ওঁ নমঃ শ্রী ভগবতে প্রণবায় ।
আমাদের ভারতীয় সত্য সনাতন হিন্দু ধর্মে মূল্যবান সুন্দর মনুষ্য জীবনে *ভগবান ও ঈশ্বর* শব্দদুটি মোটেও এক নয়। *ঈশ্বর* শব্দের অর্থ হল সর্বশক্তিমান। ঈশ্বর হল সয়ম্ভূ, অজ। যার কোন জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। যিনি সর্বত্র বিরাজমান, সকলের মুক্তিদাতা, সগুণে সাকার কিংবা নির্গুণে নিরাকার, প্রয়োজনে বহু রূপ ধারণ করতে পারেন, তিনিই হচ্ছেন ঈশ্বর, পরমেশ্বর, পরমাত্মা। ঈশ্বর এক, অবিভক্তে তিনি এক। বিভক্তে তিনি বহু। ঈশ্বর নিজ আনন্দে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সৎ-চিৎ-আনন্দ বিগ্রহ। তিনিই অনাদি, তিনিই নিত্য, জ্ঞানময়, আনন্দময়। তিনি হচ্ছেন অনাদি, সয়ম্ভূ, এবং সমস্ত কারণের মূল কারণ। ঈশ্বর বলতে বোঝায়, সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা, পরমাত্মা, প্রভু জগৎস্রষ্টা, অধিপতি ইত্যাদি। ঈশ্বরকে ভগবান, পরমেশ্বর, ইষ্টদেবতা, বিশেষ আত্মা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
*ভগবানঃ* ‘জন্মদাস্য যত’- যার থেকে সমস্ত প্রকাশিত হয়। ভাগবদ পুরাণ ১/১ ভগবান শব্দটি সংস্কৃত, এবং এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি (১) সমগ্র ঐশ্বর্য (ধনসম্পদ) (২) সমগ্র বীর্য (৩) সমগ্র যশ (৪) সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য) (৫) সমগ্র জ্ঞান (৬) সমগ্র বৈরাগ্য। যিনি এই ষড়ৈশ্বর্য গুনযুক্ত তিনিই ভগবান পদবাচ্য। আবার ভগবান:- ভ- ভূমি, গ- গগন, ব- বায়ু, অ/আ- অগ্নি, ন- নীর। এই ভূমি, গগন, বায়ু, অগ্নি ও নীর- কে যিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তিনিই ভগবান। ভগবান হলেন ঈশ্বরের উপাধি। ঈশ্বরকে যখন ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান, ও বৈরাগ্যের অধীশ্বর হিসেবে আরাধনা করা হয়, তখন তাকে ভগবান বলা হয়।
*ঈশ্বর, ভগবান, ও দেবতা* এই তিনটি শব্দই ভিন্ন অর্থ বহন করে। ঈশ্বরকে বিশ্বজগতের সর্বোচ্চ স্রষ্টা বলা হয়। ভগবান হলেন ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান, ও বৈরাগ্যের অধীশ্বর। দেবতা হলেন অতিপ্রাকৃত সত্তা। ঈশ্বর,ভগবান, ও দেবতার মধ্যে পার্থক্য:- ঈশ্বর শব্দের অর্থ হল বিশ্ব জগতের সর্বোচ্চ স্রষ্টা। ভগবান হলেন ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান,ও বৈরাগ্যের অধীশ্বর। দেবতা হলেন অতিপ্রাকৃত সত্তা। অতিপ্রাকৃত বলতে এমন ঘটনা বা সত্তাকে বোঝায় যা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। ঈশ্বরকে পরমেশ্বরও বলা হয়। ঈশ্বরকে পরমাত্মাও বলা হয়। ঈশ্বরকে ইষ্টদেবতাও বলা হয়। ঈশ্বরকে বিশেষ আত্মাও বলা হয়।
যেমন, আমরা বাস্তবে দেখি *অসৎ* লোকের ভাবনায় ঈশ্বর দৈত্য, দানব, রাক্ষস! সে তারা স্বীকার করুন আর নাই করুন। তাইতো তারা ঈশ্বরকে ভয় পায়। অসৎ না হলে ঈশ্বরকে ভয় পাবে কেন?
*লোভী এবং নির্বোধ* ব্যক্তির কাছে ঈশ্বর অলৌকিক এক শক্তি ! কাল্পনিক এই অসীম শক্তির সাথে তারা দেওয়া এবং নেওয়া নীতি (Give and take policy) এর হিসাব করে। কল্পিত ঈশ্বরকে তারা নানারকম উপহার দিয়ে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করে।
*ধর্মব্যবসায়ীদের* কাছে ঈশ্বর হচ্ছে তাদের সম্পত্তি। তাই তারা খরিদ্দার ধরার তাগিদে দোকান খুলে বসে। এসব ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্ম ব্যবসা করে এরা বিরাট সম্পদ গড়ে তোলে।
*নাস্তিকের* কাছে ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও তারা ঈশ্বর নেই, ঈশ্বর নেই বলে চলে সদা সর্বদা। ঈশ্বরবিশ্বাসীদের ক্রমাগত বাজে মন্তব্য করে সবচাইতে অমানবিক আচরণ করে। তারা ভুলে যায় বিশ্বাসীদের বিশ্বাসে আঘাত করা ঘৃণ্য মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
*আস্তিকের কাছে, আমাদের কাছে, আমার কাছে আত্মাই ঈশ্বর। নিজের মাঝে যে শুভশক্তিটুকু আছে সেটাই ঈশ্বর। নিজের ভেতর থেকে যখন জানার আগ্রহ প্রবল হয়, সেই জ্ঞানতৃষা মেটানোর পথটুকুই ঈশ্বর। কর্মই ঈশ্বর, ঈশ্বর হচ্ছে জ্ঞান, ঈশ্বর যুক্তি, ঈশ্বরই মুক্তি। ঈশ্বর পেতে হলে নিজের ভেতরে অনুসন্ধান চালাতে হয়। শুভ ইচ্ছা নিয়ে নিজের ভেতরে খুঁজে বেড়ালেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। আত্মজিজ্ঞাসাই ঈশ্বর।*
একইভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র
ষড়ৈশ্বর্য যুক্ত ছিলেন তাই তাঁদের কে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বলে সম্বোধন করি। ভারতীয় সত্য সনাতন হিন্দু ধর্মের মধ্যে যখন কোন মানুষকে ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি গুনের অধীশ্বর রূপে আরাধনা করা হয় তখন তাকে ভগবান বলা হয়। যেমন আদি শঙ্করাচার্য, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য, ভগবানবুদ্ধ, স্বামী প্রণবানন্দ ইত্যাদি। তাই, আমরা গুরু মহারাজকে জগৎগুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী বলে সম্বোধন করি। আমাদের ভারতীয় সত্য সনাতন হিন্দু ধর্ম হল সেই বিজ্ঞান যেটা বহু বছর ধরে সাধু, সন্ন্যাসী, জ্ঞানী, মহাত্মাদের সঠিক মার্গ দর্শনে আমাদের দেশে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে। তাই হিন্দুধর্ম হল একটা বিজ্ঞান সম্মত ধর্ম যার নাম সনাতন ধর্ম,শাশ্বত চিরন্তন ধর্ম। তাই, আমাদের হিন্দু ধর্মের কোন প্রবর্তক নেই। আমাদের সত্য সনাতন হিন্দু ধর্মে সামাজিক জীবনে ধর্মীয় প্রভাব অপরিসীম। তাই, সনাতন হিন্দু ধর্মে ঈশ্বরকে এক ও অদ্বিতীয় বলা হয়। কারণ, তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজনীন, নিরাকার, এবং সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনিই পরম কারণ এবং সর্বোচ্চ সত্তা।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)