Categories
রিভিউ

পুবদিকের হৃদয় এবং একজন হৃদয়সন্ধানী কবি ::: শুভঙ্কর দাস।।।

“আঁতুড়ঘরে এক চিলতে রোদ মায়ের আঁচলের স্পর্শের মতো ছুঁয়ে যায়,শিশুপৃথিবী…
এই সূচনা প্রথম যাত্রাপথের…
ফিরে যেতে একাই একদিন, রেখে যাবে,আরও একটু আলো,হৃদয়ের…

সেই দিক যদি পূর্ব হয়,তাহলে বুঝবে প্রতিটি জন্ম আসলে অনন্তের…

শুধু মা আর সূর্য জানে,নিজেদের মতো”

একজন কবিহৃদয় শেষ পর্যন্ত যে শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকে,তা হল অপর হৃদয়ের আলো ও উষ্ণতা। মা যেমন আঁতুড়ঘরের প্রতিটি মুহূর্ত চেতন-অবচেতনে গর্ভধারণের প্রথম সময়কাল থেকে মনে মনে এঁকে রাখেন,কবিও সেই মাতৃহৃদয়অনুভবী।
নিজের ভেতর নিজেই আশ্চর্য অনুভবে লক্ষ্য করেন,সামান্য ঘষামাজার গতানুগতিক জীবন-যাপনের গতি ও গ্রহণ কীভাবে অপর হৃদয়ের সন্ধানে পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং প্রকাশিত হয়ে চলেছে।এই ক্রমাগত আবেগ ও আবেশের মুখ একমাত্র দর্শন করতে পারে, বোধ।
বোধই হল মাতৃগর্ভের মতো জন্মচক্রের আধার।এখানে শিশুসন্তানের মতো জন্ম নেয় চিন্তা। চেতনা।উপলব্ধি।
যা কবিপ্রাণকে অস্থির করে তোলে,আবার তাই কবির একমাত্র অস্তিত্ব।
সেই ভাবনা কবি সমীররঞ্জন খাঁড়ার কবিতাও আছে—

“শুধু এক পরমান্ন আজও পাহারা দেয়
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি
মা নামক এক আগুনপ্রেম”

ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মাঝখানে যে বিচিত্র ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতার প্রপিতামহ ঝুলি ভরে ওঠে,তাই বোধকে খাদ্য ও পুষ্টি জোগায়।সেখান থেকে নির্মিত হয় একের পর এক নতুন দরজা।তাই করে চলেছেন কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া।তিনি সবিনয়ে সহৃদয়ে অপর হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন,অনুভব করছেন এবং তাকেই নিজের ভেতর জারিত করে প্রকাশ করছেন দরজা।
হা,দরজা।
এই দরজা খোলার কাজটি পাঠক করবেন,কিন্তু তার আগে দরজা নির্মাণ করা প্রয়োজন। তাই ধ্বনিত সমীরণে —

“সূর্যের আলো যেমন দিনের জন্ম দেয়
রাত্রির আঁধার আনে নক্ষত্রের দল
তেমনি মানুষও হৃদয়-আকাশ রচনা করে কাহিনি হয়ে ওঠে”

এ কাহিনির সূচনা হয়েছিল সেই অ্যামিবা থেকে…
তারপর জঙ্গল,গুহা,তপোবন,কুরুক্ষেত্র এবং সিংহাসনের পর সিংহাসন পেরিয়ে জন্ম নিল মাটির অভিমুখ। কিন্তু সেখানেও শিকলের পর শিকল,তাই কেটে তৈরি হল এক তেরঙা পতাকার দেশ,স্বদেশবাসী এবং আত্মবলিদানের ওপর আত্মপ্রকাশ। এইসব ইতিহাসের পাতার ভেতর কালো কালো অক্ষরের কারাগারে বন্দী হয়ে যখন দম আটকে গিয়ে গিয়েছিল, তখন কবিতা এসে তাকে জাগিয়ে তুলল,বোঝাল,অনুভূতি মরে গেলে হৃদয় মরে যায়…
আর হৃদয় মরে গেলে সূর্য নিভে যায়…
তাই সূর্যের আলোর দিকে যাত্রা প্রয়োজন এই অন্ধকারে, এই অসুখে…
কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া যেন সেই চিরায়ত সত্যকে তুলে ধরার জন্য কবিতার আশ্রয়ে প্রকাশিত হয়েছেন—

“অচিন দেশের কোন্ অন্ধকার গুহা থেকে করো বিদীর্ণ অতি পরিচিত হৃদয়ের ভার,অজানা সময়ে হানো দ্বারে দুর্বিষহ অকস্মাৎ! কেন, কেন তুমি জীবনের সব আকাঙ্ক্ষা করো ম্লান নিষ্ঠুর কষাঘাতে? জানি আমি নই,নাও তুমি শাশ্বত এই ধরিত্রীর”

শাশ্বত ধরিত্রীর জন্য সযতনে নির্মিত সব ছেড়ে চলে যেতে হবে,তাহলে কীসের জন্য এই অনুসন্ধান? এই কবিতা? এই জীবনবোধ!
সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের একটি অসাধারণ অনুভব আছে,তার হল,আমাদের জীবিতকালেই কোনো বিরাট পরিবর্তন দেখতে পাওয়ার সম্ভবনা কম। আমাদের আসল জীবন আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। সে ভবিষ্যৎ ঠিক কতদিন পরে,তাও আমরা জানি না।দশ বছরও হতে পারে,হাজার বছরও হতে পারে।তবুও শুভচিন্তার আর যুক্তিবোধের এলাকাটা অল্প অল্প করে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে ”

দুটি চেতনা,শুভচিন্তা এবং যুক্তিবোধ।
এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সুমনন কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া প্রণীত কাব্যটি “পুবের দিকে হেঁটে চলেছি”
কবিতার বইটির নামকরণের মধ্যে সেই শুভচিন্তা ও যুক্তিবোধের মাত্রামিল লক্ষ্যনীয়।
কিন্তু কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া তা কীভাবে ব্যক্ত করেছেন,তা একটু পড়ে নিই আসুন—

এক

“অক্ষর আলোয় বদলে নিই অন্ধকার গলিপথ ”

দুই

“আমি জ্বরের চাদর দু-হাত ঠেলে/এগিয়ে চলেছি পুবের দিকে”

তিন

“অশ্রুকণায় হৃদয় আকাশ হয় ”

চার

” জন্মভিখিরিও সিংহাসন খুঁজে পায়
যদি পরমান্নের ছোঁয়া হৃদয়ে লাগে।”

পাঁচ

“জন্মের মধ্যে ক্ষয় আছে জানি
তবুও জন্মের জন্য জীবন প্রখরতর হয়।”

এই ভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয় সরিয়ে জয়, ভয় হারিয়ে ভালোবাসা, ক্ষতি সারিয়ে জ্যোতি,প্রত্যাখ্যান ফেলে প্রস্তাব এবং আগুনকে আলো করার সহৃদয় সন্ধানে কবি সমীররঞ্জন ধুলো-বালি পথ হাঁটছেন।হলদিয়া শিল্পনগরীর শিশু পরিচর্যা ও আরোগ্যলাভের বরাভয় তাঁর হাতে,তিনি সেই শিশুহৃদয়কে সযত্নে ও সতর্কতায় সুস্থ রাখতে দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন। তার মধ্যেই তাঁর অনুভবী দৃষ্টি পড়ে এইভাবে যে,শিশুটি পেল নতুন ছাড়পত্র, তা কি সত্যি বেঁচে থাকার পৃথিবীর! সেই কতদিন আগে কত সহজ ভাষায় কিশোর কবি বলেছিলেন—

“চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ”

সত্যি এই অঙ্গীকার বুকে হাত রেখে ক’জন করতে পারে? যখন কবি সুকান্ত একথা লিখছিলেন,সেই অসহায় ও অবহেলিত শিশুপৃথিবীর কি কোনো উন্নতি হয়েছে? কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এখনও অসংখ্য পথশিশু ও কিশোর-কিশোরী সভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মরছে,এখনও ব্যস্ত রাজপথের ধারে হোটেলে নিয়ন বাতির নিচে বাসন মাজছে কোনো খালি-গায়ের বালক,এখনও চকলেট বা মোতির গহনার কারখানার বিভৎস অন্ধকারে ছোট ছোট হাতগুলো চিরে যাচ্ছে, শ্রমে ও লালসায়… এখনও অসংখ্য শিশু-কিশোরী চালান হয়ে যাচ্ছে পর্ণগ্রাফির জ্বলন্ত আগুনে…
তাই সুকান্তের কবিতা অমলিন,তার আবেদন চির-প্রতিবাদের…
মানুষের যেমন কষ্ট পেলে যেমন আর্তনাদ করে,এই কবিতা সেই আর্তনাদের দলিল।
কবি সমীররঞ্জন সেই আর্তচিৎকারকে আত্মবেদী করে কবিতা রচনা করছেন।
তিনি আসলে চিকিৎসা করতে করতে এটাও ভেবেছেন,এই সব অসংখ্য শিশু সুস্থ হয়ে ফিরে যাক সেই সুকান্তের কবিতার মতো সুন্দর পৃথিবীতে… ” তাইতো এখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি / মনে হয় শুধু তোমারই মধ্যে আমরা যে বেঁচে আছি”

এই একাত্মবোধ। তাই কবিতা হয়ে ধরা পড়েছে সমীররঞ্জনের কবিতায়।তিনিও একান্তভাবে চাইছেন—

“আমার অক্ষরগুলো চাতক পাখির মতো বর্ষা খোঁজে ”

অথবা

“এসো, তুমি বীজমন্ত্রের বিধাতা হয়ে/ শস্যগোলা তরণী পূর্ণ পৃথিবী করে”

অথবা

” অশ্রুভর্তি থালা লড়াইয়ের সিংহাসন হয়ে ওঠে”

এই চেতনা ও বোধ কবি সমীররঞ্জনের শক্তি ও সাহস।তাঁর কবিসত্তার পূর্ণ আনন্দ ও আলো এই পথেই…
এই কবিতার পরতে পরতে একজন সহৃদয় মানবতার প্রতীক হয়ে অক্ষর সাজিয়েছেন কবি।তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে এক সহানুভূতিশীলতা ও সুসমপর্ণবোধ রয়েছে। তিনি নিজে যেন সেই ধারণার বাইরে নয়, এ যেন মাটিতে নেমে মাটি দিয়েই মনের মিনার নির্মাণ করার সুপ্রচেষ্টা।ভক্ত কবীরের একটি দোঁহা আছে—

” তিনকা কবহুঁ না নিদিয়ে, জো পাঁয়ন তর হোয়
কবহুঁ উড়ি আঁখিন পরৈ, পির ঘনেরি হোয়!”
অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র জিনিস বলে অবহেলা করা উচিত নয়। তিনকা অর্থাৎ খড়কুটো বলে পায়ের তলায় চাপা দিয়ে অবহেলা করা উচিত নয়, যে কোনো মুহূর্তে চোখে এসে পড়লে, খুবই কষ্টের কারণ হতে পারে।অর্থাৎ কোনো মানুষকে ছোট বা অবহেলা করা উচিত নয়। ”
সুমনন কবি সমীররঞ্জনের কবিতায় কবীরের দোঁহার প্রভাব আছে,তিনি অতি ক্ষুদ্র জিনিস ও চোখে পড়ে না,এমন অনুভবকে অতি যত্নে তুলে এনেছেন।তাঁর অনুভব সূর্যের আলো শুধু আলো নয়, বরং

” ঘুম ভাঙতেই দেখে–চাকুরির নিয়োগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে তার অন্ধ ছেলে
এক চিলতে রোদ এসে আলো করে দেয় উঠোন”

এই আলো,যা মানুষের বুকের মধ্যে আছে,তাই তিনি সন্ধান করছেন পুবের দিকে হেঁটে হেঁটে… আসলে তিনি এইভাবে কবিতায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন নিজেই একটি দিক হয়ে উঠবেন,তাই তিনি এত সুন্দর করে আঁকেন বিশ্বাস —

“পুবের দিকে হেঁটে চলেছি
পশ্চিমি হাওয়ার বাঁকে
ঠাকুর দেবতা ঈশ্বর নয়
মানুষই সীমানা আঁকে”

প্রচ্ছদে কবি ও শিল্পী ভগীরথ সর্দার অনবদ্য ভঙ্গিতে পুবদিকের যাত্রাপথ ও যাত্রী অঙ্কন করেছে,যা এই কাব্যটির প্রাণপ্রতিমা আলোকিত। লিপি প্রকাশনা সযতনে ও সুন্দরতায় প্রকাশ করেছেন,তার জন্য বিশুদ্ধ হাততালি অবশ্যই প্রাপ্য।
এই কাব্য যে নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন পৃথিবী নির্মাণ, তাই অতি সুন্দরভাবে প্রকাশিত উৎসর্গপত্রে…
সেখানে লেখা,” প্রিয় পুত্র অর্চিস্মানকে, যে বাবার পেশাগত শত ব্যস্ততায় মনে করিয়ে দেয়,’তুমি কিন্তু অনেকদিন কবিতা লেখোনি’

এই সঞ্চারিত আলোকরেখা,এ-ই তো নতুন পৃথিবীর দরজা।শুধু খোলার জন্য অসংখ্য অগণিত অর্চিস্মানের জন্য বাসযোগ্য সুকান্ত পৃথিবী তৈরি করে যেতে হবে,সে মাটিতে হোক বা কবিতায়…

পুবের দিকে হেঁটে চলেছি
কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া
প্রকাশকাল।নভেম্বর ২০২১
প্রচ্ছদ। ভগীরথ সর্দার
প্রকাশনা। লিপি
মূল্য। আশি টাকা।

Share This
Categories
রিভিউ

নদীয়া জেলায় সাহিত্য সমাবেশ।

নদীয়া জেলার মুড়াগাছার গাছা বাজারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল “সাহিত্য সমাবেশ ও গ্রন্থ প্রকাশ” অনুষ্ঠান । ভূমিপুত্র বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক বীরেন্দ্রনাথ সরকারের উদ্যোগে গান, আবৃতি, কবিতা পাঠ, ইত্যাদি নিয়ে একটি সুন্দর মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান । বিভিন্ন জেলার কবি সাহিত্যিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন । অনুষ্ঠানটিতে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন সিস্টার নিবেদিতা আই-টি-আই’এর অধ্যক্ষ মাননীয় প্রবোধ কুমার দাস । বাঙালি বিশ্বে স্বনামধন্য এবং এপার বাংলা-ওপার বাংলার জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক দিলীপ রায় প্রধান অতিথি হিসাবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন । বিশেষ অতিথি হিসাবে মঞ্চে গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া । ছিলেন বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক বিমলচন্দ্র গড়াই, বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ তপন কুমার গাঙ্গুলি, প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস, ড. অমিত কুমার রায়, শিশু সাহিত্যিক স্বপন পাল, বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক ভুবন পাল, বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল ও রবি সরকার । উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয় । উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন সহেলী চ্যাটার্জী । তারপর উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন বীরেন্দ্রনাথ সরকার । স্বাগত ভাষণের পর মঞ্চে উপবিষ্ট গুণীজনদের হাত ধরে বীরেন্দ্রনাথ সরকার ও দিলীপ পালের লেখা গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন হয় । মোড়ক উন্মোচনের সময় বীরেন্দ্রনাথ সরকারের স্ত্রী, প্রীতিকণা সরকার ও একমাত্র ছেলে উপস্থিত ছিলেন । তারপর প্রধান অতিথির ভাষণ । প্রধান অতিথি তাঁর ভাষণে বাংলা ভাষার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং গাছা বাজারের মতো জায়গায় সাহিত্যের অনুষ্ঠানের তাৎপর্য তুলে ধরেন । তিনি উপস্থিত কবি সাহিত্যিকদের বাংলা সাহিত্য শ্রীবৃদ্ধিতে নজর দিতে অনুরোধ করেন । সমাজ উন্নয়নে তথা দেশ উন্নয়নে কবি সাহিত্যিকদের ভূমিকার কথাও মনে করাতে ভুলে যাননি । মাননীয় তপন কুমার গাঙ্গুলি, স্বপন পাল ও বিমলচন্দ্র গড়াই তাঁদের ভাষণে সাহিত্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন । উপস্থিত ছিলেন অর্ক দীপের সাহিত্য সোপানের কর্ণধার ডাঃ দীপ্তি রায় । তিনি কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের নিরিখে সুন্দর বার্তা দিয়েছেন । কবিতা পাঠ করেছেন অনেকেই । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুমিতা পয়ড়া (নদীয়া), রণজয় মালাকার (উঃ ২৪ পরগণা) , ফটিক বিশ্বাস (হুগলী), মানিক সরকার (নদীয়া), প্রমুখ । অন্যান্য কবিদের কন্ঠে কবিতা পাঠ অনন্য সুন্দর হয়ে উঠেছিল । কবি সুসময় বিশ্বাস নিজের লেখা ও সুর দেওয়া গান পরিবেশন করলেন । সমস্ত অনুষ্ঠানটি সর্বাঙ্গসুন্দর হওয়ায় সভাপতি তাঁর ভাষণে কর্মকর্তাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন । সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভূমিপুত্র ও শিশু সাহিত্যিক দিলীপ পাল ।

Share This
Categories
রিভিউ

সাহিত্যে চরিত্র হয়ে উঠে আসা সাধারণ মানুষদের নিয়ে মহালয়ার শুভদিনে চোখ সাহিত্য পত্রিকার পূজো আড্ডা ও প্রকাশনা উৎসবের জমকালো আয়োজন কলকাতার বুকে….

গল্প নয় সত্যি হ’য়ে কিছু ইচ্ছে পরিপূর্ণতা পায় তার স্বভাবসুলভ স্বকীয়তায়… ভাষার প্রকাশের ঐশ্বরিক অনুলিখন ফুটে ওঠে ছাপার অক্ষরে পাতায় পাতায়…!

তেমনই এক সুন্দরতম শুদ্ধ সাহিত্যের আয়োজনে,
গত ২৫ শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার পূণ্যদিনে কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো চোখ সাহিত্য পরিবার আয়োজিত কবি সম্মেলন এবং মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান…!
চোখ সাহিত্য পরিবার সাহিত্যের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে বরাবরের মতোই একই ধারায় নির্দিষ্ট ভাবনা ভিত্তিক অনুষ্ঠান করে এসেছে বিগত বছরগুলোতে, যা কিনা সাংস্কৃতিক একটি স্বকীয় উজ্জ্বতম নব ধারার সৃষ্টি করেছে এই সময়ের কলকাতার সাহিত্য অঙ্গনে..!

চোখ সাহিত্য পরিবারের কর্ণধার শ্রী রজত পুরকায়স্থ মহাশয়ের কথা ও ভাবনায়,
” নাচের অনুষ্ঠান কিংবা পূজো প্যান্ডেল হয় একটা থিম বা ভাবনাকে কেন্দ্র করে, একটা সাহিত্যের অনুষ্ঠানও ভাবনা বা থিম নির্ভর হতে পারে এবং হওয়া উচিতও বটে.. এটাই আমরা মনে করেছি এবং সেই ভাবনা থেকেই এবারের থীম বা বিষয় ছিলো সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে উঠে আসা সফল কিছু মানুষদের নিয়ে “ওঁরা কাজ করে” শীর্ষক ভাবনার..! উল্লেখ্য যে বিগত বছরে আমাদের মঞ্চ ভাবনা ছিল, কবিপাঠকএবংকবিতারবিষয়.. এই ভাবনাকে সামনে রেখে আমরা মঞ্চে সম্মান জানিয়েছিলাম কবি এবং পাঠকদের…। কবিতার বিষয় বলতে, কবি/সাহিত্যিকরা যাদের নিয়ে মেতে ওঠে সৃষ্টির পরম আনন্দে..যেমন, বাজারের মাছওলা, সবজিওলা, রিক্সাচালক, শ্রমিক এবং ট্রান্সজেন্ডার….. আমরা সবাইকে সম্মান জানিয়েছিলাম প্রথম বর্ষে…। পরের দ্বিতীয় বছরে আমাদের ভাবনা ছিল, ‘তুমিওনারী’…। এই ভাবনায় আমরা মঞ্চে সম্মান জানিয়েছি আমাদের সমাজের মানবিক দিক থেকে অবহেলিত ট্রান্সজেন্ডার ও যৌনকর্মীদের…। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সর্বভারতীয় সভাপতি শ্রীমতী ভারতী ঘোষ মহাশয়া..। তাই এবারের মহালয়ার দিন আমাদের মঞ্চ ভাবনা– ‘ওরাকাজকরে’…। এই ভাবনাকে সার্থক করতে এবার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, বাঁকুড়া থেকে অপরাজেয় এক নারী.. সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি…। যিনি ভূগোলে এম,এস সি ; বি, এড করেও বাস্তবতার নিরিখে চাকরী না পেয়ে ট্রেনে হকারি করেন..। তিনি কাজ করেন অবিরাম জীবনধারণের তাগিদে। আমার মতে, এই সমাজকে তিনি উপহার দিয়েছেন চরম এক লজ্জা। তিনি আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, আমাদের চোখে এই সমাজের বীরাঙ্গনা…। এবার মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন কর্ণেল আবির ঘোষ। তিনি কাজ করেন দেশকে রক্ষা করার জন্য ভারতের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সীমান্তে..। আবির বাবু বিগত কার্গিল যুদ্ধের অন্যতম নায়ক ছিলেন। তাঁকে সম্মান জানাতে পেরে আমরা সম্বৃদ্ধ হয়েছি…! চেষ্টা করেছি আমাদের মঞ্চ ভাবনা ‘ওরাকাজ_করে’ অনুযায়ী এবারের অনুষ্ঠানটিকে উপস্থাপন করতে…!”

অনন্য ভাবনার চোখ সাহিত্য পরিবারের এই প্রাক পূজো মিলনমেলা ও প্রকাশ উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক শ্রী নলিনী বেরা মহাশয়, প্রধান অতিথি ছিলেন আনন্দ প্রকাশনির কর্ণধার শ্রী আনন্দ মণ্ডল মহাশয়, ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী পৃথ্বীরাজ সেন মহাশয়, আরও ছিলেন তরুণ কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শ্রী সৌগত রাণা কবিয়াল মহাশয় প্রমুখ বিজ্ঞ মানুষেরা…।

সময় শ্রদ্ধা জানায় সেই কর্মকেই, যে কর্মে মানুষের কথা লেখা থাকে…! রজত পুরোকায়স্থ মহাশয়ের ভাবনায় অসাধারণ ভাবে উজ্জীবিত এক মঞ্চ হয়ে ওঠে গত ২৫ সে সেপ্টেম্বরে কলকাতার বুকে কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলের চোখ সাহিত্য মঞ্চ.. যেখানে নবীন প্রবীণ লেখকগন নিজেদের ভাবনা নিয়ে কথা বলেন, আর চোখ পরিবারের ভাবনায় তাদের মুখোমুখি ছাপায় বোনা সেই চরিত্রগুলো ভেসে ওঠে চোখ সাহিত্য পরিবারের উৎসব বারান্দায়…! অনুষ্ঠান মঞ্চের আলোয় শিশু সাহিত্যিক হিসেবে জ্বলে উঠে দশ বছর বয়সের দেভাংশ চ্যাটার্জি.. মঞ্চে দেবী দুর্গার প্রতিরুপ হয়ে ওঠেন বাঁকুড়ার ট্রেনে নিজের জীবিকার তাগিদে একজন সাধারণ মানুষ থেকে কর্ম-শিল্পী হয়ে ওঠা আমাদের সমাজের চোখের অনাহুত বিবেক গ্লানি নিয়ে ভূগোলের এম এসসি, বি এড সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি…! মঞ্চে উপবিষ্ট সকল মানুষ অহংকারে তাদের দেশের এক কৃতি মানুষ কর্ণেল আবীর ঘোষকে অভিবাদন করে অবচেতন ভাবেই স্যালুট করে জানিয়ে দেয় যে যথাযোগ্য সন্মানে কখনই বাংলার সাহিত্য কর্মীরা কৃপণ নয়… নব ধারায় আগামী ভারতকে তুলে ধরতে কণ্যা স্নেহে মাতৃ দৃষ্টিতে ভালোবাসা আর আশির্বাদের ছবিতে ফুটে ওঠে ন্যাশানাল গেমসে চারটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত সায়ন্তনী সাহা মণ্ডল’…!

কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলের সভাগৃহে চোখ সাহিত্য পত্রিকার এই অনুষ্ঠানে অসাধারণ সঞ্চালনা করেন প্রবীণ শিক্ষক শ্রী দেবাশিস পাল মহাশয় এবং শ্রীমতী স্বাগতাপাল মহাশয়া…।
“চোখ সাহিত্য পরিবার” এর এডমিল শ্রীমতী মৌমিতা চ্যাটার্জী মহাশয়া এবং শ্রী পঙ্কজ দত্ত মহাশয়ের আন্তরিক পরিচালনায়, পত্রিকার সম্পাদক শ্রী রজত পুরকায়স্থ মহাশয়ের অসাধারণ আথিতেয়তায় মঞ্চে
সম্মান জানানো হয় এই সময়ের প্রতিভাবান একঝাঁক কবি সাহিত্যিককে..প্রদান করা হয় সম্মাননা স্বারক ও সনদ পত্র… ।
মঞ্চে সম্মান জানানো হয় ন্যাশানাল গেমসে চারটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত সায়ন্তনী সাহা মণ্ডল কে…! নাট্যকার বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ স্মৃতি সাহিত্য সম্মান প্রদান করা হয় কবি শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল মহাশয়, কবি মধুছন্দা গাঙ্গুলী মহাশয়া, কবি সজল পোদ্দার মহাশয়কে। চোখ সাহিত্য সম্মান -২০২২ প্রদান করা হয় কবি বৃন্দাবন দাস মহাশয়, কবি অসীমবদাস মহাশয়, কবি মহাদেব নস্কর মহাশয়কে…। সেরা পাঠক-২০২২ প্রদান করা হয় অশোক রায় মহাশয়কে…। বীরাঙ্গনা সম্মান -২০২২ প্রদান করা হয় সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি মহাশয়াকে.. ।
অনুষ্ঠানে আরও যে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে, প্রাত্যহিক কবিতা পাঠের আসর এর শিল্পী কবি সুনীল বণিক মহাশয়, শ্রদ্ধেয়া মাধুরী শর্মা মাহাশয়া এবং বর্ণালী মিস্ত্রী মাহাশয়াকে..।

বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে মোড়ক উন্মোচন করা হয় কবি রজত পুরকায়স্থ সম্পাদিত চোখ সাহিত্য পত্রিকার পূজো সংখ্যা ও চোখ কাব্য সংকলনের..। এছাড়াও প্রকাশ করা হয় সাতটি একক গ্রন্থ..যথাক্রমে, কবি কৃষ্ণা গুহ’র “নির্বাচিত কবিতা”, কবি বিকাশ গুঁইয়ের “প্রেম ও প্রকৃতি”, কবি সিদ্ধার্থ সেন এবং ডাক্তার লিপিকা সেনের “রং ও তুলি”, কবি কৃষ্ণগোপাল ঘোষের “প্রথম প্রেম”, কবি ড: শিপ্রা মুখোপাধ্যায় হালদারের “পূর্বরাগের প্রণয়লিপি”, বিষ্ময় বালক দেভাংশ চ্যাটার্জির “A Tide Of Tales” এবং রজত পুরকায়স্থের “রাজার কলম হোক ক্রীতদাস”…।

মেধা মননশীলতায় বাংলা সাহিত্য সবসময় দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রধান পঙক্তির সমার্থক..সেই অর্থে আধুনিক সাহিত্যে সত্য এবং সুন্দরকে পাশাপাশি হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে চোখ সাহিত্য পরিবারের মতন এমন ফেরিওয়ালা চাই যাদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য এগিয়ে যাবে তার সঠিক ভবিষ্যতের দিকে…!
জয় হোক শুদ্ধ সাহিত্যের..জয় হোক মানুষের…!

সৌগত রাণা কবিয়াল—
— কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Share This
Categories
রিভিউ

চার দেয়ালের ঘেরাটোপের বাইরে উন্মুক্ত আকাশের সন্ধ্যা আলোয় বৃষ্টিস্নাত হয়ে লীনা প্রকাশনীর এক ভিন্নমাত্রার আয়োজনে সুরে-স্বরে মুখরিত হয়ে উঠলো কলকাতার মোহর কুঞ্জের সবুজবীথি।।।।

আলো এসে ভরিয়ে দিচ্ছে কাশ ভোরের সকাল..মাতৃ পক্ষের আগমনী সুরে প্রকৃতি হয়ে কথা বলছে তরুণ কিশোরের মনের ভাষা..বাংলার সাহিত্য পাড়ায়ও তার ছোঁয়া অদ্ভুত এক উজ্জ্বল সুখের কথা হয়ে ফুটে উঠছে আবীর রাঙা সব উৎসবে…!

লীনা প্রকাশনীর আয়োজনে এমনই এক অসাধারণ ভালোবাসা ও বন্ধনে সাহিত্যের মিলনমেলার প্রাণময় এক উৎসবে পরিনত হলো কলকাতার মোহর কুঞ্জ প্রাঙ্গণে গত ২৪ শে সেপ্টেম্বরের সুন্দর বিকেলের রোদ- বৃষ্টির সন্ধিক্ষণে…!

প্রকাশনীর সম্পাদক কবি বাণীব্রত সরকারের মোহরকুঞ্জে লীনা পাবলিকেশনের প্রাক শারদ আড্ডায় মিলিত হলেন এই সময়ের নবীন প্রবীণ কবি সাহিত্যিকগন.. উন্মুক্ত মঞ্চে আড্ডা কবিতায় সুর হয়ে ফুটে উঠলো বাংলার চীরচেনা শরৎ উৎসবের আলো…!

লীনা পাবলিকেশন ও কবিতা নীড় সৃজন বাংলা সাহিত্য পরিবারের যৌথ উদ্যোগের খোলা মনের এই পূজোর আড্ডায় কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শ্রী সৌগত রাণা কবিয়ালের হাত ধরে উন্মোচিত হলো কবি পলাশ দাসের ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ , প্রবীণ সাহিত্যিক কনককান্তি মজুমদারের যে’দিন আমি থাকবো না’, কবি পঞ্চু নস্করের ‘বিচ্ছুরণ’…! অনুষ্ঠানের রোদ মেঘ বৃষ্টির অসাধারণ এই সান্ধ্য আলোয় কবি সাহিত্যিকদের সন্মানিত করতে তাদের হাতে শারদ সন্মাননা তুলে দেন নীনা প্রকাশনীর কর্ণধার কবি বাণীব্রত সরকার ও বাচিক শিল্পী সেঁজুতি বসু….!

অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক ক্ষণ থেকেই আকাশের মেঘ ছায়ার খেলায় বৃষ্টি ভেজা হয়ে প্রাকৃতিক স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জমে ওঠে প্রাক শারদীয়া এই আড্ডা… চার দেয়ালের ঘেরাটোপের বাইরে ভিন্নমাত্রার এই আয়োজন সুরে-স্বরে মুখরিত হয়ে ওঠে সাহিত্যের প্রেমময় বন্ধনে…রচিত হয় এক স্মৃতি মাধুকরী ক্ষণের…! স্বতস্ফূর্তভাবে আগত সাহিত্যপ্রেমীরা মজলেন সন্ধ্যার সিক্ত সাহিত্য আড্ডায়..সকলের মন শিশুতোষ ভালোবাসাময় হয়ে উঠলো আগত তরুণ প্রবীণের দৃষ্টি দৃশ্য…!

উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ৭ই অগাস্ট লীনা প্রকাশনীর বই প্রকাশের জমকালো আয়োজনে কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল হলের সভাগৃহে এক হয়েছিলেন বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাহিত্য প্রেমী গন..!

মহালয়ার প্রাক সন্ধ্যায় কলকাতার মোহর কুঞ্জের সবুজবীথিতে লীনা প্রকাশনীর আনন্দময় আগমনীর এই মিলনমেলায় কবিতা গানের সাথে প্রকাশ উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশ পেলো বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন সৌহার্দপূর্ণ সৃষ্টি উল্লাসের..! এভাবেই এগিয়ে যাক বাংলার সাহিত্যের বৈতরণী, সসম্বৃদ্ধ হোক আগামী প্রজন্মের জন্য মূল্যবান ইতিহাস..!

সৌগত রাণা কবিয়াল…
— কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Share This
Categories
রিভিউ

ঐশ্বরিক ভাবনাতে মানবিক প্রতিমা গড়ে কলকাতার বুকে চোখ সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলে।।।

গল্প নয় সত্যি হ’য়ে কিছু ইচ্ছে পরিপূর্ণতা পায় তার স্বভাবসুলভ স্বকীয়তায়… ভাষার প্রকাশের ঐশ্বরিক অনুলিখন ফুটে ওঠে ছাপার অক্ষরে পাতায় পাতায়…!

তেমনই এক সুন্দরতম শুদ্ধ সাহিত্যের আয়োজনে,
গত ২৫ শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার পূণ্যদিনে কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো চোখ সাহিত্য পরিবার আয়োজিত কবি সম্মেলন এবং মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান…!
চোখ সাহিত্য পরিবার সাহিত্যের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে বরাবরের মতোই একই ধারায় নির্দিষ্ট ভাবনা ভিত্তিক অনুষ্ঠান করে এসেছে বিগত বছরগুলোতে, যা কিনা সাংস্কৃতিক একটি স্বকীয় উজ্জ্বতম নব ধারার সৃষ্টি করেছে এই সময়ের কলকাতার সাহিত্য অঙ্গনে..!

চোখ সাহিত্য পরিবারের কর্ণধার শ্রী রজত পুরকায়স্থ মহাশয়ের কথা ও ভাবনায়,
” নাচের অনুষ্ঠান কিংবা পূজো প্যান্ডেল হয় একটা থিম বা ভাবনাকে কেন্দ্র করে, একটা সাহিত্যের অনুষ্ঠানও ভাবনা বা থিম নির্ভর হতে পারে এবং হওয়া উচিতও বটে.. এটাই আমরা মনে করেছি এবং সেই ভাবনা থেকেই এবারের থীম বা বিষয় ছিলো সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে উঠে আসা সফল কিছু মানুষদের নিয়ে “ওঁরা কাজ করে” শীর্ষক ভাবনার..! উল্লেখ্য যে বিগত বছরে আমাদের মঞ্চ ভাবনা ছিল, কবিপাঠকএবংকবিতারবিষয়.. এই ভাবনাকে সামনে রেখে আমরা মঞ্চে সম্মান জানিয়েছিলাম কবি এবং পাঠকদের…। কবিতার বিষয় বলতে, কবি/সাহিত্যিকরা যাদের নিয়ে মেতে ওঠে সৃষ্টির পরম আনন্দে..যেমন, বাজারের মাছওলা, সবজিওলা, রিক্সাচালক, শ্রমিক এবং ট্রান্সজেন্ডার….. আমরা সবাইকে সম্মান জানিয়েছিলাম প্রথম বর্ষে…। পরের দ্বিতীয় বছরে আমাদের ভাবনা ছিল, ‘তুমিওনারী’…। এই ভাবনায় আমরা মঞ্চে সম্মান জানিয়েছি আমাদের সমাজের মানবিক দিক থেকে অবহেলিত ট্রান্সজেন্ডার ও যৌনকর্মীদের…। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সর্বভারতীয় সভাপতি শ্রীমতী ভারতী ঘোষ মহাশয়া..। তাই এবারের মহালয়ার দিন আমাদের মঞ্চ ভাবনা– ‘ওরাকাজকরে’…। এই ভাবনাকে সার্থক করতে এবার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, বাঁকুড়া থেকে অপরাজেয় এক নারী.. সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি…। যিনি ভূগোলে এম,এস সি ; বি, এড করেও বাস্তবতার নিরিখে চাকরী না পেয়ে ট্রেনে হকারি করেন..। তিনি কাজ করেন অবিরাম জীবনধারণের তাগিদে। আমার মতে, এই সমাজকে তিনি উপহার দিয়েছেন চরম এক লজ্জা। তিনি আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, আমাদের চোখে এই সমাজের বীরাঙ্গনা…। এবার মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন কর্ণেল আবির ঘোষ। তিনি কাজ করেন দেশকে রক্ষা করার জন্য ভারতের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সীমান্তে..। আবির বাবু বিগত কার্গিল যুদ্ধের অন্যতম নায়ক ছিলেন। তাঁকে সম্মান জানাতে পেরে আমরা সম্বৃদ্ধ হয়েছি…! চেষ্টা করেছি আমাদের মঞ্চ ভাবনা ‘ওরাকাজ_করে’ অনুযায়ী এবারের অনুষ্ঠানটিকে উপস্থাপন করতে…!”

অনন্য ভাবনার চোখ সাহিত্য পরিবারের এই প্রাক পূজো মিলনমেলা ও প্রকাশ উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক শ্রী নলিনী বেরা মহাশয়, প্রধান অতিথি ছিলেন আনন্দ প্রকাশনির কর্ণধার শ্রী আনন্দ মণ্ডল মহাশয়, ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী পৃথ্বীরাজ সেন মহাশয়, আরও ছিলেন তরুণ কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শ্রী সৌগত রাণা কবিয়াল মহাশয় প্রমুখ বিজ্ঞ মানুষেরা…।

সময় শ্রদ্ধা জানায় সেই কর্মকেই, যে কর্মে মানুষের কথা লেখা থাকে…! রজত পুরোকায়স্থ মহাশয়ের ভাবনায় অসাধারণ ভাবে উজ্জীবিত এক মঞ্চ হয়ে ওঠে গত ২৫ সে সেপ্টেম্বরে কলকাতার বুকে কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলের চোখ সাহিত্য মঞ্চ.. যেখানে নবীন প্রবীণ লেখকগন নিজেদের ভাবনা নিয়ে কথা বলেন, আর চোখ পরিবারের ভাবনায় তাদের মুখোমুখি ছাপায় বোনা সেই চরিত্রগুলো ভেসে ওঠে চোখ সাহিত্য পরিবারের উৎসব বারান্দায়…! অনুষ্ঠান মঞ্চের আলোয় শিশু সাহিত্যিক হিসেবে জ্বলে উঠে দশ বছর বয়সের দেভাংশ চ্যাটার্জি.. মঞ্চে দেবী দুর্গার প্রতিরুপ হয়ে ওঠেন বাঁকুড়ার ট্রেনে নিজের জীবিকার তাগিদে একজন সাধারণ মানুষ থেকে কর্ম-শিল্পী হয়ে ওঠা আমাদের সমাজের চোখের অনাহুত বিবেক গ্লানি নিয়ে ভূগোলের এম এসসি, বি এড সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি…! মঞ্চে উপবিষ্ট সকল মানুষ অহংকারে তাদের দেশের এক কৃতি মানুষ কর্ণেল আবীর ঘোষকে অভিবাদন করে অবচেতন ভাবেই স্যালুট করে জানিয়ে দেয় যে যথাযোগ্য সন্মানে কখনই বাংলার সাহিত্য কর্মীরা কৃপণ নয়… নব ধারায় আগামী ভারতকে তুলে ধরতে কণ্যা স্নেহে মাতৃ দৃষ্টিতে ভালোবাসা আর আশির্বাদের ছবিতে ফুটে ওঠে ন্যাশানাল গেমসে চারটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত সায়ন্তনী সাহা মণ্ডল’…!

কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলের সভাগৃহে চোখ সাহিত্য পত্রিকার এই অনুষ্ঠানে অসাধারণ সঞ্চালনা করেন প্রবীণ শিক্ষক শ্রী দেবাশিস পাল মহাশয় এবং শ্রীমতী স্বাগতাপাল মহাশয়া…।
“চোখ সাহিত্য পরিবার” এর এডমিল শ্রীমতী মৌমিতা চ্যাটার্জী মহাশয়া এবং শ্রী পঙ্কজ দত্ত মহাশয়ের আন্তরিক পরিচালনায়, পত্রিকার সম্পাদক শ্রী রজত পুরকায়স্থ মহাশয়ের অসাধারণ আথিতেয়তায় মঞ্চে
সম্মান জানানো হয় এই সময়ের প্রতিভাবান একঝাঁক কবি সাহিত্যিককে..প্রদান করা হয় সম্মাননা স্বারক ও সনদ পত্র… ।
মঞ্চে সম্মান জানানো হয় ন্যাশানাল গেমসে চারটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত সায়ন্তনী সাহা মণ্ডল কে…! নাট্যকার বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ স্মৃতি সাহিত্য সম্মান প্রদান করা হয় কবি শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল মহাশয়, কবি মধুছন্দা গাঙ্গুলী মহাশয়া, কবি সজল পোদ্দার মহাশয়কে। চোখ সাহিত্য সম্মান -২০২২ প্রদান করা হয় কবি বৃন্দাবন দাস মহাশয়, কবি অসীমবদাস মহাশয়, কবি মহাদেব নস্কর মহাশয়কে…। সেরা পাঠক-২০২২ প্রদান করা হয় অশোক রায় মহাশয়কে…। বীরাঙ্গনা সম্মান -২০২২ প্রদান করা হয় সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি মহাশয়াকে.. ।
অনুষ্ঠানে আরও যে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে, প্রাত্যহিক কবিতা পাঠের আসর এর শিল্পী কবি সুনীল বণিক মহাশয়, শ্রদ্ধেয়া মাধুরী শর্মা মাহাশয়া এবং বর্ণালী মিস্ত্রী মাহাশয়াকে..।

বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে মোড়ক উন্মোচন করা হয় কবি রজত পুরকায়স্থ সম্পাদিত চোখ সাহিত্য পত্রিকার পূজো সংখ্যা ও চোখ কাব্য সংকলনের..। এছাড়াও প্রকাশ করা হয় সাতটি একক গ্রন্থ..যথাক্রমে, কবি কৃষ্ণা গুহ’র “নির্বাচিত কবিতা”, কবি বিকাশ গুঁইয়ের “প্রেম ও প্রকৃতি”, কবি সিদ্ধার্থ সেন এবং ডাক্তার লিপিকা সেনের “রং ও তুলি”, কবি কৃষ্ণগোপাল ঘোষের “প্রথম প্রেম”, কবি ড: শিপ্রা মুখোপাধ্যায় হালদারের “পূর্বরাগের প্রণয়লিপি”, বিষ্ময় বালক দেভাংশ চ্যাটার্জির “A Tide Of Tales” এবং রজত পুরকায়স্থের “রাজার কলম হোক ক্রীতদাস”…।

মেধা মননশীলতায় বাংলা সাহিত্য সবসময় দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রধান পঙক্তির সমার্থক..সেই অর্থে আধুনিক সাহিত্যে সত্য এবং সুন্দরকে পাশাপাশি হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে চোখ সাহিত্য পরিবারের মতন এমন ফেরিওয়ালা চাই যাদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য এগিয়ে যাবে তার সঠিক ভবিষ্যতের দিকে…!
জয় হোক শুদ্ধ সাহিত্যের..জয় হোক মানুষের…!

সৌগত রাণা কবিয়াল—
— কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Share This