ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের অব্যর্থ পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে শিবরাম রাজগুরু প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন। শিবরাম রাজগুরু ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যিনি দেশমতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ রূপে।মৃত্যুর সময় রাজগুরুর বয়স ছিল বাইশ বছর মাত্র। পাঞ্জাবের ফিরোজপুর জেলার শতদ্রু নদীর তীরে হুসেইনিওয়ালা গ্রামে তাঁদের মৃতদেহ চরম গোপনীয়তায় দাহ করা হয়।
শিবরাম হরি রাজগুরু ( ২৪ আগস্ট ১৯০৮ – ২৩ মার্চ ১৯৩১) ছিলেন মহারাষ্ট্র (তৎকালীন বোম্বে প্রেসিডেন্সি) থেকে একজন ভারতীয় বিপ্লবী, যিনি মূলত জন সন্ডার্স নামে একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার জন্য পরিচিত। তিনি হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (এইচএসআরএ) এর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং ২৩ মার্চ ১৯৩১ তারিখে, তাকে তার সহযোগী ভগত সিং এবং সুখদেব থাপার সহ ব্রিটিশ সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। শিবরাম হরি রাজগুরু ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী বিপ্লবী হিসাবে পরিচিত নাম।
প্রারম্ভিক জীবন—
রাজগুরু ১৯০৮ সালের ২৪ আগস্ট খেদে (মা পার্বতী দেবী এবং বাবা হরিনারায়ণ রাজগুরুর) নামক স্থানে একটি মারাঠি দেশস্থ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খেদ পুনের কাছে ভীমা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। মাত্র ছয় বছর বয়সে তার বাবা মারা যান এবং পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার বড় ভাই দিনকরের ওপর। তিনি খেদে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে পুনের নিউ ইংলিশ হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। অল্প বয়সেই তিনি সেবাদলে যোগ দেন। তিনি ঘাটপ্রভা-এ ড. এন.এস. হার্দিকার দ্বারা পরিচালিত একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তরুণ বয়সে আর এস এস’এ যোগ দেন।
বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপ—
রাজগুরু সংস্কৃতের মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।ছাত্রাবস্থাতেই তিনি দেখেছিলেন ভারতের জনগণের ওপর ব্রিটিশদের অন্যায়, বঞ্চনা আর অত্যাচার। তার এই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে প্রস্তুত হন।চন্দ্রশেখর আজাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে যে কোন মূল্যে দেশকে ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্ত করতে গঠিত হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয় যান। তিনি চেয়েছিলেন যে কোনো উপায়ে ভারতকে ব্রিটিশ রাজ থেকে মুক্ত করা হোক।
রাজগুরু ভগত সিং ও সুখদেব থাপারের সহকর্মী হয়ে ওঠেন এবং ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর লাহোরে একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জেপি “জন” সন্ডার্সের হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের ক্রিয়াকলাপ ছিল লালা লাজপত রাইকে মারধরের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। সাইমন কমিশনের প্রতিবাদ করার সময় একটি মিছিলে; লালা লাজপত রায় সন্ডার্স হত্যার এক পাক্ষিক পর মারা যান।
HSRA-এর সক্রিয় সদস্য হওয়ার পর, তিনি সুখদেব থাপার এবং ভগৎ সিং-এর আদর্শের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। তিনি ১৭ ডিসেম্বর, ১৯২৮ তারিখে লাহোরে একজন ব্রিটিশ সহকারী পুলিশ সুপার জন সন্ডার্সকে হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন। এই তিনজন লালা লাজপত রায়ের প্রতিশোধ নিতে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যিনি সাইমন কমিশনের প্রতিবাদে একটি সমাবেশে পুলিশের মারধরের কারণে এক পাক্ষিক পরে মারা গিয়েছিলেন।
হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হওয়ার পরে এখানেই ভগৎ সিং এবং সুখদেবের সাথে পরিচয় হয়। রাজগুরু, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং জয়গোপাল মিলে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই ডিসেম্বর লাহোরে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জে পি স্যান্ডার্সের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটান। যদিও তাঁদের লক্ষ্য ছিলেন পুলিশ অফিসার জে.এ.স্কট,কিন্তু এই ঘটনায় স্যান্ডার্সের মৃত্যু হয়। লালা লাজপতের ওপর নৃশংস লাঠি প্রয়োগের আদেশ দিয়েছিলেন স্কট। আসলে এটি বিপ্লবী লালা লাজপত রায়ের সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় পুলিশি লাঠিচার্জে রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া ছিল।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই জুলাই লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব সহ একুশ জন ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হল। তিনজনই দোষী সাব্যস্ত হন।
ফাঁসি—
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মার্চ ফাঁসি আদেশ দেওয়া হয়। ওইবছরই ২৩ শে মার্চ নির্দিষ্ট দিনের একদিন আগে তিনজন বিপ্লবীর ফাঁসি হয়। বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং এবং সুখদেবের সাথে, রাজগুরুকেও ব্রিটিশ সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। সমগ্র জাতি দেশের জন্য তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে কারণ ২৩ শে মার্চ প্রতি বছর শহীদ দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
তার সম্মানে, খেদের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রাজগুরুনগর, এখন পুনের খেদ তহসিলের একটি সেন্সাস টাউন। শহিদ রাজগুরু কলেজ অফ অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস ফর উইমেনও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ দিল্লির বসুন্ধরা এনক্লেভে তৈরি করা হয়েছিল।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।