১. যাত্রার শুরু
সকালবেলায় কলকাতার হাওড়া স্টেশন।
প্ল্যাটফর্ম ভরতি মানুষের কোলাহল, গরম চা আর খবরের কাগজের গন্ধ—যেন এক বিশেষ ভ্রমণের ডাক।
আমরা চারজন বন্ধু—আমি, অর্ক, স্নিগ্ধা আর রোহন—নিশ্চিন্ত মনে দাঁড়িয়ে আছি।
আজ থেকে শুরু হচ্ছে আমাদের বহু প্রতীক্ষিত উত্তরাখণ্ড ভ্রমণ।
গন্তব্য—তুংনাথ।
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু শিবমন্দির। পাহাড়ের কোলে বসে থাকা এক দেবালয়, যার পথও এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।
২. প্রথম গন্তব্য – হরিদ্বার ও ঋষিকেশ
ট্রেনে রাত কাটিয়ে সকালে পৌঁছলাম হরিদ্বারে।
সকালবেলার গঙ্গার ঘাট যেন স্বর্গীয় দৃশ্য—হালকা কুয়াশা, ঘণ্টাধ্বনি, ধূপের গন্ধ।
আমরা সকলে মিলে গঙ্গাজলে হাত ডুবিয়ে প্রণাম করলাম। মনে হল, ভ্রমণের শুরুতেই আশীর্বাদ পেয়ে গেলাম।
তারপর ছোট্ট বাসযাত্রা করে পৌঁছলাম ঋষিকেশ।
লক্ষ্মণ ঝুলা পার হওয়ার সময় গঙ্গার গর্জন কানে আসছিল।
স্নিগ্ধা ছবি তুলতে ব্যস্ত, অর্ক বলল—
— “দেখো না, আমরা যেন অন্য দুনিয়ায় এসে পড়েছি!”
ঋষিকেশের নিরিবিলি ক্যাফেতে বসে গরম কফি খেলাম। পাহাড়ি বাতাসে ক্লান্তি উড়ে গেল।
৩. চন্দ্রশিলা ট্রেকের সূচনা
পরদিন সকালে আমরা গাড়িতে করে পৌঁছলাম চোপতা।
এখান থেকেই শুরু হবে তুংনাথ ট্রেক।
চোপতার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে মনে হয়, প্রকৃতি এখানে নিজের হাতে ছবি এঁকেছে—
সবুজ তৃণভূমি, বরফে ঢাকা দূরের শৃঙ্গ, আর পাখিদের গান।
ট্রেক শুরু করতেই প্রথমেই বোঝা গেল—এটা সহজ হবে না।
রাস্তা ঢালু, শ্বাস নিতে কষ্ট, কিন্তু দৃশ্য এত সুন্দর যে কষ্ট ভুলে যাচ্ছিলাম।
পথে দেখা পেলাম পাহাড়ি গ্রামের ছোট্ট বাচ্চাদের। তাদের হাসি যেন পাহাড়ের ঝর্ণার মতো স্বচ্ছ।
৪. তুংনাথ মন্দিরে পৌঁছানো
প্রায় তিন ঘণ্টার চড়াই পেরিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছলাম তুংনাথ মন্দিরে।
এখানে দাঁড়িয়ে মনে হল—মেঘের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি।
নীচে সবুজ উপত্যকা, উপরে নীল আকাশ আর চারপাশে বরফে ঢাকা শৃঙ্গ।
মন্দির ছোট্ট, কিন্তু শান্তির অনুভূতি অসীম।
মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, ঠান্ডা হাওয়া, আর পাহাড়ের নীরবতা—সব মিলে মনে হল যেন শিব স্বয়ং এখানে বিরাজমান।
আমরা চারজনই মন্দিরের সিঁড়িতে বসে চা খেলাম।
ক্লান্ত শরীরের মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি ফিরে এল।
এমন মুহূর্তে মনে হয়—এই কষ্টটাই তো আসল আনন্দের মূল্য।
৫. চন্দ্রশিলার শীর্ষে
মন্দির থেকে আরও এক ঘণ্টার ট্রেক করে আমরা পৌঁছলাম চন্দ্রশিলার শীর্ষে।
সেখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ—নন্দাদেবী, ত্রিশূল, চৌখাম্বা, কেদারনাথের শৃঙ্গ—সব একসঙ্গে দেখা যায়।
রোহন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম—
— “কি ভাবছিস?”
সে হেসে বলল—
— “মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন আজ।”
আমি মনে মনে ভাবলাম, এ সত্যিই এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায়।
৬. ফেরার পথে অনুভূতি
নামার সময় সূর্যাস্ত হচ্ছিল।
আকাশে কমলা-গোলাপি রঙের মেলা বসেছে।
মনে হচ্ছিল পাহাড় আমাদের বিদায় জানাচ্ছে।
চোপতায় ফিরে আমরা আগুন জ্বালিয়ে বসে গান গাইলাম, গল্প করলাম।
সেই রাতের তারা ভরা আকাশ আজও আমার মনে সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি হয়ে আছে।
গল্পের সারমর্ম
তুংনাথ ভ্রমণ আমাদের শিখিয়েছে—
জীবনের সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় তখনই, যখন কষ্টকে জয় করে এগিয়ে যেতে পারো।
পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে ছিল নতুন এক অনুভূতি।
এই ভ্রমণ কেবল একটি ট্রেক ছিল না—এটা ছিল এক আত্মঅন্বেষণ।
আজও যখন চোখ বন্ধ করি, মনে হয় আমি সেই তুংনাথের সিঁড়িতে বসে আছি, আর দূরে নীল আকাশে ভেসে যাচ্ছে মেঘের দল।