Categories
গল্প

মৃত্যঞ্জয় : ডঃ অশোকা রায়।

কফির আড্ডায় আজ সবাই আছে নেই মৃত্যুঞ্জয়।
অবসরের পর আমরা সবাই কলকাতায়, দেশ- বিদেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে।
কর্মজীবন আমাদের সাত বন্ধুর জোড়টা আলগা করেছিল। তবে চোখের দেখা না থাকলেও প্রাণের বাঁধন বজায় রেখেছিল ইন্টারনেট। সুতরাং বন্ধুত্বে ভাঁটা সেভাবে পড়ে নি। স্কাইপ বা ভিডিও কলে আমরা পরস্পরের মেদ-বাহুল্য ঘটার ঘটনা যেমন জানতে পারতাম, তা,অপরাধী বন্ধুর পক্ষ থেকে লোকানোর যতোই চেষ্টা করা হোক না কেন, আবার কারো ওজন দ্রুত কমলে সেটাও জানা থাকতো । জ্ঞান বরিষণের হাত থেকে রেহাই পেতে তার কাজের অজুহাতে ভিডিও ক্যামেরার সামনে থেকে পালানোর কথা বাকিদের কাছে অজানা থাকতো না। সকলের নাড়িনক্ষত্র আমাদের প্রত্যেকের কাছে খোলা খাতার মতোই ছিল। কথাটা যে কতটা ভুল ছিল তা’ বুঝেছি অবসরের পর। তবে সে বোঝা অলৌকিকভাবে।
অবসরের পর আমরা সবাই দেশের মাটিতে। মৃত্যঞ্জয় রয়েছে মেক্সিকোতে। ওর বিদেশিনী বৌয়ের চাকরি আর কয়েক মাস আছে। মৃত্যুঞ্জয় আর তার বৌ লিসা ঠিক করেছে ভারতে ফিরবে। আর তো কয়েক মাস। তারপর সপ্তরত্নের সভা সস্ত্রীক জমজমাট। বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভা হার মেনে যাবে। আমাদের স্ত্রীরা যমের মুখে ছাই দিয়ে বহাল তবিয়তে বর্তমান। সুতরাং দুরন্ত মৃত্যুঞ্জয় ঘরে ফিরলে আমরা সাত দু-গুণে চোদ্দো। নবরত্ন সভাকে হাসিহুল্লোড়ের রেটিং এ পিছে রাখতেই পারি।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আলিপুরের এক কফি-বারিস্তায় আমাদের নতুন আড্ডা। আগের আড্ডা কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস আমরা ছেলে-ছোকরা আর কিছু ইন্টেলেকচুয়াল লোকজন কে ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্য কোনকালেই আমরা যথাযথ ইন্টেলেকচুয়াল ছিলাম না। তবে ইন্টেলেকচুয়ালের ভান করাটা প্যাশন এবং ফ্যাশন ছিল। তাই ব্রাত্য হওয়ার ভয়ে কফি হাউসের কাঠের সিঁড়ি ভাঙ্গতাম।
এখন সেই ফ্যাশনের মোহ নেই, প্যাশন উধাও। বয়স বেড়েছে। আমরা সবাই দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। এতোটা পথ উজিয়ে যাওয়ার এনথু একেবারে লেস।
তাই কফিহাউস ছেড়ে আলিপুরের কফি-বারিস্তায় আমাদের আড্ডা। রোজ নয়, সপ্তাহে দুদিন। আড্ডার অত সময় আমাদের মধ্যে তিনজনের নেই। আমার ছেলের চাকরি খোদ কলকাতার বুকে। একে নিজের বৌয়ের ফরমায়েশ, তার ওপর বৌমার চিকণ গলায় আবদারের সুরে বলা তার নিজস্ব জিনিসের ফর্দ। কায়দা করে জুড়ে দেয় প্রশংসা, ” বাবা তোমার বাজার করার ফরম্যাট টা সুন্দর। তোমার ছেলে কে কেন শেখাও নি? কিছু আনতে বললে আগেভাগে ফরমান জারি করে, ওসব কোথায় পাওয়া যায় জানি না। বাবা কে বলো। ” অগত্যা বাজারে দরকারী অ- দরকারী কাজে আমার কাটে পাক্কা দু ঘন্টা। তারপর কিছু অবসর। চারটে বাজতে না
বাজতেই দুটো ক্ষুদে দস্যির আগমন। পার্ক আর ইনডোর গেমস। কিন্তু সেটা আমার রিলাক্সেশন। আসলের চেয়ে সুদ বেশি। বাদবাকি দুজনের ঐ একই অবস্থা। একটু ঊনিশ-বিশ।
হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। সেদিন আড্ডা তুঙ্গে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পাওয়া নিয়ে। চলে এসেছে অমর্ত্য সেনের প্রসঙ্গ। কফির পেয়ালায় আলোচনার তুফান। হঠাৎ আমাদের টেবিলের সামনে মৃত্যুঞ্জয়। সেই দীর্ঘ দেহ। ঠোঁটে মুচকি হাসি। আমরা ছ’ জন হতবাক। সায়ক বলে, “তোর তো ফিরতে কয়েক মাস বাকি! ” মৃত্যুঞ্জয় বলে,” আগে ফিরতে মন চাইছিল বড়ো। কেন তোরা খুশি হসনি? ” নবারুণ, উদয়, অমিত, কৌশিক সমস্বরে বলে, ” তুই ভাবলি কি করে এ কথা। আমরা বলে অপেক্ষা করে আছি, কবে আসবি তুই “? মৃত্যঞ্জয় এবার আমার দিকে চায়, ” কি করে প্রদীপ, এমন করে চেয়ে আছিস যে। এক কাপ কফি তো বল। আর কাজুবাদামও অর্ডার কর। ” আমরা ভালো করে জানি মৃত্যঞ্জয়ের পছন্দ। আগে বলতো, কফির সাথে কাজু হোয়াটস এ্যা ফ্যান্টাস্টিক কম্বিনেশন”! একটু পজ দিয়ে বলতো, “খেতে খেতে আমি ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় চলে যাই। “
আমি কফি- কাজুর অর্ডার দিই।
ওগুলো আসার আগে মৃত্যুঞ্জয় বন্ধুদের সাথে মেক্সিকোর গল্পে মেতেছে। আমার মনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। সকালের ফোনটা কি ফেক ফোন? ঐরকম বদমাইশি কেউ কারও সাথে করে! ভেবছিলাম, বন্ধু দের একটু পরে জানাব, কেউ একজন মেক্সিকো থেকে জানিয়েছে, “মৃত্যঞ্জয় ভৌমিক ইজ নো মোর। ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক”। আর এখন মৃত্যুঞ্জয় আমার সামনে বসে কলকাতার কফি-বারিস্তায় কাজু খাচ্ছে! ভাগ্যিস খবরটা বন্ধু দের আগে দিই নি। লেগপুলিং কে আমার বড়োই ভয়। ভেবেছিলাম বাড়ি ফেরার আগে দেব। আজ দুপুরে ভাত খাইনি ফোন রিসিভ করে মন খারাপ।
ভাবনার মধ্যে আমার ফোন টা বাজছে। ফোন বার করে দেখি, কলার লিসা। “হ্যালো”. ” প্রদীপ, মৃত্যুঞ্জয় চলে গেছে। ফিউরানাল শেষ হলো। ইন্ডিয়ায় ফেরার জন্য ফিউরিয়াস হয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝিনি। বোঝাতাম আর তো কয়েক মাস। মুখে কিছু বলত না। কিন্তু রেস্টলেস হয়ে গিয়েছিল বোধহয়।
আমার ইল- লাক। আমি চাকরি ছাড়ছি। সময়ের টি
কাজ সময়ে করা উচিত,এ শিক্ষা আমার ইগনোর করা উচিত ছিল। বড়োই লেটে বুঝলাম। মৃত্যঞ্জয়ের ইচ্ছামত বাদবাকি জীবন ইন্ডিয়ায় কাটাব। বাট মৃত্যুঞ্জয় থাকবে না, সাথে। তুমি আমার একটা এ্যাকোমোডেশন এ্যারেঞ্জ করে দিও প্লিজ। ” লিসা জানে, আমি মৃত্যঞ্জয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এটুকু সাহায্য সে চাইতেই পারে। আশ্চর্যজনক কিছু নয় সেটা। আমি ফোন টা ইদানীং কানে কম শুনি বলে সবসময় স্পিকারে দিই। বন্ধু রা আমার ফোনে লিসার প্রায় এক তরফা কথা শুনেছে। মৃত্যঞ্জয়ের চেয়ারের দিকে তাকিয়েছে। চেয়ার খালি। কফির কাপ শেষ।
কাজুবাদামের প্লেট খালি।
জীবন থেকে চলে গিয়েও মৃত্যুঞ্জয়ের ইচ্ছা হয়েছিল বন্ধুদের সাথে অন্ততঃ একবার আড্ডা মারার। মৃত্যু কে জয় করে মৃত্যুঞ্জয় তার ইচ্ছাপূরণ করেছে।
সর্বস্বত্ব লেখিকা কর্তৃক।সংরক্ষিত।
19/10/2019

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *