Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, ষষ্ঠদশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

কঙ্কাবতী কিছুতেই বুঝতে পারছে না, এত তাড়াতাড়ি কী করে রসুলপুরের মেয়ে লতাকে ঘোতন পছন্দ করলো ! খবরাখবর নিয়ে কঙ্কাবতী জানতে পেরেছে লতা খুব ডানপিটে । আরও জানতে পেরেছে, মাসীর বাড়িতে থেকে সালার কলেজে লতার পড়াশুনা । ব্রজেশ্বরবাবু মেয়ের চালচলনের ঠাটবাট দেখে কোনো ঝুঁকি নেননি । তাই লতাকে মাসী বাড়ি রেখে পড়ানো । সালার কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার ডিগ্রি করার লতার খুব ইচ্ছা ছিল । কিন্তু বাড়ি থেকে সেভাবে সাড়া পায়নি । তাই তার উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা থেমে গেছে । লতা মেয়ে হিসাবে ঘোতনের উপযুক্ত । কিন্তু কঙ্কাবতীর খটকা অন্য জায়গায় । নাদনঘাট থেকে ভাল একটা সম্বন্ধ এসেছিল । সেই মেয়েটা যেমন শিক্ষিত, তেমনি মার্জিত । মেয়ের বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক । ভদ্র পরিবার । মেয়েটি ফর্সা না হলেও তাকে পুরোপুরি শ্যামলা বলা যাবে না । কঙ্কাবতী যতটুকু জেনেছিল, মেয়েটির স্বভাব-চরিত্র যেমন ভাল তেমনি মেয়েটি কর্মঠ । পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ শিখত । মেয়েটির প্রতি কঙ্কাবতীর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল । কিন্তু ঘোতন এককথায় নাকচ করে দিয়ে বলেছিল, “মেয়েটি কালো ।“ অথচ মেয়েটির বাবা নাদনঘাটের বিশিষ্ট মানুষ । সেখানকার মানুষ তাঁকে সমীহ করে চলে । কঙ্কাবতীর দৃষ্টিতে লতার চেয়ে নাদনঘাটের মেয়েটি ঘোতনের জীবনসঙ্গিনী হিসাবে বেশী উপযুক্ত ।
যাই হোক ঘোতনের ইচ্ছা অনুসারে লতার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হলো । কিন্তু গোঁ ধরলো ঘোতন । তার ইচ্ছা, দোকানটা আরও সাজিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে । অন্যদিকে বিয়ে দেরীতে হোক, লতা তার ঘোরতর বিরোধী । তাই ঘোতনের মতলব জানার পর লতা সরাসরি ঘোতনের দোকানে এসে হাজির । বর্ধমানের রসুলপুর থেকে মিঁয়া স্টেশন পৌঁছানো ভীষণ ঝকমারী । তবুও বর্ধমান, কাটোয়া হয়ে দুপুরের আগে সোজা ঘোতনের দোকানে । লতাকে দেখে ঘোতন অবাক ! কৌতুহলি দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ লতার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
ফ্যালফ্যাল করে তাকানো দেখে লতার ঝটিকা প্রশ্ন, “আপনি জীবনে কোনোদিন মেয়ে দেখেননি ? ঐভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন ? অনেক দূর থেকে এসেছি । কোথায় আমাকে বসতে বলবেন কিংবা খাবার এনে খাওয়াবেন, সেসব না করে হাঁদার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন !”
প্রশ্নের জেরবারে থতোমতো খেয়ে ঘোতন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! ভ্যাবাচেকা খেয়ে তড়িঘড়ি করে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “বসুন ম্যাডাম ।“
উঁহু, ম্যাডাম নয় । আমি আপনার বৌ হতে যাচ্ছি, সুতরাং শুধুমাত্র লতা । তবে শুনুন, আমি বসতে আসিনি ?
“তবে ?” প্রশ্ন করেই আবার লতার দিকে হাবলার মতো তাকিয়ে রইলো ।
এবার কিছুটা ধমকের শুরে লতা ঘোতনকে বলল, “মশাই, আর তাকাতে হবে না । কিছুদিনের মধ্যে আপনার সঙ্গে ঘর বাঁধতে স্থায়ীভাবে আসছি । কিন্তু …?”
আবার কিন্তু কেন ?
আমাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসাটা দেরী করলে চলবে না । পুজোর পরে অগ্রহায়ণ মাসেই আমাদের বিয়ে হবে এবং সেটা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহেই । আমি পঞ্জিকা দেখে এসেছি । ৪ঠা অগ্রহায়ণ বুধবার, বিয়ের ভাল দিন । ঐদিন আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে বলুন । অন্যথা হলে, আমার দিকে ফ্যালফ্যাল তাকানোর আর সুযোগ পাবেন না । কথাটা মনে রাখবেন । তারপর দোকান ঘরের দিকে তাকিয়ে লতা বলল, “ঘরটা এত নোংরা কেন ? একটু গায়ে-গতরে খেটে পরিষ্কার রাখতে পারেন তো ?”
কী যেনো বলতে যাচ্ছিলো ঘোতন । তাকে থামিয়ে দিয়ে লতা বলল, “আমার দরকারি কথা বলা শেষ ! এবার আমি বাড়ি চললাম ।“
ঘোতন এতক্ষণ লতার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তার চোখা-চোখা কথাগুলি শুনছিলো আর ভাবছিলো মেয়ে তো নয়, পুরোমাত্রায় থানার দারোগা ! রাখঢাক নেই । সোজাসাপ্টা কথা সোজাসাপ্টাভাবে বলার অভ্যাস । সুতরাং এই মেয়ে নিয়ে তার কপালে কী আছে, কে জানে ? ঘোতনের মতো ঠাটবাট ছেলেকেও ঘোল খাওয়াতে লতা একাই একশ ! তারপর লতার মুখে চলে যাওয়ার কথা শুনে ঘোতন আরও ঘাবড়ে গেলো । কী মেয়েরে বাবা ! রসুলপুর থেকে বয়স্থা মেয়ে একা সোজা মিঁয়া স্টেশন পৌঁছানো, প্রচণ্ড ধকলের ব্যাপার । তার উপর দিনের দিন ফিরে যাওয়ার চিন্তা ! অতোটা পথ ফিরে যাওয়া খুবই কষ্টকর । যাতায়াতের ঝক্কি-ঝামেলা ভীষণ সাংঘাতিক ! লতার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ঘোতন এবার বেঁকে বসলো এবং বলল, “বাড়ি ফিরে যাওয়া হবে না । আজ এখানে থাকতে হবে । তার আগে আপনার খাওয়া-দাওয়া ।“
বিরবির করে লতা বলল, “ক্যাবলাকান্তের মুখে বোল ফুঁটেছে ।“
কী বলছেন বিরবির করে ?
বলছি, থাকার জন্য আসিনি । আর থাকলে লোকে আপনাকে দুষবে এবং বলবে, “বিয়ের আগে মেয়েটাকে বাড়ি ডেকে এনে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করছেন ! তাতে আপনার সম্মানহানি ঘটবে । সুতরাং মশাই, এবার আমার বাড়ি ফেরার পালা !”
উঁহু আপনাকে আমি একা ছাড়ছি না ।
তাহলে কী আপনি আমার সঙ্গে যাবেন ?
দরকার হলে যাবো ।
রসুলপুর, অনেক দূর । কথাটা ভেবে বলছেন তো ?
ঘোতন পড়েছে ফ্যাসাদে । অতো সাতপাঁচ ভেবে কথাটা বলেনি । এখন সত্যিই যেতে হলে রাতে বাড়ি ফেরা অসম্ভব । তবুও ঢোক গিলে বলল, “ম্যাডাম, আমি আপনার সঙ্গে যাবো ।“
বেশ ! রেডি হয়ে নিন ।
মিঁয়া স্টেশন থেকে তিনটে কুড়ির ট্রেন ধরে প্রথমে কাটোয়া । সেখানে নেমে বর্ধমানের বাস ধরার আগে বাস স্ট্যান্ডে দুজনে দুটো কেক্‌ কিনে গরম চা খেলো । বর্ধমান থেকে সন্ধ্যা ৭টায় বাস পেলো । বর্ধমান – বিষ্ণুপুর বাস । সোনামুখী হয়ে যাচ্ছে । সেই বাসে রসুলপুর ।
ঘোতন বাড়ি ফিরতে চাইলে লতা নাছোড়বান্দা, তার বাড়ি ফেরা হবে না । এতক্ষণ দুজনে খুব কাছাকাছি একসঙ্গে সফর করার জন্য তাদের কথাবার্তায় “আপনি” উঠে গিয়ে এখন শুধু “তুমি” । তাই একরকম জোর দিয়ে লতা বলল,”তোমাকে আমি ছাড়ছি না । ভয় নেই, আমরা এক ঘরের ভিতর শুয়ে তার কাটাবো না । তার গ্যারান্টি থাকলো ।“
অগত্যা ঘোতন লতাদের বাড়ি থাকার সিদ্ধান্ত নিলো ।
রাত্রিবেলায় খাওয়া-দাওয়ার এলাহি আয়োজন ! দেশী চিকেন, পুকুরের কাতলা মাছ ! রসুলপুরের বাস স্ট্যান্ডের ঘনাদার মিষ্টির দোকানের গরম গরম রসগোল্লা । আরও কতো কী !
তারপর…………?
তারপর পরেরদিন ভোরবেলায় পূর্ব আকাশে কেবল সূর্য উঠেছে । ঘোতন বাড়ি ফেরার জন্য জামা-কাপড় পরে রেডি । ঘোতনকে জামা-কাপড় পরা অবস্থায় দেখে ব্রজেশ্বরবাবু বললেন, “রেডি হলে চলবে না বাবা । দুটো ভাত খেয়ে রওনা দেবে ! কেননা অনেকটা পথ । বাড়ি ফিরতে বেলা গড়িয়ে যেতে পারে ।“ ব্রজেশ্বরবাবুর কথা শেষ হতেই কোথা থেকে লতা ছুটে এসে একেবারে ঘোতনের সামনে । হাঁপিয়ে গেছে বেচারা ! হাতে ছোট একটা পুটুলি । তার মধ্যে গোটা পাঁচ-ছয় কাঁচা পেয়ারা । দুটো পেয়ারা ঘোতনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আজ তোমার বাড়ি যাওয়া বন্ধ । আমি চা বানিয়ে আনছি । চুপচাপ চা খাও । তারপর বাজারে যাওয়া । বাজার থেকে ফিরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে তোমাকে শক্তিগড়ের ল্যাংচা খাওয়াতে নিয়ে যাবো । তারপর দুপুরের খাওয়ার পর কালী মন্দির । সেখানে গ্রামীন মেলা বসেছে । মেলায় তোমার সঙ্গে নাগরদোলায় উঠবো । আপাতত এই কয়েকটা প্রোগ্রাম । সুতরাং বাড়ি ফেরার একদম নাম করা চলবে না । তারপর ঘোতনকে লতা হাত ধরে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসিয়ে বলল, “এখানে চুপচাপ বসো । আমি এক্ষণি চা বানিয়ে আনছি ।“ ইত্যবসরে লতার মা দুটো প্লেটে দু-কাপ চা এনে হাজির ।
চা খাওয়ার পর লতা বাবাকে বলল, “আজ তোমাকে বাজারে যেতে হবে না । আমি বাজারে যাবো ।“ বাবাকে কথাটা বলেই ঘর থেকে বাজারের ব্যাগ এনে ঘোতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার দয়া করে আমার সঙ্গে বাজারে চলো ।“
বাজারটা লতাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে । লতার বাবা ব্রজেশ্বরবাবু সাধারণত সাইকেলে বাজারে যান । লতার একটা লেডিস্‌ সাইকেল রয়েছে । তা সত্ত্বেও লতা ঠিক করলো, “পায়ে হেঁটে বাজারে যাবে । তাতে ঘোতনের সাথে অনেক কথা বলা যাবে ।“
রাস্তায় রতন কাকার সাথে দেখা । রতন কাকা জিজ্ঞাসা করলে, “হনহন করে কোথায় চললি লতা ?”
বাজারে যাচ্ছি ।
কেন, তোর বাবা কোথায় গেলো ?
বাবার শরীরটা ভাল না । তাই আমি বাজারে যাচ্ছি ।
তোর সঙ্গের ছেলেটিকে তো চিনতে পারলাম না !
ইনি আমাদের বাড়ির কুটুম ।
কেমন কুটুম ? ইতিপূর্বে তাকে কখনও তো দেখিনি !
আমার বান্ধবীর দাদা । কাকা, আমার তাড়া আছে । আমি বাজারে চল্লুম ।
এক ঝলক মুচকী হাসি দিয়ে রতন কাকা লতাকে বললেন, “ছেলেটির সাথে তোর ভীষণ মানিয়েছে ।“
লতা রতন কাকার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বাজারে ।
হঠাৎ রাস্তার বা-পাশের অর্জুন গাছ তলা থেকে প্রথমে একটা শিস দেওয়ার আওয়াজ । ঘোতন তাকিয়ে দেখে গাছের নীচে কতকগুলি ছেলের জটলা । ছেলেগুলোর চেহারার ধরন দেখে ঘোতন বুঝতে পারলো, উটকো ছেলে-পেলেদের জটলা । তারা আড্ডায় মত্ত । তারপর জটলার মধ্যে থেকে একজন উটকো ছেলে সম্ভবত তাদের মধ্যের অন্যজনকে চিৎকার করে লতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, চেয়ে দ্যাখ । তোর ভালবাসার লতার সাথে অন্য আর একজন নাগর ঘুরছে !”
ঘোতন দাঁড়িয়ে পড়লো । ঘোতনের শারীরিক কায়দা দেখে লতা ঘাবড়ে গিয়ে কোনোকিছু না ভেবে ঘোতনের হাত টেনে ধরে আরও জোরে হাঁটতে লাগল । বাজারে ঢুকে প্রথমে মাছ বাজারে ঢুকলো । সোনালী রঙের লোকাল ট্যাংরা মাছ । দামটা একটু বেশী । তারপর বড় সাইজের বোয়াল মাছ । মাটন কিনতে ঘোতন বারণ করেছিল । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! লতা বেশ খানিকটা মাটন কিনলো । তারপর সবজির বাজার । আলু, পিঁয়াজ, আদা, রসুন, কাঁচা লঙ্কা, টমেটো, পটল, গরমমশলা, ইত্যাদি কিনে এবার রিক্সায় উঠলো । লতার ভয়, গাছ তলার ছেলেগুলি আবার বিরক্ত করলে ঘোতনকে সামলানো দায় হয়ে দাঁড়াবে !
রিক্সা মৃদুমন্দ গতিতে এগোচ্ছে । অর্জুন গাছের কাছাকাছি আসা মাত্র লতা লক্ষ্য করলো, সবগুলি উটকো ছেলে লাঠি নিয়ে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়েছে । লতা পরিষ্কার বুঝতে পারলো ছেলেগুলির ধান্দা খারাপ ! মারপিট করার ধান্দা !
হঠাৎ উটকো ছেলেগুলির মধ্যে পল্লবকে দেখে ঘোতনের চোখ ছানাবড়া ! নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, ঘাটের মরাটা এখানে কেন ? তারপর কোনোকিছু বোঝবার আগেই উটকো ছেলেগুলি ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ……?
 (চলবে)

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *