Categories
উপন্যাস গল্প

চিঠিতে লেখা প্রেম।

🧩 গল্পের সারাংশ:

এই গল্প একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক অসম্ভব প্রেমের, যেখানে দু’জন অচেনা মানুষ — ঋদ্ধি ও আকাশ — এক ভুল ঠিকানায় পৌঁছানো চিঠি থেকে শুরু করে, এক গভীর আত্মিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সময়, দূরত্ব, পরিবার ও সমাজের বাস্তবতা তাদের পরীক্ষা নেয়, কিন্তু ভালোবাসা বারবার ফিরে আসে… কখনো চিঠিতে, কখনো নীরবতায়।

🎭 প্রধান চরিত্র:

ঋদ্ধি সরকার: কলকাতার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে, সাহিত্যে আগ্রহী, আবেগপ্রবণ, অন্তর্মুখী।

আকাশ দত্ত: এক গ্রাম্য ডাকঘরের কর্মচারী, শান্ত স্বভাবের, কবিতা ভালোবাসে, দায়িত্বশীল।

কাকলি (ঋদ্ধির বন্ধু), মিস্টার মুখার্জি (আকাশের ডাকঘরের বস), ঋদ্ধির বাবা-মা, আকাশের দিদি মালবিকা — সহায়ক চরিত্র।

🗂️ গল্পের কাঠামো (২৫ পর্ব):

ভুল ঠিকানায় পাঠানো চিঠি

আকাশের আগ্রহে প্রথম উত্তর

চিঠির উত্তর-পত্র চলতে থাকে

নামহীন পরিচয়ের টান

ঋদ্ধির কাকলির সন্দেহ

আকাশের ব্যক্তিজীবন প্রকাশ

ঋদ্ধির কলেজে নাটক, প্রথম কবিতা পাঠ

আকাশের ডাকঘরের গোলমাল

ঋদ্ধির অভিমান

এক দীর্ঘ চিঠিতে ক্ষমা

আকাশের দিদির দেখা মেলানো চেষ্টা

পুজোর সময় কলকাতায় দেখা হতে পারত

দেখা হয়নি, বেড়ে যায় দুরত্ব

ঋদ্ধির বাবা অন্যত্র বিয়ের প্রস্তাব দেন

আকাশের ভেতর যুদ্ধ

কাকলির সাহসী পদক্ষেপ

ঋদ্ধির বিদ্রোহ

প্রথম ফোনালাপ

একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে

আকাশ কলকাতা আসে

মুখোমুখি দেখা

পরিবার জানে সব

সম্পর্কের স্বীকৃতি চাওয়া

চিঠির শেষ পাতা

নতুন ঠিকানা — একই নামে

এখন নিচে এই কাহিনির জন্য একটি কল্পচিত্র তৈরি করছি, যাতে পুরো সিরিজটির অনুভব উঠে আসে।

📖 চিঠিতে লেখা প্রেম

পর্ব ১: ভুল ঠিকানায় পাঠানো চিঠি
কলকাতার একটি মেঘলা বিকেল। ঋদ্ধি তার জানালার ধারে বসে ছিল, এক হাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে একটি সাদা খাম। চোখে চিন্তা — চিঠিটা লিখেছে সে, কিন্তু পাঠাবে কি পাঠাবে না, তা বুঝে উঠতে পারছে না।
চিঠিটা সে লিখেছে একজনকে, যার নাম অনিরুদ্ধ — তার কলেজের সিনিয়র, যাকে সে অনেক দিন ধরে পছন্দ করে। কিন্তু সাহস হয়নি মুখোমুখি বলার। সে ভেবেছিল, একটা চিঠি পাঠালে হয়তো মনের কথা কিছু বলা যাবে।
অবশেষে, খানিক সাহস করে সে পিন কোড, এলাকা সব লিখে দিয়ে পোস্টবক্সে ফেলে দেয় চিঠিটা।
তবে ভুলটা সেখানেই ঘটে।
ঋদ্ধি ভুল করে পিন কোডে দুটি সংখ্যা উল্টে লিখে ফেলে। চিঠিটা পৌঁছে যায় ৭০০০১৬ নয়, ৭০০০৬১-তে — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক ছোট ডাকঘরে।
অন্যদিকে —
সেই ছোট্ট ডাকঘরের ভিতরে এক তরুণ কর্মচারী — আকাশ দত্ত। ছুটির শেষে একটা অদ্ভুত চিঠি তার হাতে এসে পড়ে। প্রাপক যাকে লেখা, সেই ঠিকানায় এমন কেউ নেই।
কিন্তু চিঠির কাগজে এমন শব্দ, এমন আন্তরিকতা — যেন সেটা কারোর ব্যক্তিগত কবিতা।
“তুমি জানো না আমি কে, কিন্তু আমি তো তোমায় প্রতিদিন দেখি…” — এমন এক চিঠির পংক্তি পড়ে আকাশ অবাক হয়।
সে ভাবে: “এই চিঠির উত্তর যদি দিই? যদি তার লেখার মতো করে লিখি কিছু? সে কি উত্তর দেবে?”
সেই সন্ধ্যায়, আকাশ লেখে তার জীবনের প্রথম চিঠি — যা ঠিক প্রেরকের নামে নয়, বরং এক অচেনা হৃদয়ের খামে।

 

📖 চিঠিতে লেখা প্রেম

পর্ব ২: (আকাশের আগ্রহে প্রথম উত্তর)

আকাশ দত্তর জীবন ছিল একরকম ছন্দে বাঁধা — সকালে অফিস, দুপুরে চা, বিকেলে কাগজপত্রের ঝাঁপি গুছিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা।
কিন্তু সেই একটি ভুল ঠিকানায় পৌঁছনো চিঠি যেন তার ছন্দে এক নতুন সুর এনে দিল।
চিঠিটা সে অন্তত দশবার পড়েছে।
লেখা ছিল —
“তুমি জানো না আমি কে, তবু প্রতিদিন তোমার চোখে কিছু দেখার ইচ্ছে হয় আমার। যদি জানত তুমি, কীভাবে আমি তোমায় অনুভব করি — হয়তো হাসতে, হয়তো কাঁদতে।”
চিঠির লেখার ভঙ্গি আকাশকে অভিভূত করেছিল। এই যে কেউ একজন, এই শহরের কোথাও, এমন নিঃশব্দে কারো দিকে তাকিয়ে প্রেম করছে — একরকম সাহস আর নরম আবেগের সংমিশ্রণ ছিল তাতে।
সেই রাতে আকাশের ঘরে ছিল কেরোসিনের আলো।
সে টেবিলে বসে প্রথমবার কাগজে কলম রাখে, অনেক ভেবে লিখে ফেলে:

“প্রিয় অচেনা তুমি,
তোমার লেখা পড়ে আমি ভীষণ চমকে গেছি। চিঠিটা কাকতালীয়ভাবে আমার হাতে পড়েছে।
জানি, তুমি যাকে চিঠি লিখেছো, আমি সে নই। তবু তুমি যা লিখেছো, তা এতটা সত্য আর আন্তরিক, যে আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি।
আমি জানি না, তুমি আমাকে উত্তর দেবে কিনা, কিংবা আদৌ পড়বে কিনা আমার চিঠি।
তবু যদি উত্তর দাও, তবে আমি খুশি হব।
— আকাশ”

চিঠিটা শেষ করে সে লিখে দেয় খামের গায়ে প্রেরকের ঠিকানা — ঋদ্ধি সরকার।
তারপর পোস্ট করে দেয় পরদিন সকালে।
কলকাতার অন্যপ্রান্তে, দুদিন পরে, ঋদ্ধি ডাকঘর থেকে ফেরার পথে চিঠি হাতে পায়। প্রথমে অবাক হয়ে ভাবে — “আকাশ? কে?”
চিঠি খুলে পড়ে সে অবাক হয়ে যায় —
“তার মানে… আমার চিঠি… সে পেয়েছে? কিন্তু সে তো অনিরুদ্ধ না!”
তবু, চিঠির একেকটা বাক্য তার মনে নরম স্পর্শ ছুঁয়ে যায়।
একটা অচেনা নাম, এক অচেনা ভাষা — কিন্তু তাতে এক অদ্ভুত টান।
চোখে যেন ধরা পড়ে এক স্বীকারোক্তি —
“ভুল ঠিকানায় পাঠানো ভালোবাসা যদি উত্তর পায়, তবে সেটা কি সত্যিই ভুল থাকে?”

 

পর্ব ৩: (চিঠির উত্তর-পত্র চলতে থাকে)

ঋদ্ধি চিঠিটা পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। জানালার কাঁচে ধেয়ে আসা হালকা বৃষ্টি আর দূরের কাকের ডাক যেন চুপচাপ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার ভেতরের আলোড়নের।
চিঠিটা সে বারবার পড়ে। কে এই আকাশ? ডাকঘরের কর্মচারী, কিন্তু কী সুন্দরভাবে লিখেছে! কোনো অভিযোগ নেই, কৌতূহলও কম — তবু কোথাও যেন একটা ভদ্রতা মেশানো আন্তরিকতা।
তারপর হঠাৎ যেন একটা কিশোরীর হাসি ঝরে পড়ে ওর ঠোঁটে।
“চলো, এই খেলাটা দেখি কতদূর যায়। চিঠিতে চিঠির জবাব দেওয়া — এটাও তো একরকম প্রেম নয় কি?”
সেই রাতে সে লিখে ফেলে তার উত্তর।

প্রিয় আকাশ,
তোমার চিঠি পেয়ে বিস্ময় আর আনন্দ একসাথে কাজ করেছে।
হ্যাঁ, এই চিঠি আমি অনিরুদ্ধ নামে একজনকে লিখেছিলাম, যে হয়তো কোনোদিনই পড়বে না। তুমি পড়েছো, তাতে খারাপ লাগেনি। বরং ভালোই লেগেছে।
তুমি যদি লেখো, আমিও লিখব।
নাহ, আমরা কোনোদিন দেখব না হয়তো, তবু কয়েকটা পৃষ্ঠা থাক আমাদের মাঝে।
তুমি জানতে চেয়েছিলে আমি কে — আমার নাম ঋদ্ধি, সাহিত্যে স্নাতক করছি। কবিতা পড়ি, সিনেমা দেখি, আর মাঝে মাঝে এমন চিঠি লিখি…
তুমি লিখতে পারো, আকাশ। ঠিকানাটা তো এখন জানো।
— ঋদ্ধি

চিঠিটা পাঠিয়ে দিয়ে সে একরকম অপেক্ষা করতে থাকে।
প্রথমে ১ দিন, তারপর ২ দিন, ৩ দিন…
৪র্থ দিনে এক বিকেলে আবার এক খাম আসে।
আকাশের লেখা — নীল কালিতে।
এবার লিখেছে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ছোটবেলার গল্প, কীভাবে সে প্রতি সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে কবিতা পড়ে…
আর শেষে লিখেছে:

*”তুমি বলেছিলে, আমরা দেখা করবো না।
আমি বলছি, চিঠিতে যদি একদিন চোখে দেখা পাওয়া যায় — তবে আর বাইরে দেখা না হলেও চলবে।”*

ঋদ্ধির মুখে এক শান্ত হাসি।
এইভাবে শুরু হয় চিঠির যাত্রা —
সপ্তাহে একবার করে।
কখনো কবিতা, কখনো গল্প, কখনো নিঃশব্দ যন্ত্রণার কথা — তারা সব বলে, শুধু লিখে।

 

পর্ব ৪: (নামহীন পরিচয়ের টান)

চিঠির খামে কখনো নাম থাকত না — শুধু “প্রিয় তুমি” আর “তোমার আকাশ”।
সপ্তাহের সেই নির্দিষ্ট দিনে ঋদ্ধি ডান হাতের কড়ে আঙুলে মেহেদির মতো অপেক্ষা বয়ে বেড়াত — আজ চিঠি আসবে।
আর আকাশ? সে প্রতিদিন ডাকঘরের ব্যাগ থেকে একটা খালি জায়গা রেখে দিত — ওখানে থাকত ঋদ্ধির চিঠির জন্য আলাদা জায়গা।
তাদের মধ্যে কোনো মোবাইল নম্বর নেই, ছবি নেই, সোশ্যাল মিডিয়াও না।
তবু এই অদ্ভুত অদৃশ্য যোগাযোগ — একটা অদেখা মানুষের জন্য এমন করে অপেক্ষা?
প্রথমে কাকলি — ঋদ্ধির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী — কিছু না বুঝে জিজ্ঞেস করেছিল,
— “তোকে কি সত্যিই চিঠিতে ভালো লাগা শুরু হয়েছে? নাম জানিস, পেশা জানিস, ছবি জানিস না। তার মানে কি?”
ঋদ্ধি শুধু হেসে বলেছিল,
— “কিছু কিছু সম্পর্ক জানার নয়, অনুভব করার। ওর নাম তো আকাশ — সীমাহীন, অথচ ধরা যায় না।”
অন্যদিকে আকাশও এক সন্ধ্যায় লিখে ফেলে:

“প্রিয় তুমি,
আজ সকাল থেকে অফিসে খুব চাপ, কিন্তু মাথার ভিতরে শুধু একটা কথাই ঘুরছে —
তোমার চোখ কেমন? তুমি বৃষ্টিতে ভেজো? চায়ের কাপ ধরে গাল ভিজে যায় তোমার?
কেমন অদ্ভুত না, আমি এসব জানি না, তবু মনে হয় জানি।
তুমি কি আমায় দেখতে চাও?
নাকি এই না-দেখা, না-জানা ভালোবাসাটাই আমাদের গল্প?”
— তোমার আকাশ

ঋদ্ধি উত্তর দেয় না সোজাসুজি। পরের চিঠিতে সে শুধু লিখে —

“বৃষ্টিতে ভেজা চোখের ছবি ভালোবাসি। দেখা নয়, অনুভব — সেটাই সবচেয়ে সত্যি।”

তারা নিজেরা যেন এক ছায়ায় ছায়া খুঁজছিল। এক অচেনা টান, এক নামহীন গভীরতা তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক এমন জগতে, যেখানে পরিচয় মুখ নয়, আত্মা।
এইভাবে কেটে যায় কয়েকটি মাস।
শহরের মাঝে, ছেলেমেয়ের গলার সুরে, বইমেলার ভিড়ে, তারা আলাদা আলাদা থেকেও যেন একসাথে হাঁটছিল।
তাদের নাম ছিল না একে অপরের ঠোঁটে, কিন্তু হৃদয়ের পৃষ্ঠায় একেকটা চিঠি হয়ে লিখে যাচ্ছিল —
ভালোবাসার অপরিচিত গল্প।

অসাধারণ! নিচে আমি তোমার জন্য পর্ব ৫ থেকে ১০ পর্যন্ত গল্পটি পরপর সাজিয়ে দিচ্ছি। প্রতিটি পর্ব ছোট ছোট করে হলেও আবেগ, টান ও নাটকীয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।

পর্ব ৫: (কাকলির সন্দেহ)।

কাকলি এখন আর চুপ করে নেই।
একদিন চিঠিগুলো দেখে বলে বসলো,
— “দেখ, ঋদ্ধি, অচেনা কারও সঙ্গে এমন আবেগ দিয়ে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। হয়তো ও বিবাহিত, কিংবা…”
— “তুমি ওকে চেনো না, কাকলি,” বলে ঋদ্ধি শান্তভাবে চিঠিগুলো গুছিয়ে রাখে।
— “তুইও কি চাস না, একবার ওকে দেখতে?”
— “না কাকলি। আমি চাই চিঠিগুলো থাকুক… ওকে না দেখেই এই অনুভবটা সত্যি।”
কিন্তু কাকলির মনে একটা অস্থির সন্দেহ বাসা বাঁধে — আর সে চুপচাপ কিছু খোঁজ নিতে শুরু করে…

পর্ব ৬: (আকাশের ব্যক্তিজীবন প্রকাশ)।

ঋদ্ধির চিঠির উত্তরে আকাশ এবার নিজের কিছু ব্যক্তিগত কথা জানায়।

“তুমি জেনো, আমি ছোটবেলা থেকে বইয়ের মধ্যে থাকতাম। মা মারা যান যখন আমি দশ বছরের, বাবা এরপর আর নতুন সংসার করেননি। এখন আমি আর দিদি — আমাদের দুইজনের ছোট সংসার।
আমি চিঠিগুলোর মধ্যে যেন একটা বন্ধ দরজার ওপাশে আলো দেখি — সেই আলো তুমি।
তুমি কেমন? তোমার মা-বাবা? কাউকে বলেছো আমার কথা?”

ঋদ্ধির চোখে জল আসে। সে ভাবে, একজন ছেলে, এতটা ভেতর খুলে দেয় কাউকে — শুধু চিঠিতে?
এই গভীর আত্মার ছোঁয়া যে খুব কম পাওয়া যায়।

পর্ব ৭: (ঋদ্ধির কলেজে নাটক, প্রথম কবিতা পাঠ)।

ঋদ্ধির কলেজে বসন্তোৎসব। সে এবার নিজের লেখা কবিতা পাঠ করবে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার চোখ বারবার খোঁজে সেই একজনকে, যে আসবে না, তবু তার সব কবিতার উৎস।
সে পড়ে তার নিজের লেখা কবিতা:

“চিঠির কাগজে আঁকা নামহীন মুখ,
প্রতিটি অক্ষরে তুমি ছিলে, তবু চেনা হলে না।
তুমি এসোনি কোনো সন্ধ্যায়,
কিন্তু আমার প্রতিটি সকাল, তোমায় দিয়েই শুরু।”

বন্ধুরা প্রশংসা করে, কিন্তু সে জানে কবিতার মূল শ্রোতা আজ নেই।
পরদিন সে চিঠির সঙ্গে কবিতার কপি পাঠিয়ে দেয় আকাশকে।

পর্ব ৮: (আকাশের ডাকঘরের গোলমাল)।

ডাকঘরে হঠাৎ চিঠি হারানোর অভিযোগে একটা তদন্ত হয়।
আকাশকে প্রশ্ন করা হয় — সে কি ব্যক্তিগত চিঠি খুলে পড়ে?
কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। ঋদ্ধির চিঠির কথা কাউকে না বলে কেবল নিজের সততা প্রমাণ করে।
বস, মিস্টার মুখার্জি, পরে বলে,
— “তোকে জানি বেটা, কিন্তু সাবধান। আজকের দিনে কেউ কাউকে চিঠি লেখে?”
আকাশ একভাবে হেসে ফেলে।
সে জানে, আজও কেউ কেউ হৃদয়ের খামে ভালোবাসা ভরে পাঠায়…

পর্ব ৯: (ঋদ্ধির অভিমান)।

এক সপ্তাহ চিঠি আসে না।
ঋদ্ধি ঘুমাতে পারে না, চোখে কালি পড়ে যায়।
সে ভাবে —
“তাহলে কি আকাশও চলে গেল? সেও কি এখন বাস্তবের দিকে ফিরে গেল?”
চিঠির প্রতীক্ষায় দিন কেটে যায়।
অবশেষে চতুর্থ সপ্তাহে চিঠি আসে, কিন্তু অল্প কথায় লেখা:

“কিছুদিন ডাকঘরের ঝামেলায় মন ছিল না, দুঃখ দিয়েছি।
তবে বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে লেখা বন্ধ করিনি — শুধু একটু হারিয়ে গিয়েছিলাম।
তুমি রাগ করো?
তুমি কি এই চিঠির উত্তর দেবে, নাকি আমায় ক্ষমা করবে না আর?”
— তোমার আকাশ

ঋদ্ধি ভেতরে কেঁপে ওঠে।
তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ে — সে রাগ করতে পারেনি, শুধু মন খারাপ করেছিল।
সে উত্তর লেখে —

“আমি চিঠি পাওয়ার অপেক্ষা করি, রাগ করি না। আমি আজকাল তোমার শব্দেই বাঁচি আকাশ…”

পর্ব ১০: (এক দীর্ঘ চিঠিতে ক্ষমা)।

এই পর্বে আকাশ নিজের সমস্ত অনুশোচনা এক চিঠিতে লেখে।

“ঋদ্ধি, তুমি জানো, চিঠি না পাঠিয়ে আমি নিজেকেই যেন ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি এখন বুঝি, এই চিঠিগুলো শুধু লেখা নয় — এটা আমাদের অস্তিত্ব।
আমি তোমায় না দেখে ভালোবেসে ফেলেছি, হয়তো অযৌক্তিক, কিন্তু এর চেয়ে সত্য আর কিছুই নেই।
যদি পারো, আমাকে ক্ষমা কোরো।
আমি আর কখনো হারিয়ে যাবো না।”

চিঠির শেষে ছিল একটা প্রশ্ন —
“তুমি কি আমাকে ঠিকঠাক ভালোবাসো, ঋদ্ধি?”
ঋদ্ধি উত্তর দেয় না সাথে সাথে।
সে জানে, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে… তার ভিতরটাও মেলে ধরা।
তার চোখে তখন মেঘ জমে —
“ভালোবাসা কি সত্যিই হয় চিঠিতে?
না কি… এটাও একটা গল্প মাত্র?”

অসাধারণ! নিচে আমি তোমার জন্য পর্ব ৫ থেকে ১০ পর্যন্ত গল্পটি পরপর সাজিয়ে দিচ্ছি। প্রতিটি পর্ব ছোট ছোট করে হলেও আবেগ, টান ও নাটকীয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।

📖 চিঠিতে লেখা প্রেম

পর্ব ৫–১০

পর্ব ৫: কাকলির সন্দেহ

কাকলি এখন আর চুপ করে নেই।
একদিন চিঠিগুলো দেখে বলে বসলো,
— “দেখ, ঋদ্ধি, অচেনা কারও সঙ্গে এমন আবেগ দিয়ে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। হয়তো ও বিবাহিত, কিংবা…”
— “তুমি ওকে চেনো না, কাকলি,” বলে ঋদ্ধি শান্তভাবে চিঠিগুলো গুছিয়ে রাখে।
— “তুইও কি চাস না, একবার ওকে দেখতে?”
— “না কাকলি। আমি চাই চিঠিগুলো থাকুক… ওকে না দেখেই এই অনুভবটা সত্যি।”
কিন্তু কাকলির মনে একটা অস্থির সন্দেহ বাসা বাঁধে — আর সে চুপচাপ কিছু খোঁজ নিতে শুরু করে…

পর্ব ৬: আকাশের ব্যক্তিজীবন প্রকাশ

ঋদ্ধির চিঠির উত্তরে আকাশ এবার নিজের কিছু ব্যক্তিগত কথা জানায়।

“তুমি জেনো, আমি ছোটবেলা থেকে বইয়ের মধ্যে থাকতাম। মা মারা যান যখন আমি দশ বছরের, বাবা এরপর আর নতুন সংসার করেননি। এখন আমি আর দিদি — আমাদের দুইজনের ছোট সংসার।
আমি চিঠিগুলোর মধ্যে যেন একটা বন্ধ দরজার ওপাশে আলো দেখি — সেই আলো তুমি।
তুমি কেমন? তোমার মা-বাবা? কাউকে বলেছো আমার কথা?”

ঋদ্ধির চোখে জল আসে। সে ভাবে, একজন ছেলে, এতটা ভেতর খুলে দেয় কাউকে — শুধু চিঠিতে?
এই গভীর আত্মার ছোঁয়া যে খুব কম পাওয়া যায়।

পর্ব ৭: ঋদ্ধির কলেজে নাটক, প্রথম কবিতা পাঠ

ঋদ্ধির কলেজে বসন্তোৎসব। সে এবার নিজের লেখা কবিতা পাঠ করবে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার চোখ বারবার খোঁজে সেই একজনকে, যে আসবে না, তবু তার সব কবিতার উৎস।
সে পড়ে তার নিজের লেখা কবিতা:

“চিঠির কাগজে আঁকা নামহীন মুখ,
প্রতিটি অক্ষরে তুমি ছিলে, তবু চেনা হলে না।
তুমি এসোনি কোনো সন্ধ্যায়,
কিন্তু আমার প্রতিটি সকাল, তোমায় দিয়েই শুরু।”

বন্ধুরা প্রশংসা করে, কিন্তু সে জানে কবিতার মূল শ্রোতা আজ নেই।
পরদিন সে চিঠির সঙ্গে কবিতার কপি পাঠিয়ে দেয় আকাশকে।

পর্ব ৮: আকাশের ডাকঘরের গোলমাল

ডাকঘরে হঠাৎ চিঠি হারানোর অভিযোগে একটা তদন্ত হয়।
আকাশকে প্রশ্ন করা হয় — সে কি ব্যক্তিগত চিঠি খুলে পড়ে?
কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। ঋদ্ধির চিঠির কথা কাউকে না বলে কেবল নিজের সততা প্রমাণ করে।
বস, মিস্টার মুখার্জি, পরে বলে,
— “তোকে জানি বেটা, কিন্তু সাবধান। আজকের দিনে কেউ কাউকে চিঠি লেখে?”
আকাশ একভাবে হেসে ফেলে।
সে জানে, আজও কেউ কেউ হৃদয়ের খামে ভালোবাসা ভরে পাঠায়…

পর্ব ৯: ঋদ্ধির অভিমান

এক সপ্তাহ চিঠি আসে না।
ঋদ্ধি ঘুমাতে পারে না, চোখে কালি পড়ে যায়।
সে ভাবে —
“তাহলে কি আকাশও চলে গেল? সেও কি এখন বাস্তবের দিকে ফিরে গেল?”
চিঠির প্রতীক্ষায় দিন কেটে যায়।
অবশেষে চতুর্থ সপ্তাহে চিঠি আসে, কিন্তু অল্প কথায় লেখা:

“কিছুদিন ডাকঘরের ঝামেলায় মন ছিল না, দুঃখ দিয়েছি।
তবে বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে লেখা বন্ধ করিনি — শুধু একটু হারিয়ে গিয়েছিলাম।
তুমি রাগ করো?
তুমি কি এই চিঠির উত্তর দেবে, নাকি আমায় ক্ষমা করবে না আর?”
— তোমার আকাশ

ঋদ্ধি ভেতরে কেঁপে ওঠে।
তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ে — সে রাগ করতে পারেনি, শুধু মন খারাপ করেছিল।
সে উত্তর লেখে —

“আমি চিঠি পাওয়ার অপেক্ষা করি, রাগ করি না। আমি আজকাল তোমার শব্দেই বাঁচি আকাশ…”

পর্ব ১০: এক দীর্ঘ চিঠিতে ক্ষমা

এই পর্বে আকাশ নিজের সমস্ত অনুশোচনা এক চিঠিতে লেখে।

“ঋদ্ধি, তুমি জানো, চিঠি না পাঠিয়ে আমি নিজেকেই যেন ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি এখন বুঝি, এই চিঠিগুলো শুধু লেখা নয় — এটা আমাদের অস্তিত্ব।
আমি তোমায় না দেখে ভালোবেসে ফেলেছি, হয়তো অযৌক্তিক, কিন্তু এর চেয়ে সত্য আর কিছুই নেই।
যদি পারো, আমাকে ক্ষমা কোরো।
আমি আর কখনো হারিয়ে যাবো না।”

চিঠির শেষে ছিল একটা প্রশ্ন —
“তুমি কি আমাকে ঠিকঠাক ভালোবাসো, ঋদ্ধি?”
ঋদ্ধি উত্তর দেয় না সাথে সাথে।
সে জানে, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে… তার ভিতরটাও মেলে ধরা।
তার চোখে তখন মেঘ জমে —
“ভালোবাসা কি সত্যিই হয় চিঠিতে?
না কি… এটাও একটা গল্প মাত্র?”

 

পর্ব ১১: (আকাশের দিদির দেখা মেলানোর চেষ্টা)।

আকাশের দিদি মালবিকা অনেক দিন ধরেই ছোট ভাইয়ের এই “চিঠি প্রেম” নিয়ে চিন্তিত।
একদিন রাতে আকাশ যখন রান্নাঘরে, তখন মালবিকা ওর ড্রয়ার থেকে কয়েকটা চিঠি দেখে ফেলে।
চোখে পড়ে —

“ঋদ্ধি সরকার, কলেজ স্কোয়ার, কলকাতা…”

মালবিকা ঠিক করে, ছেলেটাকে বাঁচাতে হলে, মেয়েটার বাস্তব অস্তিত্ব জানা দরকার।
সে নিজের একজন পরিচিতের মাধ্যমে কলেজ স্কোয়ার এলাকায় খোঁজ শুরু করে…
পায় একটা সূত্র —
“ঋদ্ধি, কলকাতার সিটি কলেজে পড়ে, সাহিত্যের ছাত্রী।”
মালবিকা আর আকাশকে কিছু না বলে চুপচাপ একদিন কলকাতা রওনা দেয়…

পর্ব ১২: (পুজোর সময় কলকাতায় দেখা হতে পারত)।

এদিকে শরৎ এসেছে। দুর্গাপূজার ঢাকে শহর ভরে গেছে।
ঋদ্ধি আকাশকে চিঠিতে লিখে —

“পুজোর সময় যদি তুমি কলকাতায় আসো, আমি কলেজ ফেস্টিভ্যালে কবিতা পাঠ করব।
দেখা না হলেও, crowd-এর মধ্যে একটা অচেনা চোখ যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে… জানব, তুমি এসেছো।”

আকাশ খুব করে চায় যাওয়া, কিন্তু অফিস থেকে ছুটি মেলে না।
তার দিদি তখনো শহরে… এবং সে গিয়ে দেখে ঋদ্ধিকে ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করতে।
এক মুহূর্ত, মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সাদা-শাড়ি-পরা মেয়েটার চোখে একরাশ গভীরতা দেখে মালবিকা থমকে যায়।
সে ভাবে,
“এই মেয়েটাই কি আমার ভাইয়ের চিঠির নায়িকা?”
কিন্তু সে সামনে গিয়ে কিছু বলে না। শুধু দূর থেকে দেখে যায়।

পর্ব ১৩: (দেখা হয়নি, বেড়ে যায় দূরত্ব)।

পূজোর পর চিঠিতে ঋদ্ধি লেখে:

“তুমি এলে না কেন? আমি ওইদিন একটু একটু করে তোমাকে খুঁজছিলাম।
crowd-এ অনেক চোখ, কিন্তু কোনোটাই ছিল না আমার আকাশ…”

আকাশ কেবল লিখে:

“তুমি বলেছিলে দেখা না হলেও চলবে… এখন তুমি কাঁদছো কেন?”

ঋদ্ধি অভিমান করে চিঠির উত্তর দেয় না।
একটা সপ্তাহ, তারপর আরেকটা…
আকাশও কিছু লেখে না।
এক নীরবতা জমতে থাকে তাদের মাঝখানে —
যেন প্রতিটা না-পাওয়া শব্দ এক একটা শূন্য খাম হয়ে ফেরত যাচ্ছে…

পর্ব ১৪: (ঋদ্ধির বাবা অন্যত্র বিয়ের প্রস্তাব দেন)।

এক সন্ধ্যায় ঋদ্ধির বাবা বলেন,
— “একটা ভালো পরিবার থেকে প্রস্তাব এসেছে, ঋদ্ধি। ছেলে কলকাতায় চাকরি করে। দেখা করবি একবার?”
ঋদ্ধি চমকে ওঠে।
সে বলে না কিছু, শুধু নিজের ঘরে গিয়ে একটার পর একটা চিঠি বের করে বিছানায় ছড়িয়ে দেয়।
প্রত্যেকটা কাগজে যেন আকাশের ছোঁয়া —
তার না দেখা ভালোবাসা।
সে রাতটা ঘুমায় না। শুধু লেখে ডায়েরিতে —
“আমি যদি হেরে যাই, তাহলে কাগজের ভালোবাসা কি জিতবে কখনও?”

পর্ব ১৫: (আকাশের ভেতর যুদ্ধ)।

অন্যদিকে আকাশ মালবিকার মুখোমুখি।
মালবিকা বলে,
— “আমি ওকে দেখেছি। মেয়েটা খুব ভালো। কিন্তু ও তো জানে না তুমি কে। এক অদ্ভুত মোহ তৈরি হয়েছে তোমাদের মধ্যে।
এটা যদি একদিন ভেঙে পড়ে? ও কি সামলাতে পারবে?”
আকাশ চুপ করে থাকে।
তার মাথার ভিতর চলছে এক যুদ্ধ —
“আমি কি নিজে থেকেই দূরে সরে যাই?
নাকি ওকে জানাই আমি কে?
আমার ছবি পাঠাবো?
ও যদি আমাকে দেখে পছন্দ না করে? যদি…”
কিন্তু সেই রাতে, আকাশ একটা ছোট্ট খামে নিজের একটা পুরনো ছবি রেখে চিঠির সঙ্গে পাঠায়।
চিঠির শেষ লাইনে লেখে —

“ঋদ্ধি, আজ আমি তোমায় আমার মুখটা দিলাম।
দেখো, তুমি যদি ভালোবাসো আমাকে — চিঠির মতোই।”

পর্ব ১৬: (কাকলির সাহসী পদক্ষেপ)।

ঋদ্ধি আকাশের ছবি হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
না সে কাঁদে, না হাসে। কেবল দেখে। আর ভাবে –
“এই মানুষটাই? এই সেই আকাশ, যে আমার প্রতিটি দুঃখের ওষুধ হয়ে উঠেছিল?”
কিন্তু চিঠিতে সে কোনো উত্তর দেয় না।
দুদিন, চারদিন… এক সপ্তাহ কেটে যায়।
এদিকে কাকলি চুপচাপ সব লক্ষ্য করছিল।
একদিন সে বলে,
— “দেখ, তোদের গল্পটা কাগজে আঁকা, কিন্তু তাতে রং আছে। যদি তুই কিছু না বলিস, সব মুছে যাবে।
তোর যদি ভয় লাগে, আমি তোকে নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করব।”
ঋদ্ধি চমকে যায়।
— “তুই জানিস কোথায়?”
— “না, কিন্তু আমরা বের করব। পিওনের খামে মোহর দেওয়া নাম আর এলাকা তো রয়েছেই।”
সেই শুরু —
কাকলি ঠিক করে, সে নিজেই একদিন চিঠি লেখবে আকাশকে।

পর্ব ১৭: (ঋদ্ধির বিদ্রোহ)।

ঋদ্ধির বাবা আবার বিয়ের ব্যাপারে চাপ দেন।
তিনি বলেন,
— “এই বয়সে কবিতা দিয়ে পেট চলে না। ভালো ছেলে, ভালো চাকরি — জীবন সহজ হবে।”
ঋদ্ধি শান্ত গলায় বলে,
— “বাবা, তুমি কি জানো, আমি কোনোদিন কারো সঙ্গে এতখানি মন খুলে কথা বলিনি?
তুমি যাকে পছন্দ করছো, সে আমাকে বুঝবে তো?”
রাগে-অভিমানে সেই রাতে সে নিজের ঘরে বসে চিঠি লেখে আকাশকে:

“আমি জানি না আমাদের শেষ কোথায়, কিন্তু আমি চাই না এটা চিঠির মাঝখানে আটকে থাকুক।
আমি তোমাকে ছুঁতে চাই না, আমি তোমার সত্যটা জানতে চাই।
তুমি যদি পারো, এসো দেখা করতে।
আমি থাকব কলেজের সামনে, আগামী শনিবার, দুপুর ৩টায়।
যদি না আসো, বুঝব — গল্পটা শেষ।”

পর্ব ১৮: (প্রথম ফোনালাপ)।

আকাশ এই চিঠি পড়ে কাঁপতে থাকে।
সেই মুহূর্তে প্রথমবার সে নিজের মনের ভয় ভেঙে দিদিকে বলে,
— “আমাকে ওর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। এখনই। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে আগে…”
দিদি একটা ফোন নম্বর জোগাড় করে দেয়। কাকলির মাধ‍্যমে।
রাতে, বহুদিনের পর, চিঠির শব্দ কণ্ঠে রূপ নেয়।
ঋদ্ধি ফোনটা তোলে:
— “হ্যালো?”
— “আমি… আকাশ।”
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর দু’পাশেই নিঃশ্বাস।
আরো কিছু না বলেও তারা সব বলে ফেলে।
শব্দের মাঝখানে শুধু কান্না আর হাসির সুর।
ঋদ্ধি শুধু ফিসফিসিয়ে বলে,
— “তুমি আসবে তো?”
— “আসব। এবার সত্যিই আসব।”

পর্ব ১৯: (একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে)।

শনিবার সকাল।
আকাশ ট্রেন ধরে কলকাতা আসছে। তার ব্যাগে কয়েকটি চিঠি, একটা পুরনো বই, আর একটা ছোট্ট উপহার।
কিন্তু সেই মুহূর্তে, মালবিকা রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি।
আকাশ দ্বিধায় পড়ে যায় — সে কি যাবে দেখা করতে, নাকি থাকবে দিদির পাশে?
সে ফোন করে কাকলিকে —
— “ঋদ্ধিকে বলো, আমি কথা রেখেও রাখতে পারলাম না। আমি আসতে পারছি না…”
কাকলি ফোন রাখার পর ঋদ্ধিকে কিছু বলে না।
ঋদ্ধি বিকেলে কলেজ স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঘড়ির কাঁটা চলে যায় ৩টা, ৪টা, ৫টা…
সে জানে, হয়তো আকাশ আর আসবে না।
কিন্তু মন বলে —
“ভালোবাসা চলে যেতে পারে, কিন্তু প্রতীক্ষা কখনও মরে না…”

পর্ব ২০: (আকাশ কলকাতা আসে)।

তিনদিন পর মালবিকার অবস্থার উন্নতি হয়।
আকাশ সেই রাতেই একটি ট্রেন ধরে কলকাতা আসে।
সকাল ৬টা, সিটি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে…
সে দেখে — একজন মেয়ে মাধবীলতা ফুলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে ক্লান্তি, মুখে আলো।
ঋদ্ধি।
তারা চুপ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
নজর এড়িয়ে থাকা সেইসব চিঠির শব্দ যেন এবার হাওয়ায় ভাসে।
আকাশ ফিসফিস করে বলে —
— “তুমি চিঠিতে যেমন ছিলে, চোখেও ঠিক তেমনই…”
ঋদ্ধি শুধু বলে —
— “তুমি আসবে বলেছিলে। তুমি এসেছো। বাকিটা আমি মানি…”
এক মুহূর্ত, সময় থেমে যায়।
আর, একটা পুরনো প্রেম… কাগজের গন্ধ থেকে সত্যিকারের শ্বাসে রূপ নেয়।

পর্ব ২১: (মুখোমুখি দেখা)।

সিটি কলেজের সামনের সেই বেঞ্চ — যেখানে একসময় ঋদ্ধি একা বসে চিঠি লিখত, আজ সেখানেই বসে আকাশ।
দু’জনে একসাথে।
তারা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
পরে আকাশ বলে,
— “তুমি জানো? আমি ভেবেছিলাম দেখা হলে সবকিছু বদলে যাবে।
কিন্তু না… চিঠির ঋদ্ধি আর এই ঋদ্ধি — একদম এক!”
ঋদ্ধি হেসে বলে,
— “তুমি ঠিক বলেছো… চিঠিতে আমরা একে অপরের মধ্যে যা খুঁজেছি, চোখে সেটা হারাবে না। কারণ চিঠি তো শুধু কাগজ নয়, ওটা তো আত্মা।”
ওই বিকেলে, তারা আর কিছু চায় না — শুধু একটু পাশে থাকা, একটু চুপচাপ থাকাই যেন বহুদিনের পূর্ণতা।

পর্ব ২২: (পরিবার জানে সব)

ঋদ্ধি নিজের পরিবারকে সব বলে দেয়।
প্রথমে বাবা রেগে যান।
— “তুমি একজন সাধারণ ডাকঘরের কর্মচারীর সঙ্গে জীবন কাটাবে?”
মা বোঝাতে চেষ্টা করেন:
— “ওকে এতদিন তুমি জানো না, আর মেয়েটা তাকে ভালোবাসে… এতটাই গভীরভাবে।”
কিন্তু বাবা সহজে মানতে চান না।
তবু, আকাশের চিঠিগুলো পড়ে তাঁর মুখে একরকম নরমতা আসে।
তিনি বলেন,
— “ছেলেটার কলমে যা আছে, সেটা যদি তার হৃদয়ে থাকে — তাহলে আমি কিছু বলব না। কিন্তু জীবনটা কঠিন, ও পারবে তো?”
ঋদ্ধি জবাব দেয়,
— “যে মানুষ কথা না রেখেও ক্ষমা চাইতে জানে, সে কষ্ট এলেও পাশে থাকবে।”

পর্ব ২৩: (সম্পর্কের স্বীকৃতি চাওয়া)।

আকাশ এবার নিজের দিদিকে সব জানায়।
মালবিকা প্রথমে একটু চিন্তিত ছিল, কিন্তু তারপর বলে,
— “যদি ও তোমার সেই ঋদ্ধি হয়, তাহলে আর ভয় কিসে? এগিয়ে যা, ভাই।”
আকাশ এবং ঋদ্ধি এবার একসাথে দুই পরিবারের সামনে দাঁড়ায়।
আকাশ বলে,
— “আমি বড় কিছু দিতে পারব না, কিন্তু ওর প্রতিটি চিঠির মতোই প্রতিদিন ওর পাশে থাকব। ভুল করলেও চিঠির মতো ক্ষমা চাইব।”
বাবা একটু চুপ করে, তারপর বলেন,
— “আচ্ছা, এবার যদি আমার মেয়ের চোখের জল ফেলে রাখো — তখন কিন্তু আমি চিঠিতে নয়, সামনে দাঁড়িয়ে আসব!”
ঘরজুড়ে হাসি।
প্রেম এবার সত্যিকারের নাম পায় — “একটি সম্পর্ক”।

পর্ব ২৪: (চিঠির শেষ পাতা)।

বিয়ের ঠিক আগের রাতে আকাশ ও ঋদ্ধি আবার চিঠি লেখে —
একটি শেষ চিঠি, যেটা তারা একে অপরকে দেবে বিয়ের দিন সকালে।
চিঠিতে ছিল…
আকাশের চিঠি:

“আমার প্রিয় চিঠির মেয়ে,
আগামীকাল থেকে আমাদের আর কাগজে কাগজে দেখা হবে না।
তুমি আমার পাশে থাকবে, আমার হাতে হাত রাখবে, আর প্রতিটি কথা — সরাসরি হৃদয় থেকে কানে পৌঁছাবে।
তবুও এই শেষ চিঠি রাখো — যেন কোনোদিন ঝড় এলে, তুমি পড়ে নিতে পারো আমাদের শুরুটা।”

ঋদ্ধির চিঠি:

“আকাশ,
তুমি শুধু একজন চিঠির মানুষ ছিলে না, তুমি আমার নীরবতা ছিলে।
আমি জানি, একদিন আমাদের কথা কমে যাবে — দায়িত্বে, বাস্তবতায় হারিয়ে যাবে।
কিন্তু আমি প্রতিদিন অন্তত একবার তোমার নামের আগে ‘আমার’ শব্দটা বসিয়ে ভাবব — আর মনে করব, ‘আমার আকাশ’ তখনও আছে।”

পর্ব ২৫: (নতুন ঠিকানা — একই নামে)।

বিয়ের দিন।
ঋদ্ধি লাল বেনারসি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
আকাশ আশীর্বাদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে, চোখে জল।
পান্ডেল জুড়ে সবাই জানে — এই বিয়ে শুধু দুটি মানুষ নয়,
দুইটি আত্মা — যারা চিঠির অক্ষরে ভালোবেসেছিল।
বিয়ের পর প্রথম রাত।
আকাশ ঋদ্ধির হাতে একটা খাম দেয়।
ঋদ্ধি অবাক হয়ে বলে,
— “আবার চিঠি?”
আকাশ হাসে,
— “এটাই শেষ নয়।
এখন থেকে প্রতি বছর আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে আমি তোমায় একটা চিঠি লিখব…
ঠিক যেমন আমাদের শুরু হয়েছিল।”
ঋদ্ধি খামটা খোলে।
সেখানে লেখা ছিল —

“আমার নতুন ঠিকানা:
ঋদ্ধির হৃদয়ের ভেতরে,
চিরকাল আকাশ।”

✅ সমাপ্তি

চিঠিতে লেখা প্রেম —
একটি কাগজে আঁকা ভালোবাসা, যা কালজয়ী।

Share This
Categories
উপন্যাস নারী কথা

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দামাল মেয়ে কুহেলি (প্রথম পর্ব) :: দিলীপ রায়।।

সানাই কানাই দুই ভাই । সানাই বড় ও কানাই ছোট । সানাইয়ের মেয়ে কুহেলি । কাঞ্চন নগরে তাঁদের বাড়ি । দুই ভাইয়ের পাশাপাশি বসবাস । বেঁচে থাকতে সানাইয়ের বাবা জমি-জায়গা দুজনকে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে গেছেন । সানাইয়ের বেশী বয়সে বিয়ে । সেইজন্য বিয়ের অনেক বছর বাদে তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান, কুহেলি । সানাইয়ের জীবনে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা, কুহেলি জন্ম নেওয়ার সময় তার স্ত্রী বিয়োগ । স্ত্রীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল সানাই । কিন্তু কিছুটা ডাক্তারদের অবহেলার কারণে কুহেলির মায়ের অকাল বিয়োগ । সেই থেকে সানাই মনমরা ! তবুও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সানাইয়ের বাঁচার স্বপ্ন !
কিন্তু সমস্যা অন্যত্র । সমস্যা শুরু হলো কুহেলির পান্তা মাসিকে নিয়ে । পান্তা মাসি অল্প বয়সে বিধবা । পাশের গ্রাম সুরেশপুরে তার বাড়ি । প্রতিদিন সবজি বোঝাই ঝুড়ি মাথায় নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে বিক্রি । সবজি বিক্রি করে তার সংসার । পান্তা মাসির একটাই মেয়ে । অল্প বয়সে সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে । মেয়ের শ্বশুর বাড়ি ভরতপুরে । ভরতপুর ব্লক অফিসের পাশে জামাইয়ের চায়ের দোকান । চায়ের দোকান খুব চালু । ভাল ঘরে মেয়ের বিয়ে হওয়ায় পান্তা মাসির খুব শান্তি ! জামাই খুব কর্মঠ । ব্যবহার আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে আলাদা । মার্জিত স্বভাব ! সর্বোপরি জামাই পান্তা মাসিকে মায়ের চেয়েও বেশী শ্রদ্ধা করে । মেয়ে বিয়ে দিয়ে এইজন্যে পান্তা মাসির মনে খুব শান্তি । মেয়েটা অন্তত সুখে শান্তিতে বাকী জীবন কাটাতে পারবে !
মেয়ের বিয়ের পর থেকে পান্তা মাসি বাড়িতে একা । সারাদিন মাথায় ঝুড়ি নিয়ে এ-গাঁয়ে সে-গাঁয়ে ঘোরাঘুরি । গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে তার সবজি বিক্রি । দিনের শেষে তিন-চারশ টাকা লাভ । তাতেই পান্তা মাসির শান্তি । কেননা পান্তা মাসি অল্পতেই সন্তুষ্ট ।
কুহেলি হাই স্কুলে ভর্তি হলো । ক্লাস ফাইভে । কুহেলির মুখটা ভীষণ মিষ্টি । গাঁয়ের লোকজন প্রায়শই বলে, দুর্গা মায়ের মুখটা কুহেলির মুখে বসানো । তার নাকি প্রতিমার মতো সুন্দর মুখশ্রী । আপশোশ করে বয়স্ক মহিলারা বলেন, কুহেলির মা তাঁর মেয়েটার সুন্দর মুখশ্রী দেখে যেতে পারলো না । মুখপুড়িটা মেয়েকে জন্ম দিয়ে বিদায় নিলো ।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে পান্তা মাসির কুহেলিদের বাড়ি ঘন ঘন যাতায়াত । বাড়ি থেকে বেরিয়ে পান্তা মাসি সবজির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে প্রথমেই কুহেলিদের বাড়ি । সেই সময় কুহেলি ঘুম থেকে ওঠে । অন্যদিকে তার বাবা প্রাতর্ভ্রমণ সেরে বাড়ির দাওয়ায় বসে । পান্তা মাসি সানাইকে দেখতে পেলে সবজির ঝুড়ি নামিয়ে তাদের রান্না ঘরে ছোটে । চা বানিয়ে প্রথমে কুহেলির বাবাকে খাওয়ায় । তারপর কুহেলির জন্য টিফিন বানিয়ে দেওয়া । কাজের খুব চাপ না থাকলে, পান্তা মাসি কুহেলিদের দুপুরের রান্না বানিয়ে, তারপর সবজি বিক্রি করতে পাড়ায় ছোটে ।
রান্না ঘরে ঢোকার জন্য কুহেলির বাবার সঙ্গে পান্তা মাসির ঘনিষ্টতা ক্রমশ বাড়তে থাকে । সকাল আটটার মধ্যে কুহেলিদের বাড়ি ঢুকে নিজের বাড়ির মতো পান্তা মাসির কাজ শুরু হয়ে যায় । শোয়ার ঘরের বিছানা তোলা । ঘর-দোর ঝাঁট দেওয়া । কুহেলির যত্ন নেওয়া । কুহেলিকে স্কুলে যাওয়ায় আগে যেমন স্কুল ব্যাগ, স্কুলের জন্য আলাদা টিফিন, ইত্যাদি গুছিয়ে দেওয়া । সকালের চা-জলখাবারের পর্ব শেষ হয়ে গেলে দুপুরের রান্নায় মন দেয় । প্রতিদিন জেলেরা গাঁয়ে মাছ বিক্রি করতে আসে । তাদের কাছ থেকে নিজে মাছ কেনে পান্তা মাসি । ডাল ছাড়া প্রতিদিন মাছের ঝোল ও একটা সবজির তরকারি রান্না করা চাই । তবে রান্না করার পর নিজে কিছুতেই খাবে না । পান্তা মাসিকে খাওয়ার জন্য সানাই অনেক অনুরোধ করেছে । কিন্তু তার একটাই কথা, মা-মরা মেয়েটার কথা ভেবে আমার রান্না করা । তার মুখে দু-মুঠো খাবার তুলে দিতে পারছি, এটাই আমার শান্তি ! আমাকে খেতে বলবেন না প্লীজ, আমি খেতে পারব না । দুপুরের রান্না শেষ করে পুনরায় ঝুড়ি মাথায় পান্তা মাসি সবজি বিক্রি করতে পাশের গ্রামে ছোটে ।
একদিন কৌতুহলবশত কুহেলি পান্তা মাসিকে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি আমাদের বাড়ি এত কাজ করো কেন ? এতে তোমার খাটুনি বাড়ে বই কমে না । আমাদের বাড়িতে পরিশ্রম করে তোমার কী লাভ ?”
ফ্যাকাশে মুখে পান্তা মাসি কিছুক্ষণ কুহেলির দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি দিয়ে কান্তা মাসি বলল, “তুই এই খাটুনির মর্ম বুঝবি না । বড় হলে বুঝতে পারবি ।“
ভরা বৈশাখ মাসে প্রখর তাপের মধ্যে গাঁয়ে ঘুরেঘুরে কাজ করার জন্য পান্তা মাসি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো । সেই সময় কুহেলি লক্ষ্য করলো, “তার বাবা খুব মনমরা । সকালে ওঠে আগের মতো প্রাণচঞ্চল নয় ! সকালে হাঁটতে বের হয় না । বাড়িতে মনমরা হয়ে বসে থাকে ।“ কুহেলি কাকীমার কাছে জানতে পারলো, সে স্কুলে বেরিয়ে গেলে তার বাবা পান্তা মাসির বাড়ি যায় । তাকে ডাক্তার দেখানো, ঔষধ কেনা, রান্না করা, সবকিছু করে দিয়ে বাড়ি ফেরে । ফলে তার বাবার দুপুরের খাবার খেতে নাকি বেলা তিনটে গড়িয়ে যায় । কাকীমার কাছে এতকথা শুনলেও কুহেলি বাবাকে কিচ্ছুটি জিজ্ঞাসা করে না । তবে কয়েকদিন যাওয়ার পর কুহেলি তার কৌতুহল চেপে রাখতে পারলো না । তাই বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা ! পান্তা মাসির কী হয়েছে ?” উত্তরে মনমরা সুরে সানাই বলল, “তোর পান্তা মাসির টাইফয়েড জ্বর হয়েছে ।“
ডাক্তার কী বলল ?
“জ্বর এখন নিয়ন্ত্রণে ।“ ডাক্তারবাবু বললেন । তবে তোর পান্তা মাসিকে দেখভালের জন্য একটা লোক দরকার । আর তা ছাড়া তাকে নিয়মিত দামী দামী ফল খাওয়ানো খুব প্রয়োজন !
“তুমি চিন্তা করো না বাবা । পান্তা মাসি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে ।“ বাবাকে সান্ত্বনা দিলো কুহেলি ।
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে এ-ঘর ও-ঘর খুঁজেও বাবাকে পাচ্ছে না কুহেলি । বাবা কোথায় গেলো ? ভয় পেয়ে গেলো কুহেলি । বাবা তাকে না জানিয়ে কোথাও যায় না । কাঞ্চন নগরের শেষ মাথা দিয়ে একে-বেঁকে গেছে নোনাই নদী । দীর্ঘদিনের নোনাই নদী । এই নদীতে গ্রীষ্মকালে ভাল মাছ পাওয়া যায় । কুহেলি জানে, কারণে-অকারণে বাবা মাঝে মাঝে নোনাই নদীর পারে গিয়ে বসে থাকে । তাই কুহেলি ভাবলো, বাবা সম্ভবত নোনাই নদীর পারে গিয়ে বসে থাকতে পারে । তাই কুহেলি হাঁটতে হাঁটতে নোনাই নদীর পারে গিয়ে উপস্থিত । নোনাই নদীর পারে গিয়ে কুহেলি দেখলো, গাঁয়ের অনেক মানুষ সেখানে রয়েছেন । অনেকে খেপলা জালে নদীতে মাছ ধরছে । অত লোকের মাঝে কোথাও তার বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না । হতাশ হয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো কুহেলি ।
রাস্তায় শীতলের সঙ্গে দেখা ।
“এত সকালে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় চললি ?” জিজ্ঞাসা করলো শীতল ।
নোনাই নদীর পারে গিয়েছিলাম, এখন বাড়ি ফিরছি ।
হঠাৎ নোনাই নদীর পারে কেন ?
ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা বাড়িতে নেই । তাই ভাবলাম, বাবাকে নদীর পারে পাওয়া যাবে !
তোর বাবাকে সুরেশপুরে দেখলাম । বলেই শীতল পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, “তোর বাবা এত সকালে ঐ গ্রামে কেন ?”
কাজ আছে নিশ্চয় ! কিন্তু তুই সেখানে কী করছিলি ? পাল্টা প্রশ্ন করলো কুহেলি ।
আমি পড়তে গিয়েছিলাম । তুই তো জানিস, আমাদের অঙ্কের স্যার সুরেশপুরে থাকেন । তাঁর কাছে অঙ্ক শিখতে গিয়েছিলাম ।
সাইকেল থেকে নেমে শীতল হাঁটা শুরু করলো ।
মাঝখানে তিন-চারদিন কুহেলির সাথে শীতলের দেখা হয়নি । গাঁয়ে খেলার মাঠে কুহেলি কয়েকদিন যায়নি । অথচ কুহেলির অন্যান্য বন্ধুরা মাঠে প্রতিদিন যাচ্ছে এবং তারা কিৎ কিৎ, দৌড়, ইত্যাদি খেলায় মত্ত । স্কুল থেকে ফেরার সময়ও কুহেলির সাথে শীতলের দেখা হয়নি । শীতল ক্লাস সেভেনে পড়ে । কিন্তু কুহেলির সাথে শীতলের খুব ভাব । দু-ক্লাস উপরে হলেও শীতল কুহেলিকে খুব পছন্দ করে । টিফিন ভাগ করে খায় । স্কুল থেকে ফেরার সময় একসঙ্গে বাড়ি ফেরে । দুজনের মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক ।
“দুদিন খেলার মাঠে আসলি না কেন ?” শীতল কুহেলিকে প্রশ্ন করলো ।
স্কুল থেকে ফিরে বাবার সঙ্গে কাজ করছিলাম ।
“বাবার সঙ্গে কাজ করছিলি !” কথাটা পুনরুক্তি করেই শীতলের কী হাসি !
হাসছিস কেন ?
বাবার সঙ্গে তুই কী কাজ করছিলি ? তুই কী বাবার মতো কাজ করতে পারিস ?
বড্ড হাসবি না । আমি বাবাকে রাতের রান্নার সবজি কেটে দিচ্ছিলাম ।
তুই কী রান্না জানিস ?
জানি তো ! জানিস শীতল, আমি ভাত ও ডাল রান্না করতে পারি ।
কোনোদিন রান্না করেছিস ?
হ্যাঁ করেছি । গত রবিবারদিন বাবা জরুরি একটা কাজে ভরতপুর গিয়েছিল । যদিও বলে গিয়েছিল বাড়ি ফিরে রান্না করবে । কিন্তু আমি বাবার জন্য অপেক্ষা করিনি । বাবা ফেরার আগেই ভাত ও ডাল বানিয়েছিলাম । ভাতের মধ্যে আলু সেদ্ধ দিয়েছিলাম । বাবা খাবার খেয়ে খুব খুশী !
ডালে ঠিকমতো নুন দিয়েছিলি ?
বোকার মতো প্রশ্ন করিস না । তুই একটা হাঁদারাম !
হাঁদারাম বললি কেন ?
কেন হাঁদারাম বলবো না ! আমি ডাল রান্না করে বাবাকে খাওয়ালাম, অথচ প্রশংসা দূরে থাক একটা ধন্যবাদ দিলি না !
এবার বুঝেছি !
কী বুঝেছিস ?
তোর অভিমান হয়েছে !
আমি অভিমান শব্দের অর্থ বুঝি না । কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে কথা বলবি না । আমি গরীব মানুষ । বাবা স্কুলে পড়াচ্ছে, কিন্তু বাড়িতে মাস্টার রেখে পড়াতে পারছে না । শুধুমাত্র ক্লাসের মাস্টার মশাইদের পড়াগুলি ঠিকমতো করি । সুতরাং অতো কঠিন শব্দ এখনও শিখিনি, বুঝলি !
তারপর বাড়ির দোরগড়ায় পৌঁছে কুহেলি শীতলকে বলল, “আমি এসে গেছি । সুতরাং তুই এখন বাড়িতে ফিরে যা ।“
আজ স্কুল যাবি তো ?
এখনও বুঝতে পারছি না । বাবা এখনও বাড়ি ফেরেনি । সুতরাং বাবা বাড়িতে না ফিরলে স্কুলে যাওয়া হবে কিনা সন্দেহ !
হঠাৎ শীতল পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে কুহেলির বাবা বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছেন । তখন কুহেলিকে শীতল বলল, তোর বাবা বাড়ির দিকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরছেন । এবার নিশ্চয় তোর স্কুলে যাওয়ার সমস্যা নেই ।
এক গাল হাসি দিয়ে কুহেলি বলল, “অবশ্যই স্কুলে যাচ্ছি । তখন দেখা হবে ।“
তারপর শীতলের দিকে তাকিয়ে ‘টা টা’ দিয়ে বাবার দিকে ছুটলো কুহেলি । বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি যাওয়ার সময় বলে যাওনি ? তাই আমি তোমাকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছি ।“
আমার অন্যায় হয়ে গেছে মা । আর আমার ভুল হবে না । এরপর যেখানেই যাই না কেন, তোমাকে অবশ্যই বলে যাবো ।“
কথা দিচ্ছ !
“হ্যাঁ দিচ্ছি ।“ তারপর বাপ-বেটির কী হাসি ।
(চলবে)

Share This
Categories
উপন্যাস গল্প

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, অষ্টাদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

সেই আলাপ ঘনীভূত হলো । সম্পর্কের স্থায়ীকরণে বাদ সাধলো প্রদীপ্তের পরিবার । প্রদীপ্তের বাবার একটাই কথা, “তিনি কোনো অ-ব্রাহ্মণ মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবেন না ।“ পুবালী পড়ে গেলো মহা ফাঁপড়ে । বিয়ের ব্যাপারে প্রদীপ্তের বাড়ির গড়িমসি অবলোকন করে, পুবালীর বাবা তাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগলেন । পুবালীও নাছোড়বান্দা, “নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না ।“ মন ভেঙ্গে গেলো পুবালীর । কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় দিশাহারা । পুবালী বাড়িতে অথচ সব সময় দুশ্চিন্তায় মনমরা । পুবালীর দিনগুলি খুব হতাশায় কাটছিল । পারিবারিক মতবিরোধের কারণে তাদের পবিত্র দুটি জীবন ছন্নছাড়া ! দুজন একে অপরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলো ।
অন্যদিকে প্রদীপ্তের মানসিক স্থিতি তথৈবচ ! পুবালীকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণায় পুবালীর মতো সেও দিশেহারা । অমানসিক বিড়ম্বনায় মুষড়ে পড়লো প্রদীপ্ত । পুলিশের চাকরির আবেদন করলো না । বাড়িতে থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের কথা বেমালিম ভুলে গেলো । বাবার পরিষ্কার নির্দেশ, “পুবালীকে বিয়ে করলে বাড়ির মায়া তাকে ত্যাগ করতে হবে ।“ কয়েকদিন ভাত জল খাওয়া বন্ধ । মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লো । বেশ কিছুদিন পর ফন্দি আঁটতে লাগল, “অতঃপর কী করা যায় ?” তারপর গোপন সূত্রে খবর পায়, কোচবিহারের এই আশ্রমে সব সময়ের জন্য শিক্ষিত লোক দরকার । খবর পেয়ে মনে মনে প্রদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিলো, বাকী জীবন সে আশ্রমেই কাটিয়ে দেবে । আর তা ছাড়া তাকে বিরক্ত করতে কেউ খুঁজে পাবে না । খবরটি জানার পর কাউকে খবরটি শেয়ার করেনি । এমনকি পুবালীকেও জানায়নি । প্রদীপ্তের ধারণা, খবরটি পাঁচ-কান হলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেতে পারে ! তাই ইচ্ছাকৃত কাউকে জানায়নি ।
একদিন খুব ভোরে সকলের অগোচরে প্রদীপ্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা কোচবিহার ।
************************************************
তারপর কোচবিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এই আশ্রমের মহারাজ । আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী, প্রদীপ্ত জীবনে কোনোদিন স্থায়ীভাবে জীবন সঙ্গিনী নিয়ে ঘর সংসার বাঁধতে পারবে না বা আশ্রমে জীবন সঙ্গিনী নিয়ে বাকী জীবন কাটাতে পারবে না । তাঁকে ঘর সংসারের চৌকাঠ মাড়ানো যাবে না । সাংসারিক জীবনের চৌহদ্দির অনেক দূরে থাকতে হবে । আশ্রমে এই রকম একটি ধরাবাঁধা জীবনের মধ্যে দিব্যি ছিল প্রদীপ্ত ! দিনগুলি ভালই কাটছিল । কিন্তু হঠাৎ পুবালীকে দেখে প্রদীপ্ত রীতিমতো অবাক ! অবাক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ পুবালীর দিকে তাকিয়ে রইলো । মুখের ভাষা বন্ধ । কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না ! মনের ভিতর তোলপাড় ! পুবালীকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন প্রদীপ্তের মনে আবার চাগাড় দিলো । এখন কী করবে ? পুবালীকে নিয়ে ঘরবাঁধার স্বপ্ন মন থেকে একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারছে না । অথচ পুবালীকে আপন মানুষের মতো কাছে টেনে নিতেও দ্বিধা-দ্বন্দ ! খুব অসহায়ের মধ্যে প্রদীপ্তের মানসিক অবস্থা !
কুহেলি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে দুজনের মাঝখানে ঢুকে পুবালীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি টিফিন খেয়ে নে । আবার বেরোতে হবে ।“
“এবার কোথায় যেতে হবে ?” জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলো পুবালী ।
“দেখা যাক । তুই তাড়াতাড়ি টিফিন খেয়ে বাইরে বেরিয়ে আয় ।“ পুবালীকে কথাটা বলে কুহেলি বাইরে বেরিয়ে যাবে এমন সময় প্রদীপ্ত বলল, “আজ আপনাদের অন্য কোথাও না গেলে বরং ভাল হয় ।“
কেন ? আশ্রমে আমাদের কোনো কাজ আছে কী ? কাজ থাকলে জানাবেন । সেই ক্ষেত্রে আমরা আর বাইরে বের হবো না ।
দরকার নেই । তবে অনেকদিন পর পুবালীর সঙ্গে দেখা হলো, তাই তার সাথে দুদণ্ড বসে কথা বলতে চাই ।
বেশ তো ! সেক্ষেত্রে পুবালী আশ্রমে থাক । আমরা বরং অন্য কাজ সেরে আসি । এখন বের না হলে খাওয়ার আগে ফিরতে পারব না ।
এই কথা শুনে পুবালী একবার প্রদীপ্তের দিকে আর একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “না, তা হয় না । আমিও তোমাদের সাথে যাবো ।“
পুবালীর কথা না শোনার ভান করে কুহেলি ঘর থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় । তারপর ভাবছে অতঃপর তার কী করণীয় ! ভেবেছিল বাজারের দিকে গিয়ে এলাকা সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেবে । কুহেলির পক্ষে একা একা সেটা আর হবে না । তাই নিছক পায়ে হেঁটে আশেপাশের মানুষজনের খোঁজ খবর নিতে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো । কিছুটা হাঁটার পর কুহেলির চোখে পড়লো রাস্তার পাশে একটা প্রকাণ্ড বট গাছ ! তার মনে হচ্ছে গাছটির বয়স দুই শতাধিক হবে ! বট গাছের ডাল থেকে শিকড় মাটিতে ঝুলে পড়েছে । গ্রামের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সেই শিকড় ধরে ঝুলছে । বট গাছটার নীচে অনেক ছেলেমেয়ের আনাগোনা । বট গাছটার গোড়ায় বাঁশ দিয়ে বসার জায়গা । সেখানে গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বসে রয়েছেন । তাঁরা একে অপরের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত । জায়গাটার পরিবেশ দেখে কুহেলির খুব ভাল লাগলো । বট গাছ ঘিরে গ্রামের মানুষের অবসর বিনোদনের সুন্দর একটি পরিবেশ । দূরে বিশাল জলাশয় । আশপাশে চাষের জমি । বটগাছের উল্টোদিকে একটা টিউবওয়েল । সেখানে জল নিতে গ্রামের বধূদের ভিড় । কল পাড়ে দাঁড়িয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যে গোপন কথার আদান প্রদান । সংসারের কিছু কথা ব্যক্ত করার জন্য বধূরা মুখিয়ে রয়েছেন । কতক্ষণে তাঁদের কথা ব্যক্ত করবেন, তার একটা টানাপোড়েন নিজেদের মধ্যে চলে । কাখের কলসীতে জল ভড়ে গেলে নিজ নিজ গন্তব্যে তাঁরা আবার ফিরে যাচ্ছেন । দৃশ্য দেখে কুহেলির খুব ভাল লাগল । মনটায় একটা অভূতপূর্ব আনন্দ !
হঠাৎ ! হঠাৎ পেছন থেকে উস্কোখুস্কো চুল ও নোংরা ড্রেসের বয়স্ক একজন মানুষ এসে কুহেলিকে বললেন, “আপনি কী এখানে নতুন ?”
ঐরকম অদ্ভূত ধরনের মানুষ দেখে কুহেলি প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো । তাই কালবিলম্ব না করে হনহন করে হেঁটে সোজা আশ্রমের দিকে । দ্রুত পায়ে হাঁটার সময় বারংবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখছে, পাগল মানুষটা তাকে অনুসরণ করছে কিনা ? একরকম হাঁপাতে হাঁপাতে গেট দিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করলো ।
কুহেলিকে হাঁপাতে দেখে মাসি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি এ্যাতো হাঁপাচ্ছো কেন বাছা ?”
“গাঁয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলাম । বটগাছ তলা যেতেই একটি পাগল মানুষ আমার দিকে বিশ্রিভাবে তাকাচ্ছিল । পাগল মানুষটাকে দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে আমি সোজা আশ্রমে ফেরার রাস্তায় এসে উঠলাম । তারপর একরকম ছুটতে ছুটতে আশ্রমে ফিরে এলাম ।“ কথাগুলি বলে কুহেলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ।
মাসি কুহেলিকে ঘরে নিয়ে বসালো । চা বানিয়ে কুহেলির দিকে ধরে বললেন, “চা খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো । আমি পাগল সম্বন্ধে তোমাকে সব জানাচ্ছি । পাগলের জীবনের মর্মান্তিক কথাগুলি শুনলে তাঁর উপর তোমার হৃদয়ের মমতা জাগ্রত হতে বাধ্য ।“
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে নড়েচড়ে বসলো কুহেলি ।
মাসি জানালেন, “পাগল মানুষটি আসলে পাগল নয় । দীর্ঘদিন নাওয়া-খাওয়া না হওয়ার দরুন চেহারায় তার প্রভাব পড়েছে । কিন্তু তিনি একজন সজ্জন মানুষ । শোনা যায়, বাড়িতে নিজের স্ত্রী তাঁকে ঠকিয়ে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে লোক দিয়ে তাড়িয়ে দেয় । এই মহিলার প্রেমে পাগল হয়ে নাকি ভদ্রলোক আগের স্ত্রী-সন্তানদের ত্যাগ করে কোচবিহারে পালিয়ে আসেন এবং এই মহিলার সাথে ঘর বাঁধেন । এই স্ত্রীর বোন কোচবিহার
এলাকার ডানপিটে মহিলা । তার প্ররোচনায় ভদ্রলোকের বর্তমান বৌ দিনরাত তাঁকে জ্বালাতন করতো । মানসিক যন্ত্রণা দিতো । বৌয়ের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে একসঙ্গে বাঁচার আশা নিরাশায় পরিণত হয় । তাই লজ্জায় বাড়ি ফিরে না গিয়ে, এই গাঁয়ের বটগাছ তলায় আশ্রয় নেয় । গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে কাজকর্ম করে । খড়ের ঘরের ছাউনী বাঁধে । কারও জমিতে কাজ করে । তবে তাঁর সততা দেখে গ্রামের মানুষেরা ভদ্রলোককে গ্রামের শেষ মাথায় এক ফালি বসত বাড়ির জমি ঠিক করে দিয়েছে । ঘর বানিয়ে তিনি এই গ্রামে পাকাপাকিভাবে বাস করতে চান । যতদিন ঘর বানানো সম্ভব হচ্ছে, ততদিন এই বটগাছ তলায় কাটিয়ে দিতে চান ।
ভদ্রলোকের বর্তমান স্থিতির কথা শুনে কুহেলির চোখে জল । ঠিক সেই মুহূর্তে পুবালী এসে বলল, “তুমি কোথায় বের হবে, বলছিলে ?”
এইমাত্র গ্রাম থেকে ঘুরে এলাম । একটু পরে আবার বের হওয়া যাবে । আশ্রমের আশেপাশের লোকজনদের দেখা এবং এলাকা সম্বন্ধে অবগত হওয়া !
ঠিক আছে । তবে পরেই বের হওয়া যাবে ।
তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে কুহেলি ভাবলো, পাগল লোকটাকে একবার দেখে আসা যাক । যেই ভাবনা, সেই আশ্রম থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় । আশ্রমের মহারাজ কুহেলিকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে তার কাছে এলো এবং বলল, “এভাবে যখন খুশি আশ্রম থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না । আপনাদের পেছনে কিন্তু অজানা আগন্তুকেরা ঘোরাফেরা করতে পারে । সেক্ষেত্রে বিপদের আশঙ্কা ! সুতরাং যখন কোথাও বের হবেন, একা একা যাবেন না প্লিজ । সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাবেন । কাউকে না পেলে, আপনার বান্ধবীকে অন্তত সঙ্গে রাখবেন । তাহলেও অনেকটা নিরাপদ অনুভব করতে পারবেন ।“ বলেই মহারাজ আশ্রমে ঢুকে গেলেন ।
তবুও পাগল মানুষটাকে নিয়ে কুহেলির অহেতুক কৌতুহল থামছে না । অথচ মহারাজের কথাটা ভাববার বিষয় !
( ক্রমশ )

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস : সপ্তদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

আশ্রমের মহারাজকে দেখে পুবালী রীতিমতো চমকে উঠলো ! এটা কী করে সম্ভব ! পুবালীর মনে একটাই প্রশ্ন, তার অন্তরের মানুষ এখানে কেন ?
সকালের টিফিন খাওয়া মাথায় উঠলো পুবালীর । সে পুরানো দিনের স্মৃতিতে ফিরে গেলোঃ প্রদীপ্ত সবে পোস্ট গ্রাজুয়েট । বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ. । বাড়িতে বসে চাকরির চেষ্টা । যদিও চাকরির বাজার মন্দা ! তাই নিজের এলাকার আনাচে-কানাচে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা । পুবালীর বাবা স্বয়ং একদিন প্রদীপ্তের কাছে হাজির । কী ব্যাপার ? ব্যাপার হচ্ছে, পুবালীর ছোট ভাই নকড়িকে টিউশন পড়াতে হবে । বাড়িতে বসে, তাই প্রদীপ্ত আপত্তি করেনি । নকড়িকে পড়ানো শুরু করলো । সন্ধেবেলায় পড়ানো । পরের বছর নকড়ির উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা । তাই পড়ানোর চাপ বেশী । নকড়িকে পড়ানোর জন্য প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময় ছাড়াও বেশী সময় থাকে । একটাই উদ্দেশ্য, নকড়ি যাতে ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করতে পারে । নতুবা টিউশনির মাস্টার হিসাবে তার বদনাম ।
নকড়ির দিদি পুবালী । পুবালী তখন সালার কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী । ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা সামনে । তাই কলেজে ক্লাস শেষ । বাড়িতে বসে তার পড়াশুনা । এদিকে প্রদীপ্ত প্রায় প্রতিদিন নকড়িকে টিউশনি পড়াতে যায় । নকড়িকে পড়ানোর জন্য মাঝে মধ্যেই তাকে অতিরিক্ত সময় দিতে হয় । যেদিন অতিরিক্ত সময় প্রদীপ্তকে দিতে হয়, সেদিন চা-জল খাবার দেওয়ার দায়িত্ব পুবালীর । পুবালীর সাথে প্রদীপ্তের আগে আলাপ ছিল না । বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে থেকে প্রদীপ্তের পড়াশুনা । পাশের গ্রামের ছেলে হওয়ার সুবাদে পুবালীর সাথে সেভাবে ঘনিষ্টতা জন্মায়নি । পাড়ার বান্ধবীর মুখে প্রদীপ্তের নাম শুনেছিল, কিন্তু কোনোদিন সাক্ষাৎ হওয়ার সৌভাগ্যে ঘটেনি । তাই কৌতুহলবশত মাঝে মাঝেই ভাইয়ের পড়ার ঘরে উঁকি দিয়ে মাস্টারকে দেখে নিতো । লম্বা চওড়া সুপুরুষ । মুখটা খুব মিষ্টি । হাসিখুশী । অমায়িক ব্যবহার । চেহারায় একটা অদ্ভূত মিষ্টতা, যেটা পুবালীকে প্রদীপ্তের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল । যাই হোক প্রথমদিন জলখাবার দেওয়ার সময় কোনো কথা হলো না । পরেরদিন পুনরায় পড়াতে এলে সেদিনও প্রদীপ্ত অতিরিক্ত সময় থাকলো । সেদিন চা-জলখাবার দিতে গেলে নকড়ি মাস্টারের দিকে তাকিয়ে পুবালীকে দেখিয়ে বলল, “স্যার, আমার দিদি ।“
“নমস্কার ।“ প্রদীপ্ত জোড় হাতে পুবালীর দিকে তাকিয়ে নমস্কার জানালো ।
প্রতি-নমস্কার জানিয়ে পুবালী এক গাল হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কোথায় চাকরি করেন ?”
“আমি চাকরি করি না । বাপের হোটেলে খাই-দাই, আর ঘুরে বেড়াই । আমি একজন বেকার মানুষ ।“ হেসে হেসে প্রদীপ্ত উত্তর দিলো ।
অন্যদিকে কৌতুহলবশত প্রদীপ্ত পুবালীকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কী চাকরি করেন ?”
সালার কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী । চাকুরিজীবি না ।
অর্থাৎ আপনি কী বি.এ. ফাইনাল দিচ্ছেন ?
“ঠিক তাই । সামনে ফাইনাল পরীক্ষা । কলেজের ক্লাস শেষ ! তাই বাড়িতে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি ।“ বলেই পুবালী পুনরায় প্রদীপ্তকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনার বাড়িটা কোথায় ?”
পাশের গ্রামে ।
বাবা কী করেন ? কৌতুহলবশত পুবালীর সরাসরি জিজ্ঞাসা ।
“বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক আর মা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা ।“ প্রদীপ্ত মুচকী হেসে পুবালীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আর কোনো প্রশ্ন ?”
প্রদীপ্তের মুচকী হাসি পুবালীকে বুঝিয়ে দিলো, পুবালীর ব্যবহারে প্রদীপ্ত বিরক্ত নয় । পুবালী নিজের পড়ার টেবিলে ফিরে গিয়ে অনেকক্ষণ প্রদীপ্তের কথা ভাবলো । ভাবনার মধ্যে বারংবার প্রদীপ্তের প্রাণখোলা হাসি পুবালীর বুকের মাঝে উঁকি দিচ্ছিলো । সেই রাত্রিতে পুবালীর পড়াশুনার প্রতি মন বসলো না । প্রায় সারা রাত্রি প্রদীপ্তকে নিয়ে পুবালীর উত্থাল-পাতাল হৃদয় !
শনিবার সন্ধ্যাবেলায় মা-বাবা গাঁয়ের সুজন কাকুদের বাড়ি কালী পুজোর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলেন । শনিবার রাত্রিতে নাকি মানসিক কালী পুজোর শুভক্ষণ । তাই তাঁদের বাড়িতে কালী পুজো । তবে এই পুজোর একটা বৈশিষ্ট্য, সূর্য ডোবার পর, মায়ের মূর্তি বাড়িতে ঢুকবে এবং পুজা শেষ হয়ে গেলে রাত্রিতেই অর্থাৎ সূর্য ওঠার আগেই বিসর্জন দিতে হবে । সেখানে পুবালীর মা-বাবা দুজনে গেলেন । যাওয়ার সময় বারকয়েকবার মা পুবালীকে বলে গেলেন, টিউশন মাস্টারকে ঠিকমতো চা-জলখাবার দিতে ।
এদিকে বাবা-মা ঘরে নেই । সেইজন্য নকড়িবাবুর পোয়াবারো । বকাঝকা করার কেউ নেই । দিদিকে সে পাত্তাই দেয় না, বরং দিদি তার বন্ধু । তাই প্রদীপ্ত পড়াতে আসার সাথে সাথে নকড়ি বলল, “মাস্টার মশাই, আজ বেশীক্ষণ পড়ানো চলবে না । জি-বাংলার নাচের অনুষ্ঠান দেখবো ।“
ঠিক একঘন্টার মধ্যেই নকড়ি পড়া থেকে উঠে সোজা দিদিকে বলল, “স্যারকে আমি তোর হাতে হ্যান্ডোভার করে দিলাম ।“
পুবালী ভাইয়ের গালে আদর করে বলল, “তুই দিন দিন বড্ড পাকা হচ্ছিস ।“
প্রদীপ্ত বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো ঠিক সেই সময় নকড়ি ছুটে এসে বলল, “উঁহু ! আপনি উঠবেন না । দিদি আসছে । দিদি আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী !” বলেই নকড়ি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ।
পরক্ষণেই পড়ার ঘরে পুবালীর আগমন । তখন প্রদীপ্ত মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কীযেনো ভাবছে !
মাস্টার মশাই, আপনার চা ।
আমাকে মাস্টার মশাই বলবেন না প্লীজ । “মাস্টার মশাই” শুনলে নিজেকে মনে হয় হাই স্কুলের বয়স্ক একজন শিক্ষক ।
তাহলে মাস্টার মশাই, আপনি বলে দিন, কীভাবে আপনাকে ডাকবো ?
আপনার যেটা ভাল মনে হবে, সেটা বলেই ডাকবেন ।
উঁহু মাস্টার মশাই ! তা হবে না, আপনাকে স্বয়ং বলে দিতে হবে কীনামে আপনাকে ডাকবো ?
আচ্ছা জ্বালায় পড়া গেলো । তখন থেকে মাস্টার মশাই বলেই যাচ্ছেন । এবার একটু বিরতি নিন । আমাকে ভুল-ঠিক একটা কিছু বলে ডাকবেন । তাতেই আমি সন্তুষ্ট । এতবার আমাকে ‘মাস্টার মশাই’ ডাকবেন না ।
তাহলে আপনাকে আমি মশাই নামে ডাকবো ।
এটা কী ধরনের নাম ? আমার মাথায় ঢুকছে না ! অন্য নাম ভাবুন ।
আজগুবি কথাবার্তা বলে পুবালী খুব মজা পাচ্ছিলো । এতকিছুর পরেও প্রদীপ্ত রাগছে না বা পুবালীকেও বকাঝকা করছে না ।
এদিকে পুবালীকে চুপচাপ থাকতে দেখে প্রদীপ্ত চেয়ার ছেড়ে উঠলো । পুবালীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার চলি ।“
মাস্টার মশাই, এটা কী বলছেন ? আপনাকে চা না খাওয়ালে আমার চাকরি থাকবে না, সেটা আপনি কী জানেন ?
এটা আমার জানা ছিল না । কিন্তু এবার বলুন, আপনাকে আপনার চাকরি থেকে কে বরখাস্ত করবেন ?
কেন, স্বয়ং পিতৃদেব । মাতৃদেবের সুপারিশে পিতৃদেব আমাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেবেন । সুতরাং আপনি চুপচাপ বসুন ।
পুবালীর কথা শুনে প্রদীপ্ত চুপচাপ বসে পড়লো । পুবালী ভাবছে, বেচারা এখন তার কব্জায় । ভাবছে আর মুচকী মুচকী হাসছে ! প্রদীপ্তের গোবেচারা দৃশ্য দেখে পুবালী আর হেসে চেপে রাখতে পারলো না ।
“কী ব্যাপার ? এত হাসছেন কেন ?” পুবালীর হাসি দেখে প্রদীপ্তের প্রশ্ন ।
“হাসির মর্ম আপনি বুঝবেন না । আমি চা বানিয়ে আসছি ।“ পুবালী ভিতরে ঢুকে গেলো । সম্ভবত চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলো ।
কিছুক্ষণ পরে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকলো পুবালী । মুখে সেই মন ভোলানো হাসি । হেসে হেসে স্বাভাবিক ছন্দে বলল, “এবার চা ও স্নাক্স খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন ।“
উদ্ধারের কথা কেন বলছেন ?
ওরে বাবা ! মা যদি জানেন আমি আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াইনি । তবে আমাকে আস্ত রাখবেন কিনা সন্দেহ !
আপনি মাকে ভীষণ ভয় করেন বুঝি ?
তা একটু করি । প্রয়োজনে বাবাকে ম্যানেজ করা যায়, কিন্তু মাকে ম্যানেজ করা আমার সাধ্যের অতীত !
চায়ে চুমুক দিয়ে পুবালীর দিকে তাকালো প্রদীপ্ত । তারপর জিজ্ঞাসা করলো, “আপনার নিজের জন্য চা কোথায় ?”
আপনি তো আচ্ছা মাস্টার মশাই ! দিব্যি নিজের চা খেয়ে এবার খোঁজ নিচ্ছেন, আমি চা খাবো কিনা ? এটা ঠিক নয় । চা খাওয়ার আগে খোঁজ নিয়ে জানতে হতো আমি চা খাবো কিনা ?
ভুল হয়ে গেছে । তার জন্য মাফ চাইছি !
মুচকী হেসে পুবালী বলল, “ঠিক আছে মশাই । ধীরে খান । আমার চায়ের কাপ নিয়ে আসছি ।“
চা নিয়ে পুবালী প্রদীপ্তের পাশে বসতে যাবে এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ ! মনে মনে পুবালী ভাবলো, এই সুন্দর মুহূর্তের সময়ে কাদের আসার সময় হলো ? কিছুটা নিমরাজি হয়ে দরজা খুলে দেখে স্বয়ং ‘মা-বাবা’ এসে হাজির । মা ঘরে ঢুকেই প্রথমে প্রশ্ন, “মাস্টার মশাইকে কী চা বানিয়ে দিয়েছিস ? ”
তুমি পড়ার ঘরে ঢুকে দেখো, মাস্টার মশাই এখনও চা খাচ্ছেন !
ঠিক আছে । চা বানিয়ে দিয়ে ভাল করেছিস । তারপর বাবা-মা দুজনেই ঘরে ঢুকে গেলেন । সেই ফাঁকে ছুটে গিয়ে মাস্টার মশাইয়ের পাশ থেকে নিজের চায়ের কাপ সরিয়ে নিলো পুবালী । মা দেখতে পেলে অহেতুক নানান প্রশ্নে নাজেহাল করে দিতো । অন্যদিকে পুবালীকে দেখতে পেয়ে প্রদীপ্ত বলল, “এবার আমি আসছি । তবে একটা কথা ?”
ঘুরে দাঁড়িয়ে ঔৎসুক্য চিত্তে প্রদীপ্তের দিকে তাকিয়ে রইলো, গোবেচারা মাস্টার মশাই আবার কী বলতে চায় ?
একগাল হাসি দিয়ে প্রদীপ্ত বলল, “আপনার বানানো চা খেয়ে পরম তৃপ্তিতে খেলাম !”
মুখে শব্দ ছাড়া নিঃশব্দে বলল, “গোবেচারার মুখে বুলি ফুটেছে !” তারপর পুবালী মাস্টার মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে । এবার আসুন । আপনাকে দেরী করিয়ে দেওয়ার জন্য দুঃখিত ।“
আর একটা কথা ?
“আবার কী কথা ?” বিরক্ত মুখে পুবালী জিজ্ঞাসা করলো । এমনিতেই পুবালী ভয়ে ভয়ে রয়েছে, কোনো কারণে তাদের কথাবার্তার মাঝে মা এসে পড়লে বিপদের শেষ নেই । মা এসে পড়লে মায়ের কাছে অযথা বকুনি খাওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা ! তার উপর গোবেচারা কী বলতে চায় ?
পুবালীর ঠিক কানের কাছে গিয়ে বলল, “আগামীকাল থেকে শুধু প্রদীপ্তদা ।“
কথা শুনে প্রচণ্ড হাসি পেয়েছিল পুবালীর । কিন্তু হাসি চেপে রেখে শুধুমাত্র পুবালী বলল, “আগামীকালকেরটা আগামীকাল দেখা যাবে । ।“
প্রদীপ্ত ঘর থেকে বেরিয়ে সাইকেল নিয়ে সোজা রাস্তায় । সাইকেলেই ছাত্রের বাড়িতে প্রদীপ্তের যাতায়াত । তারপর রাস্তায় এসে এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়ালো । রাত্রির ঘনকালো অন্ধকার । হঠাৎ সাইকেলের সামনে পুবালী । পুবালীকে দেখে প্রদীপ্ত চমকে উঠলো ! আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি এখানে ?”
আমি এখানে তাতে কী ? বাড়ির সামনের রাস্তায় কী আমাকে আসতে নেই ? আপনি একটা আস্ত হাঁদারাম !
মাস্টার মশাই ছেড়ে আবার হাঁদারাম ! হচ্ছেটা কী ?
মনে হচ্ছে আপনি সত্যিই হাঁদারাম ! কোথায় অন্ধকারে লুকিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এলাম । আমাকে তারিফ না করে এলোপাথারি জিজ্ঞাসা ? আমি কী চুরি বা ডাকাতি করেছি নাকি ? যার জন্য এত জেরা ?
জেরা করলাম কোথায় ? আপনি এত রাত্রিতে সোজা রাস্তায় উঠে আমার সাইকেলের সামনে ? তাই কৌতুহল ?
আপনি আপনার কৌতুহল নিয়ে থাকুন । আমি চললাম ।
পুবালীর ডান হাতটা টেনে ধরে প্রদীপ্ত বলল, “কোথায় চললেন ? কথা তো বলা হলো না ?”
মনে মনে পুবালী ভাবছে হাঁদারামের টনক নড়েছে । এবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে । তাড়াতাড়ি প্রদীপ্তকে বলল, “আপনি আমার হাত ধরলেন কেন ? আমাকে নিয়ে পালাতে চান নাকি ?”
পালাতে পারলে জীবনে বড় কিছু পেতাম ।
তারপর দুইজনে চুপচাপ ! প্রায় পনের মিনিট । তারপর পুবালীর মায়ের চিৎকার, পুবালী তুই কোথায় । শিগ্‌গির খাবার টেবিলে আয় । খাবার রেডি !
পুবালী ঘরে ঢুকে গেলো । প্রদীপ্ত সাইকেল ছুটিয়ে বাড়ির দিকে ।
****************************************************************
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো । ভাই কলেজে ভর্তি হলো । পুবালী বি.এ. পাশ করলো । কিন্তু শত চেষ্টা করেও প্রদীপ্তের চাকরি জুটলো না । অন্যদিকে প্রদীপ্ত ও পুবালীর প্রেম-ভালবাসার খবর নিজের গ্রাম ছাড়িয়ে ভিন গাঁয়ে পৌঁছে গেলো । পুবালী যেমন প্রদীপ্তকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না, তেমনি প্রদীপ্ত পুবালীকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না ।
প্রদীপ্তের চাকরি নেই । প্রদীপ্ত ঘুণাক্ষরেও বাড়িতে জানায়নি সে পুবালীকে ভালবাসে । প্রদীপ্তের বাবা গোঁড়া ব্রাহ্মণ ! তিনি নিজের জাতির মেয়ে ছাড়া অন্য জাতির মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবেন না । এই ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্তের নড়চড় হবে না । তাই প্রদীপ্ত তার ভালবাসার কথা বাবা-মাকে জানায়নি । জানালে হিতে বিপরীত হতে পারে । অন্যদিকে পুবালীর বাড়ি থেকে বিয়ের তদ্বির তদারকি শুরু হয়ে গেছে । তাঁরা অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করে থাকতে গররাজি । কিন্তু চাকরি না পেয়ে পুবালী বিয়েতে নারাজ । বাড়িতে তার সাফ কথা আগে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, তারপর বিয়ে !
তারপর দিন যায় রাত আসে । রাত যায় দিন আসে ।
একদিন হঠাৎ প্রদীপ্তদের বাড়িতে পুবালী হাজির । হাজির হওয়ার একটাই কারণ, কলকাতা পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টর পদে লোক নিচ্ছে সেকথা জানাতে । সেদিন প্রদীপ্তদের বাড়িতে অনেক লোকজন । বাবা-মা ছাড়াও তার দিদি-জামাইবাবু ও তাদের ছেলে মেয়ে । তার মধ্যে পুবালী গিয়ে সরাসরি প্রদীপ্তদের বাড়ি হাজির । তখন সন্ধ্যা । সেই মুহুর্তে প্রদীপ্ত চপ-সিঙ্গারা আনতে বাইরে বেরিয়েছে । পুবালী প্রদীপ্তের বাবাকে চিনতে পারেনি । তাই সোজা প্রদীপ্তের বাবার কাছে জিজ্ঞাসা, “প্রদীপ্ত কী বাড়ি আছে ?”
“কেন, প্রদীপ্তকে কী দরকার ?” প্রদীপ্তের বাবার গাম্ভীর্য্যপূর্ণ উত্তর ।
তাকে ডেকে দিন । জরুরি কথা আছে । আমি সেটা তাকেই বলবো ।
“আমাকে বললে কী অপরাধ হয়ে যাবে ।“ গলার স্বর চড়িয়ে প্রদীপ্তের বাবা উত্তর দিলেন । প্রদীপ্তের বাবার উঁচু গলার স্বর শুনতে পেয়ে ভিতর থেকে প্রদীপ্তের দিদি বেরিয়ে এলেন । প্রদীপ্তের দিদি পুবালীকে চেনে না । তবে বুঝতে পারলো, মেয়েটা নিশ্চয় প্রদীপ্তের কাছের কেউ হবে । তার দিদি পুনরায় পুবালীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার ভাইকে কেন দরকার ? সে বাজারে গেছে, এক্ষুণি ফিরবে । খুব দরকার থাকলে ঘরে এসে বসুন । ভাই কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরবে ।”
পুবালী দিদির পেছন পেছন ঘরে ঢুকলো । দিদিও তেমনি, খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে পুবালীর ঠিকুজি কুষ্ঠি জেনে নিলো ।“
ঘরের ভিতর পুবালীকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো প্রদীপ্ত !

(চলবে)

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস ,ষোড়শ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)

কোচবিহার মদনমোহন মন্দিরের অন্যতম কর্মকর্তা সুরেশবাবুর কাছে পুলিশি অভিযান ও শহরের যত্রতত্র পাচারকারীদের ঘোরাঘুরির খবর পেয়ে কুহেলি যারপরনাই চিন্তিত হয়ে উঠলো । মন্দিরে থাকাটা তাদের কাছে আর নিরাপদ হবে না ভেবে কুহেলি প্রমাদ গুণতে লাগলো, অতঃপর কী করা যায় ? আর এখানে থাকা খুব ঝুঁকিবহুল । সুতরাং অন্যত্র চলে যাওয়াই শ্রেয় !
পুবালী এই ফাঁকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলো কুহেলিকে । কুহেলি বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিপক্ষে । কেননা তার মতে, নারী পাচার চক্র এখনও ধরা পড়েনি । তারা বহাল তবিয়তে উত্তরবঙ্গ সহ নানান জায়গায় অবাধে ঘোরাফেরা করছে । এখনও তাদের শকুনের দৃষ্টি । মেয়েদের ফুসলিয়ে বা যেভাবে হোক কব্জায় এনে ভিন্ন জায়গায় পাচার করা । পাচারের গ্যাং ধরা পড়লে তাদের বাড়ি ফেরাটা নিরাপদ হতো । যেহেতু তারা পাচার চক্রের হাত থেকে পালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেহেতু তারা এখন পাচার চক্রের চক্ষুশূল । যেকোনো মুহূর্তে তারা পাচারকারীদের হাতে ধরা পড়তে পারে । তাই কুহেলি ঠিক করলো, মন্দির থেকে পালাতে । কিন্তু বাড়িতে নয় ! কোথায় যাবে সেই চিন্তায় কুহেলি ও পুবালী অস্থির ?
ইতিমধ্যে কোচবিহার শহরে শুরু হয়েছে শক্তপোক্ত পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা । জোর কদমে চলছে পুলিশি টহল । তা ছাড়া থানা থেকে এলাকার বিশেষ বিশেষ মানুষকে ডেকে সাবধান করে দিয়েছে, শহরে নারী পাচাকারী চক্র ঘোরাফেরা করছে । যেকোনো মুহূর্তে তারা অঘটন ঘটাতে পারে । তাই নাগরিকদের সচেতনার নিরিখে থানার বড়বাবুর পরামর্শ, শহরে কোনো মেয়ে যেনো একা একা ঘোরাফেরা না করে বা অবাঞ্ছিত কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশকে সত্বর জানায় ।
কোচবিহার শহরে সন্ধ্যাবেলায় থমথমে পরিবেশ । কুহেলিরা খুব সাবধান মতো মন্দিরের ভিতরে কাজকর্ম সারছে । সুরেশবাবু পুনরায় কুহেলি ও পুবালীকে ডাকলেন এবং জানতে চাইলেন, তাদের পরবর্তী কী চিন্তাভাবনা ? কুহেলি আমতা আমতা করে সুরেশবাবুকে বোঝালো, “আমাদের কয়েকটা দিন সময় দিন । আমরা মন্দির ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবো । এই মুহূর্তে চারদিকে পাচারকারীদের আনাগোনা । সুতরাং এইরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে বের হলে আমরা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে যাবো । তাতে আখেরে আমাদের বিপদ !“
সুরেশবাবু তাদের অভয় দিয়ে বললেন, “এখানে থাকায় আমার আপত্তি নেই । মন্দিরে অনেক ভক্তের আগমন । বিভিন্ন জায়গার ভক্তদের আনাগোনা । সবাইকে আমরা চিনিও না বা জানিনা । কখন কে কী মতলব নিয়ে মন্দিরে আসে এবং বেরিয়ে যায় আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন ! মন্দিরে প্রবেশ অবাধ । সুতরাং মন্দিরের দরজা বন্ধ রাখতে পারবো না । মন্দির যতক্ষণ খোলা থাকবে মানুষের আনাগোনা থাকবেই । এর মধ্যে পাচারকারী-দুর্বৃত্তরা মন্দিরে ঢুকে তোমাদের উপর নজর রাখলে, সেই ক্ষেত্রে বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ! তাতে তোমাদের বিপদ বাড়বে বই কমবে না । তাই তোমাদের হিতার্থে আমি একটা পরামর্শ দিচ্ছি ।
পুবালী নড়েচড়ে বসে বেশ আগ্রহ দেখিয়ে সুরেশবাবুকে বলল, “আপনি বলুন । আপনার পরামর্শ কী ?”
“এই জেলার মাথাভাঙায় আমার পরিচিত খুব সুন্দর একটি আশ্রম আছে । তোমরা কিছুদিনের জন্য সেখানে গিয়ে গা-ঢাকা দিতে পারো । থাকার ব্যবস্থা খুব ভাল । আর তা ছাড়া তাদের আটোসাটো নিরাপত্তা ব্যবস্থা । তোমরা থাকতে চাইলে আমি সেই আশ্রমের মহারাজকে বলে দিচ্ছি । সুতরাং তোমাদের থাকার কোনো অসুবিধা হবে না । যে কদিন থাকতে চাও, থাকতে পারবে । সেখানে আশ্রমে প্রবেশ অবাধ নয়, অনুমতি সাপেক্ষে আশ্রমে ঢোকা যায় । অনেক টাইট নিরাপত্তা ব্যবস্থা । এইবার তোমরা ভেবে দ্যাখো, কী করবে । এখানে থাকাটা তোমাদের ক্ষেত্রে টেনশনের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ! সুতরাং আমার পরামর্শ ভেবে দেখতে পারো ।“ সুরেশবাবু সবিস্তারে জানালেন ।
কিন্তু মাথাভাঙা যাওয়ার সময় আমরা অতি সহজে দুর্বৃত্তদের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারি ।
সেই ব্যবস্থা আমি করছি । যাতে তোমারা নিরাপদে মাথাভাঙার আশ্রমে পৌঁছাতে পারো, সুরেশবাবু আশ্বস্ত করলেন ।
কুহেলি ভেবে দেখলো মাথাভাঙা যাওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনো উপায়ও নেই, যার উপর ভিত্তি করে কোচবিহার শহরে থেকে যাবে । তাই সুরেশবাবুর প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত ভেবে কুহেলি সুরেশবাবুকে বলল, “আপনি আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করুন । আমরা মাথাভাঙার আশ্রমে পরের কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে চাই ।“
পুবালীর মুখটা ব্যাজার ! তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছা । বাড়ির কারও সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই । বাবা-মা ছাড়া আত্মীয় স্বজন কারও সঙ্গে দেখা হচ্ছে না । বন্ধু-বান্ধবীরা নিশ্চয় খোঁজ খবর নিচ্ছে । পুবালীর বাড়ির কথা ভীষণ মনে পড়ছে । ছোট ভাইয়ের দুষ্টুমীর ভাগিদার হতে পারছে না । বাবার আহ্লাদ ও মায়ের বকুনি থেকে সে বঞ্চিত । এইসব ভেবে পুবালীর মনটা দুঃখে ভরপুর । কোনোকিছুতেই তার মন নেই । মাথাভাঙার আশ্রমে যেতে তার ভীষণ আপত্তি । কুহেলি তাকে বোঝাচ্ছে, এই মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেওয়া সেটা হবে বোকামী । তাদের কাছে ‘নদীর তীরে এসে নৌকা ডোবার’ ন্যায় । কেননা পাচারকারীদের শ্যেনদৃষ্টি চতুর্দিকে । পুনরায় তাদের গোচরে পড়লে বিপদের শেষ থাকবে না । নির্ঘাত ভিনদেশে চালান হতে হবে । ফলে বাকী জীবন অন্ধকার জগতে বেঁচে থাকা ছাড়া উপায় থাকবে না । সেই অন্ধকার জগতে ঢোকার চেয়ে আর কয়েকটা দিন মাথাভাঙার আশ্রমে কাটিয়ে দেওয়াটা তাদের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ । কুহেলি পুনরায় পুবালীর দিকে তাকিয়ে জোর দিয়ে বলল, এবার পুলিশের জালে পাচারকারীরা পড়তে বাধ্য । একবার এই দলটা ধরা পড়লে তাদের মুক্তির পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে । তখন লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফেরায় এতটুকু টেনশন থাকবে না । সুতরাং আর কটাদিন এদিক-ওদিক কাটিয়ে দিতে পারলে স্থায়ীভাবে এবং নির্ভয়ে এলাকায় বাস করতে কোনো বাধা থাকবে না ।
এক চিলতে হাসি দিয়ে পুবালী বলল, “ঠিক আছে ।“
পরেরদিন খুব ভোরে কাঁচ লাগানো এসি গাড়িতে পুবালী ও কুহেলি গিয়ে উঠলো মাথাভাঙার আশ্রমে । সেখানে পৌঁছে দেখে আশ্রমবাসীর তখনও ঘুম ভাঙ্গেনি । তখনও আশ্রমের সকলে ঘুমাচ্ছে । সূর্য পূর্ব আকাশে উদয়ের পথে । চারিদিকে পাখির কলরব । দূরে মুরগীর ডাক । কৃষি প্রধান এলাকা । চারিদিকে চাষের জমি । মাথাভাঙা একটি ছোট্ট শহর । কিন্তু আশ্রমটি মাথাভাঙা শহর ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে । জায়গাটা খুব নিরিবিলি । আশেপাশে চাষের জমি ছাড়া যদিও কিছু বসত বাড়ি রয়েছে । সেখানকার মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল নয়, বাড়িঘর ও লোকজনের হাঁটাচলাতে সেটা পরিষ্কার । চারিদকটা দেখার মাঝখানে একজন বয়স্ক মহিলা চোখ রগড়াতে রগড়াতে কুহেলির কাছে এসে বললেন, “তোমরা কী কোচবিহারের মদনমোহন মন্দির থেকে এসেছো বাছা ?”
“হ্যাঁ ।“ পুবালী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো ।
ঘরে এসে বসো মা । আশ্রমের মহারাজ প্রাতঃকালীন ভ্রমণে বেরিয়েছেন । তিনি একটু পরে এসে পৌঁছাবেন । ততক্ষণে আমি চা করে আনছি । তোমরা চা খেয়ে একটু জিড়িয়ে নাও ।
কুহেলি লক্ষ করলো, ভদ্রমহিলা বয়স্ক হলেও যথেষ্ট মার্জিত । তাঁর ব্যবহারও অমায়িক । তাঁর কথাবার্তায়, কোথায় যেনো মায়া জড়ানো । বয়স্ক মহিলাকে দেখার পর কুহেলির বারংবার মনে হচ্ছে, “তিনি অনেকদিনের পরিচিত আপনজন ।“ কুহেলি আর দেরী না করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো ।
বয়স্ক মহিলা আর কেউ নন, তিনি শ্রাবন্তী মাসি । আশ্রমে সকলের মায়ের মতো । কুহেলিকে প্রণাম করা দেখে শ্রাবন্তী মাসি বললেন, “থাক্‌ মা । প্রণাম করতে হবে না । তোমরা একটু বসো । আমি চা করে আনছি । ততক্ষণে আশ্রমের মহারাজ এসে যাবেন ।“
বসার ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । অনেকটা বড় । চারিদিকে মহাপুরুষদের ছবিতে ভরা । টেবিল চেয়ারের পেছনে বইয়ের আলমারী । খোলা আলমারী । বইগুলি পরিপাটিভাবে সাজানো । বইয়ের ভাণ্ডার দেখে বোঝা যাচ্ছে, মহারাজ পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । কুহেলি বইয়ের আলমারীর পাশে গিয়ে দেখলো, তাতে সব ধরনের বই সাজানো । পাঠ্য বই ছাড়া বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস, ধর্মের বই, বেদ এমনকি উপনিষদ, ভ্রমণের বই, প্রবন্ধের বই, ইত্যাদি । বইয়ের ভাণ্ডার দেখে মহারাজের রুচিবোধের একটা ধারণা কুহেলির মধ্যে জন্মালো ।
শ্রাবন্তী মাসি চা নিয়ে হাজির । সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট । চা খাওয়ার সময় কুহেলি শ্রাবন্তী মাসির সাথে দু-চারটে কথা বলার সুযোগ পেলো ।
কুহেলি প্রথমেই প্রশ্ন করলো, “মাসি, আশ্রম চলে কী করে ? অর্থাৎ আশ্রম চালাতে খরচ কোথা থেকে আসে ?”
আমি তো সব জানি না বাপু । তবে আশ্রমের নামে কয়েক বিঘা জমি আছে । সেই জমিতে ধান চাষ হয় । সেই ধানের চালে আশ্রমের লোকেদের সারা বছরের খাবার জোটে । আশ্রমে কিছু দুস্থ ছেলে-মেয়ে থাকে । তারা পড়াশুনা করে । আগে যারা পাশ করে বেরিয়ে গেছে, তারা মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠায় । সেই টাকায় নুন-তেল-হলুদের মতো দৈনন্দিন খরচা উঠে আসে । এছাড়া ভক্তরা তাঁদের সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা করে । সেই আর্থিক সহায়তায় অন্যান্য খরচ মিটে যায় । এইটুকু মোটামুটি আমি জানি ।
আচ্ছা মাসি, আশ্রমের উদ্দেশ্য কী ? অন্যভাবে বলতে গেলে আশ্রমের ভাবনা কী ? কী প্রয়োজনে আশ্রমের প্রতিষ্ঠা ?
উত্তরে শ্রাবন্তী মাসি বললেন, “আমাদের মহারাজ বলেন, মানুষের সেবা করা আমাদের ব্রত । মানুষের হিতার্থে আশ্রমের কাজকর্ম ।“
এইসব অগোছালো কথাবার্তার মাঝে আশ্রমের মহারাজ এসে উপস্থিত । তিনি সোজা স্নানে ঢুকলেন । দূর থেকে বোঝা গেলো, লম্বা-চওড়া একজন সুপুরুষ ! তবে বয়সটা মনে হলো, হাল্কা বয়স । মহারাজ আসার সাথে সাথে মাসি উঠে চলে গেলেন । তিনি বললেন, “ছেলেটা এসেছে । তার কিছু দরকার হলে আমাকে ডাকবে । তোমরা বরং একটু বসো । আমি মহারাজের সঙ্গে দেখা করে আসি ।“
কুহেলি ও পুবালী বসে রইলো । উত্তরবঙ্গের খবরের কাগজ আশ্রমে পৌঁছে গেলো । খবরের কাগজের হেড লাইনের খবরগুলিতে চোখ গেলো কুহেলির । “গভীর রাত্রিতে পাচারকারীদের সাথে পুলিশির খণ্ডযুদ্ধ । কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ না থাকায় পুলিশি অভিযান ভেস্তে গেলো ।“ ভিতরে আরও লেখা, পুলিশ নাকি পাচারকারীদের ডেরা ধরতে পেরেছে । খুব শীঘ্র পাচারকারীর দল পুলিশের জালে ধরা পড়তে বাধ্য । পাচারকারীদের ডেরার চারিপাশে পুলিশি তল্লাশি অব্যাহত । প্রয়োজনে আধা সামরিক বাহিনী নামার সম্ভাবনা ।
শ্রাবন্তী মাসি কুহেলি ও পুবালীকে ডাকলো, “চায়ের টেবিলে আশ্রমের আবাসিকরা আসছে । তাদের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মহারাজ বললেন । সুতরাং তোমরা আমার সঙ্গে এসো । আগে সকলের সঙ্গে আলাপ হোক । তারপর হাত মুখ ধুয়ে সকালের জলখবার খাওয়া ।“
চায়ের টেবিলে বারোজন ছাত্র এবং চারজন ছাত্রী । পাঁচজন আবাসিক সর্বক্ষণ মাঠের জমি দেখাশোনা করে । দুজন মহিলা । আশ্রমের অন্যান্য কাজকর্মে তারা নিয়োজিত । আশ্রমে বলদ গরু নেই, কিন্তু দুগ্ধবতী গরু চারটি । বাছুর আপাতত তিনটি । অর্থাৎ তিনটি গরু এখন দুধ দিচ্ছে । একটি গাই-গরু সম্ভবত বাচ্চা দেবে । মহারাজকে সহযোগিতা করার জন্য সর্বক্ষণের কুমারদা । তার কাজ হচ্ছে আশ্রমের ভালমন্দ দেখাশোনা করা । ছেলে-মেয়েদের স্কুলের/কলেজের সাথে যোগাযোগ রাখা । তাদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়া । ছাত্রদের কোনো গৃহশিক্ষক নেই । কুমারদা তাদের গৃহশিক্ষক । সকলের সাথে আলাপ করে কুহেলি উৎফুল্ল । সে অন্তত এখানে একটা ঘরোয়া পরিবেশ পেলো । তার ভিতর থেকে ভয়টা ক্রমশ বিদায়ের পথে । সকলে যথেষ্ট আন্তরিক । একে অপরের সুবিধা-অসুবিধায় প্রত্যেকে সজাগ । তাই কুহেলির মনে হচ্ছে, সে এখন ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে । আর দমবন্ধ জীবন নেই । দমবন্ধ জীবন থেকে সাময়িক মুক্তি । আশ্রমের আবাসিকরা সকলেই হাসিখুশী ও কর্মঠ ।
জলখাবার রেডি । দুটো করে আটার রুটি, সবজির তরকারি । ঝাল ঝাল করে ধনে পাতা দিয়ে আলু ও কুমড়োর তরকারি । খাবার ঘরে সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার রেওয়াজ । কারও কলেজ/স্কুল থাকলে আলাদা কথা । মাঠের জমিতে যারা কাজে যান, তাদের জলখাবার কেউ না কেউ জমিতে পৌঁছে দিয়ে আসে । শ্রাবন্তী মাসি মহারাজকে ডাকলেন । তার কথাবার্তায় কুহেলি বুঝতে পারলো, মহারাজ শ্রাবন্তী মাসিকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন ।
পুবালী বাইরের কলে হাত ধুতে গেলো । এমন সময় মহারাজ সকালের জলখাবার টেবিলে হাজির । সোজা কুহেলি চোখে চোখ পড়তেই কুহেলির মনে হলো, ভদ্রলোকটি তার অনেকদিনের চেনা ।
কুহেলি হাত জোড় করে মহারাজকে নমস্কার জানালো
মহারাজ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোন্‌ ভোরে বের হয়েছেন । টিফিন খেয়ে আপনারা একটু বিশ্রাম নিন ।“
তার দরকার হবে না স্যার । এখানে সকল আবাসিকের সাথে আলাপ হয়ে মনে হচ্ছে, নিজের বাড়িতে আছি । সুতরাং আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে আপনি অযথা উতলা হবেন না । আমরা খুব ভাল জায়গায় এসেছি এবং নিরাপদ বোধ করছি ।
সুরেশবাবুর কাছে আপনাদের সম্বন্ধে কিছুটা শুনেছি । বাকীটা আপনাদের মুখ থেকে শুনবো । নিশ্চিন্তে ও সাবধানে থাকুন । আশা করি আপনাদের আর কোনো বিপদ হবে না । তবে সাবধানে থাকাটা যুক্তিযুক্ত ।
কুহেলির হঠাৎ প্রশ্ন, “স্যার, আপনার মতো শিক্ষিত ও গুণী মানুষের সান্নিধ্যে এসে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি । কিন্তু আমার মনে একটা খটকা, “আপনি গার্হস্থ্য জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে কেন আশ্রমবাসী হলেন, এটা খুব জানতে ইচ্ছা করছে ?“
আপনার প্রশ্নটা অমূলক নয় ! এই প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ আগেও বহুবার হয়েছি । আপনি বলতে পারেন, আমি মানুষের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছি । এটা আমার জীবনের ব্রত ।
কোচবিহারের প্রত্যন্ত এলাকায় মাথাভাঙার মতো জায়গায় আশ্রম খুঁজে পেলেন কী করে ?
সেটাও একটা ইতিহাস । ঘটনাচক্রে আমার জীবনে একটা দূঃসময় আসে । সেই সময় আমি এলোপাথারি ঘোরাঘুরি করি । “সংসার জীবনে ঢুকবো না” স্থির সিদ্ধান্ত নিই । তখন আমার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী এই আশ্রমের হদিস দিলো । তাঁর বন্ধু মাথাভাঙা হাইস্কুলে চাকরি করার সুবাদে তিনি এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন । হাইস্কুলের মাস্টার মশাই আবার এই আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা । তিনি আমাকে পেয়ে আশ্রমের দায়িত্বে বসিয়ে দিলেন । আগের মহারাজ বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন । বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার তাঁর তাগাদা ছিল । মাস্টার মশাই আমাকে পেয়ে আগের মহারাজকে বাকী জীবনের জন্য ছুটি দিয়ে দিলেন । তিনি এখন বাংলাদেশে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন । আর আমি এখন আশ্রম সামলাচ্ছি । আশ্রমে যারা রয়েছেন, প্রত্যেকে খুব ভাল মানুষ । শ্রাবন্তি মাসি সকলের কাছে মায়ের মতো । ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রাবন্তী মাসিকে খুব ভালবাসে । যার জন্য তাদের যতো আবদার, সবটাই শ্রাবন্তি মাসির কাছে ।
তারপর মহারাজ কুহেলির দিকে তাকালো, “আপনার আর কী প্রশ্ন ?”
প্রশ্ন অনেক । তবে একসঙ্গে নয় । পরে অবসর সময়ে আশ্রম নিয়ে কথা বলা যাবে । ঠিক সেই মুহূর্তে পুবালী হাত ধুইয়ে খাওয়ার টেবিলে হাজির । শ্রাবন্তি মাসি দুখানা রুটি ও আলু-কুমড়োর তরকারি এগিয়ে দিলেন । রুটি দেখে পুবালীর মাথা গরম । মুখে বলতে পারছে না, অথচ খেতেও চাইছে না ।
মহারাজের ঠিক উল্টোদিকে পুবালী বসলো । যার জন্য মহারাজের মুখ পুবালী দেখতে পেলো না । তাই পুবালী জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা কুহেলি !”
“কী ?” কুহেলি জানতে চাইলো ।
আশ্রমের মহারাজকে দেখতে পেলাম না ?
এবার মহারাজ পুবালীর উদ্দেশে বলল, “মহারাজ তো আপনার পাশেই !”
মহারাজ পুবালীর দিকে তাকাতেই, পুবালী চমকে গেলো ! সে কাকে দেখছে ?
( চলবে )

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, পঞ্চদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

মন্দিরের পুরোহিতের কাছে কুহেলি সব খুলে বলায় শর্তসাপেক্ষে মন্দিরে থাকার অনুমতি । সকালে ঘুম থেকে উঠে মন্দিরে কিছু কাজকর্ম থাকে । কুহেলি বাগান ঘুরে ঘুরে পুজোর ফুল সংগ্রহ করে । সেই ফুলে সকালে ঠাকুর পুজা । কুহেলি বাগানের সমস্ত ধরনের ফুল সংগ্রহ করে পুরোহিত ঠাকুরকে পৌঁছে দেয় । পুরোহিত ঠাকুর ঠিক সকাল সাতটা পনের মিনিটে পুজোয় বসেন । তিনি খুব নিষ্ঠাবান পুরোহিত ঠাকুর । তাই তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো সারেন । পুজোয় বসলে তিনি শুধুমাত্র ঠাকুরের প্রতি ধ্যান দেন । অন্যদিকের আনুসঙ্গিক কাজকর্ম বা ভাবনা-চিন্তা তার মাথা থেকে বেরিয়ে যায় । প্রতিদিন সকালে পুজোর সময় অনেকেই মন্দির চত্বরে ভিড় করেন । পুজো শেষে প্রসাদ বিতরণ ।
পুজোর পর মন্দিরে পোষা হাঁসগুলি দেখার দায়িত্ব কুহেলির । কুহেলি হাঁসগুলি নিয়ে মন্দিরের পুকুরে ছেড়ে দিয়ে আসে । গোটা বাইশটি হাঁসের মধ্যে পাঁচটি রাজহাঁস । খাঁচা থেকে হাঁসগুলি বের করলে কুহেলির বেশ লাগে । একটা অদ্ভূত সুন্দর আওয়াজ করতে করতে দল বেঁধে তারা পুকুরে নামে । পুকুরের জল পরষ্কার পরিচ্ছন্ন । পুকুরের পার পরিপাটিভাবে সাজানো । পারে অনেক ধরনের গাছ-গাছালি । পুকুরটি নিয়ে অনেক ইতিহাস । এখনও পুকুরের জলে ভক্তরা স্নান সারেন । পুকুরটিতে হাঁস ছেড়ে দিয়ে কুহেলির সকালের ব্রেকফার্স্ট । সকালের জলখাবারে বেশীর ভাগ দিন দুটো রুটি ও সবজির তরকারি । তারপর নিজের কিছু কাজ সেরে রান্নাঘরে ঢুকতে হয় । রান্নার টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনতে হলে কুহেলি সেগুলি আনতে ছুটতে হয় । তারপর স্নান সেরে দুপুরের খাবার । বিকেলে কাজ নেই বললেই চলে । শুধুমাত্র সন্ধার আগে হাঁসগুলি পুকুর থেকে এনে খাঁচায় বন্দি করে তবেই মুক্তি ! এই অবসর সময়ে কুহেলি আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখে । কোচবিহার শহরটার আনাচে-কানাচে ঘোরাঘুরি করে । অনেক সময় একাই ঘোরে । তবে মাঝে মাঝে পুবালী সঙ্গী হয় । তবে বাইরে বের হলে মুসলিম নারীদের মতো বোরখার ন্যায় মুখ ঢেকে বের হয় । নতুবা দুর্বৃত্তদের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে । কোনো কারণে তাদের চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই । পুবালীর পরামর্শমতো কুহেলি কিছুতেই পুলিশকে তাদের ঘটনাটা জানায়নি । পাছে অহেতুক টানাপোড়েনের ভয়ে । এমনকি কুহেলি ইচ্ছা করে জগন্নাথের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে না । ফোনের টাউয়ার ধরে পুলিশ অনায়াসে কুহেলিদের ধরে ফেলবে । তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা । তাই আপাতত পুলিশের টানাপোড়েন থেকে দূরে থাকতে চায় ।
কুহেলি সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরে থাকবেই । সন্ধ্যাবেলার আরতি দেখতে কুহেলির মন টানে । যেখানেই থাকুক না কেন, সে সন্ধ্যার সময় মদন মোহন মন্দিরে এসে সন্ধ্যারতি দেখবেই । সেই সময় স্থানীয় অনেক মানুষ মন্দিরের সামনে ভিড় করেন । স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, মদন মোহন জাগ্রত ঠাকুর । এখানে মানত করলে তাঁদের মনোবাঞ্ঝা পূরণ হবেই । একদিন সন্ধ্যারতির সময় কুহেলি ভাবলো, তাকে মদন মোহন মন্দিরের ইতিহাস জানতে হবে । তাই গবেষণার মতো মদন মোহন মন্দির সম্বন্ধে জানতে শুরু করলোঃ-
উত্তরবঙ্গের একটা ছোট্ট জেলা হল কোচবিহার, আর এই জেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মদনমোহন মন্দির। এমনিতেই ‘বারো মাসে তেরো পার্বন’ উদযাপন করার বদনাম বাঙালিদের চিরকালের সঙ্গী । তার উপর যদি আনুসঙ্গিক মেলা বা আনন্দোৎসব হয়, তাহলে তো কথাই নেই । স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বাঙালির উৎসবেরও রকমফের আছে ! তেমনই এক বহু চর্চিত উৎসব হল কোচবিহারের মদনমোহন বাড়ির রাস উৎসব । এই রাস উৎসব কেবলমাত্র উত্তরবঙ্গেই নয়, বরং সমগ্র দেশে এবং দেশের বাইরেও পরিচিত । রাস উপলক্ষ্যে সমগ্র কোচবিহারবাসী যেমন উৎসবে মেতে উঠেন, তেমনি কোচবিহারের বাইরের মানুষও ছুটে আসেন ।
এই রাস উৎসব সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, কোচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা বিক্রমাদিত্য নর নারায়ণ অসমের বৈষ্ণব ধর্মগুরু শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের নির্দেশানুসারে বংশীধারীর অষ্টধাতুর বিগ্রহ তৈরী করিয়েছিলেন । এরপর পণ্ডিত অনন্ত কন্দলির সহায়তায় মাঘ মাসের উত্তরায়ণ সংক্রান্তির পূর্ণিমা তিথিতে মহারাজা সেই বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করেন । পরবর্তীকালে অবশ্য সেই বিগ্রহটি চুরি হয়ে যায় এবং নতুন করে একটি অষ্টধাতুর বিগ্রহ পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা হয় । প্রাথমিক ভাবে এই বিগ্রহের বেশ কিছু নাম ছিল, যেমন ‘বংশীধারী’ বা ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’ বা ‘শ্রী শ্রী মদনমোহন’। কিন্তু এই নাম নিয়েও তৎকালীন ভক্তমহলে দ্বিমত ছিল । শঙ্করদেবের মতাদর্শ অনুসরণকারী বৈষ্ণবদের মতে “শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধা রাণী পুজিতা হন না”, তাই একক ত্রিভঙ্গমুরারী রূপে পুজো করা শুরু হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের । কিন্তু কোচবিহারের সমস্ত মানুষ শ্রী শ্রী মদনমোহন দেব নামেই পুজো করতে শুরু করেন “বংশীধারী”কে । জানা যায়, পরবর্তীতে মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ ভূপের আমলে, রাজধানী কোচবিহারে বিভিন্ন ভৌতিক ঘটনা ঘটতে শুরু করে । এই সমস্ত ঘটনার জন্য মহারাজা নিজের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন ভেটাগুড়িতে । সম্ভবত ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মানসাই নদী পেরিয়ে নিজের নতুন রাজধানীতে গৃহপ্রবেশ করেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ এবং সেদিনই সেখানে গৃহদেবতা শ্রী শ্রী মদনমোহনের রাসমেলার সূচনা করেন । সম্ভবত তখন থেকেই এই স্থানান্তরের প্রথা শুরু হয়েছিল । এরপর থেকে যখনই কোচ-রাজারা নিজেদের রাজধানী স্থানান্তরিত করতেন, তখনই তাদের গৃহদেবতা শ্রী শ্রী মদনমোহন ঠাকুরেরও স্থান পরিবর্তন হত ।
যতোদূর জানা যায় যে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে হরেন্দ্রনারায়ণের প্রপৌত্র মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের রাজত্বকালে, কোচবিহারের বৈরাগী দীঘির পারে বর্তমান চারচালা আকৃতির মদনমোহন মন্দিরটি তৈরির কাজ সম্পন্ন হয় । ওই বছরের একুশে মার্চ নবনির্মিত মন্দিরে রাজপরিবারের কূলদেবতার বিগ্রহ সহ অন্যান্য দেবদেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । মন্দিরের মোট পাঁচটি কক্ষ রয়েছে । একেক কক্ষে একেক দেবীর বিগ্রহ । পূর্ব প্রান্তে জয়তারা । পশ্চিম প্রান্তে কালী বিগ্রহ । আরেক পাশে ভবানী বিগ্রহ । অন্য দিকে নাটমন্দির । নাটমন্দিরে দুর্গাপুজো হয় । মন্দির স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই মন্দির সংলগ্ন এলাকায় রাস পূর্ণিমার দিন থেকে মেলার প্রচলন হয় যা কিনা আজ পর্যন্ত চলে আসছে । তবে মাঝের এই দীর্ঘ সময়ে এই মেলা সম্পর্কিত নানান রকম ঘটনার সাক্ষ্য বহন করতে হয়েছে কোচবিহার শহরকে । সময়টা ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ, কোচবিহারে সেসময় কলেরা রীতিমত মহামারী আকার ধারণ করে। তখন বৈরাগী দীঘির জলকে দূষণ মুক্ত রাখার জন্য রাজ আদেশে মেলাকে প্যারেড গ্রাউন্ডে সরিয়ে নেওয়া হয় । এছাড়াও একটা সময় ছিল যখন এই রাস মেলাতে এসে জুয়ার নেশায় পড়ে আশেপাশের গ্রামের মানুষগুলোকে রীতিমত সর্বশান্ত হয়ে ফিরতে হত । সম্ভবত ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের নির্দেশে কড়া ব্যবস্থা নিয়ে এই সমস্ত জুয়ার আড্ডা বন্ধ করে দেওয়া হয় ।
এরপর ধীরে ধীরে বৈদ্যুতিক আলোর প্রচলন হয় এবং মেলার জৌলুসও বাড়তে শুরু করে । রাজ পরিবারের শাসনকালে সাধারণত রাজারাই নিয়ম করে রাসচক্র ঘুরিয়ে, মদনমোহন ঠাকুর সহ সমস্ত বিগ্রহকে প্রণাম করে মেলার উদ্বোধন করতেন । প্রণামি দিতেন চোদ্দ টাকা । ১৯৬৯ সাল অর্থাৎ শেষ স্বাধীন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের সময় পর্যন্ত এই নিয়মেই চলছিল রাসমেলার উদ্বোধন । তবে পরবর্তী সময় কালের নিয়মে সমস্তটাই বদলে যায় । বর্তমানে রাসমেলা উদ্বোধনের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে কোচবিহারের জেলাশাসকের ওপর । রাজ আমলে রাজারা যজ্ঞে বসতেন কিনা জানা যায়নি । কিন্তু পরবর্তী সময় থেকে দেবোত্তর ট্রাস্টের সভাপতি হওয়ার সূত্রে কোচবিহারের জেলাশাসকেরাই প্রতি বছর পুজো, যজ্ঞ ও উদ্বোধন করে আসছেন । রাসমেলা এখন শ্রী শ্রী মদনমোহন বাড়ি থেকে শুরু করে, জেনকিন্স স্কুল সংলগ্ন রাস্তা ও সামনের রাসমেলার মাঠ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে । এই মেলার বিবরণ দেওয়ার আগে রাস উৎসব সম্পর্কে কিছু কথা জানিয়ে রাখা জরুরি। মদনমোহন ঠাকুর ছাড়াও কোচবিহারের এই রাস উৎসবের মূল আকর্ষণ হল রাসচক্র । বৌদ্ধ ধর্মচক্রের আদলে বাঁশের তৈরি প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু এবং ৮-১০ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট চোঙাকৃতি কাঠামোর ওপর কাগজের সূক্ষ্ণ কারুকাজ করে এই রাসচক্র তৈরি করা হয় । এর বিশেষত্ব হল প্রতি বছর লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে নিয়ম করে, একমাস নিরামিষ খেয়ে কোচবিহারের বাসিন্দা আলতাফ মিঞা ও তাঁর পরিবারের সদস্যেরা বংশপরম্পরায় এই রাসচক্র তৈরি করে আসছেন । এই রাসচক্রে দক্ষ হাতের নানারকম নকশার সাথে সাথে বিভিন্ন দেবদেবীর রঙিন ছবিও থাকে । কোচবিহারের মানুষের আবেগের সাথে জড়িয়ে থাকা এই রাসচক্র একই সাথে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে ঐতিহ্য বহন করে আজও আসছে ।
মদন মোহন মন্দিরের ঘটনাবলী জেনে কুহেলি আনন্দে আহ্লাদিত ।
মন্দির প্রাঙ্গনে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর কুহেলি ভাবছে, তাদের এবার বাড়ি ফেরার পালা । কুহেলি ভেবেছিল, নারী পাচার চক্রের দল সত্বর ধরা পড়বে । চক্রটা ধরা পড়লে তাদের বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধার সম্মুক্ষীণ হতে হতো না । কিন্তু পাচারকারী চক্রের ধরা পড়ার কোনো খবর নেই । খবর নেওয়ার জন্য প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়ে । প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত চোখ বোলানো কুহেলির অভ্যাস । অথচ তাদের মধ্যে বাড়ি ফিরে যাওয়ার একটা তাগাদা অনুভব হচ্ছে । কাঞ্চন নগরের মোড়ে কুহেলির দোকান এখন বন্ধ । দোকানের কী পরিস্থিতি তার কোনো খবর নেই । জগন্নাথের সাথে যোগাযোগ রাখছে না, পাছে পুলিশে তাদের ধরে । এই মুহূর্তে পুলিশে ধরলে কুহেলির অনুমান, তাদেরকে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হবে । কেননা পুলিশ চাইবে কুহেলিদের কাছ থেকে পাচার চক্রের কোনো হদিস পাওয়া যায় কিনা ? সেই ক্ষেত্রে আরও বিড়ম্বনা ! কেননা তাদের পুলিশ হেফাজতে থেকে পুলিশদের সহযোগিতা করতে হবে ।
তখন মন্দিরে সন্ধ্যাবেলার সন্ধ্যারতি চলছে । হঠাৎ মন্দিরের একজন কর্মকর্তা, সুরেশবাবু মন্দির প্রাঙ্গনে হাজির । তাঁর সাথে কুহেলির কয়েকবার দেখা হয়েছে । কারণ মন্দিরের টাকা পয়সার হিসাব তাঁর কাছে থাকে । বাজারের খরচা বাবদ সুরেশবাবুর কাছ থেকে টাকা নিতে গিয়ে এবং খরচার হিসাব দিতে গিয়ে সুরেশবাবুর সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে । সুরেশবাবু কুহেলির খুব কাছে এলেন । সেই সময় কুহেলি হাত জোড় করে ঠাকুরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় মগ্ন ।
কুহেলির কানের কাছে গিয়ে বললেন, “তুমি একটু বাইরে এসো । তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে !”
কুহেলি ঘাবড়ে গেলো । সুরেশবাবু হঠাৎ কী কথা বলবেন । এযাবৎ যতো টাকা নিয়েছিল সব টাকার হিসাব কুহেলি সুরেশবাবুকে দিয়ে দিয়েছে । তবে কেন তিনি ডাকছেন ? গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো কুহেলি । তবুও সুরেশবাবু ডাকছেন, সুতরাং তাকে সুরেশবাবুর কথা শুনতেই হবে । কারণ তারা এই মন্দিরে আশ্রিতা । বাইরে বেরিয়ে এলো কুহেলি ।
এবার সুরেশবাবুর দিকে তাকিয়ে কুহেলি বললো, “স্যার, বলুন কী বলবেন ?”
সুরেশবাবু তখন কুহেলিকে বলতে শুরু করলেন, “থানা থেকে পুলিশ আধিকারিকেরা এসেছিলেন । তাঁরা বললেন, “নারী পাচার চক্রের দলের মানুষ যেভাবে হোক জানতে পেরেছে, তোমরা মন্দিরে প্রাঙ্গনে আশ্রয় নিয়েছো ।“ …………
( চলবে )

Share This
Categories
উপন্যাস

 দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃচতুর্দশ পর্ব) :  দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।।।

পাটকাঠির ঢিপির মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় থাকার জন্য জগন্নাথের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না । এমনকি কুহেলি ফোনে কথা বলতে বা মেসেজ পাঠাতে পারছে না । ঐদিকে অদূরে দুষ্কৃতিরা আড়ালে বসে তাদের উপর নজর রাখছে । টের পেলে কুহেলিদের রক্ষে নেই । আবার নারী পাচার চক্রের খপ্পরে পড়তে হবে । কুহেলি কিছুতেই পাচারকারীদের হাতে পুনরায় ধরা পড়তে নারাজ । কুহেলি নিজেকে বাঁচাতে যেকোনো প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে মানসিকভাবে তৈরী !
হঠাৎ পুবালীর হাঁচি ! সারা রাত দৌড়-ঝাঁপ করার জন্য পুবালীর শরীর ঠিক নেই । শরীরে জ্বর জ্বর ভাব । অনেকক্ষণ থেকে নাক টানছে । নাকের ভিতর ভীষণ অস্বস্তি । আর হাঁচি ধরে রাখতে পারলো না । হাঁচির শব্দ পাটকাঠির ঢিপি ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে গেলো । হাঁচি দেওয়ার সাথে সাথে পুবালীর শরীর নড়েচড়ে উঠলো । শারীরিক নড়াচড়ার জন্য খাড়া করা পাটকাঠিগুলোও কেঁপে উঠলো ।
ওত পেতে বসে থাকা দুষ্কৃতিরা হাঁচির শব্দে উজ্জীবিত হয়ে উঠলো । শারীরিক ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাদের হারানো ধনের সন্ধান তারা পেয়ে গেছে ! উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে ভালভাবে দেখে নিলো । চাষের জমিতে যেমন চাষ করার কোনো লোকজন নেই তেমনি আশেপাশেও কোনো লোকজনের সাড়াশব্দ নেই । শুরু হলো তাদের তল্লাশি । হাঁচির শব্দকে কেন্দ্র করে কুহেলিদের খুঁজতে শুরু করলো । তিনজন দুষ্কৃতি একসঙ্গে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে । দুষ্কৃতিদের চলাফেরা দেখলে মনে হচ্ছে, তারা হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে । জলাশয়ের কিনারে পাটকাঠির প্রায় পনেরটা ঢিপি । একটা একটা করে ঢিপি খুঁজতে লাগলো । তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পাটকাঠির ঢিপির মধ্যে কুহেলিরা লুকিয়ে । তাই তারা প্রতিটা ঢিপি ধরে ধরে খুঁজছে । কুহেলি ঝুঁকি নিতে চাইছে না । তাই দুষ্কৃতিরা পৌঁছানোর আগে তাদের পালানোর উদ্যোগ । কিন্তু কিছুতেই পালাবার পথ পাচ্ছে না । কুহেলি রীতিমতো টেনশনে ঘামছে । আর মাত্র দুটো পাটকাঠির ঢিপি খোঁজা অবশিষ্ট । অথচ কুহেলি দুষ্কৃতিদের হাতে ধরা দিতে নারাজ । পালাতে যথাযথ সুযোগ না পাওয়ার কারণে উদ্বিগ্নতায়, টেনশনে কুহেলির ছটফটানি ।
অবশেষে মনকে শক্ত করলো কুহেলি । পুবালী ও কুহেলি পালিয়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ! যদিও পুবালী কুহেলির মতো অতোটা মানসিকভাবে শক্তিশালী নয় । বারংবার কুহেলিকে উত্ত্যক্ত করছে, “ধরা পড়লে কী হবে ?” পুবালী জানে, কুহেলি যেমন শারীরিকভাবে শক্ত, তেমনি তার মনে ভয়-ডর কম । যেকোনো পরিস্থিতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে । অতীতে বেয়াদপ ছেলেদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে কুহেলিকে অনেক প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং সাহসিকতার সাথে সেই প্রতিকূল অবস্থাকে সে সামলিয়েছে । তাই কুহেলি দুষ্কৃতিদের হাত থেকে রেহাই পেতে পালাবার জন্য মানসিকভাবে চাঙা ! তবুও দুষ্কৃতিদের হাতে ধরা দিতে নারাজ !
গুটি গুটি পায়ে কুহেলিরা দুষ্কৃতিদের পেছন দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে, তারপর দৌড় । শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সজোরে দৌড় । যেটা দুষ্কৃতিরা প্রথমে বুঝতে পারেনি । কিন্তু দৌড়াবার আওয়াজ পেয়ে দুষ্কৃতিরা কুহেলিদের পেছন পেছন ধাওয়া । দুজনের ষণ্ডামার্কা চেহারা । তিনজনের মধ্যে দুজন প্রাণপন ছুটছে । যেভাবে হোক, কুহেলিদের ধরতে মরিয়া !
অল্পতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে পুবালী । কুহেলির সাথে পেরে উঠছে না । দৌড়াতে গিয়ে পুবালীর পড়ে যাওয়ার উপক্রম । পুবালীকে পড়ে যেতে দেখে কুহেলির ধমক, “আরও জোরে, আরও জোরে পুবালী ।“ কুহেলি জানে, সে যেভাবে হোক পালিয়ে বাঁচবে । দৌড়িয়ে অন্তত দুষ্কৃতিরা তাকে ধরতে পারবে না ! কিন্তু পুবালী দৌড়াতে না পারলে আখেরে কুহেলির বিড়ম্বনা । পুবালীকে নিয়ে ভুগতে হবে । কেননা পুবালীকে সঙ্গে নিয়েই তাকে ফিরতে হবে । তাই পুবালীকে দৌড়ানোর গতি বাড়াবার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে । কিন্তু পুবালী কুহেলির সাথে দৌড়াতে পারছে না । হাঁপিয়ে যাচ্ছে । তারপর হঠাৎ ………?
হঠাৎ পুবালী হোঁচট খেয়ে জমিতে কাদার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো । খুব দ্রুত দুষ্কৃতিরা পুবালীকে ধরে ফেললো । পুবালীর পড়ে যাওয়াটা টের পায়নি কুহেলি । তাই সে এলোপাথারি ছুটছে । তার টার্গেট, আগে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানো । তারপর খোঁজ নিয়ে জানবে, “তারা এখন কোথায় ?”
কিন্তু পরক্ষণেই …………?
দুষ্কৃতিরা চিৎকার করে কুহেলির উদ্দেশে বললো, “আর একপাও এগোবি না । পালাবি কোথায় ? তোদের নিয়ে আমরা সোজা ভিন রাজ্যে । সেখানে তোদের বিয়ে । আর তোদের বাঁচার আশা নেই ।“
ঘুরে তাকিয়ে কুহেলি দেখলো, পুবালী দুষ্কৃতিদের হেফাজতে ! ভয় পেয়ে আতকে উঠলো কুহেলি । বিষম বিপদ । পুনরায় দুষ্কৃতিদের জালে জড়িয়ে পড়লে ভবিষ্যতে সেই জাল থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব ! এদের অনেক দূর পর্যন্ত জাল বিস্তার । সুতরাং ধরা পড়লে সর্বনাশ ! তাই সেই মুহূর্তে কীভাবে নিজেদের বাঁচাবে সেই চিন্তায় অস্থির । পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো কুহেলি । যেভাবে হোক পুবালীকে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে উদ্ধার করে অন্যত্র পালাতে হবে । ষণ্ডামার্কা দুজন কুহেলিকে ধরার জন্য প্রস্তুত । বয়স্ক দুষ্কৃতিটার জিম্মায় পুবালিকে রেখে অপর দুজন খুব দ্রুত এগোচ্ছে । কিন্তু এই মুহূর্তে কুহেলির কাছে সবচেয়ে মুস্কিল ব্যাপার সেটা হচ্ছে, ঝৌড়-ঝাঁপ টানা-হ্যাচড়ার জন্য ঐ ষণ্ডামার্কা দুজনের সাথে সামনাসামনি লড়াই করার শারীরিক ক্ষমতা তার এখন কম । তবুও কুহেলি নাছোড়বান্দা । তার ঘাবড়ালে চলবে না । যেভাবে হোক পুবালীকে উদ্ধার করা চাই । তা ছাড়া কুহেলির হাতে সময় খুব কম । ভাববার সময় নেই । তাই ভাল করে দুজন দুষ্কৃতির আক্রমণ করার ধরনটা বুঝে নিলো । কুহেলি নিশ্চিত, ওদের হাতে এই মুহুর্তে পিস্তল-জাতীয় কোনো বিপজ্জনক আগ্নেয়াস্ত্র নেই । শুধুমাত্র শারীরিক হম্বিতম্বি !
প্রায় কাছাকাছি । কুহেলি পায়ের কাছের ইটটিকে দু-টুকরো করে একজনের মাথা টার্গেট করে ছুড়লো । দুষ্কৃতির মাথা ফেটে রক্ত । নিমেষেই মাটিতে গড়াগড়ি । আর একজন দুষ্কৃতি সমস্ত বলপ্রয়োগ করে কুহেলিকে ডান হাত দিয়ে ঘুষি ! ঘুষি মারবার আগেই কুহেলি পা দিয়ে কোমরের নীচে তাকে লাথি । লাথি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো বেশী হম্বিতম্বি করা দুষ্কৃতিটা । তারপর কোনো কিছু ভাববার আগেই কুহেলির বয়স্ক দুষ্কৃতির কাছ থেকে নেওয়া পিস্তল থেকে শূন্যে এক রাউণ্ড গুলি ! সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক দুষ্কৃতিকে পিস্তল উঁচিয়ে চিৎকার করে বললো, “এক্ষুণি পুবালীকে ছেড়ে দে, নতুবা পিস্তলের একটা গুলিতে তোর প্রাণ শেষ !” ভয় পেয়ে বয়স্ক দুষ্কৃতি দিশেহারা । বাধ্য হলো পুবালীকে ছেড়ে দিতে । পুবালীকে কাছে পেয়ে কুহেলির চিৎকার, যে যেখানে যেভাবে আছিস, চুপচাপ থাক । নড়াচড়া করেছিস তো পিস্তলের গুলিতে সব কটাকে শেষ !”
ছুটে পাটের জমির আড়াল দিয়ে কুহেলিরা দৌড়াচ্ছে । পেছনে পেছনে দুষ্কৃতিরা তিনজন । শূন্যে আবার এক রাউণ্ড গুলি ! কিন্তু দুষ্কৃতিরা পিছু হটছে না । কুহেলি আতঙ্কে কাহিল হয়ে পড়লো । পুনরায় দুষ্কৃতিদের হাতে ধরা পড়লে ভয়ংকর বিপদ ! অগ্রিম বিপদের কথা ভেবে কুহেলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে । কোনো লোকজনের দেখা নেই । শুধু ধু ধু মাঠ ! দূরে তাল গাছের সারি দেখে কুহেলির অনুমান, নিশ্চয় পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে । কুহেলি ভাবছে, জমিতে বড় বড় পাট গাছ থাকায় তাদের পালাতে সুবিধা । কিছুটা যাওয়ার পর পরেই বড় বড় পাটের জমি । সুতরাং পাট গাছের আড়াল-আবডালের জন্য লুকিয়ে পালাতে তাদের অনেকটাই সুবিধা । পুবালী ও কুহেলি, দুজনে পাটের জমিতে দুষ্কৃতিদের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে দুষ্কৃতিরাই কীভাবে যেনো তাদের টপকে ভিন্ন পথ দিয়ে আগে চলে গেলো । সুযোগ পেয়ে কুহেলি পেছন দিকের অন্য রাস্তা ধরে ঘুরপথে সোজা নদীর কিনারে । নদী কেমন বা নদী কোথায় গেছে ভাববার আগেই দুজনে নদীতে ঝাঁপ । সাঁতার কাটতে গিয়ে হাতের মোবাইল, পিস্তল সমস্ত কিছু জলে ডুবে উধাও ! নদী পার হতে অনেক সময় লেগে গেলো । তবুও রক্ষে, দুষ্কৃতিরা একটুও টের পায়নি । অবশেষে কুহেলিরা সাঁতার কেটে নদী পার হলো । নদীর পারে উঠেই দূরে যাত্রী বোঝাই বাস যেতে দেখে কুহেলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পুবালীর দিকে তাকিয়ে বললো, “এবার আমরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবো !” কিন্তু পুবালির দিকে তাকিয়ে কুহেলি অবাক ! মেয়েটা কাঁদছে । তারপর ক্রন্দনরত অবস্থায় কুহেলির কাঁধে মাথা রেখে পুবালী বললো, “আমি আর পারছি না ।“ কুহেলি সান্ত্বনা দিয়ে পুবালীকে মানসিকভাবে শক্ত হতে বললো । পুবালীকে আরও বললো, “তাদের বিপদ এখনও কাটেনি । নিরাপদ আশ্রয়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের বিপদের ঝুঁকি ষোলোআনা ।“
রাস্তায় হাত দেখানো মাত্র একটি খালি লরি দাঁড়িয়ে পড়লো ।
“কোথায় যাবেন দিদি ?” লরির ড্রাইভার জানতে চাইলো ।
পরের শহরটায় ।
পরের শহরটা কোচবিহার । এখান থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার । আমরা তার আগে অন্য রাস্তা ধরে অন্যত্র চলে যাবো । আপনারা বরং লরি থেকে নেমে অন্য বাসে কোচবিহার পৌঁছাতে পারবেন ।
মাথা নেড়ে সায় দিলো কুহেলি । আগে তাদের এখান থেকে পালানো দরকার ! নতুবা ঐ দুষ্কৃতিরা আবার ধাওয়া করলে আর রক্ষে নেই । ওদের নেটওয়ার্ক দেশের সর্বত্র । কুহেলিদের খবর তাদের কানে গেলে যেভাবে হোক তারা কুহেলিদের খুঁজে বের করবেই । সুতরাং অযথা সময় নষ্ট না করে পুবালী ও কুহেলি লরিতে উঠে বসলো । লরি ছুটলো কোচবিহারের দিকে ।
এদিকে পুবালী সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছে না । তার খুব ক্ষিদে । তার ক্ষিদের কথা অন্তত তিনবার কুহেলিকে বলা হয়ে গেছে । ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় জেরবার পুবালী । ঠিক মতো বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে । কুহেলি সান্ত্বনা দিয়ে বললো, “কোচবিহারে পৌঁছালে তবেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ।“
কোচবিহারে পৌঁছে কুহেলিদের চোখে শর্ষে ফুল । কিচ্ছু চেনে না । তার উপর অঝোর ধারায় বৃষ্টি । ভারী বর্ষণের দরুন রাস্তা দিয়ে চলাচলে অশান্তি । পান্তা মাসির কাছে একবার শুনেছিল, কোচবিহার শহরের প্রাণকেন্দ্রস্থলে মদনমোহনের মন্দির । ১৮৮৯ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন । রাজবংশের পারিবারিক দেবতা “মদনমোহন” কোচবিহার মানুষের প্রাণের ঠাকুর । সেখানে সর্বক্ষণ ভক্তদের ভিড় । মন্দিরের দরজা সকাল ৯টায় খুলে রাত্রি ৮টায় বন্ধ । প্রয়োজনে ভক্তদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে । তবে সে শুনেছিল প্রসাদ পেতে গেলে নাকি ১০টাকার কুপন কাটতে হয় । কুহেলি প্রমাদ গুণলো, এই মুহুর্তে মদনমোহনের মন্দিরে আশ্রয় নেওয়াটা তদের ক্ষেত্রে নিরাপদ ও যুক্তিযুক্ত ।
এদিকে পুবালী কুহেলিকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে থানায় সমস্ত ঘটনা জানিয়ে দেওয়ার জন্য । এই মুহূর্তে পুলিশকে রিপোর্ট করার ঘোর বিরোধী কুহেলি । কেননা থানায় জানালে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা । পুলিশ মহল নারী পাচার চক্রের উদ্ধারের তাগিদে কুহেলি ও পুবালীকে তুলে নিয়ে পুলিশি হেপাজতে রেখে জেরা শুরু করতে পারে । পুলিশি জেরার মুখে পড়লে আরেক হ্যাপা ! অশান্তির শেষ নেই । নানান ধরনের প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে হেনস্তা করতে পারে । যদিও পুবালীর চাইছে, পুলিশ আমাদের জেরা করুক এবং নারী পাচার চক্র ধরুক । কিন্তু কুহেলি ধারণা, নারী পাচার চক্র উদ্ধারে ইতিমধ্যে পুলিশ চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে । তাঁরা চিরুনি তল্লাশি যেভাবে করছে, করুক । সুতরাং পুলিশের কাজ পুলিশ করুক । তারা আগে সুস্থ ও স্বাভাবিক হোক এবং নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাক, তারপর থানায় গিয়ে রিপোর্ট করবে । যার জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কুহেলি জগন্নাথের সাথে যোগাযোগ করছে না । জগন্নাথের সাথে যোগাযোগ করলে তাদের ফিরে যাওয়া নিশ্চিত হতো জেনেও কুহেলি নীরব ! একটাই কারণ, এখন তাদের শরীরে অতিরিক্ত ধকল নেওয়া খুব কঠিন । তাই পুবালীকে বুঝিয়ে পুলিশি ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিলো । অবস্থা স্বাভাবিক হলে অবশ্যই তারা পুলিশকে জানাবে ।
পুলিশকে না জানানোর ক্ষেত্রে কুহেলির মাথায় অন্য একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে । নারী পাচার চক্রের নেটওয়ার্ক বিশাল বড় । তাদের চেলা-চামুণ্ডা নিশ্চয় কোচবিহার জেলার আনাচে-কানাচে ঘুরপাক খাচ্ছে । উত্তরবঙ্গের মেয়েদের তুলে নেওয়ার খবর বেশী শোনা যায় । কুচক্রীদের নাকি উত্তরবঙ্গের মেয়েদের কব্জা করা সহজ এবং ঝুঁকিও কম । সেইজন্য উত্তরবঙ্গে নারী পাচারকারীদের বিচরণ যত্রতত্র । তারা যদি টের পায় কুহেলিরা থানায় যোগাযোগ করছে, তাহলে অবধারিতভাবে পুনরায় কুহেলিদের পাচার চক্রের কবলে পড়তে হবে । সেই সময় দুষ্কৃতিরা কীভাবে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কুহেলিদের তুলে তাদের ডেরায় তুলবে কাক-পক্ষীও টের পাবে না । এই ব্যাপারে কুহেলির অভিজ্ঞতা যথেষ্ট । যদিও পুরোটাই মেয়ে-মহল থেকে শোনা । তবুও কুহেলি খুব সতর্কভাবে নিজেদের চালনা করতে চায় ! কিছুতেই পুনরায় নারী পাচার চক্রের খপ্পরে পড়তে চায় না । কুহেলি এখন মানসিকভাবে শক্ত । এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারছে, তারা এখন নারী পাচার চক্রের হাত থেকে মুক্ত । বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তাদের খুব সাবধানে গা-ঢাকা দিয়ে চলতে হবে । তারপর বাড়ি ফিরে শক্তভাবে নিরাপদে বাঁচতে চায় কুহেলি ।
কুহেলি অবাক ! এত বড় নারী পাচার চক্র দেশের আনাচে-কানাচে সক্রিয়, সেটা নিয়ে দেশের সুশীল নাগরিক সমাজ নীরব ! তাঁদের মুখে কুলুপ আঁটা । কোনো টু শব্দ নেই । অথচ বর্তমান নাগরিক সমাজ ভালভাবেই জানেন, যেসব মেয়েরা পাচার হচ্ছে তারা তাদের হয় প্রতিবেশী নতুবা পাশের গ্রামের মেয়ে । পরোক্ষভাবে তাঁদের হয় বোন, না হয় মেয়ে সমতুল্য । অবাধে পাচার হচ্ছে । পুলিশকে দোষ দিয়ে তাঁরা নীরব থাকছেন ! এখানেই কুহেলির খটকা ! তাহলে কী সুশীল নাগরিক সমাজ এটাকে প্রছন্ন মদত দিচ্ছেন ? হৈচৈ হচ্ছে না কেন ? শুধুমাত্র যবতী মেয়েরাই পাচার হচ্ছে না, পাচারের তালিকায় মেয়ে শিশু থেকে বুড়ি সকলেই আছে । সুতরাং মেয়েদের পাচারের মতো জঘন্য ও ঘৃণ্য কাজ সমাজ থেকে খুব শীঘ্র উপড়ে ফেলা উচিত । নতুবা পাচারকারীদের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে । কুহেলি এইসব নিয়ে যতো ভাবে, ততই হতাশায় ভোগে ।
কুহেলির চোখে জল । এই বিশাল পৃথিবীতে সে বেঁচে থাকতে চায় । বেঁচে থাকার জন্য কারও উপর নির্ভরশীল নয় । একান্ত আপন মানুষ তাকে ছেড়ে চলে গেছে । গোটা পৃথিবীতে কুহেলি এখন একা । বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে লড়াইটা তার একার । পাশে কেউ নেই । তবুও এক শ্রেণীর কুচক্রী মানুষ তার বেঁচে থাকার পথে বাধা । চেষ্টা করলেও তার একার দ্বারা এই কুচক্রী মানুষদের ধ্বংস করা অসম্ভব । এইজন্য জনমত দরকার । সবচেয়ে কুহেলির আশ্চর্য লাগে, মিডিয়াও সেভাবে নারী পাচার নিয়ে সোচ্চার না । যার জন্য মেয়েদের অবাধে পাচার করার ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র ভীষণভাবে সক্রিয় । মাথা চাড়া দিচ্ছে । সবাই জেনেবুঝে চুপচাপ । এখানেই কুহেলির দুশ্চিন্তা ! তার দুশ্চিন্তা আরও বাড়ছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে । কেননা কুহেলি সারা জীবনের মতো নারী পাচার চক্রের কাছে টার্গেট হয়ে গেলো । তারা ঝোঁপ বুঝে যেকোনো মুহূর্তে কোপ মারতে পারে । সুতরাং তার বেঁচে থাকাটাই এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ । মানুষ চ্যালেঞ্জ দেয়, বিভিন্ন কারণে – যেমন পড়াশুনায় রেজাল্ট ভাল করার ক্ষেত্রে, চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে, দুইজন বন্ধুর মধ্যে রেষারেষি করে ভালবাসার মানুষটাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে, অথচ অন্ন বাসস্থানের কথা ছেড়ে দিয়ে কুহেলির জীবনে নারী সত্বা বাঁচিয়ে বেঁচে থাকাটাই এখন চ্যালেঞ্জ !
( চলবে )

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, ত্রয়োদশ পর্ব) : দিলীপ রায় ।।।

নীলকন্ঠ উদ্বিগ্ন । থানা থেকে বাড়ি ফেরেনি জগন্নাথ । বাড়ি ফিরতে সাধারণত ছেলেটা এত রাত্রি করে না । দুশ্চিন্তায় নীলকন্ঠ অস্থির । দোকান বন্ধ করে আমলাই বাজার থেকে অনেকক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছে নীলকন্ঠ । বাড়ি এসে দেখে ছেলেটা বাড়ি ফেরেনি । সাধারণত রাত্রের খাবার তারা তিনজন একসঙ্গে খায় । ছেলেটা না ফেরায় তারা খেতে বসতে পারছে না । তাই নীলকন্ঠের অস্থিরতা । অস্থিরভাবে নীলকন্ঠ একবার ঘরে, আর একবার বাইরে করছে । রাত্রি অনেক । চারিদিকে অন্ধকার । গাঁয়ের রাস্তা সুনসান !
হঠাৎ রাস্তা দিয়ে দুটো মোটর বাইক তার দিকে ধেয়ে আসছে । সাহাপুরের মানুষ সহজ সরল । খাটাখাটুনিতে তাঁদের জীবন যাপন । খুব প্রয়োজন না থাকলে এত রাত্রিতে কেউ বাড়ির বাইরে বের হয় না । মনে হচ্ছে কোনো বিপদের সংকেত ! নতুবা দুটি লোক সজোরে বাইক চালিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসবে কেন ?
বাইক থেকে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “আমি কাঞ্চন নগরের শ্যামল । আপনি আমাদের চিনবেন না । আপনার ছেলে জগন্নাথ কুহেলিকে খুঁজতে অনেক দূর চলে গেছে ।“
তাকে খুঁজতে কোথায় গেছে ? সেটা বলবেন তো ?
কোথায় গেছে আমরা কিচ্ছু জানি না ।
কী হয়েছিল সেটা বলবেন তো ? তা ছাড়া কুহেলি কে ?
“সন্ধ্যা রাত্রিতে কাঞ্চন নগরের মোড় থেকে তিনজন দুষ্কৃতি কুহেলি ও পুবালীকে চার চাকার গাড়িতে তুলে উধাও । ঠিক পরক্ষণেই জগন্নাথ কুহেলির চায়ের দোকানে হাজির । কাঞ্চন নগরের মোড়ে কুহেলির চায়ের দোকান । ভীষণ চালু দোকান ! জগন্নাথ কুহেলিকে ভীষণ ভালবাসে । তাই জগন্নাথ ক্রোধে অগ্নিশর্মা । যেভাবে হোক কুহেলিকে উদ্ধার করতে হবে । জগন্নাথের সন্দেহ, এই নিন্দনীয় জঘন্য কাজটি নারী পাচারকারী দলের । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মোটর বাইকে আমাকে তুলে নিয়ে থানায় । থানার গাড়িতে মাত্র দুজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে জগন্নাথ কোথায় ছুটলো আমাকে বলে যায়নি । শুধুমাত্র আমাকে বলে গেলো, বাইকটা বাড়িতে পৌঁছে দিতে এবং আপনাকে খবর দিতে ।“ এইটুকু বলে শ্যামল আবার বললো, “আমার ধারণা কুহেলিকে উদ্ধার না করে জগন্নাথ বাড়ি ফিরবে না ।“
নীলকন্ঠের মাথায় হাত ! তার ছেলের সদ্য চাকরি । দুর্বৃত্তদের সাথে তার এখনও এ্যাকশনের অভিজ্ঞতা নেই । তাই দুর্বৃত্তদের সাথে সে কতোটা এঁটে ওঠবে সেই চিন্তায় নীলকন্ঠ অস্থির । নারী পাচারকারীরা খুব ভয়ংকর । তারা তাদের স্বার্থে বাপ-ভাই-বোন কাউকে রেয়াত করে না । সুতরাং তিনজন পুলিশকে দুষ্কৃতিরা কখনই সহজে ছেড়ে দেবে না । জগন্নাথের মা শুনলে, তাকে কীভাবে বোঝাবে ? সেটাও আর একটা বড় চিন্তা !
শ্যামল বাইকটি ফেরত দিয়ে তার বন্ধুর বাইকে ঘরে ফিরে গেলো ।
নীলকন্ঠ ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো । অন্যদিকে ছেলের ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে গিন্নি ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে । নীলকন্ঠ গিন্নিকে আর ডাকলো না । ছেলের খবর জানতে পারলে গিন্নি প্রচণ্ড উতলা হয়ে উঠবে । তখন নাছোড়বান্দা হয়ে মালদাতে ছুটতে চাইবে । সেটাও আবার একটা জ্বালা ! নীলকন্ঠ কস্মিনকালেও শুনেনি এমনকি ভাবেনি, জগন্নাথ কুহেলিকে ভালবাসে । রাস্তার উপরে চায়ের দোকানের মেয়েকে জগন্নাথ কীভাবে এতখানি ভালবাসলো, এটাও তাঁর মোটা মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না । ছেলেটা বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে, এবার নীলকন্ঠ বুঝতে পারছে । কেননা ছেলের একটা নিজস্ব মত তৈরী হয়েছে । যার উপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেললো । ছেলের ভালবাসা যে গভীর সে বিষয়ে নীলকন্ঠ নিশ্চিত ! নতুবা তাকে বাঁচানোর জন্য এতটা ঝাঁপিয়ে পড়তো না । কুহেলিকে উদ্ধারের জন্য ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখে নীলকন্ঠের চিন্তা আরও বেড়ে গেলো । অন্যদিকে ছেলেটার সাথে সাথে তার প্রিয় বান্ধবী কুহেলির জন্যেও নীলকন্ঠের চিন্তা শুরু হলো । ঘরে বসে বসে ঝিমোচ্ছে নীলকন্ঠ । হঠাৎ জগন্নাথের ফোন, “বাবা, আমার জন্য দুশ্চিন্তা করো না । কুহেলিকে উদ্ধার করে আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছি । ইতিমধ্যে আমরা মালদা পৌঁছে গেছি । মালদার জেলা পুলিশ প্রশাসন আমাদের টীমকে যথেষ্ট সহায়তা করছেন । সুতরাং বিপদের ভয় নেই । কিন্তু আমাকে ফোন করে বিরক্ত করো না । প্রয়োজন হলে আমি ফোন করে সর্বশেষ পরিস্থিতি তোমাদের জানিয়ে দেবো ।“
বোলারো গাড়ির নম্বর পেয়ে সমস্ত থানায় জানিয়ে দিলো । থানার অধীনে সড়কের সমস্ত পুলিশ পিকেটংয়ে খবর পৌঁছে গেলো । পুলিশের মধ্যে যোগাযোগের দায়িত্বে জগন্নাথ । মালদা থেকে জগন্নাথ খবর পেলো, দুষ্কৃতিদের গাড়ি শিলিগুড়ির দিকে না গিয়ে রায়গঞ্জের দিকে ধাবিত । তাই পুলিশের অনুমান, দুষ্কৃতিরা বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশে পালাতে পারে । সঙ্গে সঙ্গে মালদা থেকে বালুরঘাটের পুলিশ পিকেটিংকে জানিয়ে দিলো । কেননা বালুরঘাট দিয়ে হিলি বর্ডার যাওয়ার রাস্তা । হিলি বর্ডার পার হলেই বাংলাদেশ । বাংলাদেশের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, ইত্যাদি জেলা । পাশেই এ্যায়ারপোর্ট । সুতরাং পুলিশের ধারণা, বাগডোগরা বিমান বন্দরে না ঢুকে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে পারে । ইচ্ছা করলে, দুষ্কৃতিরা খুব সহজে অসাধ্য সাধন করতে পারে ।
দুষ্কৃতিদের গাড়িতে বিভিন্ন নামী-দামী ব্রাণ্ডের ফরেন লিকারের বোতল । ফরাক্কা ব্যারেজ পার হওয়ার পর এবং ঠিক মালদা ঢোকার মুখে চারজনে মদ খেয়ে নেশায় বুঁদ । নেশার ঘোরে চারজনের চোখ ঢুলু ঢুলু । হঠাৎ ফোন আসায় দুষ্কৃতিরা নড়েচড়ে বসলো । তাদের টার্গেট ছিলো শিলিগুড়ি ! তারপর বাগডোগরা বিমান বন্দর থেকে অন্য টিমের সাথে একত্রে অন্যত্র পলায়ন । কিন্তু তারা সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে হিলি বর্ডার দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো । তাদের কথোপকথনে কুহেলির এটা অনুমান ।
রায়গঞ্জ পার হয়ে বোলারো গাড়িটা জঙ্গল ঘেঁষা রাস্তার পাশে থামলো । কুহেলিদের চোখ ও মুখ খোলা । শুধুমাত্র হাত বাধা । কুহেলি দেখতে পেলো কিছুটা দূরে একটা ছোটখাটো ধাবা । সেখানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে । একজন দুষ্কৃতিকে গাড়িতে পাহাড়ায় রেখে অন্য তিনজন ধাবায় ছুটলো । হয়তো তাদের লোক সেখানে অপেক্ষা করছে । নতুবা অন্য কারণে ধাবায় যেতে পারে । কারণটা কুহেলির বোধগম্য হলো না । তবে বুঝতে পারলো এখানে তারা কিছুক্ষণ দাঁড়াবে । যাওয়ার সময় একজন বয়স্ক দুষ্কৃতিকে পাহাড়ায় রেখে বলে গেলো, মেয়ে দুটির উপর সর্বক্ষণ নজর রাখতে ।
যাকে বসিয়ে গেছে সে অনেক বয়স্ক । তার উপর অতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করার ফলে বাছাধন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই । মদ্য অবস্থায় ফ্যাল ফ্যাল করে যুবতী দুটি মেয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো পঞ্চাশোর্ধ পাহাড়াদার । কুহেলি চালাক মেয়ে । তেমনি শারীরিকভাবে শক্ত সামর্থ । এই সময়টাকে কাজে লাগাতে চাইছে । কুহেলি মনে মনে মতলব আঁটলো, এই সুযোগে এখান থেকে পালাতে হবে । পাহাড়াদার দুষ্কৃতিকে কীভাবে পটানো যায় তার ফন্দি আঁটতে শুরু করলো । সময় কম । যা করতে হবে খুব দ্রুত করতে হবে এবং খুব সাবধানে । ধরা পড়লে হবে না । কোনো কারণে অন্য তিজনের নজরে এলে ঘোরতর বিপদ ! তাই খুব সন্তর্পণে তাকে অনুসরন করতে পুবালীকে ইশারা করলো । বাঁকা চোখের ইশারায় পাহাড়াদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো । হাত বাঁধা । তাই হাত দিয়ে কিছুই বোঝাতে পারলো না । কুহেলি পাহাড়াদারকে অঙ্গভঙ্গি করে ন্যাকামি সুরে বললো, “তুমি দূরে কেন ? আমাদের মাঝখানে এসে বসো । তোমার সুরসুরি পেলে আমরা খুব মজা পাবো ।“ পুবালী আরও বেশীমাত্রায় অঙ্গভঙ্গি করে আড় চোখে পাহাড়াদারকে ইশারায় বললো, “ডার্লিং, আমার পিঠটা খুব চুলকাচ্ছে । তুমি একটু পিঠটা চুলকিয়ে দাও না !”
যুবতী মেয়েদের রসাত্মক আবেদনে সাড়া দিলো পাহাড়াদার দুষ্কৃতি । পকেটের পিস্তল সিটের উপর নামিয়ে রেখে প্রথমেই পুবালীর কাছে গিয়ে তার পিঠ চুলকাতে উদ্যত হলো । তৎক্ষণাত পুবালী অঙ্গভঙ্গিমা করে বললো, “উঁহু ডার্লিং, হাতটা না খুললে আমরা তোমাকে আদর করবো কীভাবে ?” কুহেলি আরও একটু এগিয়ে ন্যাকামী সুরে বললো, “তুমি আমাদের নাগর । নাগরের সাথে মজা করতে হলে হাত বাঁধা থাকলে কীভাবে হবে ? হাতটা খুলে দিয়ে আমাদের পাশে বসো ।”
পাহাড়াদার দুষ্কৃতি পুবালীর দিকে তাকিয়ে বললো, “হাত খোলার হুকুম নেই ।“
“আরে ডার্লিং, মজা হয়ে গেলে পুনরায় হাত বেঁধে দেবে ।“ পুবালী ঢঙ করে আবদার করলো । তাতেই পাহাড়াদার দুষ্কৃতি পটে গেলো, “ঠিক আছে, আমি হাত খুলে দিচ্ছি । তার আগে তোমাদের পিঠটা একটু চুলকিয়ে দিই ।“
পাহাড়াদার দুষ্কৃতির তখন ভাববার সময় নেই । যুবতী মেয়েদের সাথে মজা-মস্করা করার এত বড় সুযোগ সে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছে না । পুবালী ও কুহেলির যৌন আবেদন অবলোকন করে পাহাড়াদার দুষ্কৃতি আনন্দে উত্তেজিত । হাতের দড়ি খুলে দিয়েই পুবালীকে নিয়ে টানাটানি । ততক্ষণে কুহেলি পিস্তল সোজা পাহাড়াদার দুষ্কৃতির কপালে ঠেকিয়ে বললো, “বাঁচতে চাইলে সোজা হয়ে দাঁড়া । নতুবা এখানেই শেষ ।“
পাহাড়াদার দুষ্কৃতি এখন অন্য নেশায় উত্তেজিত ! মজার উচ্ছ্বাসে বিভোর । কিছুতেই পুবালীকে ছাড়ছে না । জাপটে ধরে বলছে, “একটু মজা করে নিই ডার্লিং ।“
কুহেলি কনুই দিয়ে তার ঘাড়ে জোরে আঘাত করায় গাড়ির ভিতর পড়ে গেলো । পুবালী তখন তড়িঘড়ি দড়ি দিয়ে পাহাড়াদার দুষ্কৃতির হাত-পা বেঁধে ফেললো । অন্যদিকে কুহেলি কাপড়ের টুকরো দিয়ে চোখ ও মুখ বেঁধে দিয়ে বললো, “তুই শুয়ে থাক । এবার আমরা চললাম !”
খুঁজে খুঁজে তাদের মোবাইল ও দুষ্কৃতির পিস্তলটা নিয়ে চম্পট ! পিস্তল সাথে রাখার একটাই কারণ, অন্তত প্রয়োজনে আত্মরক্ষার জন্য কাজে লাগতে পারে ।
রাত্রি অনেক । তবে ভোর হতে অনেকটা দেরী । পিছন দিক দিয়ে তারা জঙ্গলে ঢুকে প্রথমেই জগন্নাথকে ফোন । জগন্নাথ ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রায়গঞ্জ থানাকে জানিয়ে দিলো । থানার পুলিশ ঝটাপট স্পটে হাজির । কেননা দুষ্কৃতিদের গাড়ি রায়গঞ্জ শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো । ফলে অল্প সময়ের মধ্যে রায়গঞ্জ থানার পুলিশ পৌঁছে গেলো । জগন্নাথ আগেই জানিয়ে রেখেছিলো, দুষ্কৃতিরা ধাবায় ঢুকেছে । তাই দ্বিতীয় পুলিশের গাড়িটা সোজা ধাবায় । আশ্চর্যের ব্যাপার ধাবায় এসে দেখে ধাবায় কেউ নেই । এমনকি ধাবার মালিক পর্যন্ত নেই । পুলিশের অনুমান, পুলিশ আসার খবর অগ্রিম কেউ জানিয়ে দেওয়ায় দুষ্কৃতিরা পালিয়েছে ।“
ধরা পড়লো পাহাড়াদার দুষ্কৃতি । তার হাত-পা এমনকি চোখ-মুখ বাঁধা । ইচ্ছে থাকলেও তার পালাবার উপায় নেই । অবশেষে রায়গঞ্জ থানার পুলিশের কাছে একজন দুষ্কৃতি ধরা পড়লো । তবুও রায়গঞ্জ থানার পুলিশের স্বস্তি, একজন দুষ্কৃতি অন্তত ধরা পড়েছে । জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক তথ্য পুলিশ পাবে ।
কুহেলিকে জগন্নাথ বলেছিলো, তোমরা বেশীদূরে যাবে না । কেননা রায়গঞ্জের পুলিশ তোমাদের উদ্ধার করে সসম্মানে বাড়ি ফিরিয়ে দেবে ।
কিন্তু জঙ্গলে তাদের কাছাকাছি মানুষের পায়ের একটা খটমট আওয়াজ পেয়ে কুহেলি ঝুঁকি নিলো না । কিছুদূর হাঁটার পর তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো । এতক্ষণ জগন্নাথের কথামতো রায়গঞ্জ যাওয়ার সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলো । কিন্তু মানুষের পায়ের খটমট আওয়াজে কুহেলি ভাবলো, দুর্বৃত্তরা পুনরায় আক্রমণ করলে নিজেদের বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে । যদিও রাত্রি শেষ হওয়ার দিকে । তবুও ঘন অন্ধকার রয়েছে । জমিতে তখনও বড় বড় পাট রয়েছে । কিছু জমিতে পাট কাটা হয়ে গেছে । পাটের জমির ভিতর দুষ্কৃতিরা ঘাপটি মেরে বসে থাকলে কুহেলিরা কিচ্ছু টের পাবে না । তার চেয়ে বরং উল্টোদিকে যাওয়া তাদের নিরাপদ । রাতের অন্ধকারে জমির আইল দিয়ে পুবালী ও কুহেলি ছুটছে । কোথায় যাচ্ছে নিজেরাই জানে না । শুধু তারা বড় রাস্তার অপেক্ষায় । বড় রাস্তা পেলে নিরাপদে কোথাও আশ্রয় নেওয়া যাবে । হঠাৎ পিস্তলের গুলির শব্দ । ঠিক তাদের কাছ থেকে । কুহেলির ধারণা, দুষ্কৃতিরা তাদের পিছু ধাওয়া করেছে । সামনেই একটা জলাশয় । জলাশয়ের কিনারে জাঁক দেওয়া পাট ছাড়ানোর পর শুকানোর জন্য পাটকাঠি দাঁড় করানো । গাঁয়ের মেয়ে কুহেলি । সে জানে, পাট ছাড়ানোর পর কীভাবে পাটকাঠি দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় । পাটকাঠি দাঁড় করালে মাঝখানটা ফাঁকা থাকে । তাই তারা সাতপাঁচ না ভেবে সোজা দাঁড় করানো পাটকাঠির মাঝখানে ঢুকে গেলো । সেখানে ঢুকে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো । অন্তত দুষ্কৃতিরা তাদের টিকিও ছুঁতে পারবে না । ভোর হলে এখান থেকে বের হবে ।
জলাশয়কে দীঘি বলা যেতে পারে । বিশাল বড় দীঘি । দীঘির কিনারে এখনও পাটের জাঁক রয়েছে । অন্ধকারে মাঠের ফসল বোঝা যাচ্ছে না । তবে এলাকাটা কৃষি এলাকা, জমি-জায়গা দেখে এটা বোঝা যায় । কুহেলি অন্তত নিশ্চিত, তাদের দুষ্কৃতিরা নাগাল পাবে না । পাটকাঠির ফাঁক দিয়ে দুজনে দেখলো, চার জন দুষ্কৃতি জলাশয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে ছুটছে । তাদের চোখ শ্যেন দৃষ্টির ন্যায় । চতুর্দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে । কুহেলি ও পুবালীকে হারিয়ে তারা এখন ওদের ধরার জন্য মরিয়া । কুহেলি দুষ্কৃতিদের হেঁটে যাওয়ার পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারলো, তারা পুলিশি অভিযানের ভয়ে একটুও ভীত নয় । যাই হোক চুপচাপ দুজন পাটকাঠির মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইলো । কোনোরকম শব্দ করার উপায় নেই । ফোন করা তো দূরের কথা । এখন তাদের মাথায় একটাই চিন্তা, ভোর হলেই এখান থেকে পালানো ।
কিছুটা গিয়ে দুষ্কৃতিরা দীঘির পাড়ে বসলো । বিড়ি খাচ্ছে ।
মহা ফাঁপড়ে পড়লো কুহেলি ও পুবালী । দুষ্কৃতিদের জন্য তারা টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না । নড়াচড়া করার উপায় নেই, অথচ পালাতে চাইলে হবে না । দুষ্কৃতিরা আর একবার ধরলে বাঁচার পথ বন্ধ । ভয়ে, আতঙ্কে পুবালী ও কুহেলির মুখ শুকিয়ে কাঠ । দুজনে ভীষণ বিপদ্‌গ্রস্ত । মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । তাদের দুর্গতির শেষ নেই । কীভাবে তারা নিজেদের বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরবে সেই টেনশনে তারা ঘামছে । চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ ! বাঁচার জন্য চোখ বুজে পুবালী ইষ্টনাম জপ শুরু করে দিলো । কুহেলি খুব সাহসী মেয়ে । সহজে কাহিল হওয়ার মেয়ে নয় । যে কোনো প্রতিকুল অবস্থার মোকাবিলা করতে কুহেলি সিদ্ধহস্ত । তাই সে একটুও না ঘাবড়িয়ে পুরো অবস্থাটার উপর নজর রাখছে ।
ধীরে ধীরে পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা প্রস্ফুটিত হচ্ছে । তাতেই কুহেলির ধারণা, কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশে সূর্যের উদয় ঘটবে । পরিষ্কার আকাশ । তাই কুহেলির আশা, দিনের ঝলমলে রৌদ্র ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল ।
(চলবে)

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস,দ্বাদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

“কি হলো নাতনী । আমার চা দাও !”
গুণধর দাদুর ডাকে কুহেলির হুঁশ ফিরলো । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে কুহেলি বলল, “দাদু“ চা আনছি ।“ তারপর মাটির দুটি চায়ের ভাঁড়ের মধ্যে একটি ভাঁড় গুণধর দাদুর দিকে এগিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলো, “আজ কী ধরনের বিস্কুট দেবো ?”
না নাতনী, আজ বিস্কুটের পরিবর্তে আমাকে একখানা পাউরুটি দাও । পাউরুটি দিয়ে চা খাবো ।
তারপর কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে গুণধর দাদু জিজ্ঞাসা করলো, “যুবক ছেলেটি কী তোমার পূর্ব-পরিচিত ?”
না দাদু । চা খেতে দোকানে ঢুকেছিলো ।
উহুঁ নাতনী । ছেলেটির সাথে নিশ্চয় তোমার কোনো সম্পর্ক আছে ! নতুবা তার জন্য তুমি অতোটা উতলা কেন ?
কোথায় উতলা হলাম !
নাতনী, আমি ঠিক বুঝতে পারি । ছেলেটির প্রতি তোমার টান দেখে আমি নিশ্চিত, যুবক ছেলেটি তোমার একান্ত আপনজন…… ?
কি যে বলো দাদু । সে নিছক একজন খরিদ্দার ।
খরিদ্দার হলে কী হবে ? ছেলেটিকে আমি চিনি । খুব ভাল ছেলে । সাহাপুর গ্রামের নীলকন্ঠের ছেলে । নীলকন্ঠের সাইকেল, ভ্যান-রিক্সা সারানোর দোকান । আমলাই বাজারে খুব চালু দোকান । নীলকন্ঠের গিন্নি ভ্যানে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে সব্জি বিক্রি করে । নীলকন্ঠের বৌটা একটু-আধটু লেখাপড়া জানে । দুজনের উপায়ে তাদের সুখী সংসার । কিন্তু নীলকন্ঠের একটাই ছেলে । ছেলেটি চাকরি না পাওয়ায় তাদের মন খারাপ । তারা চায় না, তাদের ছেলে সাইকেল সারানোর মতো ব্যবসায়ে নামুক । ছেলেটির পড়াশুনা খুব বেশী না । তবে চাকরির চেষ্টা অনেকদিন থেকে । তবে ছেলেটির পুলিশের চাকরির প্রতি বেশী ঝোঁক ! আজ সম্ভবত পুলিশের চাকরির পরীক্ষা দিতে কান্দি গেলো ।
দাদু, তুমি তো ছেলেটির হাঁড়ির খবর পর্যন্ত জানো । তবে ছেলেটির নাম কী ?
নামটা আমার মনে নেই । তবে ছেলেটি খাসা ! গাজা-মদ-বিড়ি-সিগারেট কিচ্ছু খায় না । গাঁয়ের মানুষ সকলেই তাকে ভালবাসে ।
তারপর কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “নাতনী এবার আমি চলি ।“
গুণধর দাদু চলে যাওয়ার পর দোকানে বেশ কয়েকজন খরিদ্দারের ভিড় । তাদের চা-জল খাবার দরকার । ব্যস্ত হয়ে পড়লো কুহেলি । কাজের ব্যতিব্যস্ততায় নিমেষের মধ্যে যুবক ছেলেটির কথা কুহেলির অন্তর থেকে আউট ! সেই মুহূর্তে খরিদ্দারদের চাহিদা মেটাতে কুহেলি হিমসিম । উনুন থেকে এক কড়াই ঘুগনি নামলো । ঘুগনি সুস্বাদু হওয়ার কারণে খরিদ্দাদের ভিড় । ঘুগনি উত্তম স্বাদযুক্ত বানানোর জন্য কুহেলির অনলস খাটুনি । ইদানীং ঘুগনিতে পনিরের ছোট ছোট টুকরো মেশায় । ঘরে তৈরী করা নিজের মশলাটা ব্যবহার করে । যার জন্য স্বাদ খুব ভাল হয় । চারজন টোটোওয়ালা অপেক্ষা করছে পাউরুটি ঘুগনি খাওয়ার জন্য । তাদের খাবার দিয়ে উনুনে চা বসালো । কুহেলির একটাই নীতি, সেটা হচ্ছে কখনই চা বানিয়ে চায়ের কেটলিতে রেখে পরের খরিদ্দারদের দেবে না । খরিদ্দারেরা যখন চাইবেন ঠিক সেই মুহূর্তে চা বানিয়ে খরিদ্দারদের পরিবেশন করবে । তাতে দু-কাপ হোক, বা চার কাপ হোক । খরিদ্দারদের প্রয়োজন মতো কুহেলি চা বানাতে অভ্যস্ত । তা ছাড়া চা তৈরীর রসায়ন কুহেলির একেবারে নিজস্ব । ফলে তার দোকানের চায়ের গুণগত মান তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট ভাল । এছাড়া এলাকার সকলেই জানে, খাবারের প্রতি কুহেলি যথেষ্ট যত্নশীল ।
**********************************
তারপর অনেকদিন কেটে গেলো । খরিদ্দারদের নিয়ে কুহেলির ব্যস্ততা বেড়েছে, তো কমেনি । সেদিন রবিবার । দুপুরে প্রয়োজন ছাড়া কুহেলি কখনই খাওয়ার জন্য বাড়ি ছোটে না । তবে তুলনামূলকভাবে দুপুরে খরিদ্দারের ভিড় কম । সেই সময় টোটোওয়ালা, অটোওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, ছোট ছোট দোকানদার দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে ছোটে । তাই দুপুরটাতে বেচাকেনা হাল্কা । দুপুরে মসুরির ডাল সেদ্ধ ও বাটা মাছের ঝাল বানিয়েছে । সাধারণত দুপুরে সেদ্ধ ভাত খেতে অভ্যস্ত কুহেলি । তবে মাছ না থাকলে ডিম সেদ্ধ অথবা অন্তত ডিমের ওমলেট থাকে । আজ নকুল কাকু লোকাল বাটা মাছ কেটে সুন্দরভাবে ড্রেসিং করে কুহেলিকে পৌঁছে দিয়ে বলে গেছেন, “মাছের ঝাল বানিয়ে খেতে ।“ কাঁচা হাতে মাছের ঝাল বানানো । তাই তার একরাশ চিন্তা, বাটা মাছের যে ঝালটা সে বানিয়েছে সেটা খেতে পারবে কিনা ? থালায় গরম ভাত ও মসুরির ডাল সেদ্ধ ও একটা বাটিতে মাছের ঝাল । তারপর খরিদ্দারদের জায়গায় থালা নিয়ে খেতে বসলো কুহেলি । খেতে বসে তাকিয়ে দেখে , খাওয়ার জল নিয়ে বসেনি । ইতিপূর্বে তার বাবা খাওয়ার সময় জলের গ্লাস দেখতে না পেলে, তিনিই ছুটে জল নিয়ে বসতেন । তাঁর একটা কথা আজও কুহেলির কানে বাজে, “খাওয়ার সময় অবশ্যই জল নিয়ে বসা চাই । নতুবা কোনো কারণে খাবার গলায় আটকে গেলে সেক্ষেত্রে জল না খেলে বিপদের আশঙ্কা !” তাই খাওয়ার সময় কুহেলি জলের গ্লাস বা জলের বোতল পাশে রাখবেই । আজও তার ব্যতিক্রম হলো না । খাওয়ার জলের বোতল সঙ্গে নিয়ে খেতে বসলো ।
ডাল সেদ্ধ দিয়ে খাওয়ার পর বাটা মাছের ঝাল কেবলমাত্র মুখে দিয়েছে, ঠিক সেই সময় সাহাপুরের সেই যুবক ছেলেটি কুহেলির চায়ের দোকানে উপস্থিত । তারপর একগাল হাসি দিয়ে কুহেলির উদ্দেশে বলল, “সেইদিনের অর্ডারের চায়ের দাম মেটাতে এলাম ।“ আপনি খেয়ে নিন, তারপর কথা হবে ।
দোকানের চেয়ারের দিকে ইশারা করে কুহেলি বলল, আপনি একটু বসুন প্লীজ । খাওয়ার পরে আপনার সঙ্গে কথা বলছি ।
যুবক ছেলেটি চুপ থাকার পাত্র নয় । কুহেলির সাথে অনর্গল অযথা বকবক করতে শুরু করলো ।
প্রথমেই জিজ্ঞাসা, “বাড়ি থেকে কী রোজ খাবার দিয়ে যায়, নাকি আপনি বাড়ি না যেতে পারলে খাবার আসে ?” প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রশ্ন, “কাঞ্চন নগরের মোড় থেকে আপনার বাড়ি কতোদূর ?”
কুহেলি নীরব ! মনে মনে ভাবছে, কলির কেষ্ট এসেছেন । কুহেলি সম্বন্ধে তার কৌতুহলের শেষ নেই । অথচ এখনও তার নাম অজানা ।
হাত মুখ ধুয়ে আর একটা চেয়ার নিয়ে কুহেলি বসলো ।
“আপনার শুভ নামটাই জানা হলো না ?”
যুবক ছেলেটি তখন হাসিমুখে বলল,”আমি জগন্নাথ, তবে গ্রামে বেশীর ভাগ মানুষ জগা নামে ডাকে ।“
আমি আপনাকে জগাদা বলে ডাকবো ।
আমার জগা নামে ডাকটা ভাল লাগে ।
অপরিচিত মানুষের মুখে জগা নামটা শুনতে কী আপনার ভাল লাগবে ?
আপনি অপরিচিত কেন বলছেন ? সেদিন আপনার দোকান ঘুরে গেলাম । ভাবলাম, দুপুরে দোকানে খরিদ্দার কম থাকবে । তাই এই সময়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসা । আর তা ছাড়া …………
আর তা ছাড়া কী ?
তা ছাড়া সেদিন বলে গিয়েছিলাম, “পরে আপনার দোকানে আসবো ।“
সব ঠিক আছে, কিন্তু জগা নামে ডাকাটা আমার স্মরণে লাগছে !
কী আশ্চর্য ! আমি আপনাকে ডাকার জন্য অনুরোধ করেছি ।
তবুও আমি জানিয়ে রাখছি, আমি আপনাকে জগাদা বলে ডাকবো ।
তারপর একটু হেসে কুহেলি জিজ্ঞাসা করলো, “এবার বলুন, সেদিনের ইন্টারভিউ কেমন হলো ?
সেদিন ছিল আমার শারীরিক মাপজোক । স্বাস্থ্য বিষয়ক কথাবার্তা । রাজ্য সরকারের পুলিশের কন্সটেবলের চাকরি । আগের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর মাপজোকে ডেকেছিল । সেদিনের মাপজোকের পরীক্ষা দিয়ে আমি খুশী । সুতরাং পুলিশের চাকরিটা হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল । জানি না, শেষ পর্যন্ত কী হবে ?
আমার বিশ্বাস, পুলিশের চাকরিটা আপনি পাবেন । এবার বলুন, কী খাবেন ?
আপনার হাতে তৈরী চা খাবো । সেদিন চা খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি । আজ চা খাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছি না ।
আপনি বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি ।
এত ব্যস্ত হবেন না । খরিদ্দার এলে তাদের সাথে আমাকেও বানিয়ে দেবেন । বরং ফুরসত পেয়েছেন, একটু জিরিয়ে নিন ।
আপনি যথেষ্ট মানবিক !
মানবিকতা আমার জীবনের বড় গুণ । কিন্তু জীবনের অন্যান্য দিকগুলির দিকে তাকালে এবং নম্বর দিতে চাইলে, সেখানে নির্ঘাত জিরো দেবেন ।
কেন নিজেকে ছোট ভাবছেন ?
কোনো কাজ করি না । বাপের হোটেলে খাই-দাই, ঘুরে বেড়াই । শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাড়াতে পারিনি । এইজন্য বাপের বকুনি অহরহ । সুতরাং আমি একটা অকর্মার ঢেঁকি ।
দুইজন টোটোওয়ালা ঢুকে বলল, “আদা দিয়ে ভাল করে দুটো চা বানাও দিদি ।“
তিন কাপ চা বানালো কুহেলি । মাটির ভাঁড়ে পরিবেশন করলো । আলাদা প্লেটে জগন্নাথকে দু-রকম বিস্কুট দিলো । টোটোওয়ালা চায়ে চুমুক দিয়ে স্বতোস্ফূর্তভাবে বলল, “আজকের চা অন্যান্যদিনের চেয়ে অনেক বেশী সুস্বাদু । বরং বলা ভাল আজকের চা, স্পেশাল চায়ের চেয়েও অনেক উন্নত ।“
টোটোওয়ালার কথা শুনে জগন্নাথ মুচকী মুচকী হাসছে । তারপর কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদা একদম ঠিক বলেছেন । আজকের চা অতি মধুর ।“
“থাক জগাদা ! লোকের কথা শুনে আপনাকে সুমিষ্ট মন্তব্য করতে হবে না ।“ বলেই আড়চোখে জগন্নাথের দিকে তাকালো কুহেলি ।
এমন সময় জগন্নাথের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো ।
“হ্যালো বাবা । হঠাৎ ফোন !”
এইমাত্র পোস্টম্যান এসেছিলেন । পুলিশের চাকরির এ্যাপোন্টমেন্ট লেটার দিয়ে গেলেন । তোকে সত্বর পুলিশের চাকরিতে জয়েন করতে হবে ।
বাবা, পোস্টিং কোথায় দিলো ?
এই মুহূর্তে ভরতপুর থানায় রিপোর্ট করতে বলেছে ।
“ঠিক আছে বাবা । আমি একটু পরে বাড়ি ফিরছি ।“ বলেই লাইন কেটে দিলো জগন্নাথ । কুহেলি লক্ষ করলো, চাকরির খবর পেয়ে জগন্নাথের শারীরিক ভাষা পুরোপুরি পাল্টে গেলো । খুশীতে টগবগ । তবুও নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক ছন্দে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “পুলিশের চাকরিটা আমার হয়ে গেছে ।“
হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে কুহেলি উত্তরে বলল, “অভিনন্দন !”
“অসংখ্য ধন্যবাদ ।“ খুশীর মেজাজে জগন্নাথ তখন উৎফুল্ল ।
জগাদা, একটা কথা বলবো ।
“কী ?” জানতে চাইলো জগন্নাথ ।
এবার আপনি কী আমাদের ভুলে যাবেন ? যদিও আমার সঙ্গে আপনার আলাপ স্বল্পদিনের ।
স্বল্পদিনের হলেও ……… । যাকগে সেকথা ।
থামলেন কেন জগাদা । কীযেন বলতে চেয়েছিলেন । “স্বল্পদিনের হলেও” বলতে গিয়ে থেমে গেলেন ।
আজ আমি উঠবো কুহেলি ম্যাডাম !
উহুঁ ! কুহেলি ম্যাডাম নয় । এখন থেকে শুধু কুহেলি ।
তবে আপনাকেও জগা নামে ডাকতে হবে, এমনকি “তুমি” সম্বোধনও ।
“ধীরে বৎস ! ধীরে ।“ ঠিক সেই সময় লোহাদহ ঘাট যাওয়ার প্যাসেঞ্জার ভর্তি বাস এসে থামলো । ঠাসা ভিড় । বাস থেকে অনেক প্যাসেঞ্জার নামলেন । এক ঝাক প্যাসেঞ্জার কুহেলির দোকানে হাজির । তাদের বক্তব্য, “বাসটি দেরী করার জন্য তাদের প্রচণ্ড খিদে । ঘুগনী সহযোগে পাউরুটি ও ডিম-টোস্ট চাই ।“
কুহেলি পড়লো মহা সমস্যায় । তাই মুখ ফুটে বলে ফেলল, এতগুলি লোকের পাউরুটি টোস্ট বানাতে একটু সময় লাগবে । একার হাতে আমাকে সব তৈরী করতে হবে । আপনারা ধৈর্য ধরে বসুন প্লিজ !
আপনি ধীরেসুস্থে করুন । আমাদের তাড়া নেই । প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে থেকে অল্প বয়সী মহিলা জগন্নাথের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “আপনার স্বামীকে হাত লাগাতে বলুন । তাহলে আরও তাড়াতাড়ি হবে ।“
একটু হেসে কুহেলি উত্তর দিলো, “উনি আমার স্বামী নন । বরং বন্ধু বলতে পারেন ।“
মহিলা আবার কীযেনো বলতে যাচ্ছিলেন । তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জগন্নাথ কুহেলিকে বলল, “উনি যথার্থ বলেছেন ।“
কোনটা যথার্থ বলেছেন — স্বামী, না অন্য কিছু ?
আহম্মকের পাল্লায় পড়া গেলো ! আমি বলতে চাইছি, আমি আপনার কাজে হাত লাগাতে চাই ।
“সরকারি পুলিশকে দিয়ে আমি কোনো কাজ করাতে পারবো না । তাতে খরিদ্দার বিরাগভাজন হলেও আমার তাতে দুঃখ নেই । দেখা যাবে, আপনি একদিন অজানা অজুহাতে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে ছাড়বেন !
কুহেলির হাত থেকে একরকম ছিনিয়ে নিয়ে জগন্নাথ পাউরুটি সেঁকতে শুরু করলো । অন্যদিকে কুহেলি ডিম ফাটিয়ে ঐ টোস্ট বানাতে লাগলো । নিমেষের মধ্যে খাবার রেডি করে খরিদ্দারদের খাবার পরিবেশন করলো কুহেলি । কাজের ফাঁকে ফাঁকে জগন্নাথের কর্মকাণ্ড লক্ষ করে কুহেলি বুঝতে পারলো, জগন্নাথ সত্যিই আন্তরিক ও মানবিক । কাজের প্রতি এতটাই নিষ্ঠা, যার জন্য কুহেলির দিকে ঘুরে তাকাবার ফুরসত নেই । জগন্নাথকে নিয়ে গুণধর দাদুর বর্ণনা একদম সঠিক । জগন্নাথের এইসব কর্মকাণ্ড দেখে একটু হলেও কুহেলির মন জগন্নাথের প্রতি দুর্বল হয়ে উঠলো ।
দিদি, আমাকে একটু ঘুগনি দেবেন !
খরিদ্দারের ডাক শোনামাত্র কুহেলির মন থেকে জগন্নাথের চিন্তা উধাও । পুনরায় দোকানের খরিদ্দারকে পরিষেবা দিতে তৎপর হয়ে উঠলো ।
তারপর ভরতপুর থানায় যোগ দেওয়ার দিন খুব সকালে কুহেলির সঙ্গে দেখা করে গেলো জগন্নাথ । সেদিন জগন্নাথের সাথে কুহেলি কোনো কথা বলতে পারেনি । তার চোখ ছিল ছলছল । শুধু অস্ফূট স্বরে বলেছিল, “ভাল থেকো ।“ জগন্নাথও তদ্রূপ । চুপচাপ বসেছিল । দোকান ভর্তি লোকের মধ্যে উঠে যাওয়ার সময় কুহেলির খুব কাছে গিয়ে জগন্নাথ বলল, “তোমাকে আমার সর্বক্ষণ মনে থাকবে ।“
***********************************
কুহেলি টাকা জমানোর দিকে জোর দিলো । তার ইচ্ছা, আধুনিক স্টাইলে রেস্টুরেন্ট খোলা । তার জন্য পর্যাপ্ত পুঁজি দরকার । দোকান ঘর সাজাতে হবে । দরকার হলে উপরে ঘর বানাতে হবে । খরিদ্দারদের বসার জন্য চেয়ার-টেবিল যথেষ্ট সংখ্যায় দরকার ! তার উপর লাইট-ফ্যান । সোজা কথা আধুনিক স্টাইলে দোকানের সৌন্দর্য বাড়াতে হবে । রেস্টুরেন্টে কলেজের ছেলে-মেয়ে সহ সব ধরনের খরিদ্দারদের আগমন ঘটবে । তা ছাড়া দোকানে তখন কর্মচারী রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে । সুতরাং অনেক চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন । সর্বোপরি পুঁজির দরকার ।
মাঝখানে কানাই কাকাকে তার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলো কুহেলি । কানাই কাকা পরিষ্কার বলে দিয়েছে, “দোকান উন্নয়নের ব্যাপারে তোমার পুরো স্বাধীনতা রয়েছে । সুতরাং তুমি তোমার ইচ্ছামতো দোকান ঘর সাজিয়ে যাও, আমি তোমার পাশে আছি । আমি চাই, তোমার ব্যবসা বাড়ুক ।“
কুহেলি এখন বড় ব্যবসায়ী । গাঁয়ে-গঞ্জে কুহেলিকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা, “অভিভাবকহীন একটা বয়স্তা মেয়ে গায়ে-গতরে খেটে যেভাবে দোকানটাকে দাঁড় করালো, সেটা অবর্ণনীয় । তার সমবয়সী অনেক ছেলেরা এইভাবে দোকান দাঁড় করাতে পারবে না । অন্যান্য মেয়েদের কথা ছেড়েই দিলাম । তার উপর মেয়েটা দুর্ধর্ষ সাহসী । এমন সাহসী মেয়ে দ্বিটীয়টি খুঁজে পাওয়া কঠিন !” কাঞ্চন নগর গাঁয়ের বুড়ো মানুষেরা রোজ বিকেলে কুহেলির দোকানে ভিড় করছেন । তাঁদের অনুরোধে কুহেলি বিকেলে অল্প সংখ্যায় সিঙ্গারা ভাজে । সিঙ্গারা বানানোর পদ্ধতি কুহেলি আগেই শিখেছিলো । কেননা প্রথমদিকে সে চেয়েছিলো, সিঙ্গারার দোকান দিতে । তাই কুহেলির সিঙ্গারা বানানোর প্রণালী শেখা । যার জন্য কুহেলি জানে মশলার পরিমান, কতোটা আলু, কতোটা ময়দা, কাঁচা লঙ্কা, সাদা তেল, খাবার সোডা, হলুদ, মৌরি, বাদাম ভাজা, পেয়াজ কুচানো, শুকনো লঙ্কা, আদা-রসুন, গরম মসলা, ধনে পাতা, ইত্যাদি উপকরণ সিঙ্গারা তৈরীতে লাগে । বিকেলের সিঙ্গারা ভাজা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে । আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাইকেলে এসে কুহেলির দোকান থেকে সিঙ্গারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে । দোকানের বিক্রিবাট্টা দেখে প্রতিবেশী দোকানদারদের কুহেলির প্রতি বাঁকা চাহনী । অথচ অন্যদিকে কুহেলির জনপ্রিয়তা দেখে কাঞ্চন নগর গ্রামের স্মৃতির বাবা বললেন, “তুমি এলাকার ছেলেমেয়ের কাছে উৎকৃষ্ট উদাহরণ । তোমাকে দেখে তাদের শেখা উচিত ‘কঠোর পরিশ্রম কাকে বলে এবং কঠোর পরিশ্রম করলে আর্থিক উপার্জন অনায়াসেই সম্ভব ।“
তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেলো ।
জগন্নাথ এখন ভরতপুর থানার পুলিশ । বাড়ি থেকেই মোটর বাইকে যাতায়াত । কুহেলির দোকানে বসে চা খাওয়ার সময় নেই । মাঝে মধ্যে যাওয়া-আসার পথে কাঞ্চন নগরের মোড়ে এসে দূর থেকে হাত তুলে ‘টা-টা’ দিয়ে গন্তব্যস্থলে চলে যায় । জগন্নাথের ব্যস্ততা দেখে কুহেলি হাসে ও ভাবে, “বাবু এখন থানার বড় পুলিশ । দায়িত্ব অনেক । তাই তার অফিসে যাওয়ার ভীষণ তাড়া !”
কুহেলি এখনও রেস্টুরেন্ট খোলার প্রয়োজনীয় পুঁজি সংগ্রহ করতে পারলো না । তবে দোকান ঘরটায় হাত দিয়েছে । ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে । প্লাস্টারের কাজ চলছে । সামনে বর্ষাকাল । আষাঢ় মাসের শেষ দিক । ভারী বর্ষণ শুরু হয়নি । জমিতে এখন পাট চাষ । পাট কেটে সেই জমিতে ধান রোয়ার চাষ শুরু হবে । চারিদিকে পাট ক্ষেত । বড় বড় পাট । কিছুদিনের মধ্যেই পাট কেটে পচানোর কাজ চলবে ।
অন্যদিকে পাট বড় হলেই কুহেলির চিন্তা বাড়ে । এই সময় গ্রামের মেয়েদের জীবনে অনেক অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটে । কিছু সুযোগ সন্ধানী পুরুষ লোলুপ দৃষ্টিতে বয়স্থা মেয়েদের দিকে বিশ্রিভাবে তাকায় । তারা ছোট-বড় মানে না, মেয়ে দেখলেই তাকে তুলে নিয়ে পাটের জমিতে ঢুকিয়ে অশালীন ব্যবহার করার নোংরা প্রয়াস ! দুরভিসন্ধি নোংরা মানুষের হাত থেকে গৃহস্থ বাড়ির বৌ-ঝি’রাও ছাড়া পান না । তার উপর রয়েছে পাচারকারীর চক্র ! নারী পাচারকারী চক্র এই সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে । তারা বিভিন্ন জায়গায় ওত পেতে থাকে । স্থানীয় প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে রাতের অন্ধকারে মেয়েদের তুলে নিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে ভিন রাজ্যে পাচার করে দেয় । সেইজন্য আষাঢ়ের শেষে বা শ্রাবণের গোড়ায় জমিতে পাট না-কাটা পর্যন্ত কুহেলির দুশ্চিন্তা ! ভয়ে ভয়ে বাড়িতে যাতায়াত । রাতের বেলায় কাঞ্চন নগরের মানুষের সাথে বাড়ি ফেরে । কাউকে না পেলে, কানাই কাকাকে ডেকে আনে এবং তারপর কাকার সাথে বাড়ি ফেরে । বাড়ি ফেরার সময় লোক নির্বাচন ঠিক না হলে, সেই লোকের হাতে হেনস্থা হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল । অতীতে অনেক অঘটন ঘটেছে । যদিও কুহেলি এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন কোনোদিন হয়নি । তবে মেয়েদের নিয়ে এই ধরনের আপত্তিজনক ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ।
সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি ! আকাশ মেঘাচ্ছন্ন । বিকেলে খরিদ্দার কম । আকাশের অবস্থা ভাল না থাকায় কুহেলি বিকেলে সিঙ্গারা ভাজেনি । যদিও সিঙ্গারার দুজন খরিদ্দার ঘুরে গেলেন । সন্ধ্যা নেমে এলো । বৃষ্টি কিছুটা থেমেছে । তবে রাস্তা-ঘাটে বৃষ্টির জমা জল । রাস্তা কাদায় ভর্তি । বাসে প্যাসেঞ্জার কুব কম । দোকানে কয়েকজন বসে চা খাচ্ছেন । সন্ধ্যা শেষ হতে না হতেই, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার । রাত্রি বাড়ছে । দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে চায় কুহেলি । খরিদ্দার নেই । দোকানে শুধুমাত্র ভ্যান রিক্সাওয়ালা মন্টু বসে চা খাচ্ছে । তখন লোডশেডিং । দোকানে বড় বড় দুটি মোমবাতি জ্বালানো । মন্টু কুহেলিকে বলল, “আজ চারিদিকে খুব অন্ধকার । সম্ভবত অমাবস্যা কাছে ! রাস্তায় লোকজন কম । পরের বাসটা দেখে আমি বাড়ি চলে যাবো । শেষ বাসের অপেক্ষায় থাকবো না ।“
“আমিও দোকান বন্ধ করবো মন্টুদা । খরিদ্দারের আনাগোনা খুব কম ।“
ঠিক সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে কাঞ্চন নগরের পুবালী দোকানে ঢুকেই কুহেলকে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে বাড়ি ফিরবো । আমার খুব বিপদ ! অজানা কিছু দুষ্কৃতী আমার পিছু নিয়েছে । সংখ্যায় তারা তিনজন । আবছা আলোয় একজনের মুখে কালো দাড়ি দেখলাম । তাদের উদ্দেশ্য খারাপ । বিশ্রি ভাষায় আমাকে শাসাচ্ছিলো । অন্ধকারে দুষ্কৃতীদের চেহারা বোঝা গেলো না । দুষ্কৃতকারীরা বাইরে থেকে আমাদের এলাকায় ঢুকেছে । মেয়েদের সর্বনাশ করা তাদের টার্গেট ! পেছনে তাড়া করার জন্য খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে তোমার দোকানে । অল্পের জন্য আজ রক্ষা পেলাম । এবার তোমার সঙ্গে বাড়ি ফিরবো ।“
পুবালীর কথা শেষ হতে না হতেই সেই মুহূর্তে ঐ তিনজন দুষ্কৃতি কুহেলির দোকানে হাজির । কুহেলির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে । মুখে বিশ্রি গন্ধ । দুষ্কৃতি তিনজন দোকানে ঢোকামাত্র, কুহেলি মোবাইলে জগন্নাথকে দুষ্কৃতদাকারীর অসৎ উদ্দেশের কথা মেসেজ করে দিলো ।
“এই বেটি, দোকানের মালিক কে ? আমরা চা খাবো ।“ আধা আধা হিন্দি ও বাংলা মিশিয়ে চায়ের অর্ডার । অন্যদিকে ঐতিনজন দুষ্কৃতিকে দেখতে পেয়ে পুবালী পেছন দিয়ে পাশের মিষ্টির দোকানে পালালো । মন্টু তখনও চা খাচ্ছে । দোকানে মন্টু থাকায় কুহেলির একটু ভরসা !
তিনটি চা বানিয়ে তাদের সামনে ধরে কুহেলি বলল, “আপনারা কোথা থেকে এসেছেন ?”
দাড়িওয়ালা পরিষ্কার বাংলায় বলল, “তারা সালার থেকে এসেছে । একজন আত্মীয়কে তারা খুঁজছে ।“ তারপর নিজেদের মধ্যে মৃদু স্বরে বলাবলি, চায়ের দোকানের মেয়েটি খুব খাসা ! তারপর অন্য একজন দুষ্কৃতি মন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, দোকানে কী কেউ একটু আগে ঢুকেছিলো ?”
চোখের ইশারায় কুহেলি মন্টুদাকে কিছু বলতে “না” করে দিলো । তাই রিক্সা ভ্যানওয়ালা মন্টুদা বোবা মানুষের অভিনয় করে হাতের ইশারায় দুষ্কৃতিদের কথার উত্তর দিলো, “সে দোকানে কাউকে দেখেনি ।“ মোবাইলের এস-এম-এসের আওয়াজে মোবাইলে তাকিয়ে দেখে জগন্নাথ বাইক নিয়ে তার দোকানে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছাচ্ছে । নিশ্চিন্ত হলো কুহেলি । তাই হাল্কা কথাবার্তার মধ্যে দুষ্কৃতিদের আটকে রাখলো কুহেলি ।
এই মুহূর্তে জগন্নাথ একমাত্র কুহেলির কাছের মানুষ । শীতল অনেকদিন আগেই সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে । শীতল অজুহাত দেখিয়েছিল, তাদের বাড়িতে কুহেলিকে মেনে নিচ্ছে না । কেননা তারা নীচু বংশের । তবুও কুহেলি উপযাজক হয়ে শীতলকে চেপে ধরে বলেছিলো, “ভালবাসা জাতপাত দেখে হয় না । তুমি আমাকে ভালবাসো, এটাই সত্যি । সুতরাং আমাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে তোমার কী মত ?” নির্লজ্জের মতো উত্তরে শীতল বলেছিল, “যেখানে বাবা-মায়ের মত নেই, সেখানে আমাদের সম্পর্ক স্থায়ী করতে অপারগ ।“ পরে কুহেলি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিল, “শীতল কলকাতার অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে অনেক আগেই জড়িয়ে পড়েছে । তাকেই জীবনসঙ্গিনী হিসাবে বেছে নিয়েছে শীতল ।“ তারপর থেকে শীতলের সঙ্গে কুহেলির সম্পর্ক শেষ । এমনকি শীতলের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ !
হঠাৎ দোকানের সামনে বোলারো চার চাকার গাড়ি !
কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাদা রুমালে কেমিক্যাল মিশিয়ে কুহেলিকে বেহুঁশ করে গাড়িতে তুললো । সেই অপহরণের দৃশ্য দেখার জন্য বাইরে উঁকি দিতেই দুষ্কৃতিদের চোখে পড়লো পুবালী । তাকেও গাড়িতে তুললো । নিমেষের মধ্যে বোলারো গাড়ি সোজা লোহাদহ ঘাট । সেখানে ডিজেল ইঞ্জিনে চলা খেয়া নৌকা রেডি । আরও একজন ষণ্ডামার্কা দুষ্কৃতি খেয়া ঘাটে অপেক্ষারতো । পরিকল্পনামাফিক তাদের ছক । বোলারো গাড়ি সমেত খেয়া নৌকায় পার হয়ে বাজারসৌ এলাকাকে পেছনে রেখে গাড়ি ছুটলো বহরমপুরের দিকে । কলকাতার দিকে ঝুঁকি নিলো না । বহরমপুর শহরে না ঢুকে তারা ছুটলো শিলিগুড়ির বাগডোগরা বিমান বন্দরের দিকে । সেখানে জলপাইগুড়ির জঙ্গল থেকে অপহরণ করা চারজন মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের আর একটি দল । ভোরের ফ্লাইটে দিল্লি যাওয়ার কথা ! কুহেলি ও পুবালীকে নিয়ে আগন্তুকদের গাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটছে ।
(চলবে)

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, একাদশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

কুহেলির ভীতি তখনও কাটেনি । সারা শরীরে আতঙ্কের ছাপ । গত রাত্রের ঘটনা কুহেলিকে ভাবিয়ে তুলেছে । দৈনন্দিন জীবনে সাধারণত তার একটাই সমস্যা, এলাকার উটকো ও উঠতি ছেলেপুলে নিয়ে । কেননা যুবতী কুহেলির শারীরিক সৌন্দর্য সকলের নজরকাড়া । গাঁয়ে গঞ্জের ছেলেপুলে ছাড়াও তার দোকানের খরিদ্দারদের মধ্যেও অনেকের কুহেলির প্রতি অতিরিক্ত টান । সেটা সামলাতে কুহেলিকে হিমসিম অবস্থা । তার উপর জুটলো নারী পাচারকারীদের কুৎসিত চক্রান্ত । কানাঘুঁষায় কুহেলি যতোটুকু বুঝেছে, তাকে বিদেশে চালান করে দিতে পারলে অনেক টাকার লেনদেন ! যার জন্য নারী পাচারকারীদের কুহেলি এখন টার্গেট । পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতায় এযাত্রায় নিস্তার পেলো বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে এ্যালার্ট না থাকলে যে কোনো সময়ে বিপদ অনিবার্য ।
“চিনি ছাড়া দুটো চা । সঙ্গে প্যাটিস বিস্কুট ?” কাঞ্চন নগরের সতীশ কাকা কুহেলিকে বললেন । সতীশ কাকার সঙ্গে কাকীমা রয়েছেন ।
“এত সকালে কোথায় চললেন সতীশ কাকা ?” কুহেলি কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলো ?
“আর বলো না । তোমার কাকীমার তিনদিন যাবৎ জ্বর । কিছুতেই কমছে না । গত রাত্রে তীব্র আকার ধারন করেছিল । জলপট্টি দিয়ে কোনোরকমে সামাল দিয়েছি । এখন চললাম ভরতপুরের কল্যাণ ডাক্তারবাবুর কাছে । বাস আসতে দেরী, সুতরাং তোমার দোকানে বসে চা খাওয়া যাক ।“ কুহেলির দিকে তাকিয়ে আবার সতীশ কাকা জিজ্ঞাসা করলেন, “শুনলাম, তোমাকে নাকি নারী পাচারকারীরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো ? এটা কী সত্যি ?”
“পাচারকারীরা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো” এই খবরটা আপনাকে কে জানালো কাকা ?
“গাঁয়ে এটা নিয়ে যত্রতত্র আলোচনা চলছে । সেখান থেকে শোনা । আমি অবশ্য কথাটা বিশ্বাস করিনি । তোমার কাছে আসল ঘটনা শোনার জন্য উদগ্রীব !” সতীশ কাকা উত্তর শোনার জন্য কুহেলির দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
“নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছিলাম, এটা ঠিক । কিন্তু পুলিশের সক্রিয় তৎপরতার জন্য বেঁচে গেছি । নারীপাচারকারীরা অবশেষে তুলে নিয়ে পালাতে পারেনি ।“
“বাস এসে গেছে । আমরা চললাম ।“ বলেই সতীশ কাকা ও কাকীমা বাসে উঠে পড়লেন ।
কুহেলি বুঝতে পারলো, তাকে নিয়ে গাঁয়ের মানুষের মধ্যে ভুল খবর রটেছে যেটা কাম্য নয় । তা ছাড়া কিছু মানুষ তিলকে তাল করছেন । তাই কুহেলি ঠিক করলো সন্ধ্যাবেলা কানাই কাকাকে বলবে সঠিক খবরটা গাঁয়ের মানুষদের বলতে । যাতে মানুষ আর ভুল খবর রটাতে না পারেন ! সেই মতো কানাই কাকা গাঁয়ের মানুষদের ঘটনাটা বোঝালো এবং গাঁয়ের মানুষ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সকলেই কুহেলির পাশে দাঁড়ালেন । কুহেলিকে অভয় দিয়ে গ্রামবাসীরা জানিয়ে দিলেন, “যেকোনো সমস্যায় গ্রামবাসীরা তার পাশে আছে ।“
গ্রামবাসীদের স্বতস্ফূর্ত সাড়া পেয়ে কুহেলির চোখে জল এসে গেলো । দুর্দিনে গ্রামবাসীরা তার পাশে আছেন এটা জেনে আবেগে কুহেলির চোখে জল । হাত জোড় করা অবস্থায় কুহেলি গ্রামবাসীদের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো । মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না । শুধুমাত্র চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো মাটিতে ।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো ।
কুহেলি দোকান নিয়ে ব্যস্ত ।
এদিকে সরকারি তৎপরতায় কাঞ্চন নগরের মোড়ের রাস্তা প্রশস্ত করার কাজ শুরু হলো । একই সাথে ভরতপুর যাওয়ার রাস্তা বাড়ানোর কাজ শুরু হলো যাতে রাস্তা দিয়ে অন্তত তিনটি গাড়ি একসঙ্গে চলতে পারে অর্থাৎ আপে দুটি ও ডাউনে একটি কিংবা আপে একটি ও ডাউনে দুটি বাস বা গাড়ি অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে । বলা চলে একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ !
কাঞ্চন নগরের মোড়ের রাস্তা বড় হলেও, সমস্ত দোকানদারদের দোকান ঘর যার যার জায়গায় রইলো । যদিও তাদের দোকান সরাতে হলো । দোকান সরাতে গিয়ে লাভ হলো কুহেলির । এই সুযোগে রাস্তার পাশে তার দোকান ঘর আরও বাড়াতে পারলো । ফলে অনেকটা জায়গা জুড়ে তার দোকান ঘর । দোকানের মধ্যে একদিকে খরিদ্দারদের বসার জায়গা ও অন্যদিকে দোকানের সাজ-সরঞ্জাম । সুযোগ পেয়ে কুহেলি পুরো জায়গাটা জুড়ে মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘর বানালো । ভবিষ্যতে আর্থিক সুযোগ ঘটলে দোকান ঘর পাকা করার চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেলো । আপাতত মুলি বাঁশের বেড়া ও উপরে টিনের চালা ।
রাস্তা বড় করার জন্য কুহেলির আরও একটা সুবিধা । সেটা হচ্ছে, কুহেলির দোকান ঘরটি ঠিক বাস স্ট্যান্ডের প্যাসেঞ্জারদের বসার ঘরের পাশে । বসার ঘরটি আধুনিকভাবে স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে তৈরী করা । ফলে বাস স্ট্যান্ড দিয়ে যাতায়াত করা সমস্ত প্যাসেঞ্জারের দৃষ্টি কুহেলির দোকানে পড়বেই । সুতরাং তার দোকানে খরিদ্দার বাড়বে বই কমবে না ।
মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে দোকান ঘর বানাতে গিয়ে কিছুটা ধার করতে হলো কুহেলিকে । তবে দোকানের বেচা-কেনা লক্ষ করে তার বিশ্বাস, অচিরেই কুহেলি ধার শোধ করতে পারবে ।
ক্রমশ কাঞ্চন নগর মোড়ের বাস স্ট্যান্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠছে । লোকজনের যাতায়াত বাড়ছে । অনেক দোকান হওয়ার কারণে স্থানীয় মানুষের আনাগোনা বেড়েছে । সবজির দোকান, মাছ-মাংসের দোকান কাঞ্চন নগরের মোড় জুড়ে বসছে । বিশেষ করে সবজিওয়ালা রাস্তার পাশে চার কোনায় চারটি বাঁশ পুঁতে মাথার উপরে পলিথিন টাঙিয়ে সবজি নিয়ে রোজ বসছে । মাছের ব্যবসায়ীরাও তদ্রূপ, মাথার উপর শেড দিয়ে মাছ বিক্রি করছে । ফলে কাঞ্চন নগরের মোড় এখন জমজমাট !
কুহেলির দোকান আরও সাজালো । এখন তার দোকানে চা ছাড়াও রুটি-ঘুগনি পাওয়া যাচ্ছে । এছাড়া রয়েছে পাকা কলা ও পাউরুটি । অনেক সবজিওয়ালা কিংবা মাছওয়ালা পাউরুটি ও কলা খেতে অভ্যস্ত । তাই সবরকম ব্যবস্থাপনা । কুহেলির দোকানের খাবারের গুণগত মান উন্নত থাকার কারণে খরিদ্দারের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে । বলা চলে খরিদ্দারদের ভিড় চোখে পড়ার মতো । সমস্ত খরিদ্দারদের আবদার হাসমুখে সামলায় কুহেলি । কুহেলির চরিত্রের এটা একটা বড় গুণ, হাসি মুখে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার । ইতিমধ্যে, কুহেলির খরিদ্দারদের দাদা, কাকা, জ্যাঠা, পাতানো হয়ে গেছে । লোহাদহের গুণধর বাড়ুই টোটো চালান । বয়স সত্তরের আশ-পাশ । ছেলে-বৌমা তাঁকে দেখ-ভাল না করার জন্য তিনি নিত্য টোটো চালান । সারাদিনে যেটুকু আয়, তাতেই তাঁর ডাল-ভাত জুটে যায় । সেই গুণধর টোটোওয়ালা কুহেলিকে নাতনি সম্বোধনে ডাকেন । ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলেই টোটো নিয়ে সোজা কাঞ্চন নগরের মোড় । কাঞ্চন নগরের মোড়ের মাছের ব্যবসায়ী লোহাদহের সুখকরকে টোটো থেকে নামিয়ে গামছায় কপালের ঘাম মুছতে মুছতে কুহেলির দোকানে ঢুকে প্রথমেই তাঁর ডাক, “নাতনী, বড্ড খিদে পেয়েছে । আমাকে চা-পাউরুটি দাও !” ঐ ডাক শুনে কুহেলি হন্তদন্ত হয়ে পাউরুটি সেঁকে একটা প্লেটে সাজিয়ে গুণধর দাদুর সামনে ধরে বলবে, “পাউরুটি রেডি । চায়ের সাথে ভিজিয়ে খাও ।“ যদি তরকারি বা ঘুগনি তৈরী হয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে দাদুকে তরকারির সাথে পাউরুটি পরিবেশন এবং তারপর একগাল হাসি । ঐ হাসি দেখে মাঝে মাঝে দাদুকে বলতে শোনা যায়, “লোকে ঔষধ খাইয়ে লোককে পাগল বানায়, কিন্তু তুই তোর হাসি দিয়ে লোককে পাগল বানাবি !”
“তুমি কী আমার হাসিতে পাগল, দাদু ?” দাদুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কুহেলি কথাটা জিজ্ঞাসা করলো ।
বয়স থাকলে অবশ্যই পাগল হতাম ! তারপর দাদুর প্রাঞ্জল হাসি ! সেই হাসির তাৎপর্য বোঝা খুব কঠিন ! কিন্তু গুণধর দাদুর অকৃত্রিম ভালবাসা কুহেলির চলার পথের সারাদিনের তাজা অক্সিজেন ! প্রায়দিন গুণধর বাড়ুই কুহেলির দোকানের প্রথম খরিদ্দার । তাই কুহেলিকে খুব ভোরবেলা এসে দোকান খুলতে হয় । প্রথম প্রথম অতো ভেরবেলায় দোকান খুলতে বিরক্ত লাগতো কুহেলির । তা ছাড়া ঘুম থেকে ভোরবেলায় ওঠা কুহেলির এই সেদিন তার বাবা থাকা পর্যন্ত অভ্যাস ছিলো না । কিন্তু এখন, পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে ঘুম থেকে ভোরবেলায় ওঠা ।
দুপুরবেলায় প্রত্যেকদিন দোকানেই নিজের জন্য ভাত বানিয়ে নেয় । সাধারণ মানের খাওয়া-দাওয়া । সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে রাত্রিতে ঘরে ঢোকা । ঘরে ঢুকে স্থান সেরে খাওয়া-দাওয়া এবং তারপর বিছানায় শুতে যাওয়া । ছোটবেলার ছোট্ট কুহেলি এখন চায়ের দোকানদার । ভাবতেই তার কেমন লাগে । অথচ বেঁচে থাকার জন্য স্বল্প পুঁজিতে চায়ের দোকান দেওয়া ছাড়া অন্য কোনোভাবে উপার্জনের পথ খোলা ছিলো না । তবে এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতি হওয়ার কারণে কুহেলির ইচ্ছা, জায়গাটার উপর আধুনিক মানের রেস্টুরেন্ট খোলা ! যার জন্য রেস্টুরেন্ট খোলার আদব-কায়দা, বিভিন্ন রকমের রান্নার রেসেপি, রান্নার টিপস, ইত্যাদি নিয়ে ইতিমধ্যে পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে । মানুষের রুচি ও স্বাস্থ্যকর খাবারের রেস্টুরেন্ট বানানোর প্রতি তার খুব ঝোঁক ! রেস্টুরেন্ট খুলে উপার্জনের মাধ্যমে সারাজীবন বেঁচে থাকতে চায় কুহেলি ! সেইজন্য পরবর্তী ডিগ্রি নিয়ে অতটা উতলা নয় ।
পরেরদিন ভোরবেলা ।
ভোর সাড়ে-পাঁচটায়, গুণধর দাদুর ডাক, “নাতনী, চা দাও ?”
সবে কুহেলি দোকান খুলেছে । তাই দাদুর দিকে তাকিয়ে বললো, “দাদু, এক মিনিট জিরিয়ে নাও ! আমি তোমার চা বানিয়ে দিচ্ছি ।“
তুমি এখনও উনুন জ্বালাওনি ? উনুন না জ্বললে চা বানাবে কী করে ?
দাদু, তুমি কিচ্ছু ভেবো না । দরকার হলে আমি স্টোভে চা বানিয়ে দিচ্ছি ।
ঠিক আছে নাতনী । আমি চাপা কল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসছি । দাদু বেরিয়ে যেতেই একজন হাল্কা বয়সের যুবক তার দোকানে উদয় হলো । চেহারাটা মিষ্টি । এমনকি পোশাক পরিচ্ছদও পরিপাটি, কিন্তু মুখটা শুকনো । বলা চলে মুখমণ্ডলে দুঃখজনক পরিস্থিতির ছাপ । তা ছাড়া কেমন যেনো উদাসী । দোকানে ঢুকে কুহেলিকে দেখে কিছুটা আড়ষ্ট । সম্ভবত যৌবন বয়সের মহিলা চায়ের দোকানদারকে আশা করেনি । অতো সকালে চায়ের দোকানে একজন অল্প বয়সের মেয়েকে দেখবে সেটাও তার চিন্তার বাইরে । যদিও কুহেলির সবটাই অনুমান ।
কুহেলিকে দেখে অবাক বিস্ময়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো । কুহেলির দিক থেকে চোখ ফেরাতে চাইছে না । ভাবনার জগতে নিমজ্জিত । তা ছাড়া এমন একটা ভাব, যেনো কুহেলির মধ্যে সে কিছু একটা খুঁজছে !
এরপর আর চুপ থাকতে পারলো না কুহেলি । যুবক ছেলেটির খুব কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কিছু বলবেন, নাকি চা খাবেন ?”
আচমকা কুহেলির প্রশ্নে ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো । তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে এক গাল হাসি দিয়ে কুহেলিকে বলল, “এক কাপ চা পাওয়া যাবে ? আমি পরের বাসটা ধরবো ।“
“নিশ্চয়ই । আপনি বসুন । আমি চা বানিয়ে আনছি ।“ পুনরায় ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কুহেলি বলল, “চায়ে কী চিনি দেবো ।“
“চিনি দেবেন, কিন্তু খুব কম ।“ উত্তর দিয়েই আবার কুহেলির দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ।
ইতিমধ্যে উনুন ধরে গেছে । উনুনে চা বসালো । সেই সময় গুণধর দাদু পুনরায় দোকানে ঢুকে, “নাতনি, আমার চা কী হলো ?”
দাদুর প্রশ্নের উত্তরে কুহেলি বলল, “উনুনে চা বসিয়েছি, আর দু-মিনিট ।“
চা বানিয়ে এবার মাটির ভাঁড়ে ঢাললো । ছেলেটির দিকে চায়ের ভাঁড় এগিয়ে ধরে কুহেলি বলল, “আপনার চা ।“
চায়ের ভাঁড় ধরতে যাবে এমন সময় বাসের হুইসেল ।
বাস ঢুকছে দেখতে পেয়ে চায়ের ভাঁড় নিলো না যুবক ছেলেটি । উল্টে হাত জোড় করে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাস এসে গেছে । এই বাসটা মিস করলে চাকরির পরীক্ষা কেন্দ্রে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারবো না । আমাকে মাফ করবেন । অন্য সময় এসে আপনার দোকানে বসে চা খেয়ে যাবো । কথা দিলাম ।“ কুহেলির উত্তর শোনার ধৈর্য নেই । ছুটে বাসে উঠে পড়লো । জানালার পাশের সীটে বসে এক দৃষ্টিতে কুহেলির দিকে তাকিয়ে রইলো । কুহেলির হাতে চায়ের ট্রেতে তখনও চায়ের ভাঁড়ে গরম ধোঁয়া উড়ছে । কুহেলিও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো, যুবক ছেলেটি তার অনেকদিনের চেনা !
( চলবে )

Share This