Categories
প্রবন্ধ

মানুষ ও মানবতা – একটি পর্যালোচনা  :  দিলীপ রায়।

“মানবতা” শব্দ নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা পাঠক সমাজে ইতিমধ্যে উপহার দিয়েছি । তবুও আমি মনে করি ‘মানবতা’ নিয়ে ঐ কয়েকটা লেখা জন-সচেতনার পক্ষে যথেষ্ট নয় । মানবতা, মানবিকতা, মানবপ্রেমী, ইত্যাদি শব্দগুলি আজকের দিনে খুব প্রাসঙ্গিক । রাস্তা ঘাটে হাঁটলে এবং চারিদিকের মানুষজনের দিকে তাকালে মানবিকতার কথা মনের ভিতর উদ্রেক ঘটলে, মুখে একটা শুকনো হাসি পায় । একটা কথা বার বার ঘুরপাক খায়, “হায় রে মানবিকতা ! তোর এত আকাল !” চোখ বুজে ভাবলে একটা কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ হয়, “নিঃস্বার্থ মানবিকতা কোথায় ?” অথচ আমরা জানি, প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে মানবিকতা বিরাজমান । মনুষ্যত্বহীন মানুষকে মানুষ বলা সমাজের দৃষ্টিতে প্রচণ্ড কঠিন । সমাজের দৃষ্টিতে মানবিকতা মানুষের সুপ্ত গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম গুণ । সুতরাং এটা বলা যায়, মানুষ মানবিকতার অধিকারী । মানুষ্যত্ববোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মানুষের কার্যকর অস্তিত্বের মধ্যেই “মানুষ’এর প্রকাশ । তাই বলা চলে, মানবিকতা ছাড়া মানুষ নয় । মানবিকতা আছে বলেই মানুষ অর্থাৎ মানবিকতা ধারন বা লালন করে বলেই মানুষ । কিন্তু দুঃখের বিষয় — মানব কল্যাণে মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ দূরবীণ দিয়ে দেখার মতো !
“মানবতা” শব্দের সঙ্গে গভীরভাবে যে শব্দটি জড়িয়ে আছে সেটা হচ্ছে ‘নিঃস্বার্থ’ । কারণ আমরা জানি, যখন কোনো মানুষ, মানুষের কল্যাণে কাজ করবে সেটা থাকতে হবে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ । কিন্তু বতর্মানে একেবারে স্বাথের্র বাইরে মানুষ মানবিকতার নিরিখে কতটা কাজ করে বা করছে সেটা স্থিরভাবে বলা খুব কঠিন । কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে কোনো স্বার্থ না থাকলেও পরোক্ষভাবে রয়েছে । বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক সংগঠনকেই মানবসেবা, মানব কল্যাণে কাজ করতে দেখা যায় । তাদের প্রয়াস কতটা ব্যাপৃত সেটা এখন ভাববার বিষয় ? সমাজে যারা অভাবী, অসহায়, সম্বলহীন, খেটে খাওয়া অতি সাধারণ মানুষ প্রয়োজনে ঐসব সংগঠন থেকে তারা কতটা উপকৃত হচ্ছে — তার কোনো রিপোর্টিং বা সংবাদ মাধ্যমে খবর আমাদের চোখে পড়ছে না ! তারা আর্থিক দিক থেকে যেমন দুর্বল তেমনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে । মুখে না বলে বাস্তবে অভাবী, যাকে বলে অভাবগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ালে মানব কল্যাণ কথাটার স্বার্থক রূপ পেতো ।
(২)
মানবতাপ্রেমী বলে যারা চিল্লাচ্ছেন তাঁদের কর্মকাণ্ড খানিকটা বিজ্ঞাপনের ন্যায় । বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদেরকে মানবতাপ্রেমী হিসাবে মানুষের সামনে তুলে ধরতে তাদের মুখ্য চিন্তা । চোখের সামনে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আজকের মানুষেরা সেই অসহায় মানুষের হাতে ধরে ওঠানোর সময়টুকু পর্যন্ত পান না, অথচ চলমান সেই (কিছু) মানুষের মুখে অহরহ — তিনি একজন প্রকৃত মানবতাপ্রেমী মানুষ । এটা লজ্জার, যেমনি নিজের কাছে তেমনি সমাজের কাছেও । তাই মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ আজ বড় অদ্ভূত ধরনের, বোঝা কঠিন ! আবার একই মানুষকে দুই ধরনের ভূমিকায় দেখা যায় — কোনো সময় তিনি জনদরদি আবার কোনো সময় তিনি পশুর চেয়ে হিংস্র । মানবিক দিকের কাজটা দেখাতে গিয়ে নিজের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে, তিনি তখন আসল রূপ ধারন করেন । পশুর চেয়েও হিংস্র হয়ে ওঠেন । তখন হিতাহিত জ্ঞানের অভাব ঘটে ।
তাই বলি, মনুষ্যত্ব বা মানবিকতা আমাদের অন্তরের বিষয় । আর এই অভ্যন্তরীণ বিষয়কে জাগ্রত করতে আমাদের চাই আন্তরিক ইচ্ছা । এই মানবতা বা মানবিকতা গড়ে তুলতে আমাদের চাই মানসিক শক্তি, অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, যা আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে ও বিভিন্ন বিপদের বিরূদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করবে । এই ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের কথায় আসা যেতে পারে । তিনি মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “নীতিপরায়ন ও সাহসী হও । কাপুরুষেরা পাপ করিয়া থাকে, বীর কখনও পাপ করে না—এমনকি মনে পর্যন্ত পাপ আনতে দেয় না । সিংহ-গর্জনে আত্মার মহিমা ঘোষণা কর, জীবকে অভয় দিয়ে বল – “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধিত” —ওঠ, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামিও না । এস মানুষ হও । …… নিজেদের সংকীর্ণ গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে । তোমরা কি মানুষকে ভালবাস ? তোমরা কি দেশকে ভালবাস ? তাহলে এসে, আমরা ভাল হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি ।”
মানবতা ও মানবসেবা একার্থক নয় । মানবসেবার মধ্যে পরোপকার জাতীয় একপ্রকার অনুভূতির জন্ম হয় । সেক্ষেত্রে স্বজ্ঞানে বা অ-জ্ঞানে বিশেষ অহংকারবোধের উদ্রেক হয় । তবে মানবসেবা মানবিক হতে পারে — “যখন মানুষ অন্যের সেবা করে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিকে উপেক্ষা করে, নিঃস্বার্থভাবে অন্যের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে, সেবা ও মানবিকতার আদর্শের মিলনকে স্বার্থক করে তোলে ।” মানুষের মানবিকতার উৎকর্ষতা নির্ধারিত হয় জগতে বিরাজমান সমস্ত জীবের প্রতি আচরণের নিরিখে । মানুষের নৈতিকতা, দায়দায়িত্ব, কর্তব্যপরায়নতার বহিঃপ্রকাশ হয় এই মহান আদর্শের মধ্য দিয়ে । সুতরাং এই কথা বলাই যায় যে, মানবতা কোনো মতবাদ নয়, একটি আদর্শ ।
পরিশেষে এটা পরিষ্কার, মানুষ মানবতার অধিকারী । আর ‘মানবতা’ হচ্ছে মানুষের বৈশিষ্ট্য । মানুষের সেবা করাই হচ্ছে মানব ধর্ম । জীব ঈশ্বরের এক মহান সৃষ্টি । প্রতিটি জীবের মধ্যে ঈশ্বর বর্তমান । জীবের সেবা করার মাধ্যমে ঈশ্বরের সেবা করা যায় । সেইজন্যেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর” । বাণীটি মানব কল্যাণের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত) ।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *