Categories
প্রবন্ধ

সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, প্রখ্যাত গান্ধীবাদী নেতা ও গঠনমূলক সেবাকার্য ও পল্লীউন্নয়নের বিভিন্ন পদ্ধতির আবিষ্কারক।

সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত (১৪ জুন ১৮৮০–২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯) হলেন একজন রসায়নবিদ ও প্রখ্যাত গান্ধীবাদী নেতা।

জন্ম ——
সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তর ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুন বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পূর্ণচন্দ্র দাশগুপ্ত ও মাতা বিজয়লক্ষ্মী দেবী। পিতা-মাতার আদর্শে ও প্রেরণায় তাঁর জীবন গঠন।
শিক্ষা জীবন——
কুঁড়িগ্রামে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কলকাতায় আসেন। প্রথমে রিপন কলেজ বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ। স্নাতকোত্তর শ্রেণীর রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময়ই একাগ্রচিত্ত কর্মনিষ্ঠ ছাত্রটির প্রতি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় এবং ছাত্রটিও আচার্যের চিন্তা ও জীবনচর্চায় প্রভাবান্বিত হন।
গান্ধীদর্শন——

বেঙ্গল কেমিক্যালে সতীশচন্দ্রের ব্যস্ততার মাঝে তখন একদিকে নতুন নতুন উদ্ভাবনা তথা সন্ধানের চিন্তা আর অন্যদিকে অন্তহীন জিজ্ঞাসা – দরিদ্র দেশবাসীর সমস্যার সমাধান কীভাবে? অশান্ত মনের এমন মানসিক অবস্থায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কোকনদ অধিবেশনের শিল্পপ্রদর্শনীতে যোগ দিতে গিয়ে প্রথম গান্ধী দর্শন হল তার। বেঙ্গল কেমিক্যালে গবেষণা ছেড়ে গান্ধীজির নির্দেশিত স্বরাজের পথে সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার আন্তরিক বাসনা ব্যক্ত করেন। কিন্তু গান্ধীজির উপদেশ মত বেঙ্গল কেমিক্যালে থেকে গবেষণা ও উদ্ভাবনের কাজ চালিয়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও তার ফসল গরীব দেশবাসীর পর্ণকুটিরে পৌঁছেছেন দিতে লিপ্ত হলেন। সতীর্থদের উদ্বুদ্ধ করে কর্মীদের দিয়ে চরকায় সুতা কাটানো, তাঁত চালানো ও কাপড় বোনার কাজ শুরু করলেন। আচার্য আর দুই শিষ্য মিলে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেন খদ্দরের উপর রং প্রণালী নিয়ে। বিজ্ঞানের গবেষণাগার তখন চরকা ও কুটির শিল্পের গবেষণাগারে ও কর্মশালায় পরিণত হল।

খাদি প্রতিষ্ঠান ——–
কিন্তু তাতেও তার মনের তৃপ্তি মিলছে না যখন, গান্ধীজির কাজে তিনি সপরিবারে রাতের অন্ধকারে বেঙ্গল কেমিক্যালের বাসভবন ছেড়ে চলে গেলেন সোদপুরে। ‘ফায়ারকিং’ আবিষ্কারক-বিজ্ঞানীর প্রাপ্য দু’লক্ষ টাকা দিয়ে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তুললেন ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’। ঘরে ঘরে চরকা পৌঁছে দিতে স্বল্প মূল্যের বাঁশের চরকা তৈরি করেন। বাংলার বিভিন্ন স্থানে কর্মকেন্দ্র স্থাপন করে বহুমুখী কর্মযজ্ঞের সূচনা করলেন। কুটির শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণা করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানে কটেজ ট্যানিং ইন্ডাস্ট্রি এক সময় বড়ো বড়ো ট্যানারির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছে। নিরক্ষর ও অল্পশিক্ষিত মানুষকে লেখাপড়া শিখিয়ে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে দক্ষকর্মীরূপে গড়ে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। প্রধান কর্মকেন্দ্র কলকাতার নিকটবর্তী সোদপুরের আশ্রমটি গান্ধী আশ্রম নামে পরিচিত হল। এর উদ্বোধনে মহাত্মা গান্ধী,মতিলাল নেহেরু ছাড়া সেকালের জাতীয় স্তরের বিখ্যাত ব্যক্তি হাজির ছিলেন। গান্ধীজী এই আশ্রমকে তার ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ তথা ‘বাংলার বাসগৃহ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সোদপুরের গান্ধী আশ্রম সেই সময় দেশের রাজনীতিকদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল। সতীশচন্দ্র গান্ধীজির অনুগামী হয়ে কারাবাসও করেছেন। আলিপুর জেলে অবস্থানকালে স্বেচ্ছায় সেখানে গোশালা রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব পালন করেন। তবে স্বাধীনতা উত্তরকালে আমৃত্যু রাজনীতি থেকে দূরে থেকে সংগঠনমূলক কাজ করে গেছেন ।

গবেষক লেখক সতীশচন্দ্র – নিজের অধীত বিদ্যায়, জ্ঞানে ও উদ্ভাবনে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন – তার রচিত দু’টি খণ্ডে প্রকাশিত ‘দি কাউ ইন ইন্ডিয়া’পরবর্তীকালে ভেটেরিনারি কলেজের পাঠ্যপুস্তক হিসাবে নির্বাচিত হয়। ব্যাধিজড়িত দরিদ্র দেশবাসীর জন্য লেখেন ‘হোম অ্যান্ড ভিলেজ ডক্টর’ গ্রন্থটি। তার অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থগুলি হল-
‘খাদি ম্যানুয়েল’
‘কটেজ অ্যান্ড ম্যাচ ফ্যাক্টরি’
‘ফাউন্টেন পেন ইন্ক’
‘বোন মিট ফার্টিলাইজার’
‘গোবর গ্যাস প্ল্যান্ট’
‘হ্যান্ড মেড পেপার’
‘ক্রোম ট্যানিং ইন কটেজেস’
এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য রচিত ও অনূদিত গ্রন্থসমৃহ হল-
‘রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী’
‘গান্ধীভাষ্য গীতা’
‘জীবনব্রত ও গান্ধীবাদ’
‘বিলাতে গান্ধীজী’
‘ভারতের সাম্যবাদ’
‘কুটির চর্মশিল্প’
‘রামচরিত মানস’
‘সংযম বনাম স্বেচ্ছাচার’
‘শিক্ষা ও সেবা’
‘বস্তির গল্প’
‘হিন্দু স্বরাজ্য'(অনূবাদ)
‘গান্ধীজীর আত্মকথা’ (গুজরাটি ভাষা থেকে অনূদিত)
দীর্ঘকাল তিনি ‘রাষ্ট্রবাণী’ নামে ইংরাজী ও বাংলা ভাষায় দু’টি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনা করেছেন।

সম্মাননা——
সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন নিরলস সাধনায় বিস্ময়কর প্রতীক – দেশবাসীর স্নেহলাভে বঞ্চিত হননি এবং সেটিই ছিলো তাঁর সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি আর সম্মান। অবশ্য আজীবন গঠনমূলক সেবাকার্য ও পল্লী উন্নয়নে বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ-পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে যমুনালাল বাজাজ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। ওই বৎসরেই তিনি বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মান সূচক ডি.এসসি উপাধিতে ভূষিত হন।
মৃত্যু——–
জীবনের শেষ লগ্নে বন্ধ্যা-জননীর কোলে গোগড়া কৃষি খামারে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে ডিসেম্বর সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত প্রয়াত হন।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *