Categories
গল্প

রোদের নিচে জমে থাকা শীত।

(একটি শীতের দুপুরের প্রেমকাহিনি)

শীতের দুপুরগুলো অদ্ভুত।
সকাল যেমন কুয়াশায় ঢাকা থাকে, সন্ধে যেমন হিম হয়ে আসে—
দুপুর ঠিক তেমন নয়।
দুপুরে রোদ থাকে, অথচ শীত যায় না।
যেমন কিছু মানুষ—ভালোবাসা দেখায়, তবু দূরে থাকে।

সেদিনও এমনই এক শীতের দুপুরে,
কলকাতার উত্তর দিকের ছোট্ট পাড়াটার রাস্তায় হাঁটছিল নীলয়।

রোদ পড়েছে ঠিকই, কিন্তু বাতাসে এখনো কাঁপুনি।
হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে সে ধীরে হাঁটছিল।
আজ অফিস নেই।
ছুটির দিন—তবু কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই।

হঠাৎ চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সে।

এই দোকানটা তার খুব পরিচিত।
দু’তলা পুরনো বাড়ির নিচে, কাঠের বেঞ্চ, লোহার কেটলি,
আর সেই চেনা গন্ধ—চা, বিস্কুট, ধোঁয়া আর পুরনো সময়।

“এক কাপ লাল চা,” বলল নীলয়।

চা হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসতেই চোখ পড়ল জানালার দিকে।
আর ঠিক তখনই—

সে দেখল মিতালীকে

অনেক বছর পর।

মিতালী জানালার ধারে বসে আছে।
হালকা বাদামি সোয়েটার, খোলা চুল, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা।
হাতের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে,
আর মুখে সেই চেনা নির্লিপ্ত ভাব।

যেন কিছুই বদলায়নি।

নীলয়ের বুকের ভেতর হঠাৎ করে কিছু একটা নড়ে উঠল।
অনেকদিন পর কেউ হঠাৎ পুরনো গান বাজিয়ে দিলে যেমন হয়।

সে নিজেও বুঝল না কেন,
পা দুটো নিজে থেকেই মিতালীর দিকে এগোল।

“মিতালী?”
স্বরে সামান্য দ্বিধা।

মিতালী তাকাল।
চোখের পাতা এক মুহূর্ত কাঁপল।
তারপর ধীরে হাসল।

“নীলয়!”

এই এক শব্দে এত স্মৃতি জমে ছিল—
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।

“তুমি এখানে?”
মিতালী বলল।

“হ্যাঁ… মানে… মাঝে মাঝে আসি,”
নীলয় হালকা হেসে বলল।

“বসো,”
মিতালী সামনে রাখা চেয়ারটা টেনে দিল।

নীলয় বসল।
দুজনের মাঝখানে টেবিল, দু’কাপ চা,
আর বহু বছর না বলা কথা।

তাদের শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় সাত বছর আগে।
সেদিনও ছিল শীত।
তবে দুপুর নয়—সন্ধে।

সেই দিনটার কথা দুজনেই মনে রেখেছে।
কারণ সেদিনই সব শেষ হয়েছিল,
কিন্তু কেউ ঠিক করে কিছু শেষ করেনি।

“কেমন আছ?”
মিতালী জিজ্ঞেস করল।

“চলে যাচ্ছে,”
নীলয় বলল।
“তুমি?”

“আমি… ভালোই,”
একটু থেমে যোগ করল,
“মানে, থাকা যায়।”

এই ‘থাকা যায়’ কথাটার ভেতরেই মিতালীর সব কথা লুকিয়ে থাকে।
আগেও থাকত।

নীলয় জানে।

“এখন কোথায় থাকো?”
নীলয় জানতে চাইল।

“সল্টলেকে,”
“অফিস ওখানেই।”

“এখনো লেখালেখি করো?”
নীলয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

মিতালী তাকিয়ে রইল।
তারপর হালকা হেসে বলল,
“কখনো সখনো।”

এই উত্তরটার মানে নীলয় ভালো করেই বোঝে।
কখনো সখনো মানে—
মন খারাপ হলে,
শীতের দুপুরে,
অথবা পুরনো কেউ হঠাৎ সামনে এসে বসলে।

চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
তবু কেউ খেয়াল করছিল না।

বাইরে রোদ পড়েছে।
রাস্তায় মানুষজন, রিকশা, সাইকেল—সব চলছে।
কিন্তু এই টেবিলটার চারপাশে যেন সময় থেমে গেছে।

“তুমি কি বিয়ে করেছ?”
মিতালী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

নীলয় একটু থমকে গেল।
তারপর মাথা নাড়ল।

“না।”

“আমি… করেছিলাম,”
মিতালী বলল খুব আস্তে।

নীলয় জানত না কেন,
এই কথাটা শুনে তার ভেতর কোনো ব্যথা হলো না।
বরং একরকম শান্তি।

“কেমন?”
নীলয় জানতে চাইল।

মিতালী জানালার বাইরে তাকাল।
রোদের দিকে।

“শেষ হয়ে গেছে,”
বলল সে।
“কিছু জিনিস টেকে না।”

নীলয় চুপ করে থাকল।
এই কথার মানে সে বুঝতে পারে।

তাদের গল্পটা শুরু হয়েছিল কলেজে।
শীতের দুপুরে লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে।

মিতালী তখন কবিতা লিখত।
নীলয় পড়ত, শুনত, বোঝার চেষ্টা করত।

তাদের ভালোবাসা ছিল শান্ত।
কোনো নাটক নেই, কোনো চিৎকার নেই।
শুধু দুপুরের রোদ,
চায়ের কাপ,
আর দীর্ঘ নীরবতা।

সমস্যা এসেছিল তখনই—
যখন জীবনের গতি বদলাতে শুরু করেছিল।

নীলয়ের চাকরি,
মিতালীর লেখালেখি,
দুজনের আলাদা আলাদা স্বপ্ন।

তারা ঝগড়া করেনি।
শুধু কথা বলা কমে গিয়েছিল।
আর একদিন—
কথা বলা পুরোপুরি থেমে গিয়েছিল।

“তোমার মনে আছে?”
মিতালী হঠাৎ বলল।
“সেই শীতের দুপুরটা?”

নীলয় হাসল।
“যেটাতে তুমি বলেছিলে—
ভালোবাসা মানে চুপ করে পাশাপাশি বসে থাকা?”

“হ্যাঁ,”
মিতালীও হাসল।
“আমি এখনো তাই ভাবি।”

নীলয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমিও।”

দুজনেই জানত—
এই কথাটার ভেতর অনেক কিছু আছে।
কিন্তু সেগুলো আর বের করার দরকার নেই।

বাইরে রোদ একটু ঢলে পড়েছে।
শীতের দুপুর ধীরে ধীরে বিকেল হচ্ছে।

মিতালী উঠে দাঁড়াল।

“আমাকে যেতে হবে,”
বলল সে।

নীলয় মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ।”

দুজনেই জানত—
এই যাওয়াটা চূড়ান্ত নয়,
আবার নয়।

দরজার কাছে এসে মিতালী থামল।
একটু ভেবে বলল,
“কখনো… আবার দেখা হবে?”

নীলয় জানত,
এই প্রশ্নটার উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’—
কোনোটাই পুরো সত্য নয়।

তবু বলল,
“হতে পারে।”

মিতালী হালকা হাসল।
তারপর চলে গেল।

নীলয় আবার বেঞ্চে বসল।
ঠান্ডা চা হাতে নিল।

শীতের দুপুর তখন শেষের পথে।
রোদ কমছে,
কিন্তু ভেতরের ঠান্ডা একটু কমেছে।

সে বুঝল—
কিছু ভালোবাসা শেষ হয় না।
শুধু জমে থাকে।

শীতের দুপুরের মতো।
রোদের নিচে,
চুপচাপ।


✨ শেষ ✨

 

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *