Categories
প্রবন্ধ

আর্থিক বিকাশে মাছ চাষের গুরুত্ব অপরিসীম :  দিলীপ রায়।

আমাদের দেশে মাছ চাষের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে । খাল, বিল, নদী-নালা, জলাশয়, পুকুর, মাছ চাষের উপযুক্ত  মাধ্যম । ইদানীং বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ পরিলক্ষিত হয় । তবে মূলত  আমাদের দেশে যে সকল মাছের চাষ করা হয় তার বেশীরভাগই রুই-কাতলা  জাতীয় মাছ । এসকল মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউস, ইত্যাদি । তা ছাড়া হ্যাচরির মাধ্যমে চিংড়ি মাছ চাষ আজ জনপ্রিয় । যেমন গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, ইত্যাদি । তবে কুচো চিংড়ির চাষ না হলেও নদী-নালা-খাল-বিল  থেকে বেশি ধরা হয় । মাছের ভেরি  বা  হ্যাচারি মূলত বেশি  দেখা যায় সুন্দরবন এলাকায়  ।  এসব মাছ ব্যাতীত বেশ কিছু মাছের চাষও আমাদের দেশে হয়ে থাকে যেমন, মাগুর, শিং, পাঙ্গাস ইত্যাদি  । মাগুর, শিং সাধারনত উন্নত প্রথায় চাষ হওয়ার কারণে এক-একটি মাছের ওজনও নজরকাড়া ।  পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা খাল-বিলে (চাষ ছাড়া)  জল শুকিয়ে গেলে সেখানেও  দেশি মাগুর, শিং মাছের সন্ধান পাওয়া যায় ।
মাছ চাষ বা মৎস্য চাষ হলো সাধারণত খাবারের জন্য পুকুরে বা জলাভূমিতে বাণিজ্যিকভাবে  মাছ চাষ করা । এটি জলজ চাষের প্রধান রূপ এবং এই চাষ সামুদ্রিক প্রাণীর সাথেও হতে পারে । একটি সুবিধা যা বিনোদনমূলক মাছ  ধরার জন্য বা একটি প্রজাতির প্রাকৃতিক সংখ্যার পরিপূর্ণ  করার জন্য ছোট মাছেদের ছাড়ার  ব্যবস্থাকে সাধারণত মাছের হ্যাচারি হিসাবে উল্লেখ করা হয় ।
লাভজনক মাছ চাষ বাস্তবায়ন করতে গেলে  ধাপে ধাপে ধাপে কতকগুলি পদক্ষেপ নিতে  হয় । যেমন  মাছ চাষ শুরু করার উপযুক্ত পদক্ষেপগুলি হলো   পুকুর / জলাশয়  নির্বাচন, ফিশ ফার্মের ধরণ (খাঁচা, ট্যাঙ্ক বা পুকুর), খাঁচা বা পুকুর নির্মাণ,  মাছের প্রজাতি নির্বাচন,  খাবার খাওয়ানো, যত্ন ও পরিচর্যা, মাছ ধরা ও বিপণন (মার্কেটিং), ইত্যাদি  ।
মৎস্য চাষ ক্ষেত্রটির পরিধি ব্যাপক । পুকুর, জলাভূমি ছাড়াও, লোনা জলে মাছ চাষ দেখা যায় । এছাড়া রয়েছে  শীতল জল এবং বাহারি ও শৌখিন মাছ চাষ ।
মাছ ও মাছ থেকে পাওয়া প্রোটিনের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে ।  চীনে বিশ্বের মোট মাছ চাষের ৬২% হয়ে থাকে ।  ২০১৬ সাল নাগাদ পৃথিবীর মোট উৎপাদিত সীফুডের মধ্য জলজ পালনে ৫০% এর অধিক সীফুড উৎপাদিত হয়  ।
ভারতে মৎস্য চাষ একটি উদীয়মান ক্ষেত্র (সেক্টর) । ভারতে মৎস্যচাষে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে । এখনও পর্যন্ত মৎস্যচাষে বিশ্বে ভারতের স্থান তৃতীয় এবং বিশ্বে মৎস্য উপাদনের ৭.৯৩ শতাংশ আসে ভারত থেকে । সেইসঙ্গে বিশ্বে মৎস্যচাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনে ভারতের স্থান দ্বিতীয় । ভারতের অর্থনীতিতে মৎস্যচাষ ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে । জাতীয় GDP-তে মৎস্যচাষের  ক্ষেত্রের অবদান প্রায় ১ শতাংশ । যে দ্রুতগতিতে এই ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটছে তাতে শুধু জাতীয় আয়ই নয়, বরং রপ্তানি, খাদ্য ও পুষ্ঠি নিরাপত্তা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও  এই ক্ষেত্র গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চলেছে । এই মৎস্যচাষ  ক্ষেত্র ২.৮ কোটিরও বেশি মৎস্য শিকারি ও মৎস্যচাষীর কর্মসংস্থান করছে ।
মৎস্যচাষের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে মৎস্যচাষ, পশুপালন ও ডেয়ারি মন্ত্রক মোট ২০,০৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে চালু করেছে “প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনা” । এছাড়াও, মৎস্যচাষের সঙ্গে  সঙ্গে এই মৎস্যচাষ ক্ষেত্রের পরিকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে নীল বিপ্লবের সূচনা করেছে ভারত সরকার । তা ছাড়া সমবায় ভিত্তিক মৎস্যচাষের জোরদার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে ।  ভারতে মৎস্যচাষ সমব্যয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে শীর্ষ ও জাতীয় স্তরের সমব্যয় সংস্থাটি হলো “ন্যাশনাল ফেডারেশন ফিশার্স কো-অপারেটিভস লিমিটেড (FISHCOPFED) । ১৯৮২ সাল  থেকে FISHCOPFED  কাজ শুরু করে । দেশের মৎস্যচাষ সমবায়গুলির ক্ষমতায়নই   FISHCOPFED-এর মূল লক্ষ্য । এছাড়াও অনেক রাজ্যে প্রাথমিক মৎস্যচাষ সমবায় সমিতিগুলির কাজের সুবিধার্থে মৎস্য বিপণনের ক্ষেত্রে খুচরো ও পাইকারি বিক্রেতা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করে থাকে এই সংস্থা ।  এই প্রক্রিয়ায় মৎস্যচাষীরা তাদের পণ্যের সঠিক মূল্য পেতে পারেন ।
মৎস্যচাষ সেক্টরের পরিধি অনেক ব্যাপক । এর মধ্যে অনেকগুলি বিভাগ রয়েছে – যেমন সামুদ্রিক, অন্তর্দেশীয়, লোনা জলের মৎস্যচাষ । এছাড়া রয়েছে শীতল জল এবং বাহারি ও শৌখিন মৎস্যচাষ ।
এখানে উল্লেখ থাকে যে, দেশের রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে চব্বিশটিতে রাজ্যস্তরীয় মৎস্যচাষ ফেডারেশন রয়েছে ।  মৎস্যচাষ ক্ষেত্রে কিছু কিছু রাজ্য ফেডারেশন অত্যন্ত ভাল কাজ করছে  । যেমন – কেরলের “মৎস্যফেড”, গুজরাতের “গুজরাত ফিশারিজ সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন, পশ্চিমবঙ্গের “বেনফিশ” । এছাড়া রয়েছে মহারাষ্ট্রের রাজ্য ফেডারেশন, মধ্য প্রদেশ রাজ্য ফেডারেশন, অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য ফেডারেশন, ইত্যাদি ।
পরিশেষে যেটুকু জানা গেছে, প্রাথমিক মৎস্যচাষ সমবায়গুলির মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ উপকৃত । বলা চলে এই সমবায়গুলি সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে জীবিকা, পুষ্টি  তথা সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারে । এখানে আর একটি কথা প্রনিধানযোগ্য, মানুষের হাতের নাগালে  পুষ্টিকর খাদ্য পৌঁছে  দেওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে গেলে এই সমবায়গুলিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে । প্রাথমিক মৎস্যচাষ সমবায়গুলিকে কম্পিউটার চালিত করা গেলে তৃণমূল স্তরেও এই মৎস্যচাষ সমবায় ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ  বিকাশ ঘটবে ।
সুতরাং আগামীদিনে আর্থিক বিকাশে মৎস্যচাষ দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠবে, এটা নিঃসন্দেহে ভবিষ্যদ্‌বাণী করা যায় ।

 

(চিত্র ঋণ : গুগুল)

(তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত ও যোজনা-৭/২৩)
———–০————

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *