শুনেছি সোজা রথ দেখলে নাকি উল্টোরথ দেখতে হয়।মনে বাসনা ছিল অনেকদিনের
সুযোগ এসে গেল।দশ বারো বছর আগে।আমরা ছসাতজন মিলে ঠিক করলাম এবং উল্টোরথের দু দিন আগে পুরী গিয়ে পৌঁছলাম।বাপরে কি ভীড় কি ভীড় ।লোক থৈ থৈ করছে।আমরা গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম ।ভুবনেশ্বর থেকে পুরী ঢুকতে মধ্য রাত হয়ে গেল।গাড়ির ভীড় মানুষের ভীড় দেখে আমার রথ দেখার ইচ্ছে টাই যেন চলে গেল।কেমন যেন বুকের ভেতর টা গুড়গুড় করছে।কি জানি বাবা দর্শন হবে তো।
পরের দিন গাড়ি চলবে সকালে।ঠিক হোলো মাসির বাড়ি গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করে আসবো।বেশ ফাঁকায় ফাঁকায় প্রভুর দর্শন হয়ে গেল।মন তৃপ্তিতে ভরে গেল।এবার রথে একবার দর্শন হলেই পুণ্য অর্জন ভালোই হবে।আমাদের দুজন অভিভাবক ছিলেন সঙ্গে ।এক আমার বেয়াইমশাই আর তার বন্ধু ।তিনি পুরীর বাসিন্দা।এবং বেশ নাম আছে ওখানে।আমার বেয়ায়মশাইদের জমিদারি ছিল ।এবং পুরীতে বেশ বড় বাড়ি এবং পরিচিতি দেখলাম ।ঠিক হোলো মন্দিরের কাছাকাছি রথ এলে আমাদের জানাবেন আমরা বাড়ি থেকে একটু আগে বেরিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে রথ যাত্রা দেখবো।
উল্টোরথের দিন প্রভু যাত্রা করেছেন ।আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে রথ আর যাবে না।আমরা রাতে গিয়ে রথে প্রভু জগন্নাথ কে দেখে এলাম ।পান্ডারা বললেন ভোরে রথ মন্দির অভিমুখে যাবে।আমরা ঠিক করলাম ভোরে এসে রথের দড়ি স্পর্শ করে যাবো।আমার বেয়ান খুব হুল্লোড়বাজ।আমাকে কানে কানে বললো দিদি ওরা বলুক আমরা রথ টানবো।আমি ভয়ে বললাম না না এই ভীড়ের মধ্যে মাথা খারাপ ।
ভোরে স্নান টান করে রথ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এসে দাঁড়ালাম।একটি দোকানের সামনে ভালো দেখা যাবে।সবই ওই অভিজ্ঞ বন্ধু টির পরামর্শ মতো।আমরা রথ তৈরি হচ্ছে সেই সময় দড়ি ধরে দাঁড়ালাম।আস্তে আস্তে যখন চলবে একটু টেনেই চলে আসবো টানাও হবে পুণ্য ও হবে।সেইমতো সবাই গিয়ে রথের দড়ি ধরে দাঁড়ালাম।রথ চলতে শুরু করলো ওরা পেছন থেকে ডাকছে এবার চলে এসো।সুপ্রিয়া আমার হাত চেপে ধরে থাকলো।সবাই বেরিয়ে গেল রথ জোরে ছুটছে আমরা দুজনে ছুটছি।কি জোরে যাচ্ছে আমরাও সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ লোকের সঙ্গে দড়ি ধরে ছুটে চলেছি।কি আনন্দ কি আনন্দ ভোরের পবিত্র আলোয় যেন হাওয়ায় ভেসে চলেছি।কোনও ভয় নেই ভাবনা নেই পিছুটান নেই প্রভুর রথের দড়ি ধরে ছুটে চলেছি।কি উদ্দেশ্যে জানি না কি মনস্কামনা ভুলে গেছি কি প্রার্থনা করবো ভুলে গেছি শুধু সামনে জগন্নাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন এই আনন্দে যেন সারা শরীর মন অপার্থিব পরিতৃপ্তি তে ভরে যাচ্ছে ।একবার রথ থামলো।অনেকে ভেতরে ঢুকে মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে বলছে আরতি করো মা আমরা মনের সুখে দুজনে আরতি করলাম ।প্রভু জগন্নাথ তুমি দয়া করো।একটা বাচ্চা ছেলে নারকেল এনে বললো প্রভুকে নিবেদন করো।নারকেল ফাটিয়ে প্রভুকে পথের ধুলোমাখা নৈবেদ্য দিলাম।তুমি তো আজ পথেই আছো প্রভু তাই এই নিবেদন গ্রহণ করো মনে মনে বলি।বাচ্চা টা টাকা চাইলে যা হাতে উঠে এলো দিয়ে দিলাম ।হিসেব করি নি নিজেই যে বেহিসেবি এখন।
রথ আবার চলতে শুরু করলো সুপ্রিয়া বললো দিদি বেরিয়ে পড়ি চলো।এবার জোরে ছুটবে আর বেরোতে পারবো না।ভীড় ঠেলে বাইরে আসি দূরে মন্দিরের চূড়ো ঝকঝক করছে।
অনেক দূরে চলে এসেছি।রাস্তা ফাঁকা ।ওদের খুঁজতে খুঁজতে হাঁটছি।দেখতে পাচ্ছি না ।
এদিকে ওরা রথ যাওয়ার সময় চোখ বুজে সবাই যখন আত্মমগ্ন সেই তালে তো আমরা পালিয়েছি।প্ল্যান তো আগেই করা ছিলো। এদিকে আমাদের না পেয়ে ওখানে তো হুলুস্থুলু কান্ড।নির্ঘাত আমরা হারিয়ে গেছি ঐ ভীড়ের মধ্যে কি করবো কোথায় যাবো ভেবে অস্থির ।শেষ মেশ যখন পুলিশকে জানাতে যাবে আমার দিদি চেঁচিয়ে বললো ওই তো আসছে ওরা।আমরা ভয়ে ভয়ে এসে ওদের কাছে আসতেই আমার বেয়াইমশায়ের উৎকন্ঠিত গলা আপনার ছেলেকে আমি কি বলতাম দিদি।
ভেতরটা হাসিতে ফেটে পড়ছে।বাড়ি ফিরে আগে আমরা দুজনে প্রাণ খুলে হেসে নিলাম।তারপর ভালমানুষের মতো এসে বললাম আমরা বুঝতে পারি নি রথ জোরে ছুটছিল বেরোতে ও পারছিলাম না।উনি আমাদের মন খারাপ দেখে বললেন ঠিক আছে।বিদেশ বিভুঁয়ে চিন্তা হয়।আপনি ভীতু মানুষ ।
জয় জগন্নাথ ক্ষমা করে দিও।
মনে মনে বলতে থাকলাম
জগন্নাথ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে
