Categories
অনুগল্প প্রবন্ধ

সাহিত্যের ছোটো আকাশ, বড়ো আকাশ : শুভঙ্কর দাস।

এই সময়ের সাহিত্যের আকাশটা বড় থেকে
ছোটো হয়ে আসছে
তার প্রধান তিন কারণ

এক
এই সময়ের সাহিত্যচর্চায় সত্যিকারের সন্ধানীহাতের বড় অভাব।অর্থাৎ খুঁজে খুঁজে নবীন প্রতিভা বের করে প্রতিষ্ঠা দান।তার মারাত্মক অভাব।অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেই খুঁজে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিস্ময়কর আভিধানিক আবিষ্কার করেছিলেন।বুদ্ধদেব বসুর উদারতায় ও আহ্বানে জীবনানন্দের মতো বিরল প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছিল, আজকের জয় গোস্বামী, শ্রীজাত,বিনায়ক, মন্দাক্রান্তা, এমন কি মায়ে সুবোধ সরকার পর্যন্ত সকলেই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আনন্দময় সান্নিধ্যের পক্ষপাতপুষ্ট প্রতিভা।এই সূত্রে প্রবাদপ্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষের নাম স্মরণীয়। তাঁর গৃহের রবিবারের আড্ডা তো অসংখ্য সৃজনশীল হাওয়ার বাতাস হয়ে ওঠার সিঁড়ি ছিল।
এখানে উচ্চারিত নামগুলো শুধু উদাহরণ, কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য উল্লিখিত নয়, এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিভাবান এবং সাহিত্যে সৎ।
এই সময় প্রিয় ‘কবিসম্মেলন’ পত্রিকার দুই মহারথী কবি শ্যামলকান্তি দাশ ও শংকর চক্রবর্তী নীরবে ও নির্দ্বিধায় শস্যরোপনের কাজটি করে চলেছেন।এঁরা ব্যতিত নবীন প্রতিভার দাঁড়ানোর স্থান এতখানি অকুলান, তাতে যাকে অনুপ্রেরণা বলে,তা সত্যিকারের অণু হয়ে থেকে গেছে।
তাহলে
বল মা দাঁড়াই কোথা?

দুই
আপনার পাশের সাহিত্যরচনাকারীটি আপনার লেখা পড়েন না!
অর্থাৎ মহানগর তো দূরের নক্ষত্র, মফস্বলি কোনো সৃজনকর্মের পাঠক মফস্বলের পাওয়া দুষ্কর। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় কতজন সম্পাদক, সাহিত্যিক এবং সংগঠক আছেন,যাঁরা হাতে প্রাপ্ত কবিতা-গল্প-উপন্যাস যাই পান,তার এক পাতাও উলটে দেখেন কি না সন্দেহ!
ফলে তাঁর মুখে এই আফসোস প্রতিফলিত, আজকাল ভালো লেখার বড় অভাব! আসলে তিনিই যে সবচেয়ে অভাবী,দরিদ্র, একথা কাকে বোঝানো যাবে?
ঠিক একই কথা বাচিকশিল্পীদের ক্ষেত্রে খাটে,তাঁরা এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছেন,তিনি এখনও গলার শিরা ফুলিয়ে এবং হস্তসঞ্চালনপূর্বক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম এবং সুকান্তে আওড়ে চলেছেন।তাঁরা অবশ্য অনেক খুঁজে খুঁজে সুনীলের নির্বাসন,শক্তির অবনী বাড়ি আছো? জয় গোস্বামীর মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয় আর সুবোধের শাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেছেন,তারপর? তারপর? তারপর সবই অঙ্কে যত শূন্য পেলে!
না, না, মোটেই আমরা বলছি না,যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত-সুকুমার পড়বেন না,আবৃত্তি করবেন না,বরং এঁদের সৃষ্টি না পড়লে,যেকোনো সাহিত্যের লাজ অসম্পূর্ণ, তা তো সত্য। কিন্তু তার পাশে নতুন জমিও সন্ধানের চোখ,কণ্ঠ এবং হস্তসঞ্চালন রাখুন,তাহলে আকাশটা বড় হবে,আপনিও…
কিন্তু তা হচ্ছে না!
ফলে নবীন প্রতিভা শেষ পর্যন্ত সেই এলেবেলে আস্তাকুঁড়ে ভবিষ্যতের বীজধান হয়ে শুয়ে থাকে!

তিন
এরপর প্রকাশক!
এঁরা এক আশ্চর্য আকাশ! বাংলা সাহিত্যের প্রবহমান ধারার ধারক ও বাহক!
যাঁরা পড়েন কম, প্রকাশ করেন বেশি!তার থেকেও ব্যবসায় আবেগ খাটান আরও আরও বেশি!
আমি বই ব্যবসায়ে নেমেছি,ব্যবসাকেই প্রধান করে দেখব,একদম সঠিক।তাই তাঁদের বই প্রকাশ করে চলেন,যাঁদের বাজার তৈরি আছে।
এবং যাঁরা বাজার তৈরি করে দিতে পারবেন!
এবং তাঁদের, যাদের হাতে নিজস্ব বাজার আছে!
ফলে প্রকাশকগণ নিজে খেটে, নিজে হেঁটে প্রতিভার সন্ধান বন্ধ করে রেখেছেন!
কিন্তু এতে একদিন দেখা যাবে সাহিত্যের মৃত রথী-মহারথী ছাড়া কোনো জীবিত প্রতিভার বই প্রকাশের সুযোগ পাওয়া যাবে না!
চলুক,এইভাবে চলুক…
কিন্তু তাঁরা এটা কি বোঝেন,যদি সত্যিকারের সন্ধানী চোখ দিয়ে নবীন নবীন প্রতিভা তুলে ধরে বাজারে রাখার চেষ্টা করি,তাদের মধ্যে কেউ না কেউ পাঠকসমাজ পাবেন,ফলে আবার নতুন করে বাজার তৈরি হবে!
কিন্তু সেই ঝুঁকি নিতে এঁরা আগ্রহী নয়! ফলে সাহিত্যের আকাশ,শুধু লেখার নয়, প্রকাশেরও ছোট হতে হতে সমুদ্র থেকে গর্ত হয়ে যাবে!
এবং একদিন কলেজ স্ট্রিট না গিয়েও বলে দেওয়া যাবে,ওখানে কী বই বিকোয় এবং কী বই শুকোয়!

এই সবের ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
কিন্তু তা এতো যৎসামান্য যে,আকাশটাকে কিছুতেই বড় করতে পারছে না! বরং সেই সব ব্যতিক্রমীদের এমনভাবে বাধা-বিপত্তির বেড়াজালে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদের নাভিশ্বাস আকাশ পর্যন্ত ওঠে না!

সুপ্রিয় সচেতন পাঠক,
এই কথাগুলো চোখ চারিয়ে,হৃদয় মিশিয়ে এবং বোধ পিষিয়ে রচিত।এ-র সঙ্গে আপনি একমত হতে পারেন আবার নাও হতেন পারেন!
আপনি কমেন্ট করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন!
সেটা সম্পূর্ণ আপনার মনন এলাকা।
কিন্তু এই আলোচনা পাঠের পর কথককে অকারণে ও অযৌক্তিক নেতিবাচক এবং সূচীশিল্পে বিদ্ধ না করিয়া কীভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নস্যাত করা যায়,তাই লিখুন…
আপনার মতামতের জন্য তো ফেসবুকে পোস্ট করা…

ওহ্ হ্যাঁ,ফেসবুক।
জয় ফেসবুকস্বতী।

যার কেউ নেই, তার ফেসবুক আছে।
এবং তাই বোধহয় হলদিয়া টু হাওড়া,কলকাতা টু কাঠমান্ডু,ঢাকা টু কাশ্মীর,নিউইয়র্ক টু নদের গঞ্জ পর্যন্ত আকাশটা বেঁচেবর্তে আছে!

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

টুকাই : রাণু সরকার।

পতিত বস্তু পথ থেকে তুলে তুলে জড়ো করে বস্তায় নানান জায়গা থেকে, কখনো ডাস্টবিন ঘেঁটে।
ছোটবেলা থেকে বঞ্চিত মাবাবার ভালোবাসা থেকে। এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা মা বাবার সাথেই কুড়িয়ে বেরায় জঞ্জাল।
এই আবর্জনা কুড়িয়ে বিক্রি করে যা টাকা পায় কোনরকমে পেট চলে, ওদের ঘর নেই, রাস্তার ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়।
মেয়েদের সমস্যা বেশিরভাগ,অন্ধকার নেমে আসলেই ভয়ে ভয়ে রাত কাটে- কখন কি অঘটন ঘটিয়ে দেয় হিংস্রের দল। একদিন এক ঝুপড়ির দুহিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র জন্তু, মনে হয় তার খাদ্যের অনটন দেখা দিয়েছিল, আসলে বিনামূল্যে গায়ের জোরে খাবার মেলে যে ঝুপড়িতে। সেই দুহিতা কিছুদিনের মধ্যেই হয় অন্তঃসত্ত্বা, আর কি করা ওদের সাথে তো কেউ নেই ঘৃণার চোখে দেখি তাই অস্বাভাবিক ভাবেই হলো গর্ভমোচন। এরাতো টুকাই- তাই না?ছেলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো কিছুদিন লালনপালনও করলো। কি জানি কে চুরিও করে নিলো শিশুটিকে সন্তান হারা মা এখন পাগল।কে করবে ওর চিকিৎসা?

পাশের এক ঝুপড়ির টুকাই সব দেখে ভয় পেলো – ওরকম যদি ওর হয়।
এই টুকাই একটু বুদ্ধিমতী ছিলো তাই সে একদিন জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবহৃত আবরক কিনে রাখলো তার আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এক ওষুধের দোকান থেকে-দোকানী টুকাইয়ের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে-ভাবতে থাকে যে কি করবে-হয়তো পরে ভাবনার উত্তর ঠিক খুঁজে পেয়েছে।
কোন হিংস্র আসলে অনিচ্ছাকৃত এই অস্ত্রটি হাতে তুলে দিয়ে বলবে, এই নে– আমার অস্ত্র দিয়ে আমাকে খুন কর—

ভাবা যায় না সচরাচর এইরকম ঘটেই চলছে- এই টুকাই দের কথা ভাবি না, নিজেকে নিয়েই থাকি ব্যস্ত।

Share This
Categories
অনুগল্প প্রবন্ধ

স্বামীজি ও বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন : তন্ময় সিংহ রায়।

জাহাজ ও দু-দুটো ট্রেন পাল্টে অবশেষে ৩০ শে জুলাই রাত ১১ টায় তিনি উপস্থিত হলেন শিকাগোয়।
ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরটা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে তাকে ফেলেছে এক চরম অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতে, এমনটাই মনে হচ্ছিল। পরিস্থিতি ধারণ করলো আরো জটিল আকার যখন তিনি জানতে পারলেন যে, ধর্মমহাসভায় পরিচয় পত্র আবশ্যক ও যোগদানের তারিখ-ও পেরিয়ে গেছে।
মুহুর্তের মধ্যেই মনে হতে লাগলো অতি যত্নে সাজানো সমস্ত রঙীন স্বপ্নগুলো তাঁর চোখের সামনেই হয়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো!
এদিকে শিকাগোর মতন বড়লোকি শহরে থাকার খরচ।
সামান্য পুঁজি ফুরিয়ে আসার মুহুর্তে তিনি আবিষ্কার করলেন বস্টন নামক একটি শহর যেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ অনেকাংশে কম। অবশেষে বস্টন অভিমুখে রওনাকালীন ট্রেনে পরিচয় হয় ক্যাথেরিন স্যানবর্ন নামক এক ধনী ও প্রভাবশালী মহিলার সাথে।
প্রতিভাদীপ্ত সুদর্শন এক পুরুষের সাথে তিনি নিজেই এসে পরিচয় করে দু-এক কথায় মুগ্ধ হয়ে স্বামীজি-কে তার বাড়িতে থাকার জন্যে জানালেন হার্দিক আমন্ত্রণ!
এ অবস্থায় স্বামীজি সাদরে গ্রহণ করলেন সে আমন্ত্রণ। ক্যাথেরিন স্যানবর্নের বাড়িতে থাকাকালীন স্বামীজি তাঁর এক শিষ্যকে চিঠিতে জানালেন, ‘এখানে থাকায় আমার প্রতিদিনের এক পাউন্ড করে বেঁচে যাচ্ছে আর তাঁর(ক্যাথেরিন স্যানবর্ন) প্রাপ্তি হল, তিনি তাঁর বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে দেখাচ্ছেন ভারতের এক বিচিত্র জীবকে!’
বস্টনে থাকাকালীন ক্যাথেরিন স্যানবর্নের সূত্রে সেখানকার শিক্ষিত সমাজে স্বামীজি হয়ে উঠেছিলেন ভীষণভাবে পরিচিত। অকস্মাৎ ক্যাথেরিনের মাধ্যমে স্বামীজির পরিচয় হয় হাভার্ড ইউনিভার্সিটির এমন একজন সুবিখ্যাত প্রফেসার জন হেনরি রাইটের সাথে যাকে বলা হত বিশ্বকোষতুল্য জ্ঞানভান্ডারের অধিকারী। কিন্তু স্বামীজির তেজোদীপ্ত প্রতিভার আলোক ছটায় বিষ্ময়ে হতবাক হলেন তিনিও। পরিচয়পত্র না থাকায় তিনি (স্বামীজি) মহাধর্মসম্মেলনে যোগ না দিতে পারার সংক্ষিপ্ত কারণ বিশ্লেষণে প্রফেসার প্রত্যুত্তর করলেন, ‘মহাশয়, আপনার কাছে পরিচয়-পত্র চাওয়ার অর্থ এমন যে সূর্যকে প্রশ্ন করা যে তার কিরণ দেওয়ার অধিকার আছে কিনা।’ অতঃপর মহাধর্মসম্মেলনের এক কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে প্রফেসার রাইট লিখলেন :
‘ইনি (স্বামীজি) এমন একজন ব্যক্তি যে, আমেরিকার সমস্ত প্রফেসারের পান্ডিত্য এক করলেও এঁর পান্ডিত্যের সমান হবে না।’ অবশেষে স্বামীজী’র মনে হতে লাগলো তাঁর রঙীন স্বপ্নগুলো জোড়া লাগতে শুরু হল আবার ধীরে ধীরে।
বস্টনে সপ্তা তিনেক থাকার পর শেষে তিনি রওনা হলেন শিকাগো অভিমুখে।

১১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩, শিকাগোর কলম্বাস হলে সকাল দশটায় বিশ্ব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল যে আধিদৈবিক সিংহপুরুষের দ্বিতীয় অধিবেশনের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে তিনি-ই হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
“সিস্টার্স এন্ড ব্রাদার্স অফ অ্যামেরিকা”…… হাজার হাজার দর্শকমণ্ডলীর হর্ষধ্বনি ও করতালিতে ফেটে পড়েছিলো মঞ্চ।
মনে হচ্ছিল এক সংক্ষিপ্ত শক্তিশালী আঁধি সেই মুহুর্তে, সেই স্থানের উপস্থিতজনেদের উপর দিয়ে বয়ে গেলো। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের জয়ঢাক তিনি বাজাননি। মহা ধর্মসম্মেলনে যেখানে সবাই নিজ নিজ ধর্ম সম্বন্ধেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেখানে স্বামীজি দেখিয়েছিলেন, সব ধর্মই সত্য কারণ প্রতিটি ধর্মই মানুষকে পৌঁছে দেয় একই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে।

১৯৯২ সালে স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার একশত বছর পূর্তির আগে এলেনর স্টার্ক নামক এক আমেরিকান মহিলা স্বামীজিকে নিয়ে ‘দ্য গিফট আন-ওপেন্ড.. এ নিউ আমেরিকান রেভলিউশন’ নামক একটি বই লিখেছিলেন যাতে লেখিকা স্বামীজির বাণীকে বর্ণনা করেছেন ‘উপহার’ বলে অর্থাৎ, ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকাকে দেওয়া উপহার।
তিনি বলেছেন, সেই উপহারের প্যাকেট আমেরিকা খুলে দেখেনি, স্বামীজির বাণীকে তারা জীবনে ব্যবহার করেনি। যদি তারা তা করত, একটা নতুন ধরণের বিপ্লব ঘটে যেত আমেরিকাবাসীদের জীবনে।’ ঐ বইতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকা মহাদেশের ভূখন্ডটা কিন্তু বিবেকানন্দ আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকার আত্মাকে!’

‘আমি মুসলমানের মসজিদে যাব, খৃষ্টানদের গির্জায় প্রবেশ করে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর সামনে নতজানু হব, বৌদ্ধদের বিহারে প্রবেশ করে আমি বুদ্ধের শরণাপন্ন হব আবার অরণ্যে প্রবেশ করে হিন্দুদের পাশে বসে ধ্যানমগ্ন হব…. শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যে সব ধর্ম আসতে পারে, তাদের জন্যেও আমার হৃদয় আমি উন্মুক্ত রাখবো।’ (স্বামীজির বাণী) ।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমরা স্বল্প শিক্ষিত ও সীমিত জ্ঞানীরা চুড়ান্ত সাম্প্রদায়িক, আত্মকেন্দ্রিক ও চরম ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বইছে আমাদের রক্তে। তাঁর আদর্শের পরমানুটুকুও ক্রমশঃ আমাদের শরীর থেকে হতে চলেছে নিশ্চিহ্ন!
শরীরের লজ্জা আমরা সহজেই ঢাকতে পারি পোষাক দিয়ে কিন্তু মনুষ্যত্বের এ লজ্জা আমরা ঢাকবো কোন পোষাকে??

 

( তথ্য সংগৃহীত)

Share This
Categories
অনুগল্প

হতভাগিনী মা : তন্ময় সিংহ রায়।

——————————— আমার দশ বছরের জন্মদিনে তুমি বাবাকে বলেছিলে…’কি গো শুনছো? এবারে পূজোয় আমি তোমার কাছে কিছুই চাইবোনা, তুমি আমার সোনাকে একটা সাইকেল কিনে দাও।’
আমার স্বাধীনচেতা বাবার কাছে চাকরীটা ছিলো হুকুমের গোলাম-এর মতন, স্বভাবতই বাবার ইচ্ছেটা চাকরীর বিপক্ষে বলাটাই এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আদর্শবান নিম্ন মধ্যবিত্তের যে কত জ্বালা বাবা সেটা বুঝতেই চাইতেন না বলতেন,
‘তোমরা কি না খেয়ে-পরে আছো? প্রয়োজনগুলো কি খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছে তোমাদের ?’ মনে হতো পরোক্ষভাবে বাবা বোঝাতে চাইতেন, গ্রামের রবীন খুড়ো, দিপু’র মা, শুক্লাদি, ঝুনু মাসি ওদের ছায়ায় বসে অনুপ্রেরণা কুড়াও গভীর মনযোগে। বিশেষত অর্ধাহারে, অনাহারে থাকা পাড়ার যত পড়াশুনা করা ছেলে-মেয়ে, প্রায় বেশিরভাগের-ই উপকরণসহ যথাসম্ভব শিক্ষা সরবরাহের একমাত্র অফিস ছিলো যেনো বাবার ওই প্রাচীন আধখাওয়া ফ্যাকাসে লাল উন্মুক্ত ইঁটগুলোর ঘরটা।
কেউ সারামাস পড়ে একটা লাউ, কেউ দু-কৌটো চাল আবার কেউবা তার পুকুরের মাঝারি সাইজের দুটো পোনা মাছ নিয়ে হাজির হতো। এক্ষেত্রে বাবার অপছন্দটা বিশেষ গুরুত্ব পেতো যে নাই তা আমি আর মা বেশ ভালোই বুঝতাম। একনিষ্ঠভাবে সারাটা জীবন পাড়ার ছেলেমেয়ে মানুষের দায়িত্বেই বাবা হয়ে গেলেন বার্ধক্যের বাহাত্তর!

আমার তখন সাতাশ বছর তিন মাস দু-তিনদিন বোধ হয় হবে, হঠাৎ-ই একদিন গভীর রাতে অসম্ভব বুকের যন্ত্রণা, মুহুর্তেই সব শেষ!
একটা জমকালো নিস্তব্ধ রাত হিংস্রভাবে যেনো ছিনিয়ে নিলো বাবার হৃদপিন্ডটা!
যে মানুষটা আমাদের জন্যে, গ্রামের ছেলে-মেয়েদের জন্যে প্রায় সারাটা জীবন এত কিছু করলেন, সুযোগ-ই দিলেন না তিনি তাঁর জন্যে শেষ সময়-ও কিছু করার। চোখের সামনে জীবন্ত দেখলাম ওই কালো রঙা প্যাঁচাটা’র সাথে আমার ‘বাবা’ শব্দটা উড়ে বেরিয়ে চলে গেলো বহু দূরে! সারাজীবনের মতন জীবন থেকে হারিয়ে গেলো আমার ‘বাবা’ ডাক-টা। অসম্ভব বুকের যন্ত্রণাসহ জল ভরা দু-চোখ নিয়ে একজন আদর্শবান নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবার চিতার লালচে-হলুদ আগুনকে আমি দেখেছিলাম পাথর দৃষ্টিতে!
সেই থেকে ভগ্নহৃদয়ের অসহায়া মা-এর একমাত্র দুশ্চিন্তার কারণ হলাম আমি! আর্থিক সামর্থ্য ছিলো না আমার বাবার, একটা মধ্যবিত্ত/উচ্চমধ্যবিত্ত স্বামী কেনার, তায় দেখতে আমি মন্দ! বেশ ভালোই বুঝতে পারতাম আমার মায়ের ঢাকা যন্ত্রণা-টা!
সেই প্রবাদ বাক্যটার স্মৃতিচারণে (একে রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর) কাটতে লাগলো আমার অতি সাধারণ পিতৃহারা জীবন অর্থাৎ বাবার মৃত্যু শোকে মা ছিলেন মর্মাহত তার ওপরে আবার আমার দুশ্চিন্তা!

কিছুদিন স্বাভাবিক…..
শুরু হয়ে গেলো গ্রামের কানাঘুষো….’বুড়ি মেয়েটা ঘরে বসে আছে, আর কতদিন এভাবে চলবে কে জানে! বিয়ে হবেনা ওর… কে নেবে ওকে!’ মনে হতে লাগলো বাবার আদর্শের প্রতিফলন বুঝি এমন-ই হয়! পাড়ায় বেরোলেই নানা লোকের নানা নেতিবাচক মন্তব্যে বৃদ্ধা অসহায়া মা-টা আমার বাড়িতে ফিরতো যন্ত্রণাকে দ্বিগুণ করে। বেশ কয়েকবার-ই অনুভব করেছি, রাতে না ঘুমিয়ে মায়ের ডুকরে কান্নার শব্দ!

সহ্য একদিন লঙ্ঘন করলো তার সীমা, আর দেখতে পারলাম না আমার মায়ের এ কষ্ট! বারে বারেই আমায় রেটিনায় গঠন হতে থাকলো শুধু আমার বৃদ্ধা মায়ের কষ্টের প্রতিবিম্বটা! একদিন গভীর রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম সোজা চলে পাশের গ্রামের প্রধানে’র একমাত্র চরিত্রহীন, মোদো-মাতাল, বখাটে ছেলেটার দামি নরম গদি’র বিছানায়….,ক্ষুধার্ত নেকড়ের সহজপাচ্য খাদ্য হয়ে বললাম,’ সিঁথিতে আমায় সিঁদুরটা অন্তত টেনে দিস, একটা স্থায়ী ভোগ্য বস্তু পাবি আর পাবি সেবা দাসী।’
সেদিন ভোরে সিঁথি রাঙিয়ে আমি হলাম একজন চরিত্রহীনা কলঙ্কিতা ও অবহেলিত স্ত্রী। এভাবেই টেনে হিঁচড়ে চলতে থাকে আমার জীবন!….. বহুদিন আর ফিরিনি গ্রামে। দিন গেছে, রাতের পর রাত পেরিয়ে আবার নতুন ভোরের আলোয় আলোকিত হয়েছে প্রকৃতি। বারে বারে মনে পড়েছে আমার বৃদ্ধা মা-টাকে!
কেমন আছে আমার মা-টা? কি খাচ্ছে? কে করে দিচ্ছে ঘরের কাজগুলো, নিশ্চই বুড়ি হয়ে গেছে অনেক?
প্রশ্নগুলো অসহায়ভাবে কেবলি ছটফট করেছে সারা মন জুড়ে! যন্ত্রণার তিক্ষ্ণ ফলায় রক্তাক্ত হয়েছি বারে বারে, তবুও যেতে পারিনি আমার গ্রামটায়, আমার মায়ের কাছে!…..
কখনও চিৎকার করে হাউ হাউ করে কেঁদে জানতে ইচ্ছে করতো ‘মা তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না? আমি তোমার যোগ্য সন্তান হয়ে তোমার কোলে ফিরতে পারিনি মা’… কেনো?… তার উত্তর খোঁজেনি কেউ!………………

হঠাৎ-ই আগুনের একটা হলকা’র ছেঁকা গায়ে লাগতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলাম আমি!
চারিদিকে লোকজন, কারো হাতে বাঁশ…কারো হাতে মাটির কলসী আর মাঝে মধ্যেই উচ্চারিত হচ্ছে ধ্বনি…. ‘বল হরি, হরি বল!’ দেখলাম দাউ দাউ করে জ্বলছে আমার হতভাগিনী মা-টা!!….. আজ অনেকদিন পরে সেই কলঙ্কিতা আমি আমার মায়ের ঝলসে যাওয়া দেহের সামনে বসে!!

Share This
Categories
অনুগল্প

বুড়িটা বোঝেনি সে কথাগুলো : তন্ময় সিংহ রায়।

এ গ্রহের উদ্ভিদ বড়জোর আর ক’টা দিন তাকে দেবে অক্সিজেন!
বিভিন্ন প্রসাধনীতে যে ত্বক একদিন ধরে রাখতো তার লাবণ্য, বেশ কয়েক বছর হল শেষ নিঃশ্বাসটাও ত্যাগ করেছে সেটা!
অসংখ্য ভাঁজে সে হারিয়েছে তার স্বাভাবিক রুপ!
ঘুমন্ত শিরা ধমনীগুলো প্রতি মুহুর্তে আজ উপেক্ষা করে ত্বক’কে!
যে স্নিগ্ধ-স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ছিল পরম মমতার কোমল স্পর্শ, সে ঝাপসা দৃষ্টিও আজ চরম অনাদরে ও অবহেলায় ভাসে নোনাজলে!
হাঁটুর নিচ পর্যন্ত যে ঘন কালো চুল সমগ্র মাথা জুড়ে বসে থাকতো সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে, আজ ক্লোরোফিলের চরমাভাব সেগুলোতে স্পষ্ট!
দুর্বল পা’দুটো টেনে হিঁচড়ে কোনরকমে বাধ্য হয়ে পালন করে ভারসাম্যহীন একটা শরীরের কর্তব্য!

আজ প্রায় বছর দেড়েক হল, প্রতিদিন বিকেল চারটে বাজলেই বুড়ি’টা জানালাটার লোহার রডগুলোকে ধরে তাকিয়ে থাকে দুরে ওই মাঠটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে!
কৌতুহলদীপ্ত জনা-তিনেক মন-এর জানার প্রবল ইচ্ছাকে দমন করতে না পেরে অবশেষে একদিন বুড়িটা বলেই বসে,
তার একমাত্র আদরের সোনার টুকরো জীবন! তার ছোট্ট ছেলেটা নাকি ভীষণ চঞ্চল!
কোথায় খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে বিষম চোট পায়, রক্ত বেরোয় কেটে গিয়ে, কি করে বসে!… তাই প্রতিদিন খেলার সময়ে তিনি তাকে অস্পষ্ট ও নিষ্পলক দৃষ্টিতেও দুর্বল রেটিনায় বসিয়ে নাকি তাকে করে রাখেন নজরবন্দী।

পরম মমতার এরূপ মর্মান্তিক প্রতিফলনে বিষ্ময়ে হতবাক চশমাবৃত ছ’টা দুর্বল চোখের অশ্রুগ্রন্থি নিঃসৃত করেছিলো কিছু সুপরিচিত(তাদের কাছে)বেদনাশ্রু!
বোঝানোর সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম সত্বেও সে বুড়িটা বোঝেনি যে তাঁর সোনার টুকরো ছেলেটা আজ প্রাপ্তবয়স্ক।
এ পৃথিবীর অনেক কিছুই এখন সে বোঝে, বিয়ে করে একটা বউ এনেছে সে ঘরে।
আর বউয়ের অপছন্দটা ছেলের কাছে আজ তাঁর(বুড়ির)চেয়ে বেশি মূল্যবান!
মূল্যটাকে হীন করে অব্যবহৃত প্রাণহীন আসবাবপত্রের মতন তাঁকে(বুড়িকে ফেলে রেখে গেছে এই ঘরেই, তাঁদের(অন্যান্য বৃদ্ধাদের)সাথে!
তার শেষ জীবনের ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া-পাওয়া, আশা, স্বপ্ন, ভরসা সবই বর্জ্যের ন্যায় তাচ্ছিল্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে এই প্রাণহীন আবদ্ধ ইঁটের খাঁচায়!
তার ‘একমাত্র আদরের সোনার টুকরো জীবন’-এ, সবচেয়ে কম অধিকারটুকুও সে হারিয়েছে!
বুড়িটা বোঝেনি যে, আজ আর তার সোনার টুকরো ছেলেটা রাতে দুধের জন্যে ডুকরে কেঁদে ওঠেনা!
তাকে আজ আর পরাতে হয়না যত্ন করে কাজল টিপ!
ছোট্ট আঙুলটা ধরে অতি যত্নে গুটি গুটি পায়ে মায়ের সাথে হাঁটার প্রয়োজনটা ফুরিয়েছে!
স্কুল থেকে এসেই ঝপাস করে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে অভুক্ত মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আজ আর বলেনা….
‘মাগো খিদে পেয়েছে, ভাতটা মেখে খাইয়ে দাও!’
বুড়িটা বোঝেনি সে বোঝানো কথাগুলো!

একদিন গহীন রাতে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে বুড়িটা চিৎকার করে উঠলো বলে,
‘সোনা আমার, ওদিকে যাসনা বাবা!… ওদিকে পুকুর আছে!’

সেই জানালাটা তেমনি আছে, আছে দিগন্ত বিস্তৃত সেই খোলা মাঠটাও, কিন্তু শুষ্ক ত্বকের মমতা মাখানো সেই হাতদুটো বিকেল চারটে-তে আর কোনোদিনও স্পর্শ করেনি লোহার রডগুলোকে সেদিন রাতের পর!!

Share This