Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ভারতে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বিভিন্ন ধরনের আগ্রাসী নীতির (ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার) সংক্ষিপ্ত পরিচয়।।।

সূচনাঃ-
ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যে শুধুই ভারতীয় সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ধ্বংস করে নিজেদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরী করেছিল তাহা নয়, তাহাকে যথেষ্ঠ স্ফীত ও উর্বর করে তুলেছিল। এদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এদেশের কৃষক সম্প্রদায়কে নানান আর্থিক বোঝা বহন করতে হয়েছিল। ইংরেজদের ব্যবসাপত্র চালু রাখা ও মুনাফা লাভের জন্য এবং কম্পানীর প্রসারের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। আর সেই সময় অর্থের আগমনের প্রধান সূত্র ছিল ভূমি রাজস্ব। ফলে ইংরেজ ঐ পথেই অতিরিক্ত অর্থ উপায়ের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও আরো কিছু নীতি প্রনয়ণের মাধ্যমে তারা তাদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করেছিল।
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিঃ- .
তৎকালীন ভারতীয় নৃপতিগণ পরস্পরের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন।

লর্ড ওয়েলেসলী এই সুযোগের সদব্যবহার করার জন্য সত্ব বিলোপনীতি চালু করেন। এই নীতির শর্ত ছিল সকল দেশীয় নৃপতি এই নীতিতে স্বাক্ষর করবে। কোম্পানী বহিঃশত্রুর আক্রমন হতে এদেরকে রক্ষা করবে বিনিময়ে রাজ্যের কিছু অংশ কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে হবে। এই নীতিতে স্বাক্ষরকারী নৃপতিগণ কখনও ইংরেজ অনুমতি ব্যাতীত পরস্পরের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারবেনা। এই নীতিতে যাঁরা স্বাক্ষর করতেন তাঁরা নিজেদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে হারাতেন। উল্টোদিকে ইংরেজরা দেশীয় নৃপতিদের অর্থে নিজেদের সামরিক বাহিনীর ব্যয় নির্বাহ করতেন।
দেওয়ানী লাভঃ-
১৭৬৫ খ্রীঃ লর্ড ক্লাইভ বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা দেবার বিনিময়ে বাংলা বিহার ও উড়িস্যার দেওয়ানী লাভ করে। এই দেওয়ানী ইংরেজদের কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এই দেওয়ানী লাভের ফলে বাংলার ক্ষমতা কার্যত ইংরেজদের হাতে চলে যায়। নবাব কেবলমাত্র নামেই নবাব ছিলেন। তাঁর হাতে আর প্রকৃত কোন ক্ষমতা থাকল না। ফলে । ফলে বাংলার পরবর্তী কোন নবাবই আর ইংরেজদের অবাধ্য হইবার সাহস পেলনা। নবাবের কর্মচারীগণ কোম্পানী কতৃক নির্বাচিত হইতেন এবং কোম্পানির নির্দেশেই কাজ করিতেন। ফলে ভারতবর্ষের বুকে নবাবের ক্ষমতার হ্রাস হয়ে ইংরেজদের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ বণিকরাও ক্রমে বণিকের মানদণ্ড ছেড়ে রাজদণ্ড হাতে নিতে শুরু করে।
দ্বৈতশাসনের অবসানঃ-
দ্বৈতশাসনের নীতি অনুসারে রাজ্যের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ছিল ইংরেজদের হাতে, আর প্রশাসনের ভার রইল নবাবের উপর। এর ফল হল মারাত্মক। কোম্পানী বা নবাব কেউই আর প্রজামঙ্গলের কথা না ভেবে দুর্নীতি ও অত্যাচারে রাজত্ব চালাতে লাগল। এর ফলে প্রজাদের জীবনে নেমে এল চরম দুরাবস্থা। ক্রমে ক্রমে ক্লাইভের ‘দ্বৈতশাসনের’ কুফল কোম্পানীর উপর পড়ায় হেস্টিংস এই শাসন ব্যবস্থা বাতিল করে কোম্পানীর হাতে রাজস্ব আদায়ের ভার অর্পণ করলেন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তঃ-
কর্ণ ওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেন। প্রথমে কোম্পানী পাঁচ বছরের জন্য, পরে এক বছরের জন্য জমি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থায় জমিদাররা উৎসাহ প্রকাশ না করায় কর্ণ ওয়ালিশ প্রথমে দশ বছরের জন্য জমি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থার ফলে জমিদার ও রাজস্ব সংগ্রাহকরা বংশানুক্রমিক ভাবে জমির মালিক হতে থাকে। আর কৃষকরা কেবলমাত্র খাজনাদানকারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। জমিদাররা কোম্পানীকে যে রাজস্ব দেবে তা চিরকালের জন্য বেঁধে দেওয়া হয়, কিন্তু কৃষকরা জমিদারদের কী পরিমাণ রাজস্ব দেবে তা বেঁধে না দেওয়ায় জমিদাররাই কৃষকদের উপর অত্যাচারী হয়ে ওঠে। এই বন্দোবস্তে কৃষকদের অস্তিত্ব রক্ষার কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আবার সূর্যাস্ত আইন অনুসারে অনেক জমিদার সূর্যাস্তের আগে খাজনা না দিতে পারায় সর্বসান্ত হয়েছেন। তাছাড়া এই রাজস্ব ব্যবস্থায় জমির মূল্য বহুগুণ বেড়ে গেলেও রাজস্বের পরিমান স্থির থাকায় কোম্পানীর আয় সিমীত হয়ে পড়ে। তাই ইংরেজরা এই বন্দোবস্ত পরে তুলে দিতে বাধ্য হন। এর চুড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে বলা হয়-জমিদার, রাজা এই তিনের মধ্যে- Permanent settlement “amerio the of the first, somewhat postpond the claims of the second and sacrificed the interest of the third”.
উপসংহারঃ-
ডালহৌসী সত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে অরাজকতার অজুহাত দেখিয়ে এদেশীয় অনেক রাজ্যকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। আবার অনেক রাজা বা জমিদার মারা গেলে তাদের পুত্র বা উত্তরাধিকারী না থাকলে তাদের সাম্রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। এই নানা ধরনের নিত্যনূতন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে ইংরেজরা ভারতবাসীকে শোষন করে নিজেদের সাম্রাজ্যকে সু-প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *