Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাপ্রভুর বিশ্বরূপ দর্শন দান : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

সর্বাবতারী নদিয়াবিহারী শ্রীশ্রীগৌরহরি নদীয়ার নবদ্বীপে সর্বদা কীর্তনবিলাস করে চলেছেন । নগরে, চত্বরে, জলে, বনে—-যেখানেই তিনি কৃষ্ণনাম শ্রবণ করেন অমনি নিরবধি তাঁর শ্রীনয়ন দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে যায় । নবদ্বীপের ভক্তসমাজ তাঁর দশা দেখে বলেন, বিশ্বম্ভর রায় যে ভক্তিরসময় হয়ে গেছেন ! নিমাই পণ্ডিত কারোর মুখে ‘হরি’ শব্দ শ্রবণ করলেই নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না আর । অশ্রু-কম্প-পুলক-বৈবর্ণ‍্য আদি অষ্ট সাত্ত্বিক ভাবের প্রকাশ হয় সর্বাঙ্গে তাঁর । ধূলায় বিলুন্ঠিত হন, গড়াগড়ি যান । যে আবেশ দর্শন করলে ব্রহ্মাদি দেবতারা পর্যন্ত ধন্য হন —-সেই দেবদুর্লভ দর্শন সৌভাগ্যবান নদীয়াবাসী লাভ করেন ।
একদিন কীর্তনবিলাসী গৌরের ভাবেতে মূর্ছাগ্রস্ত অবস্থা এমন । পার্ষদরা তাঁকে নিয়ে চলে এলেন তাই গৃহে । দ্বার দিয়ে শুরু করলেন কীর্তন । অনন্ত ভাব প্রকট তখন তাঁর অন্তরে । নির্দিষ্ট কোন রসে, কোন ভাবে তিনি যে বিহ্বল হয়ে আছেন —-তা কেউ অনুধাবন করতে পারেন না । কখনও তিনি বলছেন —-“আমিই তো মদনগোপাল,” কখনও বলছেন—- “আমি সর্বকালের কৃষ্ণদাস,” আবার কখনও “গোপী !গোপী !গোপী!” বলে জপ করেন । কখনও কৃষ্ণের নাম শ্রবণ করে কেঁপে ওঠেন তেজে ; বলতে থাকেন—- “কোথাকার কৃষ্ণ তোর ! সে তো মহাদস্যু ! শঠ, ধৃষ্ট কৈতব একজন ! কে তাকে ভজনা করবে শুনি ! নারী মন জয় করে নারীদেরই নাক কান কেটে দেয় ! লোভীর মতো বালির প্রাণ কেড়ে নিল ! আমার কোন দরকার নেই চোরের কথায় !” এরপর যদি কারোর মুখে পুনরায় কৃষ্ণ শব্দ শোনেন তো ক্রোধে তাঁকে তিরস্কার করতে থাকেন । আবার “গোকুল গোকুল” বলতে থাকেন ক্ষণে ক্ষণে । কোনদিন বলেন “বৃন্দাবন, বৃন্দাবন” । কখনও বা আনন্দকন্ঠে “মথুরা মথুরা” বলেন । আবার মৃত্তিকায় শ্রীকৃষ্ণের ত্রিভঙ্গ আকৃতি এঁকে, সেদিকে চেয়ে রোদন করতে থাকেন । কখনো বলেন, “এ কী চারিদিকে যে অরণ্য ! এই দেখো অরণ্যে সিংহ, ব্যাঘ্র, ভাল্লুকের গণ সব ।” দিনের বেলাকে রাত্রি বলেন, আবার রাত্রিবেলাকে দিন । —-এমন আবেশ সর্বক্ষণ তাঁর শরীরে ; ভক্তিবশ হয়েছেন বিদ্যাহঙ্কারী নিমাই পণ্ডিত এখন । ভক্তরা তাঁর কৃষ্ণপ্রেমাবেশের এমন দশা দেখে ক্রন্দন করতে থাকেন গলা জড়াজড়ি করে । যে আবেশ দর্শন করা ব্রহ্মাদিদেবের অভিলাষ —-সে আবেশ দর্শন করেন নবদ্বীপের বৈষ্ণবের দাসেরা ।
গৌরহরি নিজগৃহে আর কতক্ষণই বা থাকেন ! তিনি দিনের বেশীরভাগ সময়ে ভক্তদের গৃহেই পড়ে থাকেন । গৃহে যেটুকু সময় ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন —-তা কেবল তাঁর জননীকে প্রবোধ দিতে চেয়ে, মাতৃসুখ প্রদানের কারণে । ওদিকে তাঁকে নিয়ে বৈষ্ণবদের আনন্দ আর ধরে না । এ কী অপরূপ কৃষ্ণপ্রেম ! অনির্বচনীয় ! অদ্বিতীয় ! অভাবনীয় ! এমন ভগবদ্ প্রেম কোন মানুষের মধ্যে হতে পারে তা জানা ছিল না কারোর । ঈশ্বরাংশ না হলে শরীরে এমন প্রেম প্রকট হওয়া তো অসম্ভব !
গৌরহরির অভিন্ন প্রাণ নিত‍্যানন্দ তো মত্ত সিংহ এক ! তিনি সর্বদা ছায়ার মত গৌরাঙ্গের পাশে থাকেন । তাঁকে নিয়ে গোরা রায় অনন্ত লীলায় ঘরে ঘরে মেতে থাকেন । আর থাকেন গদাধর পণ্ডিত, আচার্য অদ্বৈত ও অন‍্যান‍্য ভক্ত মহাজনেরাও ।
একদিনের ঘটনা । গোপীভাব নিয়ে অদ্বৈত নৃত‍্য করছেন শ্রীবাস প্রাঙ্গণে। আর, সকলে মহা অনুরাগের সঙ্গে কীর্তন করছেন । আহা ! অদ্বৈতের নৃত‍্যে সে কী ভাব ! কী আর্তি ! তিনি বারংবার দন্তে তৃণ ধরে দৈন্য করতে করতে বিবশ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন । আর তাঁর দশা দেখে ভক্তরা আরও আবেগসহ গীত গাইছেন । দুই প্রহরেও নৃত‍্যের বিরাম হচ্ছে না । অবশেষে ভক্তরা শ্রান্ত হলেন । সকলে মিলে আচার্যকে স্থির করলেন । নৃত্যের বিশ্রাম হল । অদ্বৈতের চারপাশে ভক্তগণ ঘিরে বসলেন । ধীরে ধীরে অদ্বৈত শান্ত হলেন । সবকিছু স্বাভাবিক হলে শ্রীবাস, রামাই আর সকলে গেলেন গঙ্গাস্নান করতে । একলা অদ্বৈত বসে রইলেন শ্রীবাস গৃহেই । কিন্তু, বাইরে তাঁকে স্থির মনে হলেও ভিতরে-ভিতরে, অন্তরে-অন্তরে তাঁর আর্তির এতটুকুও কম হয় নি, বরং বেড়ে চলেছে তা। সে সময় শ্রীগৌরহরি সেখানে ছিলেন না । তিনি ছিলেন নিজের গৃহে অথচ অন্তর্য‍ামী গৌরহরি অন্তরে অনুভব করলেন অদ্বৈতের আর্তি । ভক্ত-আর্তি পূর্ণকারী সদানন্দ রায় চলে এলেন শ্রীবাস গৃহে যেখানে অদ্বৈত এতক্ষণ ধরে গড়াগড়ি দিয়ে এখন বসে আছেন খানিক শান্ত-ভাব দেখিয়ে । প্রাণনাথকে, ইপ্সিত ধনকে নয়ন সম্মুখে পেয়ে আনন্দ আর ধরে না আচার্য‍ের যেন । হৃদয়ের ভাবতরঙ্গ উথলে উঠলো । নয়ন আবেগে অশ্রুপূর্ণ হল । মহাপ্রভু অদ্বৈতের মন বুঝে তাঁকে নিয়ে এলেন শ্রীবাসের বিষ্ণুমন্দিরে । দ্বার ভেজিয়ে দিলেন । তারপর নিজপ্রিয় ভক্তের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন—- ”বলো গো আচার্য‍ ঠাকুর ! কি তোমার ইচ্ছা ? কি তুমি চাইছো বলো তো ? আমার থেকে তোমার কি প্রত্যাশা ?”
অদ্বৈত বললেন, “আমি আর কী চাইবো প্রভু ! আমার সবই তো তুমি ! আমি শুধু তোমাকেই চাই । তুমিই তো সর্ব দেব-সার, সর্ব বেদ-সার ।”
মহাপ্রভু—- “আমি তো তোমার সম্মুখে সাক্ষাৎ আছি, এই দেখো । আর কি চাও, সত্য করে বলো তো !”
অদ্বৈত—- “হ্যাঁ, প্রভু ! তুমি ঠিকই ধরেছো ! আমার আরও কিছু অভিলাষ আছে । সুসত‍্য বচন তোমায় বলছি এবার শোনো । আমি জানি এ তত্ত্ব যে তুমিই সর্ব বেদ-বেদান্তের সার । তবু আমি তোমার কিছু বৈভব দর্শন করতে চাই ।”
মহাপ্রভু—- “কী চাইছো এবার খুলে বলো ।”
অদ্বৈত—- “প্রভু, তুমি অর্জুনকে পূর্বে যা দেখিয়েছিলে, আমি তা দেখতে চাই । তুমি নিশ্চয়ই এবার বুঝে গেছ আমার হৃদয়ের অভীপ্সা ! আমি তোমার বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাই । তুমি কী আমার এই বাসনা পূরণ করবে না প্রভু !”
অদ্বৈতের কথা শেষ হতে না হতে তিনি দেখলেন তাঁর সম্মুখে বিশাল এক রথ । চতুর্দিকে সৈন্যদল মহাযুদ্ধে রত হয়ে আছে — সমরক্ষেত্র। আর রথের উপর গৌরাঙ্গ র‍য়েছেন শ্যামল সুন্দররূপে । তাঁর চতুর্ভুজ । শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধারণ করে আছেন চার ভুজে । মহাপ্রভুর অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দেখতে পেলেন অদ্বৈত। চন্দ্র, সূর্য, সিন্ধু, গিরি, নদী, বন-উপবন দেখতে পেলেন তাঁর শরীরে । কোটি কোটি চক্ষু , বহু-বহু মুখ পুনরায় পুনরায় দেখছেন । দেখলেন শ্যামল সুন্দরের চরণের কাছে বসে তাঁকে দর্শন করছেন বিস্মিত নয়নে অর্জুন ও স্তুতি করছেন । প্রভুর মুখে মহা অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে রয়েছে । সেই অগ্নির তেজে সকল পাষণ্ড, দুষ্টগণ পতঙ্গের ন্যায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে । যে পাপীষ্ঠ অপরকে নিন্দা করে, অপরের প্রতি দ্রোহ আচরণ করে—-শ্যামল সুন্দর শ্রীচৈতন্যের মুখাগ্নিতে পুড়ে মরছে তারা সকলে ।
“বলিতে অদ্বৈত মাত্র দেখে এক রথ।
চতুর্দিকে সৈন্য দল মহাযুদ্ধ পথ।।
রথের উপরে দেখে শ্যামল সুন্দর।
চতুর্ভুজ শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধর।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দেখে সেই ক্ষণে।
চন্দ্র সূর্য সিন্ধু গিরি নদী উপবনে ।।
কোটি চক্ষু বহুমুখ দেখে পুনঃ পুনঃ ।
সম্মুখে দেখেন স্তুতি করয়ে অর্জুন।।
মহা অগ্নি যেন জ্বলে সকল বদন।
পোড়য় পাষণ্ড পতঙ্গ দুষ্টগণ।।
যে পাপিষ্ঠ পর নিন্দে পর দ্রোহ করে।
চৈতন্যের মুখাগ্নিতে সেই পুরি মরে।।
এই রূপ দেখিতে অন্যের শক্তি নাই ।
প্রভুর কৃপাতে দেখে আচার্য গোঁসাই।।”
(চৈতন্য ভাগবত , মধ্য, ২৪)
এমন দর্শন করার শক্তি কার আছে ! একমাত্র মহাপ্রভুর কৃপা শক্তিতেই আচার্য গোসাঞি দেখতে সমর্থ‍্য হয়েছিলেন । প্রেমসুখে, অচিন্ত‍্যনীয় দৃশ্য দর্শন করে অদ্বৈত তখন ক্রন্দন করছেন । তিনি দন্তে তৃণ ধারণ করে পুনরায় পুনরায় মহাপ্রভুর প্রতি দাস‍্য ভক্তি প্রার্থনা করতে থাকলেন ।
ওদিকে শ্রীনিত্যানন্দ সেসময় পর্য‍্যটন সুখে নদীয়ায় ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন । মহাপ্রভুর প্রকাশ তাঁর তো অজানা নয় । তিনি অনুভব করে ফেলেছেন যে, প্রাণগৌর তাঁর, বিশ্বরূপ ধারণ করেছেন । তিনি বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ হাজির হলেন শ্রীবাস গৃহের বিষ্ণুমন্দিরে । এসেই মত্ত হস্তীর ন্যায় দ্বারে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে থাকলেন । ভিতরে মহাপ্রভু অনুধাবন করে ফেললেন তাঁর অভিন্ন স্বরূপ, প্রাণের দোসর নিত‍্যানন্দ এসে দাঁড়িয়েছেন । তিনি সত্ত্বর দ্বার উন্মুক্ত করলেন । নিত‍্যানন্দ গৌরাঙ্গের অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দর্শন করেই দণ্ডবৎ হয়ে পড়ে গেলেন । আবেশে, আনন্দে তাঁর আঁখি বুজে গেছে । কম্পিত কলেবর । পুলকিত প্রাণ ।
মহাপ্রভু—- “ওঠ নিত‍্যানন্দ ! ওঠো ! আমার সকল আখ্যান তোমার তো অজানা নয় কিছুই । তুমি তো সবই জানো ! তবে কেন এমন দৈন্য করছো ! তুমি তো আমার প্রাণ ! যে ব‍্যক্তির তোমাতে প্রীতি—- সে আমায় পায় । তোমার থেকে প্রিয়তম আমার যে আর কিছুই নেই । যে তোমাতে আর অদ্বৈতে ভেদ বুদ্ধি করে —-তার অবতারবাদ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান নেই । সে মূর্খ ।”
নিত‍্যানন্দ ও অদ্বৈতকে একসাথে পেয়ে বিশ্বম্ভর বিষ্ণু গৃহের অভ‍্যন্তরে আনন্দে নৃত‍্য করতে থাকলেন । হুঙ্কার গর্জন করছেন আর বলছেন—- “দেখ ! দেখ !” আর অদ্বৈত ও নিত‍্যানন্দও প্রভুর বিশ্বরূপ দর্শন করে বিহ্বল বদনে বলছেন, “প্রভু ! প্রভু গো !” এমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল শ্রীবাস ভবনে অথচ শ্রীনিত‍্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈত ভিন্ন কেউ টেরও পেলেন না । কারণ, সে কৃপাশক্তি মহাপ্রভু কাউকে দেননি । ওঁনাদের দু’জনকেই শক্তি সঞ্চার করেছিলেন দর্শন করার ।
পরবর্তীতে এসব কথা আচার্য‍ অদ্বৈত সকলকে জানিয়েছিলেন । মনে রাখতে হবে, যার এতে অবিশ্বাস আছে—- সে নিশ্চয়ই দুষ্কৃতি, অভক্ত । যে গৌরচন্দ্রকে সর্বমহেশ্বর রূপে না মানে —-সে সর্বকালের পাপী । বৈষ্ণবের অদৃশ‍্য সে ।
এরপর মহাপ্রভু নিজের বিশ্বরূপ সম্বরণ করে নিলেন । ততক্ষণে স্নান সেরে সকল ভক্তরা অঙ্গনে এসে হাজির । গৌরাঙ্গ তাঁদের নিয়ে নিজ বাসায় গেলেন । আর এদিকে বিশ্বরূপ দর্শনের আবেশ অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে তখনও মত্ত করে রেখেছে । বৈভব দর্শন সুখে দু’জনাই গরগর তনু তখনও । ধূলায় গড়াগড়ি যাচ্ছেন, কখনও করতালি দিয়ে হাসছেন, কখনও বা নাচছেন, গান করছেন । দুই মহাবলী মহাজন ঢুলে ঢুলে পড়ছেন একে অপরের শ্রীঅঙ্গে । তারপর শেষে একসময় দু’জন গালি দিয়ে কলহ শুরু করলেন । অদ্বৈত বললেন—- “এই অবধূত মাতালিয়া কোথাকার ! এখানে কে তোকে ডেকে এনেছে যে তুই এলি ! দুয়ার ভাঙ্গার অবস্থা করে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করলি কেন, শুনি ? কে তোকে বলে রে সন্ন্যাসী ! তুই কোথাকার সন্ন্যাসী ! এমন কোন জাতি আছে, যার ঘরে তুই আহার করিস নি ! তাহলে তুই কি করে সন্ন্যাসী হলি রে ! মাতোয়াল এক চলে এসেছে বৈষ্ণব সভায় ! চলে যা, বলে দিচ্ছে এখুনি । পালা এখান থেকে ।”
অদ্বৈতের গালমন্দ দেওয়া শেষ হলে এবার নিত্যানন্দ বলা শুরু করলেন । এতক্ষণ তিনি সব শুনছিলেন বড় বড় চোখ করে । এবার বললেন, “আরে নাড়া ! বসে থাকো চুপ করে । পড়ে কিলাবে । আগে তোমায় আমার প্রতাপ দেখাই ! বুড়ো বামনা ! ভয় করে না, না তোমার ! জানো ,আমি কে ? আমি ঠাকুরের ভাই, মত্ত অবধূত । আর তুমি হলে গিয়ে স্ত্রী-পুত্র সমেত সংসারী মানুষ । জানো, আমি পরমহংসের পথের অধিকারী জন । আমি তোমায় যদি মারিও তাও তোমার অধিকার নেই কিছু বলার । কেন অকারণে আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে এসেছো ? বৃথা গর্ব দেখাচ্ছো ! আস্ফালন করছো ! কী ক্ষমতা তোমার !”
নিত্যানন্দের কথা শুনেই অদ্বৈত যেন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন । বললেন, “দিগম্বর হয়ে থাকো ! মৎস খাও, মাংস খাও—- কোথাকার সন্ন্যাসী এমন করে শুনি ! কোথায় তোমার পিতা, কোথায় মাতা, কোন দেশেই বা তোমার বসতি ? কেউ কী জানে তোমার ব্যাপারে কিছু, কেউ জানে না ! কোথা থেকে এক চোর এসেছে ! —-সর্বক্ষণ খাব, গিলবো, সংহার করবো এসব বলে চলেছে ! আরে সন্ন্যাসী তো তাকে বলা হয় যে কিছু চায় না । আর তুমি তো এমন যে একবেলায় তিন-তিনবার খাও। শ্রীবাস পন্ডিতের জাতি-জ্ঞান সব গেছে, কোথাকার এক অবধূতকে ঠাঁই দিয়েছে নিজের গৃহে ! এই অবধূতই সকল জাতি নাশ করলো ওর । কোথা থেকে মদ‍্যপ এসে বসে পড়েছে !” —-এভাবে কৃষ্ণপ্রেম সুধারসে কলহমত্ত হলেন দু’জন ।
কলহ করেন সর্বক্ষণ দু’জন–নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত । অথচ এঁনাদের একজনের পক্ষ হয়ে কিছু বললে, অন্য জনের নিন্দা করলে তার ভক্তি ক্ষয় হয়—- পতন হয় তার । নিত্যানন্দ-অদ্বৈতের কলহ হচ্ছে প্রেমকলহ । এই প্রেমকলহের মর্ম না জেনে একজনের প্রশংসা, অপরজনের বন্দনা করলে—- সে পুড়ে মরে নরকে । আবার শুধু তাই নয়, যদি এমনও হয় যে, অদ্বৈতের পক্ষ হয়ে বললো আর গদাধরের নিন্দা করলো —-সেক্ষেত্রেও একই ব‍্যাপার ঘটে । সে কখনও অদ্বৈত-কিঙ্কর হতে পারে না । ঈশ্বর ঈশ্বরেরই কলহের পাত্র —-এখানে । এসবই তো বিষ্ণু-বৈষ্ণবের বৈভবের লীলা । বিষ্ণু ও বৈষ্ণব সমান দুই । অথচ পাষণ্ডী নিন্দুক যারা, তারা এই বৈভবকে বিপর্য‍য় ভাবে । যাঁরা সকল বৈষ্ণবের প্রতি অভেদ দৃষ্টি দিয়ে শ্রদ্ধা করে তারাই তো ভবতরণী তরতে পারে ।
শ্রীমন্ মহাপ্রভুর এই বিশ্বরূপ দর্শন দান লীলা যাঁরা শোনেন, পাঠ করেন, বিশ্বাস করেন—- তাঁরা কৃষ্ণধন প্রাপ্ত হন ।
(সংকলিত)
গ্রন্থ – মহাপ্রভুর মধুময় কথা
প্রকাশক – তথাগত
প্রাপ্তি–8100673093 তে হোয়াটসঅ্যাপ

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

বৃন্দাবনের পথে শ্রীজাহ্নবার অদ্ভুত লীলা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীনিত‍্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবাদেবী প্রথম বার যখন বৃন্দাবন গমন করেন সেটা ছিল সম্ভবতঃ ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দের (১৪৮২ শকাব্দ) মাঘ মাস। সহযাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থরচনাকার নিত্যানন্দ দাস, উদ্ধারণ দত্ত প্রমুখ। আর দ্বিতীয়বার ব্রজে পদার্পণ করেন ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে (১৫০৪ শকাব্দ) খেতু্রীর উৎসবের পরে। সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পদকর্তা গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস, ভাস্কর নয়ন মিশ্র, পরমেশ্বর দাস প্রমুখ। দ্বিতীয়বার যাত্রাপথে জাহ্নবা মাতা অনেক অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেন। পথের মধ্যে রাত্রিযাপন কালে এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন যখন, সেসময় স্থানীয় কিছু নিন্দুক গ্রামবাসী লক্ষ্য করেন যে, সঙ্গীরা সকলে এক রমণীর (জাহ্নবাদেবীর) চরণে প্রণত হচ্ছেন। এ ঘটনায় তাঁরা অত্যন্ত আশ্চর্য ও ক্ষুব্ধ হলেন। কারণ চন্ডীদেবীর পরিবর্তে কোন মানুষীর চরণে শরণাগত হয়েছিল সঙ্গীরা সকলে। তাই তাঁরা গ্রাম মধ‍্যস্থ চন্ডীমন্ডপে চন্ডীমাতার কাছে নালিশ করলেন যে, যারা দেবীর পরিবর্তে মানুষের চরণে পতিত হয় তাদের যেন তিনি সংহার করেন অবিলম্বে। শাস্তি বিধান অত্যন্ত প্রয়োজন। এমন বলে যখন তাঁরা নিদ্রায় গেলেন তখন ক্রোধিত দেবী চণ্ডী তাঁদেরকে স্বপ্নাদেশ দিলেন –“জাহ্নবাকে নারীজ্ঞানে অবহেলা করছো তো, তোমাদের মুণ্ডছেদন করবো আমি ! মহিমা না জেনে ধিক্কার করছো তাঁর! মানুষী জ্ঞান করছো! কিন্তু তিনি আমারও প্রণম‍্য। কাল প্রভাতেই অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইবে তাঁর কাছে। না হলে, আমি তোমাদের সংহার করবো।” নিন্দুকেরা সকলে পরদিবস প্রভাতেই মাতার চরণে পড়লেন। দোষ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন। ঈশ্বরী জাহ্নবা সন্তান জ্ঞানে সকলকে কাছে টেনে নিয়ে কৃপা করলেন। প্রত‍্যক্ষদর্শী নিত্যানন্দ দাসের বিবরণ অনুযায়ী এমন আরও এক অলৌকিক লীলা করেন জাহ্নবা ঠাকুরাণী পথে।

কুতুবুদ্দিন নামক এক দস‍্যুদলপতি নিজের সঙ্গীদের নিয়ে রাতে ডাকাতি করতে আসেন যে গৃহে জাহ্নবা মাতা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই গৃহেই। কিন্তু, ডাকাতদল সারারাত ধরে ঘুরেও পথ খুঁজে পেলেন না গৃহে প্রবেশের। গৃহের চারিদিকে বিশালাকার ভয়ংকর সব সর্প ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গৃহের দিকে এগোতেই ছুটে আসছিল সর্পরা দংশন করতে। রাত্রি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু প্রতীক্ষা ব্যর্থ হল। কিছুই করতে পারলেন না তাঁরা। শেষরাত্রে দৈববাণী হল—-“ঠাকুরাণীই তোমাদের জব্দ করলেন।” কুতুবুদ্দীন তাঁর সঙ্গীসাথীসমেত মাতার চরণে শরণ নিয়ে ক্ষমা চাইলেন। জাহ্নবাদেবী নামপ্রেম দিয়ে তাঁদের অযাচিত কৃপা করলেন।
এভাবে, পথে নানা পতিত উদ্ধার লীলা করতে করতে জাহ্নবা মাতা গণসমেত শুভাগমন করলেন মথুরায়। সেখান থেকে ব্রজে। শ্রীজীব গোস্বামী জাহ্নবাদেবী ও তাঁর সঙ্গীদের বাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। ঈশ্বরীর আগমনে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দ যারপরনাই আনন্দিত হলেন। গোপাল ভট্ট, ভূগর্ভ গোস্বামী, লোকনাথ গোস্বামী, মধু পন্ডিত, কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী প্রমুখ মহাজনরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করলেন। জাহ্নবা মাতা যে কতখানি সম্ভ্রম-সম্মান নিজ গুণে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দের থেকে অর্জন করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ দুটি উদাহরণ দেওয়া যায় –(১) ঈশ্বরীর দ্বিতীয়বার বৃন্দাবন আগমনের পূর্বে যখন শ্রীনিবাস আচার্য বৃন্দাবন থেকে গৌড়ে গমন করবেন, তখন শ্রীগোপাল ভট্ট তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তিনি যেন গৌড়ে ফিরে জাহ্নবা মাতাকে বৃদ্ধ গোপাল ভট্টের খেদোক্তির কথা জানান –“ঈশ্বরীর পদযুগ না দেখিনু আর।” (প্রেমবিলাস , ৬ বিলাস)। আসলে অসুস্থ গোপাল ভট্টের বয়স হয়েছিল। তাই তাঁর শঙ্কা ছিল যে জাহ্নবা মাতার চরণ দর্শনের সৌভাগ্য বোধহয় আর এ জীবনে হবে না তাঁর। তাই তিনি অমন বিলাপ করেছিলেন।
(২) যখন প্রথমবার জাহ্নবা মাতা ব্রজে যান তখন রাধাকুণ্ড নিবাসী রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পর্ব ঘটেনি। তাই তিনি দ্বিতীয়বার ব্রজে আসছেন শুনে চলচ্ছক্তিরহিত বৃদ্ধ দাস গোস্বামীজী নিজে প্রেরণ করেন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ ও অন্যান্য বৈষ্ণববৃন্দকে , যাতে তাঁরা ব্রজ থেকে সসম্মানে জাহ্নবা মাতাকে রাধাকুণ্ডে নিয়ে আসেন। জাহ্নবাদেবী কৃপাদর্শন দান করে ধন্য করবেন দাস গোস্বামীজীকে তাহলে।
রন্ধন পটিয়সী দেবী জাহ্নবা বৃন্দাবনে আপন হস্তে ভোগ রন্ধন করে শ্রীগোবিন্দ, গোপীনাথ, মদনমোহন,রাধাদামোদর ও রাধারমণ –এই ছয় বিগ্রহকেই ভোগ নিবেদন করতেন। তারপর সেই প্রসাদামৃত ব্রজবাসীদের বিতরণ করে দিতেন। সকলেই সে সুস্বাদু প্রসাদ আস্বাদন করে ধন্য হতেন, তৃপ্ত হতেন।

ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবার রাতুল চরণে অধমা রাধাবিনোদিনীর ভক্তিপূর্ণ প্রাণের প্রণতি নিবেদিত হল ।

সমাপ্ত

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

সম্বন্ধ : রাণু সরকার।

এক ঘটক তার মেয়েকে বিয়ে দেবে পাত্রের ভীষণ দরকার, তার একটি মেয়ে আছে দেখতে বিশেষ ভালো না বলে অভাব হচ্ছে পাত্রের। তার স্ত্রী বলে বলে কানের পোকা বেরকরে দিচ্ছে- বলছে স্বামী মেয়ের বিয়ের দিন পার হচ্ছে কবে বিয়ে দেবে?
মেয়ে তো শেয়ানা হয়েছে এর পরে বিয়ে দিতে কষ্ট হবে।
ছেলে একটা তো দেখে এলাম মাইনা একটু কম পায়,
ছেলেকে দেখে যখন বেরোলাম গিন্নী কি বলবো- পাশের বাড়ির একটি মেয়ে নাম তার টেপি সে এসে বললো হর দম নাকি নেশা করে কি করি বলতো গিন্নী।

আর মাস খানেক দেখবো ,তারপর যাকে পাবো তার সাথেই দেবো বিয়ে-
তুমি এতো চিৎকার করো গিন্নী তোমার ভয়ে ভয়ে মুখ বুঁজে থাকতে হয় আমার।
আর একটি দেখেছি ছেলে,মাইনা যদিও বা পায় একটু বেশি কিন্তু বংশটা একদমই ভালো না ভাবছি কি করা যায়।
শোন গিন্নী, বংশ মাইনা সব যদি ঠিকঠাক মিলে যায় তবেই দেবো বিয়ে।
আমাদের জমির কিছু অংশ দেবো বেঁচে কি বলো?
কেনো না ছেলে ভালো হলে পণ সোনা সবই চাইবে তাই না?
আর একটি ছেলে আছে,শুনেছি বংশটা ভালো ওর ভাগ্যে থাকলে রানী হয়ে থাকতে পারবে।
এখন ভালো সহজ সরল ছেলে কোথায় আছে বলো দেখি শুনি?
এখনের ছেলেরা-প্রেমের শিকারি মদ মাতাল আর কখনো খুন টুন ও করে শুনি।
জেনে শুনে দিতে পারি কিরবো বলো? মেয়ে আমাদের একটু কমজুড়ি দেখতেও ভালো না কি করে যে হলো এমন ভাবতেই পারিনা গিন্নী।

মেয়ে তো আমাদের একটু আবা প্রেমটেম ওসব কিছুই বুঝবে না তাই বলো স্বামী?
চালাক যদি হতো আজ অব্দি-একলা কি থাকতো বল গিন্নী? ঠিক একটা না একটা ছেলে পটিয়ে ফেলতো।

আমি আর গিন্নী মেয়ের পাত্রের আলোচনা করছিলাম
হঠাৎই দরজাতে টুট টুট শব্দ খুলে দেখি মেয়ের সাথে মাঝ বয়সি এক ছেলে,একদম হাঁদা,বোকা দাঁত কিছু আছে ওই ফোকলা দাঁতে হাসছে। দুজনার গায়ে
বিয়ের পোশাক কিজানি ওগো গিন্নী ভুল দেখছি নাতো।
মেয়ে বলছে এই তোমাদের জামাই মা- তোমরা মোটেও ভুল দেখনিকো।
দেখতে কত সুন্দর তাই না মা? মা একটু তাকি হু বললো, দেখেছো মা হাজার টাকা কামাই করে কিন্তু একটাও দাঁত নেই সবাই ছিছি বলে চলে গেলো।
হাজার টাকা মাইনে পায় শুনে-জ্ঞান হারালো গিন্নী স্বামী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
এর মধ্যেই পাড়া পড়শির কানে গেলো-সবাই এসে হাজির, বললো সবাই হাঁদা বোকা মেয়ে তোমার যা করেছে ঠিক করেছে, ভোজের জন্য করো সবাইকে আহ্বান।

Share This
Categories
গল্প

ভাগ্যহীনা : রাণু সরকার।

মেয়েটির সবে বড় বেলা হয়েছে সুরু, ঘুরে ঘুরে বেড়ায় যে যা দেয় তাই খায়,মাঝে মাঝে হোটেল বাসন মাজে ওখানেই থাকে। একদিন এক বৃদ্ধ এসেছে ঐ হোটেলে খেতে মেয়েটি টেবিল মুছছিলো দেখে ভীষণ কষ্ট হলো বৃদ্ধের।
বৃদ্ধের আবার দেখার কেউ থেকেও নেই। মেয়েটিকে দেখে বৃদ্ধের মায়া হওয়াতে মেয়েটিকে বললো আমার সাথে যাবি আমার বাড়ি? ভালো থাকবি খাওয়া পড়া পাবি আমার ঘরের সব কাজ করবি, মেয়েটি বললো যাবো তখন মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করলো তোর নাম কি?একটু হেসে বললো আমার নাম অভাগী বৃদ্ধ বললো এটা আবার কেমন নাম? হ্যাঁগো বাবু এটাই আমার নাম ।
আমার বাবটা মাটাকে ছেড়ে চলে গেলো সেই দুঃখে হয়তো মাটা মরে গেলো,
তখন থেকেই সবাই আমায় অভাগী বলে ডাকে,

থাক তোর কথা আর বলতে হবে না সব বুঝেছি তুই চল আমার সাথে।
অভাগী চলে এলো বৃদ্ধার বাড়ি বৃদ্ধা ভীষণ ভালোবাসতো মেয়েটিকে যা চাই তো সে তাই দিতো ধীরে ধীরে মেয়েটি বড় হলো। বৃদ্ধার একটু লোভ হলো মেয়েটির প্রতি। বৃদ্ধা ভীষণ অসুস্থ একরকম বিছানা নিয়েছে বলা চলে।মেয়েটির দোকান বাজার সব করতে হয় নিজের হাতে। এই দোকান বাজার যেতে আসতে একজনের সাথে তার ভালোবাসা হলো বৃদ্ধ সেটা জানতো না। একদিন বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে-এই অভাগী, তোর আগুন জোড়া হাত-
আমার বুকে একটু স্পর্শ করবি একটিবার কর না আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে
তোর উষ্ণতা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।
এই অভাগী,কোথায় গেলি আমার কাছে আয় না একবার।

উফ্! কুঁজোর সাধ জেগেছে চিৎ হয়ে শোবার,
আমার নারীত্বের এক টুকরোও ছিঁড়তে দেবোনা- আমি চলে যাবো এখান থেকে।
কোন চুলোয় যাবিরে মাগি? তুমি আমায় গাল দিচ্ছো? হ্যাঁ দিচ্ছি তো তোর জন্য এতো করলাম বড়ও করলাম আমার মুখে মুখে কথা?
তোর মুখে নুড়ো জ্বেলে দেবো,ছিলি তো রাস্তায়-এখানে তো হলি ডাগর ডুগোর কোন মরদ আছে তোর বল তো-আমায়?

মেয়েটি রাগ করে চলে যাচ্ছে, বলছে খাব না আর তোমার ভাত,এই আমি চললাম
তোমার মনে মনে এই ছিলো?
যাস নে অভাগী আমি এই আছি এই নেই-
আমার চাওটা কি খুব বেশি হলো?
উত্তর দে- কিনা দিয়েছি তোকে,যখন যা চাইছিস তাই পেয়েছিস।
অভাগী শুনোলো না চলে গেলো বুড়োকে একা রেখে-
তার নারীত্বের একটুরোও দেবে না,
মরদ ঠিক করা আছে যে তার।

কিছুদিন চললো মরদের সাথে ভরা যৌবন খেলা।মরদের সংসার আছে যে-মেয়টির নারীত্ব গেলো সে মা হতে চলেছে আর ভালো লাগছে না মরদের মারধর করে দিলো তাড়িয়ে।
এলো গর্ভবতী হয়ে বুড়োর দ্বারে,এসে দেখে বুড়ো মরে আছে, পাড়ার মানুষ তাকে থাকতে দেবে কেনো?
সেই আগের জায়গায় তাকে ফিরে যেত হলো।

Share This
Categories
উপন্যাস গল্প

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাসঃঅন্তিম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

তানিশা পল্লীদহ গ্রামের চয়ন হালদারকে বিয়ে করলো । গাঁয়ে চয়নের মুদিখানার দোকান । ভীষণ চালু দোকান । চয়নের সাথে তানিশার পরিচয় ছোটবেলা থেকে । কিন্তু মাঝখানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল । কিন্তু সাগরের সাথে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর তানিশা নিয়মিত চয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো, যেটা বাড়িতে কেউ টের পায়নি । তানিশাকে অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে পেয়ে খুশীতে বিহ্বল । অন্যদিকে তানিশার বিয়ে হওয়ায় কঙ্কাবতী স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ।
তারপর …………?
তারপর তার মোবাইলে থানা থেকে হঠাৎ ফোন পেয়ে কঙ্কাবতী চমকে উঠলো । নিয়ামতপুর থানা থেকে স্বয়ং বড়বাবুর ফোন । ভয়ে ভীতিতে কঙ্কাবতী আমতা আমতা করে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আমাদের অপরাধ ?”
থানার বড়বাবু উত্তরে বললেন, “আপনি থানায় আসুন ! থানায় দেখা করলে টের পাবেন আপনার অপরাধ কী ?” থানার বড়বাবু আরও নির্দিষ্ট করে বললেন, “পরেরদিন সকাল এগারোটার মধ্যে আপনাকে থানায় আসার অনুরোধ রইল ।“
কঙ্কাবতী তার জামাইদের ডাকলো । সন্ধ্যায় কঙ্কাবতীর বাড়িতে চার মেয়ে ও চার জামাই এবং দুই ছেলে ও বৌমা উপস্থিত । কঙ্কাবতী সবাইকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করলো, তারা কোনো গর্হিত কাজ করেছে কিনা ? যার জন্য বড়বাবুর হঠাৎ তলব ! আলোচনায় কঙ্কাবতী বুঝতে পারলো, তার মেয়ে-জামাই এমনকি ছেলে-বৌমারা কেউ কোনো অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত নেই । সুতরাং কঙ্কাবতী নিশ্চিন্ত, তাদের পরিবারের কেউ কোনো অপরাধমূলক কাজ করেনি । এমনকি কোনো অপরাধমূলক কাজের ষড়যন্ত্রেও তারা যুক্ত নয় । তাই কঙ্কাবতী ঠিক করলো, পরিবারের সকলে দল বেঁধে থানায় যাবে । বিনা অপরাধে বড়বাবুর কেন তলব ?
পরেরদিন সকালবেলা । রুটি ও কুমড়োর তরকারি রেডি । সবাই রুটি তরকারি খেয়ে চায়ের জন্য অপেক্ষারত ! নতুন বৌ লতা চা বানালো । চায়ের চুমুক দিয়ে ঘোতন সকলের উদ্দেশে বলল, “আর দেরী করা যাবে না । পরের ট্রেনটা মিঁয়া হল্টে ঠিক নটা দশ মিনিটে । ঐ ট্রেন যেভাবে হোক পেতে হবে । নতুবা অনেক দেরী হয়ে যাবে ।“
মিঁয়া থেকে সালার । সালার স্টেশনে নেমে বাসে নিয়ামতপুর থানা ।
বাড়ি থেকে বের হতে যাবে ঠিক সেই সময় চঞ্চল বটব্যাল এসে হাজির । চঞ্চল বটব্যাল পাশের গ্রামে বাস করেন । তিনি পুলিশের বড় অফিসার । এতকাল উত্তরবঙ্গে পোস্টিংয়ে ছিলেন । খুব সম্প্রতি তিনি নিয়ামতপুর থানায় বদলী হয়ে এসেছেন । গাঁয়ে তাঁর অনেক জমি জায়গা । এলাকার মানুষ তাঁকে সমীহ করে চলেন । কঙ্কাবতী শুনেছে, চঞ্চল বটব্যাল নাকি নিয়ামতপুর থানার মেজবাবু । কিন্তু কঙ্কাবতী ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, তাঁর মতো নামজাদা পুলিশ অফিসার তার বাড়িতে আসবে । তাই চঞ্চল বটব্যালকে দেখে কঙ্কাবতী তাঁকে আপ্যয়ন করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো ।
কঙ্কাবতীর ব্যতিব্যস্ততা দেখে চঞ্চলবাবু বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না । বরং যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যাওয়ার প্রতি ধ্যান দিন ।“
“তা হয় নাকি ! আপনি জীবনে প্রথম আমাদের মতো গরীবের বাড়িতে পা রাখলেন । সুতরাং আপনাকে একটিবারের জন্য হলেও বসতে হবে । আপনাকে চা খেয়ে যেতে হবে । দরকার হলে, থানায় একটু পরে যাবো ।“
“উহুঁ ! থানায় যেতে দেরী করবেন না । সেই কথা বলতেই আমার আসা । থানায় আপনাকে আর্জেন্ট দরকার ।“ চঞ্চল বটব্যাল জোর দিয়ে কঙ্কাবতীকে বললেন ।
সাহস পেয়ে কঙ্কাবতী চঞ্চলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “থানায় কেন আমার মতো গরীব মানুষের হঠাৎ তলব ? আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না ! বিপদের কথা ভেবে গত রাত্রিতে আমার ঘুম হয়নি । থানায় আমাকে তলব কেন, জানালে আশ্বস্থ হতাম ।“
আমি কিচ্ছু জানি না । আমাকে বড়বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং আপনাকে থানায় সঠিক সময়ে পৌঁছানোর জন্য বলেছেন ।
কঙ্কাবতী পুনরায় চঞ্চল বটব্যালবাবুকে বলল, “স্যার, আমার বড্ড ভয় করছে ! জীবনে এভাবে থানা থেকে আমাকে কোনোদিন ডাকেনি । এমনকি কোনো প্রশাসনিক দপ্তর থেকেও এভাবে ডাক পাইনি ।“
“আপনি অযথা উতলা হবেন না । থানার বড়বাবু ভীষণ ভদ্র মানুষ । আপনাদের কোনোরকম অসুবিধা হবে না ।“ চঞ্চলবাবু কঙ্কাবতীকে আশ্বস্ত করলেন । তারপর তিনি বাড়ির দিকে রওনা দিলেন ।
আর কালবিলম্ব না করে কঙ্কাবতী তার চার মেয়ে ও চার জামাই এবং দুই ছেলে ও দুই বৌমা এবং স্বামী অনিন্দ্যকে নিয়ে নিয়ামতপুরের দিকে রওনা দিলো । পরিবারের সবাইকে নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য, যদিও বিপদজনক কিছু ঘটে তবে সকলে মিলে থানার বড়বাবুর চেম্বারের বাইরে ধর্ণায় বসবে । নিরপরাধ মানুষকে ডেকে এনে কেন হুজ্জুতি ? কঙ্কাবতীর দূরদৃষ্টি সাংঘাতিক । বিপদে পড়লে নিজের লোকেরাই পাশে দাঁড়াবে । পাড়া প্রতিবেশীরা সমালোচনায় সিদ্ধহস্ত, অথচ বিপদে পড়লে তাঁরা বরং মুখটা ঘুরিয়ে নেয় । বেশী করে কটুকথা শোনায় । তাঁদের ভাবটা এমন, আমরা যতো বিপদে পড়বো ততো তাদের শান্তি !
সালারে পৌঁছে কী বিপদ ! নিয়ামতপুর যাওয়ার কোনো বাস নেই । বাস ধর্মঘট । সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত । সালার থেকে নিয়ামতপুর যাওয়ার রাস্তা খুব বেশী নয় । খুব বেশী সময় লাগলে, লাগবে আধা ঘন্টা । সকাল দশটা বাজে । কীভাবে পৌঁছাবে সেই চিন্তায় কঙ্কাবতী অস্থির । বাড়িতে এসে থানার মেজবাবু বলে গেছেন, ঠিক সময়ে থানায় পৌঁছাতে । অথচ যাতায়াতের কোনো যানবাহন নেই । সালার থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করলে, অনেক টাকা খরচ ! তারা সংখ্যায় অনেক । বড় গাড়ি দরকার ! কঙ্কাবতী ঠাহর করতে পারছে না, তারা এখন কীভাবে পৌঁছাবে ?
ইত্যবসরে বড়বাবুর টেলিফোন, “হ্যালো ! আমি কি কঙ্কাবতী ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলছি ?”
মায়ের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মনীষা পাল্টা জানতে চাইলো, “আপনি কে বলছেন ?”
“আমি নিয়ামতপুর থানার বড়বাবু বলছি ।“
“নমস্কার স্যার । আমি কঙ্কাবতীর মেয়ে বলছি । ট্রেন থেকে নেমে আমরা সালারে আটকে গেছি । বাস ধর্মঘট ! নিয়ামতপুর পৌঁছানোর কোনো যানবাহন নেই । কী করব, ঠিক বুঝতে পারছি না ।“
আপনারা একসঙ্গে কতোজন আছেন ?
আমরা পরিবারের সবাই আছি । সংখ্যায় ১৪জন । বড় বৌদি আবার সন্তান সম্ভাবনা । যার জন্য আরও চিন্তা !
বড়বাবু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “এই মুহূর্তে আপনারা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন ?”
আমরা স্টেশন লাগোয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি ।
“আপনারা সকলে সালার স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়ান । সালার থানা থেকে পুলিশের গাড়িতে আপনাদের নিয়ামতপুরে পৌঁছে দেবে ।“ বড়বাবু তারপর লাইন কেটে দিলেন ।
কঙ্কাবতী আরও শঙ্কিত, কী বিপদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ! পুলিশ নিজ দায়িত্বে তাদের থানায় নিয়ে যাচ্ছে । অনিন্দ্য যতোবার বোঝাবার চেষ্টা করছে, আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। সুতরাং ভয়ের কোনো কারণ নেই । তবুও কঙ্কাবতীর আশঙ্কার ধন্দে কাটছে না । ভয়ে বরং বলা চলে গুটিয়ে রয়েছে । অথচ থানার বড়বাবুর ডাককে উপেক্ষা করতে পারছে না । ঘোতনও মাকে বোঝাচ্ছে, “তুমি অযথা চিন্তা করছো ? নিশ্চয় বড়বাবু কোনো কাজের কথাবার্তার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন !”
ইতিমধ্যে সালার থানা থেকে পুলিশের দুখানি জিপ গাড়ি এসে হাজির ।
জেলার মধ্যে নিয়ামতপুর থানা একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরানো থানা । আশেপাশে অনেক লোকজন ও দোকানপাট । এলাকায় হিন্দু-মুসলমান সব শ্রেণীয় মানুষের বসবাস । তবুও মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট । এই ব্যাপারে থানার ভূমিকা অনস্বীকার্য । নিয়ামতপুরে রয়েছে ব্লক অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আরও অসংখ্য ছোট ছোট অফিস । যার জন্য মহাকুমার মধ্যে নিয়ামতপুরের গুরুত্ব অপরিসীম ।
থানায় নামার সাথে সাথে ভয়ে কঙ্কাবতীর বুক ধড়ফড় !
থানার সামনে নীল-লাল বাতি লাগানো বেশ কয়েকটা গাড়ি । গাড়ি দেখে কঙ্কাবতীর আরও ভয় পেয়ে গেলো । অনিন্দ্যকে বলল, “আমাকে এক গ্লাস জল খাওয়াও ।“
অনিন্দ্য তড়িঘড়ি দোকান থেকে দশ টাকা দিয়ে জলের বোতল এনে কঙ্কাবতীকে খাওয়ালো । তারপর তার তেষ্টা মেটে ।
চঞ্চল বটব্যাল হাসতে হাসতে কঙ্কাবতীর কাছে উপস্থিত । তিনি কঙ্কাবতীকে বললেন, “আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি ।“
কঙ্কাবতী তখনও ভয়ে জড়সড় । কঙ্কাবতীর আড়ষ্টতা অবলোকন করে চঞ্চলবাবু আবার বললেন, “ম্যাডাম, ভয়ের ব্যাপার নয় । আপনি আপনার কথা নির্ভয়ে বলবেন । এখন আমার সঙ্গে চলুন ।“
আপনার সঙ্গে কোথায় যাব ?
বড়বাবুর চেম্বারে ।
আমার স্বামী ও পরিবারের লোকজন কখন যাবে ?
আপনি ভিতরে ঢুকে স্যারকে বলবেন, “আপনার পরিবারের লোকজন আপনার সঙ্গে আলোচনায় থাকতে চায় ? তিনি সানন্দে সম্মতি জানাবেন । কিন্তু এই মুহুর্তে আপনি একা আমার সাথে বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকুন । কেননা সেখানে জেলার অনেক উচ্চপদস্থ আধিকারিকগণ বসে আছেন । বড়বাবুর অনুমতি ব্যতিরিকে পরিবারের লোকজন চেম্বারে ঢোকাটা শোভনীয় হবে না । আর সময় নষ্ট করবেন না । আমার সঙ্গে চলুন ।“
বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকে দুই হাত জড়ো করে কঙ্কাবতী বলল, “নমস্কার স্যার ।“
“বসুন ।“ হাত দিয়ে চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন বড়বাবু । বড়বাবুর নির্দেশ মতো কঙ্কাবতী চেয়ারে বসলো ।
তারপর বড়বাবু আবার বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই । আপনার পাশে রয়েছেন এলাকার বি ডি ও সাহেব এবং একেবারে সামনে রয়েছেন মহাকুমা শাসক এবং বা-পাশে রয়েছেন অতিরিক্ত জেলা শাসক । আপনাকে এখানে ডাকার কারণ এবার খুলে বলি ।
কঙ্কাবতী বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আলোচনার মধ্যে আমার পরিবারের লোকজন থাকলে ভাল হয় ।“
“অবশ্যই তারা থাকবেন ।“ বড়বাবু তারপর চঞ্চলবাবুকে বললেন, “কঙ্কাবতীর সাথে যারা এসেছেন, সবাইকে ডাকুন ।“
একদিকে জেলা প্রশাসনের মানুষজন বসেছেন এবং ঠিক তার উল্টোদিকে মুখোমুখি কঙ্কাবতীর বাড়ির লোকজন ।
বড়বাবু শুরু করলেন, “আপনার নাম কঙ্কাবতী ?”
হ্যাঁ স্যার ।
আপনার চার মেয়ে ও দুই ছেলে ?
“হ্যাঁ স্যার । কিন্তু স্যার, আমার বাড়ির এত খবর জানলেন কীভাবে ?” কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলো কঙ্কাবতী ।
“সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি । এবার আপনার সঙ্গে কয়েকটা জরুরি কথা সেরে নিই !” বড়বাবু হাসিমুখে কথাগুলি বলছিলেন । ঠিক তার মাঝখানে কঙ্কাবতী মুখটা ভার করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, আমি জ্ঞানত কোনো অন্যায় করিনি । আবার কী ধরনের বিপদের কথা শোনাবেন, বুঝতে পারছি না ?”
অতিরিক্ত জেলা শাসক চঞ্চলবাবুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “আপনারা ম্যাডামকে কিছু জানাননি ?”
চঞ্চলবাবু সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বললেন, “স্যার, আমাদের বড়বাবু স্যারের নির্দেশ ছিল ‘ম্যাডামকে আগেভাগে কিছু না জানাতে’ । সেই মোতাবেক আমরা ম্যাডামকে কিছুই জানাইনি ।“
এবার বড়বাবু অতিরিক্ত জেলা শাসকের দিকে তাকিয়ে বল্লেন, “ম্যাডামকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য খবরটা জানাইনি ।“
তারপর অতিরিক্ত জেলা শাসক কঙ্কাবতীর কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি বসুন ম্যাডাম । বড়বাবু একটা ভাল খবর শোনাবেন । যে খবরটার জন্য আমরা জেলার মানুষ গর্বিত ।“
বাড়ির সকলের দৃষ্টি এখন বড়বাবুর দিকে ।
বড়বাবু আবার শুরু করলেন, “ম্যাডাম, আপনি সমস্ত প্রতিকুলতা কাটিয়ে যেভাবে আপনার চার মেয়েকে মানুষ করেছেন এবং তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছেন, তার স্বীকৃতি স্বরূপ কেন্দ্রিয় সরকার আপনাকে “নারীশক্তি” সম্মাননা দিয়ে সম্মান জানাবেন । এটি একটা বিরল সম্মান । আমাদের রাজ্য থেকে একমাত্র আপনি সেটা পাচ্ছেন ।“
খবরটা জানানোর সাথে সাথে সকল প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে কঙ্কাবতীকে সম্মান জানালো । কঙ্কাবতী তখন তার চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না । স্পটেই কেদে দিলো । পরিবারের সবাই তখন কঙ্কাবতীকে জড়িয়ে ধরে আবেগে উচ্ছ্বাসে আনন্দাশ্রুতে বিহ্বল ।
————-০—————

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

ফাগুরঙ্গে মাতল নাগর-নাগরী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীশ্যামনাগর আজ নাগরিমণি শ্রীরাধাকে নিয়ে হোরীরঙ্গে মেতেছেন। ব্রজগোপিনীরা সে রঙ্গলীলায় অনুঘটক । রাধারমণ রমণীমনচোরা রাসবিহারী নওলকিশোর কানু, ফাগুয়া অঙ্গে মেখে ও মাখাতে মহানায়ক হয়েছেন । ব্রজসুন্দরীগণ তাঁকে মন্ডলী-মন্ডলী করে চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছেন আর মধ্যখানে মনমোহনিয়া মুরলীমনোহর আজ সেই ব্রজরামাদের মনোভাব বুঝে ভরিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের ঘনপরিরম্ভনে,চুম্বনে, সোহাগের পরশে-হরষে।

নটন বিভঙ্গে ফাগুরঙ্গে মাতল
নাগর অভিনব নাগরি সঙ্গ।
ঋতুপতি রীত চীত উমতায়ল
হেরি নবীন বৃন্দাবন রঙ্গ ৷৷
ফাগুয়া খেলত নওল কিশোর।
রাধারমণ রমণীমনচোর ।। ধ্রু॥
সুন্দরিবৃন্দ- করে কর মণ্ডিত
মণ্ডলি মণ্ডলি মাঝহি মাঝ ৷
নাচত নারিগণ ঘনপরিরম্ভণ
চুম্বন লুবধল নটবর রাজ॥
কানুপরশ রসে অবশ রমণিগণ
অঙ্গে অঙ্গে মিলি ঝাঁপি রহু।
পূরল সবহুঁ মনোরথ মনোভব
মোহন গোবিন্দদাসিয়া পহু।।

ফাল্গুনী পূর্ণিমায় হোরীলীলা বা হোলিখেলা আদপে প্রেম প্রদানের উৎসব। প্রেমের বৈচিত্র্যময় ভাবের মূর্তিমন্ত রূপই হল যেন নানান রঙের আবীর আর ফাগ। মুঠো মুঠো ফাগ ছুঁড়ে ,রঙ মাখিয়ে যেন সেই প্রেমকেই নতুন করে নিবেদন করা মনের মানুষটিকে,কাছের জনকে । প্রাণ ভরে সারাদিন অক্লান্ত হোরি খেলে খানিক জিরিয়ে নিতে দোলনায় বসে দোল খান শ্রীরাধাকৃষ্ণ। তাই ,এ উৎসবের আর এক নাম দোলযাত্রা ,একথা মনে হলেও ,আদপে সেটি নয় । দোলযাত্রার ইতিহাস আরও হাজার হাজার বৎসর পূর্বে—সেই ঋকবেদের সময়কালের, অর্থাৎ সাত-আট হাজার বৎসর পূর্বের।

উত্তরায়ণের আগমনে নতুন বছরের সূচনা রূপে আর্য ঋষিরা এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বিষ্ণুর পূজা করতেন। পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চারকারী সূর্যকে সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুরই প্রতিভূ মেনে তাঁরা সে পূজায় নারায়ণ শিলাকে উত্তর দক্ষিণে তিনবার ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দোল দিতেন,যাতে আগামী বৎসরেও সূর্যের যাত্রা নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয় উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়নকে মাধ্যম করে। আর তাই নাম দোলযাত্রা।

সাত-আট হাজার পূর্বের দোলোৎসব পূজাই পরবর্তীতে হয় হোলি বা হোরীলীলা । দোলযাত্রা হল বছরে একটি নয় দুটি— একটি দোল পূর্ণিমায় অপরটি শ্রাবণী পূর্ণিমায় হিন্দোলযাত্রা বা ঝুলনযাত্রা। দোল অর্থাৎ দোলন আর যাত্রা অর্থে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গমন । অতএব, দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা। যেমন রথযাত্রা বা ঝুলনযাত্রা। একটা কথা মনে দোলা দিতে পারে যে দেবী দুর্গাও তো যাত্রা করেন পতিগৃহ থেকে পিতারগৃহে কিছুদিনের জন্য । তবে কেন আমরা দুর্গাযাত্রা বলি না। আসলে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালির উৎসব এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে তা দুর্গোৎসব নামেই যথার্থতা পায়। আর, তাছাড়া যাত্রা শব্দটি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর গমনের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে। ফিরে আসি দোলযাত্রার কথায়,ব্রজের হোলিতে।

এই প্রেমের উৎসবের আগমণী সুর কিন্তু ফুলেরা দুজের দিনই ধ্বনিত হয়ে যায় বৃন্দাবন আর মথুরায় । ‘ফুলেরা দুজ’ হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা-মঞ্চের তথা দোলনা প্রস্তুতির সূচনা দিবস ;যা ফাল্গুনের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে পালিত হয়। এদিন ফুলের নয়নাভিরাম সাজে সজ্জিত হন বিগ্রহগণ। মন্দিরচত্বর থেকে শুরু করে সর্বত্র ফুলের সজ্জা।মন্দিরে-মন্দিরে ,গৃহে-গৃহে হোলির গীত,নৃত্য ,নাটকের অপূর্ব উপস্থাপনা শুরু হয়ে যায় এদিন থেকেই। এরপর চতুর্থীর দিন পালিত হয় লাড্ডু হোলি‌।

মথুরার রাভেলের ভূস্বামী তথা রাধারাণীর পিতা ‘বৃষভানু’ কংসের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের মাথায় সুউচ্চ স্থানে প্রাসাদ গড়লেন । নতুন জনপদ ‘বৃষভানুপুর’(এরই অপভ্রংশ বর্ষাণা)-এর পত্তন হল।সেসময় কংসের নানান অত্যাচারে একইভাবে অতিষ্ঠ নন্দগ্রামবাসীরাও।রাজা বৃষভানু আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বন্ধু নন্দরাজা তথা শ্রীকৃষ্ণের পিতাকে; বললেন, নন্দগ্রামবাসীসমেত বৃষভানুপুরে এসে বাস করতে ।এই বসন্ত চতুর্থীর দিনেই নাকি গোপীগণের চিত্তহারী-চপল-চটুল- নওলকিশোর নন্দকুমার কৃষ্ণ তাঁর গ্রাম নন্দগাঁও থেকে রাধারাণীর গ্রাম বর্ষাণায় এসেছিলেন ।তখন তাঁদের আতিথেয়তা করা হয়েছিল লাড্ডু খাইয়ে।আর তাই,সেদিনের সেই আনন্দ দিবসের স্মরণে আজও বর্ষাণায় লাড্ডু তো খাওয়া হয়ই,তার সাথে চলতে থাকে একে অপরকে লক্ষ্য করে লাড্ডু ছোঁড়াছুঁড়ির পালা;যা লাড্ডু হোলিতে পর্যবসিত হয়। সত্যি,এহেন মিষ্টিমধুর আনন্দময় উৎসব ভারতভূমিতেই বুঝিবা সম্ভব।

ঠিক পরদিন, বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে বর্ষাণায় পালিত হয় লাঠমার হোলি , অর্থাৎ লাঠি দিয়ে মারের হোলি। পড়তে অদ্ভুত লাগছে তাই না! যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে পুরুষরা কোন বিশেষ কার্যে গ্রামে নেই, আর হঠাৎ,কংসের অত্যাচারী দুষ্টু পেয়াদারা এল বর্ষাণায়। তখন মহিলারা আত্মরক্ষা করবেন কীভাবে(!) –তার মহড়া শুরু হল সেখানে। গোপিনীরা লাঠি দিয়ে মেরে শক্তি প্রদর্শন করলেন ,আর মার খেলেন মাথায় বালির বস্তা ,হাতে ঢাল নিয়ে গোপেরা dummy সেজে। মহিলাদের সেই লাঠিখেলা আজও অব্যাহত হয়ে পালিত হয় এই লাঠমার হোলির দিন।তবে তাতে লেগেছে উৎসবের আবেশ,আমেজ আর আনন্দ। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সখারা জোর করে রঙ মাখিয়েছিলেন শ্রীরাধাসহ তাঁর সখীদের। ছদ্ম প্রণয়কোপ প্রকাশ করতে প্রফুল্লিত গোপিনীরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন লাঠি। সেই স্মৃতিতেই তো আজও নন্দগ্রাম থেকে পুরুষরা রঙ মাখাতে আসেন বর্ষাণার মহিলাদের। আর মহিলারা লাঠমার দেন মাথায় ছোট বস্তা বাঁধা,মাটির ঢাল হাতে সজ্জিত পুরুষদের। লাঠির ঘায়ে একজনের ঢাল ভেঙ্গে গেলে,অপরেরটা কেড়ে আত্মরক্ষা করে সে। এভাবে চরম হাসাহাসি,আনন্দ,উৎফুল্লতার মধ্য দিয়ে এই হোলি পালিত হয়।

তারপর ,মূল হোলির উৎসব আগত হয় ; বসন্ত পূর্ণিমার শেষলগ্নের দিন তা পালিত হয়। তবে তার আগের দিন পালিত হয় হোলিকাদহনোৎসব । দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র বালক প্রহ্লাদ ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। অনেক প্রকার চেষ্টা করেও , অনেক শিক্ষা দিয়েও যখন প্রহ্লাদের মতিগতির পরিবর্তন করা গেল না , তখন ক্ষুব্ধ হিরণ্যকশিপু স্থির করলেন দুষ্ট গোরুর থেকে শূণ্য গোয়াল ভালো— অর্থাৎ, প্রহ্লাদকে প্রাণে নিধন করবেন। কিন্তু প্রাণে মারার নানান রকম প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল । হতাশ হিরণ্যকশিপুকে দেখে শেষে ভগ্নী হোলিকা বলে বসলেন তিনি এবার হাল ধরবেন‌ । হোলিকা বরপ্রাপ্তা ছিলেন যে তাঁর অঙ্গকে অগ্নি স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি তাই প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে অগ্নিসংযোগ করিয়ে দিতে বললেন তাঁকে চতুর্দিক থেকে। জ্বলন্ত অগ্নির দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠা গ্রাসে ফল হল বিপরীত। দুষ্ট অভিসন্ধি নিয়ে স্বেচ্ছায় অঙ্গে অগ্নিসংযোগ করায় , প্রাপ্ত বর কাজে লাগলো না । হোলিকা জ্বলেপুড়ে ভস্মীভূত হল আর বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কোন ক্ষতি হল না। কথায় আছে রাখে হরি মারে কে ! আসুরী শক্তির , অশুভ উল্লাসের পরাজয় যে সর্বদা হয়— তা স্মরণ করতে ও করাতে এবং আর্য ঋষিদের দ্বারা কৃত উত্তরায়ণের নব বৎসরের দোলযাত্রা উৎসবের আগের দিন পুরাতন আবর্জনা পুড়িয়ে পরিবেশ পরিষ্কার করার ও আগত নব বৎসরের আনন্দের দ্যোতক রূপে পালিত হয় এই হোলিকাদহন উৎসব । প্রচলিত নাম চাঁচর । চাঁচর শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার চর্চরী শব্দ থেকে। অর্থ— উৎসবের হর্ষধ্বনি। খড়, বাঁশ, শরপাতা, পুরানো গাছের ডাল, তালপাতা , নারকেল পাতা—- এসব দিয়ে তৈরী করা হয় ঘরের মত করে স্তূপ। তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সেই স্তূপে অগ্নিসংযোগ করে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে হোলিকাদহনোৎসব পালন । এর অপর একটি প্রচলিত নামও আছে —-মেড়াপোড়া । আসুরী শক্তির প্রতীকী রূপে পিটুলি দিয়ে তৈরি একটি ভেড়াকে (যার নাম মেন্ডাসুর) ওই খড়ের ঘরের মধ্যে রেখে দেওয়া হতো। এই অসুর মেন্ডাকে পোড়ানো থেকেই হয় মেড়াপোড়া, যা আরও অপভ্রংশ হয়ে হয় নেড়াপোড়া। মনে পড়ছে , নেড়াপোড়ার সময় আমাদের বাংলায় প্রচলিত এক ছড়া—-আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল , পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল। উল্লেখ্য যে, সম্ভবতঃ হোলিকার নাম থেকেই হোলি উৎসব হয়েছে।

কথিত আছে, নব-নীরদ-বরণ শ্রীকৃষ্ণকে সান্ত্বনা দিতে মা যশোদা তাঁর হাতে রঙ দিয়ে বলেছিলেন, গৌরবর্ণা রাধার গাত্রে লেপন করে তাঁকে নিজের মত এক বর্ণের করে নিতে। সবান্ধব শ্রীকৃষ্ণ লুকিয়ে ছুঁড়লেন রঙ রাধা ও তাঁর সখীদের লক্ষ্য করে। গোপিনীরাই বা দমবেন কেন! তাঁরাও কলসে কাদামাটি গুলে তৎক্ষণাৎ দিলেন ঢেলে কানু আর তার গোপসখাদের মাথায়। ব্যস,মাখামাখি ,হাতাহাতি আনলো হাস্য-পরিহাস আনন্দের বন্যা। সেই থেকে রঙ দেওয়া-নেওয়া খেলার শুরু হয়ে গেল।
ফাগু খেলিতে ফাগু উঠিল গগনে।
বৃন্দাবনের তরুলতা রাতুল বরণে ।।
আবীর ,রঙ,ফাগের স্নানে সমগ্র বৃন্দাবন রেঙে ওঠে । রঙ তো নয় ,যেন হাতভর্তি মুঠো মুঠো ভালোবাসা অর্পিত হয় একে অপরের প্রতি। বর্ণবিদ্বেষকে যেন এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দেবার দ্যোতক এই দোল উৎসব। মানবের মহামিলনের ,মহানন্দের হাট বসে যেন। আবার ,এই ফাল্গুনী পূর্ণিমাতেই তো শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ তথা মধ্যযুগের বাঙলার নবজাগরণের নায়ক শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মহাবির্ভাব মর্ত্য মাঝে। সে দিন ছিল ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ,শনিবার সন্ধ্যাবেলা।

কৈছন মধুরিমা, কৈছন রাধাপ্রেম, কৈছন প্রেমে তিঁহ ভোর——অর্থাৎ, রাধার প্রেমের মাধুর্য কেমন, রাধার প্রেমই বা কেমন আর সেই প্রেম আস্বাদন করে রাধা কী জাতীয় সুখ আস্বাদন করেন— এই তিন বাসনা পূরণ করতে তথা জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে শ্রীরাধার ‘ভাব’ কে নিজের হৃদয়ে ধরে , শ্রীরাধার অঙ্গকান্তি অঙ্গে মেখে শ্রীশ্যামসুন্দর আবির্ভূত হলেন অবনী মাঝে শ্রীগৌরাঙ্গ হয়ে। দোল পূর্ণিমা এবার নবনামে আরো বেশী উজ্জ্বল ও ভাস্বর হল । আরও মহিমাময় হল। গৌরচন্দ্রের গৌরববোজ্জ্বল উদয় হয়েছে যে এই তিথিতে ! তাইতো ‘গৌরপূর্ণিমা’ হল। আহা , কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে -চারিপার্শ্বে ! বসন্ত রাগে শ্রীল নরহরি চক্রবর্তীপাদ গেয়ে উঠলেন তাঁর শ্রীভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে—-
জয় জয় জয় মঙ্গলরব ফাল্গুন পূর্ণিমা ফাল্গুন নিশি নবশোভিত
শচী-গর্ভে প্রকট গৌর বরজ (ব্রজ) রঞ্জনা
ঝলকতবর কনক তনু, কুঙ্কুম থির দামিনী ভানু,
চমকত মুখচন্দ মধুর ধৈরজভর ভঞ্জনা…
গায়ত কিন্নর সুধঙ্গ, বায়ত মৃদুতর মৃদঙ্গ
ধা ধি ধি ধিকিতা ধিক্ ধিক্ ধিক্কট তক ধিন্নানা।

তাই, সব মিলিয়ে ফাল্গুনী পূর্ণিমা এক বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ মধুময় তিথি ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই ঋক্ বেদের সময়কাল থেকে।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

কল্যাণীর সতীমার দোল মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

যতদূর জানা যায়, আনুমানিক দুশো বছর আগে আউলিয়া সম্প্রদায়ের সতীমা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী এই মেলার প্রবর্তন করেন । এপার বাংলা- ওপার বাংলায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষপাড়ার সতীমার দোল মেলা । খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষদয়ের নিয়ে গড়ে ওঠে আউলচাঁদ সমাজ । এই সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিলেন আউলচাঁদ । তাঁর মৃত্যুর পর আউল সমাজের কর্তাপদ লাভ করেন রামশরণ পাল । তাঁরই স্ত্রী ছিলেন সরস্বতী দেবী যিনি পরবর্তীকালে সতী মা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন ।
বাউল, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লীগীতির সুরে মেলা জমে ওঠে । আখড়ায় আখড়ায় সারা রাত ধরে বসে গানের আসর । শ্রোতারা অধিকাংশই গ্রাম ও মফঃস্বলের । বিভিন্ন জায়গায় তৈরী হয় লালন মঞ্চ । গানের পাশাপাশি বিশাল উনুন জ্বালিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা হয় ঐ আখড়াগুলিতে । দূরদূরান্তের যাত্রীদের আশ্র্যস্থল এই আখড়াগুলি ।


এবার আসছি কর্তাভজা সম্প্রদায় প্রসঙ্গে ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় আঠারো শতকে বৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদ থেকে বিকশিত একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায় । এই সম্প্রদায়ের মূল গুরু আউল চাঁদ ।
প্রথমেই বলি, আউল চাঁদ হলেন একজন বাঙালি ধর্ম প্রচারক ও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু । কিংবদন্তি বা লোকবিশ্বাস যে, গোরাচাঁদ অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যদেব আউল চাঁদ রূপে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছেন । গৃহী মানুষকে বৈরাগ্য ধর্ম শেখাতে শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হন আউল চাঁদ ফকির হয়ে । এখানে তাই কোনো জাতিভেদ নেই ।
আউল চাঁদের জন্ম খ্রিষ্টাব্দ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে । শোনা যায়, তিনি হিন্দু না মুসলমান সেটা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি । তবে প্রচলিত লোক কাহিনী অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার উলা গ্রামের ( অনেকের মতে, নদীয়া জেলার প্রাচীন জনপদ উলা বীরনগর ) পান ক্ষেত থেকে একটি নবজাতক শিশু পাওয়া যায় । ক্ষেতের মালিক মহাদের বারুই ভগবানের আশীর্বাদ ভেবে তাঁকে লালন-পালন শুরু করেন । বড় হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেন । আউল চাঁদের পুরানো নাম পূর্ণচন্দ্র । সংস্কৃত ভাষা শেখানোর জন্য তাঁকে পাঠানো হয় সে সময়কার বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য হরিহরের কাছে । বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং নানাভাবে শিক্ষালাভ করেন । শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধিলাভ করেন । তাঁর নতুন নাম হয় ফকিরচাঁদ বা আউল চাঁদ । বহু দেশ ঘোরার পর নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় রামশরণ পাল নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি তাঁকে আশ্রয় দেন । আউল চাঁদের ২২জন শিষ্যের মধ্যে অন্যতম শিষ্য রামশরণ পাল । ২২জনের মধ্যে রামশরণ পাল আউল চাঁদের মৃত্যর পর গুরুপদ প্রাপ্ত হন । যারজন্য তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্তাভজা ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান, যা পরবর্তী সময়ে সতী মায়ের মন্দির নামে সবার কাছে পরিচিত । রামশরণ পালের স্ত্রীর নাম সরস্বতী, যার নামেই এই মন্দির—-সতী মায়ের মন্দির । কথিত আছে, সরস্বতীর প্রথম অক্ষর “স” আর শেষ অক্ষর “তী” অনুসারে সতী । আউল চাঁদের শিষ্য রামশরণ পাল গুরুর ভাবাদর্শকে ভিত্তি করে কর্তাভজা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন । এইজন্য ভক্তের নিকট তিনি “কর্তা” এবং তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী “কর্তামা” নামে অভিহিত । রামশরণ পালের পর সরস্বতী দেবী এই সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দেন । রামশরণ পালের স্ত্রী কর্তাভজা সম্প্রদায়কে দিশা দেখান । রামশরণের স্ত্রী সরস্বতী দেবী ছিলেন অতীব ধর্মপরায়ণা । শোনা যায়, আউল চাঁদ হিম সাগরের জল ও ডালিম গাছের তলার মাটির সাহয্যে সরস্বতী দেবীকে অলৌকিক উপায়ে মৃত্যের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন । আরও শোনা যায়, আউল চাঁদই রামশরণ পাল ও সরস্বতী দেবীর সন্তান হয়ে পরবর্তীতে জন্ম নেন দুলাল চাঁদ নামে । দুলাল চাঁদ (১৭৭৬-১৮৩৩) কর্তাভজা সম্প্রদায়কে সাংগঠনিক রূপ দেন । তিনি বহু পদ রচনা করে কর্তাভজা ধর্মমতকে একটা তাত্ত্বিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত করেন । পদগুলি ভাব-গীত-রূপে ভক্তদের নিকট সমাদৃত । কর্তাভজারা কোনো জাতিভেদ মানেন না । তাঁরা লোভ-মোহ-কাম-ক্রোধকে নৈতিক পাপ বলে মনে করেন । সৎ পথে থেকে এবং মিথ্যা কথা পরিহার করে নৈতিকভাবে ধর্মকর্ম করা তাঁদের প্রধান লক্ষ্য । তাঁর সময়ে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত গড়ায় । মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় । এরপর তাঁর মা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী কর্তা মা বা সতীমা নামে খ্যাতিলাভ করেন ।
নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ার রামশরণ পালের আদি ভিটেটুকু ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র । ভিটের পাশেই ডালিম গাছ । এই গাছের নীচেই যেহেতু সতীমা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেই হেতু ভক্তরা ডালিম গাছের ডালে ঢিল বেঁধে মানত করেন । বাতাসা, কদমা, চিড়ে, মুড়কি দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে ভক্তদের সতীমাকে পুজো দেওয়ার রীতি ।


জনশ্রুতি, শেষ বয়সে সরস্বতী দেবী সন্তানহারা হলে দোলপূর্ণিমার দিন গুরু পুজার আয়োজন করেন । সেই থেকে দোল পূর্ণিমার সূচনা । হাজার হাজার মানুষের সঙ্গেও বাউলেরা আসেন । তাই সতী মায়ের মেলাটা আউল-বাউলের মেলা বা আখড়া নামে পরিচিত ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় মূর্তিপুজা এবং সকল প্রকার আনুষ্ঠানিক যাগযজ্ঞের বিরোধী । কর্তাভজা প্রচারক দুলাল চাঁদ রচিত ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান, সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান ।“ উক্ত ভাবের গীত থেকে বোঝা যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজনে মানব সেবার প্রসঙ্গটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । এই প্রসঙ্গে ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “মানুষ ভজ, মানুষ চিন্ত, মানুষ কর সার, সকলি মানুষের খেলা মানুষ বই নাই আর” ।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য । এই সম্প্রদায়ে নারী পুরুষ নেতৃত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয় না । এই কারণে গুরুদেবের ভূমিকায় নারী পুরুষ উভয়কেই দেখা যায় । একই ভাবে তাঁরা বাউল সম্প্রদায়ের মতো জাতিভেদ প্রথা মানেন না । দুলাল চাঁদের ভাবের গীতে তাই বলা হচ্ছে—- “ভেদ নাই মানুষে মানুষে, খেদ কেন ভাই এদেশে ।”
সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ে । এ বিষয়ে কবি নবীন চন্দ্র সেনের বক্তব্য অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য । তাঁর মতে, “কর্তাভজা সম্প্রদায়ে কোন জাতিভেদ নেই । সকলেই এক রন্ধনশালার পাক গ্রহণ করে । ছোঁয়াছুয়ির দোষ এদের কাছে মুখ্য নয় । মানুষ সেবা তাঁদের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় ।“
কর্তাভজাদের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো গুরুদেবের পুত্র অযোগ্য হলে তাঁরা তাকে গুরু নির্বাচন করতে চান না । তাঁদের নিয়মাবলী নামক ভাবের গীতে এই প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করে বলা হয়েছে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিই গুরুদেব হবার অধিকারী । এই জায়গায় কর্তাভজা সম্প্রদায় বর্ণবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন ।
আজও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীমায়ের কৃপা পাওয়ার নিরিখে যথেষ্ট উন্মাদনা । তাঁদের মধ্যে সরল বিশ্বাস ও ভক্তি আজও উজ্জীবিত । যার জন্য দোল পূর্ণিমার দিন সতী মায়ের মেলায় হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে । এদেশ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকেও মেলাপ্রাঙ্গনে অনেক মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো । বাউলদের সমারোহ আলাদা মাধুর্যে ভরপুর থাকে ঘোষপাড়ার এই মেলা । (তথ্যঃ সংগৃহীত) ।
—————-০———–
লেখক কথা সাহিত্যিক (ভারত) / +৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানুন , জগন্নাথের প্রসাদ আস্বাদন করার সময় মহাপ্রভুর কী হয়েছিল? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

একদিন মহাপ্রভু গেছেন শ্রীজগন্নাথ দর্শন করতে, সিংহদ্বারে দ্বারপাল তাঁকে দেখেই এগিয়ে এসে চরণবন্দনা করলেন । অমনই মহাপ্রভু , “কোথায় আমার কৃষ্ণ ? আমার প্রাণনাথ কোথায় গো? তুমি আমার সখা ; আমায় দেখাও সখা ,আমার প্রাণনাথকে ।”—-বলে অনুনয় করার মত দ্বারপালের হাতখানা জড়িয়ে ধরলেন। দ্বারপাল বললেন, “আমি দর্শন করাচ্ছি আপনাকে , চলুন ।” শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর হাত ধরে মন্দিরের জগমোহনে নিয়ে গেলেন দ্বারপাল। আর তারপর , শ্রীপুরুষোত্তমকে দেখিয়ে বললেন, “ঐ যে তিনি ! আপনার প্রাণনাথ।”

গরুর স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দর্শন করতেন মহাপ্রভু । তিনি কখনোই গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথ দর্শন করতেন না । প্রতিদিনের মত আজও দ্বারপাল নিয়ে তাঁকে গরুর স্তম্ভের পিছনে বাঁ দিকটায়(গরুড়ের বাম দিক) দাঁড় করালেন এবং সেখান থেকেই মহাপ্রভু দু’নয়ন মেলে জগন্নাথকে দর্শন করলেন । জগন্নাথ আজ এখন মুরলীবদন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ধরা দিলেন মহাপ্রভুর নেত্রে । —-এই লীলার কথা রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাঁর ‘শ্রীচৈতন্যস্তবকল্পবৃক্ষ’ গ্রন্থের সপ্তম শ্লোকে প্রকাশ করেছেন।

“ক্ক মে কান্তঃ কৃষ্ণস্ত্বরিতমিহ তং লোকয়
সখে ! ত্বমবেতি দ্বারাধিপমভিবদন্নুন্মদ ইব।।
দ্রুতং গচ্ছ দ্রস্টুং প্রিয়মিতি তদুক্তেন
ধৃততদ্ভুতজান্তর্গৌরাঙ্গো হৃদয় উদয়ন্মাং মদয়তি ।।”

এমন সময় গোপালবল্লভ ভোগ লাগলো জগন্নাথের । ভোগের পর শঙ্খ , ঘন্টা আদি সহ আরতি হল । ভোগ সরলে জগন্নাথের সেবকগণ প্রসাদ নিয়ে মহাপ্রভুর কাছে এলেন। তাঁকে প্রসাদী মালা পরিয়ে প্রসাদ হাতে দিলেন। সেই প্রসাদের আঘ্রাণ নিলেন মহাপ্রভু আর বললেন, “বহুমূল্য প্রসাদ ! এ যে সর্বোত্তম বস্তু !” এর অল্প নিয়ে তিনি জিহ্বায় দিলেন আর বাকিটা সেবক গোবিন্দ দাস আঁচলে বেঁধে নিলেন। সেই কণিকা মাত্র প্রসাদের অমৃতাস্বাদ করে প্রভুর মনে যেন চমৎকার হলো, সর্বাঙ্গে পুলক তাঁর । আর নেত্র থেকে অশ্রুধারা বইতে থাকলো। তিনি আপন মনে বিস্মিত হয়ে বললেন , “এই দ্রব্যে এত স্বাদ কোথা থেকে এলো ! ওহ্‌, এতে তো কৃষ্ণের অধরামৃত সঞ্চারিত হয়েছে ! তাই বুঝি এই বস্তু এত মধুময় হয়েছে স্বাদে !”—- এ কথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর মধ্যে প্রেমাবেশ হলো । কিন্তু পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সম্বরণ করে নিলেন জগন্নাথের সেবকরা তাঁর সামনে আসায় ।

মহাপ্রভু বারবার ‘সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত’ বলতে থাকলেন। জগন্নাথের সেবক মহাপ্রভুর মুখে এই শব্দ শুনে জিজ্ঞাসা করলেন “প্রভু , সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে কি? অর্থ কি এর ?” তখন মহাপ্রভু বললেন , “এই যে তুমি আমায় কৃষ্ণের অধরামৃত দিলে ,এই বস্তু ব্রহ্মা আদি দেবতাদেরও দুর্লভ এবং অমৃতের স্বাদকেও নিন্দনীয় হতে হয় এর কাছে। শ্রীকৃষ্ণের ভুক্তাবশেষের নামই হল ফেলা । তিনি ভাগ্যবান যিনি ফেলামৃত লব মাত্র পান । সামান্য ভাগ্য যার সে এই বস্তু প্রাপ্ত হতে পারে না। যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ কৃপা তিনি তা পান। আর, তিনিই সুকৃতীবান যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের কৃপা থাকে । অর্থাৎ সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে হল যাঁর সুকৃতি লাভ হয় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ হয় তিনিই ফেলা রূপ অমৃত লাভ করতে পারেন ; শ্রীকৃষ্ণের অধরামৃত আস্বাদনের অধিকারী হন।”— এই বলে মহাপ্রভু সকলকে বিদায় দিলেন । তারপর জগন্নাথের উপলভোগ দর্শন করে গম্ভীরায় ফিরে এলেন।

মধ্যাহ্নকালে ভিক্ষা নির্বাহণ করলেন মহাপ্রভু । কিন্তু অন্তরে কৃষ্ণ-অধরামৃতের স্বাদ সর্বদা স্মরণ হচ্ছে তাঁর। বাইরে কর্ম করছেন অথচ অন্তরে প্রেমে গরগর মন হয়ে আছে। সেই সঘন আবেশ অত্যন্ত কষ্ট করে সম্বরণ করছেন তিনি। সন্ধ্যা বেলায় যখন পুনরায় নিজের পার্ষদগণের সাথে বসে কৃষ্ণকথা রঙ্গে নিভৃতে কাল কাটাচ্ছেন , তখন সেবক গোবিন্দ দাসকে ইঙ্গিত দিলেন দুপুরের সেই আঁচলে বেঁধে রাখা প্রসাদ এখন আনার জন্য । পুরী-ভারতী তথা তাঁর গণের সন্ন্যাসীদের জন্য কিছুটা পাঠিয়ে দেওয়া হলো , আর সেখানে উপস্থিত রামানন্দ রায় , সার্বভৌম ভট্টাচার্য , স্বরূপ দামোদর ও অন্যান্যদের সেই প্রসাদ বিতরণ করা হলো। প্রসাদের সৌরভ-মাধুর্য আস্বাদন করেই সকলে বিস্মিত হলেন । যে প্রসাদ এমন দিব্য সৌরভ সম্পন্ন , সেই প্রসাদের স্বাদ না জানি কেমন অলৌকিক হবে ! তখন মহাপ্রভু বললেন , “দ্যাখো, প্রসাদে যা যা আছে যেমন ধরো আখের গুড় , কর্পূর, মরিচ, এলাচ , লবঙ্গ,কাবাবচিনি, দারুচিনি এইগুলো সব প্রাকৃত দ্রব্য। তোমরা সকলেই এই সব প্রাকৃত দ্রব্যগুলোর স্বাদ, সুগন্ধ কেমন জানো । কিন্তু এই প্রসাদে তাহলে এত আমোদ কোথা থেকে এলো? প্রসাদের এই সৌরভ —এতো লোকাতীত ! এর আস্বাদন তাহলে কত না দিব্য ! আস্বাদ করে দেখ সকলের মনে প্রতীত হবে তাহলে। আস্বাদন তো অনেক পরের কথা , কেবল গন্ধেই মন মাতিয়ে দেয়। তাই না ! প্রসাদের এমন মাধুর্য যে আস্বাদন সময়ে আস্বাদন ব্যতীত অন্য সকল কিছু বিস্মৃত করিয়ে দেয় । কেন? কারণ , শ্রীকৃষ্ণের অধর স্পর্শ করেছে এই প্রসাদ। তাঁর অধর রসের গুণ সব সঞ্চারিত হয়েছে প্রসাদে, তাইতো অলৌকিক সুগন্ধ মাধুর্য হয়েছে এমন ! মহাভক্তি করে সকলে প্রসাদ আস্বাদ করো।”
সকলে হরিধ্বনি দিয়ে প্রসাদ আস্বাদন করলেন এবং আস্বাদন মাত্রই সকলের মন প্রেমে মত্ত হল। মহাপ্রভুর মধ্যে প্রেমাবেশ সে সময় । তিনি আজ্ঞা দিলেন রামানন্দ রায় কে শ্লোক পাঠ করতে। রামানন্দ রায় শ্রীমদ্‌ ভাগবতের শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।

“সুরতবর্দ্ধনং শোক নাশনং , স্বরিতবেণুনা সুষ্ঠচুম্বিতম্ ।
ইতররাগবিস্মারণং নৃণাং, বিতর বীর নস্তেহধরামৃতম্ ।।”
(শ্রীমদ্ ভাগবত, ১০, ৩১, ১৪ শ্লোক)

—– শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসমন্ডল থেকে অকস্মাৎ অন্তর্ধান হয়ে যান, শোকাকুলা গোপীরা বিলাপ করে বলছেন তখন— হে বীর ! তোমার সেই সুরতবর্ধনকারী (সম্ভোগেচ্ছা ক্রমশঃ বর্ধনকারী) অধরের সুধা যা তোমার বিরহ জনিত শোক রাশিকে নাশ করে তা আমাদেরকে বিতরণ কর । তোমার অধরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বেণু পঞ্চম সুরে নাদিত হয়ে মানবের সকল আসক্তি ভুলিয়ে দেয় ; সেই অধরের অমৃত আমাদের দাও।

সেই শ্লোক শ্রবণ করে রসরাজ-মহাভাবের মিলিত স্বরূপ মহাপ্রভু তখন ভাবাবিষ্ট হয়ে রাধার উৎকণ্ঠা জনিত একটি শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।

“ব্রজাতুলকুলাঙ্গনেতর রসালি তৃষ্ণাহরঃ ,
প্রদীব্যদধরামৃতঃ সুকৃতিলভ্য ফেললাবঃ।
সুধাজিদহিবল্লিকাসুদলবীটিকাচর্বিতঃ,
স মে মদনমোহনঃ সখি তনোতি জিহ্বাস্পৃহাম্।।”
(গোবিন্দলীলামৃত, ৮, ৮শ্লোক)

—- শ্রীমতী রাধিকা তাঁর সখী বিশাখাকে বলছেন, হে সখি ! অনন্যা ব্রজকুলবতী ললনাদের যিনি অধরামৃত দ্বারা আনন্দ দান করে তাঁদের অন্য সকল রস-তৃষ্ণাকে হরণ করেন , যাঁর চর্বিত তাম্বুলে অমৃতাপেক্ষা অধিক স্বাদ—-সেই শ্রীমদনমোহন আমার জিহ্বার স্পৃহাকে বিস্তৃতি দান করেছেন।

তারপর মহাপ্রভু নিজেই দুই শ্লোকের অর্থ প্রলাপের মত উচ্চারণ করে গেলেন । সকলে শ্রবণ করে ভাবের ভিয়ানে বিহ্বল হলেন। গ্রন্থ– মহাপ্রভুর মধুময় কথা , লেখিকা —- রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক, প্রকাশক–তথাগত।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানুন পীলু ফল নিয়ে মহাপ্রভুর আনন্দময় কাহিনী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীজগদানন্দ পন্ডিত বৃন্দাবন ভ্রমণ করে নীলাচলে মহাপ্রভুর কাছে ফিরে যাচ্ছেন । শ্রীসনাতন গোস্বামী তাই তাঁর হাত দিয়ে মহাপ্রভুর জন্য কিছু ভেট বস্তু অর্থাৎ উপহার সামগ্রী পাঠালেন । কী কী সেই উপহার ? — রাসস্থলীর বালু , গোবর্দ্ধনের শিলা , শুষ্ক পাকা পীলু ফল আর গুঞ্জামালা । জগদানন্দ পন্ডিত ফিরে যেতেই সনাতনের মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো মহাপ্রভুর জন্য। এতদিন তো মহাপ্রভুর অতি কাছের একজন মানুষ, প্রিয় পরিকর বা দূত যাই বলি না কেন তিনি ছিলেন সনাতনের কাছে। জগদানন্দের সঙ্গ পেয়ে সনাতনের মনে হতো যেন মহাপ্রভুর আবেশ উপলব্ধি করছেন । যেমনটা হয় আর কী ! প্রিয়জনের কাছের কাউকে পেলেও মনে এক অদ্ভুত প্রেম ভাব জাগে , ভালো লাগে—তেমন আর কী ! আজ জগদানন্দ চলে যেতে সনাতনের মন তাই কেঁদে উঠলো মহাপ্রভুর জন্য। দ্বাদশ আদিত্য টিলার উপর একটি মঠ পেয়ে , সে স্থান সংস্কার করে চালা বেঁধে রেখে দিলেন তিনি, যাতে ব্রজে এসে মহাপ্রভু সেখানে বাস করতে পারেন নিরালায় ।

ওদিকে জগদানন্দ পথে একটুও দেরী না করে খুব শীঘ্র চলে এলেন নীলাচলে । তাঁর যে আর তর সইছে না মহাপ্রভুকে দু’চোখ ভরে দেখার জন্য। নীলাচলে মহাপ্রভু সহ আর সব ভক্তদের পেয়ে তাঁর মনে পরম আনন্দ হল । প্রভুর চরণ বন্দনা করে সকলের সাথে আলিঙ্গন করলেন। মহাপ্রভুও তাঁকে দৃঢ় আলিঙ্গন দিলেন । ব্রজ থেকে ফেরত এসেছে যে প্রাণপ্রিয় বাল্যবান্ধব জগদানন্দ ! তাই। এরপর জগদানন্দ সেই সমস্ত ভেট তথা উপহার সামগ্রী মহাপ্রভুর শ্রীহস্তে তুলে দিলেন, যা-যা সনাতন প্রেরণ করেছিলেন মহাপ্রভুর জন্য ।

রাসস্থলীর বালু , গোবর্দ্ধনের শিলা আর গুঞ্জামালা নিজের কাছে রেখে মহাপ্রভু পীলু ফলগুলি তখনই সকলের মধ্যে বণ্টন করে দিতে বললেন । ভক্তরা বিশেষতঃ গৌড়ীয়ারা পীলু ফল দেখেননি। গৌড়দেশে পীলুফল হয়ও না। বৃন্দাবন থেকে এসেছে যে ফল সে ফল না জানি কত ভালো , কত সুস্বাদু, কত অমৃতসম মিষ্টি হয়তো বা ! তাই তো সনাতন পাঠিয়েছেন পীলু ফল ! তাই না ! একারণে সকলের মধ্যেই মহা আগ্রহ পীলু ফল খাবার । সকলে মহা আনন্দের সাথে পীলু ফল হাতে নিলেন খাবেন বলে।

যাঁরা জানেন তাঁরা পীলু ফল নিয়ে চুষতে থাকলেন আর যাঁরা জানেন না বিশেষতঃ গৌড়ীয়ারা পীলু ফলে কামড় বসিয়ে চিবোতে শুরু করে দিলেন। আর যে মুহূর্তে চিবোলেন অমনি তাঁদের মুখের ছাল উঠে গেল, জিহ্বা প্রচন্ড জ্বালা করতে থাকলো । আসলে পিলু ফল এমনই হয় ,চিবিয়ে খেতে নেই ,চুষে খেতে হয় । চিবোলেই মুখ জ্বলে যায় । স্বাভাবিক ভাবেই পীলু ফলকে কেন্দ্র করে তখন সেখানে এক মহা রগড় হলো মহাপ্রভু ও ভক্তদের মধ্যে।

“সনাতন প্রভুকে কিছু ভেট বস্তু দিলা ।।
রাসস্থলীর বালু আর গোবর্ধনের শিলা ।
শুষ্ক পক্ক পীলু ফল আর গুঞ্জামালা ।।
জগদানন্দ পণ্ডিত চলিলা সব লইয়া।
*************************************
*************************************
*************************************
সনাতনের নামে পন্ডিত দণ্ডবৎ কৈল।
রাসস্থলীর বালু আদি সব ভেট দিল ।।
সব দ্রব্য রাখি পীলু দিলেন বাঁটিয়া ।
বৃন্দাবনের ফল বলি খাইল হৃষ্ট হইয়া।।
যে কেহ জানে সে আঁটি চুষিতে লাগিল ।
যে না জানে গৌড়ীয়া পীলু চিবাইয়া খাইল।।
মুখে তার ছাল গেল জিহবা করে জ্বালা ।
বৃন্দাবনের পীলু খাইতে এই এক লীলা।।”
(চৈ।চ। অন্ত্য,১৩)

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাপ্রভুর মধুময় কথা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীগৌরাঙ্গের পতিত-পাবন নামের সার্থক প্রমাণ হল শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই উদ্ধার লীলা। ভক্ত শিরোমণি জগাই-মাধাইয়ের অবণীতে আবির্ভাব হয় প্রভুর ইচ্ছায় দুরাচারী, অত্যাচারী, মদ্যপ ও অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিরূপে। এমন কোন পাপকর্ম জগৎ-এ ছিল না, যা, তাঁরা করতেন না। চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, গোমাংস ভক্ষণ, পরের গৃহ অগ্নিদগ্ধ করা, স্ত্রী-হত্যা, ব্রহ্মহত্যা ইত্যাদি সব রকম অসৎকর্মই তাঁরা অবলীলায় করতেন। তবে হ্যাঁ, উল্লেখ্য যে, বৈষ্ণব অপরাধ তাঁরা কখনও করেননি। মদ্যপ সঙ্গীদের সঙ্গ সবসময় করতেন বলে বৈষ্ণব অপরাধ করার মতো পরিস্থিতি বা সুযোগ কোনদিন হয়ে উঠেছিল না।
নবদ্বীপবাসী ব্রাহ্মণ শুভানন্দ রায়। নবদ্বীপের জমিদার বলেই তাঁর দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছিল। সুমিষ্ট, সৎ ব্যবহারের জন্য পাৎসাহ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তাঁর দুই পরম-সুন্দর পুত্র—–জ্যেষ্ঠ রঘুনাথ, কনিষ্ঠ জনার্দন দাস। রঘুনাথের পুত্রের নাম জগন্নাথ আর জনার্দনের পুত্র মাধব। এই জগন্নাথ ও মাধবই ওরফে ‘জগাই-মাধাই’ বলে পরিচিত ছিলেন। নবদ্বীপের কোটাল এই দুই ভাই। যদিও জগাই-মাধাইয়ের পূর্বপুরুষরা সকলেই সদাচারী ছিলেন, কিন্তু মদ্যপ-কুসঙ্গীদের পাল্লায় পরে জগাই-মাধাইয়ের চরিত্রের অবনমন ঘটে। আর সেজন্য স্বজনদের দ্বারা তাঁরা পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। ভক্তসঙ্গ কী জিনিষ তা তাঁরা জানতেনই না। মদ্যপান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি পর্যন্ত যেতেন, কখনো বা বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন, আবার কখনো অশ্রাব্য গালিগালাজ করে নিজেদের মধ্যেই কিল-চড়-লাথি দিতেন। লোকে তাঁদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন সব সময়। যে পথ দিয়ে জগাই-মাধাই যেতেন। দূর থেকে দেখতে পেলে সেই পথ এড়িয়ে অন্য পথ ধরতেন ভীত পথিকেরা।
এমনই একদিন প্রচুর মদ্যপান করে রাস্তায় ধুলোয় পড়ে ‘কিলাকিলি-লাথালাথি করছিলেন জগাই-মাধাই। এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গের আদেশে প্রতিদিন নিত্যানন্দ ও যবন হরিদাস নবদ্বীপের প্রতি ঘরে ঘরে গমন করে মানুষকে কৃষ্ণ বলাচ্ছেন সেসময়। সেদিন তাঁরা সম্মুখীন হলেন পথে জগাই-মাধাইয়ের। দেখলেন ওভাবে মদের নেশার বিক্ষেপে তাঁদের পশুবৎ দশা। তখন পরম করুণ নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন, “ইস্! কী করুণ দশা এদের! এমন পাতকী তো কোথাও দেখিনি। আমার প্রভু গৌরাঙ্গ পাতকীদের উদ্ধার করতেই এই কলিতে এসেছেন। যদি এদের মতো পাপীদের তিনি উদ্ধার করেন, তবেই তো তাঁর পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে, তবে তো জগৎবাসী জানবে যে আমার প্রভুর মহিমা কতখানি! যাঁর ভৃত্য বলে আমরা গর্ব বোধ করি, তিনি যে কতখানি ক্ষমতা ধরেন সে প্রমাণ পাবে মানুষ তখন। না, এদেরকে ভক্তিপথে আনতেই হবে। যাঁরা ভক্ত হয় তাঁরা অতি সহজেই নাম নেয়; কিন্তু যদি এদের মত দুরাচারীকেও নাম নেওয়ানো যায়, তবেই আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সফল হবে। না হলে তো বৃথা আষ্ফালন সব আমাদের ! না, হরিদাস, আমাদের এখন প্রথম কাজ হবে এদেরকে উদ্ধার করা। অন্য জায়গায় আমরা পরে যাব। গৌরীহরিকে এদের কথা জানাবো। হরিদাস, তোমাকে যবনরা অত্যাচার করেছিল। তুমি তো তাদেরও মঙ্গল কামনা করেছিলে। এবার এদের মঙ্গল চাও। কারণ, তোমার মত ভক্তের চাওয়া ভগবান পূরণ করবেনই। এরা উদ্ধার হবে এই পাপী জীবন থেকে তবে।”
হরিদাস বললেন, “সে কী কথা! তুমি চেয়েছো যখন তখনই তো তা পূরণ হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। তোমার ইচ্ছাই যে প্রভুর ইচ্ছা। আবার আমাকে টানছো কেন!” নিত্যানন্দ একথায় হেসে প্রেমালিঙ্গন দিলেন হরিদাসকে। তারপর একটু দূর থেকে উপদেশের সুরে জগাই-মাধাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, লহ কৃষ্ণনাম। কৃষ্ণ মাতা, কৃষ্ণ পিতা, কৃষ্ণধন প্রাণ।। তোমা সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার। হেন কৃষ্ণ ভজ, সব ছাড় অনাচার।।”
কিন্তু উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হল । জগাই এমন কথা শুনে একটু মাথা তুলে প্রথমে দেখলেন, তারপরই মহাক্রোধে “ধরতো! ধরতো!” বলে ধাওয়া করলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে। “রক্ষ কৃষ্ণ, রক্ষ কৃষ্ণ” বলে নিতাই-হরিদাস কোনক্রমে জগাইয়ের প্রহারের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। সে কী অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য! গর্জন করতে করতে দুই দস্যু ধাওয়া করছেন আর সামনে প্রেমে বিহ্বল দুই মহাভক্ত হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছেন।
শ্রীবাস গৃহে ভক্ত সমেত বসে আছেন বিশ্বম্ভর। নিতাই-হরিদাস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সব বললেন তাঁকে। শ্রীবাস পন্ডিত ও গঙ্গাদাস জগাই-মাধাইয়ের বংশ পরিচয় দিলেন এবং তাঁদের দুষ্কর্মের আদ্যোপান্ত বর্ণনাও দিলেন। নিত্যানন্দ বললেন, “প্রভু, আগে তোমায় এদেরকে উদ্ধার করতেই হবে। তারপর অন্য কথা। তোমার পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে এদের পাপমোচনের দ্বারা। বিশ্ববাসী তোমার মহিমা দেখুক।” গৌরাঙ্গ হেসে বললেন, “যে মুহুর্তে তোমার দর্শন ওরা পেয়েছে, তুমি চেয়েছো ওদের উদ্ধার, সেই মুহূর্তেই ওদের সব পাপ মোচন হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু তুমি ওদের মঙ্গল চিন্তা করো, দেখবে অচিরেই কৃষ্ণ ওদের মঙ্গল সাধন করে দিয়েছেন। তোমার ইচ্ছাই ফলপ্রসূ হবে।”
রাত্রিবেলায় একদিন নগর ভ্রমণ করে নিত্যানন্দ যাচ্ছেন পথ দিয়ে হেঁটে, এমন সময় জগাই-মাধাই তাঁর পথ অবরোধ করলেন। বললেন, “কে রে? কে তুই?” নিত্যানন্দ বললেন, “আমি অবধূত, গৌরগুণ গাই। এখন বাড়ি যাচ্ছি।” অবধূত শব্দ শোনা মাত্র মাধাই করলেন কী, পথের পাশে পড়ে থাকা এক ভাঙা কলসী উঠিয়ে নিয়ে আছাড় মারলেন নিত্যানন্দের মস্তকে। সজোরে আঘাত করায় মাথা ফেটে গেল নিতাইয়ের। আর অবিরল ধারায় রক্ত ঝরতে লাগলো। অক্রোধ পরমানন্দ, অভিমান শূন্য নিতাই গৌরস্মরণ করে নির্বিকার চিত্তে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর নির্লিপ্ততা দেখে মদ্যপ মাধাই আবার মারতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রক্তধারা আর নিতাইয়ের নিশ্চুপতা দেখে জগাইয়ের মন দৈবেচ্ছায় মাখনের মত গলে গেল। তিনি মাধাই কে বললেন, “না, না, আর মেরো না। ও তো অবধূত, তা আবার দেশান্তরী ! ওকে মেরে লাভ কী তোমার! এত নির্দয় হয়ো না।” এই বলে তিনি মাধাইয়ের হাত ধরে ফেললেন। এদিকে অন্যান্য পথচারীদের কেউ একজন ছুটে গিয়ে এ দুঃসংবাদ দিলেন গৌরাঙ্গকে।

শোনামাত্র গৌরাঙ্গ সপরিকর ছুটতে ছুটতে এলেন সেই মুহুর্তেই। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইয়ের অঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! এ কী সহ্য করা সম্ভব! প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন গৌরাঙ্গ। স্বয়ং তাঁকে প্রহার করে রক্ত ঝরিয়ে দিলেও এতখানি ক্রোধিত হতেন না, যতখানি নিতাইয়ের ক্ষেত্রে হলেন। ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি “চক্র, চক্র” বলে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান জানিয়ে নিজের হাত উপরে তুললেন। সুদর্শন চলে এলেন তাঁর হাতে। ভক্তরা সকলে প্রমাদ গুনলেন। এবার তো আর নিস্তার নেই জগাই-মাধাইয়ের! চক্র দ্বারা প্রভু তাঁদের সংহার করবেনই করবেন। কিন্তু, কলিতে এই অবতারে তো তাঁর অস্ত্র ধরার কথা নয়। তাঁর অঙ্গ-উপাঙ্গ স্বরূপ পার্ষদরাই তাঁর অস্ত্র। পার্ষদদের দ্বারা নাম-প্রেম বিতরণ করিয়ে তিনি পতিতদের উদ্ধার করবেন। তাঁর রূপ মাধুর্য্যের দ্বারা অসুরের আসুরিক স্বভাবের পরিবর্তন করবেন। তাঁকে দর্শন করেই দুরাচারীদের মন পরিবর্তিত হবে। এযুগে তো তিনি কাউকে সংহার করবেন না। বরং মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রেমভক্তিতে মনকে জারিত করবেন, ভক্ত বানাবেন অভক্তদের। মহাভাগবত হবেন তাঁরা এক-একজন সব।
নিত্যানন্দ করলেন কৌশলতা এক। তিনি মহাপ্রভুর মন ঘোরাবার চেষ্টা করলেন, বললেন- “প্রভু, দেখ, দেখ, এই যে জগাইকে দেখছো , এ আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছে। মাধাই মারতে গেলেও তাঁকে বাঁধা দিয়ে রক্ষা করেছে আমায়।” একথা শুনেই গৌরাঙ্গের মনসংযোগ চক্রের প্রতি থেকে সরলো। বললেন- “তাই নাকি! তুমি আমার নিতাইকে রক্ষা করেছো জগাই ! প্রভু তোমার অনেক মঙ্গল করুক। নিত্যানন্দকে বাঁচিয়ে তুমি আমায় কিনে নিলে আজ।” এই বলেই তিনি জগাইকে জড়িয়ে ধরলেন। জগাইকে রেখে পাছে মাধাইকে মারেন, তাই নিত্যানন্দ বলে চললেন- প্রভু, এই দু’জনার শরীরই আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি। তুমি তো এযুগে প্রতিজ্ঞা করেছো যে অস্ত্র না ধরেও জীবতারণ করবে। তবে কেন তার ব্যাতিক্রম করবে! এই দুইজনকেই তুমি কৃপা কর।”
এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেমালিঙ্গন দেওয়ায় প্রেমভার বইতে না পেরে জগাই মূর্ছিত হয়ে গেছেন। গৌরাঙ্গ বললেন- “ওঠো জগাই। তোমার যা বর লাগে, তুমি চেয়ে নাও আজ। আমি আজ সত্য সত্যই তোমায় প্রেমভক্তি প্রদান করলাম। আমার দেহ থেকেও নিত্যানন্দের দেহ বড় আমার কাছে জেনো। তুমি তাঁকে রক্ষা করেছো যখন, শ্রীকৃষ্ণ তোমায় অনেক কৃপা করবেন এই আমি বললাম।” জগাই দেখলেন গৌরহরি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রেমানন্দে করজোড়ে তখন প্রাণের আকুতিভরা প্রণাম জানাচ্ছেন গৌরাঙ্গকে জগাই। তাঁর নয়নের জল সর্বাঙ্গ বয়ে নীচে পড়ছে। তিনি আবার জ্ঞান হারালেন। তখন গৌরহরি নিজের শ্রীচরণখানি তাঁর বক্ষের ওপর স্থাপন করলেন। যাঁর অভয়পদ স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর জীবন, সেই পদ হৃদয়ে ধরে জগাই সদৈন্যে তখন কেঁদেই চলেছেন। সেই দুরাচারী জগাই কই আর! ইনি যে এখন মহাভক্ত এক। জগাইয়ের ওপর গৌরহরির এমন করুণা দেখে উপস্থিত ভক্তবৃন্দরা হরিধ্বনি দিতে থাকলেন উচ্চৈঃস্বরে। আকাশ ভেদ করে সে দিব্যধ্বনি যেন গোলকে পৌঁছে যাচ্ছিল।

এতক্ষণ ধরে এতসবের সাক্ষী মৌন মাধাই। তাঁর ভাবান্তর ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী জগাই এমন কৃপা পেয় গেল, পরিবর্তিত হয়ে গেল, উদ্ধার হয়ে গেল, অথচ, তিনি তিমিরেই পড়ে রইলেন !—– একথা ভেবে মাধাই তখন পাগলপ্রায় হয়ে গৌরাঙ্গের পাদপদ্মে পড়ে গেলেন ছিন্নমূল বৃক্ষের মত। তাঁর দুর্বুদ্ধির বিনাশ হয়ে গেছে। তিনিও এখন দুষ্কর্ম ছেড়ে জগাইয়ের মত ভক্ত হতে চান। তাই বিনয় বচনে বললেন- “আমরা দুই ভাই জগাই-মাধাই সর্বক্ষণ একসাথে থাকি। একই কুকর্ম করি, তবে কেন একজনকে কৃপা করে অন্যজনকে বঞ্চিত করবে প্রভু? আমাকেও উদ্ধার কর। ক্ষমা করে দাও আমায়। অনুগ্রহ করে আমাকেও তোমার নাম-গান প্রচারে সামিল কর। আমার মত দুর্জনকে তুমি উদ্ধার না করলে, আর কী গতি হবে আমার! কৃপা কর দয়াময়। কৃপা কর।” গৌরাঙ্গ বললেন, “না, তোমার ত্রাণ কোনমতে হবে না। তুমি নিত্যানন্দের দেহে আঘাত করেছো।” মাধাই—-“প্রভু, তোমার অন্যান্য অবতারে কত অসুর তো তোমায় বাণেতে বিদ্ধ করেছে। তুমি তো তাঁদের সকলকেই উদ্ধার করেছো। তোমার অভয়পদে স্থান দিয়েছো। তবে আমার বেলায় কেন তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করবে তোমার! গৌরাঙ্গ, “তুমি তো আমায় নির্য্যাতন করোনি। করেছো আমার প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইকে। যদি আমায় করতে, তাহলে ক্ষমা আমি অনেক আগেই করে দিতাম। কিন্তু, আমার দেহের থেকেও নিত্যানন্দের দেহ যে অনেক প্রিয় , অনেক বড় আমার কাছে। তাঁকে দুঃখ দিয়ে আমার কৃপা কোনমতেই পাবে না আমার থেকে।” মাধাই, “প্রভু, তুমি তো সর্ব রোগহর বৈদ্য চূড়ামণি। তবে আমার এই কঠিন রোগ কেমন করে দূর হবে বলো! বলে দাও কী করলে আমার পরিত্রাণ হবে এ ঘৃণ্য অপরাধের থেকে। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো।” তখন গৌরসুন্দর বললেন- “যদি নিজের পাপমোচন করতে চাও, তবে যাঁর চরণে অপরাধ হয়েছে, তাঁর শরণ নাও। নিতাইয়ের অপরাধী তুমি, তাই নিতাইয়ের কাছেই তোমার ক্ষমাভিক্ষা করতে হবে। সে যতক্ষণ না কৃপা করবে, তোমার প্রেমভক্তি ততক্ষণ বাদ।”
মাধাই নিত্যানন্দের শ্রীচরণে পড়লেন। যে পদ দেব ঋষিগণ প্রার্থনা করেন, রেবতী যে পদযুগলকে সেবা করেন সেই পদে মাথা কুটতে থাকলেন মাধাই। গৌরহরি বললেন, “নিতাই তুমি ওকে ক্ষমা না করলে যে ও উদ্ধার হবে না ! তোমার কৃপা বিনা তো কেউ প্রেমভিক্ষা পায় না। তাই, এবার দেখো তুমি ওকে কী করবে!” নিত্যানন্দ হেসে বললেন, “আমার জীবনে যদি কিছু সুকৃতী থেকে থাকে, আমি তার সমস্তটা আজ মাধাইকে দান করলাম।” এই বলে মাধাইকে নিজের চরণ থেকে তুলে কৃপালিঙ্গন দিলেন তিনি। মাধাইয়ের শরীরে নিজ শক্তি সঞ্চার করে দিলেন। সকল বন্ধনের বিমোচন হয়ে গেল মাধাইয়ের। মহাভাগবত হলেন মাধাই সে মুহুর্তেই। গৌরাঙ্গ বললেন, “জগাই-মাধাই, তোমাদের কোটি জন্মের সব পাপের ভার আমার হল। আর কিন্তু নতুন কোন পাপ কার্য করো না, আজ থেকে। তোমাদের পূর্বের কর্মের সবদায় আমার হল।“ জগাই-মাধাই সমস্বরে বলে উঠলেন- “না, না, বাবা, আর নয়। আমরা আর কোনদিন, কোন কুকর্ম করবো না। এমনকী করার কথা ভাববোও না।” গৌরাঙ্গ, “বেশ, তবে তোমাদের দেহ আমার অবতার হবে। তোমাদের দুজনার মুখ দ্বারা আহার হবে আমার।” এমন কৃপাশীর্বাদ পেয়ে দু’ভাই বাহ্য হারালেন। গৌরাঙ্গ তাঁর পরিকরদের বললেন, “এদের দুজনকে আমার ঘরে নিয়ে চল। ব্রহ্মার দুর্লভ যে ধন, আজ সেই ধন আমি এদেরকে দেব। সকলের থেকে উত্তম বানাবো। এদেরকে স্পর্শ করলে গঙ্গাস্নানের সমান ফল প্রাপ্ত হওয়া যাবে এমন পূণ্যবান ভক্ত বানাবো এদের।”
জগাই-মাধাই দু-ভাইকে নিয়ে গেলেন ভক্তরা প্রভুর ঘরে। তাঁদের দুজনকে ঘিরে সংকীর্তন শুরু হল। কীর্তনের রোল শ্রবণ করে প্রেমানন্দে উঠে বসে দু’বাহু তুলে অপার নৃত্য করতে থাকলেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দেহে বাহ্যস্মৃতি লোপ পেল। প্রেমে বিভোর দুই তনু তখন ঢলঢল, গড়গড়। অশ্রুনীরে সর্বাঙ্গ সিক্ত। সাত্ত্বিকভাবের প্রকাশ দেহে। দৈন্য, স্তুতি করে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের সেই দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়। তাঁদের দৈন্য দেখে বুক ফাটে এমন দশা তখন ভক্তদের। গৌরাঙ্গ বললেন, “আজ থেকে এরা আর মদ্যপ হবে না। এরা আমার সেবক। সকলে প্রাণঢেলে আশীর্বাদ কর এদেরকে যেন জন্মে-জন্মে আমায় না ভোলে আর। কারোর চরণে যদি কিছু অপরাধ থেকে থাকে এদের, তাহলে তোমরা নিজগুণে সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিও। কৃপা কর সকলে জগাই-মাধাইকে।” তখন দু’ভাই জগাই-মাধাই চোখের জলে ভেসে সকলের চরণ ধরে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকলেন । সকলে ক্ষমাসুন্দর চোখে তাঁদেরকে আপন করে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সেদিন থেকে তাঁরা অনুগত সেবক হলেন গৌর-নিতাইয়ের। এরপর সকলে মিলে কীর্তন করতে করতে গঙ্গাস্নান করতে গেলেন। অনেক জলকেলি হল। জগাই-মাধাইয়ের সব পাপ নিজে ধারণ করে নিলেন প্রভু। প্রমাণ দিতে ‘কালিয়া-আকার’ ধারণ করেছিলেন সেদিন। স্নান সেরে তীরে উঠে, নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ প্রভুদ্বয় আপন আপন কন্ঠের মালা জগাই-মাধাইকে পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে মহাভাগবত হলেন দু-ভাই জগাই ও মাধাই।
“মহাপ্রভু দুঁহে করিয়া আলিঙ্গন।
বোলে আজি হৈতে মোর সেবক দুইজন।। নিতাই আলিঙ্গিয়া দুঁহে বলয়ে বচন।
প্রিয় শিষ্য হৈলে মোর তোমরা দুইজন।। জগাই মাধাই হৈলা ভক্ত অতিশয়।
দুই প্রভুর দুই শাখা মধ্যে গণনা যে হয়।।”
(প্রেমবিলাস, ২১)

“এতেক যতেক কৈল এই দুইজনে।
করিলাম আমি ঘুচাইলাম আপনে।।
ইহা জানি এ দুইয়ে সকল বৈষ্ণব।
দেখিয়া অভেদ দৃষ্ট্যে যেন তুমি সব।।
শুন এই আজ্ঞা মোর যে হও আমার।
এ দুইয়ে শ্রদ্ধা করি যে দিব আহার।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে যত মধু আছে।
সে হয় কৃষ্ণের মুখে দিলে প্রেমরসে।।
এ দুইরে বট মাত্র দিবে যেই জন।
তার সে কৃষ্ণের মুখে মধু সমর্পণ।।
এ দুই জনেরে যে করিবে উপহাস।
এ দুইর অপরাধে তার সর্বনাশ।।
তবে গলার মালা দোঁহার গলে দিল।
প্রভু কৃপা পাই দোঁহে প্রেমেতে ভাসিল।।”
(চৈ.ভা-১৩)
পরম প্রেমিক, মহাভক্ত জগাই-মাধাই দু’ভাই এখন দিবানিশি কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে আঁখি নীরে ভাসেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে এসে তাঁরা দুই লক্ষ নাম নেন। কৃষ্ণ বলে নিরবধি হা-হুতাশ করেন। কৃষ্ণময় জগৎ এখন তাঁদের। কিন্তু, এত সবের সঙ্গে নিজেদের অতীতের কীর্তিকলাপের কথা ভেবে ধিক্কার দেন নিজেদেরকেই তাঁরা। নিজেদের জীবহিংসার কথা ভেবে মরমে মরে যায়। ভূমিতে পড়ে আকুলি-বিকুলি করেন অনুশোচনায়। পতিত পাবন গৌরসুন্দর কত দয়াময় আর নিত্যানন্দ এত করুণাময়(!), তাঁদের এত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন এত অবলীলায়, এত কৃপা করলেন!—–এসব ভেবে কেঁদে আকুল হন তাঁরা। বিহ্বল হয়ে যান প্রভুদের কৃপালীলার কথা ভেবে। কখনো কৃষ্ণপ্রেমানন্দে, কখনো নিজেদের কর্মের কথা ভেবে প্রায়ই আহার করেন না। তখন নিতাই-গৌরসুন্দর অনেক বুঝিয়ে আহার তুলে দেন মুখে তাঁদের।
মাধাই আরও বেশী অনুশোচনায় ভোগেন জগাইয়ের থেকে। তিনি নিতাইকে প্রহার করেছেন, রক্ত বের করে দিয়েছেন মাথা থেকে; কত না পাপীষ্ঠ তিনি! —-একথা ভেবে বক্ষ ভাসান নয়ন জলে। যদিও নিতাই তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তবুও একদিন দন্তে তৃণ ধরে আবার নিত্যানন্দের চরণে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন তিনি। চোখের জলে নিত্যানন্দের চরণ ধুয়ে দিলেন, স্তব করলেন কত না। সন্তুষ্ট নিত্যানন্দ বুকে টেনে নিলেন তাঁর প্রিয় মাধাইকে। বললেন- “মাধাই, তুমি এখনো এতদিন পরেও কেন এমন করো। শোক পরিহার কর। তুমি তো এখন আমার দাস। তোমার শরীর এখন আমার সম্পদ। তুমি এভাবে দৈন্যক্রন্দন করে আমাকে কেন কষ্ট দাও। শিশুপুত্র যদি পিতাকে মারে, পিতার কী কিছু যায় আসে তাতে! পুত্রের অপরাধ দেখে না পিতা। তেমন তুমিও তখন অজ্ঞানী ছিলে শিশুপুত্রের ন্যায়। তোমার কোন অপরাধ আমি দেখিনি। তার ওপর আমার প্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ তোমায় আপন করেছেন। যাকে তিনি কৃপা করেন, সে আমার জন্মে জন্মে প্রিয়পাত্র হয়। আর যে জন তাঁকে লঙ্ঘন করে আমায় পূজা দেয়, সেই মূঢ় কখনো আমার কৃপার প্রাপ্ত হয় না, প্রিয়পাত্র হওয়া তো অনেক দূরের কথা। তোমায় তিনি কৃপা করেছেন যখন, তখন তুমি আমার যে কত প্রিয় হয়েছো, তা আমি বোঝাতে পারবো না।” এইবলে নিত্যানন্দ মাধাইকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। তখন মাধাইয়ের অন্তর শান্ত হলেন। মাধাই বললেন, কিন্তু, প্রভু আমার যে অনেকের কাছে অনেক অপরাধ জমা আছে। তার কি হবে? আমি তো তাদের সকলকে চিনিও না। ভুলে গেছি কারা তারা। কি করে তাদের কাছে আমি ক্ষমা চাইবো? আমি বহু বহু পাপ করেছি এতদিন ধরে। কি করে সেই অপরাধবোধ যাবে আমার?”
তখন নিত্যানন্দ বললেন, বেশ, তবে এক কাজ করো। তুমি প্রতিদিন গঙ্গারঘাটে গিয়ে মার্জন করবে ঘাঁট। যারা স্নান করতে আসবে তাদের যতটা সম্ভব সেবা করবে। তারা স্নান করে উঠলে তাদের প্রণাম জানিয়ে ক্ষমা চাইবে। প্রসন্ন হয়ে তারা তোমায় আশীর্বাদ করবে কল্যাণ হোক বলে, তাতেই তোমার পাপস্খলন হবে, অপরাধবোধ চলে যাবে। হৃদয় প্রশান্ত হবে। এই আকুলতা দূর হবে।
নিত্যানন্দের দেখানো পথেই এখন জগাই-মাধাই আচরণ করেন। সকলের চরণ ধরে প্রার্থনা করেন- “জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যত পাপ করেছি আপনার প্রতি, ক্ষমা চাইছি সবের জন্য। আপনি ক্ষমা করুন এই জীবাধমকে, এই পতিতকে। এ নরাধম ভিক্ষা মার্জনা চাইছে আপনার থেকে।” তাঁদের ক্রন্দন দেখে আর অনুরোধ শুনে ঘাটে আগত স্নানার্থীদের চোখেও জল এসে যেত। তাঁরাও নয়নাশ্রু ফেলে ক্ষমা করে দিতেন। আবেগে তাঁদের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যেত জগাই-মাধাইয়ের বিনয় দেখে।
প্রেমিক সুজন জগাই-মাধাই কঠোর থেকে কঠোরতম ভজনে মগ্ন হলেন। ব্রহ্মচারী বলে তাঁরা খ্যাত হলেন। তাঁরা কোদাল চালিয়ে মাটি কেটে গঙ্গার ঘাট বানালেন। এখনও সে স্থান দর্শন হয়। ‘মাধাইয়ের ঘাট’ নামে প্রসিদ্ধ সে ঘাট, নিত্যানন্দের করুণাগুণে তাঁরা চৈতন্যচরণ পেয়েছেন। গৌরাঙ্গের পতিত পাবন লীলার মহাপ্রমাণ হলেন তাঁরা। নিতাইয়ের কৃপাপাত্র এই দুই ভাগ্যবান ভ্রাতারা আসলে শ্রীনারায়ণের ধাম বৈকুন্ঠের দুই দ্বারপাল ‘জয়’ ও ‘বিজয়’। সনকাদি মুনির অভিশাপে দুর্বৃত্ত হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধরণীতে। “বৈকুন্ঠে দ্বারপালৌ যৌ জয়াদ্য বিজয়ান্তকৌ। তাবাদ্য জাতৌ স্বেচ্ছাতঃ শ্রীজগন্নাথ-মাধবৌ।” (গৌ.গ.দি.-১১৫)
নিত্যানন্দ চেয়েছিলেন প্রাকৃত মদ্যপান করে যেমন অস্পৃশ্যরা উন্মত্ত হয়, তেমন মদ্যপ জগাই-মাধাই প্রেমভক্তিসুধা পান করে পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হোক, কীর্তন করুক, নৃত্য করুক আবেশে, ভজন পরায়ণ হোক,সকলের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হোক গৌরকৃপাপাত্র হবার——সে ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রকৃত অর্থেই। মহা ভাগবত, ভজনানন্দী হয়েই সারাটা জীবন কাটালেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দর্শনেই মানব পাপমুক্ত হত, কৃপা প্রাপ্ত হত।
ওহে প্রেমিকসুজন দুই ভ্রাতা ‘শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই’ , কৃপা করুন যাতে নিরবধি নিতাইচরণ চিন্তা করতে পারি, চৈতন্য কৃপার যোগ্য পাত্রী যেন হতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণে অনন্ত অর্বুদ কোটি প্রণাম এ জীবাধমার।
—– (সংকলিত), গ্রন্থ — ‘মহাপ্রভুর মধুময় কথা’, লেখিকা–রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক,

Share This