Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস :(ধারাবাহিক উপন্যাস; প্রথম পর্ব) : দিলীপ রায়।

 গাঁয়ের নাম চড়ুইডাঙা । তারপর একটু থেমে কঙ্কাবতী বলল,পোস্ট অফিসের নাম শিলাইদহ, থানা-নিয়ামতপুর,  জেলা – মুর্শিদাবাদ । এবার আমার ভাতার টাকাটা দিন ?
   এখানে টিপসই  দিন ?
  “আমি টিপসই  দেওয়া পছন্দ করি না ।“  তারপর টেবিলের উল্টোদিকে বসা ষণ্ডা মার্কা চেহারার লোকটার হাত থেকে কলমটা একরকম  ছিনিয়ে নিয়ে খাতায় স্বাক্ষর  করে দিলো । সই করার সময় কঙ্কাবতী নিজের চোখে দেখতে পেলো, তার নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা  । রেজিস্টারে লেখা দেখে কঙ্কাবতী নিশ্চিত,  “নারী ভাতা বাবদ সে এক হাজার টাকা পাচ্ছে !” 
  ষণ্ডা মার্কা  লোকটা কঙ্কাবতীর হাতে আটশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে লাইনে দাঁড়ানো অপরজনকে ডাকল ।
  টাকা গণনা করার পর কঙ্কাবতির চোখ চড়কগাছ ! দুশো টাকা কম ! সঙ্গে সঙ্গে চোখ গরম করে কঙ্কাবতী কৈফয়িৎ চাইল, “হিতেনদা, আমি আটশ টাকা পেয়েছি ! এখনও দুশো টাকা বাকী ।“
   ঐ টাকাই তোমার প্রাপ্য ।
   “মানে, আপনি কী বলতে চাইছেন । আমি দুশো টাকা কম নিয়ে বাড়ি যাবো ? পুরো এক হাজার টাকা আমাকে বুঝিয়ে দিন । নতুবা আমি এখান থেকে নড়ছি না ।“ কঙ্কাবতী নাছোড়বান্দা !  
  আচ্ছা জ্বালাতন দেখছি ? তুমি আমাদের কাজে বাধা দিচ্ছো ? আমাদের কাজে বাধা  দিলে আমরা তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবো ?
  হিম্মৎ থাকলে আমাকে টাকা বুঝিয়ে না দিয়ে এখান থেকে সরান, তবে বুঝবো আপনাদের গুণ্ডামির শক্তি ?
 তুমি কী আমাদের চ্যালেঞ্জ দিচ্ছো ? 
 আমার বাকী দুশো টাকা না দিলে ঠিক তাই,  আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি ?
 হঠাৎ হিতেনের একজন সাগরেদ কঙ্কাবতীর ডান হাত হ্যাঁচকা টান দিয়ে চিল্লিয়ে অসভ্য ভাষায় বলল, “পালাবি ? না পালালে তোর কী হবে জানিস ? কেউ তোকে বাঁচাতে আসবে না ?”
   হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কঙ্কাবতী চিল্লিয়ে বলল, “আমি না পালালে কী হবে তুই আগে সেই কথা শোনা, তারপর আমি কী করব সেটা শোনাচ্ছি !”  
   “তোর মেয়েদের তুলে নিয়ে জঙ্গলে ফুর্তি করবো ।“  
  শোনা মাত্র কঙ্কাবতী পায়ের চটি খুলে হিতেনের সাগরেদের গালে সজোরে কয়েক ঘা এমনভাবে মারলো, মারের আঘাতে বেচারা মাটিতে গড়াগড়ি ! 
  উপস্থিত সমস্ত মহিলারা একজোট হয়ে হিতেনের সাগরেদকে টাইট দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল । এতক্ষণ তারা কঙ্কাবতীর সঙ্গে কথা কাটাকাটির দৃশ্য দেখছিল আর প্রমাদ গুণছিল, কখন তারা কঙ্কাবতীর সঙ্গে সামিল হবে ! হিতেনের গুন্ডামি তারা মেনে নিতে পারছিল না । কিন্তু সাহস করে হিতেনের গুন্ডামির যোগ্য জবাবও দিতে পারছিল না । তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ।   সুযোগ পেয়ে অন্যান্য মহিলারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল । তারা রীতিমতো টাকা ফেরতের জন্য সোচ্চার ! 
  অবস্থা বেগতিক বুঝে হিতেন স্পটে এসে সমস্ত মহিলাদের উদ্দেশে হাত জোড় করে বলল, “যারা টাকা কম পেয়েছেন, ফেরত নিয়ে যান ।“ 
  চড়ুইডাঙার বিনোদের মা এগিয়ে এসে কঙ্কাবতীকে পরামর্শ দিলেন, “রাত্রিতে সাবধানে থেকো । হিতেন একজন অসভ্য ও  নোংরা মনের মানুষ । এলাকার মানুষের অনেক ক্ষতি  করেছে  । রাস্তা থেকে বয়স্থা মেয়েদের তুলে  তাদের ইজ্জ্বত নিয়ে মজা করা তার এক ধরনের আনন্দ । রাজনৈতিক দলের ও কিছু মন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় থাকার জন্য এহেন জঘন্য কাজ করেও সে পার পেয়ে যাচ্ছে । কেউ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না । এমনকি ভুক্তভোগী মেয়েদের অভিভাবকেরাও না !  সুতরাং তোমাকে তারা সহজে ছেড়ে দেবে না !” বিনোদের মা আরও জোর দিয়ে বললেন, “বদলা হিতেন নেবেই ।“ 
  কঙ্কাবতীর দুঃসাহস  যথেষ্ট । সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মহিলা না । ইতিপূর্বে  তার নিজের মেয়েদের চলাফেরার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা কঙ্কাবতীকে শক্ত হাতে সামলাতে হয়েছে । তাই বিনোদের মাকে কঙ্কাবতী অভয় দিয়ে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না । হারামজাদাগুলোকে কীভাবে টাইট দিতে হয়, সেই কৌশল আমার জানা আছে । তা ছাড়া হারামজাদাগুলো আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না । গুণ্ডামি করে আমাদের হকের টাকা মারবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না । সেইজন্য আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না । তবে এটা ঠিক, হিতেনের সাগরেদকে গণধোলাই দেওয়ার জন্য আমরা  টাকাটা ফেরত পেলাম । নতুবা এতগুলি টাকা গায়েব করে দিতো ।“
  বাড়ি ফিরতে কঙ্কাবতীর সন্ধ্যা । 
 বাড়ি ফিরে লক্ষ করলো  তার ছোট মেয়ে বিপাশা হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দিয়েছে । কঙ্কাবতীর হাতে মুরগির মাংস । ছোট মেয়ের উদ্দেশে কঙ্কাবতি বলল, “আজ রাত্রিতে মাংস ভাত হবে ।“ কঙ্কাবতীর ছোট মেয়ে সর্বদা মায়ের ন্যাওটা । মায়ের কাজে হাত লাগাতে সে সর্বদা চনমনে । 
  মাংস-ভাতের কথা শুনে কঙ্কাবতীর ছেলেমেয়েরা খুশীতে টগবগ ।
  ঘর থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল মুখে কঙ্কাবতীকে অনিন্দ বলল, “মাংস আনার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ।“  
 কঙ্কাবতীর ভরা সংসার । তার নিজের বয়স অনেক । কিন্তু চেহারাখানা তার চৌকশ । যেমন এক মাথা চুল । তেমনি তার শারীরিক গঠন । তার চেহারা বা চালচলন দেখলে কেউ বলতে সাহস পাবে না, কঙ্কাবতী ছয় সন্তানের জননী । তাক লাগানো চেহারা । যে কোনো বয়সের পুরুষের চোখে পড়ার মতো তার শরীর-গতর । হৃষ্টপুষ্ট শারীরিক স্থিতি । লম্বা যেমনি, তেমনি তার তাগড়াই চেহারা । চলাফেরায় সাবলীল । কিছুটা স্বাধীনচেতা ।  ভয়ডর খুব কম । অল্প বয়সের ছেলেপুলে তাকে উত্ত্যক্ত করলে, সোজা  কান ধরে শুনিয়ে দেয়, “সে তার মায়ের বয়সী ।“  কিন্তু কঙ্কাবতী পড়াশুনায় নবডঙ্কা ! অষ্টম শ্রণী পর্যন্ত ।  অল্প বয়সে অনিন্দের সঙ্গে বিয়ে ।  তারপর প্রথম দুটি ছেলে এবং পরপর চারটি মেয়ে । দুজন ছেলে হচ্ছে – যথাক্রমে রূপন ও ঘোতন । বড় মেয়ে তানিশা, মেজ মনীষা, সেজ অনীশা ও ছোট বিপাশা । বড় ছেলে তেমন লেখাপড়া শেখেনি । যার জন্য সংসারের কাজে বড় ছেলে নিয়োজিত । ছোট ছেলে ঘোতন ।  গাঁয়ে ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় তার অবাধ ঘোরাঘুরি । ঘোতনকে এলাকায় সবাই চেনে । বিনা কারণে যেখানে-সেখানে ঘোতনের অবাধ বিচরণ, অনিন্দের  একেবারেই অপছন্দ । 
  চার মেয়েই ডাগর-ডোগর । কঙ্কাবতীর চার মেয়ের চরিত্র চার রকমের । 
  অনিন্দের উপার্জনের জায়গাটা শক্তপোক্ত নয়, নড়বড়ে । ট্রেনের হকারি । আর মাঠে আট বিঘে চাষের জমি । তা ছাড়া অনিন্দ শারীরিকভাবে দুর্বল । নানান অসুখে জর্জরিত । যার জন্য উপার্জনের কথা মাথায় রেখে কঙ্কাবতীকে বেশীর ভাগ সময় ভ্যান রিক্সায় সব্জি বিক্রি করতে গাঁয়ে বের হতে হয় । পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে তার সব্জি বিক্রি । সব খরচা বাদ দিয়ে দিনে মোটামুটি  চারশ টাকা থাকে । বিয়ের প্রথম দিকে তাকে সংসারের খরচা নিয়ে ভাবতে হত না । অনিন্দ সব দিক সামলাতো । কিন্তু পরবর্তীতে কঠিন ব্যামোতে পড়েছিল অনিন্দ, যেখানে ছিল  জীবন-মরণের প্রশ্ন । ডাক্তারের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই  সময় অনিন্দ প্রাণে বেঁচে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল । তখনই ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, অনিন্দকে দিয়ে পরিশ্রমের কাজ আর করানো যাবে না । সেই থেকে অনিন্দ ট্রেনের হকার । হকারিতে আয় খুব কম । অথচ বাড়িতে বড় বড় ছেলে মেয়ে । নিষ্কর্মার ঢেঁকি । অথচ  তাদের খাওয়া-দাওয়ার খরচা এখন ঊর্ধ্বগতি । 
 পড়াশুনায় কেউ আগ্রহী না । শুধুমাত্র ছোট মেয়ে বিপাশা স্কুলে যাচ্ছে । সামনে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা ! বড় ছেলে রূপন বাবার অসুখের জন্য বেশীদূর পড়াশুনা করতে পারেনি । ঘোতন কলেজে উঠে নানান অশান্তিতে জড়িয়ে পড়ে ।  স্নাতক ডিগ্রি তার কপালে জোটেনি । রূপন বিবাহিত । রূপনকে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে । রূপনের একটি ছেলে । রূপন এখন ঘোর সংসারী । মাঠে চাষবাস নিয়ে থাকে । রূপনের চেষ্টায় মাঠে এখন চাষের জমি বারো বিঘা । জমিতে শুধুমাত্র ধান চাষ । ফলে বছরের খাওয়ার চাল, চাষের জমি থেকে উঠে আসে । সংসার খরচের নগদ টাকার জন্য কঙ্কাবতীর নিরলস কসরত । 
   রূপন সাদামাটা মানুষ । মাঠের জমিতে চাষ-আবাদ ছাড়া গাঁয়ের কোনো সাতেপাঁচে থাকে না । রূপনের বৌ তেমনি । ঘর সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে  সামলায় । চারটে ননদ । কখনও সংসারের কাজে ননদদের বিরক্ত করে না । মুখ বুজে হেঁশেল সামলায় । তাই কঙ্কাবতী গাঁয়ের মানুষদের অহরহ বলে, “অনেক ভাগ্য করে আমরা বৌমা পেয়েছি যে কিনা পুরোপুরি ঘর সংসারী । ঘরের সমস্ত কাজ নিজে হাতে সামলায় ।“  বড় বৌমার প্রশংসা প্রসঙ্গে অনিন্দ আরও একটু বাড়িয়ে বলে, “তার বড় বৌমা বাড়ির লক্ষ্মী । শত খুঁজলেও দ্বিতীয়টি মেলা ভার !” 
  কঙ্কাবতীর হয়েছে জ্বালা ! নিজের তাগড়াই চেহারা । দৈহিক চাহিদা অত্যধিক বেশী । কিন্তু ঘরের হাঁদারাম মরদটা অকর্মার ঢেঁকি ! তবুও তার হা-পিত্যেশ নেই । ছোঁকছোঁক বাতিক নেই । গায়ে পড়ে কেউ ভাব জমাতে এলে, কঙ্কাবতীর হুমকি খেয়ে তারা পালিয়ে বাঁচে । কাউকে ডরায় না । রাতে অনিন্দের সাথে এক বিছানায় শুয়ে শান্তি না থাকায় খুব ভোরে কাজে বের হয়ে যায় । চড়ুইডাঙা গ্রাম থেকে স্টেশন অনেকটা দূর ! পায়ে হাঁটা রাস্তা । স্টেশন বলা ভুল, হল্ট । মিয়াগ্রাম হল্ট । ভোরের প্রথম ট্রেন ধরে সোজা সালার স্টেশন । সেখান থেকে পাইকারি দরে সব্জি কিনে পরের ট্রেনে বাড়ি ফিরতে প্রায় সকাল আটটা । তারপর সেদ্ধ-ভাত খেয়ে ভ্যানে সব্জিগুলি সাজিয়ে গাঁয়ে বের হয় বিক্রি করার জন্যে ।  এগ্রাম-সেগ্রাম ঘুরে সব্জি বিক্রি । তাই বাড়ি ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায় ।  বাড়ি ফিরে বৌমার সাথে গাল-গপ্প । মেয়েদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাসা ! গেরস্থালির কাজ । এসবের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । তবুও ধরাবাঁধা রুটিনের বাইরে কয়েকটা অঘটন তার জীবনে ঘটে গেছে, যেটা ভাবলে তার গা শিউরে উঠে  !  গায়ে কাঁটা দেয় ! 
  সেটা বৈশাখ মাসের সংক্রান্তি  ।
  কঙ্কাবতীর সব্জি বিক্রি প্রায় শেষ । আর কিছুটা সব্জি অবশিষ্ট রয়েছে । বিশেষ করে বেগুন, কলমি শাক, ঢেঁড়শ, পটল, একফালি কুমড়ো, টমাটো, কাঁচা লঙ্কা, ইত্যাদি ।  তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে ।  পাশের গ্রাম হরিবল্লভপুর । কঙ্কাবতী যে গাঁয়ে সব্জি বিক্রি করছিল, সেই গ্রাম থেকে হরিবল্লভপুর যেতে খানিকটা হাঁটা পথ ! তবে মাটির রাস্তা কিন্তু অনেকটা প্রশস্ত । ঐ রাস্তায় গরুর গাড়ির আনাগোনা বেশী ।  ভ্যান নিয়ে কঙ্কাবতী হরিবল্লভপুরের দিকে এগোচ্ছে । তার ধারণা, হরিবল্লভপুরে গেলে তার সমস্ত সব্জি বিক্রি হয়ে যাবে ।  এতগুলি সব্জি অবিক্রি অবস্থায় বাড়িতে ফেরত নিয়ে গেলে তার লোকসান । কেননা, সব্জিগুলি গরমে প্রায় শুকিয়ে গেছে । পরেরদিন ঐগুলি বিক্রি করা কঠিন । অবশেষে সব্জিগুলি জঙ্গলে ফেলে দেওয়া  ছাড়া উপায় থাকবে  না । তাই ছুটলো হরিবল্লভপুর গ্রামের দিকে । রাস্তা ধরে এগোচ্ছে । এমন সময় আকাশে কালো মেঘ । হঠাৎ মেঘ ।  নিমেষের মধ্যে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেলো । হরিবল্লভপুর পৌঁছাতে কঙ্কাবতীর  অর্ধেক রাস্তা তখনও বাকী । ঝড়ের পূর্বাভাস ! ভ্যান নিয়ে জোরে পা চালায় কঙ্কাবতী । 
  শুরু হল বিদ্যুৎ চমকানো । আর প্রচণ্ড ঝড় । কঙ্কাবতীর মতে,  নিঃসন্দেহে ঘূর্ণিঝড় ! লাগামছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ওলট-পালট অবস্থা । আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা । কালো মেঘ, তার উপর মেঘের গর্জনের দাপট ! অচিরেই  চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো । তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, অথচ চারিদিকে অন্ধকার । ঝড়ের তীব্রতায় রাস্তা দিয়ে হাঁটা দায় ! ঝড়ের গতিবেগ এতটাই বেশী, যার জন্য ভ্যান রিক্সা ঠেলতে পারছে না কঙ্কাবতী । ঝড়ের দাপটে নিজেকে সামলানোও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে কঙ্কাবতীর পক্ষে । তার উপর ভ্যান রিক্সা  সামলানো  ! ঝড়ের সো-সো শব্দ ! ক্ষমতাশালী প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড ! রাস্তায় একটা লোক নেই । চারিদিক সুনসান  ।  এই রাস্তা দিয়ে সাধারণত মানুষের যাতায়াত খুব কম । হরিবল্লভপুরের মানুষ পূর্বদিকের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতে অভ্যস্ত । এই রাস্তাটা খুব একটা কাজে লাগে না । যার জন্য রাস্তাটার কোনো সংস্কার নেই । এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা । মাঠের ফসল তোলার সময় গরুর গাড়ির যাতায়াত যথেষ্ট । যার জন্য রাস্তাটা খানাখন্দে ভর্তি । প্রলয়ংকর ঘূর্ণীঝড়ে কঙ্কাবতীর ভ্যান রিক্সার উপরের সব্জি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি । এবার সে ভ্যান রিক্সা আর ঠেলতে পারছে না । অন্যদিকে পরনের শাড়ি ঠিক রাখতে পারছে না । ঝড়ো হাওয়ায় বুকের উপর থেকে অনেকক্ষণ আগেই শাড়ি উধাও । ঝড়ের তাণ্ডবে সে নিজেকে বাঁচাতে তটস্থ ! তার উপর ভ্যান রিক্সা আগলানো । এসবের মাঝে তার পরনের শাড়ি সামলানোর পরস্থিতি নেই । 
    শুরু হল ঘূর্ণিঝড়ের সাথে ভারী বৃষ্টি ! ঝড়ের ধ্বংসলীলায় চারিদিকে গাছগাছালি ভেঙ্গে  পর্যুদস্ত । সামনে রাস্তার উপরে কাটাজাতীয় একটি বাবলা গাছ  পড়ে থাকতে দেখলো । কঙ্কাবতী কোনোরকমে গাছটা সরিয়ে এগিয়ে গেলো ।  এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই । হরিবল্লভপুর গাঁয়ে ঢুকে তবে রেহাই । কিন্তু হরিবল্লভপুর পৌঁছাতে এখনও অনেকটা দূর ! ঢেলে বৃষ্টি । বৃষ্টিতে কঙ্কাবতীর শরীর   ভিজে একশা ! 
   ঝড় কিছুটা থিতিয়ে গেছে । কিন্তু বৃষ্টির বর্ষণ সমানে চলছে । কঙ্কাবতী বৃষ্টিতে ভিজে নদীতে স্নান করার ন্যায় । তার শারীরিক গঠন এতটাই সুন্দর,  যার জন্য বৃষ্টিতে ভেজার পর তার শরীরের দ্যুতির বিস্ফোরণ আকর্ষণীয় ।
উল্টোদিক থেকে নিয়ামতপুর থানা থেকে বাড়ি ফিরছে পঞ্চায়েতের রক্ষিতবাবু । তাঁর বয়স কঙ্কাবতীর কাছাকাছি । রক্ষিতবাবুর বাড়ি চড়ুইডাঙার পাশের গ্রাম পল্লীদহ গাঁয়ে । তিনি সেখানকার পঞ্চায়েত । পঞ্চায়েত হলে কী হবে ? কঙ্কাবতীর রূপে তিনি মুগ্ধ । কয়েকবার একথাটা বলা হয়ে গেছে । কঙ্কাবতী ঐসব কথার গুরুত্ব কোনোদিনও দেয়নি, সুতরাং রক্ষিতবাবুর কথারও গুরুত্ব দেয়নি  । বরং দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে । এমনকি রক্ষিতবাবু কঙ্কাবতীকে পঞ্চায়েতের কাজে ঢোকানোর প্রলোভনও  দেখিয়েছিল ।  কিন্তু চালাক কঙ্কাবতী ঐসব প্রলোভনে পা দেয়নি । কঙ্কাবতী জানতো, এইসবের পেছনে রক্ষিতবাবুর অন্য ধান্দা রয়েছে । কারণ রক্ষিতবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে কঙ্কাবতী ষোলোআনা অবগত । সেই কারণে রক্ষিতবাবুর ফাঁদে পা বাড়ায়নি । কঙ্কাবতী কানাঘুষো শুনেছে, পল্লীদহের শান্তি বিধবা বৌটার সঙ্গে রক্ষিতবাবুর কেলেঙ্কারির কেচ্ছা ! সেই খতরনাক লোকটাকে দেখে আতকে উঠল কঙ্কাবতী ! কঙ্কাবতী  খুব দ্রুত  তার  পরনের  শাড়ি  গোছাতে শশব্যস্ত হয়ে উঠল ।
   রক্ষিতবাবু  প্রথমে বুঝতে পারেনি । কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলো, শাড়ি পরিহিত একজন হৃষ্টপুষ্ট মহিলা ভ্যান রিক্সার আড়ালে বসে রয়েছে । আকাশে তখনও মেঘের গর্জন । বৃষ্টি অনবরত চলছে ।  বৃষ্টির জলের ফোঁটা ভীষণ ঠাণ্ডা ! সূর্য দেবতা কালো  মেঘে ঢাকা ।  কাছাকাছি  এসেই  রক্ষিতবাবু  হাঁক  ডাকলো, “কে ? কে  ওখানে ?” 
 সাড়া না পেয়ে রাস্তার পাশে কঙ্কাবতীর কাছে গিয়ে তার ঘোমটা খুলে দিলো ।  আচমকা কঙ্কাবতীকে দেখে রক্ষিতবাবু আনন্দে উচ্ছ্বসিত । কঙ্কাবতীর ঘোমটা খুলে তাকে দেখে আনন্দে তার মুখ থেকে বের হল, “আমার অনেকদিনের স্বপ্নের রানীকে আজ সে হাতের মুঠোতে পেয়েছে  ?” 
   কঙ্কাবতী পালাতে ব্যস্ত । এতক্ষণ ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কঙ্কাবতী কিছুটা শারীরিকভাবে কাহিল ? যার জন্য ছুটে পালাতেও হোঁচট খাচ্ছে । তবুও সে পালাতে মরিয়া । নতুবা এই নির্জন জায়গায় রক্ষিতবাবুর খপ্পরে পড়তে বাধ্য । অনেক যত্নে বাঁচিয়ে রাখা তার নারীসত্তার ধ্বংস অনিবার্য । 
                                                                                 ( ক্রমশ)
Share This
Categories
গল্প

পরিবর্তন : দিলীপ রায়।

             তপা পরীক্ষার মার্কশীট নিয়ে বাড়ি ফিরল । অভিভাবকের স্বাক্ষর করিয়ে পরের দিন অবশ্যই জমা দিতে হবে । পরেরদিন মার্কশীট জমা দেওয়ার শেষ দিন । তপা মায়ের কাছে গিয়ে মার্কশীট দেখিয়ে বলল, কীভাবে বাবার স্বাক্ষর নেওয়া যায় ?  বাবা মার্কশীট দেখলে আমাকে ভীষণ বকাবকি করবে । 
      নম্বরের যা  বহর, তাতে তুই কোন্‌ মুখে  বাবার কাছে গিয়ে স্বাক্ষর চাইবি !            
     তপার বাবা পশুপতি খাঁ । পূর্বস্থলি স্টেশনের কাছে সোনাঝরা গ্রামে তাঁর মুদিখানার দোকান । দোকানে অনেক ধার-বাকী । খরিদ্দারের কাছ থেকে ধারের  টাকা আদায় হচ্ছে না । চাইতে গেলে সকলের মুখে এককথা, “মাঠের ধান উঠুক, ধারের সমস্ত টাকা শোধ করে দেবো ।“  পশুপতির আবার ধার দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ । অথচ ধার না দিলে খরিদ্দার ধরে রাখা কষ্ট । সদলবলে গাজি মিয়ার মুদির দোকানে হত্যে দেবে । তাতে আখেরে তাঁর লোকসান । 
      তখন সন্ধ্যা আঁটটা ! খরিদ্দারের আনাগোনা নেই বললেই চলে । তাই ভাবল পশুপতি, এবার দোকান বন্ধ করা যাক । মন-মেজাজ তাঁর ভাল নেই । কিছুক্ষণ আগে খাতা খুলে পশুপতির মাথায় হাত ! প্রায় আঠারো হাজার টাকা  ধার  । এইটুকু দোকানে এতগুলি  টাকা ধার ! লোকে ধার খেয়ে শোধ করার নাম করছে না । অথচ অনেকগুলি টাকা । সংসারে অনেক খরচ । অভাব  অনটনের বহর বেড়েই চলেছে । তাঁর বৌটা তেমনি ! একটু রেখে ঢেকে খরচা বাঁচিয়ে সংসার চালাবে সেদিকে তাঁর নজর নেই । শুধু বায়নাক্কা । এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে । দেখা যাবে  আজ গৃহের আসবাবপত্র কেনা, কাল দেখা যাবে ঘরের থালা বাসন কেনা ! আজকাল আবার অনলাইনে কেনাকাটা শিখেছে ।  কেনার শেষ নেই । তাঁর বৌয়ের খরচার হাত ষোলোআনা ।  এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে পৌঁছালো পশুপতি খাঁ ।
       গামছা হাতে  ধরিয়ে দিয়ে তাঁর বৌ বলল, “হাত মুখ ধুয়ে এসো চা বানিয়ে দিচ্ছি । ঐদিকে খাবার রেডি । যখন বলবে তখনই রাতের খাবার দিয়ে দেবো ।“  
       পশুপতি বৌয়ের  দিকে কট্মট করে  তাকিয়ে বৌকে ঝাঁঝালো সুরে বলল, “কষ্ট করে  আর  চা বানাতে হবে না । ক্ষিদে পেয়েছে, সুতরাং একটু পরে রাতের খাবার খেতে দিলেই চলবে । যতোসব আদিখ্যেতা  !”  
       পশুপতি হাত মুখ ধুতে যাবে এমন সময় তপা কাচুমাচু হয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো । মেয়েকে দেখে মুখ ভেঙ্‌চি দিয়ে পশুপতি জিজ্ঞাসা করল, “সাঝ-সন্ধ্যাবেলায় তোমার আবার কী  দরকার ?” 
  “বাবা,  আমার স্কুলের  মার্কশীটে তোমার স্বাক্ষর চাই”, তপা আমতা আমতা করে বাবাকে  বলল ।
     মার্কশিট নিয়ে ঐরকম হতচ্ছাড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? নিশ্চয়ই পরীক্ষায়  ডাহা ফেল ! দেখি তো মার্কশীট, বলেই  পশুপতি মেয়ের হাত থেকে টান দিয়ে মার্কশীট  নিজের হাতে  নিলো ।
      এক ঝলক মার্কশীটের নম্বর দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো পশুপতি । তারপর রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে কষে মেয়ের গালে এক চড়  । চড়ের আঘাত সামলাতে না পেরে তপা ঘরের মেঝেতে সটান্‌ পড়ে গেল  । যন্ত্রণায় তপা কাঁদছে । তপার মা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলতে গেলে পশুপতি এক ধ্মকে বৌকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো । আর কট্মট করে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “তোমার লায় পেয়ে মেয়েটা উচ্ছন্নে গেছে”  । 
   তপা কাঁদছে ।
   পশুপতি মার্কশীট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকলো ।
  “বাবা, মার্কশীট আগামীকাল স্কুলে জমা দিতে হবে”,  ভীত ও ত্রস্ত অবস্থায় তপা  বাবাকে বলল ।
   আগে নাচ বন্ধ করো তারপর স্বাক্ষর । নাচ বন্ধ না করলে আমি আর স্বাক্ষর করবো না । ধাই ধাই করে এখানে সেখানে নেচে বেড়ানো । যার জন্য ১০০ নম্বরের মধ্যে  অঙ্কে ২৫ নম্বর । ইংরেজিতে  ২২ নম্বর ।  আহারে ! নম্বরের কী ছিরি ! 
    তারপর আবার মেয়ের উপরে  রেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে নাচের সরঞ্জাম দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসে মেয়েকে ধমকিয়ে বলল, “আবার কখনও নাচে তোকে দেখেছি, তাহলে তোকে আস্ত পুড়িয়ে মারবো । তোর মা এসেও বাচাঁতে পারবে না । বলেই ক্রোধে অগ্নিশর্মা  হয়ে গজরাতে গজরাতে খাওয়ার ঘরে ঢুকলো ।“ 
                                                  ( ২ ) 
    পরের দিন রাজ্যস্তরে নাচের প্রতিযোগিতা । কলকাতার নজরুল মঞ্চে । স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতা ছুটলো নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে । এই ঘটনা একমাত্র তপার মা জানে । কেননা একমাত্র মা তপাকে নাচে ভীষণ উৎসাহ দেয় । সত্যি কথা বলতে, তপার পড়াশুনা ভাল লাগে না । পড়তে বসলেই পড়া থেকে উঠে নাচের অনুশীলন । নাচের অনুশীলনে তার পরিশ্রম নেই, বরং ভীষণ স্বচ্ছন্দ ।  কিন্তু তার বাবা উল্টো, পড়াশুনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না । অথচ তপার নাচই জীবন । নাচটা তার রক্তে ।  মনপ্রাণ দিয়ে নাচ শেখে । লুকিয়ে লুকিয়ে  নাচের ক্লাস করে । নাচে ভীষণ দক্ষ ।  মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে  কলকাতার  নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিলো তপা । তার সঙ্গে রয়েছে সহপাঠী অনুপম । তপাকে নাচের ব্যাপারে সবরকম সহযোগিতা করে অনুপম ।
   বিশাল বড় হল । রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম । প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে একজন অথবা দুইজন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে । টান টান উত্তেজনা ।  বিচারকের আসনে স্বনামধন্য  পাঁচজন । সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হল বেলা ১১টায়  ।  বিচারকেরা নাচের নিয়মাবলী আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন । বিচারকদের নির্দেশমতো প্রতিযোগীদের একটা মাত্র  নৃত্য পরিবেশন ।  শুরু হল নৃত্যানুষ্ঠান । 
      তপার পালা ঠিক বেলা দুটোর সময় । তাকে কত্থকের উপর নৃত্য পরিবেশনের জন্য বিচারকমণ্ডলী নির্দেশ দিলেন । তপার নৃত্যের তাল,ছন্দ ও লয় অতীব সুন্দর ।  তালে তালে এত সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করলো তপা, যার জন্য হলের সমস্ত শ্রোতামণ্ডলী অভিভূতো । প্রচণ্ড হাততালি । বিচারকগণ পুনরায় তপাকে নির্দেশ দিলেন আধুনিক লোকগীতির সঙ্গে আরও একটি নৃত্য পরিবেশন করতে । তপাও তেমনি ! নৃত্যের তাল সম্পর্কে  তপার প্রচণ্ড দখল । এটা তার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা  ।   মন খুলে মনের আনন্দে নৃত্য পরিবেশন করলো তপা । নৃত্যে তার অফুরন্ত  আনন্দ ।  অনুপম অবাক ! অনুপম লক্ষ করল, তপার নাচের পরিবেশনের সময় তার সাথে সাথে অর্ধেকের বেশি শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগলেন । অনুপম আরও লক্ষ করল, মাননীয় বিচারকেরা একে অপরের প্রতি হাসিমুখে তাকালেন ।
    তারপর দুজনে ছুটলো হাওড়া স্টেশন । ট্রেন ধরতে । পূর্বস্থলি স্টেশনে যখন পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ৭টা । অনুপমের সঙ্গে তপা বাড়ি ফিরছে । তপা ভাবছে এই সময়ে বাড়িতে বাবা নেই, সুতরাং বাবার বকা বা তাঁর হাতে মার খাওয়া থেকে মুক্তি । কিন্তু গাঁয়ের ভাওয়াল মাস্টার মশাই অনুপমের সঙ্গে তপার বাড়ি ফেরা দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন । সরাসরি  পশুপতির দোকানে গিয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ ! শেষে কিনা আপনার মেয়ে একটা আদিবাসী ছেলের সাথে মিশছে ? ভর সন্ধেবেলায় আপনার মেয়ে কিনা নীচু জাতের আদিবাসী ছেলেটার হাত ধরে  রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ! স্কুলের ড্রেস পরা । পিঠে স্কুলের বইয়ের ব্যাগ । নির্ঘাত স্কুল থেকে আলো-আধারি রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে ।“  কথাগুলি বলে ভাওয়াল মাস্টার অন্যত্র ছুটলেন ।                                        
      পশুপতি রাগে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য । দোকান খোলা রেখেই ছুটলো বাড়ির দিকে । বাড়ি পৌঁছেই  চিৎকার, “তপা কোথায় ?” 
   স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ  ধুতে বাথরুমে ঢুকেছে ।
    তপা বাথরুম থেকে বের হতেই হাতের বেতের লাঠি দিয়ে তপার পিঠে বেদম মার ! তপার মা থামাতে গেলে তাকেও ঐ বেতের লাঠি দিয়ে চপেটাঘাত । মেয়েকে শাসিয়ে  পশুপতি বলল, “নাচ বন্ধ । এখন থেকে শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা । এর বাইরে কোথাও দেখতে পেলে তোর ঠ্যাং খোড়া করে দেবো । স্ত্রীর দিকে ক্রূদ্ধভাবে  শাসিয়ে বলল, “মেয়েকে না সামলাতে পারলে আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব  পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে  দেবো ।“  
   তারপর  হন্‌হন্‌ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে  গেলো পশুপতি । 
    মা ও মেয়ে দুইজনেই কাঁদছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে তপা কেদেই যাচ্ছে । কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না ! কলকাতায় ছোটাছুটিতে সারাদিনের ধকলের পর বাবার হাতের বেদম প্রহারে তপা যতো না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছে বাবার হাতে  মা  নিগৃহীত  হওয়ার জন্য !   
                                   ( ৩ ) 
    তারপর, নাচের প্রতিযোগিতার ফলাফল । সেটা ঘোষণা হবে কলকাতায় শনিবারদিন । বাড়ি থেকে কীভাবে বের হবে সেই চিন্তায় তপা অস্থির । 
 মা মেয়েকে বলল, কাল অর্থাৎ শনিবার  তুই ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেন ধরে কলকাতা যাবি । সঙ্গে অনুপম যাবে ।
  “তুমি যাবে না মা ? তুমি আমার সঙ্গে চলো মা”, বায়না ধরলো তপা ।
  যাওয়ার ইচ্ছা আমার ষোলোআনা, কিন্তু তোর বদরাগী বাবাকে নিয়ে ভয় ? 
    তপা  মনকে শক্ত করে মাকে বলল, “আমার নাচে  কোনো পুরস্কার পেলে আমি বাবাকে আর ছেড়ে কথা বলবো না । বাবার জন্য তোমার  যেমনি অশান্তি তেমনি আমার ভীতি । দরকার হলে থানায় নালিশ জানাবো । বাবার অভব্যতার একটা বিহীত হওয়া  দরকার, নতুবা বাবা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে” । 
     মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা শান্তভাবে তপাকে বলল, “বাবাকে নিয়ে ওসব আজেবাজে  কথা বলতে নেই মা । তোর নাচের স্বীকৃতি স্বরূপ কোনো পুরস্কার পেলে তোর বাবার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়ে যাবে । তাঁর মনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য । আমার কথাটা মিলিয়ে নিস ।“ 
     পরের দিন মা ও মেয়ে দুইজনেই পশুপতি  ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে  ট্রেন ধরলো । কলকাতায় রাজ ভবনের প্রেস কর্ণার হলে ফলাফল ঘোষণা । মাননীয় রাজ্যপাল বিজেতাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন । পুরো অনুষ্ঠান টিভিতে লাইফ দেখানো হবে । তপা ও মা এবং অনুপম রাজভবনে গিয়ে আসন নিয়ে বসে পড়লো । অনুপমকে রাজভবনে ঢোকার গেটে সিকিউরিটি ধরেছিল । কিন্তু তপা অনুপমকে তার জেঠতুতো দাদা বানিয়ে কোনোরকমে ম্যানেজ করল । যার ফলে অনুপম  ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলো । 
   এবার নাম ঘোষণার পালা । 
    তপা ভীষণ টেনশনে আনচান । কোনো  পুরস্কার না পেলে আজ তার বাবার কাছে রক্ষে নেই । বাড়ি থেকে মা ও মেয়েকে তাড়িয়ে দেবে । পুরস্কারের ব্যাপারে তপা যেটা বুঝেছে সেটা হচ্ছে,  প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছাড়া আরও জেলা ভিত্তিক একটি করে পুরস্কার । জেলা ভিত্তিক দশ জনের পুরস্কার ।  পুরস্কারে নগদ ৫০,০০০/- টাকা এবং মানপত্র । প্রথম পুরস্কার ৫ লাখ, দ্বিতীয় পুরস্কার ৩ লাখ এবং তৃতীয় পুরস্কার ২ লাখ টাকা এবং সঙ্গে মানপত্র ।
     নাম ঘোষণার জন্য মঞ্চে উঠে এলেন মাননীয় ঘোষকঃ- 
       হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ । রাজ্যের মন্ত্রী ও উচ্চ পদাধীকারি আধিকারিকগণ  ।  নাম ঘোষণা করলেন ---- প্রথম,  পূর্বস্থলির তপতি বেরা । 
       তারপর হাততালি । প্রচুর হাততালি । ঘোষক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “তপতিকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি ।“ 
    মঞ্চে তপতির ওঠবার পর ঘোষক তাঁর হাতের মাইকটি তপতির হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি  শ্রোতাদের  উদ্দেশে কিছু বলো ।“ 
    এদিকে ভাওয়াল মাস্টার পশুপতিকে আবার খবর দিয়ে বলল, “টিভিতে তোমার মেয়েকে দেখাচ্ছে । এখন টিভি খুললেই তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে ।“  
   সঙ্গে সঙ্গে পাশের দোকানে টিভির সম্মুখে এসে পশুপতি অবাক ! তাঁর মেয়ে প্রেস, মিডিয়া্‌ ও  অনেক শ্রোতামণ্ডলির সামনে নির্দ্বিধায় বলছে, “নৃত্য শিক্ষায় আমার অনুপ্রেরণা আমার মা ।  মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতে আমার নৃত্য শিক্ষার বাস্তবায়ন ।“  
    পশুপতির চোখ ছলছল । সে আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলো,  ফিরে এলে মেয়েকে  আর বকবে না । মেয়ে যেটা চায় সেটাই করবে । মেয়ের ক্যারিয়ারে   কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না । সে এখন পরিষ্কার বুঝেছে, “যার যেদিকে ঝোঁক তাকে সেদিকেই এগিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় ।“  রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো পশুপতি । 
                                           ( ৪ ) 
     তারপর স্কুল, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সকলে তপার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।  নাচের প্রতিযোগিতায় তপা রাজ্যে প্রথম হওয়ায় সকলেই গর্বিত । 
   পশুপতি কাচুমাচু হয়ে মেয়ের কাছে নত হয়ে  ছলছল চোখে  বলল, “মা আমাকে ক্ষমা করিস্‌ ।“  
   তপা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর দুজনের চোখে আনন্দাশ্রু ।
             ---------০---------
Share This