ঘোড়া কা পুরওয়া গ্রামে, একটি ‘মাল্লা’ সম্প্রদায়ে—যা সমাজে ‘নিম্নবর্ণ’ হিসেবে গণ্য।
  • তার গ্রাম ও পরিবারের অভাব-দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

2. নির্যাতন, স্বামীর অত্যাচার ও বাধ্যতামূলক বিবাহ

  • মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়, এবং পরবর্তীতে তিনি শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
  • শারীরে ও মানসিকভাবে ভোজ্য তিনি পরিবারের ভয় ও সামাজিক অবজ্ঞার ঝাঁঝ వరারে বন্দী হলেন।

3. নির্যাতন ও প্রতিশোধের পথ: ডাকাত দলের আত্মগঠন

  • চিন্তিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ডাকাত দলের সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীতে দলনেতা বিক্রম মাল্লা হয়ে ওঠেন, যিনি তাকে সম্মান ও ক্ষমতা প্রদান করেন।
  • ১৯৮১ সালে, বেহমাই গ্রামে গণধর্ষণ এবং তার পরবর্তী প্রতিশোধ ঘটায় নেতৃত্ব দেন—এতে ঠাকুর সম্প্রদায়ের ২২ জন পুরুষকে দাঁড়িয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
  • এই ঘটনা ভারতের রাজনীতিতে উত্তালতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এবং প্রায় মুখ্যমন্ত্রী ওয়াল্টার পদত্যাগের কারণও হয়ে দাঁড়ায়।

4. আত্মসমর্পণ, কারাগার জীবন ও মুক্তি

  • ১৯৮৩ সালে, নির্দিষ্ট শর্তসহ তিনি মধ্যপ্রদেশে আত্মসমর্পণ করেন।
  • তাঁকে কারাভোগ শেষে ১৯৯৪ সালে মুক্তি দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

5. রাজনিতিতে ফেরা এবং সংসদ সদস্য নির্বাচন

  • মুক্তির পর তিনি সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে মির্জাপুর থেকে লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেন, সংসদ সদস্য হন।
  • পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য হন।
  • রাজনীতি ও কর্মী হিসেবে তিনি জনসাধারণের উন্নয়ন, নারী ও দলিত অধিকার নিয়ে কাজ করতে উদ্যত ছিলেন।

6. গণমাধ্যম ও আত্মজীবনী: বহুমাত্রিক বর্ণনা

  • ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘Bandit Queen’ (ব্যাণ্ডিট কুইন) চলচ্চিত্র তাঁর জীবনকে রহস্যময়ভাবে তুলে ধরে, যা নিয়ে তিনি আপত্তি জানিয়ে আদালতে মামলা করেন, পরে £৪০,০০০ ক্ষতিপূরণ পান।
  • তাঁর আত্মজীবনী ‘I, Phoolan Devi’ লেখেন ফরাসিতে, পরে ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়।
  • এই গ্রন্থ ও ছবি তাঁকে দারিদ্র্য ও অবহেলিত নারীদের জন্য বিশেষ প্রতীকী করে তোলে।

7. হত্যাকাণ্ড এবং পরিণতি

  • ২৫ জুলাই ২০০১, দিল্লির নিজের বাড়ির বাইরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং মৃত্যুবরণ করেন।
  • হত্যাকারী ছিলেন শের সিং রানা, যিনি প্রতিশোধমূলকভাবে এই অপরাধ করে—বেহমাই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেই এই ঘটনা ঘটায়।

8. স্মৃতযজ্ঞ ও ধারা

  • ফুলন দেবী হয়ে উঠেছেন দলিত, নিপীড়িত, নারী ও নিম্নবর্গীয় শ্রেণির মানুষদের এক প্রতীকী প্রতিভূ।
  • তাঁর উপর লেখা বই, চলচ্চিত্র, অনলাইন প্রচার ও আলেপ আলোচনা তাঁকে ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য চরিত্রে পরিণত করেছে।
  • কিছু রাজনীতিক তাঁর উপর ভাস্কর্য স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন—তার ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা আজও সমানভাবে আলোচিত।

উপসংহার

ফুলন দেবীর জীবনের কাহিনি জাতিগত, লিঙ্গ ও শ্রেণি নির্ভর বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াই। নির্যাতনের পর প্রতিশোধের মাধ্যমে দুঃখের মানচিত্র রচনা করে, তিনি একটি প্রতিবাদের পুরুষোচিত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তার জীবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এক নারী কীভাবে অত্যাচার থেকে উঠে আসতে পারে—রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর হয়ে—তখনকার সমাজে অভ্যুত্থানের এক অনন্য নমুনা।


বিস্তারিত রেফারেন্স সমূহ:

  • ফুলন দেবীর জীবন ও রাজনৈতিক কর্মজীবন: উইকিপিডিয়া
  • বেহমাই হত্যাকাণ্ড ও প্রতিশোধের প্রতিচ্ছবি: বাংলা উইকিপিডিয়া ও গণমাধ্যম
  • চলচ্চিত্র ‘Bandit Queen’ ও আত্মজীবনী:
Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

পুষ্পলতা দাশ: অসমের সাহসী কন্যা ও ভারতের নারী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত।

✦ ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অবদান যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ততখানি প্রেরণাদায়কও বটে। অসংখ্য নারী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন পূরণের জন্য। এই মহান নারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন পুষ্পলতা দাশ। অসমের এই সাহসিনী শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামেই অংশ নেননি, বরং সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষা, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বেও ছিলেন অনন্য। তিনি আজও অসমবাসীর কাছে এক প্রেরণার প্রতীক।
এই প্রবন্ধে আমরা পুষ্পলতা দাশের জন্ম, শৈশব, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা, কারাবাস, সামাজিক অবদান এবং তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

✦ জন্ম ও শৈশবকাল

পুষ্পলতা দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৫ সালের ২৭ মার্চ, আসামের উত্তর লখিমপুর জেলায়। তাঁর পিতা ছিলেন আইনজীবী এবং মাতা ছিলেন একজন গৃহিণী, যিনি পরিবারে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা লালন করতেন। শৈশব থেকেই পুষ্পলতা রাজনৈতিক আলোচনা ও জাতীয় আন্দোলনের গল্প শুনে বড় হয়েছিলেন।
তাঁর পরিবারে দেশপ্রেমের যে পরিবেশ ছিল, তা তাঁর চিন্তা ও জীবনদর্শন গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। ছোটবেলা থেকেই তিনি দৃঢ়চেতা, স্পষ্টভাষী এবং অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।

✦ শিক্ষাজীবন

পুষ্পলতা দাশের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় আসামের স্থানীয় স্কুলে। পরে তিনি গৌহাটি এবং শিলংয়ে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় যান এবং ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং ‘স্বদেশী’ ও ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের প্রভাব তাঁর মনে গভীরভাবে পড়ে।
ছাত্রাবস্থায়ই তিনি লালন করতেন নারী জাগরণ ও শিক্ষার স্বপ্ন। পরে এই স্বপ্নই তাঁকে নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ করে তোলে।

✦ স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান

পুষ্পলতা দাশের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে ১৯৩০ সালের দিকে, যখন মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশজুড়ে সিভিল অবিডিয়েন্স মুভমেন্ট শুরু হয়। অল্প বয়সেই তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন।
১৯৩১ সালে, অখিল অসম ছাত্রী সম্মেলন-এর সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি নারী শিক্ষার প্রসার, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এবং স্বাধীনতার বার্তা প্রচার করতে থাকেন।

✦ সল্ট সত্যাগ্রহ ও কারাবাস

গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে পুষ্পলতা দাশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অসমে মহিলাদের লবণ উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা, বিদেশি পণ্যের বয়কট, ব্রিটিশবিরোধী মিছিল—এসব কর্মকাণ্ডে তাঁর নেতৃত্ব ছিল দৃশ্যমান।
১৯৩২ সালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং কয়েক মাসের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগারে থাকাকালীন তিনি অন্য মহিলা বন্দিদের স্বশিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যান।

✦ ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন

১৯৪২ সালে কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিলে পুষ্পলতা দাশ অসমে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি অসমের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানান।
পুলিশ একাধিকবার তাঁকে গ্রেফতার করে। তিনি দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করেন, কিন্তু তাঁর মনোবল ভাঙেনি। বরং কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।

✦ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজ

স্বাধীনতার পরে পুষ্পলতা দাশ নিজেকে কেবল রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের জন্য বহু উদ্যোগ নেন। অসম মহিলা সমিতি-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি নারীদের স্বাস্থ্য, স্বনির্ভরতা এবং অধিকার নিয়ে কাজ করেন।
তাছাড়া, তিনি আসামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং প্রচারে বড় ভূমিকা রাখেন। সাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত এবং লোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল।

✦ রাজনৈতিক জীবন

পুষ্পলতা দাশ স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। তিনি অসম বিধানসভায় নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী অধিকার এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন।

✦ ব্যক্তিগত জীবন

পুষ্পলতা দাশ বিয়ে করেছিলেন ওমিও কুমার দাস-কে, যিনি ছিলেন অসমের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সমাজকর্মী। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল দেশ ও সমাজসেবার কাজে নিবেদিত। দুজন মিলে শিক্ষার প্রসারে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

✦ সম্মান ও স্বীকৃতি

পুষ্পলতা দাশ তাঁর আজীবন সংগ্রাম ও অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে।

✦ শেষ জীবন

পুষ্পলতা দাশ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমাজসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু অসম ও সমগ্র দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল।

✦ উত্তরাধিকার

পুষ্পলতা দাশ শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন; তিনি নারী মুক্তি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের এক প্রতীক। তাঁর জীবন আজও তরুণ প্রজন্মকে শেখায়—সাহস, দৃঢ়তা, ত্যাগ ও নিষ্ঠা থাকলে কোনো লক্ষ্যই অসম্ভব নয়।

✦ উপসংহার

অসমের এক ছোট্ট শহরে জন্ম নেওয়া এই নারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সমাজ সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়ে এবং রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে প্রমাণ করেছিলেন যে নারীর ক্ষমতা অসীম। পুষ্পলতা দাশের জীবন কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং আজও নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয়তাবাদের এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।

Share This