ভূমিকা
পিতা—একটি শব্দ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, স্নেহ ও কঠোর বাস্তবতার এক অনন্য মিশ্রণ। শিশুর জীবনে পিতার ভূমিকাকে কেবল আর্থিক দিক দিয়ে বিচার করলে তা হবে খুবই একপেশে। পিতার অবস্থান মায়ের মতো আবেগঘন না হলেও, তা জীবনের স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ গঠনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। এই অবদানের স্বীকৃতি দিতে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। এই দিনটি পিতৃস্নেহ, উৎসর্গ ও দায়িত্ববোধের এক অনন্য উদযাপন। এই প্রবন্ধে আমরা জানব বিশ্ব বাবা দিবস কবে, কেন, কীভাবে পালিত হয়, এর ইতিহাস, থিম ও এর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব।
বিশ্ব বাবা দিবস কবে পালিত হয়?
বিশ্ব বাবা দিবস প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পালন করা হয়।
২০২৫ সালে বাবা দিবস পড়েছে ১৫ জুন (রবিবার)।
এই দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হলেও, বিভিন্ন দেশে পালন করার তারিখ কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। যেমন:
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, বাংলাদেশ: জুনের তৃতীয় রবিবার
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড: সেপ্টেম্বরের প্রথম রবিবার
রাশিয়া: ২৩ ফেব্রুয়ারি (Defender of the Fatherland Day)
জার্মানি: খ্রিষ্টীয় ঈস্টারের ৪০ দিন পরে (Ascension Day)
২০২৫ সালের বাবা দিবসের থিম
২০২৫ সালের বাবা দিবসের থিম এখনো আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত হয়নি (শেষ তথ্য অনুযায়ী)। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতোই থিমের মূল বার্তা থাকে:
🔹 “Celebrating Fatherhood: Love, Responsibility, and Guidance”
(পিতৃত্ব উদযাপন: ভালোবাসা, দায়িত্ব এবং দিকনির্দেশনা)
থিমের মাধ্যমে সমাজে পিতার ভূমিকা, ত্যাগ ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো হয়।
বাবা দিবস পালনের ইতিহাস
আদি ধারণা
পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নতুন কিছু নয়। প্রাচীন কালে বাবাকে দেবতা, পথপ্রদর্শক বা অভিভাবক হিসেবে পূজিত হতো:
প্রাচীন ব্যাবিলনে, প্রায় ৪০০০ বছর আগে, একটি ছেলে তার বাবার জন্য প্রথম ‘Father’s Day Card’ বানিয়েছিল মাটির ফলকে।
প্রাচীন রোম ও গ্রিসেও পিতাকে পরিবার প্রধান হিসেবে সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হতো।
আধুনিক বাবা দিবসের সূচনা
সনোরা স্মার্ট ডড – এক কন্যার শ্রদ্ধা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের সনোরা স্মার্ট ডড (Sonora Smart Dodd) ছিলেন আধুনিক বাবা দিবস উদযাপনের মূল উদ্যোক্তা। তার বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট ছিলেন একজন যোদ্ধা যিনি মায়ের মৃত্যুর পর একাই ছয় সন্তানকে মানুষ করেছিলেন।
১৯০৯ সালে সনোরা একটি গির্জার মা দিবস পালনের অনুষ্ঠান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাবার সম্মানে একটি দিবস পালনের কথা ভাবেন। প্রথম বাবা দিবস পালিত হয় ১৯১০ সালের ১৯ জুন।
সরকারি স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক বিস্তার
১৯৬৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন প্রথম এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেন।
১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে জাতীয় বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন।
এরপর ধীরে ধীরে এটি বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হতে শুরু করে।
পিতার ভূমিকা: শুধু আর্থিক দাতা নন
সাম্প্রতিক যুগে পিতার ভূমিকা শুধু অর্থ উপার্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক বাবা:
শিশুর মানসিক বিকাশে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
সন্তানদের পড়াশোনা, খেলাধুলা, ও নৈতিক শিক্ষায় ভূমিকা রাখেন।
গৃহস্থালী কাজেও সহায়তা করেন।
সহানুভূতিশীল, সমর্থক ও প্রেরণাদায়ক ভূমিকায় থাকেন।
বিশ্ব বাবা দিবস এই নতুন পিতৃত্বের রূপকেও উদযাপন করে।
বাবা দিবস উদযাপন: বিশ্বজুড়ে নানা রীতি
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা
শিশুরা বাবাকে কার্ড, উপহার, ফুল দেন।
পরিবারে বিশেষ খাবার রান্না হয়।
ভারত ও বাংলাদেশ
বড় শহরগুলোতে দোকানে ‘ফাদার্স ডে’ গিফট বা ডিসকাউন্ট।
স্কুলগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
সামাজিক মাধ্যমে বাবা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ।
জাপান
শিশুরা সাধারণত হলুদ গোলাপফুল উপহার দেয়।
‘বাবা’কে শ্রদ্ধা জানাতে পারিবারিক ডিনার আয়োজন করা হয়।
জার্মানি
বাবা দিবস উদযাপিত হয় ঈস্টার পরবর্তী ৪০তম দিনে (Ascension Day)।
কিছু এলাকায় এটি ‘পুরুষ দিবস’ হিসেবেও পালিত হয়, যেখানে পুরুষেরা একত্রে বাইরে ঘুরতে যান।
বাবা দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব
১. পারিবারিক বন্ধন জোরদার করা
এই দিনটি পরিবারে আবেগময় সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং পিতাকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণভাবে স্মরণ করা যায়।
২. পিতৃত্বের সচেতনতা তৈরি
এই দিবস পিতাদেরকে আরও দায়িত্বশীল হতে উৎসাহিত করে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বাবাদের পিতৃত্বের প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে।
৩. সমাজে পিতার মর্যাদা বৃদ্ধি
বাবার অবদান অনেক সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়। এই দিনটি সেই ত্যাগ ও শ্রমের স্বীকৃতি দেয়।
৪. শিশুদের মূল্যবোধ শিক্ষা
শিশুরা যখন বাবাকে সম্মান জানায়, তখন তারা কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব ও পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব শিখে।
বাবা দিবস নিয়ে কিছু জনপ্রিয় উক্তি
“আমার বাবা ছিলেন আমার প্রথম নায়ক। তিনি ছিলেন আমার প্রথম ভালবাসা।” – এক অজানা কন্যা
“পিতৃত্ব কোনো জৈবিক যোগসূত্র নয়, এটি একটি হৃদয়ের বন্ধন।” – বব কার্লিসল
“একজন আদর্শ পিতা তার না বলা ভালোবাসায়, মধুর শাসনে, এবং নিরব ত্যাগে ধরা পড়ে।”
করোনাকালে ও আধুনিক যুগে পিতার ভূমিকায় পরিবর্তন
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী ও প্রযুক্তির প্রসারে পারিবারিক জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। অনেক বাবা:
বাড়ি থেকে কাজ করেছেন (ওয়ার্ক ফ্রম হোম)।
সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন, পড়িয়েছেন।
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়িয়েছেন।
এই পরিবর্তন বাবাদের আরও মানবিক, সহানুভূতিশীল এবং সংবেদনশীল করে তুলেছে।
কীভাবে বাবা দিবস উদযাপন করা যায়? (বাসায় বা ভার্চুয়ালভাবে)
স্মৃতিময় ফটো অ্যালবাম তৈরি করুন।
নিজ হাতে একটি চিঠি বা কবিতা লিখে দিন।
বাবার পছন্দের খাবার রান্না করুন।
পুরনো স্মৃতি নিয়ে আলোচনা করুন।
বাবাকে ধন্যবাদ জানান তার প্রতিটি ত্যাগের জন্য।
ভার্চুয়ালি ভিডিও কলে উদযাপন করুন (যদি দূরে থাকেন)।
উপসংহার
বিশ্ব বাবা দিবস কেবল একটি দিনের উদযাপন নয়; এটি একটি উপলক্ষ যার মাধ্যমে আমরা বাবার প্রতি আমাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। পিতার ভালোবাসা প্রায়ই নিরব থাকে, কিন্তু তার প্রতিটি পদক্ষেপ সন্তানের ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করে। আমরা যেন শুধু এই দিনে নয়, প্রতিদিন তার ত্যাগ ও ভালোবাসার মূল্য দিতে পারি।