আজ যখন “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী” ‘নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্বে’ লিপ্ত, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে,ধর্মে ধর্মে বিভেদের বিষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তখন আমরা স্মরণ করবো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে সৃষ্ট রাখিবন্ধন উৎসব –যা একদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল এক ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ। যখন সাম্রাজ্যবাদী লর্ড কার্জন বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য, বাঙালিকে দূর্বল করার জন্য ও হিন্দু –মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য ঘোষণা করলেন ১৯০৫ খ্রিঃ ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ হবে, তখন স্বদেশ প্রেমিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না,ছিলেন স্বদেশপ্রেমিক। তাই স্বদেশের প্রয়োজনে সেদিন তিনি সাহিত্যজগৎ থেকে নেমে এলেন রাজীতির অঙ্গনে। তিনি ব্রিটিশ সরকারের এই হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে নতুন কৌশল গ্রহণ করলেন।কার্জনের এই হীন চক্রান্তের কথা পূর্বেই জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথ একটা বিশেষ দিনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হলেন এবং রাখিবন্ধন উৎসবের সূচনা করলেন।সেদিন এই উৎসবে পরস্পরের হাতে রাখি পড়িয়ে তিনি ব্রিটিশদের জানিয়ে দিতে চাইলেন বাঙালির এক প্রাণ একতার কথা । তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা বঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন – “ঈশ্বর যে বাঙালিকে বিচ্ছিন্ন করে নাই, তাহাই বিশেষ রূপে স্মরণ ও প্রচার করার জন্য আমরা রাখিপূর্ণিমার দিনে পরস্পরের হাতে হরিদ্রাবর্নের সুত্র বাঁধিয়া দিব।” ১৬ই অক্টোবর,১৯০৫ খ্রিঃ কোলকাতার রাজপথে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল।রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে শত শত নর নারী গঙ্গানদীর গঙ্গার জলে স্নান করে হাতে কালো ব্যজ পড়ে মিলিত ভাবে গান গেয়ে চললেন – “বাংলার মাটি,বাংলার জল,বাংলার বায়ু,বাংলার ফল,
পুন্য হউক,পুণ্য হউক,হে ভগবান।”
বাংলা মাকে দ্বিখণ্ডিত করেছে বলে মনের দুঃখে সেদিন সকলে অরন্ধন ও অনশন পালন করে তাঁদের মনের শোক প্রকাশ করেছিলেন। সমকালের পরিপ্রেক্ষিতে এই রাখিবন্ধন উৎসবকে শুধু এক অভিনব কৌশল না বলে আধুনিক রাষ্ট্রতাত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে রাখিবন্ধনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা নতুন উদ্যোগ বলা যেতে পারে। তিনি রাখিবন্ধন উৎসবকে শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নারীজাতিকে এই আন্দোলনে সামিল হতে অনুরোধ করেন।ফলে সেদিন দেখা গেল শত শত নরনারী মহা উৎসাহে শঙ্খ বাজিয়ে এই উৎসবে যোগদান করলেন। তাছাড়া তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এই উৎসবের মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সমস্ত বিভেদ দুর করে ঐক্য স্থাপন করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে সুদৃঢ় করার জন্য তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে রাখি পড়িয়ে দিতে বলেছিলেন। এই প্রসঙ্গে কবিগুরুর একটি লেখা উদ্ধৃত করছি। তিনি লিখেছিলেন- “সামনে যাকে পেতাম তার হাতে বাঁধিতাম রাখি।…………মনে পড়ে একবার এক মুসলমান কনেষ্টবল হাত জোর করে বলেছিলেন-মাফ করুন হুজুর আমি মুসলমান।” মুসলমান হলেও তিনি তার হাতে রাখি পড়াতে ইচ্ছুক ছিলেন।এমনকি শোনা যায় তিনি একটা মসজিদে ঢুকে কিছু মুসলমানকে রাখি পড়িয়েছিলেন। এছাড়া তিনি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামীর কাছে ডাকযোগে রাখি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন বৈকালে ফেডারেশন হলের সভায় রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন’ বিষয়ক এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। কিন্তু এ বছর COVID-19 বা করোনা ভাইরাসের অতিমারীর আবহে আর সেদিনের মতো পথে নেমে দল বেঁধে রাখিবন্ধন উৎসব করা সম্ভব হবে না এবং সেটা বাঞ্ছিতও নয়। তাই এবারে রাখি বন্ধন উৎসব করতে হবে নিভৃতে ঘরের চারি দেওয়ালের মধ্যে নিজ নিজ পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে, প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় কিংবা ক্লাবের মধ্যে পাঁচ-দশজন সদস্য নিয়ে কিংবা কোনো সংস্থায় ৪০-৫০ জন সদস্য নিয়ে সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্য বিধি মেনে। আর উন্নত প্রযুক্তিকে সাহায্য নিয়ে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে প্রতিটি ক্লাব, সমস্ত সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থান – মন্দির- মসজিদ- গির্জা সবত্র এই রাখিপূর্ণিমায় রাখিবন্ধন উৎসব উৎযাপন করতে হবে ।
তবে এবছর এই রাখিবন্ধন উৎসব করতে হবে সকল মানুষের মধ্যে একতা জাগ্রত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। কারন সেদিনের ব্রিটিশ শক্তির মতো বর্তমানে দেশে এক সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এই শক্তিও চাইছে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করতে এবং বাংলা তথা সমগ্র ভারতকে আবার দ্বিখন্ডিত করতে। আবার যেন হিন্দু- মুসলমানের মধ্যে দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ হওয়ার উদ্যোগ চলছে গোপনে গোপনে । তাই এই দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ রোধের জন্য সকলকে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ ভুলে মনপ্রান দিয়ে রাখিবন্ধন উৎসব করতে হবে। সেদিন যেমন বাংলার নারীপুরুষ, হিন্দু-মুসলমান একযোগে ব্রিটিশের হীন চক্রান্তকে পরাভূত করেছিল এবং ১৯১১ খ্রিঃ আবার দ্বিখণ্ডিত বাংলাকে একত্র করেছিল আজও তেমনি ভাবে বর্তমানের সাম্প্রদায়িক শক্তির হীন চক্রান্তকে স্তব্ধ করে দিতে হবে । তাই অন্য বছরের মতো রাজপথে নেমে হাজার হাজার যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ একসাথে না করতে পারলেও সামাজিক দুরত্ব মেনে এবং অন্য সকল নিয়মকানুন রক্ষা করে নতুন উৎসাহে রাখিবন্ধন উৎসব করবো। এবারে প্রত্যেকে মুখে মাক্স পড়ে হাত সানিটাইজার করে হাতে তুলে দিতে হবে সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক রাখি । রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে সামনে রেখে সকলে এ বছর ৩রা আগষ্ট রাখিপূর্নিমার দিনে সকাল থেকে বিভিন্ন ক্লাবে, বিভিন্ন সংঘে কিংবা বাড়ির পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে অনলাইনে গান গাইবো – “বাঙালির প্রাণ,বাঙালির মন,বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক,এক হউক,এক হউক,হে ভগবান।”
রবীন্দ্রনাথ সেদিন শুধু এই প্রার্থনাতেই থেমে থাকেন নি সেদিন তাঁর সংগীত বেজে উঠেছিল দৃঢ় সংকল্পের অমোঘ বাণী। সেই বাণীই হবে আমাদের আজকের মন্ত্র –
“ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে
ততই বাঁধন টুটবে
মোদের ততই বাঁধন টুটবে।
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে
মোদের আঁখি টুটবে
ততই মোদের আঁখি টুটবে।”
এই সব গানের মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হবে বাঙালিরা বাংলার বুকে আবার নতুন করে বঙ্গভঙ্গ হতে দেবে না, বাংলার বুকে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-জৈন-নেপালি-গুর্খা-সকলকে এক সুত্রে গেঁথে রাখবে। তাই এ বছরের রাখিবন্ধন উৎসব হোক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নতুনভাবে প্রতিবাদ।
।।কলমে : প্রশান্ত কুমার দাস।।