প্রথমে প্রত্যেক শব্দের অর্থ জানা যাকঃ
সত্ত্বঃ- সত্ত্ব শব্দের অর্থ হলো ধর্মীয় জ্ঞানের প্রকাশ এবং সাত্ত্বিক শব্দের মানে হলো ধর্মজ্ঞানী । সত্ত্ব শব্দটির মূল কথা হলো সৎ এবং সৎ শব্দের অর্থ হলো সাধু । অর্থাৎ সত্ত্ব বা সাত্ত্বিক বলতে সর্বদা মহৎ বা উন্নত জ্ঞানসম্পন্ন ভালো কিছুকে বোঝায় । যখন কোনো ব্যক্তি প্রতিটি পরস্থিতিতে ধর্ম, সত্য ও ন্যায়ের বিচার করে তাঁর আচরণ করে থাকেন, তখন তাকে সাত্ত্বিক বলা হয়।
তমঃ- তমঃ শব্দের অর্থ হলো অন্ধকার এবং তমঃ থেকেই তামসিক শব্দের উৎপত্তি । “ভালো মন্দের বিচার ব্যতীত জীবন নির্বাহ করা অথবা কারো সকল আদেশকে বিনা দ্বিধায় পালন করা” এটা তামসিক আচরণ বলেই গণ্য । অন্যভাবে, কেবল শারীরিক চাহিদা অর্থাৎ ক্ষুধা ও যৌনতার চাহিদাকে পূর্ণ করার জন্য যখন কেউ জীবন কাটায়, তখন সেটা তামসিক আচরণের মধ্যে পড়ে । ইতর প্রাণীরা সাধারণত স্বভাববশতই এই ধরণের জীবন কাটায় বা কাটাতে বাধ্য হয় ।
রজঃ- রজঃ শব্দের অর্থ হলো অহঙ্কার । রজঃগুনী ব্যক্তির মধ্যে ধর্ম বা সত্যের জ্ঞান থাকে, কিন্তু শরীর ও মন বাসনার দ্বারা আবদ্ধ থাকে এবং অহঙ্কার পূর্ণ মন নিয়ে বেঁচে থাকে ।
সংক্ষেপে বলতে গেলে— সত্ত্ব মানে ধর্ম জ্ঞান, মঙ্গল, ভারসাম্য, রজঃ মানে অহঙ্কার, আবেগ, উত্তেজনা এবং তমঃ মানে অন্ধকার, নিস্তেজতা, জড়তা, উদাসীনতা ।
উপসংহারে বলা যায় – সত্ত্বগুণের স্বরূপ হচ্ছে নির্মল । নির্মল সত্ত্বগুণ দ্বারা পরমাত্মার জ্ঞান লাভ সম্ভব । সত্ত্বগুণের উৎকৃষ্ট উপাদান হচ্ছে জ্ঞান । জ্ঞান বোধশক্তির বোধক । জ্ঞানই প্রকৃত প্রকাশক । এই সত্বগুণ রজঃ ও তমঃগুণের বৃত্তিকে অবদমিত করে অন্তঃকরণে স্বচ্ছতা ও নির্মলতা উৎপন্ন করে । অন্যদিকে রজঃগুণ, চঞ্চল স্বরূপ । রজঃ নিজেও যেমন চঞ্চল, তেমনি অপরের মধ্যেও চঞ্চলতার উৎপাদক । রজঃগুণ বাড়লে লোভ, শান্তির অভাব ও আসক্তি এই সমস্ত বৃত্তিগুলির উদ্ভব ঘটে । আর তমঃগুণ হচ্ছে এককথায় সত্ত্বগুণের বিপরীত ! তমঃগুণ ও অজ্ঞানতা পরস্পর ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে থাকে । তমঃগুণ অজ্ঞানতা থেকেই উৎপন্ন হয় আবার অন্যদিকে অজ্ঞানতা থেকে তমঃগুণ বাড়ে ।
লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ যা কিছু কর্ম করে সেটা দুঃখদায়ক হয় । বেশীমাত্রায় আকাঙ্খার নাম লোভ । মানুষ কর্তব্য কর্ম থেকে বিচ্যুত হলে মনে অশান্তি ও চাঞ্চল্য বাড়ে । পাপ বাড়ে । সুতরাং কপকটতা করে অর্থোপার্জন, পাপের নামান্তর ।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাষায়ঃ সত্ত্ব, রজঃ আর তমঃ – মানুষের এই তিন গুণ । সব মানুষের ভিতর এর লক্ষণ ফুটে ওঠে । সেটা যেমন সংসারীর ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনি ভক্তের ক্ষেত্রেও । কিন্তু কেমন করে বোঝা যায়, কে কোন গুণের অধিকারী।
সত্ত্ব, রজঃ আর তমঃ গুণের কথা আমরা সবাই জানি । কিন্তু বুঝব কী করে আমরা কে কোন জায়গায় আছি ? আবার সংসারী মানুষ মনে করে, ভক্ত বোধহয় এসবের ঊর্ধ্বে । সত্যিই কি তাই । এই সব সংশয় নিরসনের জন্য আমাদের গুরুদেবের শরণ নিতে হয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণ ভক্তমনের এই সন্দেহ নিরসন মিটিয়ে দেন একেবারে সহজ কথায় । তিনি বলেন, “সংসারীর সত্ত্বগুণ কী রকম জানো ? বাড়িটি এখানে ভাঙা, ওখানে ভাঙা — মেরামত করে না । ঠাকুরদালানে পায়রাগুলো হাগছে, উঠানে শেওলা পড়েছে হুঁশ নাই। আসবাবগুলো পুরানো, ফিটফাট করবার চেষ্টা নাই । কাপড় যা তাই একখানা হলেই হলো । লোকটি খুব শান্ত, শিষ্ট, দয়ালু, অমায়িক; কাউকে কোনও অনিষ্ট করে না । “সংসারীর রজঃগুণের লক্ষণ বলতে — ঘড়ি, ঘড়ির চেন, হাতে দুই-তিনটি আঙটি । বাড়ির আসবাব খুব ফিটফাট । দেওয়ালে কুইনের ছবি, রাজপুত্রের ছবি, কোন বড় মানুষের ছবি । বাড়িটি চুনকাম করা, যেন কোনখানে একটু দাগ নাই । নানারকমের ভাল পোষাক ।“ সংসারীর তমঃগুণের লক্ষণ হচ্ছে — “নিদ্রা, কাম, ক্রোধ, অহংকার এই সব ।“ (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)
Categories