Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

“লাইব্রেরি” নিয়ে দুটি কথা : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।।

১৮৩৫ সালের ৩১শে আগস্ট তৎকালীন বিদ্ধদ্‌জনদের উপস্থিতিতে কলকাতার টাউন হলে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । এই সভাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, সর্বসাধারণের জন্য একটি গ্রন্থাগার বা পাবলিক লাইব্রেরি নির্মাণ করা হবে । সেই সিদ্ধান্তক্রমে গড়ে ওঠে “ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি” । অনেক জায়গায় সেই থেকে ৩১শে আগস্ট দিনটিকে গ্রন্থাগার দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে ।
তারপর ১৮৩৬ সালে “ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি” নামে প্রথম গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সময় এটি ছিল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান । প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন এই লাইব্রেরির প্রথম মালিক। ভারতের তদনীন্তন গভর্নর- জেনারেল “লর্ড মেটকাফ” ফোর্ট উইলিয়াম কলেজর ৪৬৭৫টি বই দান করেন, যেটা দিয়ে এই লাইব্রেরী গোড়াপত্তন ।
সেই সময় বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষার বই গ্রন্থাগারের জন্য ক্রয় করা হত । কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা গ্রন্থাগারকে অর্থসাহায্য করতেন । এমনকি সরকারের কাছ থেকেও অনুদান পাওয়া যেত । সেই সময় এই গ্রন্থাগারে বহু দেশি ও বিদেশি দুষ্প্রাপ্য বই সংগৃহীত হয়েছিল, যা আজও সংরক্ষিত আছে । উল্লেখ থাকে যে, ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি ছিল শহরের প্রথম নাগরিক পাঠাগার ।
তারপর ১৮৯১ সালে কলকাতার একাধিক সচিবালয় গ্রন্থাগারকে একত্রিত করে গঠিত হয় “ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি” । এই গ্রন্থাগারের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল গৃহ মন্ত্রকের গ্রন্থাগার ।
পরবর্তী সময়ে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি ও ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির সংযুক্তিকরণ ঘটে । জানা যায়, ১৯০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি লর্ড কার্জনের প্রচেষ্টায় ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি ও ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিকে সংযুক্ত করে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয় । সেই সময় সংযুক্ত লাইব্রেরিটি ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি’ নামেই পরিচিত হয় । এই সময় গ্রন্থাগারটি উঠে আসে আলিপুরের বেলভেডিয়ার রোডস্থ মেটকাফ হলের বর্তমান ঠিকানায় । এখানে উল্লেখ থাকে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাইব্রেরিটি এসপ্ল্যানেডের জবাকুসুম হাউসে স্থানান্তরিত হয়েছিল ।
এবার আসছি জাতীয় গ্রন্থাগার সম্বন্ধে …………?
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি পুনরায় মেটকাফ হলে উঠে আসে এবং লাইব্রেরির নতুন নামকরণ হয় জাতীয় গ্রন্থাগার বা ন্যাশানাল লাইব্রেরি । ১৯৫৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ জাতীয় গ্রন্থাগারকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেন ।
স্বাধীনতার পর ভারত সরকার “ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি (নাম পরিবর্তন) অ্যাক্ট, ১৯৪৮” চালু করে । তারপর “ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার আইন, ১৯৭৬”এর ১৮ ধারা মোতাবেক ন্যাশনাল লাইব্রেরির নাম পরিবর্তন করে “ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার” করা হয় ।
গ্রন্থাগার কার্যত সমস্ত ভারতীয় ভাষায় বই, সাময়িকী, শিরোনাম, ইত্যাদির সংগ্রহশালা । জানা যায়, ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারের সংগ্রহগুলি অনেকগুলি ভাষায় । হিন্দি বিভাগে বই রয়েছে যেগুলি উনবিংশ শতাব্দীর পুরো সময়কার এবং সেই ভাষায় ছাপা হওয়া প্রথম বই ।
আগেই বলেছি, ১৮৩৬ সালে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি নামে প্রথম গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সময় লাইব্রেরিটি ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান । প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন লাইব্রেরির প্রথম মালিক । ভারতের তদনীন্তন গভর্নর-জেনারেল ‘লর্ড মেটকাফ’ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ লাইব্রেরির ৪,৬৭৫টি বই গ্রন্থাগারে দান করেছিলেন । এই দানের ফলেই গ্রন্থাগারের গোড়াপত্তন । বর্তমানে এই গ্রন্থাগারে কমপক্ষে ২০ লক্ষ বা তারও বেশী বই রয়েছে । “ভারত সরকারের পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রক”এর অধীনে “কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি” এখন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত ।
এবার আসছি লাইব্রেরির গুরুত্ব প্রসঙ্গে —
‘বই’ মানুষের নিত্যসঙ্গী । জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বই । এখানে একটা কথা পরিষ্কার, লেখক লেখেন, প্রকাশক সেই লেখা ছাপেন, প্রকাশক ও বিক্রেতা উভয়েই বই বিক্রি করেন । আর অন্যদিকে গ্রন্থাগারিক সেই বই সংগ্রহ করে যথাযথ বিন্যাস করেন এবং পাঠক সমাজ ঐসব উপাদান থেকে মনের খোরাক এবং জ্ঞানলাভে সমর্থ হন ।
শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য । গ্রন্থাগারে থাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান সহ বিভিন্ন বিষয়ের বই । আগ্রহী পাঠকের জন্যে গ্রন্থাগার জ্ঞানার্জনের যে সুযোগ করে দেয়, সেই সুযোগ অন্য কোথাও পাওয়া দুর্লভ । গ্রন্থাগার গ্রন্থের বিশাল সংগ্রহশালা, যা মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম । গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহন করে জ্ঞানের মণিমুক্তা সংগ্রহের সুযোগ পায়। গ্রন্থাগারের সংগৃহীত বই সর্বসাধারণের জন্যে অবারিত । চিন্তাশীল মানুষের কাছে এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে গ্রন্থাগারের উপযোগিতা অনেক বেশি । গ্রন্থাগার হচ্ছে জ্ঞান আহরণের উপযুক্ত মাধ্যম । আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে গ্রন্থাগারের উপযোগিতা উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি । কারণ সংসারের মৌলিক চাহিদা মেটাতে আমরা হিমশিম খাই । সেখানে বই কিনে পড়া অনেক সময় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় ! সুতরাং আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে লাইব্রেরির গুরুত্ব অপরিসীম । অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক প্রতিদিনের টিফিন পিরিয়ড বা অন্য অবসর সময়টা আড্ডা ও গল্পগুজবের মধ্যে না কাটিয়ে লাইব্রেরি থাকলে সময়টা পড়ালেখায় কাটাতে পারেন । এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শিক্ষা বিকাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরি বা লাইব্রেরির অবস্থান অপরিহার্য ।
গণতন্ত্রের সাফল্যে গ্রন্থাগারের ভূমিকা গণমাধ্যমের চেয়ে কম নয় । আধুনিক বিশ্বে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা দিনে দিনে বাড়ছে । গ্রন্থাগার সকলের জন্য উন্মুক্ত । ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নেই এখানে, নেই হানাহানি কলহ । সুতরাং প্রতিটি সুশীল নাগরিকের নিয়মিত গ্রন্থাগারে উপস্থিত হয়ে লেখাপড়া ও জ্ঞানার্জন করা, তাঁদের নিয়মমাফিক রুটিনে আসুক ।
প্রমথ চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, “আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব, দেশের তত বেশি উপকার হবে । আমার মনে হয়, এদেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল-কলেজের চাইতে একটু বেশি ।“
পরিশেষে আমি মনে করি, লাইব্রেরি হচ্ছে শিক্ষা বিকাশের ও জ্ঞানার্জনের উপযুক্ত পীঠস্থান । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত) ।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *