Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাপ্রভুর মধুময় কথা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীগৌরাঙ্গের পতিত-পাবন নামের সার্থক প্রমাণ হল শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই উদ্ধার লীলা। ভক্ত শিরোমণি জগাই-মাধাইয়ের অবণীতে আবির্ভাব হয় প্রভুর ইচ্ছায় দুরাচারী, অত্যাচারী, মদ্যপ ও অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিরূপে। এমন কোন পাপকর্ম জগৎ-এ ছিল না, যা, তাঁরা করতেন না। চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, গোমাংস ভক্ষণ, পরের গৃহ অগ্নিদগ্ধ করা, স্ত্রী-হত্যা, ব্রহ্মহত্যা ইত্যাদি সব রকম অসৎকর্মই তাঁরা অবলীলায় করতেন। তবে হ্যাঁ, উল্লেখ্য যে, বৈষ্ণব অপরাধ তাঁরা কখনও করেননি। মদ্যপ সঙ্গীদের সঙ্গ সবসময় করতেন বলে বৈষ্ণব অপরাধ করার মতো পরিস্থিতি বা সুযোগ কোনদিন হয়ে উঠেছিল না।
নবদ্বীপবাসী ব্রাহ্মণ শুভানন্দ রায়। নবদ্বীপের জমিদার বলেই তাঁর দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছিল। সুমিষ্ট, সৎ ব্যবহারের জন্য পাৎসাহ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তাঁর দুই পরম-সুন্দর পুত্র—–জ্যেষ্ঠ রঘুনাথ, কনিষ্ঠ জনার্দন দাস। রঘুনাথের পুত্রের নাম জগন্নাথ আর জনার্দনের পুত্র মাধব। এই জগন্নাথ ও মাধবই ওরফে ‘জগাই-মাধাই’ বলে পরিচিত ছিলেন। নবদ্বীপের কোটাল এই দুই ভাই। যদিও জগাই-মাধাইয়ের পূর্বপুরুষরা সকলেই সদাচারী ছিলেন, কিন্তু মদ্যপ-কুসঙ্গীদের পাল্লায় পরে জগাই-মাধাইয়ের চরিত্রের অবনমন ঘটে। আর সেজন্য স্বজনদের দ্বারা তাঁরা পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। ভক্তসঙ্গ কী জিনিষ তা তাঁরা জানতেনই না। মদ্যপান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি পর্যন্ত যেতেন, কখনো বা বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন, আবার কখনো অশ্রাব্য গালিগালাজ করে নিজেদের মধ্যেই কিল-চড়-লাথি দিতেন। লোকে তাঁদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন সব সময়। যে পথ দিয়ে জগাই-মাধাই যেতেন। দূর থেকে দেখতে পেলে সেই পথ এড়িয়ে অন্য পথ ধরতেন ভীত পথিকেরা।
এমনই একদিন প্রচুর মদ্যপান করে রাস্তায় ধুলোয় পড়ে ‘কিলাকিলি-লাথালাথি করছিলেন জগাই-মাধাই। এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গের আদেশে প্রতিদিন নিত্যানন্দ ও যবন হরিদাস নবদ্বীপের প্রতি ঘরে ঘরে গমন করে মানুষকে কৃষ্ণ বলাচ্ছেন সেসময়। সেদিন তাঁরা সম্মুখীন হলেন পথে জগাই-মাধাইয়ের। দেখলেন ওভাবে মদের নেশার বিক্ষেপে তাঁদের পশুবৎ দশা। তখন পরম করুণ নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন, “ইস্! কী করুণ দশা এদের! এমন পাতকী তো কোথাও দেখিনি। আমার প্রভু গৌরাঙ্গ পাতকীদের উদ্ধার করতেই এই কলিতে এসেছেন। যদি এদের মতো পাপীদের তিনি উদ্ধার করেন, তবেই তো তাঁর পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে, তবে তো জগৎবাসী জানবে যে আমার প্রভুর মহিমা কতখানি! যাঁর ভৃত্য বলে আমরা গর্ব বোধ করি, তিনি যে কতখানি ক্ষমতা ধরেন সে প্রমাণ পাবে মানুষ তখন। না, এদেরকে ভক্তিপথে আনতেই হবে। যাঁরা ভক্ত হয় তাঁরা অতি সহজেই নাম নেয়; কিন্তু যদি এদের মত দুরাচারীকেও নাম নেওয়ানো যায়, তবেই আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সফল হবে। না হলে তো বৃথা আষ্ফালন সব আমাদের ! না, হরিদাস, আমাদের এখন প্রথম কাজ হবে এদেরকে উদ্ধার করা। অন্য জায়গায় আমরা পরে যাব। গৌরীহরিকে এদের কথা জানাবো। হরিদাস, তোমাকে যবনরা অত্যাচার করেছিল। তুমি তো তাদেরও মঙ্গল কামনা করেছিলে। এবার এদের মঙ্গল চাও। কারণ, তোমার মত ভক্তের চাওয়া ভগবান পূরণ করবেনই। এরা উদ্ধার হবে এই পাপী জীবন থেকে তবে।”
হরিদাস বললেন, “সে কী কথা! তুমি চেয়েছো যখন তখনই তো তা পূরণ হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। তোমার ইচ্ছাই যে প্রভুর ইচ্ছা। আবার আমাকে টানছো কেন!” নিত্যানন্দ একথায় হেসে প্রেমালিঙ্গন দিলেন হরিদাসকে। তারপর একটু দূর থেকে উপদেশের সুরে জগাই-মাধাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, লহ কৃষ্ণনাম। কৃষ্ণ মাতা, কৃষ্ণ পিতা, কৃষ্ণধন প্রাণ।। তোমা সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার। হেন কৃষ্ণ ভজ, সব ছাড় অনাচার।।”
কিন্তু উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হল । জগাই এমন কথা শুনে একটু মাথা তুলে প্রথমে দেখলেন, তারপরই মহাক্রোধে “ধরতো! ধরতো!” বলে ধাওয়া করলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে। “রক্ষ কৃষ্ণ, রক্ষ কৃষ্ণ” বলে নিতাই-হরিদাস কোনক্রমে জগাইয়ের প্রহারের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। সে কী অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য! গর্জন করতে করতে দুই দস্যু ধাওয়া করছেন আর সামনে প্রেমে বিহ্বল দুই মহাভক্ত হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছেন।
শ্রীবাস গৃহে ভক্ত সমেত বসে আছেন বিশ্বম্ভর। নিতাই-হরিদাস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সব বললেন তাঁকে। শ্রীবাস পন্ডিত ও গঙ্গাদাস জগাই-মাধাইয়ের বংশ পরিচয় দিলেন এবং তাঁদের দুষ্কর্মের আদ্যোপান্ত বর্ণনাও দিলেন। নিত্যানন্দ বললেন, “প্রভু, আগে তোমায় এদেরকে উদ্ধার করতেই হবে। তারপর অন্য কথা। তোমার পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে এদের পাপমোচনের দ্বারা। বিশ্ববাসী তোমার মহিমা দেখুক।” গৌরাঙ্গ হেসে বললেন, “যে মুহুর্তে তোমার দর্শন ওরা পেয়েছে, তুমি চেয়েছো ওদের উদ্ধার, সেই মুহূর্তেই ওদের সব পাপ মোচন হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু তুমি ওদের মঙ্গল চিন্তা করো, দেখবে অচিরেই কৃষ্ণ ওদের মঙ্গল সাধন করে দিয়েছেন। তোমার ইচ্ছাই ফলপ্রসূ হবে।”
রাত্রিবেলায় একদিন নগর ভ্রমণ করে নিত্যানন্দ যাচ্ছেন পথ দিয়ে হেঁটে, এমন সময় জগাই-মাধাই তাঁর পথ অবরোধ করলেন। বললেন, “কে রে? কে তুই?” নিত্যানন্দ বললেন, “আমি অবধূত, গৌরগুণ গাই। এখন বাড়ি যাচ্ছি।” অবধূত শব্দ শোনা মাত্র মাধাই করলেন কী, পথের পাশে পড়ে থাকা এক ভাঙা কলসী উঠিয়ে নিয়ে আছাড় মারলেন নিত্যানন্দের মস্তকে। সজোরে আঘাত করায় মাথা ফেটে গেল নিতাইয়ের। আর অবিরল ধারায় রক্ত ঝরতে লাগলো। অক্রোধ পরমানন্দ, অভিমান শূন্য নিতাই গৌরস্মরণ করে নির্বিকার চিত্তে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর নির্লিপ্ততা দেখে মদ্যপ মাধাই আবার মারতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রক্তধারা আর নিতাইয়ের নিশ্চুপতা দেখে জগাইয়ের মন দৈবেচ্ছায় মাখনের মত গলে গেল। তিনি মাধাই কে বললেন, “না, না, আর মেরো না। ও তো অবধূত, তা আবার দেশান্তরী ! ওকে মেরে লাভ কী তোমার! এত নির্দয় হয়ো না।” এই বলে তিনি মাধাইয়ের হাত ধরে ফেললেন। এদিকে অন্যান্য পথচারীদের কেউ একজন ছুটে গিয়ে এ দুঃসংবাদ দিলেন গৌরাঙ্গকে।

শোনামাত্র গৌরাঙ্গ সপরিকর ছুটতে ছুটতে এলেন সেই মুহুর্তেই। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইয়ের অঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! এ কী সহ্য করা সম্ভব! প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন গৌরাঙ্গ। স্বয়ং তাঁকে প্রহার করে রক্ত ঝরিয়ে দিলেও এতখানি ক্রোধিত হতেন না, যতখানি নিতাইয়ের ক্ষেত্রে হলেন। ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি “চক্র, চক্র” বলে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান জানিয়ে নিজের হাত উপরে তুললেন। সুদর্শন চলে এলেন তাঁর হাতে। ভক্তরা সকলে প্রমাদ গুনলেন। এবার তো আর নিস্তার নেই জগাই-মাধাইয়ের! চক্র দ্বারা প্রভু তাঁদের সংহার করবেনই করবেন। কিন্তু, কলিতে এই অবতারে তো তাঁর অস্ত্র ধরার কথা নয়। তাঁর অঙ্গ-উপাঙ্গ স্বরূপ পার্ষদরাই তাঁর অস্ত্র। পার্ষদদের দ্বারা নাম-প্রেম বিতরণ করিয়ে তিনি পতিতদের উদ্ধার করবেন। তাঁর রূপ মাধুর্য্যের দ্বারা অসুরের আসুরিক স্বভাবের পরিবর্তন করবেন। তাঁকে দর্শন করেই দুরাচারীদের মন পরিবর্তিত হবে। এযুগে তো তিনি কাউকে সংহার করবেন না। বরং মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রেমভক্তিতে মনকে জারিত করবেন, ভক্ত বানাবেন অভক্তদের। মহাভাগবত হবেন তাঁরা এক-একজন সব।
নিত্যানন্দ করলেন কৌশলতা এক। তিনি মহাপ্রভুর মন ঘোরাবার চেষ্টা করলেন, বললেন- “প্রভু, দেখ, দেখ, এই যে জগাইকে দেখছো , এ আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছে। মাধাই মারতে গেলেও তাঁকে বাঁধা দিয়ে রক্ষা করেছে আমায়।” একথা শুনেই গৌরাঙ্গের মনসংযোগ চক্রের প্রতি থেকে সরলো। বললেন- “তাই নাকি! তুমি আমার নিতাইকে রক্ষা করেছো জগাই ! প্রভু তোমার অনেক মঙ্গল করুক। নিত্যানন্দকে বাঁচিয়ে তুমি আমায় কিনে নিলে আজ।” এই বলেই তিনি জগাইকে জড়িয়ে ধরলেন। জগাইকে রেখে পাছে মাধাইকে মারেন, তাই নিত্যানন্দ বলে চললেন- প্রভু, এই দু’জনার শরীরই আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি। তুমি তো এযুগে প্রতিজ্ঞা করেছো যে অস্ত্র না ধরেও জীবতারণ করবে। তবে কেন তার ব্যাতিক্রম করবে! এই দুইজনকেই তুমি কৃপা কর।”
এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেমালিঙ্গন দেওয়ায় প্রেমভার বইতে না পেরে জগাই মূর্ছিত হয়ে গেছেন। গৌরাঙ্গ বললেন- “ওঠো জগাই। তোমার যা বর লাগে, তুমি চেয়ে নাও আজ। আমি আজ সত্য সত্যই তোমায় প্রেমভক্তি প্রদান করলাম। আমার দেহ থেকেও নিত্যানন্দের দেহ বড় আমার কাছে জেনো। তুমি তাঁকে রক্ষা করেছো যখন, শ্রীকৃষ্ণ তোমায় অনেক কৃপা করবেন এই আমি বললাম।” জগাই দেখলেন গৌরহরি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রেমানন্দে করজোড়ে তখন প্রাণের আকুতিভরা প্রণাম জানাচ্ছেন গৌরাঙ্গকে জগাই। তাঁর নয়নের জল সর্বাঙ্গ বয়ে নীচে পড়ছে। তিনি আবার জ্ঞান হারালেন। তখন গৌরহরি নিজের শ্রীচরণখানি তাঁর বক্ষের ওপর স্থাপন করলেন। যাঁর অভয়পদ স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর জীবন, সেই পদ হৃদয়ে ধরে জগাই সদৈন্যে তখন কেঁদেই চলেছেন। সেই দুরাচারী জগাই কই আর! ইনি যে এখন মহাভক্ত এক। জগাইয়ের ওপর গৌরহরির এমন করুণা দেখে উপস্থিত ভক্তবৃন্দরা হরিধ্বনি দিতে থাকলেন উচ্চৈঃস্বরে। আকাশ ভেদ করে সে দিব্যধ্বনি যেন গোলকে পৌঁছে যাচ্ছিল।

এতক্ষণ ধরে এতসবের সাক্ষী মৌন মাধাই। তাঁর ভাবান্তর ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী জগাই এমন কৃপা পেয় গেল, পরিবর্তিত হয়ে গেল, উদ্ধার হয়ে গেল, অথচ, তিনি তিমিরেই পড়ে রইলেন !—– একথা ভেবে মাধাই তখন পাগলপ্রায় হয়ে গৌরাঙ্গের পাদপদ্মে পড়ে গেলেন ছিন্নমূল বৃক্ষের মত। তাঁর দুর্বুদ্ধির বিনাশ হয়ে গেছে। তিনিও এখন দুষ্কর্ম ছেড়ে জগাইয়ের মত ভক্ত হতে চান। তাই বিনয় বচনে বললেন- “আমরা দুই ভাই জগাই-মাধাই সর্বক্ষণ একসাথে থাকি। একই কুকর্ম করি, তবে কেন একজনকে কৃপা করে অন্যজনকে বঞ্চিত করবে প্রভু? আমাকেও উদ্ধার কর। ক্ষমা করে দাও আমায়। অনুগ্রহ করে আমাকেও তোমার নাম-গান প্রচারে সামিল কর। আমার মত দুর্জনকে তুমি উদ্ধার না করলে, আর কী গতি হবে আমার! কৃপা কর দয়াময়। কৃপা কর।” গৌরাঙ্গ বললেন, “না, তোমার ত্রাণ কোনমতে হবে না। তুমি নিত্যানন্দের দেহে আঘাত করেছো।” মাধাই—-“প্রভু, তোমার অন্যান্য অবতারে কত অসুর তো তোমায় বাণেতে বিদ্ধ করেছে। তুমি তো তাঁদের সকলকেই উদ্ধার করেছো। তোমার অভয়পদে স্থান দিয়েছো। তবে আমার বেলায় কেন তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করবে তোমার! গৌরাঙ্গ, “তুমি তো আমায় নির্য্যাতন করোনি। করেছো আমার প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইকে। যদি আমায় করতে, তাহলে ক্ষমা আমি অনেক আগেই করে দিতাম। কিন্তু, আমার দেহের থেকেও নিত্যানন্দের দেহ যে অনেক প্রিয় , অনেক বড় আমার কাছে। তাঁকে দুঃখ দিয়ে আমার কৃপা কোনমতেই পাবে না আমার থেকে।” মাধাই, “প্রভু, তুমি তো সর্ব রোগহর বৈদ্য চূড়ামণি। তবে আমার এই কঠিন রোগ কেমন করে দূর হবে বলো! বলে দাও কী করলে আমার পরিত্রাণ হবে এ ঘৃণ্য অপরাধের থেকে। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো।” তখন গৌরসুন্দর বললেন- “যদি নিজের পাপমোচন করতে চাও, তবে যাঁর চরণে অপরাধ হয়েছে, তাঁর শরণ নাও। নিতাইয়ের অপরাধী তুমি, তাই নিতাইয়ের কাছেই তোমার ক্ষমাভিক্ষা করতে হবে। সে যতক্ষণ না কৃপা করবে, তোমার প্রেমভক্তি ততক্ষণ বাদ।”
মাধাই নিত্যানন্দের শ্রীচরণে পড়লেন। যে পদ দেব ঋষিগণ প্রার্থনা করেন, রেবতী যে পদযুগলকে সেবা করেন সেই পদে মাথা কুটতে থাকলেন মাধাই। গৌরহরি বললেন, “নিতাই তুমি ওকে ক্ষমা না করলে যে ও উদ্ধার হবে না ! তোমার কৃপা বিনা তো কেউ প্রেমভিক্ষা পায় না। তাই, এবার দেখো তুমি ওকে কী করবে!” নিত্যানন্দ হেসে বললেন, “আমার জীবনে যদি কিছু সুকৃতী থেকে থাকে, আমি তার সমস্তটা আজ মাধাইকে দান করলাম।” এই বলে মাধাইকে নিজের চরণ থেকে তুলে কৃপালিঙ্গন দিলেন তিনি। মাধাইয়ের শরীরে নিজ শক্তি সঞ্চার করে দিলেন। সকল বন্ধনের বিমোচন হয়ে গেল মাধাইয়ের। মহাভাগবত হলেন মাধাই সে মুহুর্তেই। গৌরাঙ্গ বললেন, “জগাই-মাধাই, তোমাদের কোটি জন্মের সব পাপের ভার আমার হল। আর কিন্তু নতুন কোন পাপ কার্য করো না, আজ থেকে। তোমাদের পূর্বের কর্মের সবদায় আমার হল।“ জগাই-মাধাই সমস্বরে বলে উঠলেন- “না, না, বাবা, আর নয়। আমরা আর কোনদিন, কোন কুকর্ম করবো না। এমনকী করার কথা ভাববোও না।” গৌরাঙ্গ, “বেশ, তবে তোমাদের দেহ আমার অবতার হবে। তোমাদের দুজনার মুখ দ্বারা আহার হবে আমার।” এমন কৃপাশীর্বাদ পেয়ে দু’ভাই বাহ্য হারালেন। গৌরাঙ্গ তাঁর পরিকরদের বললেন, “এদের দুজনকে আমার ঘরে নিয়ে চল। ব্রহ্মার দুর্লভ যে ধন, আজ সেই ধন আমি এদেরকে দেব। সকলের থেকে উত্তম বানাবো। এদেরকে স্পর্শ করলে গঙ্গাস্নানের সমান ফল প্রাপ্ত হওয়া যাবে এমন পূণ্যবান ভক্ত বানাবো এদের।”
জগাই-মাধাই দু-ভাইকে নিয়ে গেলেন ভক্তরা প্রভুর ঘরে। তাঁদের দুজনকে ঘিরে সংকীর্তন শুরু হল। কীর্তনের রোল শ্রবণ করে প্রেমানন্দে উঠে বসে দু’বাহু তুলে অপার নৃত্য করতে থাকলেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দেহে বাহ্যস্মৃতি লোপ পেল। প্রেমে বিভোর দুই তনু তখন ঢলঢল, গড়গড়। অশ্রুনীরে সর্বাঙ্গ সিক্ত। সাত্ত্বিকভাবের প্রকাশ দেহে। দৈন্য, স্তুতি করে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের সেই দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়। তাঁদের দৈন্য দেখে বুক ফাটে এমন দশা তখন ভক্তদের। গৌরাঙ্গ বললেন, “আজ থেকে এরা আর মদ্যপ হবে না। এরা আমার সেবক। সকলে প্রাণঢেলে আশীর্বাদ কর এদেরকে যেন জন্মে-জন্মে আমায় না ভোলে আর। কারোর চরণে যদি কিছু অপরাধ থেকে থাকে এদের, তাহলে তোমরা নিজগুণে সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিও। কৃপা কর সকলে জগাই-মাধাইকে।” তখন দু’ভাই জগাই-মাধাই চোখের জলে ভেসে সকলের চরণ ধরে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকলেন । সকলে ক্ষমাসুন্দর চোখে তাঁদেরকে আপন করে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সেদিন থেকে তাঁরা অনুগত সেবক হলেন গৌর-নিতাইয়ের। এরপর সকলে মিলে কীর্তন করতে করতে গঙ্গাস্নান করতে গেলেন। অনেক জলকেলি হল। জগাই-মাধাইয়ের সব পাপ নিজে ধারণ করে নিলেন প্রভু। প্রমাণ দিতে ‘কালিয়া-আকার’ ধারণ করেছিলেন সেদিন। স্নান সেরে তীরে উঠে, নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ প্রভুদ্বয় আপন আপন কন্ঠের মালা জগাই-মাধাইকে পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে মহাভাগবত হলেন দু-ভাই জগাই ও মাধাই।
“মহাপ্রভু দুঁহে করিয়া আলিঙ্গন।
বোলে আজি হৈতে মোর সেবক দুইজন।। নিতাই আলিঙ্গিয়া দুঁহে বলয়ে বচন।
প্রিয় শিষ্য হৈলে মোর তোমরা দুইজন।। জগাই মাধাই হৈলা ভক্ত অতিশয়।
দুই প্রভুর দুই শাখা মধ্যে গণনা যে হয়।।”
(প্রেমবিলাস, ২১)

“এতেক যতেক কৈল এই দুইজনে।
করিলাম আমি ঘুচাইলাম আপনে।।
ইহা জানি এ দুইয়ে সকল বৈষ্ণব।
দেখিয়া অভেদ দৃষ্ট্যে যেন তুমি সব।।
শুন এই আজ্ঞা মোর যে হও আমার।
এ দুইয়ে শ্রদ্ধা করি যে দিব আহার।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে যত মধু আছে।
সে হয় কৃষ্ণের মুখে দিলে প্রেমরসে।।
এ দুইরে বট মাত্র দিবে যেই জন।
তার সে কৃষ্ণের মুখে মধু সমর্পণ।।
এ দুই জনেরে যে করিবে উপহাস।
এ দুইর অপরাধে তার সর্বনাশ।।
তবে গলার মালা দোঁহার গলে দিল।
প্রভু কৃপা পাই দোঁহে প্রেমেতে ভাসিল।।”
(চৈ.ভা-১৩)
পরম প্রেমিক, মহাভক্ত জগাই-মাধাই দু’ভাই এখন দিবানিশি কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে আঁখি নীরে ভাসেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে এসে তাঁরা দুই লক্ষ নাম নেন। কৃষ্ণ বলে নিরবধি হা-হুতাশ করেন। কৃষ্ণময় জগৎ এখন তাঁদের। কিন্তু, এত সবের সঙ্গে নিজেদের অতীতের কীর্তিকলাপের কথা ভেবে ধিক্কার দেন নিজেদেরকেই তাঁরা। নিজেদের জীবহিংসার কথা ভেবে মরমে মরে যায়। ভূমিতে পড়ে আকুলি-বিকুলি করেন অনুশোচনায়। পতিত পাবন গৌরসুন্দর কত দয়াময় আর নিত্যানন্দ এত করুণাময়(!), তাঁদের এত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন এত অবলীলায়, এত কৃপা করলেন!—–এসব ভেবে কেঁদে আকুল হন তাঁরা। বিহ্বল হয়ে যান প্রভুদের কৃপালীলার কথা ভেবে। কখনো কৃষ্ণপ্রেমানন্দে, কখনো নিজেদের কর্মের কথা ভেবে প্রায়ই আহার করেন না। তখন নিতাই-গৌরসুন্দর অনেক বুঝিয়ে আহার তুলে দেন মুখে তাঁদের।
মাধাই আরও বেশী অনুশোচনায় ভোগেন জগাইয়ের থেকে। তিনি নিতাইকে প্রহার করেছেন, রক্ত বের করে দিয়েছেন মাথা থেকে; কত না পাপীষ্ঠ তিনি! —-একথা ভেবে বক্ষ ভাসান নয়ন জলে। যদিও নিতাই তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তবুও একদিন দন্তে তৃণ ধরে আবার নিত্যানন্দের চরণে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন তিনি। চোখের জলে নিত্যানন্দের চরণ ধুয়ে দিলেন, স্তব করলেন কত না। সন্তুষ্ট নিত্যানন্দ বুকে টেনে নিলেন তাঁর প্রিয় মাধাইকে। বললেন- “মাধাই, তুমি এখনো এতদিন পরেও কেন এমন করো। শোক পরিহার কর। তুমি তো এখন আমার দাস। তোমার শরীর এখন আমার সম্পদ। তুমি এভাবে দৈন্যক্রন্দন করে আমাকে কেন কষ্ট দাও। শিশুপুত্র যদি পিতাকে মারে, পিতার কী কিছু যায় আসে তাতে! পুত্রের অপরাধ দেখে না পিতা। তেমন তুমিও তখন অজ্ঞানী ছিলে শিশুপুত্রের ন্যায়। তোমার কোন অপরাধ আমি দেখিনি। তার ওপর আমার প্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ তোমায় আপন করেছেন। যাকে তিনি কৃপা করেন, সে আমার জন্মে জন্মে প্রিয়পাত্র হয়। আর যে জন তাঁকে লঙ্ঘন করে আমায় পূজা দেয়, সেই মূঢ় কখনো আমার কৃপার প্রাপ্ত হয় না, প্রিয়পাত্র হওয়া তো অনেক দূরের কথা। তোমায় তিনি কৃপা করেছেন যখন, তখন তুমি আমার যে কত প্রিয় হয়েছো, তা আমি বোঝাতে পারবো না।” এইবলে নিত্যানন্দ মাধাইকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। তখন মাধাইয়ের অন্তর শান্ত হলেন। মাধাই বললেন, কিন্তু, প্রভু আমার যে অনেকের কাছে অনেক অপরাধ জমা আছে। তার কি হবে? আমি তো তাদের সকলকে চিনিও না। ভুলে গেছি কারা তারা। কি করে তাদের কাছে আমি ক্ষমা চাইবো? আমি বহু বহু পাপ করেছি এতদিন ধরে। কি করে সেই অপরাধবোধ যাবে আমার?”
তখন নিত্যানন্দ বললেন, বেশ, তবে এক কাজ করো। তুমি প্রতিদিন গঙ্গারঘাটে গিয়ে মার্জন করবে ঘাঁট। যারা স্নান করতে আসবে তাদের যতটা সম্ভব সেবা করবে। তারা স্নান করে উঠলে তাদের প্রণাম জানিয়ে ক্ষমা চাইবে। প্রসন্ন হয়ে তারা তোমায় আশীর্বাদ করবে কল্যাণ হোক বলে, তাতেই তোমার পাপস্খলন হবে, অপরাধবোধ চলে যাবে। হৃদয় প্রশান্ত হবে। এই আকুলতা দূর হবে।
নিত্যানন্দের দেখানো পথেই এখন জগাই-মাধাই আচরণ করেন। সকলের চরণ ধরে প্রার্থনা করেন- “জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যত পাপ করেছি আপনার প্রতি, ক্ষমা চাইছি সবের জন্য। আপনি ক্ষমা করুন এই জীবাধমকে, এই পতিতকে। এ নরাধম ভিক্ষা মার্জনা চাইছে আপনার থেকে।” তাঁদের ক্রন্দন দেখে আর অনুরোধ শুনে ঘাটে আগত স্নানার্থীদের চোখেও জল এসে যেত। তাঁরাও নয়নাশ্রু ফেলে ক্ষমা করে দিতেন। আবেগে তাঁদের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যেত জগাই-মাধাইয়ের বিনয় দেখে।
প্রেমিক সুজন জগাই-মাধাই কঠোর থেকে কঠোরতম ভজনে মগ্ন হলেন। ব্রহ্মচারী বলে তাঁরা খ্যাত হলেন। তাঁরা কোদাল চালিয়ে মাটি কেটে গঙ্গার ঘাট বানালেন। এখনও সে স্থান দর্শন হয়। ‘মাধাইয়ের ঘাট’ নামে প্রসিদ্ধ সে ঘাট, নিত্যানন্দের করুণাগুণে তাঁরা চৈতন্যচরণ পেয়েছেন। গৌরাঙ্গের পতিত পাবন লীলার মহাপ্রমাণ হলেন তাঁরা। নিতাইয়ের কৃপাপাত্র এই দুই ভাগ্যবান ভ্রাতারা আসলে শ্রীনারায়ণের ধাম বৈকুন্ঠের দুই দ্বারপাল ‘জয়’ ও ‘বিজয়’। সনকাদি মুনির অভিশাপে দুর্বৃত্ত হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধরণীতে। “বৈকুন্ঠে দ্বারপালৌ যৌ জয়াদ্য বিজয়ান্তকৌ। তাবাদ্য জাতৌ স্বেচ্ছাতঃ শ্রীজগন্নাথ-মাধবৌ।” (গৌ.গ.দি.-১১৫)
নিত্যানন্দ চেয়েছিলেন প্রাকৃত মদ্যপান করে যেমন অস্পৃশ্যরা উন্মত্ত হয়, তেমন মদ্যপ জগাই-মাধাই প্রেমভক্তিসুধা পান করে পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হোক, কীর্তন করুক, নৃত্য করুক আবেশে, ভজন পরায়ণ হোক,সকলের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হোক গৌরকৃপাপাত্র হবার——সে ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রকৃত অর্থেই। মহা ভাগবত, ভজনানন্দী হয়েই সারাটা জীবন কাটালেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দর্শনেই মানব পাপমুক্ত হত, কৃপা প্রাপ্ত হত।
ওহে প্রেমিকসুজন দুই ভ্রাতা ‘শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই’ , কৃপা করুন যাতে নিরবধি নিতাইচরণ চিন্তা করতে পারি, চৈতন্য কৃপার যোগ্য পাত্রী যেন হতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণে অনন্ত অর্বুদ কোটি প্রণাম এ জীবাধমার।
—– (সংকলিত), গ্রন্থ — ‘মহাপ্রভুর মধুময় কথা’, লেখিকা–রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক,

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

এক বিতর্কিত-বিগ্রহ কাহিনী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

উত্তর ভারত থেকে পুরী যাওয়ার পথে প্রধান সড়কের ধারেই বিষ্ণুপুর অবস্থিত।ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে এখানে মন্দিরের সংখ্যা ছিল ৩৬০টি।ফলে পুরী যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা এখানে আসতেন আর দেববিগ্রহের পূজা দিয়ে দক্ষিণা-প্রণামীও দিতেন। স্বভাবতঃই মন্দির গুলো থেকে আয় হত প্রচুর।বিষ্ণুপুরের আয়ের এক অন্যতম উৎস ছিল মন্দির। আর, দেববিগ্রহদের মধ্যে সবথেকে বেশী আকর্ষনীয় বিগ্রহ ছিল   শ্রীমদনমোহনদেব। মদনমোহন মন্দিরের  আয় ছিল বিষ্ণুপুরের সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এ তথ্য পাওয়া যায় ১৭৮৯সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখে লেখা একটি চিঠিতে। চিঠিটি লিখেছিলেন  বীরভূমের সেইসময়ের কালেক্টর জী. কীটিংসয়ে’র এ্যাসিস্ট্যান্ট অন ডেপুটেশন–  এ. হেসিলরীজ। সেসময় বিষ্ণুপুরে অর্থাভাব চলছিল আর মদনমোহনদেব কলকাতার বাগবাজারে ছিলেন। হেসিলরীজ লিখেছিলেন–‘এই বিগ্রহকে যদি বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় , তবেই  সেখানকার সম্পদবৃদ্ধির সম্ভবনা আছে।’  অতএব, মদনমোহনদেবের নাম প্রাচীন বিষ্ণুপুরের অর্থনৈতিক  ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভীষণভাবে। আবার,  এক দেববিগ্রহকে নিয়ে রাজপরিবারে মামলা , বন্ধকী, ডিক্রী— এ ঘটনা ইতিহাসে আর নেই। তাই মদনমোহন বিগ্রহ বিষ্ণুপুরের রাজপ্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক দলিল স্বরূপ। বাগবাজারে নাকি বিষ্ণুপুরে(?)—তাঁর বর্তমান অবস্থানকে কেন্দ্র করে বিতর্ক বা ধোঁয়াশা এখনও পর্যন্ত  মেটেনি বললেই চলে। সেইসাথে তাঁর নানান অবিশ্বাস্য অলৌকিক লীলা— সমস্তটা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় শ্রীমদনমোহনদেবের কাহিনী ভীষণ আকর্ষণীয় ও রোমাঞ্চকর। আসুন, মদনমোহনকে নিয়ে ইতিহাসের সেই টানা-পোড়েন দৃশ্য একটু দেখার চেষ্টা করি।
ষোড়শ শতকে  বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের ৪৯তম রাজা ছিলেন বীর হাম্বীর বা হাম্বীর মল্ল । ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজত্ব শুরু করেন।তাঁর অধীনে ডাকাত বাহিনী থাকতো।পথচারীরা বিষ্ণুপুরের জঙ্গল পার করতে গেলেই এই সব ডাকাতরা দস্যুতা করে সব ছিনিয়ে নিত। তারপর সব সম্পদ বীর হাম্বীরকে দিয়ে দিত ।বদলে এদের ভরণপোষণের  ভার রাজা বহন করতেন। সেসময় এই ডাকাতদের জন্য পথচারীদের পক্ষে বনবিষ্ণুপুর পেরোনো রীতিমত ত্রাসের ব্যাপার ছিল।
“ঐছে দুষ্ট রাজা নাই ভারতভূমিতে ।
কেহ না পারয়ে এ পাপীরে দন্ড দিতে।।”
(ভক্তিরত্নাকর,৭/৭১)
বৃন্দাবন থেকে শ্রীরূপ-সনাতন,কবিরাজ গোস্বামী ও অন্যান্য গোস্বামীদের লিখিত গ্রন্থ নিয়ে গৌড় দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন শ্রীনিবাস , নরোত্তম ও শ্যামানন্দ প্রভু। উদ্দেশ্য গৌড়দেশে ভক্তি গ্রন্থ প্রচার করবেন। সকল গ্রন্থ পেটিকায়(বাক্স বা সিন্দুক) ভরে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ;সাথে দুজন পাহারাদারও রয়েছে।  জঙ্গলপথে বিষ্ণুপুরের ডাকাতদের নজরে পড়লো গো-শকট  আর তাতে যত্ন করে রাখা  পেটিকা। তারা পিছু নিল। রাতের বেলায় বিশ্রাম নিতে গাড়ি থামিয়ে যখন সকলে ঘুমোচ্ছে তখন  পেটিকা ডাকাতি করে পালিয়ে গেল ডাকাতরা। জমা দিল রাজকোষাগারে।পরদিন সকালে ডাকাতির দ্রব্য দেখতে রাজা এলেন।পেটিকা খোলা হল। সে কি !সোনা, রূপা, হীরে , জহরত কিছুই তো নেই ভেতরে। কেবল পুঁথি আর পুঁথি!  কিন্তু সোনা-রূপো না থাকলেও যা ছিল তা সোনার থেকেও মহিমায় অমূল্য রতন। রাধা-কৃষ্ণতত্ত্ব ,ভক্তিতত্ত্ব ,ভক্তিসিদ্ধান্ত সমৃদ্ধ মহাজন লিখিত গ্রন্থগুলো স্পর্শ  করা মাত্র লেখনীর দিব্য প্রভাবে যেন পরিবর্তিত হয়ে গেল দস্যুরাজা বীর হাম্বীরের হৃদয় ।
এদিকে সকালে শ্রীনিবাস আচার্যদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।সংবাদ গেল বৃন্দাবনে। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে লেখা মহাগ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’র পান্ডুলিপিও ছিল পেটিকায়। লেখক অশীতিপর বৃদ্ধ শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এতটাই ভেঙ্গে পড়লেন যে তিনি জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করলেন । বিষ্ণুপুরে অনেক অন্বেষণ করেও যখন গ্রন্থপেটিকা পাওয়া গেল না তখন শ্রীনিবাস হতাশ শ্যামানন্দ ঠাকুর ও নরোত্তম ঠাকুরকে‌ তাঁদের নিজেদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন আর নিজে রয়ে গেলেন বিষ্ণুপুরে । মনে মনে ভাবলেন এক না একদিন কোন না কোনভাবে গ্রন্থের সুলুক সন্ধান তিনি পাবেনই পাবেন ।
দশ দিন কেটে গেল , অনেক অনুসন্ধান করেও কোন কিনারা করতে পারলেন না শ্রীনিবাস।  একটি গাছের তলায় ক্লান্ত,শ্রান্ত  হয়ে মলিন মনে বসে আছেন আর দুঃশ্চিন্তা করছেন। এমন সময় কৃষ্ণবল্লভ নামে এক ব্রাক্ষ্মণ কিশোর হাজির হল সেখানে। তার সঙ্গে আলাপ করে কথা প্রসঙ্গে বনবিষ্ণুপুরের রাজার আচরণ জানতে পারলেন শ্রীনিবাস। রাজা  রাতে দস্যুবৃত্তি করান আর দিনের বেলায় রাজসভায় শাস্ত্র আলোচনা করান — একথা জেনেই সেই কিশোরকে  তিনি বললেন, ” আমায় একদিন নিয়ে যেতে পারবে সেই সভায়?” কিশোর সানন্দে রাজী হয়ে মাথা নাড়ল। শ্রীনিবাস এলেন রাজসভায় শাস্ত্র ব্যাখ্যা শুনতে। ব্যাস চক্রবর্তী পুরাণ ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছিলেন।মনে মনে শ্রীনিবাস যা ভেবেছিলেন তাই হল। পন্ডিত এর ব্যাখ্যায় ভুল ছিল। শ্রীনিবাস ভুল ধরলেন  ।রাজা বীর হাম্বীর বলে বসলেন , “এত যখন সাহস দেখালেন , তাহলে এবার আপনিই ব্যাখ্যা করুন। শুনি সকলে।”  শ্রীনিবাস এটাই চাইছিলেন ,কারণ ,তিনি জানতেন কোনভাবে যদি রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে পারেন তবে রাজার হস্তক্ষেপে  গ্রন্থপেটিকা প্রাপ্তিতে সুবিধা হতে পারে। হলও তাই ।তিনি ভ্রমর গীতা শ্রবণ করালেন। তাঁর প্রেমভক্তি সমন্বিত অসাধারণ শাস্ত্র ব্যাখ্যায় , নিখুঁত বিশ্লেষণে সভায় উপস্থিত সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। প্রত্যেকের চোখে জল এল আবেগে, ভক্তিতে ।খুশি হয়ে পুরষ্কার ঘোষণা করতে চাইলেন রাজা, বললেন, ” আপনার যা চাই আমি তাই দেব , আর এবার থেকে আপনাকে  রোজ ভাগবত প্রবচন করতে হবে সভায়।” শ্রীনিবাস বললেন,” রাজামশাই আমার কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। আপনি যদি পারেন আমার অপহৃত  ধনের প্রাপ্তিতে একটু সাহায্য করুন ।” এই বলে সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাজা  বললেন ,”আপনি আসুন আমার সঙ্গে।” রাজকোষাগারে নিয়ে গেলেন  তাঁকে। বিস্মিত শ্রীনিবাস দেখলেন, যে গ্রন্থপেটিকার জন্য তিনি এতো অনুসন্ধান চালিয়ে চলেছেন হন্যে হয়ে,  তা সব রাজার কাছেই গচ্ছিত রয়েছে।  শ্রীনিবাস আচার্যকে গ্রন্থপেটিকা ফিরিয়ে  তো দিলেনই রাজা ,পরবর্তীতে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন তাঁর থেকে। বীর হাম্বীরের পত্নীর নাম  ‘সুলক্ষণা’  ও পুত্রের  নাম ছিল ‘ধাড়ীহাম্বীর’ ।পরম বৈষ্ণব হলেন সপরিবারে তাঁরা। বীর হাম্বীরের  সময় থেকেই বংশপরম্পরায় মল্ল রাজারা  বৈষ্ণব ভক্ত হলেন । তার আগে তো তাঁরা শাক্ত ছিলেন।বিষ্ণুপুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী  মৃন্ময়ীর যে মন্দির আমরা দেখতে পাই তা   ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মল্লরাজা জগৎমল্লই  নির্মাণ করে  দিয়েছিলেন ।  বীর হাম্বীর সমস্ত অসাধু কর্ম ত্যাগ করলেন । তিনি শ্রীকালাচাঁদ বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠা করালেন শ্রীনিবাস আচার্যের দ্বারা।
“হৈল বীর হাম্বীরের পরম উল্লাস।
শ্রীকালাচাঁদের সেবা করিলা প্রকাশ।।
রাজা বীর হাম্বিরের রাণী সুলক্ষণা।
আচার্য্য প্রভুরে কত করিলা প্রার্থনা।।
আচার্য্য প্রসন্ন হইয়া দীক্ষামন্ত্র দিলা।
পাইয়া যুগল মন্ত্র রাণী হর্ষ হৈলা।।”
(ভক্তিরত্নাকর, ৯/২৭০)
পরবর্তীতে রাজা বীর হাম্বীর বৈষ্ণব ধর্মের একজন পরম পৃষ্ঠপোষক হলেন। তিনি কালাচাঁদকে নিয়ে অপূর্ব পদ রচনা করেন, যেগুলি পদকল্পতরু’তে স্থান পেয়েছে। যখন নিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী শ্রীমতী জাহ্নবা ঠাকুরাণী বৃন্দাবনে কাম্যবনের গোপীনাথের জন্য রাধিকা মূর্তি নির্মাণ করিয়ে গৌড়দেশ থেকে বৃন্দাবনে পাঠান ,তখন সেই বিগ্রহের জন্য মূল্যবান অলংকার সামগ্রী, বস্ত্র, বাসনপত্র ও যাবতীয় উপঢৌকন সব এই বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বীরই  প্রদান করেছিলেন। বৃন্দাবনের আচার্য শ্রীল জীব গোস্বামীজী প্রসন্ন হয়ে তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন ‘চৈতন্য দাস’ ।
“শ্রীজীব গোস্বামী হইলা প্রসন্ন তোমারে ।
শ্রীচৈতন্য দাস নাম থুইল তোমার ।।”
( ভক্তিরত্নাকর, ৯,২০৫)
এই  বীর হাম্বীর রাজা একবার বৃষভানুপুরের বনে পথ হারিয়ে  ক্লান্ত ,অবসন্ন হয়ে সন্ধ্যাবেলায়  উপস্থিত হলেন এক কুটীরে। সে কুটীরে সাধনা করতেন এক তান্ত্রিক। তান্ত্রিকের কাছে পূজিত হতেন অপূর্ব দর্শন শ্রীমদনমোহন বিগ্রহ। বিগ্রহের   রূপমাধুরী দর্শন করা মাত্র রাজার  ইচ্ছা হলো সে বিগ্রহ নিজের কাছে রাখার । তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তান্ত্রিক ওই বিগ্রহ কোথায় পেয়েছেন। তান্ত্রিক জানালেন যে  ,বনবিষ্ণুপুরের বিল থেকে এক জেলেনীর জালে উঠেছিলেন বিগ্রহ । জেলেনী নিজে পূজার্চনার কিছু জানতেন না বলে তান্ত্রিককে সেটি দিয়ে দিয়েছিলেন পূজা করার জন্য।
বৃষভানুপুর থেকে কোন উপায়ে বীর হাম্বীর  সে বিগ্রহ রাজপ্রাসাদে উঠিয়ে আনলেন ।  এদিকে বিগ্রহ-হারা  তান্ত্রিক  লোক মারফৎ জানতে পারলেন যে, মদনমোহন রাজার কাছে আছে। তিনি বিগ্রহ ফেরত চাইতে রাজদরবারে আসলেন। কিন্তু, রাজা বললেন, “তোমার যত ধন সম্পত্তি  লাগে নিয়ে যাও,  ওই বিগ্রহ আমাকে দিয়ে দাও তুমি।” তান্ত্রিক রাজী  নন। তাঁর অন্য কিছু নয় , বিগ্রহই  লাগবে। কয়েকদিন পর ফেরৎ দেবেন এই বলে শেষে রাজা সময় চাইলেন। এক নকল বিগ্রহ গড়ালেন আর তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে বললেন তান্ত্রিককে।কিন্তু বিগ্রহকে বুকে লাগিয়ে তাঁর অঙ্গগন্ধ নিতেই তান্ত্রিক বুঝতে পারলেন যে, সেই বিগ্রহ তাঁর নয়, নকল বিগ্রহ সেটি।  তিনি নিজের বিগ্রহ চাইলেন। রাজা বললেন, নিতে হলে ওই বিগ্রহই নিতে হবে, ওটিই আসল । শেষে অশ্রুপাত করতে করতে তান্ত্রিক বললেন ,”আজ আপনার দিন ভালো যাচ্ছে তাই আমায় এমন করে ফেরাতে পারলেন। একদিন এমন আসবে যখন আপনাদেরও এই বিগ্রহের জন্য কাঁদতে হবে, বলে গেলাম আমি।”
“মল্ল রাজাদের সময় ভালো হইতে সদয় ।
সময় গেলে কবে তারে দেখ কাঁদিতে হয়।।”
(মদনমোহন বন্দনা, অভয়পদ মল্লিক)
মদনমোহন রয়ে গেলেন রাজার কাছে। ভালোই থাকেন। ভক্ত রাজা  যত্ন করেন ,মন প্রাণ ঢেলে সেবার ব্যবস্থা করেছেন। রাজপুরোহিত  ধরণী মহাপাত্রকে   নিযুক্ত করলেন সেবার্চনার জন্য। মদনমোহনের জন্য  রাসমঞ্চ  নির্মাণ করিয়ে দিলেন । সেটা তখন ১৬০০খ্রিষ্টাব্দ।রাসমঞ্চের বিশাল বেদী।বেদীর ওপর মঞ্চ, চূড়া ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে। চূড়ার শৈলী পিরামিডের মত।  ৩৫ফুট উঁচু ও ৮০ফুট চওড়া টেরাকোটার কারুকার্যে খোদিত এই অসামান্য রাসমঞ্চ পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। মূলতঃ বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার স্থাপত্য  বীর হাম্বীরের আমল থেকেই প্রসার লাভ করে । তাঁর অপর এক কীর্তি হল দলমাদল কামান স্থাপন।এই কামানও অতীব আশ্চর্য  দর্শণীয় বস্তু। কারণ, মাকড়া বা ল্যাটেরাইট পাথর গলানো ,লোহা দিয়ে তৈরী  ২৯৬মণ ওজনের এই কামানে এখনো একবিন্দুও মরচে ধরেনি। কামানের নাম সম্ভবতঃ প্রথমে ছিল দোলমর্দন ( মর্দন অর্থাৎ দলন, শত্রু পীড়ন)  ।কালের অপভ্রংশে নাম হয় দলমাদল। তবে জনশ্রুতি বলে যে ,বীর হাম্বীর দল ও মাদল নামে দুটি কামান বসিয়েছিলেন। মাদল কামনটি বর্তমানে লালবাঁধে  জলের মধ্যে পড়ে আছে ,দেখতে পাওয়া যায় না। আর ,  যে কামানটি দেখা যায় সেটি হল  ‘দল’ কামান। যদিও সম্প্রতি কালে লালবাঁধ সংস্কার হলেও কোন কামান কিন্তু সেখানে দেখা যায় নি। এখন, এত বছরে জলকাদায় মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে কিনা সেটাই বা কে বলতে পারে। বিষ্ণুপুর মিউজিয়ামের  তত্ত্বাবধায়ক ঐতিহাসিক শ্রী তুষার সরকার জানালেন যে, ট্রেজারি বিল্ডিং-এ একটি কামান ছিল এতদিন ধরে , বর্তমানে বিষ্ণুপুর প্রশাসনিক ভবনের সামনে সেটি স্থাপন করা হয়েছে। এই কামানটির কোন ইতিহাস জানা যায় না । এই কামানটি ‘মাদল’ কামান হলেও হতে পারতো। কিন্তু, এটি আকারে অন্য কামানটির থেকে এতটাই ছোট যে সেটিও নিশ্চিত রূপে বলা সম্ভব নয়। অতএব, আলাদা করে মাদল কামান ছিল কিনা তা প্রশ্নবোধক।এই দলমাদল কামানের সঙ্গে মদনমোহনের এক অবিশ্বাস্য অলৌকিক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন বীরহাম্বীর। বীর হাম্বীরের পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে  রাজা হন  ধাড়ী হাম্বীর, রঘুনাথ মল্লদেব,বীর সিংহদেবের পর দুর্জন সিংহদেব। এই রাজা দুর্জন সিংহদেব মদনমোহনদেবের জন্য  নির্মাণ করে দেন মন্দির। বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার   শ্রেষ্ঠ মন্দির এটিই। দৈর্ঘ্য ১২.২মিটার ও প্রস্থ ১০.৭মিটার।  মন্দিরের টেরাকোটার সূক্ষ্ম কারুকার্যময় খিলান, দেওয়াল আজও বিস্ময়ান্বিত করে  দেশ-বিদেশের পর্যটক ও গবেষকদের। Archeological Survey of India (Kolkata circle)মন্দিরের বাইরে প্রশস্তিতে লিখেছে –‘এই মন্দিরটি ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ তৈরি করেন। বাংলা চালার ছাদে একটি শিখর বিশিষ্ট ইটের একরত্ন মন্দিরগুলির মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ। মন্দির দেওয়ালের পোড়ামাটির অলঙ্করণও দেখার মত।’
প্রসঙ্গত, বীর হাম্বীরের পৌত্র রঘুনাথ মল্লদেবের  সময়  মল্লরাজারা মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকে ‘সিংহ’ উপাধি পেয়েছিলেন।আর তাই, রঘুনাথের  পরবর্তী রাজাদের নামের পরে মল্লের পরিবর্তে ‘সিংহদেব’ যুক্ত হয়।

দুর্জন সিংহের পর দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহদেব , আর তারপর গোপাল সিংহদেব রাজা হন। গোপাল সিংহ ছিলেন কট্টর বৈষ্ণব। বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক রাজ্যবাসীকে সন্ধ্যেবেলায় হরি নামের মালা জপ করার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি।এমনকি প্রজারা ঠিকঠাক মালা জপ করছে  কিনা ,তা পরীক্ষার জন্য গুপ্তচরও নিয়োগ করেছিলেন।  এদিকে বর্ধমানের বর্গী রাজা ভাস্কর রাও আক্রমণ চালাবার প্রস্তুতি শুরু করে দেন বৈষ্ণবরাজা গোপাল সিংহের নিরীহতার সুযোগ নিয়ে।
একদিন আচমকাই মধ্যরাতে মারাঠা বর্গীরা অতর্কিত হামলা করল বিষ্ণুপুরের ওপর। খবর আগে থাকতেই পেয়েছিলেন গোপাল সিংহ ।কিন্তু মদনমোহনের চরণে একান্ত শরণাগত ,আত্মনিবেদিত রাজা একটুও বিচলিত হলেন না‌। তিনি রাজ্যবাসীদের আদেশ দিলেন সকলে যেন সারা রাত ধরে হরিনাম করতে থাকে। কোন অস্ত্র কেউ ধরল না । প্রত্যেক সৈনিক পর্যন্ত হরিনাম নিতে থাকলেন আর রাজার নিজের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ , সারা রাত ধরে রাজ্যবাসী কামানের  গোলাবর্ষণের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শুনলেন। অনেকে তো ভয়ে মূর্ছিত হলেন কামানের ভীষণ শব্দে। পরে দেখা গেল যে  ৫২ হাজার বর্গী সেনার একজনও আর নেই । তাহলে গোলা বর্ষণ করল কে? কামান চালাল কে?
সকালে পুরোহিত গর্ভগৃহের দ্বার খুলে দেখেন বিগ্রহের  সারা গায়ে বারুদের দাগ আর পোড়া বারুদের গন্ধে ভরে মন্দির। এদিকে এক গোয়ালা এসে ধরলো রাজাকে ;নিবেদন করলো, ” রাজামশাই ,আপনার ছেলে দই খাওয়ার টাকা শোধ করুন ।সে বলেছে আপনার থেকে চেয়ে নিতে।” রাজা বললেন–“আমার ছেলে আবার কখন দই খেল, তা আবার তোমার থেকে?”  গোয়ালা বললো–‘আপনারই ছেলে তো! সিপাহির বেশ পরা, সারা গায়ে-মুখে কালি ঝুলি মাখা ।বারুদপোড়া গন্ধ কী তাঁর শরীর থেকে! নাম বলল বোধহয় মদনমোহন।” রাজার মূর্ছা যাবার উপক্রম হল শুনতেই।বললেন , “গোয়ালা তোমার যে কত সৌভাগ্য কী বলবো। তুমি সাক্ষাৎ বিষ্ণুপুরের ভগবানকে দর্শন করেছ আজ। তাঁকে দই খাইয়েছ! তুমি ধন্য।” আনন্দের আতিশয্যে পাগলপ্রায় দশা  তখন গোয়ালার।  ভগবানকে দেখেছে সে —- এ সৌভাগ্যের কথা  কাকে বলবে, কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ দেখা গেল তার দইয়ের হাঁড়িগুলো চকচক করে উঠলো , সোনার হয়ে গেল।রাজা গোপাল সিংহ আর ঠিক থাকতে পারলেন না ।তাঁর মদনমোহনের এতসব অলৌকিক কীর্তিকলাপ দেখে তিনি সংজ্ঞাহারা হয়ে গেলেন। আসলে, যাঁর চরণে সব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা , দায় তো সব, তাঁর ওপরই বর্তায় তখন ।তাই মদনমোহন নিজেই কামাল দেগে বর্গী তাড়িয়েছেন সারারাত ধরে। আর তখনই নাকি  যুদ্ধ শেষে মাদল কামানটি  জলে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
” লালবাঁধে দল-মাদল  দুটি কামান ছিল।
তার মধ্যে ৮০মণ বারুদ ভরিল।।
দুইটি কামান প্রভু লইলো দুই বগলে।
দুই হাতে দু-কামানে দিল পলতে জ্বেলে।।
এক কোপে বহু বর্গী  হইল নিধন‌।
কামানের শব্দে মূর্চ্ছা  গেল বহুজন।।”
(মদনমোহনের আদি মাহাত্ম্য, গাইড বুক)

ভক্তের বিপদের সময় ভগবান যে বিপদভঞ্জন হন, সে প্রমাণ দিলেন মদনমোহন। আর , তা জানাবার জন্যই মদনমোহন করেছিলেন দই খেয়ে পয়সা না দেবার লীলা। সেই গোয়ালার নাম ছিলো গোপাম মূরতি।
এখন, সময়টা ১৭৪৮ সাল। বিষ্ণুপুরের রাজসিংহাসনে রাজা গোপাল সিংহদেবের পর রাজা  চৈতন্য সিংহদেব বসেছেন। তিনিও ভক্তিমান  রাজা । এদিকে রাজপরিবারের অপর  সদস্য দামোদর সিংহদেব  সিংহাসন দখল করার  জন্য মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে হাত মেলালেন ।নবাব সাহায্য করলেন ।বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন বাঁকুড়া ।কিন্তু ,লক্ষ্য পূরণ হলো না। জিততে পারলেন না ।  এরপর নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ১৭৫৬ সালে  পলাশীর যুদ্ধে হেরে প্রাণ হারান  ইংরেজদের হাতে। তিনিই ছিলেন   বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব।  সেসময় বাংলার প্রত্যেকটি রাজ্য ইংরেজের করদ্ রাজ্যে পরিণত হল। অর্থাৎ , রাজাদের সকলকেই ইংরেজদেরকে  খাজনা বা কর  দিতে হত। সামন্তরা ইংরেজের তোষামোদকারী  জমিদারে পরিণত হয়েছেন। আবার ইংরেজদের ছত্রছায়ায় সেসময়  উত্থান ঘটলো আরেক  নতুন গোষ্ঠীর….. তাঁরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ।

হাওড়া জেলার কোন্নগরে  বাস করতেন শ্রী সীতারাম মিত্র মহাশয়।  বর্গীদের প্রচণ্ড উৎপাত ,অত্যাচার মাঝেমধ্যেই হয় সেখানে । তাই সেখান থেকে মিত্র মহাশয়  চলে এলেন সুতানটি গ্রামে বা এখনকার কলকাতার বাগবাজারে । এখানে তখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য। রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা।ফলে বর্গীদের উৎপাত ছিল না বললেই চলে । সীতারাম মিত্রের পুত্র  শ্রী গোকুলচন্দ্র মিত্রের ছিল লবণের ব্যবসা। বড় ব্যবসায়ী তিনি ,সেইসাথে অত্যন্ত দয়ালুও ছিলেন । তাঁর আমলে প্রত্যেকদিন হাজার জন অনাথ-আতুড় খাবার পেত। ব্যবসার সূত্রে গোকুল মিত্র কোন ভাবে পরিচিত ছিলেন রাজা চৈতন্য সিংহের সঙ্গে‌। চৈতন্য সিংহদেবের আমন্ত্রণে তিনি বেশ কয়েকবার বিষ্ণুপুর এসেছিলেন। যেবার তিনি  প্রথম দর্শন করেন মদনমোহনদেবকে , সেবারই দর্শন মাত্র মদনমোহনের প্রতি এক অপার্থিব টান অনুভব করেন। মন যেন চাইতে থাকল  মদনমোহনের সান্নিধ্য, তাঁকে সেবা করার সৌভাগ্য। হয়তো বা সে কারণেই গোকুল মিত্র একাধিকবার বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন ।
এক সময় চৈতন্য সিংহদেবের কিছু অর্থাভাব হয় ।গোকুলচন্দ্র বাড়িয়ে দেন  চৈতন্য সিংহদেবের দিকে সাহায্যের হাত। তিনি তিন লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন চৈতন্য সিংহকে‌। তবে গোকুল মিত্র শর্ত একটা রাখলেন যে যতদিন না টাকা ফেরৎ দিতে পারবেন চৈতন্য সিংহ ,ততদিন মদনমোহনদেবকে তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখতে হবে। অর্থাৎ কিনা বন্ধক রাখতে হবে । আসলে সেই যে মিত্র মহাশয়ের  মন বিকিয়ে গেছে  মদনমোহনের পদপঙ্কজে ,এখন এসুযোগে তিনি  নিজের কাছে মদনমোহনকে রেখে দিতে চান ,প্রাণভরে সেবা করতে চান কিছুদিন । আবার,ভক্তবৎসল ভগবান তো প্রেমের কাঙ্গাল চিরকালই। তাঁরও মন হয়েছিল  গোকুল মিত্রের প্রেমসেবা গ্রহণ করে তাঁকে সুখী করতে। ভক্ত যেমন  ভগবানকে সুখ দিতে চায় , ভগবানও তো তেমন তাঁর ভক্তকে সুখী দেখতে ভালোবাসেন। তাই হয়তো বা এমন পরিস্থিতি তৈরী হল।মন  একবিন্দুও না চাইলেও ভাগ্যের পরিহাসে চৈতন্য সিংহদেবকে  বাধ্য হয়ে কুলদেবতা মদনমোহনকে বন্ধক রাখতে হল গোকুল মিত্রের কাছে। রাজা আকুল হয়ে অশ্রু বিসর্জন করছেন দেখে ,  মদনমোহনদেব  সান্ত্বনার পরশ  দিলেন তাঁর প্রিয় চৈতন্য সিংহকে । তিনি পূর্ণ সায় জানালেন  তাঁকে বন্ধক রাখার জন্য।তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে  বন্ধক হয়ে গেলেন বাগবাজারে মদনমোহনদেব ।বাগবাজারে গোকুলধামের মন্দিরের ফলকে লেখা ১৭৬১ সালে শ্রীমদনমোহন জীউ স্থাপিত হয়েছেন। সম্ভবত, ঐ বছরেই বিষ্ণুপুর থেকে এখানে মদনমোহনদেবকে আনা হয়েছিল।
এদিকে এসময় থেকে মল্লরাজাদের সম্পদ ক্ষয় হতে শুরু করে দেয়, পতনের সূচনা হয় রাজত্বের।অভয়পদ মল্লিকের লেখা ‘History of Bishnupur Raj’-এ পাওয়া যায়– ‘ Thus  according to Babu Balindra Nath Singha of Indus , a scion of immediate cause of the decay and downfall were :–1) The Mahratta raids,
2) The famine of 1770,
3) The imposition of crusing land Tax by the     British Government and
4) Family dissensions
He also enumerated some indirect causes such as 5) the adoption of the Vaishnavas and 6) its corollary the construction of costly temples etc.অর্থাৎ, বর্গী বা  মারাঠাদের ক্রমাগত হানা, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ, ব্রিটিশদের খাজনা আদায়, রাজবংশের অন্দরে কোন্দল, বৈষ্ণব ধর্মমত গ্রহণ করায় রাজার আচরণে নীরিহতা আর মন্দির নির্মাণে বহুব্যায় —- এসব কারণের দরুণ মল্ল রাজত্ব ক্ষয় এবং পতনের দিকে যেতে থাকে।
সেসময়  বর্গীরা যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে যেত সেখানকার সব শস্য তছনছ করে দিয়ে , ধানক্ষেত পুড়িয়ে দিয়ে প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে যেত নগর-গ্রাম।  ওদিকে চৈতন্য সিংহদেব আর দামোদর সিংহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল,যুদ্ধ।আবার দুর্ভিক্ষের সময়  অনাহারে ক্লীষ্ট প্রজাদের বাঁচাতে ধর্মপ্রাণ চৈতন্য সিংহদেব দু’হাতে শস্য ,সম্পদ বিলোতে থাকেন। ফলে রাজকোষাগার আকস্মিক ভাবে প্রায় খালি হয়ে যায়। ইংরেজদের কাছে খাজনা বাকী পড়তে থাকে। রাজ্য নিলামে ওঠার পরিস্থিতি তৈরী হয়।এই ভীষণ সংকট কালে অর্থ জোগাড় করে  মদনমোহন বিগ্রহ ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে চৈতন্য সিংহদেবের পক্ষে।

বাগবাজারে গোকুল মিত্র  প্রাণঢালা সেবাপূজা করেন বিগ্রহের।  আদরে-সোহাগে সুখেই আছেন মদনমোহন। গোকুলের বাল্যবিধবা কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়া নিজের পতিরূপে ভজনা করেন মদনমোহনকে।আর মদনমোহনও তাঁর প্রেমে বাঁধা পড়লেন ।একদিন রাত্রে লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে মদনমোহন নিজের চূড়া, বাঁশী খুলে রেখে গেলেন শয্যায় । পরদিন প্রভাতে পুজারীজী মদনমোহনের চূড়া -বাঁশী খুঁজে পাচ্ছেন না। চারদিকে খোঁজ খোঁজ রব। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে লক্ষ্মীপ্রিয়া দেখেন তাঁর শয্যায় তাঁর মাথার বালিশের ওপরে রাখা ওগুলো । এ লীলা দ্বারা মদনমোহন যেন বার্তা দিলেন যে তিনিও লক্ষ্মীপ্রিয়াকে নিজের পত্নীরূপে দেখেন , আর তাই রাত্রে শয়ণে যান লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে।
আর একবার তো ভগবান নিজে সেবক ভৃত্য সেজে তাঁর ভক্তের সেবা করলেন ।গোকুল মিত্র  ভৃত্য মদনাকে ডেকে তামাক সাজিয়ে দিতে বললেন ।ঘটনাক্রমে মদনা সে সময় বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে। আর গোকুল মিত্রের তামাক সেবনের সময় পেরিয়ে যেতে থাকলো। মদনমোহন করলেন কী, নিজে তামাক সাজিয়ে নিয়ে এসে গড়গড়ার নল এগিয়ে দিলেন গোকুল মিত্রের কাছে। গোকুল মিত্র মনের সুখে তামাক টানলেন। পরে মন্দিরের পূজারী দেখলেন মদনমোহন বিগ্রহের হাতে তামাক ও টীকার দাগ। আশ্চর্য হয়ে জানাতে গেলেন মিত্র মহাশয়কে। গোকুল মিত্র নিজে ছুটে এলেন সত্য কিনা পরীক্ষা করতে। সত্যিই তো! পরক্ষণেই মনে পড়লো তিনি তো তামাক দিতে বলেছিলেন ভৃত্য মদনা কে। খোঁজ নিয়ে জানলেন , মদনা তো তখন ভবনে ছিলেনই না, বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে। বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে , সে তামাক কে সেজে এনেছিল আর কেনই বা ঠাকুরের হাতে অমন দাগ।মিত্র মহাশয় আদেশ দিলেন , আর কেউ যেন ভবনে তামাক সেবন না করে এবার থেকে।ভগবানকে ভৃত্য হতে হয়েছে যে কারণের জন্য, সেই কারণটাই তিনি নির্মূল করে দিতে চাইলেন।এভাবে  একের পর এক মধুর লীলা করতে থাকলেন মদনমোহনদেব বাগবাজারে গোকুল ভবনে।

এরপর একদিন চৈতন্য সিংহদেব এলেন তাঁর প্রাণের  বিগ্রহ ফেরৎ নিতে।  তখন সম্ভবত ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ । তিনি পরিবারের সকলের অলংকারের বদলে  টাকা জোগাড় করে বিগ্রহ নিতে এলেন। এদিকে গোকুল মিত্র এতদিনে ভীষণ ভাবে  মদনমোহনের প্রেমে পড়ে গেছেন। বিগ্রহ ছাড়া থাকতে পারবেন না তিনি। তাই ,তিনি টাকার বদলে বিগ্রহ দান করে দিতে  অনেক অনুরোধ-উপরোধ করলেন রাজাকে। কিন্তু, রাজী নন রাজা। শেষে গোকুল  ,ছলে-বলে-কৌশলে বিগ্রহ পাবার জন্য   ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হেস্টিংস সাহেবের কাছে চৈতন্য সিংহের বিরুদ্ধে সময়মত টাকা ফেরৎ না দেবার নালিশ জানিয়ে আরও অনেক টাকা দাবী করে বিগ্রহের নামে  ডিক্রী আদায় করলেন । অত  টাকা দিতে  অসমর্থ রাজা । আলিপুর  আদালতের একতরফা রায় গেল গোকুল মিত্রের দিকে। ব্যাস,  ডিক্রী হয়ে গেলেন বিগ্রহ । তবে থেকে গোকুল মিত্রের বরাবরের সম্পদ হলেন মদনমোহনদেব। তখন মদনমোহনদেব  রাজাকে আশ্বাস  দেন যে প্রতিদিন আরতি ও ভোগের সময় তিনি বিষ্ণুপুরে প্রকট থাকবেন। প্রথম বিষ্ণুপুরের ইতিহাস লেখক শ্রী  ফকির নারায়ণ কর্মকার  তাঁর ‘বিষ্ণুপুরের অমরকাহিনী’ গ্রন্থে লিখেছেন , ‘ তাই নিজের ভাগ্যকে নিজে ধিক্কার দিয়ে সেই অপকৌশলের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁর প্রাণের ঠাকুরকে কলকাতার বাগবাজারে রেখে আসতে বাধ্য হন তিনি। শেষ হয়ে যায় চৈতন্য সিংহদেবের সব আশা ভরসা।বিবাদ বিসম্বাদের মধ্যেই তিনি যে মদনমহনকে ওখানে রেখে এসেছিলেন সেই কথাই সত্য।’  শ্রীমতী বন্দনা বিশ্বাস তাঁর ‘কথা ও কাহিনীতে বিষ্ণুপুর ‘- বইয়ে লিখেছেন—‘বিগ্রহ ফেরতের ব্যাপারে গোকুল মিত্র মোটা টাকা দাবী করলে রাজা অপারগ হন—ব্যাপারটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়, অবশেষে আদালতে গোকুল মিত্রের এক তরফা ডিক্রীলাভ হয়। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক থেকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত প্রায় ৬০জন রাজা বিষ্ণুপুরে রাজত্ব করেছেন, কিন্তু এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি কখনো।’ ‘সাধু গোকুল মিত্রের জীবনী’-তেও  বলা হয়েছে মামলায় জিতেছিলেন গোকুল আর তাই আসল মদনমোহনদেব তাঁর কাছে থেকে যায় কোর্টের আদেশে ডিক্রি হয়ে। “বিচার মতে রাজার ঠাকুর গোকুল ডঙ্কা মেরে নিলা।” আবার এই জীবনী বইয়ে  বলা হয়েছে যে, গোকুল মিত্রই নাকি পূর্ব জন্মে ছিলেন সেই দইওয়ালা,যিনি সিপাহী মদনমোহনকে দই খাইয়েছিলেন। মদনমোহন যখন দইয়ের হাঁড়ি সোনার করে দিয়েছিলেন তখন দইওয়ালা বলেছিলেন, সেসবে তিনি ভুলবেন না, মরণকালে তাঁর মদনমোহনের অভয়চরণ প্রাপ্তি চাই।

“রাজা বলে ভয় নাই জমি দিব আমি।
কোনখানে খেলেন দৈ দেখাও দেখি তুমি।।
বকুলতলায় দৈ খেলেন গোয়ালা দেখাইলো।
গোয়ালার হাড়ি যত সোনা হয়ে গেল।
পায়ে ধরে গোয়ালা কান্দিতে লাগিল।
ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন দেখিতে পাইল।।
গোয়ালা বলে ভুলাও কি হে মদনমোহন ।
মরণকালে দিও প্রভু অভয়চরণ।।”

তবে কোন কোন বইয়ে কিন্তু গোকুল মিত্রের জিতে যাবার কথা লেখা নেই। হেরে যাবার কথা লেখা আছে।মদনমোহন বিগ্রহ  বাগবাজারে রয়েছেন এ কথা  বিষ্ণুপুরবাসীরা অনেকেই মানতে নারাজ। বিষ্ণুপুরে পাঁচালীর আকারে লেখা যেসব ভ্রমণ গাইড পুস্তিকা গুলো বিক্রী হয় , সেগুলোতে ঘটনা অন্য রকম লেখা।’মদনমোহন মাহাত্ম্য’ বইতে লেখা চৈতন্য সিংহ যখন তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে  কুলদেবতা মদনমোহনকে বাগবাজার থেকে আবার  বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে আনতে যান, তখন গোকুল মিত্র  বিগ্রহ ছাড়তে নারাজ। তিনি মিথ্যা দলিল দেখিয়ে জানালেন যে, মদনমোহন তো রাজা বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁর কাছে আগেই ।  রাজা মনের দুঃখে চোখের জল ফেলে ফিরে যাচ্ছিলেন , সেসময় তাঁকে স্বয়ং মদনমোহন আদেশ দেন ,”হতাশ না হয়ে বরং আলিপুর কোর্টে গোকুল মিত্রের বিরুদ্ধে মামলা করো। তোমার হয়ে আমি পাগড়ী পরা উকিল সেজে সওয়াল-জবাব করবো।”  মদনমোহনের পরামর্শ মতো রাজা আপিল করলেন আদালতে ।বিচারের দিন মদনমোহন এসে দাঁড়ালেন উকিলের বেশে ।ম্যাজিস্ট্রেট নাম জিজ্ঞাসা করলে উকিল বলেন যে , তাঁর নাম মদন আর বিষ্ণুপুরের রাজার অধীনে তিনি বেতনভুক কর্মচারী। উকিল মদনের ক্ষুরধার প্রশ্নের সামনে অপ্রস্তুত , অপারগ গোকুল মিত্র হেরে গেলেন। কোর্ট আদেশ দিল বিগ্রহ ফিরিয়ে দিতে ।
গোকুল মিত্র একই রকম দেখতে একটি নকল বিগ্রহ তুলে দিলেন রাজার হাতে। চিনতে না পেরে নকল বিগ্রহ নিয়েই ফিরলেন রাজা। কিন্তু নদীর ধার থেকে এক বালক জোরে হেঁকে বলে যে , ” রাজা , তুমি তো নকল বিগ্রহ নিয়ে ফিরে যাচ্ছো।” সে বালক নাকি  স্বয়ং মদনমোহনই ছিলেন। রাজার টনক নড়লো। আসল মদনমোহন ফেরত নিতে আবার এলেন বাগবাজার।অভিযোগ জানালেন । গোকুল মিত্র বললেন,” আপনি বরং এক কাজ করুন। পাশাপাশি তিনটি বিগ্রহ রাখা হবে। চিনে নিয়ে আপনারটি আপনি নিয়ে যান।  আমার কোন আপত্তি নেই ,সবেতেই রাজী।” তিনটিই এক রকম দেখতে।’মদনমোহন মাহাত্ম্য কথা’-য় বলা হয়েছে এসময় মদনমোহনই নাকি  উপদেশ করেন, “যে বিগ্রহের বামাঙ্গ ভিজে থাকবে ও নাকের ওপর সাদা মাছি বসে থাকবে সেটি আমি ।” ঘটলও তাই। রাজা আসল বিগ্রহকে তুলে নিলেন। মদনমোহনদেব  ফিরে এলেন বিষ্ণুপুর। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে সেবাপূজা শুরু হল মদনমোহনের আবার‌। বিষ্ণুপুরের মত অনুযায়ী, যখন মদনমোহন চলে আসেন কলকাতা ছেড়ে, তখন তিনি গোকুল মিত্রকে  কথা দিয়েছিলেন এই বলে ,”ওহে গোকুল,  তুমি কেঁদো না। প্রতিবছর অন্নকূট উৎসবের সময় আমি তোমার কাছে বারো দন্ড থাকবো কথা দিচ্ছি ।”
কুলদেবতাকে কেন্দ্র করে বিষ্ণুপুরে মহোৎসাহে শুরু হল দোলযাত্রা, ঝুলন উৎসব ,রাসউৎসব ইত্যাদি।বিষ্ণুপুর পূর্ণ হল হর্ষে-আনন্দে।  ১৮০২খ্রিষ্টাব্দে চৈতন্য সিংহদেবের মৃত্যু হয় ।  তার আগের বছর অর্থাৎ ১৮০১-এ তিনি পৌত্র মাধব সিংহকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন।বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা তথা  মল্লরাজাদের রাজপুরোহিত বংশের বিশিষ্টজন শ্রী মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র জানালেন, বিতর্ক এড়াতে অনেক লেখকই আসল ঘটনা না জেনে , অনুমান ভিত্তিক লিখেছেন। ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। তিনি বলেন , তাঁদের পূর্বপুরুষরা বলতেন যে আসল মদনমোহন বিষ্ণুপুরে ফেরৎ আসেন। বিষ্ণুপুরেই নাকি  বিরাজ করছেন তিনি। (এ প্রবন্ধ লেখায়  অনেক তথ্য ও  ছবি দিয়ে সাহায্য করেছেন  মৃত্যুঞ্জয় মহাশয়। )

বাগবাজারে গোকুল মিত্র  মদনমোহনদেবের পাশে রাধিকার এবং ললিতা-বিশাখার বিগ্রহদের স্থাপন করলেন রাস উৎসবের সময় । সেরাত্রে আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার  জীবনাবসান হল। বলা হয় যে , শ্রীরাধা বিগ্রহের মধ্যেই নাকি গোকুল মিত্রের কন্যার আত্মা বিরাজিত রয়েছে।
মদনমোহনদেবের  জন্য বড় মন্দির ,  রাসমঞ্চ,ঝুলনমঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন গোকুল মিত্র।  সমস্ত সম্পত্তি তিনি  তাঁর জামাই শ্রীমদনমোহনদেবের নামে করে দিয়েছেন ,যাতে তাঁর অবর্তমানে মদনমোহনের সেবা পূজায় কোন বিঘ্ন না ঘটে। এখনও পর্যন্ত উত্তর কলকাতা চিৎপুর রোডে রাজবল্লভ পাড়ায় গোকুল মিত্র লেনে মদনমোহন তলা নামে সুপ্রসিদ্ধ মদনমোহন মন্দির এলাকা ।গোকুলধাম নামে বিখ্যাত সেই সুবিশাল মন্দির। রাজবল্লভ পাড়ার মোড়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী বাড়ি ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ডানদিকে মন্দির পরে ।মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতেই বাঁ দিকে বিশাল চওড়া শ্বেত পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে  দোতলায় উঠে যেতে হয়। সেটি দর্শনার্থীদের ব্যবহারের জন্য সিঁড়ি। উপরে দোতালাতে অবস্থান করেন শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনদেব। আর যদি সিঁড়িতে  না উঠে প্রবেশদ্বার দিয়ে সোজা এগিয়ে আসা হয় , তবে নাটমন্দির চোখে পড়ে। এখানে মদনমোহনদেবের জন্য নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। এই  চত্বরেই প্রতিদিন আগে অনাথ-আতুরদের প্রসাদ ভোজন করানো হত।নাটমন্দিরকে ঘিরে আঙ্গিনার ওপারে তিনদিকে ঠাকুর বাড়ীর দালান।একদিকে ভোগের রন্ধনশালা ,আর একদিকে মন্দিরের অফিসঘর ,এসব । আর নাটমন্দিরের ডানদিকটার পুরোটা জুড়ে বিশাল  ঝুলনমন্দির। মার্বেল বাঁধানো ঝুলন মঞ্চ।  মঞ্চের মধ্যে  দোলনা সিংহাসন।ঝুলনের সময় এখানেই ঝুলন উৎসব হয় বড় করে।
উপরে  দোতলায় মদনমোহনদেবের রাজত্ব । সিঁড়ি দিয়ে উঠেই  ডানদিকে দরবার হল তাঁর। দরবার হলের শেষপ্রান্তে সিংহাসনে শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন বিরাজ করছেন । সাথে আছেন ললিতা-বিশাখা সখীর বিগ্রহ, শালগ্রাম শিলা আর ছোট্ট গোপালসোনা। নিরাপত্তার কারণে  ব্যবধান দেওয়া লোহার গ্রিলের । সব মন্দিরে যেখানে বিগ্রহ অবস্থান করেন সেখানে সামনেই ভোগ লাগানো হয় , মদনমোহনের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয় । তাঁর ভোগের ঘর আলাদা, বিশ্রামের ঘরও আলাদা।ভোগের সময় সিংহাসন থেকে নেমে যান ভোগমন্দিরে। সেখানে ভোজন করে আসেন বিশ্রাম কক্ষে। বারান্দা পার করে বিশ্রাম ঘর। বিশ্রাম করার পর এখানেই তাঁকে শৃঙ্গার করানো হয় ।নতুন সাজে সজ্জিত  হলে আবার প্রবেশ করেন দরবার হলে। সিংহাসনে আরোহন করেন এরপর।আর, তিনি কখনও ফেরৎ যাত্রা করেন না অর্থাৎ একমুখী হয়ে গমন করেন সবসময়,একই পথে উল্টো দিকে হাঁটেন  না।
দোতালায় অপরদিকে  ভাঁড়ার-ঘর(স্টোর রুম)। এত বড়  ভাঁড়ার ঘর সমগ্র কলকাতায় আর নাকি নেই। তারপাশে অতিথিদের  থাকার ঘর । এরপরে আবার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামা। সেই সিঁড়ি দিয়ে মদনমোহন নামেন ঝুলনের সময় , রাসের সময়।  মন্দির থেকে  বেড়িয়ে বাঁ দিকে আরো একটু এগিয়ে গেলেই রাস্তার ওপরে পাকা রাসমঞ্চ তৈরী আছে। ।রাসের সময় উৎসব হয় । বিগ্রহদের নিয়ে যাওয়া হয় তখন সেখানে। এছাড়া  সারা বছরই উৎসব হয় গোকুলধামে। বড় করে পালিত হয়  অন্নকূট উৎসব। অন্নকূটে নীচে একতলায় ভক্তরা কাপড় পেতে ধরেন আর ওপরের দোতলার বারান্দা থেকে মদনমোহনদেবের অমৃতপ্রসাদ ফেলা হয় ।ভক্তরা আকুলতাসহ হুড়োহুড়ি করে সংগ্রহ করেন প্রতিটি কণা প্রসাদের।
বর্তমানে বাগবাজারে মদনমোহনদেবের পালাদার সেবাইত হলেন শ্রী মাধবমিত্র। ১৫ই এপ্রিল ,২০১৯ থেকে ১৩ই এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত মদনমোহনের সেবার ভার তাঁর। আর , বিগ্রহ অর্চন-বন্দন-পূজার ভার শ্রী সুব্রত পূজারী মহাশয়ের ওপর। তিনি হলেন ধরণী মহাপাত্রের সপ্তম অধস্তন পুরুষ। মল্লরাজারা ‘পূজারী’ উপাধি দিয়েছিলেন তাঁদের।  পূজারী মহাশয়  জানালেন , যখন মদনমোহন বাগবাজারে চলে আসেন, তখন তাঁর পূর্বপুরুষরাও  বিষ্ণুপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন মদনমোহনদেবের সেবা করবেন বলে। সেই প্রথম দিন থেকে তাঁদের বংশের পূজারীরাই মদনমোহনদেবের পূজার্চনার দায়িত্বে। মদনমোহনই নাকি স্বয়ং গোকুল  মিত্র কে আদেশ দিয়েছিলেন কেবল এই বংশের হাতেই তিনি পূজা নেবেন। ফকির নারায়ণের লেখাতেও একই কথা পেলাম–‘ মিত্র মহাশয়ের প্রতি স্বপ্নাদেশ হয়। স্বপ্নে  মদনমোহন তাঁকে বলেন ,”আমার সেবাইত, পুরোহিত ব্যতীত অপরের হাতে সেবা-পূজা নিয়ে আমার তৃপ্তি হয় না ।তাদের অভাবে আমি উপবাসী আছি। আমার স্বপ্নাদেশের কথা রাজাকে জানিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আয়‌। নইলে এইরকম উপবাসী অবস্থাতেই আমাকে দিন কাটাতে হবে।”…. সবকিছু শুনে রাজা কাঁদতে থাকেন। দ্বিরুক্তি করেন না ।সেবাইত, পুরোহিতকে পাঠিয়ে দেন তাঁদের সঙ্গে‌।’
সুব্রত পূজারী মহাশয় জানালেন, বাগবাজারের বিগ্রহই আসল মদনমোহন। তিনটি বিগ্রহের অবশিষ্ট বিগ্রহটি বর্তমানে তাঁদের ব়ংশে রয়েছেন। এখনও নানান অলৌকিক লীলা করেন মদনমোহন। দিনে-দুপুরে-রাত্রে মদনমোহনের  চলার নূপুরের ধ্বনি শোনা যায় , হঠাৎ  ম-ম করে ওঠে তাঁর অঙ্গগন্ধ  নির্জন বারান্দায়।
শ্রীমদনমোহনের অলৌকিক লীলা নিয়ে প্রচুর বই প্রকাশ হয়েছে । সেগুলির কোন কোনটি বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা বা বিষ্ণুপুর রাজবংশের ঘনিষ্ঠ কবিরা লিখেছেন , আবার কোনটা রচনা করেছেন গোকুল মিত্রের দিকের কবিরা। তাই সেসব লেখাতে পক্ষপাতিত্বের একটা ব্যাপার  লক্ষ্য করা যায় । মূল বিগ্রহ যে প্রকৃত কোথায় অবস্থিত, বাগবাজারে নাকি বিষ্ণুপুরে এটা নিয়ে একটা চোরা দ্বন্দ এখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে।বিষ্ণুপুর থেকে বলা হয় মদনমোহনদেব বিরাজ করছেন বিষ্ণুপুরেই। আর,বাগবাজার থেকে বলা হয় মূলবিগ্রহ রয়েছেন বাগবাজারে। তবে হ্যাঁ , বর্তমানে মদনমোহন যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, তিনি যে দল-মাদল কামান দেগেছেন আর গোকুল মিত্রের কাছে তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে বন্ধক ছিলেন এ কথা কিন্তু সত্য—–প্রতিটি গ্রন্থেই স্বীকৃত হয়েছে । ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’গ্রন্থে ড. সুকুমার সেন লিখেছেন –“অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্থানীয় দেবদেবী ,ব্যক্তি বা ঘটনা বিশেষ ও দৈব-দুর্বিপাক লইয়া ছড়া গান রচিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলি আমাদের হস্তগত হইবার পূর্বেই লুপ্ত হইয়াগিয়াছে ।…..একাধিক কবি রচিত মদনমোহন বন্দনা  পাওয়া গিয়াছে। ইহার বর্ণনীয় বিষয় হইতেছে  মদনমোহন কর্তৃক দল-মাদল কামান দাগিয়া বিষ্ণুপুর হইতে বর্গী বিতরণ এবং চৈতন্য সিংহ কর্তৃক কলিকাতায় গোকুল মিত্রের  নিকট মদনমোহন বিগ্রহ বন্ধক রাখা।”
মদনমোহন সর্বদা তাঁর ভক্তের সঙ্গে থেকেছেন সেবক রূপে, ভৃত্য রূপে, বন্ধু রূপে ।তা সে বিষ্ণুপুরের ভক্তিমান রাজা গোপাল সিংহ ,চৈতন্য সিংহই হন বা বাগবাজারের ধনাঢ্য ,দানবীর ,ভক্তমহাজন গোকুল মিত্রই হন না কেন। ভগবান যে তাঁর ভক্তের পরম সুহৃদ, পরম বান্ধব, পরম হিতৈষীজন এই সত্য সংস্থাপিত হয়েছে বারে বারে ,নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ মদনমোহনদেবের নানান অলৌকিক লীলায়।
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলতেন , কিছু চাইতে হলে তিন জনার কাছে চাইতে হয়–দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী, খড়দহের শ্যামসুন্দর আর বিষ্ণুপুরের মদনমোহনের কাছে।
মদনমোহনদেবের অলৌকিক কাহিনী শুনে, তাঁর মনোলোভা চিতচোর সৌন্দর্যের কথা জেনে এখনও পর্যন্ত ভক্তরা তাঁকে দর্শন করতে ছুটে যান কলকাতার বাগবাজারে আর  বিষ্ণুপুরের মন্দিরে। আসল বিগ্রহ যেখানেই থাকুন না কেন , উভয় স্থানে গিয়েই ভক্তরা অনুভব করতে পারেন শ্রীশ্রীমদনমোহনদেবের উপস্থিতির  আবেশ ও  তাঁর লীলার দিব্য অনুভূতি। আসলে, ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ভগবান যে সকল স্থানেই প্রকট হতে একান্ত ভাবে ভালোবাসেন….. তাঁর অবস্থিতি তো সর্বস্থানে!
জয় শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনদেব।

সমাপ্ত

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

শান্তিপুরের শ্রীশ্যামসুন্দরের অলৌকিক লীলামাধুরী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

আহা ! শান্তিপুরের আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির শ্রীশ্যামসুন্দরের যেমন চিত্তাকর্ষক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য তেমনই তাঁর অপূর্ব সব লীলা । পুত্র যেমন পিতার কাছে আবদার করে, বায়না করে তেমনভাবেই শ্যামসুন্দর নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ রূপে করেছেন এটা-সেটার দাবি। কখনো শ্রীআনন্দকিশোর গোস্বামীর কাছে কখনও বা শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের কাছে। প্রসঙ্গতঃ জানাই , আনন্দকিশোর গোস্বামী ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের পিতাপ্রভু ।

অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র শ্রীদেবকীনন্দন ছিলেন আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরজীউ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হন স্বয়ং অদ্বৈত, তাঁর পুত্র বলরাম এবং পৌত্র দেবকীনন্দন— তিনজনের দ্বারা মিলিত ভাবে। দেবকীনন্দন নির্দেশিত নিয়ম মেনেই এখনও সেবাপূজা চলে। বিশ্ববিশ্রুত সিদ্ধ মহাপুরুষ ,প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই বংশেই জন্মগ্রহণ করেন‌ বলে এই বাটীকে ‘বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাটী’-ও বলা হয়।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তখনও ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করেননি। মনে-প্রাণে তিনি ভীষণ ভাবে ব্রাহ্মধর্মে বুঁদ হয়ে আছেন । কলকাতাতে থেকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার চালাচ্ছেন জোরকদমে । মাঝে মধ্যে শান্তিপুরে যান । আর যখনই শান্তিপুরে যান তখনই শ্যামসুন্দর তাঁর সম্মুখে প্রকট হন। প্রেমচাহিদার যেন শেষ নেই বিজয়কৃষ্ণের কাছে শ্যামসুন্দরের । ওদিকে ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণ নীতিগতভাবে মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী থাকলেও , কোন অজ্ঞাত কারণে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ , টান অনুভব করেন শ্যামসুন্দরের প্রতি। আর , তাই শ্যামসুন্দরের আবদারও মিটিয়ে চলেন একের পর এক।

একবার নটখট্ শ্যামসুন্দর বললেন , “শোন বিজয় ! আমার দেখ না বাঁশি নেই ! একটা বাঁশী বানিয়ে দে না !” এমন ভাবে শ্যামসুন্দর বললেন, যে বুকে গিয়ে বাজলো বিজয়কৃষ্ণের সে কথা । তিনি বাংলাদেশের ঢাকাতে অর্ডার দিয়ে খুব সুন্দর একটি বাঁশি প্রস্তুত করিয়ে দিলেন। বাঁশি পেয়ে বড় আনন্দ পেলেন বিগ্রহ শ্যাম।

আবার একবার শ্যামসুন্দর বললেন , “বাঁশী তো দিলি , এবার চূড়াটাও গড়িয়ে দে। বাঁশি-চূড়া না থাকলে কী সাজ সম্পূর্ণ হয়, বল !” শ্যামসুন্দরের বলার ঢঙে হেসে ফেললেন বিজয়কৃষ্ণ । মনটা কোমল হয়ে গেল যেন । স্নেহব্যথা পেলেন চিনচিনে এক । তিনি পরদিনই ঢাকায় সংবাদ পাঠিয়ে চূড়ার অর্ডার দিলেন । বেশকিছুদিন পর ঢাকা থেকে এল চূড়া । বাঁশি আর চূড়ার সাজে শ্যামসুন্দরের সুন্দর সাজ এমন সুন্দর হল যে নয়ন ফেরানো যায় না । কিন্তু, না , শ্যামসুন্দরের মনের ইচ্ছা অন্য । তিনি বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ নিয়ে হাজির । অনুযোগের সুরে বললেন , “চূড়া তো দিলি , ভালো হয়েছে। কিন্তু , আমার মনোমতো হয়নি।” বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “কেন , কি রকম হলে তোমার মনোমতো হবে শুনি !” শ্যামসুন্দর বায়নার মত করে বললেন , “আমার সোনার চূড়া চাই। রূপার চূড়া নেব না ।”

বিজয়কৃষ্ণ বললেন অবাক হয়ে, “সে কী কথা ! আমি সোনার চূড়া কোথায় পাবো ! অত টাকা আছে নাকি আমার !কোথায় পাব টাকা !” শ্যামসুন্দর বললেন, “রাঙ্গা ঠাকুরাণীর অনেক টাকা আছে, জানিস তো ! তুই আমার নাম করে বল , দেখবি টাকা দেবে ।”

রাঙ্গা ঠাকুরাণী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাকিমা ছিলেন । তাঁকে বিজয়কৃষ্ণ সব জানালেন । তিনি শুনেই আনন্দে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না । শ্যামসুন্দরের মুখে তাঁর নাম ! শ্যামসুন্দর নিজে যেচে তাঁর থেকে সেবা নিতে চেয়েছেন । এমন সৌভাগ্যও তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করেছিলো, আহা ! পুলকিত , রোমাঞ্চিত হলেন তিনি । অতি শীঘ্র টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন বিজয়কৃষ্ণকে । সে টাকা থেকে রূপোর চূড়ায় সোনার পাত বসিয়ে সোনার চূড়া বানানো হল। অপূর্ব দর্শন রূপোর বাঁশি আর সোনার চূড়ায় সেজে শ্যামসুন্দরের যে মনোহারী, মনাকর্ষক , মুগ্ধকর সাজ হল তা ভাষায় বর্ণনার অতীত । তিনি নিজেও অনুধাবন করলেন যে , এরূপ দেখলে বিজয়কৃষ্ণও তাঁর প্রেমে পরে যাবেন । তাইতো বিজয়কৃষ্ণের কাছে এবার বললেন, “হ্যাঁ রে, দিলি তো চূড়া-বাঁশী । এবার একটু দেখবি না আমায় এসব পরে কেমন লাগছে ! যা, মন্দিরে যা, দেখ আমায়।”

বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “বা-রে ! আমি না ব্রাহ্ম! মন্দির-টন্দিরে আমায় যেতে নেই জানো না ! ওসব দেখতে নেই।”

শ্যামসুন্দর—”তাতে কী ! ব্রাহ্ম না হয় হলিই। দেখতে দোষ কী । আর ব্রাহ্ম তো তুই আমার ইচ্ছেতেই হয়েছিস । আমিই বানিয়েছি ব্রাহ্ম তোকে।”

শ্যামসুন্দরের কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণ চুপ করে রইলেন । পরে একসময় মন্দিরে গিয়ে দর্শন করে এলেন শ্যামসুন্দরকে। সত্যিই শ্যামসুন্দরের সৌন্দর্য দর্শনে মন যেন কেমন করে উঠল তাঁর।বোধহয় ইচ্ছে হল একবারটি নিজের কোলে করার, বক্ষে ধরে নেওয়ার ; শ্যামসুন্দরের ওই রাতুল চরণে মস্তক স্পর্শ করাতে ইচ্ছে হল আত্মনিবেদনের ভাব নিয়ে।

ঠিক এমনই ঘটনা আবারও একদিন হল। বিজয়কৃষ্ণের মনে হল যেন কেউ নূপুর পরে হাঁটছে। তিনি বেরিয়ে এলেন । নূপুরের ধ্বনি যেদিকে, সেদিকে এগিয়ে গেলেন। মনে তাঁর দোলা দিয়েছে, এ ধ্বনি শ্যামসুন্দরের চরণের নূপুরের না তো ! কারণ, মাঝেমধ্যেই তিনি শ্যামসুন্দরের নিক্কণের ধ্বনি পান। তাঁর পিতা-মাতা বা পরিবারের অনেকেই পান । শ্যামসুন্দর নিজের উপস্থিতি জানান দেন এভাবে। তাই আজ বিজয়কৃষ্ণ নূপুরের ধ্বনি শুনেই কোন যেন অমোঘ টানে চলে গেলেন শ্যামসুন্দরকে দেখবেন বলে বা ধরবেন বলেই হয়তো বা ।

হ্যাঁ , শ্যামসুন্দরও আজ যেন বিজয়কৃষ্ণের জন্যই রূপের ফাঁদ পেতেছেন । বিজয়কৃষ্ণ দেখলেন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে শ্যামসুন্দর । দুষ্টুমির ঝলক তাঁর আখির প্রান্তে । তাঁর রূপ দেখে বিজয়কৃষ্ণ ক্ষণিকের জন্য বিহবল হয়ে গেলেন। আর অন্তর্যামীর দেরী হল না অন্তর পড়তে বিজয়কৃষ্ণের । বিদ্যুতের ঝলকের থেকেও তাঁর অনুধাবন ক্ষমতা অতি তীব্র, অতি দ্রুত যে। তখন শ্যামসুন্দরের মনের ভাবখানা এমন যে কেমন ফাঁদ পেতেছি আমি, দেখলি তো ! কেমন ধরা পড়লি সে ফাঁদে, বল ! আর সেকারণেই ছিল দুষ্টুমির ঝলক নট্‌খট্‌ নওলকিশোর শ্যামসুন্দরের নয়নের কোনায়। কন্ঠে তিনি দুষ্টুমির সুর করে বললেন, “ বল তো , এবার আমায় কেমন দেখছিস ?” স্বগোতক্তির ন্যায় বিজয়কৃষ্ণের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “অতি সুন্দর তুমি।” পরক্ষণেই বিজয়কৃষ্ণের একটা কথা মনে এল, তিনি বলে ফেললেন তা আপনমনে —-”আচ্ছা, একটা কথা বলো তো ! আমায় দর্শন দিয়ে এত কৃপা করার ইচ্ছে যখন তোমার , তাহলে কেন এমন করে ব্রাহ্ম করলে আমায়?”

শ্যামসুন্দর আকর্ণ-বিস্তৃত মধুময় হাসি হেসে বললেন, “জানিস, অলংকার ভেঙ্গে আবার গড়ালে আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয় তা।” বিজয়কৃষ্ণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন এ উত্তর পেয়ে । শ্যামসুন্দরও অন্তর্ধান করলেন সেই মুহূর্তেই , আসল কাজ করা হয়ে গেছে এই মন নিয়ে।

শ্যামসুন্দর নিজের প্রিয় পাত্র বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগও করতেন । একবার পূজারী ভোগের সময় জল দিতে ভুলে গেলেন। শ্যামসুন্দর বাচ্চা ছেলেদের মতো এসে বিজয়কৃষ্ণকে বললেন, “দেখ বিজয়, তোদের পূজারী কেমন ! মধ্যাহ্নভোগে পারস করেছে আর জল দিতে ভুলে গেছে । বলতো খেতে বসে জল না দিলে হয় !” তখন বিজয়কৃষ্ণ পূজারীকে খানিকটা তিরস্কার করেই ঘটনা জানালেন সব। আর যেন এমন ভুল না হয় সাবধান করলেন।

আবার অন্য একটা দিনের কথাও জানাই । মন্দিরে চুরি করল এক চোর । শ্রীরাধারাণীর মুকুটটি বড় ভালো লাগায় হয়তো বা লোভ সামলাতে না পেরে সেটি নিয়ে গেল। তবে পরে নিজের ভুল বুঝে অনুতাপানলে জ্বলে ফেরত দিতে চাইলো । কিন্তু, আর তো উপায় নেই গর্ভমন্দিরে ঢুকে রাধারাণীর মস্তকে মুকুট পরিয়ে দেবার । ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে । তাই করলো কী , মুকুটটি মন্দির চত্বরেই একটু আড়াল করা স্থানে ফেলে গেল। মুকুটের খোঁজ চলছে এদিকে । পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই । তখন শ্যামসুন্দরের শ্রীরাধিকা বিজয়কৃষ্ণের কাছে প্রকাশিত হলেন । সে সময় আসনে বসে ধ্যান করছেন বিজয়কৃষ্ণ। শ্রীরাধিকা মুকুটের অবস্থান বলে দিলেন । বিজয়কৃষ্ণ তা সকলকে জানালেন। সত্যিই সে স্থানে পাওয়া গেল মুকুট।

ভক্তিপূর্ণ প্রণাম পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করি এহেনো সুন্দরের সুন্দর শ্যামসুন্দর বিগ্রহকে ও যাঁর সঙ্গে তিনি এমন মধুময় লীলা করেছেন সেই শ্রদ্ধেয় প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

নিত্যানন্দ এয়োদশী কেন এত মহিমাময় ? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

বঙ্গদেশের বেশিরভাগ রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের দু’পাশে আমরা দু’বাহু উর্দ্ধে প্রসারিত করা নিতাই-গৌরের মূর্তি দেখতে পাই । প্রায় সকলেই জানি গৌর  অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব। কিন্তু নিতাই  বলতে বুঝি গৌরের দাদা বা ভাই স্থানীয় কোন বিশেষজন। কারণ, প্রচলিত প্রবাদ বাক্য প্রায় সকলেরই জানা– “নিতাই-গৌর দুই ভাই , হল এক ঠাঁই।”  যদি প্রশ্ন করা হয় , আচ্ছা তাঁদের মধ্যে গৌর কে আর কোনজনই বা নিতাই। তাহলে কয়জন যে সঠিক উত্তর দিতে পারব সে সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ।বলবো হয়ত, দু’জনেই তো একই রকম দেখতে,তাই ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক । হ্যাঁ ,খুবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক এ কারণে যে, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর এই প্রায় পাঁচশো বত্রিশ বছরের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যত চর্চা হয়েছে তার সিকি ভাগও নিতাই বা নিত্যানন্দকে নিয়ে হয়নি । যত গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে রচিত হয়েছে , পৃথিবীর ইতিহাসে কোন বিশেষ চরিত্র নিয়ে এত গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি। অথচ, যে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে এত লেখালিখি, যাঁর ভক্তি আন্দোলন সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে দূর মহাদেশে প্রভাব ফেলেছে—-সেই তিনি নিজমুখে শ্রীরাঘব পণ্ডিতের কাছে স্বীকার করেছেন , “এই নিত্যানন্দ যেই করায় আমারে।সেই করি আমি এই বলিল তোমারে।।”(চৈ.ভা.অন্ত্য,৫) নিত্যানন্দ যদি না থাকতেন তাহলে শ্রীচৈতন্যদেবকে জগত জানতে পারতো না। ভক্তি আন্দোলন হতই না । যখন মন্দিরে নিত্যানন্দ বিগ্রহ স্থান পেয়েছেন, পূজা পাচ্ছেন ,তখন তাঁর পূজিত হওয়ার কি কারণ হতে পারে সে সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ওঠাটা খুব যুক্তিসংগত। তবে তা কিন্তু অনেকাংশে হয়নি বললেই চলে। কারণ সেই একটাই—তাঁর সম্পর্কে আলোচনা কম। অথচ ,এই নিত্যানন্দই ছিলেন মধ্যযুগের বঙ্গদেশে সংঘটিত ধর্মবিপ্লবের অন্যতম কাণ্ডারী। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব প্রদর্শিত প্রেমভক্তি-ধারার ভগীরথ । মধ্যযুগীয় মানবমুক্তির অগ্রদূত শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের  অভিন্ন আত্মা নিত্যানন্দ । চৈতন্যদেব ও  নিত্যানন্দের যৌথ সংকল্প ও প্রয়াসের সার্থক প্রতিচ্ছবি হল প্রেমভক্তি আন্দোলন। চৈতন্যের ইচ্ছার রূপকার হলেন নিত্যানন্দ।যা নিমাই চেয়েছেন, নিতাই  করেছেন তা বাস্তব। নিমাই নামপ্রেম  এনেছেন আর অকাতরে তা বিলিয়েছেন নিতাই।নিমাই-নিতাইয়ের লোকহিতৈষণা ব্রতেই  নবযুগের সূচনা সম্ভব হয়েছে । ভারতবর্ষের প্রথম সাম্যবাদী সমাজ স্থাপিত হয়েছে নিত্যানন্দরই পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতায় । ধর্ম সংগঠনের মাধ্যমে গণ সংগঠন গড়ে উঠেছিল নিত্যানন্দেরই নেতৃত্বে। চন্দ্র প্রকাশ হতে যেমন , সূর্যের আলো লাগে , ঠিক তেমন গৌরচন্দ্র প্রকাশ হত না যদি না নিতাই সূর্য থাকতো । আর , একথা অত্যুক্তি বা অতিকথন ও অতিরঞ্জন নয় । কেন? তা আমরা আজ এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আলোচনা করার চেষ্টা  করবো।  ৩রা ফেব্রুয়ারি, মাঘী শুক্ল ত্রয়োদশী তিথিতে নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর। এই সুদীর্ঘ কালের ব্যবধানে আজও যে তিনি কতখানি প্রাসঙ্গিক তা জানবো ।

ইতিহাসের খাতে নিতাই-নিমাই দুটি হৃদয়ধারা গঙ্গা-যমুনার মত পারস্পরিক সৌহার্দ্য ,ভ্রাতৃত্ব ,সাহচর্য্যকে  সম্বল করে নিরবধি বয়ে গেছে নির্দন্ধ, নিঃস্বার্থ ভাবে ।একে অপরের প্রতি কী সুগভীর টান,ভালোবাসা,অন্তরঙ্গতা — যা ইতিহাসে বিরল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, “মুঞি নিত্যানন্দের দাস— একথা প্রতিদিন মুখে যে একবার বলে,আমি তার হয়ে যাই।” আবার, নিত্যানন্দ বলেছেন, “ যে দিনান্তে অন্তত একবার ‘হা গৌরাঙ্গ’ বলে ,আমি তার দাস হয়ে যাই।” নিতাই-নিমাই দু’জনারই জীবনের এক লক্ষ্য, এক অভীপ্সা— পতিত উদ্ধার করা ,দীন-দুঃখী- দরিদ্র-দুর্বলদের মুখে হাসি ফোটানো।

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল অদ্ভুত জনাকর্ষিণী ,লোকমোহিনী শক্তি। মানুষের মন যে কী ভাবে মমতাভরা ব্যবহার দিয়ে জয় করা যায়, তা যেমন তিনি জানতেন ,তেমনি নিজ ব্যক্তিত্বগুণে সংগঠন কার্য্য পরিচালন পদ্ধতিও তাঁর অজানা ছিল না ।আর ,সে কারণেই তাঁরই অনুপ্রেরণায় শ্রীচৈতন্যদেব কীর্তনকে গণসঙ্গীতের রূপ দিয়ে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  নিত্যানন্দ নদীয়াতে আসার আগে পর্যন্ত কীর্তন ঘরের মধ্যে করা হত।নিত্যানন্দ পরামর্শ দিয়ে কীর্তনকে খোলা আকাশের নীচে পথে বের করে আনালেন ।আকাশে বাতাসে হিল্লোল তোলা কীর্তনের ভাব,আবেগ,ধ্বনি,সুর ,অনুরণন ক্রমে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করলো। সর্বস্তরের মানুষ সমবেতভাবে গলা মেলানোয় তা সংকীর্তনের রূপ নিল।  গণবিপ্লবের মাধ্যম  হয়ে উঠল ধীরে ধীরে এই সংকীর্তনরূপ গণসংগীত।  সকল শ্রেণীর মানুষ শামিল হতে থাকলেন সেই সংকীর্তনরত  গণজোয়ারে। ভেদ-ভাবের ভাবনা ভুলতে থাকলো মানুষ। জাতের বিচার করে নয় , ভক্তির গভীরতায় একে অপরকে প্রণাম করতো। ফলে দেখা গেল ব্রাহ্মণ হয়েও চন্ডাল ভক্তের পদধূলি নিয়ে মাথায় দিচ্ছে নিজে। অসাম্য দূর হল।অনাথ-আতুর-অবহেলিতরা সমাজে  হৃত সম্মান ফিরে পেতে থাকলেন। নিত্যানন্দ দেখালেন ধর্ম কখনো বিদ্বেষ তৈরি করে না , তৈরী করি আমরাই।ধর্ম তো আশ্রয় দেয় , ধারণ করে আমাদের। মানুষের সাথে মানুষের সম্মিলন করায়  ধর্ম।  এভাবেই সেদিন থেকে রক্ষণশীল সমাজের স্মার্ত-বিধি-বিড়ম্বনার অবসান সূচীত হয়েছিল। জাতিভেদের অবসান হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম সকলকে ধারণ করে সার্বজনীন মানব ধর্মে পরিণত হয়েছিল। “বৈষ্ণবের জাতি বুদ্ধি যেই জন করে। কোটি জন্ম অধম যোনিতে ডুবি মরে”।(চৈ.ভা.)

তবে পথে-ঘাটে এমন  সংকীর্তনের ফলও হয়েছিল মারাত্মক । কাজীর আদেশে পেয়াদারা কীর্তনের  বাদ্যযন্ত্রগুলো মাটিতে আছাড় দিয়ে ভাঙ্গতে থাকলো । সংকীর্তনকারীদের প্রহার করতে থাকলো। গৌরাঙ্গ সিদ্ধান্ত নিলেন কাজীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে নামবেন ।হাতে মশাল নিয়ে কীর্তন করতে করতে কাজীর বাসভবন ঘেরাও করা হল।  সেই ঘেরাও মিছিলের  নেতৃত্বে ছিলেন নিতাই। অস্ত্র একটাই—সংকীর্তন। নিজের ভুল বুঝে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন ভীত কাজী। তিনি গৌরাঙ্গের চরণে আত্মসমর্পণ করলেন ।এই আন্দোলনই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম অহিংস আন্দোলন। ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘History of Bengali Literature’ গ্রন্থে একথাই  লিখেছেন— “It was perhaps the first act of civil disobedience in the history of India.” এখনও পর্যন্ত নগর সঙ্কীর্তন করার সময় যে ‘খোন্তা’ ব্যবহার করা হয় , তা আসলে কাজীর থেকে আদায় করা কীর্তনের গেটপাস, যা সঙ্কীর্তন প্রচার-প্রসারের উদ্যোগে সেদিন নিত্যানন্দের জয়কে সূচীত করে।  সুবিশাল দেহী, অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, স্বানুভাবানন্দে বিভোর নিত্যানন্দ নবদ্বীপের ঘরে ঘরে পথে পথে নামপ্রেম বিতরণ করতে মত্ত সিংহের মত বিচরণ করেছেন। “নিত্যানন্দ মত্ত সিংহ সর্ব নদীয়ায় । ঘরে ঘরে বুলে প্রভু অনন্ত লীলায়”।(চৈ.ভা.মধ্য,২৪)

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল এক সুন্দর ক্ষমাশীল সর্বংসহ মানসিকতা। ঠিক সেকারণেই , নবদ্বীপে যখন দুর্বৃত্ত জগাই-মাধাই মদের কলসীর প্রহার করে কপাল ফাটিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত করেন, তখনও নিত্যানন্দ নির্বিকার। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে , অথচ তাও যে রক্ত ঝরালো, চাইছেন তার উদ্ধার। এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু সমগ্র বিশ্বের ধর্মের ইতিহাসে বিরল। মহাপ্রভু, তাঁর প্রাণের নিতাইয়ের অমন করুণ পরিণতি দেখে‌ ক্রোধে আত্মহারা হয়েছেন সেসময়। কিন্তু, নিত্যানন্দ সস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছেন জগাই-মাধাইকে । এমন অহিংস নীতির গুণেই জগাই-মাধাইয়ের মত নৃশংস , অত্যাচারী , কুখ্যাত মানুষের মন পরিবর্তিত হয়েছিল। সেদিন থেকে মানবিকতার মন্ত্র পেয়ে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। নিত্যানন্দের আদেশে তাঁরা গঙ্গার ঘাটে আগত স্নানার্থীদের সেবার কাজে নিজেদের বাকী জীবন নিয়োজিত করেছিলেন।  কাটোয়ায় ‘জগাই-মাধাইয়ৈর ঘাট’ আজও সেই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে চলেছে । সদা আনন্দে থাকা  নিত্যানন্দ এমন ক্রোধহীন,  অহংকারহীন ছিলেন বলেই পদকর্তা লোচন দাস ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “অক্রোধ পরমানন্দ নিত্যানন্দ রায় । অভিমান শূন্য নিতাই নগরে বেড়ায়।।”

নিত্যানন্দ ছিলেন অদোষদর্শী , কখনো কারও দোষ দেখতেন না। সকলেই তাঁর কাছে বড় আপনারজন।  সর্বদা বালখিল্যভাবে তিনি মত্ত থাকতেন।  বালকের ন্যায় মুখে খলখল হাসি আর শ্রীনয়নে যেন আনন্দধারা বয়ে যেত। তাঁকে যে দেখত তার মনও আনন্দে ঝংকৃত হয়ে উঠতো। আর কেউ যদি চৈতন্যের ভক্ত হতেন তবে তো কথাই নেই । গৌরাঙ্গের নাম নিলেই তিনি নিজেকে তার চরণে বিকিয়ে দিতেন।  তাইতো কেবল বলতেন, “আমাকে কিনিয়া লহ বল গৌরহরি”।

মহাপ্রভু চেয়েছিলেন একটি সার্বজনীন মানবধর্ম প্রতিষ্ঠিত হোক সমাজে। জাতের দলাদলি, কৌলিন্যাচারের করাল থাবা  মুক্ত হোক মানুষের জীবন । যথাযোগ্য সম্মান পাক প্রতিটি মানবিক চেতনা । উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, সম্মানীয়-হীন সকলে সকলকে গ্রহণ করুক সমানভাবে , বিভেদের বেড়াজাল ভেঙ্গে।  কিন্তু ,এ কাজে তাঁকে চরম বাধা প্রাপ্ত হতে হয়েছিল যতটা না  মুসলমানদের থেকে , তার থেকে অনেক বেশী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের থেকে । তিনি চিন্তা করে দেখলেন, সন্ন্যাসী সকলের পূজ্য হন, এখন তিনি যদি নিজে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তবে উন্নাসিক ব্রাহ্মণদের থেকে সম্মান, প্রণাম ,অধীনতা আদায়ের মাধ্যমে সমাজের অসাম্য দূর করার প্রচেষ্টায় আরো একধাপ অগ্রসর হওয়া সহজ হবে। তিনি তাই সংসারের নিরাপদ, সুখময় জীবন বিসর্জন দিয়ে সন্ন্যাসের কঠোর জীবন সংগ্রামের পথ অবলম্বন করেছিলেন । আর , মূলতঃ নিত্যানন্দই তাঁকে সম্মতি জানিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্তে।  পরিণামে ফলও  পাওয়া গিয়েছিল হিসেবমতই। মাত্র ২৪ বৎসর বয়সে জননী ও যুবাস্ত্রীকে ত্যাগ করে, নবদ্বীপের নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্ডিতের গৌরবময় জীবনকে তুচ্ছ করে নিমাইয়ের  আকস্মিক সন্ন্যাস গ্রহণ সকলকে স্তম্ভিত করলো। অতি বড় পাষাণ হৃদয়ও গলিত হল, নরম হল।

এই মহাপ্রভুই যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর পাগলের মত বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রাঢ়দেশ দিয়ে ছুটছেন; তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কোন হুঁশ নেই তাঁর। তখন নিত্যানন্দের চতুরতাতেই তাঁকে শান্তিপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
“দেখি সব ভক্তগণ করে অনুতাপ।
গৌরাঙ্গ গোলক যায় কি হবে রে বাপ।।
তবে নিত্যানন্দ প্রভু বলে বীর দাপে।
রাখিব চৈতন্য আমি আপন প্রতাপে।।”
(লোচন দাসের চৈতন্য মঙ্গল,মধ্য, ১৪)

তাই তো সুবিখ্যাত ‘অমিয় নিমাই চরিত’গ্রন্থে শ্রীশিশির কুমার ঘোষ এপ্রসঙ্গে নিত্যানন্দের অবদান স্মরণ করে লিখেছেন ,”শ্রীনিত্যানন্দের কথা কি বলিব?  প্রভু নিতাই!  তোমাকে কি ধন্যবাদ দিব? আহা! ধন্যবাদ তো অনেককেই দিয়া  থাকি,  হৃদয়ে কি তোমার পাদপদ্মে প্রণাম করিব? তাহাও তো সকলে করিয়া থাকে। অতএব, হে নিত্যানন্দ! হে বিশ্বরূপের অভিন্ন কলেবর,হে জীবের বন্ধু! আমি তোমার ধার শুধিতে পারিলাম না, তোমার নিকট চিরঋণী রহিলাম।”

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব বুঝেছিলেন যে তেজস্বী ,আত্মবিশ্বাসী, অটুট ব্যক্তিত্বের অধিকারী উদ্যমী নিত্যানন্দই এমন একজন ব্যক্তিত্ব , যাঁকে  সেসময়ের সমাজের ভীষণ প্রয়োজন। জাত-পাত বিভেদের  বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজের ক্ষুদ্র মানসিকতাকে , সংকীর্ণতাকে দূরীভূত করতে চাই নিত্যানন্দের মতো বৃহদ্ মানবিকচেতনা সম্পন্ন একজন সংগঠকের। জনমানসচেতনার উদ্বোধন ঘটাতে একজন সুদক্ষ নেতার যা যা গুণ, সর্বংসহ উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তরে মানবপ্রেম থাকা প্রয়োজন — তা সব  নিত্যানন্দের মধ্যেই নিহিত আছে।  শ্রীগৌরাঙ্গ দূরদৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন যে ,নিত্যানন্দের হৃদয়ে সকল জাতের মানুষের প্রতি  যে সাম্যভাব আছে সেই ভাব, সেই নীতিকে যদি সমাজে প্রকাশিত করে দেওয়া যায় ,প্রবাহিত করে দেওয়া যায় তবে সমাজে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়ে যাবে। আর তাই তিনি যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করে পুরীতে বাস করছেন তখন এক বছর আদেশ করলেন নিত্যানন্দকে—-

“মূর্খ নীচজড়ান্ধাখ্যা যে চ পাতকিনোপরে।
তানেব সর্বথা সর্বান কুরু প্রেমাধিকারিণঃ।।”
(মুরারি গুপ্তের কড়চা-৪/২১/১০)

—-“নিত্যানন্দ তুমি এভাবে আর রথযাত্রায় প্রতিবছর এসো না। তুমিও যদি সন্ন্যাসী-মুনীদের মত করে সব ভুলে কেবল ধর্মাচরণ পালনে ব্যস্ত থাকো, তবে সমাজকে কে চালনা করবে ! সমাজের দুঃখী-দরিদ্র ,আর্ত-আতুরদের দুরাবস্থা কে ঘোচাবে!  না, না,, তোমাকে যে আরও বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে হবে ।”

নিজের গণসমেত অর্থাৎ অনুগত জনাদের নিয়ে ফিরে এসেছিলেন নিত্যানন্দ । পুরী থেকে ফেরার পথে যখন  পানিহাটিতে  শ্রীরাঘব পন্ডিতের ভবনে উঠলেন , তখন সেখানে গঙ্গাতীরে এক মহোৎসবের আয়োজন করালেন হুগলী জেলার সপ্তগ্রামের জমিদার পুত্র  রঘুনাথ দাসের  ব্যয়ভারে। সেই উৎসবে একসঙ্গে  ৩৬জাতির মানুষকে  এক পংক্তিতে (লাইনে) বসিয়ে ভোজন করালেন । পানিহাটীকে কেন্দ্র করেই নিত্যানন্দ তাঁর সমাজসংস্কারক অভিযান শুরু করলেন। সেখানেই  নিত্যানন্দ তাঁর পার্ষদদের মধ্য থেকে উপযুক্ত বারোজনকে নির্ধারণ করলেন। শ্রীঅভিরাম , সুন্দরানন্দ , ধনঞ্জয়, গৌরীদাস, কমলাকর পিপ্পলাই, উদ্ধারণ দত্ত, মহেশ পণ্ডিত, পুরুষোত্তম দাস, নাগর পুরুষোত্তম, পরমেশ্বর দাস, কালা কৃষ্ণদাস ও শ্রীধর পণ্ডিত—–  এঁদেরকে গৌড়মন্ডলের এক একটি নির্দিষ্টস্থানে নামপ্রেম প্রচারের দায়িত্ব দিলেন। আদেশ দিলেন উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র কোন বাছবিচার না করে প্রত্যেককে  কাছে টেনে নিতে।  নিত্যানন্দের নির্দেশে সেই বারোজন সেনানী আজীবন সেই কর্মই করে গেছেন।  ফলে সমাজে এক মানববন্ধন তথা প্রেমমন্ডল তৈরি হয়েছিল। ধর্মবিভেদ ভুলে ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ নীতিতে মানুষ মানুষকে  তথা মানবাত্মাকে সম্মান করতে শিখেছিলো।

নিত্যানন্দ অনুভব করেছিলেন যে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের অর্থাৎ জল-অচল হিন্দু, বৌদ্ধ সহজিয়া , নেড়া-নেড়ী সম্প্রদায়ের সেই বিশাল সংখ্যক মানুষকে যদি সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যায় তবে হিন্দুসমাজ বলবতী হবে।  এই ভাবনা থেকেই তিনি সস্নেহে পূর্ববঙ্গের জল-অচল মানুষদের কৃষ্ণনাম প্রদান করে মূল হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন । বহিষ্কৃত সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়কেও সেসময় হিন্দু সমাজভুক্ত করেছিলেন তিনি। তারফলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণীয়তা আরো বেড়ে গিয়েছিল।শ্রীগৌরাঙ্গের আদর্শ–“কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার”— এই পন্থাকে অবলম্বন করে নিত্যানন্দ তাঁর পতিত উদ্ধারণ লীলা অব্যাহত রাখলেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বহারাদের নেতা, বঙ্গদেশের প্রথম সাম্যবাদী নেতা। তাঁর আবেদন ছিল অত্যন্ত জোরালো ও প্রভাবময়।

নিত্যানন্দ ছিলেন চরম বাস্তববাদী নেতা।  তাইতো তিনি বলেছিলেন, “কাঠিন্য কীর্তন কলিযুগ ধর্ম নয়”( জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল–উত্তরখন্ড)। আরও বলেছিলেন, “কূলবধূ নাচাইমু কীর্তনানন্দে”(ঐ)।  পুরুষদের মত নারী জাতিরও যে অধিকার আছে কীর্তনে অংশগ্রহণ করার,সেখানে নৃত্য করার—একথা প্রথম শোনা যায় নিত্যানন্দের নির্ভয় কন্ঠেই । তখন থেকেই পর্দানশীন বঙ্গবধূর বহির্জগৎ তৈরি হতে থাকে। অন্দরমহলের অন্তরায় ভেদ করে নারীরা সর্বসমক্ষে আসতে আরম্ভ করে। আর তারই চরম দৃষ্টান্ত হল  নিত্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী জাহ্নবাদেবী। জাহ্নবাদেবী হয়েছিলেন সমুদয় বৈষ্ণবকুলের আচার্যানী, জননেত্রী। সমগ্র গৌরমন্ডলে পরিভ্রমণ করে, বিগ্রহ স্থাপন করে , মহোৎসব করে বৈষ্ণবদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন তিনি।

সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতিমূর্তি নিত্যানন্দে  শৈব ,শাক্ত ,বৈষ্ণব—এই ত্রিধারার মেলবন্ধন দেখতে পাই আমরা। কারণ, তাঁর মস্তকে থাকতো শাক্ত সম্প্রদায়ের ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্র , সঙ্গে রাখতেন শৈব সম্প্রদায়ের নীলকন্ঠ মহাদেব ; আর ,কণ্ঠে ধারণ করতেন বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিভূ  অনন্তদেব শিলা ।  তাঁর মত হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব ছিল এমন বেপরোয়া আচরণ।  আবার , যে যুগে জাত বাঁচাতে ব্রাহ্মণরা অন্য জাতের জলটুকুও গ্রহণ করতেন না , সেযুগে  নিত্যানন্দ ছিলেন একেবারে ছুঁৎমার্গহীন।দিনের পর দিন বৈশ্য সম্প্রদায়ের উদ্ধারণ দত্তের  রন্ধন করা দ্রব্য  আহার করেছেন । প্রথম জীবনের সুদীর্ঘ কুড়িটা বছর ভারতবর্ষের নানা স্থানে পরিব্রাজক হয়ে ঘোরার ফলেই হয়তো বা ভারতমাতার উদার মানবিক ভাবটি আত্মস্থ হয়েছিল তাঁর।

নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর পরও তাঁর আদর্শ ও তিনি বড় বেশীরকম প্রাসঙ্গিক। তবে, গৌর আদর্শের সার্থক রূপকার নিত্যানন্দের সাংগঠনিকশক্তি ও উদার-ভাবনা সম্পর্কে গবেষণা সেই অর্থে হয় কী! বর্তমানের এই দাঙ্গা-হানাহানি, অভিযোগ-অশান্তির আবহে ভীষণ প্রয়োজন বৃহৎ আদর্শের , সাম্য মনোভাবের। মানবদরদী নিত্যানন্দ চরিত্রের আলোচনা, গবেষণা— তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ একান্ত ভাবে প্রয়োজন।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

নেতাজী বসেছিলেন,  তাই সেই চেয়ারে আর কেউ কখনো বসেননি, নেতাজীর স্পর্শ পাওয়া কাঠের চেয়ারকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন দেশুড়িয়া গ্রামের কর্মকার পরিবার।

নেতাজী বসেছিলেন যে চেয়ারে সে চেয়ারে  আর কেউ বসেনি কোনোদিন। ৭৩  বছর ধরে বাঁকুড়ার দেশুড়িয়া গ্রামের কর্মকার বাড়িতে যত্নে রাখা সেই চেয়ার আজো শূন্য। পরিবারের আশা ফের কোনোদিন নেতাজী ফিরে এসে আবার বসবেন সেই চেয়ারে।

সালটা ১৯৪০। বাংলার আকাশে ক্রমশ তীব্রতা বাড়ছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের। ২৮ এপ্রিলের তপ্ত বাঁকুড়ায় সুভাষ চন্দ্র বসু এসেছিলেন গঙ্গাজলঘাটির বুকে সভা করতে। মঞ্চে তাঁর বসার জন্য রানীগঞ্জ থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল সুন্দর সোফা। স্থানীয় নেতৃত্বের বসার জন্য মঞ্চে বরাদ্দ ছিল স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ করা কাঠের চেয়ার।

 

 

নেতাজী সোফা সরিয়ে বসার জন্য টেনে নিয়েছিলেন সাধারণ একটি কাঠের চেয়ারকে। আগুন ঝরানো বক্তৃতা শেষে নেতাজী মঞ্চ ছাড়তেই আর দেরী করেননি দেশুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা রামরূপ কর্মকার। ছুটেছিলেন মঞ্চের উদ্যেশ্যে। তাঁর বাড়ি থেকে আনা চেয়ারেই যে বসেছিলেন নেতাজী। সটান মঞ্চে উঠে সেই চেয়ার মাথায় তুলে হেঁটে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন রামরূপ কর্মকার। বাড়িতে ফিরে চেয়ার রেখেছিলেন নিজের বাড়ির ঠাকুর ঘরে।

 

বাড়ির সকলকে বলেছিলেন ওই চেয়ারে নেতাজীর ছোঁয়া আছে। তাই সেই চেয়ার যেন যত্নে রাখা হয়।  তারপর দামোদর দিয়ে বয়ে গেছে বহু জল। প্রিয় নেতাজী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। আরও পরে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু নেতাজী অন্তর্ধান রহস্যের মিমাংসা আজো হয়নি। নেতাজীকে হারানোর একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে আজো দিন কাটে কর্মকার পরিবারের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বুক দিয়ে কর্মকার পরিবার আগলে রাখেন নেতাজীর ছোঁয়া পাওয়া সেই সাধারণ কাঠের চেয়ারটিকে। পরিবারের কূলদেবী মনসার নিত্য পুজোর পাশাপাশি শূন্য কাঠের চেয়ার কর্মকার বাড়িতে পূজিত হয় দেবতা জ্ঞানে। শূন্য কাঠের চেয়ারকে ঘিরে যাবতীয় আবেগ ও অহঙ্কার আবর্তিত হয় দেশুড়িয়া গ্রামের কর্মকার পরিবারের।

 

কলমে : আবদুল হাই।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

স্বামী বিবেকানন্দ — আজও প্রাসঙ্গিক : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার । তিনি ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের একমাত্র শিষ্য । তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নত করে বিবেকানন্দ সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন । স্বামী বিবেকানন্দ জীবপ্রেমের দীক্ষা পান শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন ‘যত্র জীব, তত্র শিব’। জীবের সেবা করলে স্রষ্টারও সেবা করা হয় । স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ । সবার আগে মানব সেবা । সুতরাং মানুষের সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সেবা করা সম্ভব। জীবপ্রেমের দর্শন প্রকাশ পেয়েছে তাঁর দুটি চমৎকার লাইনেঃ
“বহুরুপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ?
জীবপ্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর ।“
তাই আমরা কেউ বিবেকানন্দকে পরিপূর্ণভাবে বুঝিনি । কারণ তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব । তিনি প্রচুর বই পড়তেন । দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য, ইত্যাদি বিষয়ে । তা ছাড়া তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল বেদ, উপনিষদ, ভাগবতগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, প্রভূতি হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে । যার জন্য সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ব, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ছিলো গভীর ব্যুৎপত্তি । তাই তিনি নিজেই বলেছেন, “বিবেকানন্দকে বুঝতে হলে আরেক বিবেকানন্দকে দরকার” । কর্মী বিবেকানন্দ, সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, গুরু বিবেকানন্দ, শিষ্য বিবেকানন্দ, জ্ঞানী বিবেকানন্দ, যোগী বিবেকানন্দ, কবি বিবেকানন্দ সবই বাহ্য । কারণ এই সমস্ত গুণেই তিনি শীর্ষস্থানের অধিকারী হলেও তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, ‘ভালোবাসায় ভরা হৃদয় বিবেকানন্দ’ ।
বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের “শিব জ্ঞানে জীব সেবা” মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন । তাই তিনি মানুষের কল্যাণ সাধনকেই প্রকৃত ঈশ্বর সাধনা বলে মনে করেছিলেন ।
বিবেকানন্দ ছিলেন মানব প্রেমিক সন্ন্যাসী । মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়কেই সমানভাবে প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন । তাঁর মতে “ধর্ম”” মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বকে ফোটাবে । বিজ্ঞান মানুষকে সুখ ও সমৃদ্ধি উপহার দেবে । শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ প্রথমে আত্মবিশ্বাসী হবে । আর আত্মবিশ্বাস থেকে আসবে আত্মনির্ভরশীলতা । বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষাই সমাজের সকল সমস্যা দূরীকরণের মূল চাবি কাঠি । শিক্ষার আলো মানুষের মনের অন্ধকারকে দূর করে এবং মানুষকে স্বনির্ভর করতে সাহায্য করে । বিবেকানন্দের শিক্ষা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যেই ছিল সমাজে যথার্থ “মানুষ” তৈরি করা –যাতে চরিত্র গঠিত হয়, মনের শক্তি বাড়ে । বুদ্ধি বিকশিত হয়, মানুষ নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে শেখে । উপরন্ত বিবেকানন্দের শিক্ষা ছিল সার্বজনীন । তিনি চেয়েছিলেন বিশেষভাবে যুব সমাজের নবচেতনার অভ্যুদয় । নিষ্ঠা, সততা ও আত্মনির্ভরতা ছিল তাঁর আরাধ্য । এসব গুণ জগতের সব সমাজের সব মানুষেরই সম্পদ ।
( ২ )
এখানে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য – বিবেকানন্দ যেভাবে ভারতবর্ষকে চিনেছিলেন বা অনুভব করেছিলেন, অন্য কোনো ব্যক্তি ঠিক সেভাবে ভারতবর্ষকে অনুভব করতে পারেননি । পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করে বিবেকানন্দ ধন্য মনে করেছিলেন । ভগিনী নিবেদিতার ভাষায়, “তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষ – রক্তমাংসে গড়া ভারত প্রতিমা ।“ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রোমাঁ রোলাঁকে (ফরাসী সাহিত্যিক) বলেছিলেন, “যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও বিবেকানন্দকে জানো । বিবেকানন্দের লেখা আগে পড়ো । “
বিবেকানন্দ সহজে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবকে গুরু মানেননি । প্রথমদিকে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে গুরু বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন । এমনকি তাঁর চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন । অথচ উল্টে তিনি রামকৃষ্ণ দেবের ব্যক্তিত্বের কাছে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন । যার জন্য ঘনঘন তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন । ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য নরেন্দ্রনাথ সেইসময় মূর্তিপূজা, বহুদেববাদ, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কালী পুজা সমর্থন করতেন না । এমনকি অদ্বৈত বেদান্তমতবাদকেও তিনি ঈশ্বরদ্রোহিতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন । নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে পরীক্ষা করতেন । রামকৃষ্ণ দেবও শান্তভাবে তার যুক্তি শুনে বলতেন, “সত্যকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করবি ।“
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে । চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁকে প্রথমে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর ও পরে কাশীপুরের একটি বাগান বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয় । সেখানেই নরেন্দ্র নাথের ধর্ম শিক্ষা চলতে থাকে । কাশীপুরে নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন । তারপর রামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে সন্ন্যাস ও গৈরিক বস্ত্র লাভ করেন । রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নরেন্দ্রনাথকে শিক্ষা দেন “মানব সেবাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সাধনা” । এরপর ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট শেষ রাত্রে কাশীপুরেই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব প্রয়াত হন । ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নরেন্দ্রনাথের গুরুভ্রাতা বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের আঁটপুরে আমন্ত্রণ জানান । সেখানেই তাঁরা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মতো জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নেন । তখন নরেন্দ্রনাথ “স্বামী বিবেকানন্দ” নাম গ্রহণ করেন ।
এরপরে পরিব্রাজকরূপে তাঁকে আমরা কী দেখলাম । ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিব্রাজকরূপে মঠ ত্যাগ করেন বিবেকানন্দ । পরিব্রাজক হিন্দু সন্ন্যাসীর এক ধর্মীয় জীবন — এই জীবনে তিনি স্বাধীনভাবে পর্যটন করে বেড়ান কোনো স্থায়ী বাসস্থান ও বন্ধন ছাড়াই । পরিব্রাজক জীবনে বিবেকানন্দের সঙ্গী ছল একটি কমন্ডলু, লাঠি এবং তাঁর প্রিয় দুটি গ্রন্থ –ভাগবদ্গীতা ও ইশানুসরণ । বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সুপরিচিত হন । এই সময় ভিক্ষোপজীবী হয়ে সারা ভারত পদব্রজেই পর্যটন করেন বিবেকানন্দ । সেইজন্য বিবেকানন্দকে সারা বিশ্বের মানুষ “পরিব্রাজক” হিসেবে জানে । ভারতবর্ষ পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন পণ্ডিত, দেওয়ান, রাজা এবং হিন্দু-মুসলমান, খ্রিষ্টান এমনকি নিম্নবর্গীয় ও সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গেও মেলামেশা ও একসঙ্গে বাস করেন ।
( ৩ )
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বারাণসী থেকে যাত্রা শুরু করেন । তখন সাক্ষাৎ হয় বিশিষ্ট বাঙালী লেখক ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও বিশিষ্ট সন্ত ত্রৈলঙ্গস্বামীর সাথে । বৃন্দাবন, হথরাস ও হৃষীকেশে ভ্রমণের সময় হথরাসে তাঁর সঙ্গে স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্তের সাক্ষাত হয় । তিনি পরে বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সদানন্দ নামে পরিচিত হন । তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের প্রথম যুগের শিষ্য । ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে আবার নৈনিতাল, আলমোড়া, দেরাদুন, ঋষীকেশ, হরিদ্বার এবং হিমালয় ভ্রমণে যান । তারপর রওনা দেন দিল্লি । এইভাবে পশ্চিম ভারত, দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ সারেন ।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩০শে জুন থেকে ১৪ই জুলাই শিকাগো যাওয়ার পথে বিবেকানন্দ জাপান ভ্রমণ করেন । তিনি ঘুরে দেখেছিলেন কোবে, ওসাকা, কিওটো, টোকিও আর য়োকোহামা শহর । ১০ই জুলাই ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে য়োকোহামার ওরিয়েন্টাল হোটেল থেকে তাঁর ভক্ত মাদ্রাজের আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠিতে বিবেকানন্দ জানিয়েছিলেন জাপান নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার কথা । তিনি জাপানীদের “পৃথিবীর সবচেয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জনগণের অন্যতম” বলে অভিহিত করেছিলেন । তারপর চিন, কানাডা হয়ে তিনি শিকাগো শহরে পৌঁছান ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে । কিন্তু শিকাগো শহরে পৌঁছে মূলত দুটি সমস্যায় পড়েন । মহাসভা শুরু হতে দেড় মাস বাকী । অন্যটা কোনো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের প্রশংসাপত্র বা পরিচয়পত্র ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বধর্ম মহাসভায় গ্রহণ করা হবে না । তারপর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সংস্পর্শে এলেন । তাঁকে হার্ভার্ডে আমন্ত্রণ জানানোর পর এবং ধর্মসভায় বক্তব্যদানে বিবেকানন্দের প্রশংসাপত্র না থাকা প্রসঙ্গে রাইটের বক্তব্য, “আপনার কাছে প্রশংসাপত্র চাওয়াটা হচ্ছে স্বর্গে সূর্যের আলো দেওয়ার অধিকার চাওয়ার মতো অবস্থা ।“ রাইট তখন প্রতিনিধিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিকট এক চিঠিতে লিখলেন, “আমাদের সকল অধ্যাপক একত্রে যতটা শিক্ষিত ইনি তাঁদের থেকেও বেশী শিক্ষিত ।“
বিশ্বধর্ম মহাসভা ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন হয় । তিনি ভারত এবং হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন । পাশ্চাত্যে অভিযানের নিরিখে যেসব অভিজ্ঞতা, তাতে শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় সনাতন ও বেদান্তের উপর ভাষণ দেওয়া ভীষন তাৎপর্যপূর্ণ । তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন, “আমেরিকার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ …।“ — সম্ভাষন করে । তাঁর বক্তব্যে সহিষ্ণুতা ও মহাজাগতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গ ওঠে । গীতা থেকে উদাহরণমূলক পংক্তি তুলে ধরেন । তাঁর বক্তব্যে বিশ্বজনীন চেতনা ধ্বনিত হয় ।
প্রেসের কাছে তিনি “ভারতের সাইক্লোন সন্ন্যাসী” হিসেবে অভিহিত হন । “নিউ ইয়র্ক ক্রিটিক” লিখেছিল “ঐশ্বরিক অধিকারবলে তিনি একজন বক্তা এবং তাঁর শক্তিশালী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার চেয়ে বরং আগ্রহোদ্দিপক ছিল ঐ সকল ছন্দময়ভাবে উচ্চারিত শব্দসমূহ ।“ আমেরিকার পত্রিকাসমূহ বিবেকানন্দকে “ধর্মসভার সবচেয়ে মহান ব্যক্তিত্ব” হিসেবে প্রতিবেদন লিখেছিল । পরবর্তীতে শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত ভারতে ফিরে এসে লিখেছিলেন, “গেরুয়াধারী কম বয়স্ক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন মঞ্চে বিবেকানন্দ ছিলেন সূর্যের মতো তেজস্বী এক পুরুষ ।“
তারপর ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর আমেরিকা ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ শেষে ইংল্যান্ড থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । তারপর ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারী কলম্বো তিনি পৌঁছান ।
( ৪ )
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বিবেকানন্দের সদর্থক ভূমিকা । রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু । সেই বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ছিলেন “আধুনিক ভারতের স্রষ্টা ।“ জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনার প্রতি তিনি ছিলেন সতত সংবেদনশীল । সুতরাং বিবেকানন্দের স্বদেশমন্ত্র দেশ স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । বলা চলে বিবেকানন্দ স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন । যার জন্য মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “বিবেকানন্দের রচনা তাঁর “দেশপ্রেম হাজারগুণ” বৃদ্ধি করেছিল ।“ যখন পরাধীন ভারতবাসী আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, তখন বিবেকানন্দ চেয়েছেন মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ । তাই তিনি বলেছেন, “তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের অধিকারি, পবিত্র ও পূর্ণ । তুমি নিজেকে দুর্বল বলো কী করে ? ওঠো, সাহসী হও, বীর্যবান হও ।“
স্বদেশমন্ত্রে তিনি বলেছেন, হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা … এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করবে ? এই লজ্জাকর কাপুরুষতা সহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে ? হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী । ভুলিও না, তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর । ভুলিও না, তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের —নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে । ভুলিও না, তুমি জন্ম হতেই “মায়ের” জন্য বলিপ্রদত্ত । ভুলিও না, নীচজাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই । হে বীর, সাহস অবলম্বন করো, সদর্পে বলো —- আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই । বলো, মুর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই । সদর্পে বলো, ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী । বলো ভাই, ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ । ভারতের কল্যান, আমার কল্যান । “
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ই জুলায় রাত ৯.১০ মিনিটে ধ্যানরত অবস্থায় দেহত্যাগ করেন । তাঁকে বেলুড়ে গঙ্গা নদীর তীরে একটি চন্দন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চিতার উপর দাহ করা হয় । যার বিপরীত পাশে ষোলো বছর আগে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মরদেহ দাহ করা হয়েছিল ।
আজ তাঁর শুভ জন্মদিন (জন্মঃ ১২ই জানুয়ারী, ১৮৬৩) । তাঁর শুভ জন্মদিনে আমার শতকোটি প্রণাম ।
———–০————–

Share This
Categories
প্রবন্ধ

বাংলার নক্সীকাঁথা..শিল্পের গায়ে মমতার স্পর্শ : বানীব্রত।

“আজও এই গাঁও অঝরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে
নিরবে বসিয়া কোন কথা যেন কহিতেছে কানেকানে।”
কবি জসিমউদ্দীনের “নক্সীকাথার মাঠ” কবিতার দুটো লাইন দিয়ে শুরু করলাম। এখানে কবি রুপাই আর সাজুর প্রেমগাঁথাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর এই প্রেম কাহিনির নেপথ্যে ছিলো নক্সীকাঁথা। রুপাই তার প্রেমিক সাজুর জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় তার মনের অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলেছিল নক্সীকাঁথায়। যার শেষ পরিনিতিতে কবরের উপরে বিছানো ছিলো ওই নক্সীকাঁথাটা। আর এই নক্সীকাঁথার ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
পুরাতন পাতলা সুতির কাপড়ের উপর বিভিন্ন রঙের সুতোয় ছোট ছোট ফোঁড়ের সেলাইয়ের ছোঁয়ায় তৈরী করা হতো কাঁথা। কাঁথাশিল্পীদের হাতের সুঁচসুতোর ছোঁয়ায় বিভিন্ন নক্সায় সেজে উঠেছিল সেই নক্সীকাঁথা। পাখি,  ফুল, গাছপালার চিত্রও দেখা দিত এই কাঁথায়। শিল্পীরা মনের মাধুরি মিশিয়ে নিজের মনের ভাবকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতো কাঁথার উপর। এই নক্সীকাঁথা ভারত ও বাংলাদেশের বাজারে সমাদৃত ছিলো।  এই নক্সীকাঁথা ছিল দুইদেশের লোকশিল্পের অন্তর্গত। শতশত বছর পুর্বে এই কাঁথার বুৎপত্তি হয়েছিল। শোনা যায় পাঁচশবছর আগে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত বইয়ে সর্বপ্রথম কাঁথার কথা পাওয়া যায়।
পুরোনো বা  ছেঁড়া কাপড়ের পাড় থেকে লাল নীল সবুজ হলুদ নানা রঙের সুতো বের করতেন এই শিল্পীরা। পায়ের বৃধাঙ্গুলিতে পাড়কে জড়িয়ে  নিয়ে আলাদা আলাদা রঙের সুতো বের করে কাগজের গোলা বা কাঠের টুকরোর মধ্যে সেই সুতো গুলোকে এক জায়গায় রাখা হতো। পরবর্তীতে সেই সুতোতেই সেজে উঠতো নকশি কাঁথা।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর, যশোর জেলায় ছিল নকশী কাঁথার জন্য বিখ্যাত। তাছাড়া সমস্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এই কাঁথা তৈরি হতো। ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ ২০০৮ সালে নকশি কাঁথার জন্য ভৌগোলিক স্বীকৃতি পায়।
কাঁথা শব্দটির উৎস সঠিকভাবে জানা না গেলেও মনে করা হয় এই শব্দটি “খেতা” থেকে এসেছে। নিয়াজ জামানের মতে সংস্কৃতি শব্দ “কথা” হতে কাঁথা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, “কথা” শব্দটির বাংলা শব্দ তেনা বা কাপড়ের টুকরো আর এই তেনা বা কাপড়ের টুকরোর উপরে অলস দুপুরে বাড়ির দাওয়ায় বা গাছের তলার ছাওয়াতে বসে মহিলারা তাদের মনের ভাবকে তুলে ধরতেন। সূক্ষাতিসূক্ষ কাজের এই কাঁথা বানাতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যেত। এই কাঁথার বৈশিষ্ট হলো, এতে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কোন নকশা করা হয় না। যিনি এই কাঁথাটি তৈরি করেন তিনি তার মত করে মনের মাধুরী মিশিয়ে নকশা আঁকেন। এই কাঁথার মধ্যে চলমান সেলাই দিয়ে মূলত দেশীয় কাঁথা বানানো হলেও নকশি বা পায়ের তোলা এই দুই নামের সেলাই ও ব্যবহৃত হয় এই কাঁথাতে। তাছাড়া ঢেউ খেলানো সেলাইয়ে তৈরি কাঁথাকে লহরী কাঁথা বলা হয়। যা রাজশাহীতে খুবই জনপ্রিয়। বর্তমানে জামালপুরের সদর শহর পুরো জেলায় প্রায় ২৫ হাজার দরিদ্র নারী ও ৫০ হাজার পুরুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত আছেন। এই শিল্পে স্বাবলম্বি হয়েছেন অনেক দরিদ্র নারী। সংসারের অন্যান্য কাজের সাথে এই নারীরা নকশি কাঁথা সহ নক্সি সামগ্রী বানান শুরু করেন। জামালপুরের নকশি কাঁথা দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। সমস্যা উজির অভাবে ন্যায্য শ্রমের মূল্য থেকে বঞ্চিত এই শিল্পীরা। এখানকার শিল্পীদের খুব সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এখানকার সহনীয় উদ্যোগতারা যারা এই শিল্পের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছেন তাদের থেকে জানা যায় একটি নকশি কাঁথা তৈরি করতে খরচ হয় ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে নেন ২ হাজার টাকায়। বড় বড় বিপনিতে এইগুলো বিক্রি হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। এই ব্যাবসার সাথে যারা যুক্ত আছেন এর থেকেই বোঝা যায় তারা একটি কাঁথা বিক্রি করে কত টাকা মুনাফা পান। ভাবলে কষ্ট লাগে যারা তাদের শ্রম দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে এই সুক্ষাতিসূক্ষ কাজ গুলি করছেন তারা হচ্ছেন বঞ্চিত। শিল্পীরা তাদের দাম পাচ্ছেন না আর তাদের নিষ্ঠার সৃস্টি দিকে দিকে কত সন্মানের সাথে শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করছে।

কলমে – বানীব্রত।

তথ্যসূত্র – গুগল

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

নারী নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মুক্তা সালভে ::: সৌরভকুমার ভূঞ্যা।।।

অনেক বিশ্বাস মতে ঈশ্বর স্রষ্টা। তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। সেই হিসেবে নারী পুরুষ উভয়ে তার সৃষ্টি। তাই যদি সত্য হয় তাহলে নারী পুরুষ উভয়ে সমান। সমান অধিকার তাদের প্রাপ্য। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে রয়েছে নারী বঞ্চনার ইতিহাস। “সমাজে পুরুষেরা কেন নারীদের দুর্বল ভাবে? কেন তাদের সমান অধিকার দেয় না?” আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে নিজের লেখা বই “স্ত্রী-পুরুষ তুলনা”-তে এমন জোরালো প্রশ্ন রেখেছিলেন নারী নবজাগরনের অন্যতম পথিকৃৎ তারাবাই সিন্ধে। মনে করা হয় তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি নারীবাদী বই লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “যে পুরুষ নারীদের শিক্ষার আলো দিতে পারে না, তাদের অধিকার দিতে পারে না, বিধবাদের দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে পারে না, সে পুরুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ কিংবা বলবান ভাবে কী করে?” গোটা বই জুড়ে এভাবে শানিত কলমে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। এককথায় তার প্রতিবাদ ছিল পুরুষদের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।

তারাবাই সিন্ধের মতো এরকমই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আরও এক নারী। তবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন একটা সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আরও পরিস্কার করে বললে, একজন দলিত নারী হয়েও বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “যদি বেদ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের হয় (এমনটা দাবি করত ব্রাহ্মণেরা), তাহলে আমরা বেদ অনুসারে চলতে বাধ্য নই।” ব্রাহ্মণরা বলতেন শুদ্রদের বেদ পড়া দূরে থাক, বেদের দিকে তাকানোটাও ছিল পাপ। সে কথা উল্লেখ করে মুক্তা বলেছিলেন, “বেদ-এর দিকে তাকালেই যদি আমাদের পাপ হয়, তাহলে বেদ-এর নীতি নিয়ম মান্য করা আমাদের বোকামি নয় কি?” ব্রাহ্মণ আধিপত্য সমাজ ব্যবস্থার দিকে এরকম কঠোর প্রশ্ন ছুঁরে দিয়েছিলেন সতেরো বছরের দলিত কিশোরী মুক্তা সালভে। মনে করা হয়ে থাকে তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা দলিত লেখিকা। মহারাষ্ট্রের খ্যাতনামা বিপ্লবী ক্রান্তিবীর লাহুজির নাতনি তিনি।

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। মহারাষ্ট্রে তখন পেশোয়ার শাসন। জাতপাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায়, সমাজের মাথা ছিলেন বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা। আর সবচেয়ে নিচে ছিল শূদ্র। মুক্তা সালভে ছিলে মাং সম্প্রদায়ের মহিলা। মাং এবং মাহার সম্প্রদায় ছিল দলিত (শূদ্র)। সমাজে দলিতদের স্থান ছিল অবর্ণনীয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্মাচরণ প্রভৃতি কোনোকিছুর অধিকার ছিল না তাদের। মন্দির, স্কুল প্রভৃতির দরজা ছিল তাদের জন্য বন্ধ। তারা ছিল অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ। তাদের স্পর্শ দূরে থাক, উচ্চ বর্ণের লোকেরা তাদের ছায়াও মাড়াত না একসময়। ব্রাহ্মণরা তাদের মানুষ বলে গন্য করত না। গরু-মহিষের থেকেও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। নির্ধারিত কয়েকটি নিম্ন পেশা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার অধিকার ছিল না তাদের। ফলে দারিদ্র্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। এককথায়, নিদারুন অপমান আর বঞ্চনার জীবন কাটাতে বাধ্য হত তারা। কেউ পড়াশোনা করতে চাইলে তার জীবনে নেমে আসত চরম বিপর্যয়। সামান্য সামান্য অপরাধে (হয়তো তা সে অর্থে অপরাধও নয়)তাদের চরম শাস্তি দেওয়া হত। অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ হয়ে অপমান আর অবমাননার জীবন কাটাতে বাধ্য হত তারা। একটা দীর্ঘ সময় অন্ধকারে ডুবেছিল তাদের জীবন। এই অন্ধকারের প্রধান কারণ ছিল শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকা।

দলিতদের নিয়ে যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহাত্মা জ্যোতিবারাও ফুলে এবং বি-আর আম্বেদকর। সমাজ সংস্কারক জ্যোতিবারাও বুঝেছিলেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে না পারলে দলিতদের এই অবস্থার উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। বিশেষত তিনি জোর দিয়েছিলেন নারীশিক্ষার ওপর। নিজের স্ত্রী সাবিত্রীবাই ফুলেকে তিনি পড়াশোনা করিয়েছিলেন। স্বামীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় সাবিত্রীবাই কেবল নিজে শিক্ষিত হননি, নারী সমাজকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করেছিলেন। সাবিত্রীবাই হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা শিক্ষক। শুধু তাই নয় প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে তিনি কোনো স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন।

সকল সম্প্রদায়ের মহিলাদের শিক্ষিত করার জন্য ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি জ্যোতিবারাও এবং সাবিত্রীবাই একটি স্কুল স্থাপন করেন। মাত্র ৮ জন মহিলা নিয়ে এই স্কুল শুরু হয়। এই ৮ জন মহিলার মধ্যে ১৪ বছরের মুক্তা সালভে ছিলেন একজন। এখানে তিনি তিন বছর পড়াশোনা করেছেন। বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুক্তা জানতে পেরেছিলেন দলিত মানুষদের পূর্বেকার অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা। নিজের সময়েও তিনি দেখেছেন দলিতদের বঞ্চনা, অপমান। শিক্ষার আলো তার চোখ খুলে দেয়। মনের অন্ধকার দূর করে। তাকে সাহসী করে তোলে। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস যেখানে মানুষের ছিল না, সেখানে সতেরো বছরের কিশোরী মুক্তা সালভে একেবারে কলম তুলে নেন লিখে ফেলেন একটি প্রবন্ধ, “Mang Maharanchya Dukhavisatha (About the Grief of Mahar and Mangs)” ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ‘Dnyanodaya’ নামক পাক্ষিক পত্রিকায় দুই কিস্তিতে এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হয় ১ মার্চ সংখ্যায়।

পুরো প্রবন্ধে তিনি জোরালো প্রতিবাদ করেছেন সমাজের জাত-পাত, ধর্ম বিভাজন নিয়ে। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ তোলেন। তাদের জমি দখল করে ব্রাহ্মণরা নিজেদের বসতি স্থাপন করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে, এমন জোরালো অভিযোগ জানান। ধর্মের নিষ্ঠুরতা নিয়ে ঈশ্বরের কাছে আবেদন করেছেন, “হে ভগবান, দয়া করে বল আমাদের ধর্ম কী। হে ভগবান, আমাকে তোমার সত্যকার ধর্ম শেখাও। যাতে করে সেই মতো আমরা চলতে পারি।”

ধর্ম বলতে তিনি সেই ধর্মের কথা বলেছেন যা সংকীর্ণতা মুক্ত। যেখানে সমানাধিকার থাকবে। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ” এমন ধর্ম, যেখানে এক ব্যক্তি সুবিধা পায়, অন্যরা বঞ্চিত হয়, তাকে এই পৃথিবী থেকে লুপ্ত করে দাও। এমন ধর্ম যেন আমাদের মধ্যে আর কখনও প্রবেশ করতে না পারে।”

এ-কথা বলা কতখানি দুঃসাহসিক, কতখানি স্পর্ধার তা সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কল্পনা করলে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারি, কতখানি দুঃসাহস ছিল তার মধ্যে। একটি দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত চরম শক্তিধর সমাজ ব্যবস্থার বুকে তিনি ঘা মেরেছিলেন। সেটা পেরেছিলেন, কেননা শিক্ষার আলো তিনি পেয়েছিলেন। এটাও বুঝেছিলেন শুধু তিনি বললে হবে না। বাকিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্য চাই শিক্ষার আলো। তাই তিনি তার প্রবন্ধের শেষে বলেছেন, “ওহে মাং ও মাহাররা, তোমরা গরিব, অসুস্থ। কেবল জ্ঞানের ঔষধই পারে তোমাদের সারিয়ে তুলতে। শিক্ষাই পারে তোমাদের কুসংস্কারের জঘন্য বিশ্বাস থেকে দূরে সরাতে। শিক্ষা তোমাদের ন্যায় পরায়ণ ও নীতিবান করে তুলবে তোমাদের ওপর যে অত্যাচার তা রোধ করতে পারবে। যে সব লোকেরা তোমাদের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করে, তা করতে আর তারা সাহস পাবে না।”

শিক্ষার শক্তি কতখানি তা তিনি তার তিন বছরের শিক্ষাজীবনে অনুভব করতে পেরেছিলেন। কিন্তু গতানুগতিক ধারার প্রভাবে দলিত সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের শিক্ষার প্রতি তেমন উৎসাহ ছিল না। শিক্ষা যে তাদের প্রয়োজন, এটা তারা অনুভব করতে পারত না। তাদের সেই ঘুম থেকে জাগাতে চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, “পড়াশোনা কর। কঠোর পরিশ্রম কর। শিক্ষিত হও এবং একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠো।”

মুক্তা সালভের আর কোনো লেখার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই একটিমাত্র লেখার মাধ্যমে তিনি নিজেকে একটি আলাদা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারীমুক্তি তথা দলিত সমাজের অধিকারের দাবিতে তার এই লেখা এক শানিত হাতিয়ার। একটি সমাজ ব্যবস্থাকে একটু হলেও তিনি ধাক্কা দিতে পেরেছিলেন।

বর্তমান সময়ে আমাদের আলোচনায় উঠে আসে বহু উজ্জ্বল নারীদের নাম। মুক্তা সালভের মতো মহিলারা হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অন্তরালে। কিন্তু, সলতে পাকানোর কাজটা তারা করেছিলেন। নারী নবজাগরণে এদের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এদেরকে বেশি বেশি করে স্মরণ করা অবশ্যই প্রয়োজন।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর — একটি পর্যালোচনা ।।।।

এটা অনস্বীকার্য যে, বাঙালী সমাজে আজও বিদ্যাসাগরের প্রদীপ্ত উপস্থিতি ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়ে । প্রাথমিক শিক্ষায় ‘বর্ণপরিচয়’ এর মাহাত্ম্য সকলের জানা । মুর্শিদাবাদ জেলার শক্তিপুর হাই স্কুলের বাংলার দিদিমণি আমার রচনা লেখার গঠন অবলোকন করে হঠাৎ তাঁর সম্মুখে ডাকলেন, “তুই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ নাম শুনেছিস ? তারপর চুপি চুপি বললেন, রোজ রাতে শোওয়ার আগে বিদ্যাসাগরের বইখানা পড়বি । রচনা লেখার সময়ে তোর বানানের জড়তা কেটে যাবে” । সুতরাং শৈশব থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় আজও অমলিন । সেই বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর । তাই দুশো বছর ধরে শিক্ষা জীবনের বাস্তবতায় বিদ্যাসাগর আজও প্রাসঙ্গিক ।
বিদ্যাসাগর যখন জন্মগ্রহন করেছিলেন সেই সময়টা ছিল রামমোহনের যুগ, যিনি একজন শিক্ষিত ও অগ্রণী পুরুষ ছিলেন এবং সমাজ সংস্কারের অন্যতম কারিগর । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত ও বলিষ্ঠ দৃঢ়চেতা পুরুষ। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরিতে খুব কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করতেন । পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা তাঁর সাধ্যের অতীত ছিল। সেই কারণে বালক ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী’র সঙ্গে বাস করতেন।
পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির ছ’মাসের মধ্যেই পাঁচ টাকা বৃত্তি পান । তাঁর প্রতিভার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে শিক্ষকেরা সকলে স্তম্ভিত । তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্মজীবন শুরু করেন ফোর্ট উইলিয়াম (১৮৪১) কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসাবে । ঐসময়েই তাঁর ইংরেজি শিক্ষার যথাযথ শিক্ষালাভ । কেননা বিদ্যাসাগরকে সকলে জানতেন সংস্কৃতের পন্ডিত হিসাবে । ইংরেজি হাতের লেখাও ছিল নজরকাড়া । ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজের অনেক সংস্কার করেন। সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, শিক্ষা প্রসারে তাঁর আরও অবদান সর্বজনবিদিত । এর আগে এ কলেজে পড়ার অধিকার ছিল কেবল ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য ছাত্রদের, কিন্তু তিনি সব শ্রেণির হিন্দুদের জন্যে কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করেন। ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে বাংলা ভাষাকে সহজবোধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন । ১৮৫৫ সালে বাংলা নববর্ষের দিনে প্রথম বর্ণপরিচয় প্রকাশ করে তিনি বাঙালীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন। ১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৮৫৯ সালে তিনি “ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল” স্থাপনে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। ১৮৬৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় “হিন্দু মেট্রেপলিটন ইসস্টিটিউট”। বিদ্যাসাগর হন এর সেক্রেটারী। ১৮৭২ সালে এটিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর এবং ১৮৭৯ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত করা হয়। বর্তমানে এর নাম “বিদ্যাসাগর কলেজ”। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ, বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন । সেদিনের সমাজে প্রচলিত প্রথার নির্মম পরিণতির জন্য নারীদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন আপামর জনতা অবলোকন করেছিলেন । শোনা যায়, একসময় রাজা রাজবল্লভ নিজের বালবিধবা কন্যাকে পুনর্বিবাহ দেওয়ার অনুমতি সমাজের পন্ডিতদের কাছ থেকে পেয়েও সেই বিবাহ কারও কারও বাধায় দিতে পারেন নি । যাই হোক ১৮৫৫ জানুয়ারি মাসে বিদ্যাসাগরের “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা” বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশ ও সমাজ চমকে উঠেছিল । শেষ পর্য্যন্ত ১৮৫৫ সালের ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয় । বিদ্যাসাগরের দরদী হৃদয় কেঁদেছিল সেকালের সমগ্র হিন্দু নারী সমাজের দুর্গতি দুর্দশায় । বিধবা বিবাহ আইন নামে পরিচিত ১৮৫৬ সালের আইনটি কেবলমাত্র বিধবা নারীর দ্বিতীয় বিবাহের স্বীকৃতি দেয়নি, আইনটি যেমন বিবাহকে আইনসিদ্ধ করে তেমনই মৃত স্বামীর এবং দ্বিতীয় বিবাহের এবং পৈত্রিক বিষয় সম্পত্তিতে অধিকার সুনিদ্দিষ্ট করে । বিভিন্নভাবে জানা যায়, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ পর্য্যন্ত মোট ৬০টি বিধবা বিবাহ সংঘটিত হয় । আরও জানা যায়, বিদ্যাসাগর ও তাঁর বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচন্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তাছাড়া নিজের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। এতে একটা জিনিস পরিস্কার, বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগরের শতভাগ সাফল্য সর্বজনবিদিত ।
তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন, যাকে পরবর্তীতে বেথুন কলেজ নামকরণ করা হয়। নারীদের শিক্ষার দিকে আনার জন্য তিনি একটি অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন, যা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখান থেকে মেয়েদের শিক্ষার জন্য যাবতীয় অর্থের ব্যবস্থা করা হতো। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের দয়া এবং মানবিকতার জন্যে তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিত (তাঁকে এ বিশেষণ প্রথমে দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত) । তিনি তাঁর দান এবং দয়ার জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ঐতিহ্যিক এবং রক্ষণশীল পরিবারে এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি যুক্তিও দিতেন হিন্দু শাস্ত্র থেকে কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান মনের। তাঁর বোধোদয় গ্রন্থ যেমন তিনি শুরু করেছেন পদার্থের সংজ্ঞা দিয়ে। পরে সংজ্ঞা দিয়েছেন ঈশ্বরের, যাঁকে তিনি বলেছেন সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান চৈতন্যস্বরূপ।
বিরাট ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অথচ চালচলনে তিনি ছিলেন নিতান্তই সাদাসিধে । খুব বিনয়ী ছিলেন এবং জীবনে দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে কাটিয়ে দিলেন। তিনি একাধারে মহান সমাজ সংস্কারক অন্যদিকে এক জন শিক্ষাবিদ ছিলেন এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করে গেছেন অবিরাম । ভারতে শিক্ষার প্রতি তার অবদান এবং নারীর অবস্থার পরিবর্তন জন্য তিনি চিরস্বরণীয়। তাঁর অবর্ণনীয় মাতৃ ভক্তি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও চর্চিত ।
——————————-০———————————————–
মো – ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

মাতৃভাষা ও সত্যিকারের মা ::: শুভঙ্কর দাস।।।

“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে,”

আমি জানি এই দুটি চরণ পড়া মাত্র পাঠক পরের দুটি চরণ অনায়াস আনন্দে উচ্চারণ করে ফেলবেন।
এবং কবির নামও হয়তো বলতে পারবেন।
অবশ্য এই কবির পুত্রের নাম জীবনানন্দ দাশ,এক ডাকে সকলেই জানেন।কবিতা পড়েন।এখনও পর্যন্ত বাংলা কবিতার জগতে তাঁর প্রভাব রবীন্দ্রনাথের পরেই…
কীভাবে লিখতেন কবি জীবনানন্দের মা,
সংসারের কাজকর্মে ফাঁকে ফাঁকে অবলীলায় কবিতা রচনা করতে পারতেন।হয়তো খুব ব্যস্ত হয়ে কিছু করছেন,’ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এখুনি কবিতা চাই,প্রেসে পাঠাতে হবে,লোক দাঁড়িয়ে আছে।
শুনে কবি-মাতা খাতা কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একটা হাতে খুন্তি, অপর হাতে কলম নাড়ছেন,যেমন চিঠি লিখছেন।বড়ো একটা ঠেকছে না কোথাও! এবং সম্পাদক মহাশয় একটু পরে হাতে পেতেন একটি মৌলিক কবিতা।
এবং এই দৃশ্য রান্নাশালের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতেন বালক জীবনানন্দ, খুবই অবাক হতেন!
এবং জেনে রাখুন,মায়ের কবিত্ব ও বই পড়ার আগ্রহই জীবনানন্দকে কবিতার প্রতি,বইপাঠের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।মা তাঁকে বই পড়তে ও কবিতা লিখতে প্রাণিত করতেন।
এবং পড়াতেন মহাপুরুষের জীবনী,যাতে জীবনানন্দ তাঁদের জীবনের ওপর কবিতা রচনা করতে পারে,আসল অর্থ ছিল,সেই জীবনের কথা জেনে নিজের জীবনের পথ তৈরি করা।
এইভাবে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জীবনানন্দের কবিতা,দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে নিয়ে।
নাম ছিল,’দেশবন্ধু প্রয়াণে’।
কবিতাটি কেমন হয়েছে জানার জন্য মায়ের কাছে নিয়ে যায় পত্রিকাটি।
তাতে মায়ের মতামত হল,চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে লিখেছো, ভালোই করেছ,কিন্তু রামমোহন ওপর লিখতে বলেছি তোমাকে,মহর্ষির ওপরেও”
এইরকমভাবে পুত্র জীবনানন্দকে মাতা একটা মহাপুরুষের তালিকা করে দিয়েছিলেন।
কারণ তাতেই হবে—

” মুখে হাসি,বুকে বল,তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে,এই তার পণ”

সেই পণে ও মায়ের ঐকান্তিক আলোর পথে গিয়ে আমরা পেলাম বাংলা কবিতার এক মহা-অনুভবী কবিকে,যাঁকে পাঠ ছাড়া আধুনিক কবিতার গতি ও গর্ব নেই!
মায়ের নাম নিশ্চিত জানেন?
এটি কমেন্টে লিখুন,কারণ এই ধরণের মায়ের বড় অভাব বর্তমান সময়ে,বই পড়া তো দূরের কথা,মহাপুরুষের জীবনীপাঠ তো পরের কথা,সন্তানকে মোবাইল আসক্তি থেকে সরাতে গিয়ে নিজেই একটি অ্যাপে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন!এখনকার মিনি মাতাগণ
নিজেই বই পড়েন না!মহাপুরুষের জীবনী পড়েন না! ফলে যেমন বৃক্ষ, তেমনই ফল…
তাই এই মাতা-কবির নাম কমেন্ট-ঘরে লিখুন এবং অন্তর সঠিক পথে চালিত হোক।কারণ

“আমাদের দেশে হবে সেই মা কবে?
মোবাইল ছাড়িয়ে বই ধরিয়ে দেবে
মুখে বাংলা, বুকে বাংলা, বই-ভরা মন
পাঠক হতেই হবে এই সত্য আমরণ”

একান্ত ক্ষমাপ্রার্থী শুভঙ্কর দাস।

Share This