Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

নারী নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মুক্তা সালভে ::: সৌরভকুমার ভূঞ্যা।।।

অনেক বিশ্বাস মতে ঈশ্বর স্রষ্টা। তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। সেই হিসেবে নারী পুরুষ উভয়ে তার সৃষ্টি। তাই যদি সত্য হয় তাহলে নারী পুরুষ উভয়ে সমান। সমান অধিকার তাদের প্রাপ্য। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে রয়েছে নারী বঞ্চনার ইতিহাস। “সমাজে পুরুষেরা কেন নারীদের দুর্বল ভাবে? কেন তাদের সমান অধিকার দেয় না?” আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে নিজের লেখা বই “স্ত্রী-পুরুষ তুলনা”-তে এমন জোরালো প্রশ্ন রেখেছিলেন নারী নবজাগরনের অন্যতম পথিকৃৎ তারাবাই সিন্ধে। মনে করা হয় তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি নারীবাদী বই লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “যে পুরুষ নারীদের শিক্ষার আলো দিতে পারে না, তাদের অধিকার দিতে পারে না, বিধবাদের দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে পারে না, সে পুরুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ কিংবা বলবান ভাবে কী করে?” গোটা বই জুড়ে এভাবে শানিত কলমে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। এককথায় তার প্রতিবাদ ছিল পুরুষদের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।

তারাবাই সিন্ধের মতো এরকমই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আরও এক নারী। তবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন একটা সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আরও পরিস্কার করে বললে, একজন দলিত নারী হয়েও বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “যদি বেদ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের হয় (এমনটা দাবি করত ব্রাহ্মণেরা), তাহলে আমরা বেদ অনুসারে চলতে বাধ্য নই।” ব্রাহ্মণরা বলতেন শুদ্রদের বেদ পড়া দূরে থাক, বেদের দিকে তাকানোটাও ছিল পাপ। সে কথা উল্লেখ করে মুক্তা বলেছিলেন, “বেদ-এর দিকে তাকালেই যদি আমাদের পাপ হয়, তাহলে বেদ-এর নীতি নিয়ম মান্য করা আমাদের বোকামি নয় কি?” ব্রাহ্মণ আধিপত্য সমাজ ব্যবস্থার দিকে এরকম কঠোর প্রশ্ন ছুঁরে দিয়েছিলেন সতেরো বছরের দলিত কিশোরী মুক্তা সালভে। মনে করা হয়ে থাকে তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা দলিত লেখিকা। মহারাষ্ট্রের খ্যাতনামা বিপ্লবী ক্রান্তিবীর লাহুজির নাতনি তিনি।

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। মহারাষ্ট্রে তখন পেশোয়ার শাসন। জাতপাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায়, সমাজের মাথা ছিলেন বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা। আর সবচেয়ে নিচে ছিল শূদ্র। মুক্তা সালভে ছিলে মাং সম্প্রদায়ের মহিলা। মাং এবং মাহার সম্প্রদায় ছিল দলিত (শূদ্র)। সমাজে দলিতদের স্থান ছিল অবর্ণনীয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্মাচরণ প্রভৃতি কোনোকিছুর অধিকার ছিল না তাদের। মন্দির, স্কুল প্রভৃতির দরজা ছিল তাদের জন্য বন্ধ। তারা ছিল অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ। তাদের স্পর্শ দূরে থাক, উচ্চ বর্ণের লোকেরা তাদের ছায়াও মাড়াত না একসময়। ব্রাহ্মণরা তাদের মানুষ বলে গন্য করত না। গরু-মহিষের থেকেও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। নির্ধারিত কয়েকটি নিম্ন পেশা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার অধিকার ছিল না তাদের। ফলে দারিদ্র্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। এককথায়, নিদারুন অপমান আর বঞ্চনার জীবন কাটাতে বাধ্য হত তারা। কেউ পড়াশোনা করতে চাইলে তার জীবনে নেমে আসত চরম বিপর্যয়। সামান্য সামান্য অপরাধে (হয়তো তা সে অর্থে অপরাধও নয়)তাদের চরম শাস্তি দেওয়া হত। অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ হয়ে অপমান আর অবমাননার জীবন কাটাতে বাধ্য হত তারা। একটা দীর্ঘ সময় অন্ধকারে ডুবেছিল তাদের জীবন। এই অন্ধকারের প্রধান কারণ ছিল শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকা।

দলিতদের নিয়ে যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহাত্মা জ্যোতিবারাও ফুলে এবং বি-আর আম্বেদকর। সমাজ সংস্কারক জ্যোতিবারাও বুঝেছিলেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে না পারলে দলিতদের এই অবস্থার উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। বিশেষত তিনি জোর দিয়েছিলেন নারীশিক্ষার ওপর। নিজের স্ত্রী সাবিত্রীবাই ফুলেকে তিনি পড়াশোনা করিয়েছিলেন। স্বামীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় সাবিত্রীবাই কেবল নিজে শিক্ষিত হননি, নারী সমাজকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করেছিলেন। সাবিত্রীবাই হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা শিক্ষক। শুধু তাই নয় প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে তিনি কোনো স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন।

সকল সম্প্রদায়ের মহিলাদের শিক্ষিত করার জন্য ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি জ্যোতিবারাও এবং সাবিত্রীবাই একটি স্কুল স্থাপন করেন। মাত্র ৮ জন মহিলা নিয়ে এই স্কুল শুরু হয়। এই ৮ জন মহিলার মধ্যে ১৪ বছরের মুক্তা সালভে ছিলেন একজন। এখানে তিনি তিন বছর পড়াশোনা করেছেন। বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুক্তা জানতে পেরেছিলেন দলিত মানুষদের পূর্বেকার অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা। নিজের সময়েও তিনি দেখেছেন দলিতদের বঞ্চনা, অপমান। শিক্ষার আলো তার চোখ খুলে দেয়। মনের অন্ধকার দূর করে। তাকে সাহসী করে তোলে। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস যেখানে মানুষের ছিল না, সেখানে সতেরো বছরের কিশোরী মুক্তা সালভে একেবারে কলম তুলে নেন লিখে ফেলেন একটি প্রবন্ধ, “Mang Maharanchya Dukhavisatha (About the Grief of Mahar and Mangs)” ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ‘Dnyanodaya’ নামক পাক্ষিক পত্রিকায় দুই কিস্তিতে এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হয় ১ মার্চ সংখ্যায়।

পুরো প্রবন্ধে তিনি জোরালো প্রতিবাদ করেছেন সমাজের জাত-পাত, ধর্ম বিভাজন নিয়ে। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ তোলেন। তাদের জমি দখল করে ব্রাহ্মণরা নিজেদের বসতি স্থাপন করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে, এমন জোরালো অভিযোগ জানান। ধর্মের নিষ্ঠুরতা নিয়ে ঈশ্বরের কাছে আবেদন করেছেন, “হে ভগবান, দয়া করে বল আমাদের ধর্ম কী। হে ভগবান, আমাকে তোমার সত্যকার ধর্ম শেখাও। যাতে করে সেই মতো আমরা চলতে পারি।”

ধর্ম বলতে তিনি সেই ধর্মের কথা বলেছেন যা সংকীর্ণতা মুক্ত। যেখানে সমানাধিকার থাকবে। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ” এমন ধর্ম, যেখানে এক ব্যক্তি সুবিধা পায়, অন্যরা বঞ্চিত হয়, তাকে এই পৃথিবী থেকে লুপ্ত করে দাও। এমন ধর্ম যেন আমাদের মধ্যে আর কখনও প্রবেশ করতে না পারে।”

এ-কথা বলা কতখানি দুঃসাহসিক, কতখানি স্পর্ধার তা সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কল্পনা করলে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারি, কতখানি দুঃসাহস ছিল তার মধ্যে। একটি দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত চরম শক্তিধর সমাজ ব্যবস্থার বুকে তিনি ঘা মেরেছিলেন। সেটা পেরেছিলেন, কেননা শিক্ষার আলো তিনি পেয়েছিলেন। এটাও বুঝেছিলেন শুধু তিনি বললে হবে না। বাকিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্য চাই শিক্ষার আলো। তাই তিনি তার প্রবন্ধের শেষে বলেছেন, “ওহে মাং ও মাহাররা, তোমরা গরিব, অসুস্থ। কেবল জ্ঞানের ঔষধই পারে তোমাদের সারিয়ে তুলতে। শিক্ষাই পারে তোমাদের কুসংস্কারের জঘন্য বিশ্বাস থেকে দূরে সরাতে। শিক্ষা তোমাদের ন্যায় পরায়ণ ও নীতিবান করে তুলবে তোমাদের ওপর যে অত্যাচার তা রোধ করতে পারবে। যে সব লোকেরা তোমাদের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করে, তা করতে আর তারা সাহস পাবে না।”

শিক্ষার শক্তি কতখানি তা তিনি তার তিন বছরের শিক্ষাজীবনে অনুভব করতে পেরেছিলেন। কিন্তু গতানুগতিক ধারার প্রভাবে দলিত সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের শিক্ষার প্রতি তেমন উৎসাহ ছিল না। শিক্ষা যে তাদের প্রয়োজন, এটা তারা অনুভব করতে পারত না। তাদের সেই ঘুম থেকে জাগাতে চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, “পড়াশোনা কর। কঠোর পরিশ্রম কর। শিক্ষিত হও এবং একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠো।”

মুক্তা সালভের আর কোনো লেখার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই একটিমাত্র লেখার মাধ্যমে তিনি নিজেকে একটি আলাদা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারীমুক্তি তথা দলিত সমাজের অধিকারের দাবিতে তার এই লেখা এক শানিত হাতিয়ার। একটি সমাজ ব্যবস্থাকে একটু হলেও তিনি ধাক্কা দিতে পেরেছিলেন।

বর্তমান সময়ে আমাদের আলোচনায় উঠে আসে বহু উজ্জ্বল নারীদের নাম। মুক্তা সালভের মতো মহিলারা হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অন্তরালে। কিন্তু, সলতে পাকানোর কাজটা তারা করেছিলেন। নারী নবজাগরণে এদের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এদেরকে বেশি বেশি করে স্মরণ করা অবশ্যই প্রয়োজন।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *