Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

অরোভিলের জননী – মীরা আলফাসা ::: সৌরভকুমার ভূঞ্যা।।।।

অরোভিল কিংবা ‘ভোরের শহর’। তামিলনাড়ুর ভিল্লুপুরম জেলায় অবস্থিত ছোট্ট সুন্দর শহর অরোভিল। যার কিছুটা অংশ রয়েছে পণ্ডেচেরিতেও। যে পণ্ডেচেরি শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুজন বিখ্যাত মানুষের নাম, ঋষি অরবিন্দ এবং তাঁর শিষ্যা ও সহযোগী মীরা আলফাসা। গুরুদেব অরবিন্দের আদর্শ মাথায় নিয়ে পরীক্ষামূলক এই শহরটি স্থাপন করেছিলেন মীরা আলফাসা। অরোভিল একটি ফরাসী শব্দ। ফরাসীতে ‘auro’ শব্দের অর্থ ভোর আর ‘ville’ শব্দের অর্থ শহর। এককথায় ভোরের শহর। তবে অনেকের মতে মিরা আলফাসা গুরুদেব অরবিন্দের নামে এই শহরের নামকরণ করেছিলেন। নামকরণের নেপথ্য কাহিনি যাই থাক, মীরার এই শহর পত্তনের উদ্দেশ্য ছিল অরবিন্দের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা। তার আদর্শ ও ভাবনাচিন্তাকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
ভারতবর্ষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতির টানে যুগের পর যুগ ধরে বহু মানুষ সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে ছুটে এসেছেন, এখনও আসেন। তাদের অনেকে এই দেশকে ভালোবেসে এখানেই পাকাপাকিভাবে থেকে গেছেন। এখানকার সভ্যতা, সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। এরকম অনেক মানুষ আছেন যাদের কথা আমরা জানতে পারি না। আবার এমন কেউ কেউ আছেন যারা তাদের কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের ইতিহাসের পাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছেন। ইতিহাস ঘাঁটলে এরকম অনেক খ্যাতনামা মানুষের কথা আমরা জানতে পারি। তেমনই একজন মহিলা হলেন মীরা আলফাসা। আধ্যাত্মিকতার টানে সুদূর ফ্রান্স থেকে তিনি ভারতবর্ষে ছুটে এসেছিলেন এবং আমৃত্যু এখানেই কাটিয়েছেন।
* * * * *
মীরা আলফাসার পুরো নাম ব্লাঞ্চে রেচেল মীরা আলফাসা। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে জন্ম হয় তার। বাবা মরিস আলফাসা ও মা মাথিলদে ইসমালুন। ছোটোবেলা থেকে মীরা ছিলেন আলাদা প্রকৃতির। যখন তাঁর বয়স চার বছর তখন থেকেই তিনি ধ্যান করতেন। নিজের মধ্যে একাত্ম হয়ে যেতেন। ঘরে তার জন্য থাকা একটি ছোট্ট চেয়ারের ওপর বসে তিনি ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যেতেন। তিনি বুঝতে পারতেন তার মনের মধ্যে আলাদা কিছু ঘটে চলেছে। তাঁর কথায়, ‘চার বছর বয়স থেকে আমি যোগা বা ধ্যান করতে শুরু করেছিলাম। আমার জন্য একটা ছোট্ট চেয়ার ছিল। আমি তার ওপর চুপ করে বসতাম আর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যেতাম। একটা উজ্জ্বল আলো আমার মাথার ওপর নেমে আসত এবং আমার মাথায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্ট করত। আমি কিছু বুঝতে পারতাম না। কেননা বয়সটা বোঝার মতো ছিল না। তবে ধীরে ধীরে আমি অনুভব করতে পারি আমি হয়তো এমন কোনো মহান কাজ করার জন্য এসেছি যার কথা কেউ জানে না।’ সেই ছোট্টবেলা থেকেই তিনি জগতের দূর্দশা, মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা বুঝতে পারতেন। যখন তাঁর বয়স এগারো বারো বছর, তখন থেকে তিনি প্যারিসের কাছাকাছি একটি বনে একাকী ঘুরে বেড়াতেন। বনটি বেশ পুরোনো। এখানে এমনকি দুহাজার বছরের পুরোনো গাছ ছিল। সেখানে কোনো গাছের নীচে বসে তিনি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যেতেন। বনের গাছপালা, পশু পাখিদের সঙ্গে তিনি অদ্ভুত একাত্মতা অনুভব করতে পারতেন। সেই বয়স থেকে তার মধ্যে গুপ্তবিদ্যার প্রতি আগ্রহ জন্মতে শুরু করে। নানারকম মানসিক ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকেন। তিনি স্পষ্টই অনুভব করেন ঈশ্বর আছেন এবং মানুষ চেষ্টা করলে সেই ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে। তাঁর ঘুমন্ত সত্ত্বায় কেউ যেন এসে তাঁকে এই শিক্ষা দিয়ে যেত। যে সত্ত্বাকে তিনি ঈশ্বর বলে মানতেন, যাকে পরবর্তীকালে তিনি কৃষ্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন তিনি সেই ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাবেন।
এরকম এক ঐশ্বরিক কিংবা স্বর্গীয় ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। রাত্রে শুতে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হত তার। কোনো কোনোদিন শুয়ে পড়ার পর অনুভব করতে পারতেন তার মধ্যেকার সত্ত্বা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। তারপর তা ক্রমশ উপরে উঠত থাকে। দেখতেন তার সেই শরীরে একটা সোনালী পোশাক। নারী পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ, অসুস্থ দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষ তার পোশাকের নীচে হাজির হয়েছে। তারা নিজেদের দুঃখ দূর্দশার কথা তার কাছে ব্যক্ত করছে। তার কাছে সাহায্যের আবেদন করছে। যেইমাত্র না তারা তার সোনালী পোশাক স্পর্শ করত সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, দূর্দশা চলে যেত। এই ব্যাপারটা তাঁকে নাড়িয়ে দিত। তার মনে হত সাধারণের মতো জীবন তার নয়। আলাদা কিছু কাজের জন্য তার এই পৃথিবীতে আসা।
সেই ছোটোবেলা থেকে নানান অদ্ভুত, অতিপ্রাকৃত ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটত। মীরার মায়ের চোখেও মেয়ের ব্যতিক্রমী স্বভাব ও আচরণ নজর এড়ায় না। তিনি মনে করতেন মেয়ের মানসিক সমস্যা রয়েছে।
নয় বছর বয়সে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। স্কুলজীবন শেষ করে পনের বছর বয়সে তিনি আর্ট সেন্টারে আকাদেমি জুলিয়ানে ভর্তি হয়েছিলেন চিত্রকলা শেখার জন্য। এখানে তিনি চার বছর পড়াশোনা করেন। তার চিত্রকলার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীও হয়। যাই হোক, এখানে পড়াশোনা করার সময় তার পরিচয় হয় হেনরি মারসেটের সঙ্গে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর তাদের বিয়ে হয়। পরের বছর তাঁদের একমাত্র সন্তান আন্দ্রের জন্ম হয়।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মীরা একটি ছোটো দল গঠন করেন। নাম দেন আইডিয়া। প্রত্যেক বুধবার সন্ধ্যায় দলের সদস্যেদর নিয়ে নিজের বাড়িতে বসতেন। আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে তাদের আলোচনা হত। পাশাপাশি গুপ্তবিদ্যা নিয়েও তাঁরা আলোচনা করতেন। তিনি মনে করতেন গুপ্তবিদ্যার জ্ঞান থাকার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক জ্ঞান থাকাও দরকার। যার মধ্যে এই দুটি বিদ্যা থাকবে তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবেন। আধ্যাত্মকি জ্ঞান না থাকলে গুপ্তবিদ্যার খারাপ প্রয়োগ হতে পারে। এই বিষয়ে তিনি অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। তাই নিজেকে নিমগ্ন করেছিলেন আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনে।
এই সময় প্যারিসে তাঁর পরিচয় হয় ম্যাক্স থিওনের সঙ্গে। গুপ্তবিদ্যা বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। দক্ষিণ আলজেরিয়ার টেলিমেসন-এ তাঁর বাড়ি। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই মীরা একাকী আলজেরিয়া যান। ম্যাক্স থিওন ও তাঁর স্ত্রী আলমা থিওনের সঙ্গে দেখা করেন। ম্যাক্স থিওনের কাছ থেকে গুপ্তবিদ্যার বিষয়ে শিক্ষা নেন। শুধু সেই বছর নয়, পরের বছরও তিনি আলজেরিয়া যান। দুবছর টেলিমেশনে নিজের শিক্ষা শেষ করেন তিনি।
ম্যাক্স থিওন এই সময় ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। তিনি মীরাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যান। মীরা এই সময়ের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন যা ভয়ংকর সুন্দর। সমুদ্রপথে ইউরোপ ভ্রমণে যাওয়ার সময় তাঁদের জাহাজ ভূমধ্যসাগরে ভয়ংকর সামুদ্রিক ঝড়ের শিকার হয়। সবাই বুঝতে পারেন বড়ো বিপর্যয় ঘটতে চলেছে। এই সময় ম্যাক্স থিওন মীরাকে আদেশ দেন তাঁর অর্জিত গুপ্তবিদ্যা কাজে লাগিয়ে এই বিপর্যয় মোকাবিলা করার। গুরুর আদেশ পেয়ে মীরা নিজের দেহ থেকে বেরিয়ে মাঝ সমুদ্রে যান। খোলা সমুদ্রে কিছু ছোটো ছোটো সজীব প্রাণসত্ত্বা দেখেন যা এই সমস্যা সৃষ্টির কারণ। তিনি তাদের সঙ্গে আধ ঘন্টা কথা বলেন। তাদের বোঝান এবং এই জায়গা থেকে ছেড়ে যেতে বলেন। তারা তার কথা মেনে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। যখন তিনি জাহাজে নিজের শরীরে ফিরে আসেন দেখেন ঝড় থেমে গেছে।
এদিকে স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে হেনরির সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের পর তিনি রু দ্য লেভিসে একটি ছোট্ট ঘরে একাকী থাকতে শুরু করেন। তিন বছর পর, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিয়ে করেন পল রিচার্ডকে। পল ছিলেন একজন খ্যাতনামা দার্শনিক। পাশাপাশি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের আধ্যাত্মিকতা, যোগা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি আগ্রহী ছিলেন।
পল রাজনীতিতেও আগ্রহী ছিলেন। ভারতবর্ষের পণ্ডেচেরি তখন ফ্রান্সের অধিকারে ছিল। পলের উদ্দেশ্য ছিল এখান থেকে ফ্রান্স সিনেটে জয়লাভ করা। সেই কারণে তিনি পণ্ডেচেরি আসেন।
* * * * *
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট কলকাতায় জন্ম হয় অরবিন্দের। তাঁর বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন তৎকালীন বাংলার রংপুর জেলার জেলা সার্জেন। মা স্বর্ণলতাদেবী ছিলেন রাজ নারায়ন বসুর কন্যা।
অরবিন্দের যখন সাত বছর বয়স তখন তার বাবা কৃষ্ণধন বসু তাকে ইউরোপে পাঠান পড়াশোনা করার জন্য। এখানে চোদ্দ বছর ছিলেন তিনি। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। আইসিএস পরীক্ষায় তিনি সফল হয়েছিলেন। কিশোর বয়স থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতেন ভারতবর্ষকে পরীধনতার অক্টোপাশ থেকে মুক্ত করার। দেশের স্বাধীনতার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করার। তিনি স্থির করেন ইংরেজদের অধীনে কাজ করবেন না। তাই আইসিএস-এর ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহন করেন না। ফলে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যান।
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন। রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে বরোদা কলেজের প্রফেসর হন। পরবর্তীকালে এখানকার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি তিনি দেশের কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বরোদায় থাকার সময় তার পরিচয় হয় মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী নেতা ঠাকুর সাহেবের সঙ্গে। তার কাছ থেকে তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা নেন। তরুণ সমাজকে বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ কাজ করে যাচ্ছিলেন। তার ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষকেও তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন।
অরবিন্দ ঘোষ তখন বরোদা কলেজের অধ্যক্ষ। এই সময় ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। নিবেদিতা তখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দালনে নিজিকে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন দেশের স্বাধীনতা আন্দালনে অরবিন্দের মতো মানুষকে দরকার। তিনি তাঁকে কলকাতায় এসে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। কলকাতায় তখন জাতীয় মহাবিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অরবিন্দকে সেই মহাবিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বরোদা কলেজের লোভনীয় পদের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আসেন অরবিন্দ। ১৯০৬ ক্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার জাতীয় মহাবিদ্যালয় যা বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে খ্যাত, তাতে যোগ দেন। শুরু হয় তার বিপ্লবী জীবনের আর এক অধ্যায়। তিনি ছিলেন চরমপন্থী আন্দোলনে বিশ্বাসী। দেশের যুব সমাজকে তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। যুগান্তর নামে গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির সঙ্গে তিনি জড়িয়ে ছিলেন।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিপিন চন্দ্র পালের ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদক হন। এই পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তিনি দেশের বিপ্লবী ও তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতেন দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী লেখার জন্য ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার বিপিনচন্দ্র পাল ও তাকে গ্রেপ্তার করে। বিপিন চন্দ্র পালের ছয় মাস জেল হয়। অরবিন্দ পত্রিকায় সরাসরি নিজের নামে লিখতেন না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় ইংরেজরা। ফলে সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারেন অরবিন্দকে এভাবে ছেড়ে রাখা তাদের পক্ষে বিপজ্জনক। তারা সুযোগ খুঁজছিলেন কোনো অজুহাতে তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য। সেই সুযোগও তাঁরা পেয়ে যান। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল অত্যাচারী মেজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী মুজফফরপুরে তার গাড়ির ওপর বোমা ছোঁড়েন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান কিন্তু দুজন ইউরোপীয় মহিলা মারা যান। তারপর পর সারা দেশ জুড়ে ইংরেজ সরকার বোমার সন্ধানে তল্লাশি অভিযান শুরু করে। মানিকতলার মুরারী পুকুর বাগানবাড়িতে বোমের কারখানা খুঁজে পায় তারা। মোট সাঁইত্রিশ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। শুরু হয় আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা। তার হয়ে মামলা লড়েন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আদালতে তিনি নির্দোষ প্রমাণতি হন। ফলে বেকসুর খালাস পান।
জেলে থাকাকালীন সময়ে অরবিন্দের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। এক অন্য জীবনের সন্ধান পান তিনি। জেল থেকে মুক্ত পাওয়ার পর সমস্তরকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। বৃটিশ সরকার যাতে তার কাজে কোনো ঝমেলা করতে না পারে তার জন্য প্রথমে যান ফরাসী অধিকৃত চন্দননগের। সেখান থেকে চলে যান পণ্ডেচেরি যেটিও ছিল ফরাসী অধিকৃত। পণ্ডেচেরি আসার পর এক নতুন জীবন শুরু হয় তার। নিজেকে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় ডুবিয়ে দেন। বিপ্লবী অরবিন্দ থেকে ক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন ঋষি অরবিন্দ।
* * * * *
নির্বাচনী কাজে পণ্ডেচেরিতে বেশ কিছুদিন ছিলেন পল রিচার্ড। এখানে থাকার সময় তিনি জানতে পারেন অরবিন্দের কথা, তার আধ্যাত্মিক সাধনার কথা। পল নিজেও আধ্যাত্মিক ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন। তাই বেশ কয়েকবার তিনি অরবিন্দের সঙ্গে দেখা করেন। অরবিন্দের জীবন দর্শন, ভাবধারায় মুগ্ধ হন তিনি। প্যারিসে ফিরে মীরাকে তিনি অরবিন্দের কথা বলেন। অরবিন্দের কথা শুনে মীরা উৎসাহী হয়ে পড়েন। তার যেন মনে হয় এই সেই মানুষ যাঁকে তিনি স্বপ্নে দেখেন। তাঁর মধ্যে আগ্রহ বাড়ে ভারতবর্ষে আসার জন্য।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ পল রিচার্ড দ্বিতীয়বার ভারতে আসেন। এবার মীরাও তার সঙ্গে আসেন। যেদিন তারা এই দেশের মাটিতে পা দেন, সেদিনই তারা সাক্ষাৎ করেন অরবিন্দের সঙ্গে। অরবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ মীরার মনে আলোড়ন তোলে। মুগ্ধ হন তিনি। তার মনে হয় এই সেই মানুষ যাকে তিনি খুঁজে চলেছেন এতদিন। যাকে তিনি স্বপ্নে দেখেছেন বারবার। ইনিই সেই ‘ঈশ্বর পুরুষ’ যাকে তিনি কৃষ্ণ বলে মনে করতেন। প্রথম সাক্ষাতে মীরা অনুভব করেন এই ভারতবর্ষ তার কর্মক্ষেত্র। অরবিন্দের সাক্ষাতে আসার পর তিনি নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন উপলব্ধি করেন। সেই সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মনে হল, যেন নতুন জন্ম হল আমার। অতীতের সব রীতি, অভ্যাস মনে হল অপ্রয়োজনীয়। আর মনে হল, একসময় যাকে আমি ফল বলে মনে করতাম, এখন মনে হল তা আসলে প্রস্তুতি মাত্র … আমার হৃদয়ের মধ্যে থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা জাগরিত হল। আমার মনে হল এতদিন ধরে আমি যা খুঁজছি অবশেষে তার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁচেছি।’
স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে নিয়মিত অরবিন্দের কাছে যেতেন। তার কথা শুনতেন। অরবিন্দের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের। পল আর মীরা স্থির করেন ‘আর্য’ নামে একটি ফিলজফিক্যাল জার্নাল প্রকাশ করার। অরবিন্দ তাদের এই ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট অরবিন্দের জন্মদিনে ‘আর্য’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
ইতিমধ্যে দেশ থেকে ডাক আসে পলের। তাকে ফ্রেঞ্চ রিজার্ভ আর্মিতে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে তিনি বাধ্য হন ভারতবর্য ত্যাগ করতে। মীরার একদমই ইচ্ছে ছিল না ভারতবর্ষ ত্যাগ করে যাওয়ার। কিন্তু থাকতে পারেন না তিনি। প্রথমত স্বামী ফিরে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত অরবিন্দও তাকে থাকার জন্য বলেন না। এই নিয়ে মীরার অভিযোগ এবং অভিমানও ছিল। যা তিনি নিজের লেখায় প্রকাশ করেছেন। আসলে অরবিন্দ মনে করেছিলেন মীরার এখনই এখানে থাকার সময় হয়ে ওঠেনি। সেই কারণে স্বামীর সঙ্গে ফিরে যেতে বাধ্য হন মীরা। ১৯১৫-এর ২২ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরার পথ ধরেন তিনি। পণ্ডেচেরি ত্যাগ করে যাওয়াটা মীরার মনে গভীর আঘাত দিয়েছিল। এর জন্য তিনি অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “He (Sri Aurobindo) did not keep me, what could I do? I had to go. But I left my psychic being with him, and in France I was once on the point of death: the doctors had given me Up.”
ফ্রান্সে এক বছর থাকেন পল। এক বছর পর তাকে সেনাবাহিনী থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি জাপান যান। মীরাও তার সঙ্গে যান। এখানে চার বছর কাটান তারা। ১৯১৯-এ জাপানে এক মহামারী রোগ ছড়িয়ে পড়ে। একসময় মীরাও সেই রোগে আক্রান্ত হন তিনি। কিন্তু তিনি কোনো ডাক্তার দেখান না, ঔষধও খান না। তিনি বোঝার চেষ্টা করেন এই মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী। অসুস্থ অবস্থায় একদিন যখন শুয়েছিলেন তখন তিনি মানস চোখে দেখতে পান সৈনিকের পোশাক পরা একজন যার মাথা নেই। সেই মুণ্ডুহীন শরীর এগিয়ে এসে তার বুকের ওপর চেপে বসে। তার শরীরের শক্তি যেন শুশে নিতে থাকে। অবস্থা এমন হয় যে মীরার মনে হয় তিনি বোধহয় আর বাঁচবেন না। সহসা তিনি তার গুপ্তবিদ্যা কাজে লাগান এবং সেই মুণ্ডুহীন সত্ত্বাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। তারপর তিনি সেরে উঠেছিলেন। মীরা বুঝতে পারেন এই মহামারী রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অসংখ্য তরুন সৈন্যের অকাল মৃত্যু হয়েছিল। তারাই চেষ্টা করছিল অন্যের শরীরে প্রবেশ করে নিজেদের ফিরে পাওয়ার। আর সেটাই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ।
১৯২০-এর এপ্রিল মাসে মীরা স্বামীর সঙ্গে পণ্ডেচেরি আসেন। মিস ডরোথি হজসন নামে এক ইংরেজ মহিলাও তাদের সঙ্গে আসেন। এরপর তিনি আর ভারতবর্ষ ত্যাগ করে যাননি। ঋষি অরবিন্দের সংস্পর্শে এসে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় ডুবিয়ে দেন। স্ত্রীর এই ব্যাপারটা পছন্দ হয় না পলের। মীরাকে তিনি অরবিন্দের কাছ থেকে নিয়ে চলে যেতে চান। কিন্তু মীরা ততদিনে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। স্বামীর কথায় রাজি হন না তিনি। ফলে তাদের সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরে। শেষমেষ মীরাকে ছাড়া তিনি পণ্ডেচেরি ত্যাগ করেন।
মীরা ও হজসন বেয়ন্ড হাউসে থাকতেন। ১৯২০-এর ২৪ নভেম্বরের এক ভয়ংকর ঝড়ে তাদের বাড়িটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একথা জানতে পেরে অরবিন্দ তাদের নিজের বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানান। তারপর থেকে মীরা ও হজসন অরবিন্দের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন।
অরবিন্দের সংস্পর্শে আসার পর মীরা আরও বেশি করে সাধনায় ডুবে যান। অরবিন্দের বাড়িতে তারা দুজন ছাড়া আরও কয়েকজন থাকতেন। আগামীর কথা ভেবে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মীরা একটি আশ্রম স্থাপন করেন। প্রথমে আশ্রমটি পরিকল্পিত ছিল না। একটু একটু করে আশ্রমে শিষ্যের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তথাকথিত আশ্রম বলতে আমাদের চোখের সামনে যে ছবি ফুটে ওঠে, এই আশ্রম তেমন ছিল না। ১৯২৬-এ আশ্রমে শিষ্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪ জন। মাত্র তিন বছরে সংখ্যাটি একশোতে পৌঁছে যায়। অরবিন্দ একটু একটু করে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছিলেন নিজের সাধনার আরও বেশি করে ডুবে যাওয়ার জন্য। আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর অরবিন্দ মীরার হাতে আশ্রমের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি বাইরের জগৎ থেকে সরিয়ে নেন। এই সময় থেকে অরবিন্দ মীরাকে ‘The Mother’ (শ্রীমা) নামে ডাকতে শুরু করেন।
সময় এগিয়ে চলে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত হন অরবিন্দ। প্রথমটা সমস্যা তেমন গুরুতর ছিল না। সবাই আশা করেছিল তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু অসুস্থতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। অবশেষে ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। অরবিন্দের মৃত্যু মায়ের কাছে ছিল বড়ো আঘাত। তাঁর মৃত্যু নিয়ে পরের দিন ড. সান্যালকে তিনি বলেছিলেন, “People do not know what a tremendous sacrifice He has made for the world.”
অরবিন্দের মৃত্যুর পর আশ্রমের সমস্ত কাজের ভার নেন শ্রীমা। প্রসঙ্গত বলার, ১৯৪৩ সাল থেকে ছোটোদের জন্য আশ্রমের মধ্যে ছোটো আকারে একটি স্কুল শুরু হয়। শ্রীমা নিজে ক্লাস নিতেন ছোটোদের। অরবিন্দের মৃত্যুর পরের বছর থেকে তিনি ছোটোদের জন্য বিশেষ ক্লাস নিতে শুরু করেন। ওই বছর তিনি একটি ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি সেন্টার স্থাপন করার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি এর উদবোধন হয়। নাম দেওয়া হয় শ্রী অরবিন্দ ইন্যারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি সেন্টার। ১৯৫৯-এ এর নাম বদলে রাখা হয় শ্রী অরবিন্দ ইন্টারন্যাশন্যাল সেন্টার অব এডুকেশন। এরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাবনা ছিল অরবিন্দের।
শ্রীমায়ের জীবনের অন্যতম কীর্তি হল অরোভিল স্থাপন। শ্রীমা স্থির করেন পরীক্ষামূলকভাবে একটি শহর স্থাপন করার। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়। স্থির হয় হিন্দি হবে ভারতের সরকারি ভাষা। প্রথম পনেরো বছর ইংরেজির পাশাপাশি সেটি সহযোগী ভাষা হিসেবে থাকবে। ১৯৬৫ এর ২৬ জানুয়ারি থেকে ইংরেজির বদলে হিন্দি হবে সরকারি ভাষা। কিন্তু অনেক অ-হিন্দিভাষী রাজ্য এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ছিল না। এই নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছিল। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তামিলনাড়ুতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা মাদ্রাজ জুড়ে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা লুঠপাঠ চালায়। আশ্রমগুলিতেও তারা আক্রমণ চালায়। সেই দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পায় না মায়ের আশ্রমও। এই ব্যাপারটা শ্রীমা-এর মনকে নাড়া দেয়। অনেক দিন মনের মধ্যে লালিত করা একটি স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ভাবনা জেগে ওঠে। তিনি চান এমন একটি জায়গা তৈরি করতে যেখানে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষ সত্যের সাধনায় প্রগতিশীল জীবন কাটাতে পারবে। সেখান থেকে তার মাথায় আসে একটি শহর তৈরির পরিকল্পনা। সেই শহর হল অরোভিল।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমা শ্রীঅরবিন্দ সোসাইটি স্থাপন করেছিলেন। ১৯৬৪-তে এই সোসাইটির বিশ্ব সম্মেলনে অরোভিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাশ হয়। এটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রীমা বলেছেন, “Auroville wants to be a universal town where men and women of all countries are able to live in peace and progressive harmony above all creeds, all policies and all nationalities.” মানুষের মধ্যে একতা ও একাত্মতা গড়ে তোলাই ছিল এই শহর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য
১৯৬৮-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে দশটায় এর উদবোধন হয়। এটির নক্সা করেন স্থাপতি রোজার অ্যাঙ্গার। পঞ্চাশ হাজার লোকের থাকার মতো এই শহর। উদবোধন অনুষ্ঠানে ১২৪ টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ভারতবর্ষের ২৩ টি রাজ্যের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিল। প্রায় সকল দেশের শিশু প্রতিনিধিরা এখানে রাখা একটি পাত্রে একমুঠো করে নিজের নিজের দেশের মাটি প্রদান করে।
অরোভিলে কারা থাকতে পারবে সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শ্রীমা বলেন, “Auroville belongs to nobody in particular. Auroville belongs to humanity as a whole. But to live in Auroville one must be the willing servitor of the divine Consciousness.” পনেরো বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই শহর। শহরের চারটি বিভাগ – আবাসিক, শিল্প, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক।
শহরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে মাতৃমন্দির। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এর ভিত্তিপ্রস্তর দেওয়া হয়। এটি দেখতে একটি সোনালী গোলকের মতো। চারটি স্তম্ভের ওপর এই গোলকটি রয়েছে। এই চারটি স্তম্বকে মায়ের চারটি শক্তির রূপক হিসেবে ধরা হয়। যে শক্তির কথা ঋষি অরবিন্দ উল্লেখ করেছিলেন তাঁর বইতে। অরবিন্দ তার ‘The Mother’ বইতে মীরার চারটি দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল জ্ঞান, শক্তি, সম্প্রীতি ও পরিপূর্ণতা। এই চারটি সত্ত্বার মধ্য দিয়ে মায়ের চারটি রূপ তুলে ধরেছেন তিনি – মহেশ্বরী, মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী। যাই হোক, মাতৃ মন্দিরের মধ্যে রয়েছে ধ্যান কক্ষ। এর ভেতরের পরিবেশ একেবারে শান্ত। মন্দিরের চারদিকে সুন্দর বাগান। এর মধ্যে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে। যখন আকাশে সূর্য থাকে না তখন এই সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে আলো গোলকের ওপর পড়ে প্রতিফলিত হয়। শুরুর দুই দশকে এখানে কুড়িটি দেশের প্রায় চারশ জন বাস করতেন। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে, অরোভিলের রজতজয়ন্তী বর্ষে এখানকার লোকসংখ্যা ছিল ৫৪ টি দেশের ২৮১৪ জন। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ ভারতীয়।
এই শহরটির তৈরি করার পেছনে শ্রীমায়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সর্বজনীন ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ জাতি ধর্ম বর্ণ দেশ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা। এর থেকে মহান উদ্দেশ্য আর কী হতে পারে? মীরা আলফাসা ছিলেন অরবিন্দ আশ্রমের জননী। অরবিন্দও তাকে ‘The Mother’ সম্বোধেন সম্বোধন করতেন। আর বিশ্ব ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ নিয়ে এমন একটি মডেল শহরের জন্ম দেওয়া মহিলাকে তার জননী বললে বোধহয় খুব একটা ভুল বলা হবে না।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন শ্রীমা। মানুষের সঙ্গে দেক্ষাসাক্ষাৎ, ভক্তদের দর্শন দেওয়া প্রভৃতি বন্ধ করে দেন। কেবল ১৫ আগস্ট, গুরুদেব অরবিন্দের জন্মদিনের দিন শেষবার তাঁর ভক্তদের দর্শন দেন তিনি। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর মারা যান তিনি। আশ্রম ভবনের সামনের চত্ত্বরে অরবিন্দের সমাধির পাশে তাকে সমাধিস্ত করা হয়।

সৌরভকুমার ভূঞ্যা
তেরপেখ্যা, মহিষাদল
পূর্ব মেদিনীপুর, ৭২১৬২৮
৯৪৭৬৩৩০৫৩৩, ৭৪৩১৯৮৫৪৮৫

Share This
Categories
অনুগল্প নারী কথা প্রবন্ধ

ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব এবং মা সারদাদেবী সম্পর্কে কিছু কথা : রাণু সরকার।

ভারতের ৪২ সাধক এবং কিছু সাধিকা জীবদ্দশায় জীবন্মুক্ত। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মা সারদাদেবী উক্ত জীবন্মুক্ত মানুষদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা দুজন যথাক্রমে ভগবান্ ও ভগবতী, কারণ পরিপূর্ণ ঐশ্বর্য, পরিপূর্ণ ধর্ম, পরিপূর্ণ যশঃ, পরিপূর্ণ শ্রী, পরিপূর্ণ বৈরাগ্য এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান — এই ৬ টি ‘ভগ’ নামে কথিত হয়, আর এই ৬টি ‘ভগ’ পরিপূর্ণরূপে তাঁদের দুজনের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁরা দুজন ভিন্ন ভিন্ন শরীরে দৃশ্যমান হলেও এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বর বটে কারণ তাঁরা স্বরূপতঃ রজোগুণ ও তমোগুণ দ্বারা অনভিভূত বিশুদ্ধসত্ত্বগুণপ্রধান সমষ্টি অজ্ঞান উপহিত চৈতন্য, বিশুদ্ধসত্ত্বগুণসম্পন্ন মায়াতে পতিত চৈতন্যের প্রতিবিম্ব ; অব্যক্ত, অন্তর্যামী, জগৎকারণ, সর্বজ্ঞ। তাঁরা দুজন সদ্গুরু অর্থাৎ শ্রোত্রীয় এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ কারণ অস্তি নাস্তি এবং এতদুভয়ের পারে যে ব্রহ্ম অবস্থিত, তাঁকে তাঁরা দুজন উত্তমরূপে জানেন। তাঁদের সকল অবস্থিতি অর্থাৎ স্থানই পরম পবিত্র। অষ্টসিদ্ধ ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব হলেন ব্রহ্মবিদ্বরিষ্ঠ, তিনি প্রত্যগাত্ম-জ্ঞানসহায়ে তিনগুণের পরিণামরূপ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সর্ববিষয়ে তৃষ্ণারাহিত্যরূপ পরবৈরাগ্যবান্ পরমহংস সন্ন্যাসী। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব মহামায়ার সন্তান। মহামায়া, যিনি মহাপ্রণব ॐকারের কলাবিভাগ বা ষট্চক্রাদি ভূমিজয়ক্রমের ১১শ কলা অর্থাৎ যথাক্রমে ব্রহ্মমূখী ও সৃষ্টিমূখী অর্থাৎ যথাক্রমে বিন্দু ও বিসর্গ অর্থাৎ যথাক্রমে উন্মনা ও সমনা যিনি দক্ষিণেশ্বরের মা দক্ষিণাকালিরূপে এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মা সারদাদেবীরূপে বিরাজমান। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেবের ভাব হল মাতৃভাব, এই মাতৃভাব সাধনের শেষ কথা হল, “তুমি মা, আমি তোমার সন্তান।” ব্যবহারিক শব্দে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায় যে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব হলেন ব্রহ্ম এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মা সারদাদেবী হলেন শক্তি, আবার এমনও বলা যায় যে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মা সারদাদেবী দুজনই অনন্ত শক্তি যা অদ্বৈত অস্তিত্ব অর্থাৎ স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। শাস্ত্র বলেন, “ব্রহ্ম ও শক্তি অভিন্ন।”_

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

আমি সতেরও মা, অসতেরও মা – প্রয়াণ দিবসে শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী সম্পর্কে কিছু কথা।

“আমি সতেরও মা, অসতেরও মা — শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী “

আজ ২০ জুলাই। ১৯২০ সালে আজকের দিনেই ইহজগত ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মা সারদা। সারদা মা অত্যন্ত সহজ ভাবে জীবনের অতিবাহিত করার পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই তিনি গভীর দর্শনের কথা বলে গিয়েছেন, তা সত্যিই অবাক করার মতো। তাঁর দর্শন মেনে চললে জীবন ধারণ অনেক সহজ হয়ে যায়। জীবনে কোন পথে, কীভাবে চলতে হবে সেটাও বলে গিয়েছেন। আসলে তাঁর কাছে সবাই ছিল সন্তানের মতো। তাই সবাইকেই তিনি সন্তান মেনে কাছে টেনে নিতে পারতেন।

 

সারদা দেবী ছিলেন উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি হিন্দু ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসের পত্নী ও সাধনাসঙ্গিনী এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘজননী।ভক্তগণ সারদা দেবীকে শ্রীশ্রীমা নামে অভিহিত করে থাকেন। রামকৃষ্ণ আন্দোলনের বিকাশ ও প্রসারে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। হিন্দু নারী এবং হিন্দু – সহধর্মিনীর প্রকৃত প্রকাশ শ্রীশ্রীমার মধ্যে মূর্ত্ত হয়ে উঠেছিল । বিবাহিত হয়েও তিনি ছিলেন আজীবন ব্রহ্মচারিণী ; আবার ব্রহ্মচারিণী হয়েও গৃহিনী । তাঁর জীবন ছিল সরল , শুদ্ধ এবং প্রার্থনার নিবিড় নীরবতার মত শান্তিময় ও সাধনাময়।

জন্ম ও বংশ পরিচয়—

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম জয়রামবাটীর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর  সারদা দেবীর জন্ম হয়। তার পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। সারদা দেবীর পিতৃকূল মুখোপাধ্যায়-বংশ পুরুষানুক্রমে রামের উপাসক ছিলেন। সারদা দেবী ছিলেন তাদের জ্যেষ্ঠা কন্যা তথা প্রথম সন্তান। জন্মের পর প্রথমে সারদা দেবীর নাম রাখা হয়েছিল “ক্ষেমঙ্করী”। রাশ্যাশ্রিত নাম রাখা হয়েছিল “ঠাকুরমণি”। পরে “ক্ষেমঙ্করী” নামটি পালটে “সারদামণি” রাখা হয়।
বাল্যকালে সাধারণ গ্রামবাসী বাঙালি মেয়েদের মতো সারদা দেবীর জীবনও ছিল অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে। এক বার জয়রামবাটিতে দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার্তদের গরম খিচুড়ি বিতরণ করার সময় (তখন মা সারদার অল্প বয়স) তাঁর মধ্যে প্রকৃত জনসেবা করার রূপটি ফুটে উঠেছিল। ওই গরিব মানুষদের পাশে বসে হাতপাখায় তাদের বাতাস করে দিয়েছেন। ওই মানুষগুলো তখন মায়ের পরম স্নেহ পেয়ে আনন্দে মত্ত হয়ে উঠেছিল। অভাব, জ্বালা, যন্ত্রণা ভুলে সকলেই একাত্ম হয়েছিল সে দিন। আর মা সারদার এমন আচরণের নজির নানা উপলক্ষে রয়েছে একাধিক।অন্যের জন্য সহানুভূতির এই বোধ, এ সারদার জন্মগত। সারাজীবনই এই বোধ সঙ্গী তাঁর। সবার সব কষ্ট দূর হয় সে বোধে, কেবলমাত্র শ্রীশ্রীমা সারদা নামের আশ্রয়েই শীতল হয় কত অস্থির হৃদয়। সারদার একটাই পরিচয় তিনি সবার ‘মা’।

 

ছেলেবেলা–

ছেলেবেলায় ঘরের সাধারণ কাজকর্মের পাশাপাশি ছেলেবেলায় তিনি তার ভাইদের দেখাশোনা করতেন, জলে নেমে পোষা গোরুদের আহারের জন্য দলঘাস কাটতেন, ধানখেতে মুনিষদের (ক্ষেতমজুর) জন্য মুড়ি নিয়ে যেতেন, প্রয়োজনে ধান কুড়ানোর কাজও করেছেন। সারদা দেবীর প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা একেবারেই ছিল না। ছেলেবেলায় মাঝে মাঝে ভাইদের সঙ্গে পাঠশালায় যেতেন। তখন তার কিছু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মী দেবী ও শ্যামপুকুরে একটি মেয়ের কাছে ভাল করে লেখাপড়া করা শেখেন। ছেলেবেলায় গ্রামে আয়োজিত যাত্রা ও কথকতার আসর থেকেও অনেক পৌরাণিক আখ্যান ও শ্লোক শিখেছিলেন।

বিবাহ ও সংসার জীবন —

 

তিন বছরের বালিকা সারদার সঙ্গে এক গানের আসরে প্রথম দেখা রামকৃষ্ণের। নবীন গায়ক দলের দিকে সারদার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও’। বালিকা তার ছোট্ট তর্জনী অন্য দিকে রামকৃষ্ণের দিকে নির্দেশ করে বলল— একে। এরপর পাঁচ বছরের বালিকা সারদার বিবাহ হল চব্বিশ বছরের যুবক রামকৃষ্ণের সঙ্গে। রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালীর মন্দিরের পূজারি

১৮৫৯ সালের মে মাসে, সেকালে প্রচলিত গ্রাম্য প্রথা অনুসারে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ। বিবাহের পরেও সারদা দেবী তার পিতামাতার তত্ত্বাবধানেই রইলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ফিরে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে।এরপর চোদ্দো বছর বয়সে প্রথম সারদা দেবী স্বামী সন্দর্শনে কামারপুকুরে আসেন। এই সময় তিনি যে তিন মাস শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বাস করেছিলেন, তখনই ধ্যান ও অধ্যাত্ম জীবনের প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি পান তার স্বামীর থেকে।

 

দক্ষিণেশ্বর যাত্রা—

আঠারো বছর বয়সে তিনি শোনেন, তার স্বামী পাগল হয়ে গেছেন। আবার এও শোনেন যে তার স্বামী একজন মহান সন্তে রূপান্তরিত হয়েছেন। তখন তিনি দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৮৭২ সালের ২৩ মার্চ পিতার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে আসার পর তার ভয় ও সন্দেহ অপসারিত হয়। তিনি বুঝতে পারেন, তার স্বামী সম্পর্কে যে সব গুজবগুলি রটেছিল তা কেবলই সংসারী লোকের নির্বোধ ধারণামাত্র। তিনি দেখলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ তখন সত্যিই এক মহান আধ্যাত্মিক গুরু। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এসে নহবতের একতলার একটি ছোটো ঘরে তিনি বাস করতে শুরু করলেন। ১৮৮৫ সাল অবধি তিনি দক্ষিণেশ্বরেই ছিলেন। তবে মাঝে মাঝে তার গ্রাম জয়রামবাটিতে গিয়েও স্বল্প সময়ের জন্য বাস করতেন। এই সময় সারদা দেবী ও দিব্য মাতৃকাকে অভিন্ন জ্ঞান করে শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন। কালীর আসনে বসিয়ে পুষ্প ও উপাচার দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পূজা করেন তাকে। অন্য সকল নারীর মতো সারদা দেবীকেও তিনি দেবীর অবতার বলে মনে করতেন। এই কারণে তাদের বৈবাহিক জীবনও ছিল এক শুদ্ধ আধ্যাত্মিক সঙ্গত।সারদা দেবীকেই মনে করা হয় তার প্রথম শিষ্য।
কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণ দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন যে তার আধ্যাত্মিক প্রচারকার্য পরবর্তীকালে চালিয়ে নিয়ে যাবেন সারদা দেবী। সেই কারণে তিনি তাকে মন্ত্রশিক্ষা দেন এবং মানুষকে দীক্ষিত করে আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করতে পারার শিক্ষাও দান করেন। শেষ জীবনে যখন শ্রীরামকৃষ্ণ গলার ক্যানসারে আক্রান্ত তখন সারদা দেবীই স্বামীর সেবা এবং স্বামী ও তার শিষ্যদের জন্য রন্ধনকার্য করতেন।

তীর্থ যাত্রা–

শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাকে কেন্দ্র করে অঙ্কুরিত ধর্ম আন্দোলনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সারদা দেবী। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের দুই সপ্তাহ পর লক্ষ্মী দেবী, গোপাল মা প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহস্থ ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে সারদা দেবী উত্তর ভারতের তীর্থ পর্যটনে যাত্রা করেন। রামচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত অযোধ্যা ও কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করেন তারা। পরে তিনি দর্শন করেন কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন। কথিত আছে, এই বৃন্দাবনেই সারদা দেবীর নির্বিকল্প সমাধি লাভ হয়েছিল। এবং এই বৃন্দাবন থেকেই গুরু রূপে তার জীবনের সূত্রপাত হয়। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, যোগেন মহারাজ প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের তিনি মন্ত্রদীক্ষা দান করেন। বৃন্দাবনেই শ্রীশ্রীমা রূপে তার সত্তার সূচনা ঘটে। তার জীবনীকার ও শিষ্যদের মতে, তাকে মা বলে ডাকা কেবলমাত্র সম্মানপ্রদর্শনের বিষয়ই ছিল না। যাঁরাই তার সাক্ষাতে আসতেন, তারাই তার মধ্যে মাতৃত্বের গুণটি আবিষ্কার করতেন।

 

বাগবাজারের মায়ের বাটী—

তীর্থযাত্রার শেষে সারদা দেবী কয়েকমাস কামারপুকুরে বাস করেন। এই সময় একাকী অত্যন্ত দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। ১৮৮৮ সালে এই খবর শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী শিষ্যদের কানে পৌঁছলে তারা তাকে কলকাতায় নিয়ে এসে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। স্বামী সারদানন্দ কলকাতায় তার জন্য স্থায়ী বাসভবন নির্মাণ করান।

মা সারদা ও শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলন–

‘মায়ের বাটী’ নামে পরিচিত বাগবাজারের এই বাড়িটিতেই জয়রামবাটীর পর সারদা দেবী জীবনের দীর্ঘতম সময় অতিবাহিত করেছিলেন। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত এই বাড়িতে তার দর্শন, উপদেশ ও দীক্ষালাভের আশায় ভিড় জমাতেন। তার মাতৃসমা মূর্তি ও মাতৃসুলভ ব্যবহার সকলকে মানসিক শান্তি দিত। তার নিজের সন্তানাদি না থাকলেও, শিষ্য ও ভক্তদের তিনি মনে করতেন তার আধ্যাত্মিক সন্তান।শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের প্রয়াণের পর রামকৃষ্ণ আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং ভক্তদের বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা দেবীর সত্তায় কোনো পার্থক্য আরোপ না করতে। বলা হয়, কয়েকজন শিষ্যও তার দর্শন লাভের পর আধ্যাত্মিক অনুভূতি প্রাপ্ত হন। কেউ কেউ তার সাক্ষাৎ দর্শনের পূর্বেই দেবী রূপে তার দর্শন লাভ করেন। আবার কেউ কেউ স্বপ্নে তার থেকে দীক্ষা লাভ করেন বলেও কথিত আছে। এইরকমই একটি উদাহরণ হল, বাংলা নাটকের জনক গিরিশচন্দ্র ঘোষ, যিনি মাত্র উনিশ বছর বয়সে স্বপ্নে তার কাছে থেকে মন্ত্র লাভ করেছিলেন। অনেক বছর পরে যখন তিনি সারদা দেবীর সাক্ষাৎ লাভ করেন, তখন অবাক হয়ে দেখেন তার স্বপ্নে দেখা দেবী আসলে ইনিই। উদ্বোধন ভবনে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যারা তার সঙ্গ দিতেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গোপাল মা, যোগিন মা, গৌরী দিদি ও লক্ষ্মী মা।

জীবনের অন্তিম লগ্ন–

১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীমা জয়রামবাটী যাত্রা করেন এবং সেখানেই এক বছর কাটান। জয়রামবাটীতে অবস্থানের শেষ তিন মাস তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ১৯২০ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি অশক্ত অবস্থায় তাকে কলকাতায় আনা হয়। পরের পাঁচ মাস তিনি রোগযন্ত্রণায় অত্যন্ত কষ্ট পান। মৃত্যুর পূর্বে এক শোকাতুরা শিষ্যাকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন,যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখ। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার। মনে করা হয় এই উপদেশটিই বিশ্বের উদ্দেশ্যে তার শেষ বার্তা।

 

তার প্রধান শিষ্যগণ–

স্বামী নিখিলানন্দ, স্বামী বীরেশ্বরানন্দ, স্বামী অশেষানন্দ, স্বামী বিরজানন্দ।

উপদেশ ও উক্তি—

“আমি সত্যিকারের মা; গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয় – সত্য জননী।”
“মানুষ তো ভগবানকে ভুলেই আছে। তাই যখন যখন দরকার, তিনি নিজে এক একবার এসে সাধন করে পথ দেখিয়ে দেন। এবার দেখালেন ত্যাগ।”
“যেমন ফুল নাড়তে-চাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ বের হয়, তেমনি ভগবত্তত্ত্বের আলোচনা করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়।
ভালবাসায় সবকিছু হয়, জোর করে কায়দায় ফেলে কাউকে দিয়ে কিছু করানো যায় না।”
“সৎসঙ্গে মেশো, ভাল হতে চেষ্টা কর, ক্রমে সব হবে।”
“কাজ করা চাই বইকি, কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়, তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদণ্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়।”
“মনটাকে বসিয়ে আলগা না দিয়ে কাজ করা ঢের ভাল। মন আলগা হলেই যত গোল বাধায়।”
“আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।”
“ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে কজনে? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা বলতে পারে কজনে?”
শ্রীশ্রীমা ছিলেন ভারতীয় নারীর আদর্শের প্রতীক । তিনি প্রাচীনা হয়েও নবীনা ছিলেন । ভারতীয় প্রাচীন আদর্শে মন্ডিত হয়েও তিনি আধুনিক হিন্দুনারীর সমুজ্জল প্রতীক ছিলেন ।কুসংস্কার ও শিক্ষার অভাবে বিভ্রান্ত ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও চেতনা ফিরিয়ে আনার কাজে যখন স্বামী বিবেকানন্দ  আসমুদ্রহিমাচল পদব্রজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন সারদা দেবী ছিলেন তাঁর একমাত্র প্রেরণা । তাঁর আশীর্বাদপুত অধুনা বিস্তৃত রামকৃষ্ণ মিশন আজ বিশ্ববিখ্যাত।   শ্রীমা বলতেন , “ শ্রীরামকৃষ্ণ ও আমি অভেদ । আমার আশীষ তাঁর আশীষতুল্য বলে মনে করবে ।”
জাতিধর্মনির্বিশেষে তার করুণা সবাইকে শান্তি ও আধ্যাত্মিক পথের সন্ধান দিয়েছে । সীতা , সাবিত্রী , শ্রীরাধা , মীরাবাঈ প্রভৃতির মত শ্রীশ্রীমাও ভারতীয় নারী জাতির আদর্শে পূর্ণ প্রকাশিত হয়েছিলেন । মায়ের উপদেশ আজও জীবনে মেনে চলেন অনেকে। তিনি বলেন, ভালবাসায় সবকিছু হয়, জোর করে কায়দায় ফেলে কাউকে দিয়ে কিছু করানো যায় না।”শ্রীশ্রী মা ছিলেন সকলের মা ;এই  বিশ্বজগতের মা। স্বামী বিবেকানন্দ সারদা দেবীকে ,জীবন্ত দুর্গা বলে অভিহিত করেছিলেন ।রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা তাঁকে ‘সংঘ জননী’ বলে জানতেন।

অন্তিম যাত্রা–

১৯২০ সালের ২০ জুলাই রাত দেড়টায় কলকাতার উদ্বোধন ভবনে তার প্রয়াণ ঘটে। বেলুড় মঠে গঙ্গার তীরে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এই স্থানটিতেই বর্তমানে গড়ে উঠেছে শ্রীমা সারদা দেবীর সমাধিমন্দির।

 

উপসংহার—-

 

মা ছিলেন সকল সামাজিক বিধিনিষেধের ওপরে।  তাকে গন্ডিভাঙা মা বলে ভক্তেরা অভিহিত করেছেন।  মা সকলের ইহকাল ও পরকালের আশ্রয়। সকলেই তার করুণা লাভ করেছে।  মুচি,  মেথর,  ডোম,  বাগদি, চন্ডাল, মুসলমান, আতুর সকলেই মায়ের কাছে অবাধ আশ্রয় পেয়ে ধন্য হয়েছে। তাই তো তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের মা।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া।।

Share This
Categories
উপন্যাস নারী কথা

 দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, নবম পর্ব) : দিলীপ রায়।

কুহেলি চায়ের দোকান খোলায় মুরারী ঘটক বেঁকে বসলো । পরেরদিন সোজা কুহেলিকে ধমক ! মুরারী ঘটক ধমক দিয়ে কুহেলিকে বলল, “এখানে চায়ের দোকান খোলা চলবে না । আমার একমাত্র চায়ের দোকান, সেটা ভীষণ চালু । সুতরাং মোড়ের মাথায় অন্য কারও চায়ের দোকান আমি খুলতে দেবো না ।“
আমার অপরাধ !
অপরাধ কিনা বলতে পারবো না । তবে তুমি দোকান গুটিয়ে না নিলে আমাকে জোরপূর্বক তোমার দোকান ভেঙ্গে দিতে হবে । সেটা আমি করতে চাই না । ছোট্ট একটু জায়গায় দুটি চায়ের দোকান কখনও চলতে পারে না ।“
“কিন্তু কাকু, আমি চায়ের দোকান বন্ধ করার জন্য খুলিনি । আমি সংসার চালানোর জন্য চায়ের দোকান খুলেছি । আর একটা কথা, খবরদার কখনও আমার দোকান ভেঙ্গে দেওয়ার কথা মুখে আনবেন না । আমি নারী বলে ভাববেন না, আমি অবলা । আমাকে কখনই অবলা ঠাউরাবেন না । আমার দোকানের কিছু একটা অঘটন ঘটলে তখন টের পাবেন, আমি কতোটা তেজি ! কথাটা মাথায় রাখবেন ।“ তেজস্বিনীর মতো চোখ গরম করে অথচ ঠাণ্ডা মাথায় কথাগুলো শুনিয়ে দিলো কুহেলি । কুহেলি একটা ব্যাপারে পরিষ্কার, আপদ শুরুতেই বিনষ্ট না করলে ভবিষ্যতে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে । তাই এতগুলি কথা শোনানো । তা ছাড়া খবর নিয়ে জেনেছে, মুরারী ঘটকের বাড়ি লোহাদহ গ্রামে । নিজের গ্রামে দোকান খুলতে পারেনি । নিজের খামখেয়ালিপনার জন্য সেখান থেকে বিতাড়িত । মোড়ের মাথায় তার বিরূদ্ধে কেউ কিছু বলার নেই, তাই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ।
মুরারী ঘটক ঠায় দাঁড়িয়ে কুহেলির কথা শুনলো । একটিও টুঁ শব্দ করলো না । মেয়েটির তেজ দেখে ঘটক অবাক ! বরং মেয়েটার কথা শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলো । মেয়েটাকে ঘায়েল করতে গেলে কথা শুনিয়ে লাভ হবে না । তাকে বশে আনতে অন্য ষড়ষন্ত্রের পন্থা প্রয়োগ করতে হবে । পাড়ার মস্তান লাগাতে হবে । তারা এসে কয়েক ঘা দিলে মেয়েটি টের পাবে “কত ধানে কত চাল” ।
সোমবার । খুব সকালে দোকান খোলার রেওয়াজ ! কেননা কলকাতা বা সন্নিহিত অঞ্চলে যারা চাকরি করেন তাঁরা সপ্তাহান্তে বাড়ি আসেন এবং সোমবার খুব ভোরে কাঞ্চন নগরের মোড় থেকে গাড়ি ধরেন । মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক কাপ চা ও বিস্কুট খেয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু । তাই কুহেলির সকাল সকাল দোকান খোলা এবং যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চা বানিয়ে খরিদ্দারদের মধ্যে চা পরিবেশন করা ।
দোকানে পৌঁছে কুহেলির চক্ষু চড়কগাছ ! তার দোকানের ইটের উনুন ভাঙ্গা । রাগে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে সোজা মুরারী ঘটকের উপরে চোটপাট, “আপনি আমার দোকান ভেঙ্গেছেন । আমিও আপনাকে এখানে দোকান চালাতে দেবো না ।“ বলেই হামানদিস্তার আঘাতে তার গ্যাসের উনুন ভেঙ্গে দিয়ে বলল, “এক্ষুণি আমার উনুন সারিয়ে না দিলে আমি তোমাদের দোকান কিছুতেই চালাতে দেবো না । মেয়ে হলেও আপনাদের মতো ধুরন্ধরদের শিক্ষা দিতে আমার হাত এতটুকু কাঁপে না ।“
বারবার চেচিয়ে মুরারী ঘটক কুহেলিকে বলল, “আমরা তোমার দোকান ভাঙ্গিনি । এটা অন্য কারও কাজ !” মুরারী ঘটকের কোনো কথা শোনার ধৈর্য কুহেলির নেই । কুহেলি চায়ের দোকান খুলতে পারছে না । এখানেই তার রাগ । সোমবার দোকান খুললে কিছুটা পয়সার মুখ দেখতে পায় । সেই পয়সায় তার সপ্তাহের সবজির বাজার চলে । সেটা বন্ধ ! তার পেটের ভাত বন্ধ করে দেওয়ার বিরূদ্ধে কুহেলির গর্জন ! ক্রোধে অগ্নিশর্মা !
চিৎকার চেচামেচি । মোড়ের মাথায় মানুষের জটলা । কুহেলি কিছুতেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয় । অন্যদিকে মুরারী ঘটকও থামছে না । তার বক্তব্য দোষ করলাম না, অথচ আমাকে দোষী বানিয়ে মেয়েটার আস্ফালন ! কুহেলির তর সইলো না । অথচ সরাসরি আমাকে আক্রমণ !
ঘটক তার দোকানের গ্যাসের উনুন ভাঙ্গার একটা বিহিত চায় এবং সেটা তখনই চায় । যার জন্য ঘটক সরাসরি থানায় ফোন করলো ।
থানার বড়বাবু এক গাড়ি পুলিশ নিয়ে স্পটে হাজির । বড়বাবু কুহেলি ও মুরারী ঘটককে ডেকে আলোচনায় বসলেন । মুরারী ঘটকের বক্তব্য, “এটা ঘটনা, মেয়েটা চায়ের দোকান খোলার পর আমি মেয়েটাকে ধমক দিয়েছিলাম । তারপর যখন জানলাম, মেয়েটা সানাইয়ের মেয়ে । বেঁচে থাকবার জন্য তার চায়ের দোকান খোলা । তাই সে মেয়েটার দোকান তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আর কোনো কৌতুহল দেখায়নি । ঘটক মনে করে, মেয়েটা সৎভাবে কাজকর্ম করে বেঁচে থাকতে চাইছে । বাঁচুক । সম্ভব হলে, ঘটক মেয়েটাকে সমস্তরকম সহযোগিতা করবে ! কিন্তু কখনই দোকান ভাঙচুরের কথা ভাবেনি । এই দুষ্কর্ম অন্য দুষ্কৃতিদের কাজ ।“
বড়বাবু মনোযোগ দিয়ে দুজনের কথ শুনলেন । তারপর ঐ রাস্তা দিয়ে পথ চলতি মানুষের সঙ্গেও কথা বললেন ।
ইতিমধ্যে কয়লার উনুনে চা বানিয়ে মাটির ভাঁড়ে সেই চা সোজা বড়বাবুর সামনে রাখলো মুরারী ঘটক । বড়বাবুকে ঘটক বলল, ‘স্যার, মেয়েটাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না এইরকম জঘন্য কাজ আমার দ্বারা অসম্ভব । মেয়েটা আপনার কাছে আমার বিরূদ্ধে অভিযোগ করছে । অথচ মেয়েটা বুঝতে চাইছে না, কারও বিরূদ্ধে অভিযোগ জানাতে গেলে প্রমাণ সহযোগে তার বিরূদ্ধে অভিযোগ জানাতে হয় । অহেতুক সন্দেহের বশে আমাকে যাচ্ছেতাই ভাবে দোষারোপ করছে । শুধু তাই নয়, অবান্তর কথাবার্তা বলছে ।“
বড়বাবু ঘটককে বললেন, “আপনি আপনার দোকানে গিয়ে বসুন । আমরা আপনাদের অশান্তির সুরাহা করতেই এসেছি । সুতরাং আমাদের কাজে বাধা দেবেন না ।“
মুরারী ঘটক একটি বাক্য ব্যয় না করে সরাসরি দোকানে গিয়ে চায়ের জল কয়লার উনুনে বসালো ।
থানার বড়বাবু পুনরায় শুধুমাত্র কুহেলিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইতিপূর্বে আপনাকে এলাকার ছেলে-ছোকরারা কোনোদিন বিরক্ত করেছিল ।“
হ্যাঁ স্যার, করেছিল !
কী নাম তার ?
ক্যাবলা কিরণ ।
ক্যাবলা কারও নাম হয় নাকি ?
কুহেলি হেসে উত্তর দিলো, “তাকে আমি ক্যাবলা বলে ডাকি । তার নাম কিরণ । আপনি তাকে কিরণ নামেই ডাকবেন স্যার ।“
কী ধরনের উত্ত্যক্ত, জানাবেন প্লীজ ?
কিরণের বিরক্ত করার ধরন আলাদা । তার ধান্দা ছিল আমার শ্লীলতাহানি । চুরির প্রবণতা তার মধ্যে দেখিনি । তবে আমার হাতে জব্দ হওয়ার পর কিরণকে আমার আশেপাশে আর কোনোদিন দেখা যায়নি ।
বড়বাবু শুধুমাত্র কিরণের নামটা নোট করে নিয়ে বললেন, “এই জাতীয় আর কোনো সমস্যায় আপনি পড়েছিলেন কী ?
না স্যার । অল্পবিস্তর রাস্তাঘাটে যেটুকু হয়েছিল, সেটা সমস্ত উঠতি মেয়েদের জীবনে ঘটে । নতুন করে বলার কিছু নেই ।
তারপর বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে কুহেলি বলল, “স্যার, আমাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দিন । আমার দোকান এইভাবে ভেঙ্গে দিলে আমি না খেয়ে মারা যাবো স্যার !”
বাবা-মা নেই শুনলাম ! বাড়িতে আর কে কে আছে ?
হতাশভাবে কুহেলি উত্তর দিলো, “পৃথিবীতে আমি শুধুমাত্র একা ।“
আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী ?
স্যার আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি ।
“আপনার জীবনের বাস্তব কাহিনী শুনে আমরা হতভম্ব ! খুব করুণ কাহিনী । খুব দুঃখজনক ! খুব সাবধানে থাকবেন । প্রয়োজনে আমাদের খবর দেবেন । আমরা আপনার পাশে আছি । কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবেন না । আমরা চাই, আপনার চায়ের দোকান ঠিকঠাক চলুক । আমরা এবার থানার দিকে রওনা দিচ্ছি ।“ থানার বড়বাবু চলে গেলেন ।
মাত্র কয়েকদিনে কুহেলির চায়ের দোকান এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় । তার দোকানের চা খেয়ে খরিদ্দারদের তৃপ্তি আলাদা । যেসব খরিদ্দার ঘটকের দোকানে নিয়মিত চা খেতেন, তারাও কুহেলির দোকানে ভিড় করছেন । তা ছাড়া বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কুহেলির চায়ের দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার । খরিদ্দারের ভিড় মূলত ভোরের সকালে ও বিকেল চারটে থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত । সেই সময়ে চা বানানোতেই কুহেলিকে ধ্যান দিতে হয় । সেই সময় কুহেলির এদিক-ওদিক তাকাবার ফুরসত থাকে না । ছাতা টাঙিয়ে তার দোকান । সামনে দুটো বসার বেঞ্চ । বিকেলে খরিদ্দারদের বসার জায়গা দেওয়া যায় না । খরিদ্দারেরা কুহেলির ব্যবহারে এতটাই প্রীত যে, তাঁরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেতেও কুন্ঠাবোধ করেন না । এতটাই তাঁদের কুহেলির প্রতি দরদ বা ভালবাসা !
কুহেলি এবার দোকান ঘর তৈরীর কথা ভাবছে । রাস্তার পাশে পাকাপোক্ত ঘর বানানো অসম্ভব । কেননা জায়গাটা সরকারি জায়গা । যেকোনো মুহূর্তে দোকান ঘর ভেঙ্গে দিতে পারে । সুতরাং সকল দোকানদারদের মতো অস্থায়ী ঘর বানানোর কথা ভাবছে কুহেলি । কিন্তু ঘর বানানোর মতো আর্থিক পরিস্থিতি এখনও তার অনুকূল নয় । তাই সময় নিচ্ছে । তবে দোকানের বিক্রিবাট্টা ভাল হওয়ার কারণে কুহেলি আশাবাদী, শীঘ্রই তার পক্ষে ঘর বানানো সম্ভব । কিন্তু এই মুহূর্তে তার আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী নয়, বরং দুর্বল ।
কুহেলির জীবনে এখন একটাই চিন্তা, পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আর দূরশিক্ষার মাধ্যমে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নেওয়া ।
ইতিমধ্যে ভরতপুর-লোহাদহ বাস রুটে দুটো নতুন বাস চালু হলো । ফলে কাঞ্চন নগরের মোড় দিয়ে দূরদূরান্তের বিভিন্ন গ্রামের মানুষের যাতায়াত বাড়লো । কাঞ্চন নগরের মোড়ের গুরুত্ব আরও বাড়লো । সারাদিন কমবেশী মানুষের যাতায়াত সর্বক্ষণ । অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর দোকানও খুললো । সরষে থেকে তেল বের করার যন্ত্র ঘানির মেশিন বসলো । কামার, কুমোর, ছাড়াও টেলারিং, ধোপা-নাপিতের দোকান, রেডিমেট জামা-কাপড়ের দোকান, সবজির দোকান, ইত্যাদি বসলো । অনেক টোটো, রিক্সা, চালু হলো । টোটোর মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রামের সাথে কাঞ্চন নগরের মোড়ের সঙ্গে সংযোগ বাড়লো । ফলে টোটো-রিক্সার পরিষেবা রমরমা । আগামীদিনে কাঞ্চন নগরের মোড় আরও উন্নত করার সরাকারি পরিকল্পনা সকলের জানা । এইজন্য স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেছেন । যার জন্য কুহেলি দোকানটা বড় করবার চিন্তায় অস্থির ।
গ্রামবাংলা ঘেঁষা ভরতপুর-লোহাদহ রুট । আগামীতে লোহাদহ ঘাটে বাবলা নদীর উপর ব্রীজ হলে সোনায় সোহাগা । বহরমপুর থেকে সরাসরি বাস চলবে এই রুটে । তখন কাঞ্চন নগরের মোড়ের মর্যাদা আরও বাড়বে । গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখন অনেক বেশী শিক্ষিত । তাঁরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কর্মরত । তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে গ্রামের মান-মর্যাদা বাড়াতে তৎপর । যার জন্য উন্নয়নের জোয়ার আসছে । সেটা কুহেলি স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারছে । তাই তার মনের ভিতর সর্বক্ষণ চিন্তা, একটা দোকান ঘর ।
কানাই কাকা আলাপ করে দিলো কান্দীর যোগেশ বর্মনের সাথে । যোগেশ বর্মন কানাই কাকার বিশেষ বন্ধু । তাঁদের একসঙ্গে পড়াশুনা । গ্রাম থেকে উঠে গিয়ে কান্দীতে বাড়ি করেছেন । খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠিত । কানাই কাকার অনুরোধে যোগেশ বর্মন সহযোগিতার হাত বাড়িতে দিলেন কুহেলিকে । তাঁর একটাই শর্ত, টাকা ধার নিলে সময়ে শোধ দিতে হবে এবং টাকা শোধ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনে সময় বাড়িয়ে দিতে তাঁর আপত্তি নেই । শুরু হলো, যোগেশ বর্মনের আর্থিক সহায়তায় কুহেলির স্বপ্নের দোকানের ঘর বানানো ।
উপরে ছাদ দেওয়া যাবে না । রাস্তার পাশে ঘর । সুতরাং যেকোনো সময় সরকারি কোপ পড়তে পারে । তাদের উঠিয়ে দিতে পারে । তাই টিনের চাল দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে ।
হঠাৎ পুলিশের ফোন ! থানার বড়বাবুর ফোন নম্বর দেখে চমকে গেলো কুহেলি । আবার বড়বাবুর ফোন কেন ?
হ্যালো স্যার । কিছু বলবেন ?
হ্যাঁ । আপনার দোকান ভাঙ্গার পেছনে একটা নারী পাচার চক্র কাজ করছে । সুতরাং আপনি সাবধানে থাকবেন । আপনাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য আমার টেলিফোন । যেকোনো সময় আপনাকে ঐ চক্র তুলে নিয়ে যেতে পারে । আপনি একা একা রাত্রিতে বাড়ি ফিরবেন না, এমনকি কোথাও যাবেন না । তা ছাড়া রাত্রিবেলায় বেশী রাত পর্যন্ত চায়ের দোকান চালু রাখাটাও নিরাপদ হবে না । অস্বাভাবিক কিছু বুঝলে অবশ্যই থানায় খবর দেবেন ।
ঘাবড়ে গেলো কুহেলি । পরক্ষণেই পালটা জিজ্ঞাসা করলো থানার বড়বাবুকে, “তাহলে আমার দোকানে ভাঙচুর কারা চালালো ?”
এখনও পরিষ্কার নয় । তবে নারী পাচার চক্রের স্থানীয় মদতদাতা দোকান ভাঙচুরের সাথে জড়িত । মদতদাতার নাম বা তার ঠিকানা এখনও উদ্ধার হয়নি । তবে এই নারী পাচার চক্রটির নেটওয়ার্ক বিশাল বড় । পুলিশি অভিযান চলছে । আপাতত আমাদের থানার অধীনে তাদের টার্গেট, আপনাকে তুলে নিয়ে ভিন্‌ দেশে চালান করে দেওয়া । তারা জানতে পেরেছে, আপনার বাবা অন্য একজন বিধবার সাথে পালিয়েছেন, এইজন্য তাদের ধারনা আপনাকে অপহরণ করা তাদের পক্ষে খুব সহজ ! তাই কুহেলি দেবী, আপনাকে আমাদের অনুরোধ চক্রটি যতদিন ধরা না পড়ছে ততদিন একটু সাবধানে থাকবেন ।
কান্দী বাজার থেকে ঘরের মাথায় কর্কেট টিনের চালা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টিন কিনে আনলো । কর্কেট টিন কিনে কান্দী বাস স্ট্যাণ্ড থেকে বাসের মাথায় চাপিয়ে ভরতপুরে নামতেই বেলা গড়িয়ে গেলো । তারপর ভরতপুরে ভ্যান রিক্সার আকাল ! বেশীর ভাগ মেশিন চালিত ভ্যান রিক্সা । তাদের ভাড়ার রেট বেশী । অবশেষে শুকুর আলীর ভ্যান রিক্সা পাওয়া গেলো বটে, কিন্তু তার ভ্যান রিক্সায় এতগুলি টিন ধরবে না । আরও একটা ভ্যান রিক্সা দরকার । কিন্তু দ্বিতীয় ভ্যান রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না । অবশেষে বিডিও অফিসের পাশ থেকে অপর ভ্যান রিক্সাটি পাওয়া গেলো । তারপর দুটি ভ্যান রিক্সা ভাড়া করে সেই টিন ভ্যানে তুললো । সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো । দোকানে যখন টিন নিয়ে পৌঁছালো, তখন ঘড়িতে রাত্রি আটটা । টিনগুলি কাঞ্চন নগরের মোড়ে রেখে গেলেও বিপদ ! কেউ চুরি করে পালাবে । আচ্ছা জ্বালায় পড়লো কুহেলি । শেষে মুরারী ঘটক এগিয়ে এসে বলল, “আমার দোকানে টিনগুলি রেখে নিশ্চিন্তে তুমি বাড়ি যাও । অনেক রাত হয়েছে । দিন-কাল বা রাস্তা-ঘাটের অবস্থা ভাল না । অহেতুক সময় নষ্ট না করে তুমি বাড়ি চলে যাও । আমি টিনগুলি ঘরে তুলে রেখে তবেই আমি বাড়ি ফিরব ।“
কাঞ্চন নগরের দিকে যেতে ছোট্ট একটা বাঁক ! রাস্তাটা দক্ষিণদিকে বাঁক নিয়েছে । বাঁকের আশেপাশে অনেক গাছপালা । ঘন অন্ধকার । চারিদিকে জোনাকিরা মিটমিট আলো দিচ্ছে । গা ছমছমে পরিবেশ । রাস্তা দিয়ে হাঁটতে কুহেলি রীতিমতো ঘামছে । অন্ধকারে চার চাকার গাড়ি দাঁড় করানো ? গাড়ি থেকে একটা মৃদুমন্দ স্বরে ডাক ভেসে আসছে, “কুহেলি !”
(চলবে)

Share This
Categories
অনুগল্প কবিতা নারী কথা

যেতে হবে পরের ঘরে : রাণু সরকার।

প্রথম পর্ব

আমার এক পিসি বনগাঁ থাকে একটু ভেতরের দিকে গ্রামে। আমি সেখানে বছরে দু’একবার যাই। ঘুমিয়ে ছিলাম খুব ভোরে হঠাৎ কানে এলো উলুর ধ্বনি,আমি মনে মনে ভাবলাম-
এইরে- এবার না জানি কোন মেয়ের সর্বনাশ হতে চলেছে। আমার মনে আসার অনেক কারণ আছে।
আমার দেখা এরকম অনেক ঘটনা এখানে ঘটেছে।
এখানে আমার এক বন্ধবী সেও কত কষ্টে আছে। আমার বাড়ি কলকাতা আশে পাশেও দেখছি তাই খারাপ ভাবনা মনে আসাটাই স্বাভাবিক।

কোনো মেয়ের বিয়ের কথা শুনলে কিম্বা দেখলে
আমার ভীষণ ভয় লাগে কষ্টের পাশে রাগও থাকে।
আমি চলে গেলাম মেয়েটির বাড়ি আমার পিসির বাড়ির থেকে দশ পা- মেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম-
এই মেয়ে, তোর নামটা কি যেন ভুলে গেছি সেই ছোটবেলায় তোকে এই ইছামতি নদীতে স্নান করতে দেখতাম আমি এখানে আসলেই।
গালে হলুদ মাখানো আজ তোর বিয়ে বুঝি?
মেয়েটি উত্তর দিলো তুমি এসব দেখে বুঝতে পারছো না, এটাও কি দিতে হবে বলে?

রাগ করে কথা বলছিস যে-জোর করে দিচ্ছে নাকি বিয়ে?
একটু বড় হলে বাপের ঘরে থাকতে নেই- এটাও কি বুঝিয়ে দিতে হবে?
তোর বাপ মা তোকে ছেড়ে থাকতে পারবে? তুই তো তাদের একটিই মেয়ে।
বাপ-মা যদি মায়া কাটিয়ে থাকতে পারে-
আমারও পারতে হবে।

আমি বোঝালাম-
শোন মেয়ে, বাবের ঘর ছেড়ে শ্বশুর ঘরে যেতে হয় সব মেয়েদের পাগলামী করিস না মেয়েদের যদি বিয়ে না হতো তাহলে কি করে ফুল ফুটতো ও ফল পেতো?

কষ্টের হাসি হেসে সে বললো- মেয়েদের বেলায় নিয়ম-নিষেধ যত- তাই না, তুমি বলো?
ধুর পাগলি, কাঁদিস কেন-বাপের ঘরের মায়া ত্যাগ করতে কষ্ট হচ্ছে বুঝেছি?
ত্যাগ না করলে শ্বশুর ঘর চিনবি কি করে
সেই জন্য সব মেয়েকে যেতে হয় শ্বশুরবাড়িতে
মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেলো।

____________________________

যেতে হবে পরের ঘরে
(দ্বিতীয় পর্ব)

কয়েক মাস পর আবার গিয়েছিলাম সেই পিসির বাড়ি,
গভীর রাতে কানে এলো চিৎকার ও কান্নার শব্দ।
মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল-
কী জানি কার আবার কী হলো।

শুয়ে ভাবছি কখন ভোর হবে-
দেখতে যাবো কার কী হলো।

ভোর হতেই তাড়াতাড়ি উঠে
হাঁটা দিলাম সেই বাড়ির দিকে
গিয়ে দেখি, সেই বাড়ি সেই মেয়ে
ঘরে ঢুকে দেখি, মেয়েটি চুপ করে শুয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম-
এই মেয়ে কী হলো রে তোর,
মরতে গেলি কেন?

কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
মরতে গিয়েছিলাম, পারলাম কই মরতে,
খেতে গিয়েছিলাম ইঁদুর মারা বিষ
যমের কাছেও আমি অরুচি।

তবে এসব নাটক করলি কেনো-
মরতে তো পারলিই না,
গ্রামের লোকের সুযোগ করেদিলি কানা-কানি, হাসা-হাসি করতে।
তোর মা-বাপের কি হুশ এলো?
তখনই বোঝা উচিত ছিলো যে- আমার কালো মেয়ে।

তখন বলেছিলি বিয়ে করবিনা-
জোর করে ঠেলে দিলো তাদের হাতে। পণ যা চেয়েছিলো ছেলের বাড়ি থেকে তা দিতে পারলো না তোর বাবা। কালো মেয়ের দিলো বিয়ে।
তখন তোর মানা শোনেনি।

কয়েক মাস আগে তোর বিয়ের দিন আমি এসেছিলাম। দেখ কি ভাগ্য আমার এবারো আমি এসেছি।
কিছু বলবো ভেবেছিলাম সেদিন পারিনি বলতে,
আমি জানতাম এরকম কিছু একটা ঘটবে-
ঠিক ঘটলো। যেহেতু তুই কালো আবার পণ দিলো কম।

তুই পালিয়ে গেলিনা কেনো?
কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতিস,
বাপের ঘরে যখন এলি তখন মরতে গেলি কেনো?
তুই তো পড়াশুনা জানিস,রাগে তোকে অনেক কথা বলেছি রাগ করিস না। তোকে দেখে আমার রাগ ও কষ্ট হচ্ছে ।

জানিস মেয়ে,
এ পৃথিবীতে ভালবাসা দিয়ে যাবি আর ঝিয়ের মতো,
খাটবি, সংসারের মানুষের কাছে থেকে মন্দ কথা শুনবি তাও মুখ বুজে-
কিন্তু কোনো উত্তর করা যাবে না।
তাহলে তুই ভালো থাকলেও থাকতে পারিস।

কোনো নিশ্চয়তা নেই, এটাই নিয়ম-
এবার তুই ভেবে দেখ কী করবি, আমাকে জানাস।

আমি আসি রে মেয়ে,
এরকম আর করিস না,
বেঁচে থেকে লড়াই কর-
মরে জিতিয়ে দিস না ওদের।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

লাবণ্যপ্রভা দত্ত : ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিকন্যা।

সূচনা—

ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলনে কত বীর সন্তান যে শহীদ হয়েছেন তার হিসেব মেলা ভার। স্বাধীনতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বহু নারী এই সংগ্রামে সমান ভাবে আহুতি দিয়েছিলেন নিজেদের। ভলোকরে  ইতিহাস ফিরে দেখলে তার খোঁজ পাওয়া যাবে। চিরস্মরণীয় মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকায় রয়েছেন মাতঙ্গিনী হাজরা, বীণা দাস, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়দ্দেদার, শন্তি ঘোষ, কমলা দেবী আরো কতো নাম। অনেকের নাম আবার অনেকেই জানেনা। তেমনি এক নমস্য বিপ্লবী বীরাঙ্গনা নারী ছিলেন
লাবণ্যপ্রভা দত্ত (১৮৮৮ ― ৬ জুন, ১৯৭১)। যিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিকন্যা। তাঁর সেই বিরত্বের কাহিনী আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

জন্ম ও পরিবার—-

লাবণ্যপ্রভা দত্ত ১৮৮৮ সালে বহরমপুরে পিতার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পিতৃভূমি ছিল মুর্শিদাবাদ এর বহরমপুরে। তার পিতার নাম হেমচন্দ্র রায় ও মাতার নাম কুসুমকুমারী দেবী। স্বামীর নাম ছিল যতীন্দ্রনাথ দত্ত। ৯ বছর বয়সে খুলনার যতীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বিবাহ হয়। অগ্ৰজ সুরেন্দ্রনাথ রায়ের কাছে রাজনৈতিক কর্মে অনুপ্রেরণা পান। ১৯০৬ খ্ৰী. স্বদেশী যুগে তিনি স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করতেন এবং স্বদেশী ছেলেদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। ২৩ বছর বয়সে বিধবা হয়ে বহুদিন পুরী ও নবদ্বীপে কাটান। ১৯২৯ খ্রী. লাহোর জেলে যতীন দাসের মৃত্যুর ঘটনায় আবার তিনি দেশসেবার কাজে এগিয়ে আসেন।

সংগ্রামী জীবন—-

জমিদার বাড়ির মেয়ে ছিলেন তিনি, বিভিন্ন অন্যায় দেখে ছোট থেকে প্রতিবাদী হয়েছেন। তার বড় ভাই সুরেন্দ্রনাথ রায়ের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। ১৯০৬ সালে স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হন। স্বদেশী কাজে যুক্ত ছেলেদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। তিনি নিজের স্বামীকে প্রভাবিত করেছিলেন স্বদেশীভাবাপন্ন করতে। ১৯৩০ খ্রী. তিনি ও তাঁর কন্যা শোভারানী দেশসেবা ও জনসেবার আদর্শ নিয়ে ‘আনন্দমঠ’ নামে এক সংস্থা প্ৰতিষ্ঠা করেন এবং দেশসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৩৩ সালে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠন করেন। তিনি দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেসের সেক্রেটারি ও চব্বিশ-পরগনার কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলন এর কাজ করার সময় তিনি গ্রেপ্তার হন ও তিনমাস জেল খাটেন।

১৪ দিন অনশন —-

১৯৩২ খ্রী. আইন অমান্য আন্দোলনে তাঁর ১৮ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। প্রেসিডেন্সী জেলের ভিতর ফিমেল ওয়ার্ডে বিধবাদের নিজেদের রান্না করে খাবার অধিকার পাবার জন্য ঐ জেলে ১৪ দিন অনশন করে সফল হন। দক্ষিণ কলিকাতা কংগ্রেসের সেক্রেটারী, চব্বিশ পরগনা কংগ্রেস কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বিপিসিসি-র মহিলা সাব-কমিটির সেক্রেটারী (১৯৩৯), বিপিসিসি’র সভানেত্রী (১৯৪০ – ১৯৪৫) ছিলেন।

মৃত্যু—

মহান এই স্বাধীনতা সংগ্রামী ১৯৭১ সালে ৬ জুন প্রয়াত হন।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

গোদাবরী তটে শ্রীমন্ মহাপ্রভু রায় রামানন্দকে প্রশ্ন করেছিলেন, “দুঃখ মধ্যে কোন্ দুঃখ হয় গুরুতর ?’ রায় রামানন্দ তদুত্তরে বলেছিলেন— “কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর।।” নিরন্তর ভক্তসঙ্গে ভজনের যে পরিপাটী লাভ করা যায় তা যে কোন একজন সাধকের ঈপ্সিত লক্ষ্য। একজন পথচারী যখন দুর্গম বনপথ দিয়ে একা গমন না করে অনেকের সঙ্গে আলাপচারিতা, কথোপকথন বা হাস্য পরিহাসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন, তখন তাঁর দস্যুভয় বা হিংস্র পশু আক্রমণের বিপদের সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পায়। তেমনই, সাধক যদি নিত্য উপযুক্ত ভক্তসঙ্গ করেন তখন সংসারের দস্যুতুল্য, পশুতুল্য কামনা-বাসনা, বিষয়-বাসনা বা কোন প্রকার ভজন অহংকার তাঁর মনে অযথা উপদ্রব হয়ে তাঁকে সাধন-পথভ্রষ্ট করতে পারে না। তাইতো শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় বলেছেন— “করহ ভকত সঙ্গ, প্রেমকথা রসরঙ্গ, তবে হয় বিপদ বিনাশ।” ভক্তসঙ্গ করার দরুণ ভক্তে-ভক্তে হয় বন্ধুত্ব। এ বন্ধুত্ব আমাদের প্রাকৃত জগতের বন্ধুত্ব নয়। দিব্য অপ্রাকৃত বন্ধুত্ব হল তা। প্রাকৃত বন্ধুত্ব নশ্বর, ক্ষণিক। তা স্বার্থ সম্বন্ধের সুক্ষ্ম আবেশ মিশ্রিত হলেও হতে পারে। কিন্তু দুই ভক্তের ভিতর ভক্তিকে কেন্দ্র করে যে বন্ধুত্ব, তা নিত্য, সত্য, স্বার্থগন্ধহীন। কারণ, এই বন্ধুত্বে কৃষ্ণেতর বস্তুতে কোন কৌতূহল থাকে না। এই বন্ধুত্বের একমাত্র লক্ষ্য পরস্পরের নিকট হতে কৃষ্ণপ্রেমরস আস্বাদন, নিরন্তর একে অপরের সঙ্গে কৃষ্ণকথা আলাপন ও একত্রে নাম-সংকীৰ্ত্তন রূপ আনন্দ সমুদ্রে অবগাহন। কৃষ্ণ মাধুর্য আস্বাদনের লোভে এক ভক্ত যখন অপর ভক্তের সঙ্গ-সান্নিধ্য প্রত্যাশা করে, তখন অচিরেই অমলিন, নিষ্পাপ, অপ্রাকৃত বন্ধুত্বের রূপ পায় তাদের উভয়ের অন্তরের টান। এরূপ বন্ধুত্ব সাধনের পরিপুষ্টি আনে। আর তাই সাধক এমন বন্ধুত্ব সঙ্গ প্রত্যাশা করে। তাই তো রামানন্দ রায় যখন মহাপ্রভুকে দশদিন গোদাবরী তীরে বাস করে তাঁকে সঙ্গ দিতে অনুরোধ করেন, তখন মহাপ্রভু বলেন— “দশদিনের কা কথা যাবৎ আমি জীব। তাবৎ তোমার সঙ্গ ছাড়িতে নারিব।। নীলাচলে তুমি আমি থাকিব এক সঙ্গে। সুখে গোঙাইৰ কাল কৃষ্ণকথা রঙ্গে।।” (চৈ. চ. / মধ্য/ ৮ম পরিঃ)।

কৃষ্ণকথা তো এ জগতে শুদ্ধকথা সার। সে অমৃত যতই পান করা যায় ততই তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায় আরও পানের। অদ্ভূত, অলৌকিক, অবিশ্বাস্য প্রভাব কৃষ্ণকথামৃতের। ভক্তমনকে জড়ীয় প্রপঞ্চের ভাবনা থেকে অপসারিত করে আনন্দলোকের মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত করে। পার্থিব লোক হতে হৃদয়কে উৎপাটিত করে কৃষ্ণলোকে রোপণ করে, যেখানে মাধুর্য্য-লাবণ্য বলতে যা , সব কিছুই কৃষ্ণকেন্দ্রিক। আর যা কৃষ্ণকেন্দ্রিক তা মায়াগন্ধহীন, কামকলুষমুক্ত। “কৃষ্ণ সূৰ্য্য সম মায়া হয় অন্ধকার। যাঁহা কৃষ্ণ তাঁহা নাহি মায়া অধিকার।। (চৈ. চ./মধ্য/২২পরিঃ)। তা সদানন্দময়, চিদানন্দময়। কৃষ্ণকথা শুরু হলে তা ভক্তমনকে এমন বিবশ করে যে, “সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়” –তাও ভক্ত টের পায় না। এ কথার আবেশে ভক্ত কখনো হাসে কখনো কাঁদে, কখনো গায় আবার কখনো আনন্দের আতিশয্যে নৃত্যও করে ফেলে। ঠিক যেমন মহাপ্রভু আর রামানন্দ রায় টের পান নি। “এইমত দুইজনে কৃষ্ণকথা রসে। নৃত্য-গীত-রোদন হৈল রাত্রি শেষে।।” (চৈ .চ/মধ্য/৮ম পরিঃ)। তাইতো, এমন দিব্য আনন্দদানকারী বন্ধুত্বে যখন বিচ্ছেদ আসে তখন ভক্তের কাছে তা এক অপূরণীয় বিরাট ক্ষতি।
যখন ঠাকুর হরিদাস মহাপ্রভুকে জানান যে, তিনি এবার মৃত্যুবরণ করতে চান, যাতে মহাপ্রভুর অপ্রকটলীলার বেদনা তাঁকে সহ্য করতে না হয়। তখন মহাপ্রভু বলেন তিনিও ঠাকুর হরিদাসের মতো ভক্তসঙ্গের বিরহ বহন করতে কষ্ট পাবেন। “কিন্তু আমার যা কিছু সুখ সব তোমা লঞা। তোমা যোগ্য নহে, যাবে আমারে ছাড়িয়া।।” (চৈ. চ./ অন্ত্য/১২ পরিঃ)। কৃষ্ণভক্ত-বন্ধুর বিরহবেদনার জ্বালার উপশম হয় না সহজে। সেই দুঃখানুভূতির কোন তুলনা হয় না কোন কিছুর সাথে। সে অভাবের কোন পূরণ হয় না। এমনটা তো হয়েছিল শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর ক্ষেত্রেও। তাঁর এবং শ্রীল রূপগোস্বামীর ভিতর ছিল এমনই অপ্রাকৃত কৃষ্ণপ্রেমময় বন্ধুত্ব। মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর যখন তিনি বৃন্দাবনে এসেছিলেন তখন তাঁর মনে মনে সংকল্প ছিল যে, বৃন্দাবনের লীলাস্থলী দর্শন করার পর গিরিরাজ গোবর্দ্ধন হতে ভৃগুপাতে জীবন বিসর্জন দেবেন। কারণ, তাছাড়া অন্য কোন উপায়ে মহাপ্রভুর কৃপা সঙ্গহীনতার মনোবেদনা নাশের পথ ছিল না তাঁর। কিন্তু ব্রজেতে আগমন করে যখন তিনি শ্রীরূপ-সনাতনের সান্নিধ্যে শ্রীব্রজধাম, গিরিরাজ শ্রীগোবর্ধন এবং শ্রীরাধাকুণ্ড দর্শন করলেন তখন তাঁর অন্তরের গৌরসুন্দর-বিরহের কিছুটা লাঘব হয়েছিল, উপশম হয়েছিল। তিনি শ্রীরাধাকুণ্ডের আশ্রয়তটে ভজনে নিমগ্ন হয়েছিলেন। শান্তি পেয়েছিলেন। অথচ, এই ব্রজধাম, এই গেবর্দ্ধন ,এই রাধাকুণ্ডই তাঁর কাছে ভয়াশ্রয়া, ভয়াল, অসহ্য মনে হয়েছিল শ্রীরূপ গোস্বামীর অপ্রকট হবার পর। তাঁর বিরহবেদনায় তিনি লিখেছিলেন—“শূন্যায়তে মহাগোষ্ঠং গিরীন্দ্রোহজগরায়তে। ব্যাঘ্রতুণ্ডায়তে কুণ্ডং জীবাতু রহিতস্য মে।।” অর্থাৎ, শ্রীরূপ গোস্বামীপাদের বিরহে জীবন ধারণের উপায় স্বরূপ এই মহাগোষ্ঠভূমি আমার নিকট শূণ্য-শূণ্য প্রতিভাত হচ্ছে। শ্রীগোবর্দ্ধন যেন অজগরের ন্যায়। শ্রীরাধাকুণ্ড যেন ব্যাঘ্রের ন্যায় মুখব্যাদান করে বসে আছে, মনে হচ্ছে। মহাবিরহে চরম বিচ্ছেদে মর্মাহত হয়ে, অধীর হয়ে খেদ করে বলেছেন- “গৌরাঙ্গচন্দ্রমিহ রূপযুগং ন পশ্যান হা বেদনাঃ কহি সহে স্ফুটরে ললাটে।”—হায়! শ্রীগৌরাঙ্গচন্দ্র ও শ্রীরূপ-সনাতনকে না দেখে আর কত বিরহ সহ্য করবো ! ওরে ললাট, তুই শতধা বিদীর্ণ হয়ে যা!

ঠিক এমনই বন্ধুপ্রীতি ছিল ঠাকুর নরোত্তম এবং শ্রীনিবাস আচার্য্য ঠাকুরের শিষ্য শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের ভিতর। রামচন্দ্র কবিরাজ শ্রীমন্ মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীচিরঞ্জীব সেনের পুত্র। পদকর্তা শ্রীগোবিন্দ কবিরাজের জ্যেষ্ঠ সহোদরও। তিনি মহাপণ্ডিত মহাকবি ছিলেন। আর মহাভক্ত তো বটেই। তাঁর সঙ্গে ঠাকুর মহাশয়ের বন্ধুপ্রীতি সম্পর্কে ‘ভক্তিরত্নাকরে’ ঠাকুর নরহরি চক্রবর্তী লিখেছেন— “রামচন্দ্র নরোত্তম দোঁহার যে রীত। আগে জানাইব এথা কহি সে কিঞ্চিৎ।। তনু মন প্রাণ নাম একই দোঁহার। কবিরাজ নরোত্তম নাম-এ প্রচার।। নরোত্তম কবিরাজ কহে সৰ্ব্বজন। কথাদ্বয় মাত্র যৈছে নর-নারায়ণ।। রামচন্দ্র নরোত্তম বিদিত জগতে। হৈল যুগল নাম সবে সুখ দিতে।।”
নরোত্তম-কবিরাজের তনু-মন-প্রাণ অভিন্নতার একটি চিত্তহারী লীলা আছে। রামচন্দ্র কবিরাজ তখন খেতুরীতে ঠাকুর মহাশয়ের সান্নিধ্যে অবস্থনারত। তাঁর পত্নী রত্নমালাদেবী রামচন্দ্রকে একাধিকবার পত্রমারফত অনুরোধ করেন যে একটি বার অন্ততঃ দর্শনদান করে ধন্য করেন তিনি রত্নমালাদেবীকে। কিন্তু সংসারত্যাগী রামচন্দ্র কবিরাজের মন একটিবারের জন্যও সে অনুরোধে উচাটন হয়নি। তিনি নরোত্তম সঙ্গ ছাড়তে নারাজ। পরিশেষে রত্নমালাদেবী পত্র মারফত অনুরোধ করলেন ঠাকুর মহাশয়কে যাতে তিনি অন্ততঃ একটি বারের জন্য রামচন্দ্র কবিরাজকে গৃহে প্রেরণ করেন বুঝিয়ে। নরোত্তম ঠাকুর কবিরাজ মহাশয়কে বললেন—তিনি যেন সে দিনই দুপুরে প্রসাদ পেয়ে কুমারনগরে নিজের গৃহে যান আর পরদিন প্রভাতে ফিরে আসেন। বললেন , “আমার শপথ ইহা না করিহ অন্যথা। না করিলে, মনে আমি পাব বড় ব্যথা।।’ (গৌরভক্তামৃতলহরী-৮ম খণ্ড, শ্রীকিশোরী দাস বাবাজী)
রামন্দ্র কবিরাজ বেজায় দুর্বিপাকে পড়লেন। বন্ধু নরোত্তমের শপথ অন্যথা করতে পারবেন না আবার সংসারের মোহভরা ঘেরাটোপে এক মুহুর্তের জন্যও যেতে চান না নরোত্তম সঙ্গ ছেড়ে। চিত্ত বড় ব্যাকুল হল। শেষে, “কান্দিতে কান্দিতে প্রেমে করয়ে গমন। খেতুরি পানে একদৃষ্টে করি নিরীক্ষণ।।” (ঐ)। পত্নী সম্ভাষণে গেলেন কবিরাজ মহাশয় বান্ধবের শপথ রক্ষা করতে। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে কুমারগ্রাম ত্যাগ করে যখন খেতুরীতে প্রত্যাগমন করলেন তখন প্রভাত। পূজারী আরতি করছেন শ্রীমন্দিরে। তিনি একাধারে রাখা মার্জনী (ঝাড়ু)টি তুলে নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গন মার্জন করতে লাগলেন। কবিরাজ মহাশয় আড় চোক্ষে ঠাকুর মহাশয়কে দর্শন করে… নিজেকেই নিজে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন, ‘হায়। আমি কী অধম চিত্তের অধিকারী। এখানকার এমন দিব্য সুখ আমার ভালো লাগলো না। আমি বহু সময় হেলায় নষ্ট করে এলাম কাল। ধিক্ আমায় ধিক্‌।’—এই প্রলাপ করেই তিনি নিজের পৃষ্ঠে নিজেই মার্জনী দ্বারা প্রহার করতে লাগলেন। অবিলম্বে নরোত্তম ঠাকুর তাঁকে বিরত করতে তাঁর হস্ত ধরে ফেললেন। বললেন, ‘আহা। করো কী, করো কী রামচন্দ্র! আমার যে বড় ব্যথা লাগলো। আর এমন কর্ম কোরো না। দেখতো কী করলে আমার অবস্থা।”—এই বলে নিজের পৃষ্ঠখানি রামচন্দ্রের সম্মুখে ধরলেন। আর রামচন্দ্র কবিরাজ দেখলেন তাঁর বান্ধব নরোত্তমের পৃষ্ঠ ফুলে গিয়েছে প্রহারে। নিজের পৃষ্ঠের প্রতিটি আঘাত নরোত্তম ঠাকুরের পৃষ্ঠে পড়েছে। সকল বেদনা তাঁর বান্ধব নিজের শরীরে ধারণ করেছেন। তখন উভয়ের ক্রন্দন আর থামে না। এমন বন্ধুপ্রীতি যে ইহজগতের ঘটনা নয়। ভাবের আবেশে ভাববিহ্বল তনু-মন-প্রাণ একাত্ম হয়ে ভূমিতে গড়াগড়ি করে বিস্তর ক্রন্দন করলেন। “দোঁহে গলাগলি কান্দে ভূমি গড়ি যায়। দুইজনে হেন প্রীতি জানে গোরারায়।।” (ঐ)।
{ ‘শ্রীগুরুকৃপার দান’ গ্রন্থে, শ্রীপাদ রামদাস বাবাজী মহাশয়ের শ্রীমুখ নিঃসৃত ‘শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের সূচক কীৰ্ত্তনে বলা হয়েছে— “শ্রীআচার্য্য প্রিয়তম নরোত্তম প্রাণ যেন / রামচন্দ্র কবিরাজ সেই। … গুরুবাক্যে নিষ্ঠা তাঁর (রামচন্দ্র-র) ত্রিভুবনে পরচার/ এই বাক্য হয় সুপ্রমাণ…. যদি গুরুপদে হয় রতি তুলনা নাহিক কতি/ শুনহ সে অপূৰ্ব্ব কথন/ একদিন শ্রীআচার্য্য /আদেশিলেন রামচন্দ্রে/ রামচন্দ্র একবার যাও/সম্ভাষণ করে এস/বিবাহিতা পত্নীসনে সম্ভাষণ করে এস./…… অপূর্ব রহস্য কথা…../ সারা নিশি করলেন আলাপন …. শ্রীগুরু-গৌর লীলা প্রসঙ্গ সারা নিশি করলেন আলাপন… নিশি পরভাত হল…. শ্রীগুরুসেবার সময় হয়েছে। চলিলেন ত্বরা করে……/ শ্রীযাজিগ্রামের পথে এসে মনে হল/ প্রভু আজ্ঞা করেছিলেন…./পুনঃরায় ফিরে গেলেন/সম্ভাষণ করলেন/রামচন্দ্রের পুরুষ অভিমান নাই / সেই স্বভাবে রামচন্দ্র করিলেন আলিঙ্গন/লাগিল রামচন্দ্র ললাটে/প্রিয়ার সিঁথির সিন্দুর লাগিল রামচন্দ্র ললাটে/ উপনীত যাজিগ্রামে/তখন নরোত্তম করছিলেন আঙ্গিনা মার্জ্জন/জিজ্ঞাসেন রামচন্দ্রে/ কোথা গিয়েছিলে বা এখন বা যাও কোথা / পত্নী সম্ভাষণে গিয়েছিলাম/ এখন যাই শ্রীগুরুসেবায় /(তখন) নরোত্তম আঘাত করলেন রোষভরে/রামচন্দ্রের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করলেন রোষভরে/ সম্মার্জ্জনী লয়ে করে আঘাত করলে রোষভরে/…. আবার মধ্যাহ্নে নরোত্তমের সেবা/ করিতেছিলেন তৈল মৰ্দ্দন/শ্রীনিবাস আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে করিতেছিলেন তৈল মৰ্দ্দন/অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে মার্জ্জনীর আঘাত অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/মনে মনে ভাবলেন /কার অঙ্গে আঘাত করেছি/ এ তো নয় রামচন্দ্রের দেহ/নরোত্তম ব্যাকুল হলেন/অপরাধ স্খালন লাগি/ নরোত্তম করলেন মনে/এ হাত পোড়াব আগুনে নরোত্তম করলেন মনে … সে ভাব বুঝে আচার্য্য বলেন মনে মনে……এ দেশে বিচার নাই বাপ রে বাপ। দিনে মারে ঝাঁটার বাড়ী রাত্রে পোড়ায় হাত।।/কি সুমধুর লীলা রে/বালাই লয়ে মরে যাই/শ্রীগুরুসেবার আদর্শ শ্রীরামচন্দ্র/ শ্রীগুরুপদে আত্ম-সমর্পণের আদর্শ শ্রীরামচন্দ্র/বিকালে তাঁর পদতলে সর্ব্বোত্তমা গতি মিলে……}

এমনই হরিহর আত্মা ছিলেন নরোত্তম-কবিরাজ। যখন শ্রীনিবাস আচার্য্য শিষ্য রামচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনে গমন করলেন তখন ঠাকুর নরোত্তমের বিপ্রলম্ভ ভাব অর্থাৎ বিরহ ভাব আর চক্ষে দেখা যেত না। তিনি তাঁর প্রেমস্থলী নামক ভজন স্থানে ভূমিতে পড়ে অহর্নিশি বুকফাটা রোদন করতেন। বিশ্বে তাঁর মতো বন্ধুবিরহীকে সান্ত্বনাদানের কোন বস্তু বা ভাষা ছিল না। সব শূণ্য তাঁর কাছে তখন। বিরহালনে দগ্ধ হৃদয় হয়ে কী মর্মবিদরী পয়ার লিখলেন—’রামচন্দ্র কবিরাজ সেই সঙ্গে মোর কাজ /তাঁর সঙ্গ বিনা সব শূণ্য। যদি হয় জন্ম পুনঃ তাঁর সঙ্গ হয় যেন /তবে হয় নরোত্তম ধন্য।। (প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা-১১৮)। এখানে ‘সেই সঙ্গে মোর কাজ’ বলতে রামচন্দ্র কবিরাজের মতো ভক্তবন্ধুর সঙ্গপ্রসঙ্গে তিনি যে ভগবৎমাধুরী ও কৃষ্ণপ্রেমরস আস্বাদন করতেন তার কথা বলেছেন। আবার নিজের প্রেমভক্তির প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে, ভক্তির অতৃপ্তি স্বভাববশতঃ যারপরনাই দৈন্য ভরে ভেবেছেন হয়তো তাঁকে আবার জন্ম নিতে হবে। আর তখন যদি রামচন্দ্র কবিরাজের মতো ভক্তের সঙ্গ পান তখনই তাঁর জীবন ধন্য হবে। তাঁর পুনঃ প্রার্থনাতেও তাঁকে লিখতে দেখা যায় “রামচন্দ্র সঙ্গ মাগে নরোত্তম দাস।” এ হেন অন্তরে সুহৃদ, পরমপ্রেমিক রামচন্দ্র। কবিরাজের মতো বান্ধব-বিরহে শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর তাই লিখেছেন—— “তাঁর সঙ্গ বিনা সব শূণ্য ।’ তাইতো —- “কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর” ।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

আজ ‘মা দিবস’, জানব দিনটি পালনের ইতিহাস ও তাৎপর্য।

জীবনের কোনও মুহূর্তেই ‘মা’-কে বাদ দিয়ে ভাবা যায় না। এই একটা শব্দ মনে অনেক শক্তি যোগায়, যা সকল প্রকার বাধাকে কাটিয়ে উঠতে যথেষ্ট। মা ছাড়া জীবন অচল, নিঃসঙ্গ যাত্রায় প্রতিটি মূহূর্ত নির্জন, জীবনে মায়ের প্রয়োজনীয়তা অসীম, মায়ের আশীর্বাদেই কঠিন পরিস্থিতিও হয় সহজ। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় ‘মাদার্স ডে’। যদিও প্রতিটি দিন মায়ের জন্য সমান, কিন্তু মাতৃ দিবস এমন একটি দিন, যেদিন শিশুরা তাদের মায়ের এই একটি দিন বিশেষ তৈরি করতে চায়। এই খুশি উপলক্ষে মাতৃ দিবসে  মা-কে শুভেচ্ছা জানান। এই বছর এই বিশেষ দিনটি পড়েছে ১৪ মে।

 

মা দিবস হল পরিবার বা ব্যক্তির মাকে সম্মান করার একটি দিন, সেইসাথে মাতৃত্ব, মাতৃত্বের বন্ধন এবং সমাজে মায়েদের প্রভাব তা স্মরণ করা । তবে এটি বিশ্বের অনেক অংশে বিভিন্ন দিনে পালিত হয়, সাধারণত মার্চ বা মে মাসে।  এটি অনুরূপ উদযাপনের পরিপূরক, পরিবারের সদস্যদের সম্মান করে, যেমন ফাদার্স ডে, ভাই-বোন দিবস এবং দাদা-দাদি দিবস।

 

ঠিক কবে থেকে পালিত হচ্ছে মাতৃ দিবস? এর ইতিহাসই বা কী? এই সম্পর্কে অনেক ভিন্ন মতামত রয়েছে। একাংশের মতে প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের মধ্যেই মাকে শ্রদ্ধা জানাতে এই বিশেষ উদযাপনের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় প্রথম। তারা মাতৃদেবী রিয়া এবং সাইবেলের সম্মানে উৎসবের আয়োজন করে। অন্যদিকে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাতৃদিবস উদযাপন হয় প্রথম। ১৯০৮ সালে মার্কিন কর্মী আনা জার্ভিস প্রথম এই দিন উদযাপন করেন।আনা জার্ভিস তাঁর মা, অ্যান রিভস জার্ভিসের সঙ্গে থাকতেন। এমনকি তিনি কখনও বিয়েও করেননি। মায়ের মৃত্যুর পর, আনা জার্ভিস তাঁরই স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং বলা হয় যে এখান থেকেই মাতৃ দিবসের সূচনা হয়েছিল।আনা জার্ভিস ছিলেন একজন শান্তি কর্মী যিনি গৃহযুদ্ধের সময় আহত সৈন্যদের যত্ন নেওয়ার জন্য মাতৃ দিবস ওয়ার্ক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আনা জার্ভিস তার পরিবার এবং দেশের প্রতি তার মায়ের উত্সর্গ এবং আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলেন এই দিনটির মাধ্যমে। আনা জার্ভিসের প্রয়াসেই মাতৃ দিবস বা মাদার’স ডে ১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারী স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার গোটা বিশ্বে মাতৃ দিবস পালিত হয়ে আসছে।

 

বেশিরভাগ দেশেই মা দিবস হল একটি সাম্প্রতিক রীতি, যা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে ছুটির দিনটির রীতি অনুসারে চলে এসেছে। যখন অন্যান্য বহু দেশ ও সংস্কৃতি এটিকে গ্রহণ করে তখন এই দিনটিকে একটি অন্য মাত্রা দেওয়া হয়, বিভিন্ন পর্বের (ধর্মীয়, ঐতিহাসিক বা পৌরানিক) সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, এবং একটি একদমই অন্য দিন বা বিভিন্ন দিনে এটিকে পালন করা হয়।
কিছু কিছু দেশে বহু আগে থেকেই মাতৃত্বের প্রতি উৎসর্গিত কয়েকটি অনুষ্ঠান ছিল এবং সেইসব অনুষ্ঠানে মার্কিন মা দিবসের মত মায়েদের কার্নেশন (গোলাপী ফুল) এবং আরো অন্য উপহার দেওয়া হত।
অনুষ্ঠান পালনের রীতিটি অনেক রকম। অনেক দেশে মা দিবস পালন না করলে এটিকে প্রায় একটি অপরাধ গণ্য করা হয়। অনেক দেশে আবার মা দিবস একটি স্বল্প-পরিচিত উৎসব যা মূলত প্রবাসী মানুষেরা পালন করে থাকে বা বিদেশী সংস্কৃতি হিসাবে মিডিয়া সম্প্রচার করে থাকে (U.K বা যুক্তরাজ্যে দীপাবলী পালনের মত)।

 

যদিও কিছু দেশে মা উদযাপনের বহু-শতাব্দীর ইতিহাস রয়েছে, তবে ছুটির আধুনিক আমেরিকান সংস্করণটি ২০ শতকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল অ্যানা জার্ভিসের উদ্যোগে, যিনি প্রথম মা দিবসের পূজার আয়োজন করেছিলেন এবং  ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনের অ্যান্ড্রুস মেথডিস্ট এপিস্কোপাল চার্চে উদযাপন, যেটি আজ আন্তর্জাতিক মা দিবসের মন্দির হিসেবে কাজ করে।  এটি হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান মা এবং মাতৃত্বের অনেক ঐতিহ্যবাহী উদযাপনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়, যেমন গ্রীক কাল্ট থেকে সাইবেলে, মাতৃদেবতা রিয়া, হিলারিয়ার রোমান উত্সব, বা অন্যান্য খ্রিস্টান ধর্মযাজক মাদারিং  রবিবার উদযাপন (মাদার চার্চের ছবির সঙ্গে যুক্ত)।  যাইহোক, কিছু দেশে, মা দিবস এখনও এই পুরানো ঐতিহ্যের সমার্থক।  মা দিবসের আমেরিকান সংস্করণটি খুব বেশি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য সমালোচিত হয়েছে।  জার্ভিস নিজেই, যিনি একটি লিটারজিকাল পালন হিসাবে উদযাপন শুরু করেছিলেন, এই বাণিজ্যিকতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন যে এটি তার উদ্দেশ্য ছিল না।  এর প্রতিক্রিয়ায়, কনস্ট্যান্স অ্যাডিলেড স্মিথ ইংরেজিভাষী বিশ্বের অন্যান্য অনেক অংশে মাতৃত্বের একটি বিস্তৃত সংজ্ঞার স্মারক হিসেবে মাদারিং সানডে-এর পক্ষে সফলভাবে ওকালতি করেছেন।

 

আধুনিক ছুটির দিনটি প্রথম পালিত হয় ১৯০৭ সালে, যখন আনা জার্ভিস পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনের অ্যান্ড্রুস মেথডিস্ট এপিস্কোপাল চার্চে প্রথম মা দিবসের উপাসনা করেন।  অ্যান্ড্রু’স মেথডিস্ট চার্চ এখন আন্তর্জাতিক মা দিবসের মন্দিরটি ধারণ করে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবসকে একটি স্বীকৃত ছুটিতে পরিণত করার জন্য তার প্রচারণা শুরু হয়েছিল ১৯০৫ সালে, যে বছর তার মা অ্যান রিভস জার্ভিস মারা যান।  অ্যান জার্ভিস ছিলেন একজন শান্তি কর্মী যিনি আমেরিকান গৃহযুদ্ধের উভয় পক্ষের আহত সৈন্যদের যত্ন নিতেন এবং জনস্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের জন্য মাদার্স ডে ওয়ার্ক ক্লাব তৈরি করেছিলেন।  তিনি এবং অন্য একজন শান্তি কর্মী এবং ভোটাধিকার জুলিয়া ওয়ার্ড হাওয়ে একটি “শান্তির জন্য মা দিবস” তৈরি করার জন্য জোর দিয়েছিলেন যেখানে মায়েরা জিজ্ঞাসা করবেন যে তাদের স্বামী এবং ছেলেরা আর যুদ্ধে নিহত হবেন না।  এটি একটি সরকারী ছুটি হওয়ার ৪০ বছর আগে, ওয়ার্ড হাউ ১৮৭০ সালে তার মাদার্স ডে ঘোষণা করেছিলেন, যা “আন্তর্জাতিক প্রশ্নের বন্ধুত্বপূর্ণ মীমাংসা, শান্তির মহান এবং সাধারণ স্বার্থ” প্রচার করার জন্য সমস্ত জাতীয়তার মায়েদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানায়।  আনা জার্ভিস এটিকে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন এবং সমস্ত মাকে সম্মান জানাতে একটি দিন নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে একজন মা হলেন “সেই ব্যক্তি যিনি আপনার জন্য বিশ্বের যে কারও চেয়ে বেশি করেছেন”।

১৯০৮ সালে, ইউ.এস. কংগ্রেস মাদার্স ডেকে একটি সরকারী ছুটিতে পরিণত করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, মজা করে যে তাদেরও একটি “শাশুড়ি দিবস” ঘোষণা করতে হবে।  যাইহোক, আনা জার্ভিসের প্রচেষ্টার কারণে, ১৯১১ সাল নাগাদ সমস্ত মার্কিন রাজ্য ছুটি পালন করে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে মা দিবসকে স্থানীয় ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেয় (প্রথমটি হল ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, জার্ভিসের হোম স্টেট, ১৯১০ সালে)।  ১৯১৪ সালে, উড্রো উইলসন একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন যেটি মা দিবসের নামকরণ করে, যা মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার অনুষ্ঠিত হয়, মায়েদের সম্মানের জন্য একটি জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে।
যদিও জার্ভিস, যিনি মা দিবসকে একটি লিটারজিকাল পরিষেবা হিসাবে শুরু করেছিলেন, উদযাপনটি প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন, তিনি ছুটির বাণিজ্যিকীকরণে বিরক্ত হয়েছিলেন এবং এটি “হলমার্ক হলিডে” শব্দগুচ্ছের সাথে যুক্ত হয়েছিল।  ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে, হলমার্ক কার্ড এবং অন্যান্য কোম্পানিগুলি মা দিবসের কার্ড বিক্রি করা শুরু করেছিল।  জার্ভিস বিশ্বাস করতেন যে কোম্পানিগুলি মা দিবসের ধারণাকে ভুল ব্যাখ্যা করেছে এবং শোষণ করেছে এবং ছুটির জোর অনুভূতির উপর ছিল, লাভ নয়।  ফলস্বরূপ, তিনি মা দিবস বয়কট সংগঠিত করেন এবং জড়িত কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন।  জার্ভিস যুক্তি দিয়েছিলেন যে উপহার এবং আগে থেকে তৈরি কার্ড কেনার পরিবর্তে লোকেদের তাদের ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হাতে লেখা চিঠির মাধ্যমে তাদের মায়েদের প্রশংসা ও সম্মান করা উচিত।  জার্ভিস ১৯২৩ সালে ফিলাডেলফিয়াতে একটি ক্যান্ডি মেকারদের কনভেনশনে এবং ১৯২৫ সালে আমেরিকান ওয়ার মাদারদের একটি সভায় প্রতিবাদ করেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে, কার্নেশনগুলি মা দিবসের সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য আমেরিকান যুদ্ধের মায়েদের দ্বারা কার্নেশন বিক্রি করা ক্ষুব্ধ হয়েছিল।  জার্ভিস, যাকে শান্তি নষ্ট করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল।
ব্রিটেনে, কনস্ট্যান্স অ্যাডিলেড স্মিথ মাদারিং সানডে-এর পক্ষে ওকালতি করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, এটি ইতিমধ্যেই বিদ্যমান একটি খ্রিস্টান ধর্মযাজক উদযাপন যেখানে বিশ্বস্তরা গির্জায় যান যেটিতে তারা বাপ্তিস্মের ধর্মানুষ্ঠান পেয়েছিলেন, একটি সমতুল্য উদযাপন হিসেবে।  তিনি মাদার চার্চ, ‘পৃথিবী ঘরের মা’, মেরি, যিশুর মা এবং মাদার নেচার উদযাপনের মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করেছেন।  তার প্রচেষ্টা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ এবং ইংরেজি-ভাষী বিশ্বের অন্যান্য অংশে সফল হয়েছিল।

 

তাই, আন্তর্জাতিক মাদার’স ডে বা মাতৃ দিবস প্রতিটি শিশুর জন্য একটি বিশেষ দিন। বছরের এই বিশেষ দিনটি প্রত্যেক সন্তান ও মায়ের জন্য এক বিশেষ দিন। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা  জানাতে পালিত হয় দিনটি। এই দিনে, শিশু, তরুণ এবং বৃদ্ধ, তাদের মায়েদের উপহার, ফুল, কার্ড দিয়ে বা বিশেষ খাবার বা কার্যকলাপের জন্য তাদের নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তাদের ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। মায়ের আদরে যে আরাম, ভরসা আছে, তা আর পৃথিবীর কারও আদরে নেই।

পৃথিবীতে সবাই বদলে যায়, কিন্তু বদলায় না মা। মা দিবসে পৃথিবীর সকল মা কে তাই জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও অশেষ ভালোবাসা।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল : দ্যা লেডি উইথ দ্যা ল্যাম্প।

আজ আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ বা ধাত্রী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আজ ভারতেও পালন করা হচ্ছে দিবসটি। নার্সিং এমন একটি পেশা যা সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। এ পেশার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে কোন রোগী বা ব্যক্তির স্বাস্থ্য পুণরুদ্ধার এবং জীবনযাত্রার গুরুত্বতা তুলে ধরা হয়। এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত, দক্ষ কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি নার্স বা সেবিকা নামে পরিচিত। প্রধানতঃ নারীরাই নার্সিং পেশার সাথে জড়িত থাকেন। তবে এখন অনেক পুুুরুষেও এই পেশার সাথে যুুুুক্ত হচ্ছেন। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জন্মদিন কে স্মরণীয় করে রাখতে আজকের দিনটি অর্থাৎ আন্তৰ্জাতিক ধাত্রী দিবস সমগ্র বিশ্বে প্ৰতিবছর ১২ মে তারিখে পালন করা হয়। ১৮২০ সালের এই তারিখে আধুনিক নার্সিং পরিষেবার মাৰ্গদৰ্শক ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্ম হয়েছিল। এই দিবস পালনের মাধ্যমে সম্মান জানানো হয় সেই নারীকে যিনি তার কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন – নার্সিং একটি পেশা নয় সেবা। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের প্ৰতি শ্ৰদ্ধা জানাবার সাথে বিশ্বের ধাত্রীদের রোগীদের প্ৰতি দেওয়া স্বাস্থ্যসেবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্ৰকাশ করা হয়।

ইতিহাস—

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর জন্মদিন কে আন্তৰ্জাতিক ধাত্রী দিবস হিসেবে পালিত হয়। তিনি ছিলেন আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত, একজন লেখিকা এবং পরিসংখ্যানবিদ। যিনি দ্যা লেডি উইথ দ্যা ল্যাম্প নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮২০ সালের ১২ মে মাসে ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণ করেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
ছোটবেলা থেকে তার স্বপ্ন ছিল নার্স হওয়া। কিন্তু তখনকার সময়ে নার্সিংকে সম্মানের চোখে দেখা হতো না। এছাড়া তার পিতা-মাতা চাননি ফ্লোরেন্স নার্স হোক। তাই ফ্লোরেন্সকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়। কেননা তার নিজ বাড়িতে তার স্বপ্নটি পূরণ করা সম্ভব ছিলনা।
১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য কাজ শুরু করেন। নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর গবেষণা চালান। যা ভারতবর্ষে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবদান রাখে।লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং । ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সাথে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় নার্সিংয়ের উপর বইও লিখেছেন। ১৮৮৩ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি। এ ছাড়াও ১৯৭৪ সাল থেকে তার জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’। যার মধ্যেমে সম্মান জানানো হয় এক নারীকে যিনি তার কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন- নার্সিং একটি পেশা নয় সেবা। ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।

 

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে নার্সিং ইতিহাসে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটেছিল। এতে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল পেশাদারী পর্যায়ে নার্সিংয়ের পরিধি এবং নীতিমালা প্রণয়ন ও বিশ্লেষণপূর্বক তার প্রণীত নোটস অন নার্সিং গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
পেশাদারী পর্যায়ে এ পেশার মানোন্নয়নে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নার্স ব্যক্তিত্বরূপে ম্যারি সীকোল, এগনেস এলিজাবেথ জোন্স এবং লিন্ডা রিচার্ড ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন। ম্যারি সীকোল ক্রিমিয়ায় কাজ করেছেন; এগনেস এলিজাবেথ জোন্স ও লিন্ডা রিচার্ডস গুণগত মানসম্পন্ন নার্সিং বিদ্যালয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে প্রতিষ্ঠা করেন। তন্মধ্যে – লিন্ডা রিচার্ডস আমেরিকার প্রথম পেশাদার ও প্রশিক্ষিত নার্সরূপে ১৮৭৩ সালে বোস্টনের নিউ ইংল্যান্ড হসপিটাল ফর উইম্যান এন্ড চিল্ড্রেন থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন।
বিশ্বের ১ম দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডে জাতীয় পর্যায়ে নার্সদেরকে নিবন্ধিত করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯০১ সালে নার্সেস রেজিস্ট্রেশন এ্যাক্ট প্রণীত হয়। এলেন ডাফার্টি ছিলেন নিউজিল্যান্ডের প্রথম নিবন্ধিত নার্স। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম অঙ্গরাজ্যরূপে নর্থ ক্যারোলাইনায় নার্সিং লাইসেন্স ল ১৯০৩ সালে গৃহীত হয়। ১৯৯০-এর দশকে নার্সদেরকে ঔষধ দেয়া, ডায়াগনোস্টিক, প্যাথলজি পরীক্ষাসহ রোগীদেরকে প্রয়োজনে অন্য পেশাদারী স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের কাছে স্থানান্তরের অনুমতি দেয়া হয়।

 

আন্তর্জাতিক ধাত্রী পরিষদ বা ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অফ নার্সেস (আইসিএন) ১৯৬৫ সাল থেকে এই দিনটি উদযাপন করে আসছে। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কল্যাণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা ডরোথি সাদারল্যান্ড প্রস্তাব করেন যে প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার “ধাত্রী দিবস” ঘোষণা করবেন; তবে তিনি তা অনুমোদন করেননি।
১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে, ১২ মে দিনটি উদযাপনের জন্য নির্বাচিত হয় কারণ এটি আধুনিক নার্সিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মবার্ষিকী। প্রতি বছর, আইসিএন আন্তর্জাতিক নার্স দিবসের কিট প্রস্তুত এবং বিতরণ করে। কিটে সর্বত্র নার্সদের ব্যবহারের জন্য শিক্ষাগত এবং উন্মুক্ত তথ্য উপকরণ রয়েছে।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
কবিতা নারী কথা

নারী : অজয় কুমার রজক।

রং বেরঙের রঙিন শাড়ি,
কপালে টিপ, খোঁপায় ফুল, অপূর্ব তুমি নারী।
জন্ম মোদের নারীর গর্ভে,
বুক ফুলে ওঠে তোমার গর্বে।
সকল মনীষী, মহাপুরুষ ,বীরপুরুষের জন্মদাত্রী,
তুমি দুর্গা, লক্ষ্মী- সরস্বতী, তুমি জগদ্ধাত্রী।
সংসারেও তুমি দশভূজা,
অতি যত্নে পরিবারের সকলের কর পূজা।
কখনো মা, কখনো বোন, কখনো মেয়ে ও প্রেয়সী।
তোমার সঙ্গ বিনা অসহায়, জীবন হতশ্রী।
জীবন- সংসার এগোবে না এক বিন্দু,
ভালবাসার আধার তুমি, তুমি করুণা সিন্ধু।
কর্তব্য, দায়িত্ববোধে অটল,
সংসারকে রাখো সর্বদা সচল।
কে বলে নারী বন্দী সুখী গৃহকোণে!
আজ সামিল তারাও কর্ম রণাঙ্গনে।
চাকুরী করে, প্লেন চালায়, মহাকাশে দেয় পাড়ি,
নয় অবলা, চালায় মোটর আর সংসার গাড়ি।
নারীদের অবহেলিত করছ যারা,
পাষণ্ড, নির্মম, অধম তারা।
জেনো দুই বংশেরই প্রদীপ নারী,
মুছে যাক সকল দখলদারি।

Share This