Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ।।।

সূচনা :-
বাঙালী জাতির জাতীয় সংহতি জাতীয়তাবাদকে আঘাত করার জন্য লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এটি প্রকাশিত হলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “বেঙ্গলী পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গের কুফল সম্পর্কে একে “একটি গভীর জাতীয় বিষাদ” বলে ব্যাখ্যা করে জাতিকে সজাগ করেন। তিনি লেখেন যে “আমরা অপমানিত, লাঞ্ছিত ও প্রতারিত হয়েছি …… এখনও সরকার যদি বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে মত না বদলান তবে স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন পথে মোড় নেবে। সারা ভারতে আগুন জ্বলবে।”
আন্দোলনের পর্যায় :-
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন দুটি পর্যায়ে ঘটে ছিল। প্রথমে সভা, সমিতি, আবেদনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পথে প্রতিবাদ জ্ঞাপন।

দ্বিতীয় পর্যায়ে বয়কট স্বদেশী আইনভঙ্গ এবং সর্বশেষে সহিংস প্রতিবাদ। বঙ্গভঙ্গ বাঙালী তথা ভারতীয়দের কাছে ছিল এক জতীয় অপমান। তাই এর বিরুদ্ধে উপরোক্ত পর্যায়ে আন্দোলন চালানোর মাধ্যমে সমগ্র ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
বয়কট আন্দোলন:-
১৯০৫ খ্রীঃ এর ১লা জুলাই ‘সুঞ্জীবণী’ পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র দেশোবাসীকে ব্রিটিশ পন্য বয়কট স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারে আহ্বান জানান। তাঁর এই প্রস্তাব বাংলাদেশের সর্বত্র সমর্থন লাভ করেন। এরপর বাঙলার সকল স্থানে বয়কট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিলাতি কাপড়, লবন, চিনি, সিগারেট, কাচের চুড়ি প্রভৃতি সকল দ্রব্য বয়কট করা হয়। বিলাতী জিনিসের দোকানের সামনে ছাত্ররা পিকেটিং করে ক্রেতাদের নিরস্ত্র করতে থাকেন। বয়কট আন্দোলন ভারতবসীদের মধ্যে এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করে যে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরাও বিলাতি চিনির দ্বারা প্রস্তুত মিষ্টানও ঠাকুরকে দিতে অস্বীকার করে। ধোপারা বিলিতি কাপড় কাচতে অস্বীকার করে। নারীরা মিহি বিলাতি কাপড় ছেড়ে মোটা তাঁতের কাপড় ব্যবহার করেন এবং বিলাতী চুড়ি পড়া বর্জন করেন। ছাত্ররা ইংরেজদের স্কুল কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে আসে, উকিল ব্যারিষ্টাররা ইংরেজদের অফিস আদালত বয়কট করেন।
রাখীবন্ধন ও অরন্ধন :-
বঙ্গভঙ্গ কার্যকলাপের দিন অর্থাৎ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর দিনটি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘রাখী বন্ধন দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। সূর্যোদয়ের পূর্বে হাজার হাজার মানুষ গঙ্গাস্নান করে মুখে বন্দেমাতরম ধ্বনি তুলে হিন্দু –মুসলমান নির্বিশেষে পরস্পর এর হাতে রাখী বেঁধে দেন।  এছাড়া রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর প্রস্তাব অনুযায়ী ঐ দিনটি আবার ‘অরন্ধন দিবস’ হিসাবেও পালিত হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের এক অংশ, এই আন্দোলনকে সমর্থন না করলেও এই আন্দোলন ব্যর্থ হয় নি।
স্বদেশী আন্দোলন :-
বঙ্গভঙ্গ বরোধী এই আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে দ্বদেশী আন্দোলনে পরিনত হয়। কেনপ্না মানুষ বুঝতে পারে শুধুমাত্র বয়কট আন্দোলনে কাজ চলবে না। কারণ বয়কট আন্দোলনের ফলে বাজারে মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দেখা দেবে। আর সে সময় পরিষধরক হিসাবে কোন কিছু না পেলে এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাবে। ফলে স্বদেশী মোটা কাপড়, চিনি, গুড়, ব্যবহার শুরু হয়। বিদেশী সিগারেট বর্জন করে মানুষ দেশীয় বিড়ি-সিগারেট ব্যবহার করতে শুরু করে জনসাধারণের স্বদেশী জিনিসের প্রতি আগ্রহ বাড়ায় স্বদেশী শিল্পের প্রসার ঘটে। দ্বদেশী ভাবধারার অনুপ্রেরণায় বহু কাপড়ের কল, ব্যাঞক, জীবনবিমা কোম্পানি , গেঞ্জি-মোজা, সাবান-চিনি, চামড়া, ঔষধ প্রভৃতির কারখানা গড়ে ওঠে। কুটির শিল্পেরও উন্নতি সাধন ঘটে।
জাতীয় ঐক্য  :-
লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ কায়েম করলে সমগ্র বাঙালী জাতি বেদনায় শিউরে ওঠে। এটা তাদের জীবনে এক জাতীয় অপমান এই অপমান ও বেদনা থেকে তাদের মনে জমা হয় ক্রোধ ও প্রতিজ্ঞা। তাই রাখী বন্ধন ও অরন্ধন এর মাধ্যমে সমগ্র হিন্দু –মুসলমান ঐক্য বদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলনের শপথ নেয়।
জাতীয় শিক্ষা-পরিষদ :-
স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব শিক্ষা ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ছিল ইংরাজী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে জাতীয় শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠা। সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ে ‘ডন সোস্যাইটি’ এই ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। এই সোস্যাইটির আহ্বানে ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে ৫ই নভেম্বর জনসভা ডাকা হয়। সেখানে সতীশচন্দ্র কলিকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ‘গোলদীঘির গোলাম খানা’ পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান। ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই আগস্ট ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গঠিত হয়। এই পরিষদ অনেক বিদ্যালয়ে স্থাপন করেছিল। যেখানে বৈজ্ঞানিক যান্ত্রিক ও মানবিক শিক্ষাকে জাতীয় অবধারায় পরিচালিত করা হত।
পুলিশী দমন নীতি :-
সরকার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন দমন করার জন্য প্রচণ্ড দমন নীতির আশ্রয় নেয়, কার্ললাইল সার্কুলার দ্বারা ছাত্রদের দমন করার ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বরিশালে প্রাদেশিক সম্মেলন ডাকা হলে পুলিশ প্রচণ্ড দমন নীতি ও গ্রেপ্তার দ্বারা সম্মেলন ভণ্ড করে।
উপসংহার :-
ক্রমশ স্বদেশী আন্দোলনের মূল আদর্শ গুলি ভারতের অন্যত্র বিস্তার লাভ করে এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের চাপে পড়ে ইংরেজ সরকার ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে বপঙ্গভঞগ রদ করতে বাধ্য হয়।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *